
আধুনিক মুদ্রা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনছে বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রা। ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল বাস্তবতায় অন্তত দুই হাজার প্রতিষ্ঠান এসব মুদ্রার লেনদেন করছে। বেশ কয়েকটি দেশে এসবের প্রচলন শুরু হলেও বাংলাদেশ এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। তবে দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন হচ্ছে বলে জানা গেছে। ভার্চুয়াল মুদ্রা লেনদেনকারীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ; অভিযুক্ত করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছ থেকে তথ্য নিয়ে মানি লন্ডারিং আইনে অনুসন্ধান চালাচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি তারা।
ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো ভার্চুয়াল মুদ্রা যা ডিজিটাল ওয়ালেটে বা আইডির মাধ্যমে লেনদেন করা হয়। এই কারেন্সির লেনদেনের তথ্য ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। ব্লকচেইন তথ্য সংরক্ষণের একটি ডিজিটাল পদ্ধতি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি তথা চেইনের মতো করে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এসব মুদ্রার লেনদেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে থাকে না। ব্যবহারকারীরা পরিচয় প্রকাশ না করে সরাসরি লেনদেন করে।
গত বছরের মে মাসে বিটকয়েন লেনদেনের অভিযোগে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা থেকে ১২ জনকে আটক করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে ২৯টি কম্পিউটার, ৩টি ল্যাপটপ, ১৫টি মোবাইল ফোন এবং নথিপত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করে। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেপ্তার সুমন বাড্ডায় ৩২ জন কর্মচারী নিয়ে বিটকয়েনের ব্যবসা করেছে। সে ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাটসহ প্লট ও সুপার শপের মালিক হয়েছে।
বলা হয়, এই ১২ জন দেশের সবচেয়ে বড় বিটকয়েনের লেনদেনকারী গ্রুপ। র্যাব দাবি করে, তদন্তে গ্রুপটির বিটকয়েন লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য জানা গেছে। এরপর বাড্ডা থানায় করা র্যাবের মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। এখনো তদন্ত শেষ করতে পারেনি সিআইডি ঢাকা মেট্রো উত্তর।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, তদন্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফরেনসিক রিপোর্ট। জব্দ করা ডিভাইসগুলো সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠানোর পর এখনো ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। ফলে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
একই মামলায় মানি লন্ডারিং আইনে অনুসন্ধান করছে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। তবে এখনো তারা মামলা দায়ের করতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা জানায়, এখন পর্যন্ত দুটি ভার্চুয়াল ওয়ালেটের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এগুলোতে কী পরিমাণ লেনদেন হয়েছে তা প্রমাণ করার উপায় তাদের জানা নেই। অভিযুক্তরা নিজেদের মধ্যে বিটকয়েন লেনদেনের বিষয়ে যেসব বার্তা আদান-প্রদান করেছে তাও মামলা করতে সহায়ক হবে। মানি লন্ডারিং আইনে ওয়ালেটের লেনদেনের তথ্য ছাড়া মামলা দুর্বল হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন না করায় এর তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে ওয়ালেট দেখিয়ে চার্জশিট করা ছাড়া বিকল্প নেই।
ভার্চুয়াল কারেন্সি লেনদেনের অন্য ঘটনাগুলোর অনুসন্ধান শুরু করেছে ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। তবে অনুসন্ধান শেষ করে মামলা দায়ের করতে পারেনি তারা। সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিটকয়েন লেনদেনের একটি মামলার অনুসন্ধান প্রায় শেষের দিকে। শিগগির মামলা দায়ের করে বিস্তারিত তদন্ত শুরু করা হবে।
পুলিশের অন্য ইউনিটগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের অভিযোগে ২৮ জনের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইউনিটে মামলার তদন্ত চলছে। অধিকাংশ মামলার তদন্তই ফরেনসিক প্রতিবেদন না পাওয়ায় আটকে আছে। ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত শেষ করেছে। কেবল ওয়ালেট শনাক্ত করেই আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে তারা। এ বিষয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মত জানা যায়নি।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্লকচেইননির্ভর মুদ্রা লেনদেন অনেক বেড়েছে। ভার্চুয়াল মুদ্রার মাধ্যমে অপরাধীরাও লেনদেন করছে। প্রযুক্তির নতুন এই বিষয় নিয়ন্ত্রণে পুলিশের দক্ষতা নেই বললেই চলে, তাই যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না। প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ডিভাইস ছাড়া এসব মামলার তদন্ত বা অনুসন্ধান গতি পাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, পুলিশের উচিত বিটকয়েনের মতো মাধ্যম ব্যবহার করে অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধে আলাদা টিম করা, যারা এসব বিষয়ে প্রযুক্তিতে দক্ষ হবে। অর্থ পাচারের বিষয়ে যারা অনুসন্ধান করছে তাদেরও প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ডিভাইস দেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, পুলিশ শুধু ওয়ালেট শনাক্ত করেই তদন্ত শেষ করছে। নিজেরা দক্ষ হয়ে উঠতে না পারলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তাদের উচিত যারা এসব বিষয়ে এক্সপার্ট তাদের সহযোগিতা নেওয়া।
ফরেনসিক পরীক্ষায় সিআইডির সক্ষমতা রয়েছে বলে দাবি করে সিআইডির ফরেনসিক শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার ড. মো. নাজমুল করিম খান গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি সংশ্লিষ্ট মামলার ফরেনসিক পরীক্ষার সক্ষমতা আমাদের আছে। তবে কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষা করছি তা গোপনীয়। আমাদের কাছে আসা ক্রিপ্টোকারেন্সি সংক্রান্ত মামলার রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছি। কোনো রিপোর্ট ঝুলে নেই।
বছরের শুরুতে একটি গোয়েন্দা সংস্থার ক্রিপ্টোকারেন্সি সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠায় পুলিশ সদর দপ্তরে। তাতে পুলিশের সাইবার ইউনিট এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার সংগ্রহের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
চিঠিতে বিটকয়েনের ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে নির্দেশনার পাশাপাশি বিটকয়েনের প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞানলাভে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে বলা হয়।
তখন পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের সঙ্গে সিআইডির কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠক করেছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তারা প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেবে। তবে নজরদারির সরঞ্জামাদির দাম অনেক বেশি হওয়ায় এখনই তা কেনা হবে না। এ ছাড়া ডার্কওয়েব ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশকে তিন বছরের প্রশিক্ষণ দেবে বলেছে। এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত উদ্যোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালে বিটকয়েনের মতো কৃত্রিম মুদ্রায় লেনদেন করা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। এর পরেও সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে তারা।
ক্রিপ্টোকারেন্সিকে একেবারে নাকচ না করার ব্যাপারে কথাবার্তা চলে সংস্থাগুলোর মধ্যে। সরকারের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি ডিভিশন ২০২০ সালের মার্চে ন্যাশনাল ব্লকচেইন স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করে। কৌশলপত্রে তারা বলে, ব্লকচেইন স্টার্টআপে ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। ভবিষ্যতে এটা বাড়তে পারে। বাংলাদেশি সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটা একটা সুযোগ। ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকায় বাংলাদেশের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না।
স্ট্র্যাটেজিতে বলা হয়, যথাযথ প্রযুক্তি, আইন ও নীতিকাঠামোর অভাবে এ ধরনের ডোমেইন দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পথ উন্মুক্ত করে দিতে পারে। এই উভয় সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে ভাবা উচিত।
গত বছর একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে সিআইডি অভিমত চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ জবাবে বলে, ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিকানা, সংরক্ষণ বা লেনদেন স্বীকৃত না হলেও এটিকে অপরাধ বলা যায় না। তবে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর আওতায় অপরাধ গণ্য হতে পারে।
১০ নম্বর জার্সির এই যে বিশেষত্ব তার একটি গল্প আছে এবং সেটা পেলেকে ঘিরেই। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে অনাকাক্সিক্ষতভাবে ১০ নম্বর পেয়ে যান ১৭ বছরের পেলে। ওই জার্সি গায়ে পুরো বিশ্বকাপ মাতিয়ে দেন। এরপর থেকে এই ১০ নম্বরের মহিমা বেড়ে যায়। ফুটবলে ১০ নম্বরের অর্থ দাঁড়ায় বিশেষ দ্যুতি ও সৃজনশীলতা। আর এই শুরুটা হয় সুইডেন বিশ্বকাপে পেলের পারফরম্যান্সের পরই। অথচ পেলে নিজেই বলেছিলেন এই জার্সি তার গায়ে ওঠার কথাই ছিল না। সাধারণ ১০ নম্বর যার জন্য ফুটবলে অসাধারণ হয়ে গেল সেই কিংবদন্তির বিদায়ে কাঁদছে ফুটবলাঙ্গন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুদে স্মরণিকায় ভরিয়ে তুলছেন ফুটবলের বাইরের লোকেরাও। বিশেষ মানুষদের ছাপিয়ে সংবাদমাধ্যম জনতার কাতারেও ছড়িয়ে পড়েছে শোক।
১৯৫৮ সুইডেন বিশ্বকাপে ব্রাজিল ফেডারেশন নম্বরবিহীন জার্সি পাঠিয়ে দেয় ফুটবলারদের জন্য। কিন্তু ১৯৫৪ বিশ্বকাপ থেকেই ফিফার নিয়ম জার্সিতে নম্বর থাকা চাই। তাই নম্বরহীন জার্সি নিয়ে বিপাকে পড়ে ব্রাজিল। ওই সময় ফিফার কোনো এক কর্মকর্তা ত্বরিত ব্রাজিল ফুটবলারদের জার্সি নম্বর ঠিক করে দেন। তাতে পেলের কাছে পড়ে ১০ নম্বরটি। এই ঘটনা অনেক বছর পর প্রকাশ্যে আসে। ওই সময় প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া ১৭ বছরের তরুণ পেলে অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ভাবিনি এই জার্সি আমি পাব। কারণ জানতাম এটা দলে বয়সী বা অভিজ্ঞ কেউ পরে থাকেন। নবাগতরা ১০ নম্বর কখনই পরেন না।’ এ যেন ভবিতব্য। সেবার বিধাতা লিখেই রেখেছিলেন ১০ নম্বর উঠবে পেলের গায়ে। এরপর পেলের নামে ১০ আলোকিত হয়ে উঠবে ফুটবলে।
সেই পেলে বৃহস্পতিবার রাতে ফুটবলের পৃথিবীকে আঁধার করে দিয়ে ৮২ বছর বয়সে চলে গেলেন পরপারে। কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত পেলে অনেক দিন ধরেই হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে হারলেন সেই যুদ্ধে। ব্রাজিল কিংবদন্তির বিদায়ে মনে পড়ে ১৯৭৭ সালে মৃত্যু নিয়ে তার করা উক্তি, ‘পৃথিবীতে সবকিছুই একটি খেলা। একটি ক্ষণস্থায়ী জিনিস। আমরা সবাই মৃত। আমরা সবাই একরকম, তাই না?’ ১০ নম্বর জার্সির মতো তার নামের নামকরণটাও চমকপ্রদ। পেলের আসল নাম এডসন আরান্তেস ডু নাসিমেন্তো। তবে ফুটবল মাঠেই কোনো একসময় তার সতীর্থ ‘বেলে’ নামের গোলরক্ষককে ডাকতে গিয়ে ভুলে তাকে পেলে ডেকেছিল কেউ। এরপর থেকেই পেলে নাম ছড়িয়ে পড়ে তার। নিজের নাম নিয়ে মৃত্যুর ব্যাপারে তার আরেকটি উক্তি ছিল এমন, ‘পেলে মরে না। পেলে কখনই মরবে না। পেলে চিরজীবী থেকে যাবে। কিন্তু এডসন একজন সাধারণ মানুষ, যে একদিন মারা যাবে। আর মানুষ তাকে ভুলে যাবে।’
পেলে ভুল বলেছেন। বিশ্ব তার বিদায়ে যেভাবে ফেটে পড়েছে, তাকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। ইতালিয়ান সংবাদমাধ্যম যেমন পেলেকে ইতিহাস, ঈশ্বর বলেছে। পেলের সতীর্থ ৯১ বছর বয়সী মারিও জাগালো আবেগঘন বার্তায় সতীর্থকে মনে রাখার কথাই বললেন, ‘সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ পেলে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। যে কিনা ১০ নম্বর জার্সিকে সম্মানিত করেছে। যে আমাদের সম্মানিত করেছে, সে চলে গেল। তুমি যেমন হাসিমাখা মুখে বিদায় নিলে আমিও তোমাকে হাসিমাখা মুখে আমার সঙ্গে রাখব। তুমি অবিনশ্বর।’ রোনালদো আরও একটু এগিয়ে লিখেছেন, ‘পেলে একজনই। সে সবসময়ই বিরাজমান। শীর্ষস্থানটা ধরে রেখে সে আজ আমাদের ছেড়ে গেল।’
এ ছাড়া পেলেকে লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নেইমারসহ পুরো বিশ্বের সাবেক ও বর্তমান ফুটবলাররা স্মরণ করছেন নিজেদের শব্দে। ক্রীড়াক্ষেত্রের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘ফুটবলের বাইরে আর কোনো খেলায় বিশ্বকে এক করা যায় না। এই একটি খেলার জন্য খুব কঠিন অবস্থা থেকে পেলের উঠে আসা শোনার মতো গল্প। আজ তার বিদায়ে আমি এবং আমার পরিবার গভীর শোকপ্রকাশ করছি।’ সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পেলের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘ফুটবলে পেলে অন্যতম সেরা একজন। খেলাই যে বিশ্বের মানুষকে একসুতোয় বাঁধতে পারে তা তিনি বুঝেছিলেন।’
শুধু উঁচু স্তরের নয়। ব্রাজিলে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোকে সমবেদনা জানিয়ে দেশটির জনগণ পেলেকে স্মরণ করেছেন। বিশ্বের সকল ফুটবলপ্রেমী নিজেদের মতো পেলেকে স্মরণ করছেন। ঠিক যেমন দুই বছর আগে ডিয়াগো ম্যারাডোনার বিদায় স্মরণীয় হয়ে আছে।
আকাশের ঠিকানায় চিঠি হয়তো লেখা যায়, কিন্তু কোনো ডাকপিওন সেই চিঠি ওপারে পৌঁছে দেয় না। বছর দুয়েক আগে ডিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর যে খোলা চিঠি লিখেছিলেন পেলে, সেটা নিজেই বোধহয় নিয়ে গেলেন হাতে করে। মর্ত্যে কখনো আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর আর ফুটবলের রাজাকে একই দলে সতীর্থ হয়ে খেলতে দেখা যায়নি। স্বর্গে নিশ্চয়ই দেশের সীমানা, রাজনীতি এসব কিছু নেই। ওপারে নিশ্চয়ই একই জার্সিতে খেলবেন পেলে আর ম্যারাডোনা।
বছর দুই আগে, নভেম্বরের ২৫ তারিখে ধুলোর পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর। তার ধরাধামে আগমনের আগেই ফুটবলের রাজা সিংহাসনে বসে গেছেন ১৯৫৪’র বিশ্বকাপে। ম্যারাডোনা পৃথিবী ছাড়লেন ২০২০ সালে, পেলে আরেকটু বেশি দিন বাঁচলেন। দুজনের খেলোয়াড়ি জীবনের সেরা সময়ে কেউই একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না, তবুও দুজনের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তুলনা হয়েছে প্রতিনিয়ত। দুজনের সম্পর্কে তিক্ততাও ছিল একটা সময়ে। একই সময়ে দুজনেরই আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়। দুজনেই দুজনের আত্মজীবনীতে অন্যকে নিয়ে বেশ বিরূপ কথাবার্তাই লিখেছেন। ম্যারাডোনা লিখেছিলেন যে, পেলের সঙ্গে সান্তোসের এক কোচের সমকামী সম্পর্ক আছে। অন্যদিকে পেলে আজীবন খেলায় মাদকের প্রভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন; ম্যারাডোনার মাদক গ্রহণের ব্যাপারে পেলে বলেছিলেন যে, এসব ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উৎসাহিত করে। সব মিলিয়ে দুজনের ভেতর সম্পর্কে একটা তিক্ততা থাকলেও পরে বরফ গলে এবং দুজনেই বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন।
ম্যারাডোনার মৃত্যুর দিন সাতেক পর বন্ধুকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখেছিলেন পেলে। হৃদয়ের অনুভূতিগুলো শব্দের অক্ষরে হয়ে উঠেছিল এক বিয়োগগাথা; পেলে লিখেছিলেন, ‘তুমি নেই সাত দিন হয়ে গেল। সারাটা জীবন অনেকেই আমাদের তুলনা করে গেছে। তুমি ছিলে এক প্রতিভা, যার দ্যুতিতে বিমোহিত ছিল গোটা বিশ্ব। তুমি ছিলে বল পায়ে এক জাদুকর, সত্যিকারের কিংবদন্তি। তবে সবকিছুর ওপরে তুমি ছিলে আমার খুব কাছের বন্ধু। একজন বড় হৃদয়ের মানুষ।
আজকে আমি জানি, পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতে পারত যদি আমাদের দুজনকে নিয়ে এত তুলনা না হতো আর আমরা পরস্পরকে আরও বেশি শ্রদ্ধা করতে পারতাম। আমি শুধু এতটুকুই বলতে চাই, তোমার কোনো তুলনা হয় না।
তোমার ক্যারিয়ারজুড়ে ফুটবল খেলেছ বিশুদ্ধ আবেগ দিয়ে। আর তোমার মতো করে, তোমার পন্থায় তুমি আমাদের শিখিয়েছ প্রতিটা দিন কী করে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলতে হয়। তুমি আগেভাগেই চলে গেলে, তাই আমাকে কথাটা বলার সুযোগ দিলে না। আজ বলছি, ডিয়েগো তোমায় অনেক ভালোবাসি।
হে আমার প্রিয় বন্ধু, জীবনের এই যাত্রায় পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। একদিন স্বর্গে নিশ্চয়ই আমরা একই দলের হয়ে খেলব। আর সেদিনই আমি গোল না করেও হাত উঁচিয়ে উদযাপন করব। কারণ সেদিনই যে আমি অবশেষে তোমাকে আবার জড়িয়ে ধরতে পারব।’
সেই দিনটা এসেই গেল অবধারিত ভাবে। সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে পেলে ভর্তি হয়েছিলেন বেশ কিছুদিন আগে, ডাক্তাররা শেষ চেষ্টা করছিলেন। কিছুদিন আগে পেলের পরিবারের সব সদস্য দেখা করেন তার সঙ্গে, বড়দিনের দিন সবাই ছিলেন হাসপাতালে। পেলের মেয়ে কেলি নাসিমেন্তোর ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট এর পোস্টগুলো থেকেই জানা যাচ্ছিল, সবাই আসলে তৈরি হচ্ছিলেন ফুটবলের রাজার অন্তিম যাত্রার জন্য।
পেলের নশ্বর দেহ পড়ে থাকবে মর্ত্য,ে তার আত্মা নিঃসন্দেহে পৌঁছে গেছে স্বর্গলোকে। ৮২ বছরের দীর্ঘ জীবনে পেলে অনেককেই দেখেছেন পৃথিবীর অধ্যায় শেষ করে অনন্তলোকে পাড়ি জমাতে। ইয়োহান ক্রুইফ না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর পেলে শোক প্রকাশ করেছিলেন এভাবে, ‘ইয়োহান ক্রুইফ ছিল অসাধারণ এক খেলোয়াড় এবং কোচ। আমাদের ফুটবল পরিবারে সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছে। আমরা অসাধারণ এক মানুষকে হারিয়েছে। আমরা যেন তার উৎকর্ষতার উদাহরণ মেনে চলতে পারি।’ পর্তুগাল কিংবদন্তি ইউসেবিওর মৃত্যুর পর পেলে লিখেছিলেন, ‘ইউসেবিও ছিল আমার ভাইয়ের মতো, তার মৃত্যুতে খুবই শোকাহত।’
অনন্তলোকে গিয়ে নিশ্চয়ই ম্যারাডোনার পাশাপাশি ক্রুইফ, ইউসেবিও সবাইকে নিয়েই একসঙ্গে খেলবেন পেলে। কী দারুণ একটা দলই না হবে সেটা! হাফটাইমে নিশ্চয়ই পেলে তাদের শোনাবেন এক খুদে জাদুকরের বিশ্বকাপ জেতার গল্পটা। কারণ এই কিংবদন্তিদের কেউই তো লিওনেল মেসিকে বিশ্বকাপ জিততে দেখে যেতে পারেননি। ম্যারাডোনা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন, আর্জেন্টিনাবাসী কি ভুলে গিয়েছে ডিয়েগোকে? পেলে হয়তো তখন বলবেন ‘না, মেসির মাঝেই তারা খুঁজে নিয়েছে তাদের প্রিয় ডিয়েগোকে।’
স্বর্গ থেকেই ফুটবলের দেবতা হয়তো এসেছিলেন মর্ত্য,ে পেলের বেশ ধরে। তিনিই ফিরে গেলেন অনন্তলোকে। পেছনে পড়ে রইল তিনটা বিশ্বকাপ আর কত স্মৃতি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসানকেই দেশের ইতিহাসের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে বাছাই করেছে ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়ালেখকদের প্রাচীন সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসপিএ)। গতকাল সংগঠনটি দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় বিএসপিএ’র ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা-উত্তর সেরা দশ ক্রীড়াবিদের তালিকা ঘোষণা করে। ৯ সদস্যের স্বাধীন বিচারক প্যানেল নাম্বারিংয়ের ভিত্তিতে সেরা ১২০ জন ক্রীড়াবিদের মধ্য থেকে ১০ জন মনোনীত করেন। সেখান থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন বাংলাদেশ টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক সাকিব। বিএসপিএ সভাপতি সনৎ বাবলার সবাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মনোনীত ১০ জনের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। এ সময় গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্রীড়াসাংবাদিকদের এশিয়ান সংস্থা এআইপিএস এশিয়ার সভাপতি হি ডং জং এবং পৃষ্ঠপোষক বসুন্ধরা গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা ও বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসান। একই মঞ্চে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ক্রিকেট ব্যাটে জয় বাংলা লিখে মাঠে নামা রাকিবুল হাসানকে দেওয়া হয় বিশেষ সম্মাননা। এছাড়া ১০ জন জ্যেষ্ঠ ক্রীড়াসাংবাদিককে দেওয়া হয় সম্মাননা। মনোনীত ১০ ক্রীড়াবিদ ও ১০ ক্রীড়াসাংবাদিককে স্মারক ছাড়াও দেওয়া হয়েছে অর্থ পুরস্কার।
সদ্য প্রয়াত ফুটবলের রাজা পেলের প্রতি সম্মান জানাতে নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। এরপর একে একে পুরস্কৃত করা হয় ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিদের। স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিচারক প্যানেল চুলচেরা বাছাই বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করেছেন বাংলাদেশের সেরা ১০ ক্রীড়াবিদ। ক্রম অনুসারে মনোনীত শীর্ষ ১০ ক্রীড়াবিদ হলেন গলফার সিদ্দিকুর রহমান (দশম), সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান (নবম) স্প্রিন্টার প্রয়াত শাহ আলম (অষ্টম), শুটার আসিফ হোসেন খান (সপ্তম), ক্রিকেটার মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা (ষষ্ঠ), বক্সার মোশাররফ হোসেন (পঞ্চম), ফুটবলার প্রয়াত মোনেম মুন্না (চতুর্থ), দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদ (তৃতীয়), ফুটবলার কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (দ্বিতীয়) ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান (প্রথম)।
বিশেষ সম্মাননাপ্রাপ্ত জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক রাকিবুল হাসান তার সম্মাননা উৎসর্গ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের। এ ছাড়া প্রাপ্ত অর্থ পুরস্কার তিনি গ্রামের সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে দেওয়ার কথা বলেন। চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের ক্রীড়া সম্পাদক দিলু খন্দকার বলেন, ‘চল্লিশ বছরে ক্যারিয়ারে প্রথম স্বীকৃতি পেলাম। সাংবাদিকরাও যে সম্মানিত হতে পারেন, সেটাই এই মঞ্চে প্রমাণিত হলো।’
অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত হয়ে বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসান বলেন, ‘৬০ বছর পূর্তিতে আমরা অংশীদার হতে পেরে সম্মানিত হতে পেরেছি। এই সংগঠনের দীর্ঘ চলাটা সৌভাগ্যের। আমরা সৌভাগ্যের সাক্ষী। ক্রীড়াসাংবাদিকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। গণমাধ্যম খেলাধুলাকে সবার সামনে তুলে ধরে। খেলার ইতিহাসের নির্মাতা আপনারা। মূল পৃষ্ঠপোষকও আপনারাই। খেলোয়াড়দের আপনারাই তারকা বানান। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াও আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারি। আপনারা যেহেতু ফুটবল নিয়ে লেখেন, তৃণমূলের ফুটবল উঠে আসে না আপনাদের লেখনীতে। অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত থাকে, যা আমাদের কষ্ট দেয়। আশা করছি আপনারা তৃণমূলে দৃষ্টি দেবেন। সাধারণ মানুষের ভালোবাসার খেলা ফুটবল। যে ১০ জন সম্মানিত হয়েছেন, তারা স্বমহিমায় সেরা হয়েছেন। এদের মাধ্যমেই এদেশের ক্রীড়াঙ্গন সমৃদ্ধ হয়েছে।’
এআইপিএস এশিয়া সভাপতি হি ডং জং বলেন, ‘৬০ বছর একটা সংগঠনের বয়স। এটা বিশাল একটা ব্যাপার। আমার মনে হয় এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সংগঠন বিএসপিএ এবং অবশ্যই অন্যতম সেরা সদস্য। তারা ওয়েলফেয়ারে যেভাবে ক্রীড়াসাংবাদিকদের জন্য কাজ করছে, তা হতে পারে অনুকরণীয়। আমি সত্যিই অভিভূত এরকম আয়োজনের অংশ হতে পেরে। সব পুরস্কারপ্রাপ্তকে জানাই অভিনন্দন।’ প্রধান অতিথি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ‘অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি বিএসপিএকে। তারা শুধু উদযাপন করছে না। তারা তাদের জ্যেষ্ঠ ক্রীড়াসাংবাদিক ও ক্রীড়ালেখকদের সম্মানিত করছে। একই সঙ্গে আমাদের ক্রীড়াবিদদেরও সম্মান জানাচ্ছেÑ যা আপনাদের এই উদযাপন নতুনমাত্রা পেয়েছে। আমি আগেও আপনাদের নানা অনুষ্ঠানে এসে মুগ্ধ হয়েছি। আপনারা সবসময় আমাকে পাশে পাবেন।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে ঢাকায় বিএনপির গণমিছিল কর্মসূচির জবাবে শান্তি সমাবেশ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গতকাল শুক্রবার ঢাকার ৯টি স্থানে এই কর্মসূচি পালন করে দলটি।
শ্যামলীতে আয়োজিত শান্তি সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সতর্ক আছে। আমরা কোনো ধরনের সহিংসতায় জড়াব না। তবে আঘাত করা হলে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।’
বিকেল পৌনে ৪টায় প্রধান অতিথি ওবায়দুল কাদের শান্তি সমাবেশে যোগ দেন। তখন নেতাকর্মীদের অবস্থান গাবতলীমুখী মিরপুর সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তাদের নিরাপত্তার জন্য মাইক থেকে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখতে অনুরোধ করা হয়। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে গাবতলীমুখী সড়কে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট, যা পুরো নিউমার্কেট পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। বিকেল ৪টা ২০ মিনিটের পর যান চলাচল শুরু হয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুক্তি চেয়ে প্রবীণ রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ ৬০ বিশিষ্টজনের বিবৃতির সমালোচনা করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘ফখরুলের মুক্তি চায়, ভালো। ফখরুল তাদের বন্ধু। তাদের শুভাকাক্সক্ষী। তিনি অসুস্থ আমরা জানি না।’ তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডে বিবৃতি দিয়েছিলেন নাকি জানতে চান ওবায়দুল কাদের।
জঙ্গিবাদ রুখতে হবে জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের রুখতে হবে। হাওয়া ভবনের লুটেরাদের রুখতে হবে। তারা (বিএনপি) বলে রাষ্ট্র মেরামত করবে। বিএনপি এই রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেছে। এই রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করেছে তারা। এই রাষ্ট্রে অর্থ পাচার করেছে বিএনপি। পাঁচ বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বিএনপি। তারা রাজনীতি নষ্ট করে। যারা নষ্ট রাজনীতি করে তারা রাষ্ট্র মেরামত করতে পারে না। ধ্বংস করতে পারে।’
শ্যামলী ছাড়াও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উত্তরা, ফার্মগেট, মহাখালী, গাবতলী, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর, বাড্ডা ইউলুপ, যাত্রাবাড়ী এলাকায় আয়োজিত শান্তি সমাবেশে যোগ দেন। দলটির সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ, যুব মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন এবং সমাবেশ করেন। ছাত্রলীগের উদ্যোগে শাহবাগ চত্বরে শান্তি সমাবেশ করা হয়।
বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে গতকাল দুপুর থেকে ঢাকার ৯টি স্থানে শান্তি সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এসব কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার নেতাকর্মীরা অংশ নেন। সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতাকর্মীরা। সেখানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
জুমার নামাজের পরপরই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে মিছিল নিয়ে নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হতে থাকেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে আয়োজিত শান্তি সমাবেশে যোগ দেন। ওই সমাবেশ আয়োজন করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মোহাম্মদপুর থানা শাখা। জুমার নামাজের পর খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন।
সমাবেশে ওবায়দুল কাদেরের আগে বক্তব্য দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি, সহসভাপতি সাদেক খান, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক রানা প্রমুখ।
আগামী ১১ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগ ও মহানগরে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গণঅবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে একই কর্মসূচি দিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট এবং ১১ দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ বর্তমান সরকারবিরোধী আরও কয়েকটি দল ও সংগঠন। গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে আলাদা আলাদাভাবে পালিত গণমিছিল কর্মসূচি থেকে এই গণঅবস্থানের ঘোষণা দেওয়া হয়।
ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা ৩৩টি রাজনৈতিক দলের যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি হিসেবে এই গণমিছিল কর্মসূচি পালন করা হয়। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও আরেক বিভাগীয় শহর রংপুরে গতকাল এই গণমিছিল বের করা হয়।
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গতকাল দুপুরে গণমিছিলপূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দলটির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের ১০ দফা দাবির প্রথম কর্মসূচি গণমিছিল। দ্বিতীয় কর্মসূচি হচ্ছে আগামী ১১ জানুয়ারি গণঅবস্থান কর্মসূচি। ঢাকায় এ কর্মসূচি নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে হবে। ঢাকা ছাড়াও সারা দেশে নয়টি বিভাগীয় শহরে একইভাবে চার ঘণ্টা গণঅবস্থান কর্মসূচি পালিত হবে। স্বৈরাচারী সরকারের পতন না ঘটানো পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আরও কর্মসূচি দেব আমরা।’
গণমিছিলে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। মনে করেছিল, ১০ ডিসেম্বরের আগে মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করলে বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাবে। যত গ্রেপ্তার, যত নির্যাতন হোক না কেন, রাস্তায় আমাদের নেতাকর্মী শুধু নয় জনগণ নেমে গেছে। আর তাদের দমানো যাবে না।’
দুপুর ২টায় গণমিছিল শুরুর ঘোষণা থাকলেও সকাল থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে থাকেন বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। হলুদ, লাল, বেগুনিসহ নানান সব রঙের ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শোডাউন করেন তারা। জমায়েত হওয়া নেতাকর্মীরা সেখানে জুমার নামাজ আদায় করেন। কাকরাইল মোড় থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত সড়কে কয়েক হাজার নেতাকর্মী অবস্থান নেয়। বিএনপির এই কর্মসূচি ঘিরে বিজয়নগরের নাইটিঙ্গেল মোড় ও ফকিরাপুল মোড়সহ আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে গণমিছিল শুরু হয়ে কাকরাইল ও মালিবাগ মোড় হয়ে মগবাজারে গিয়ে শেষ হয়।
শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ আমানের : বিএনপির গণমিছিলের সামনের অংশে থাকা নেতাকর্মীরা বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে মগবাজার মোড়ে এসে পৌঁছালে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান হ্যান্ডমাইকে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের গণমিছিল আজ শেষ। আমি মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আপনার সবাই শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যাবেন। কোনো ধরনের ঝামেলা করবেন না। মিছিলের পেছনে যারা আছেন তারাও মগবাজার এসে মিছিল শেষ করবেন।’ বিএনপির এই নেতা সবাইকে চলে যেতে বলার পাশাপাশি সড়কের জায়গা ছেড়ে দিতে বলেন।
অবশ্য গত বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছিলেন, গণমিছিল কাকরাইল, শান্তিনগর ও মালিবাগ হয়ে মগবাজার চৌরাস্তা ঘুরে ফের নয়াপল্টনে গিয়ে শেষ হবে।
এর আগে বিএনপি ছাড়াও আলাদাভাবে একইদিনে গণমিছিল করার ঘোষণা দিয়েছিল দলটির সঙ্গে বর্তমান সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। এছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে গণমিছিল বের করার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে তাদের সেখানে দেখা যায়নি। শান্তিনগর এলাকার একটি মসজিদ থেকে জুমার নামাজের পর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়।
এলডিপির গণমিছিল: যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল রাজধানীতে গণমিছিল করে এলডিপি। বিকেলে রাজধানীর পূর্ব পান্থপথে এলডিপি কার্যালয় থেকে শুরু হয়ে মালিবাগ মোড় ঘুরে মগবাজারে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়। গণমিছিলে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে এলডিপির নেতাকর্মীরা অংশ নেন। মিছিলপূর্ব সমাবেশে এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ আগামী ১১ জানুয়ারি সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সারাদেশে গণঅবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
১২ দলীয় জোটের গণমিছিল : বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগর মোড়ে যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি গণমিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ থেকে ১১ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন জোটটির নেতা কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন এনডিপির চেয়ারম্যান ক্বারী মোহাম্মদ আবু তাহের, মুসলিম লীগের মহাসচিব জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল করিম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ ইকরাম, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম ও বাংলাদেশ ইসলামী পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম।
১১ দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের গণমিছিল : বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে গণমিছিল শুরু করেন সমমনা জোটের নেতারা। পরে পুরানা পল্টন হয়ে বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কি মোড়ে গিয়ে শেষ হয় তাদের গণমিছিল। এর আগে দেওয়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ আগামী ১১ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। গণমিছিলে উপস্থিত ছিলেন জাগপা’র সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, ন্যাপ ভাসানীর সভাপতি আজহারুল ইসলাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান শাওন সাদেক এবং গণদলের চেয়ারম্যান এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী।
প্রেস ক্লাবের সামনে গণমিছিলের আগে গণতন্ত্র মঞ্চের সমাবেশ : সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। সেখানে তারা সমাবেশ করেন। এই মঞ্চের ব্যানারে জোটবদ্ধ ৭ দলের কয়েকশ নেতাকর্মী সমাবেশে অংশ নেন। সমাবেশ থেকে আগামী ১১ জানুয়ারি ১০ বিভাগে গণঅবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবুল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন স্বপন, গণঅধিকার পরিষদের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বের করা গণমিছিল পল্টন মোড়, বিজয়নগর সড়ক হয়ে কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।