
তার নাম লালন মিয়া। বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার বহুগ্রাম ইউনিয়নের তারাইল গ্রামে। কিন্তু তার রাজত্বের শুরু বহুগ্রাম ইউনিয়নের দক্ষিণ বনবাড়ী গ্রাম এলাকা থেকে। তার এলাকায় ঢুকতে লাগে অনুমতি। অনুমতি ছাড়া কেউ ওই এলাকায় গেলে খেতে হয় পিটুনি। লালন মিয়ার এলাকায় সরকারি স্থাপনা নির্মাণ হলে সেটাও তার। তার ইচ্ছে মতো রাস্তায় আবাদ করেন, রাস্তার ইট নিয়ে নিজের গরুর খামার তৈরি করেন। পাকা রাস্তা কেটে পাতা হয় ভেসাল জাল। অন্য কেউ তার এলাকায় মাছও ধরতে পারেন না। মাছ ধরলেও তার রাজকীয় ভাগ (বখরা) তার পেতেই হবে।
বহুগ্রাম ইউনিয়নের তারাইল গ্রামের গরু চাষি ও মৎস্যজীবী লালন মিয়ার জমিজমা থাকুক আর না থাকুক দক্ষিণ বনবাড়ী গ্রাম এলাকার জমিদার তিনি। সম্প্রতি ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণ বনবাড়ী পাকা রাস্তার ওপর বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়েছেন। এতে বহুগ্রাম তালবাড়ী, মঠবাড়ী ও বনবাড়ীর কোনো কৃষক ওই রাস্তা ব্যবহার করতে পারেন না। শুধু তাই নয় ওই বাঁশের বেড়া থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দক্ষিণে তৈরি করেছেন একটি গরুর খামার। যদিও খামারে নেই কোনো গরু। প্রায় ৩ কিলোমিটার রাস্তায় তিনি বুনেছেন সরিষা।
গরুর খামারের কাছে লালনদের তিন ভাইয়ের প্রায় ১ বিঘা জমি থাকলেও সরকারের টাকায় তৈরি এইচবিবি রাস্তাসহ প্রায় ১ একর জমি জবরদখল করে বালু ফেলে গরুর খামার করেছেন। প্রায় ৩শ ফুট লম্বা গরুর খামারের পাশে রয়েছে একটি সরাইখানা। সেখানে থাকেন লালনের পার্টনার ও কর্মচারীরা। স্থানীয় লোকদের অভিযোগ, মধ্যমাঠে দিনরাতে তারা কী করেন তা কেউই জানে না। কেউ জানার চেষ্টাও করে না। কারণ লালনের রাজ্যে যেতে বাধানিষেধ আছে।
লালনের রাজ্যে যে সাড়ে ৩ কিলোমিটার এইচবিবি রাস্তা আছে সেখানে বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক মাছের প্রচুর আধার রয়েছে। এজন্য লালন তার সহযোগীদের নিয়ে ৬টি মাছ ধরার ভেসাল জাল পেতেছেন। চায়না ম্যাজিক জাল ছড়িয়ে একবার মাছ ধরতে গিয়ে পিটুনি খেয়েছেন মিন্টু মিয়া নামে এক ব্যক্তি। লালন এবং তার সহযোগীরা মিন্টুর হাত ভেঙে দেয়। এ নিয়ে মামলাও হয়। লালন প্রধান আসামি হলেও পুলিশের কাছে রয়েছে পলাতক। অপর ৭ আসামি আদালতে হাজির হয়ে জামিনে আছেন। তারা হলেন কালা মিয়া, খায়ের মিয়া, ওবায়দুল মিয়া, তামিম মিয়া, আহসান শরীফ, আশিক মোল্যা ও নিরব মোল্যা। মামলা তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। জামিনে এসে ওই মামলার বাদী আবদুল্লাহ মিয়াকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে লালন বাহিনী। এনিয়ে আবদুল্লাহসহ ক্ষতিগ্রস্তরা একাধিক জিডিও করেছে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) মুকসুদপুর অফিস সূত্রে জানা গেছে, বহুগ্রাম ইউনিয়নে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে একটি বক্স কালভার্টসহ প্রায় আড়াই কিলোমিটার রাস্তায় মাটির কাজ ও এইচবিবিকরণে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। রাস্তাটি পুরো না হওয়ায় ২০১৯-২০২০ সালে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বাদবাকি আড়াই কিলোমিটার এবং ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২টি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। যাতে বহুগ্রাম তালবাড়ী, মঠবাড়ী, বনবাড়ী, দক্ষিণ বনবাড়ী, টিকারডাঙ্গী বাসুড়িয়া মাঠের পানির প্রাকৃতিক চলাচলসহ জমির মালিকরা যাতায়াত সুবিধা পায়। ২০২০ সালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাক্কলন মতো নির্মাণকাজ শেষ করেন। ওই রাস্তা তৈরি এবং এইচবিবি এবং বক্স কালভার্ট ব্রিজ করতে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও সুবিধা পাচ্ছে না ১০ গ্রামের ১০ হাজার পরিবার।
এ ব্যাপারে প্রতিবেদকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় লালন মিয়ার। প্রথমে তিনি সাংবাদিকের কাছে কোনো কথাই বলতে চাননি। এক পর্যায়ে গরুর খামারের সহযোগিতা চাইতে গেলে বেশকিছু কথা বলেন। লালন জানান, ওই এলাকায় রাস্তার আদৌ কোনো দরকার নেই। ওই রাস্তায় কেউ চলাচল করে না। এ জন্য রাস্তা কেটে গরুর খামার করেছেন। তিনি আরও বলেন, ওই রাস্তায় মোট ৬টি ভেসাল পাতা আছে। ৩টি বক্স কালভার্টের কাছে থাকলেও সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে তারা।
কীভাবে রাস্তা কেটে ভেসাল দিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে লালন মিয়া বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান (শেখ সোহেল) সব জানেন। রাস্তা যেহেতু ব্যবহার হয় না সেই জন্য সারা রাস্তায় সরিষার আবাদ করেছি। কোনো অন্যায় করিনি। বরং ফসল হলে দেশ ও দশের উপকার হবে।
এ ব্যাপারে সাবেক চেয়ারম্যান শেখ সোহেল সাংবাদিকদের জানান, রাস্তাটি যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা লজ্জাকর ব্যাপার। যে রাস্তা আমি গড়েছি সেই আমি কোনোভাবেই কাটতে বা নষ্ট করতে বলতে পারি না। লালন আমার নামে মিথ্যাচার করেছে।
বহুগ্রাম ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আশিস মজুমদার জানান আমাদের খাগড়াডাঙ্গা, মঠবাড়ী, বনবাড়ীর লোকজনের বেশিরভাগ জমিজমা ওখানে। রাস্তায় বাঁশের বেড়া দেওয়ায় কেউ ওখান দিয়ে যেতে পারে না। গরু ছাগলও চরাতে পারে না।
বহুগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরিতোষ সরকার জানান, আমি শুনেছি লালনসহ কয়েকজন রাস্তায় বাঁশের বেড়া দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। আমি যতদূর জানি সে একটা ত্রাস। সরকারি টাকায় নির্মিত রাস্তার ইট ফেলে দিয়ে রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি করেছে। স্থানীয় জনসাধারণের চলাচলে যে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, এটা গর্হিত অন্যায়। আমি তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত বিচার দাবি করছি। যাতে ভবিষ্যতে কেউ সরকারি রাস্তা নষ্ট করতে না পারে।
মুকসুদপুর উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল রাশেদী জানান জনগণের কল্যাণে কাজ করে এলজিইডি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, জনগণের চলাচলের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কেউ রাস্তা আটকিয়ে চাষাবাদ করা, রাস্তা কেটে দিয়ে মাছ ধরা এটা জনসাধাণের ভোগান্তি। এটার একটি প্রতিকার জরুরি, নিশ্চয় প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমরা বিভাগীয়ভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করব।
দুদিক থেকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। একদিকে ফাঁস করেছেন বিমানের ক্ষমতাধর এমডি মো. যাহিদ হোসেনের ক্ষমতাধর এমএলএসএস (পিয়ন) জাহিদ হাসান। আরেকদিকে ফাঁস করেছেন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য তাইজ ইবনে আনোয়ার। দুই হাত থেকে নিমেষে শত হাতে পৌঁছে যায় প্রশ্নপত্র। ফাঁসকারীদের পকেট ভারী হয়েছে, কিন্তু চুনকালি পড়েছে সরকারের মুখে।
ক্ষমতাধর এমডি পদ ফসকে যাওয়ার পথে ‘জামাই আদরে’ ফিরেছেন মন্ত্রণালয়ে। আর এমডির পিয়নকে পাঠানো হয়েছে জেলে। কর্তা যাহিদ ‘স্বর্গে’ গেছেন, কর্মী জাহিদ বলির পাঁঠা। আর তাইজ ইবনে আনোয়ার ফিরেছেন নিজের ঘরে। এক যাত্রায় কত ফল!
গত বছর ২১ অক্টোবর ছিল বিমানের ১৪৮টি পদে নিয়োগ পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় নেমে এলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর হতে বাধ্য হয়। জনরোষের ভয়ে বিমানও এবার পারেনি দায়সারা তদন্ত করতে। তাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে কীভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির দুদিক থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করা হলেও, এমডিকে দায়মুক্তি দিতে পারেনি কমিটি। তারা বলেছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেনি। কমিটির কারোর দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট বা লিখিতভাবে বণ্টন করা হয়নি।
দায়িত্ব বণ্টন না করে গোলেমালে পরীক্ষা নেওয়ার অর্থ হচ্ছে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কাউকে সুযোগ করে দেওয়া। এর দায় সংস্থাপ্রধান হিসেবে এমডি এড়াতে পারেন না। এমডির পিয়নকে ফটোকপি করার কাজে ব্যবহার করার নির্দেশ কে দিয়েছে এ প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না তদন্ত কমিটি। বিমানের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা যাহিদ হোসেন। এমনকি তিনি এমডি, সিইও, পরিচালক (প্রশাসন) থেকে শুরু করে প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিক সাপোর্ট, মার্কেটিং অ্যান্ড সেলসের পরিচালকও। উপসচিব হিসেবে প্রেষণে বিমানে গিয়েছেন। প্রেষণে থেকেই যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এখন অপেক্ষা করছেন সচিব পদে পদোন্নতির জন্য। গত জুলাইয়ে যাহিদ হোসেন নিজ ক্যাডারের আবু সালেহ মোস্তফা কামালের স্থলাভিষিক্ত হন।
২১ অক্টোবর প্রশ্নপত্রের কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েন প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত নিচের সারির কর্মচারীরা। গত ৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যাহিদ হোসেনকে বিমান থেকে তুলে নিয়ে পদায়ন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে। যদিও গতকাল সোমবার পর্যন্ত তিনি সেখানে যোগ দিতে পারেননি। বিমান-পরিস্থিতির কারণেই তাকে মন্ত্রণালয়ে যোগ দিতে বাধা দিচ্ছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। যাহিদ হোসেনকে বদলি করার পর বিমানের এমডি পদে যোগ দিয়েছেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব শফিউল আজিম।
বিমানের নিজস্ব কর্মকর্তারা সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ পদে খুব একটা পদোন্নতি পান না। প্রশাসন ক্যাডার ও বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রেষণে গিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এতে বিমানের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ। তাইজ ইবনে আনোয়ার ছিলেন উপমহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা)। মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব (জিএসই-গ্রাউন্ড সার্ভিস ইক্যুইপমেন্ট) ছিল তার অতিরিক্ত দায়িত্ব। পরিচালকের (প্রশাসন) কক্ষে রাখা প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তার জন্য সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবস্থা করেন তাইজ। তিনি তার দুই ড্রাইভারকে প্রশ্নফাঁস করতে সহায়তা করেছেন বলে তারা অভিযোগ তুলেছেন এবং প্রমাণাদি গোয়েন্দা ও তদন্তকারীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এ অবস্থায় গত রবিবার তাইজকে তার মূল দায়িত্বে ফিরিয়ে নিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় মাহমুদুল হাসানকে।
২১ অক্টোবর নিয়োগ পরীক্ষার দুদিন আগে (১৯ অক্টোবর) প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করা হয়। চারজনের নিয়োগ কমিটি বৈঠক করে জিএম অ্যাডমিন মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মদের রুমে। জিএম জিএসই তাইজ ইবনে আনোয়ারের অনুরোধে জিএম অ্যাডমিনের ব্যবহৃত প্রিন্টার থেকে প্রশ্নপত্রের প্রিন্ট দেওয়া হয়। ফাইনাল চেকের জন্য প্রশ্নটি জিএসইকে দেওয়া হয়। চেক শেষে যদিও শ্রেডিং মেশিনে তা ধ্বংস করা হয়।
চার সদস্যের নিয়োগ কমিটির প্রধান প্রকৌশলী এআরএম কায়সার জামান তদন্তকারীদের বলেন, ‘১৯/১০/২০২২ তারিখে আমি যখন জিএম অ্যাডমিনের কক্ষে যাই তখন সেখানে জিএম অ্যাডমিন ও প্রিন্সিপাল বিএটিসি জিএসই অপারেশন পদের প্রশ্নপত্র নিয়ে কাজ করছিলেন। আমার প্রবেশের আনুমানিক ১৫ মিনিট পর জিএম জিএসই প্রবেশ করেন। জিএম অ্যাডমিন, জিএম জিএসইকে প্রশ্নপত্র চেক করতে বলেন। জিএম জিএসই বলেন, একটা প্রিন্টআউট করতে। একটি কাগজের বোথ সাইড প্রিন্ট করা হয়। এর আগে জিএম অ্যাডমিন বলেছিলেন স্ক্রিনে চেক করতে।’ একপর্যায়ে প্রধান প্রকৌশলী ওয়াশরুমে যান। তিনি জিএম জিএসইকে কোনো ছবি তুলতে দেখেননি বলে তদন্ত কমিটিকে জানান।
জিএম অ্যাডমিন মো. নিজাম উদ্দীন আহমেদ তদন্ত কমিটিকে বলেন, আমি কোনো প্রশ্নপত্রের প্রিন্টআউট নিতে চাইনি। যতটুকু মনে পড়ে তাইজ সাহেবের অনুরোধে প্রিন্টআউট বের করা হয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ দুজন হলেন এমটি অপারেটর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ মাসুদ। তারা দুজনই ডিজিএম নিরাপত্তা তাইজ ইবনে আনোয়ারের গাড়ির চালক। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারা বলেছেন, ডিজিএম নিরাপত্তার কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেয়েছেন।
জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘ডিজিএম সিকিউরিটি স্যার মোটরসাইকেলে করে অপারেশন বিল্ডিংয়ে আসেন। ইশারা দিলে আমরা দুজন তার কাছে যাই। আমাকে আর মাসুদকে ভাঁজ করা একটি কপি দেন। উভয় পাশে প্রশ্নপত্র ছাপানো ছিল। আমি ওই প্রশ্নপত্রের স্ক্রিনশট নিতে চাইলে তিনি ধমক দেন এবং প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত চলে যেতে বলেন।’
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়োগ পরীক্ষার আগের দিন ফটোকপি করার সময় নিজের মোবাইল ফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি ধারণ করেন এমডি যাহিদ হোসেনের এমএলএসএস জাহিদ হাসান। পরে তিনি এ প্রশ্নপত্র হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পরিচালক প্রশাসনের দপ্তরের এমএলএসএস সমাজু ওরফে সোবহান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দপ্তরের এমএলএসএস আওলাদ হোসেনকে দেন। তারা তা দ্রুত ছড়িয়ে দেন। সে সময় তারা কারও কাছ থেকে ২ লাখ, কারও কাছ থেকে ১ লাখ টাকা নেন। অনেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়েও প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন।
তাইজ ইবনে আনোয়ার তদন্ত কমিটিকে জানান, তিনি শুরুতে প্রশ্নপত্র অন-স্ক্রিন চেক করেছিলেন। পরে প্রিন্ট করা হয়। প্রিন্ট নেওয়ার কারণ ঠিকমতো পেইজে আসে কি না, লেখা ঠিক থাকে কি না এসব বোঝা। জিএম অ্যাডমিন নিজের হাতে প্রিন্ট কপি শ্রেডিং মেশিনে দেন। প্রশ্ন দেখার সময় নিয়োগ কমিটির চারজনই রুমে ছিলেন, কেউ ওয়াশরুমে যাননি।
নিয়োগ পরীক্ষার দিনই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরিচালক অর্থ মো. নওসাদ হোসেনের নেতৃত্বে মহাব্যবস্থাপক সিএসকিউ নিরঞ্জন রায় ও উপমহাব্যবস্থাপক লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স রাশেদ মেহের চৌধুরী গত ২০ নভেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা প্রায় সবাই আটক বা জেলে। বিষয়টি আদালতে বিচারধীন থাকায় আর কিছু বলা সম্ভব নয়।’
তদন্ত কমিটির কাছে ২১ কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো না কোনোভাবে প্রশ্নপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন পেয়েছিলেন কিন্তু স্বীকার করেননি আটজন। পলাতক থাকায় কিছু কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি তদন্ত দল। প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য তদন্ত দলের মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছেন।
১০ ক্যাটাগরির ১৪৮টি শূন্যপদে ভন্ডুল হওয়া লিখিত পরীক্ষায় ৪ হাজার ৩৮৮ জনের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। গত ২১ অক্টোবর পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য তারা উত্তরার হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আইইএস উচ্চ বিদ্যালয়ে জড়ো হন। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হলে পরীক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন।
বিমানের নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম নতুন কিছু নয়। বছরজুড়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাটি কর্মী নিয়োগ দেয়। এসব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফঁাঁসের মাধ্যমে একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। সংস্থাটির বদলি, পদায়ন, কেনাকাটা, লিজ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
সরকারের বেতন কাঠামোর চেয়ে খানিকটা বেশি বেতন এ সংস্থায়। কিন্তু এর কর্মীদের মধ্যে ‘ওনারশিপ’ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রায় প্রতি মাসেই সংস্থার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো মামলা হচ্ছে।
বিদেশে বসে দেশ বা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করলে ঢাকার সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে না থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ মিশন প্রধানদের নির্দেশনা দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এ তথ্য জানান।
মন্ত্রী বলেন, যারা বিদেশে বসে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতদের মন্ত্রণালয় থেকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সরকার মোটেও চিন্তিত নয়। সময়মতো এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের নিয়মেই নির্বাচন হবে। এখাবে সব দল আসলে ভালো, কেউ না আসতে চাইলে না আসবে।
ড. মোমেন বলেন, দেশে আগে ফ্রড ভোট হতো। একবার ১ কোটি ২৩ লাখ লোক ভুয়া ভোট দিয়েছে। এখন এটা বন্ধ। ফ্রডগিরি করতে পারবেন না। দেশে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। যাতে এরা ভালোভাবে নির্বাচন করতে পারে। সুতরাং সেখানে সব দল এলে ভালো। আমরা জনগণের ওপর বিশ্বাসী । জনগণ যাকে চাইবে তাকে ভোট দেব।
নতুন বছরের প্রথম দিন রবিবার বিদেশে বাংলাদেশ মিশন প্রধানদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনারদের কী বার্তা দেওয়া হয়েছে তা জানতে চান সাংবাদিকরা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মিশন প্রধানদের বলা হয়েছে, কেউ যদি মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দেয়, আপনারা (দূতরা) চুপ করে ঢাকার সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। আপনি একজন দায়িত্বশীল মানুষ। সরকার আপনাকে সর্বোচ্চ কাজ দিয়েছে। আপনি আপনার দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছেন। কেউ যদি মিথ্যা বলে, আপনি (দূত) উত্তর দেবেন, একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মন্ত্রণালয়ের হুকুমের জন্য বসে থাকবেন না। আমরা নবযুগে প্রবেশ করেছি। আমরা বিশ্বাস করি আপনারা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল লোক। আপনারা (দূতরা) সেই অনুযায়ী কাজ করবেন, যেটা আপনারা ভালো মনে করেন।’
দূতদের ভাষ্য কী ছিল জানতে চাইলে ড. মোমেন বলেন, তাদের বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে বলেছেন, এতদিন ধরে তারা (দূতরা) এই প্র্যাকটিস করে এসেছেন (হুকুম দিলে রেসপন্স করা)।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি এখন থেকে আপনারা রেসপন্স করবেন এবং আমাদের জানাবেন। অনেকে আছেন মিশন প্রধানরা খারাপ কিছু হলে আমাদের জানাতে চান না। তারা লজ্জা পান। এখানে লজ্জার কোনো কারণ নেই। আমাদের সবকটি মিশন মিলেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমরা সবাই মিলে টিমওয়ার্ক। ভালো হোক খারাপ হোক, ঘটনা জানাতে হবে।’
বিশ্বের অন্যান্য দেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা মাস দুয়েক আগে হলেও বাংলাদেশে এক বছর আগ থেকেই হইচই শুরু হয়েছে। আর একে ঢং হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে নির্বাচন নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন নয় বলেও জানিয়েছেন তিনি।
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন পাড়ি দিয়েছেন নক্ষত্রের পথে। গত রবিবার রাত দেড়টায় বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সদ্য সাবেক সভাপতি, দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব, নগর পরিকল্পনাবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি স্থাপত্য শিল্পে যেমনা ছিলেন একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তেমনি মানবিক ও আধুনিক পৃথিবী গড়ে তোলার সহযাত্রী ছিলেন। যেকোনো অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার ক্ষুরধার অংশগ্রহণ ছিল
দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মোবাশে^র হোসেন অংশ নেন। সমরযুদ্ধে তিনি ছিলেন সাহসী সৈনিক। ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অগ্রসরমাণ স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণেও সরব হন। তার দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনী থেকে দেখা গেছে, স্থাপত্য শিল্পেই নয়, তার অবদান রয়েছে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে। নগরীর খেলার মাঠ রক্ষায় তিনি যেমন ছিলেন সোচ্চার তেমনি বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তার কঠোর অবস্থান।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের বিশেষ করে বিসিবির যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন প্রয়াত মোবাশ্বের হোসেন। সর্বশেষ গত বছর ধানম-ি মাঠ ও তেঁতুলতলা মাঠ আন্দোলন নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে ছিলেন। ছিলেন দেশের মাঠঘাট, খালবিল ও নদী দখলের বিরুদ্ধেও। তিনি ছিলেন সজ্জন, সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মী ও দায়িত্বশীল।
জীবদ্দশায় তিনি যেমন একের পর এক বর্ণিল কাজ করে গেছেন তেমনি জীবনের শেষটায় রেখে গেছেন অনন্য স্বাক্ষর। আজ মঙ্গলবার তার মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দান করা হবে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তার (মোবাশে^র হোসেন) পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। আগামীকাল (আজ) তার মরদেহ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগে গ্রহণ করা হবে। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজে ব্যবহার হবে। তিনি জীবিত অবস্থায় তার দেহ দানের বিষয়টি চূড়ান্ত করেন।’
এদিকে মোবাশ্বের হোসেনের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সব মহলে। তার মৃত্যুতে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ ও শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। সমাজের যেকোনো অনিয়মে সোচ্চার ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে দেশ একজন প্রতিভাদীপ্ত স্থপতি হারাল, এ শূন্যস্থান সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
গত রবিবার রাত ১টা ৩৮ মিনিটে ঢাকার শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে স্থপতি মোবাশে^র হোসেনের মৃত্যু হয় বলে স্থপতি ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘উনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। সবশেষ দুই মাস তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল। তখন তার ডায়ালাইসিস করা যাচ্ছিল না।’ ধীরে ধীরে শরীরের অবস্থা সংকটাপন্ন হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না জানিয়ে ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম বিদেশে নিতে, কিন্তু তার শরীরের নাজুক অবস্থার কারণে বিদেশে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় তিনি গত রাতে (রবিবার) চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।’
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় মোবাশে^র হোসেনের মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার প্রিয় কর্মস্থল বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটে (আইএবি)। মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এক শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। সেখানেই তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান।
এদিকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে মোবাশ্বের হোসেনের গুণগ্রাহী ও বিশিষ্টজনরা বললেন, দেশ যখন এ উন্নয়নের মহীসোপানে তখন তার মতো একজন গুণীকে হারানো অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সুশাসন প্রশ্নে তিনি ছিলেন সাহসী কণ্ঠস্বর। তার মতো সাহসী লোকের অভাব পূরণ করা কঠিন।
ঢাকার দুই মেয়র তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, নগর উন্নয়নের এ পুরোধার মৃত্যুতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুর রহমান বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে মোবাশে^র হোসেন কখনো ভয় পেতেন না।’ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘তিনি পরিকল্পিত নগরায়ণের একজন পথিকৃত ছিলেন।’ বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘বিভিন্ন ইস্যুতে তার মতো স্পষ্টবাদী মানুষের খুব অভাব। এ ধরনের মানুষ যতই চলে যাবে ততই উদাহরণগুলো সরে যাবে। আশা করব ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের কর্মগুলো মনে রাখবে।’
সবার শ্রদ্ধা জানানো শেষে স্থপতি মোবাশে^র হোসেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আরেক প্রিয় জায়গা ব্রাদার্স ইউনিয়নে। সেখানে তার দ্বিতীয় জানাজা হয়। এরপর শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখান থেকে রাতে মরদেহ মরচুয়ারিতে রাখা হয়। আজ বিএসএমএমইউতে মরদেহ দান করা হবে।
১৯৪৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম নেওয়া মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন এসোকনসাল্ট লিমিটেডের প্রধান স্থপতি। তিনি কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস এবং বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল, এশিয়ার (আর্কেশিয়া) প্রেসিডেন্টও ছিলেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যের স্নাতক সম্পন্ন করা এ স্থপতি বেশ কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণের কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে প্রশিকা ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক ভবন ও চট্টগ্রাম রেলস্টেশন উল্লেখযোগ্য। পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনে সোচ্চার এ স্থপতি ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) আহ্বায়ক এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সহসভাপতি ছিলেন।
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক পরিচালক ও ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সাবেক সভাপতি। এ ছাড়াও সম্মিলিত ক্রীড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়কও ছিলেন। তিনি তার জীবনে কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে আমেরিকান স্থপতি ইনস্টিটিউট (এআইএ) প্রেসিডেন্ট পদক-২০০৯ উল্লেখযোগ্য।
দেশবরেণ্য স্থপতি মোবাশ্বেরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে দেশের প্রকৌশলীদের পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি)। শোকবার্তা দিয়েছে বিসিবি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন। তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। এক শোকবার্তায় বলা হয়, মোবাশ্বের হোসেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি নৈতিক ও মানবিক সমাজ গঠনে আজীবন সাহসী ভূমিকা রেখে গেছেন। তার ভূমিকা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় তারা বলেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের ২১ তলা ‘বঙ্গবন্ধু মিডিয়া কমপ্লেক্স’র নকশা প্রণয়ন কমিটির অন্যতম পরামর্শক ছিলেন মোবাশ্বের হোসেন। তার মৃত্যুতে জাতি এক দেশবরেণ্য স্থপতিকে হারাল। স্থাপত্য শিল্পে তার অবদান জাতি গভীরভাবে স্মরণ রাখবে।
প্রিয় ক্লাব সান্তোসের ভিলা বেলমিরোতে খেলতে খেলতেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন পেলে। এই সবুজ গালিচায় চিহ্ন এঁকেছেন অজস্র ফুটবলীয় রূপকথার। গতকাল সে মাঠেই শেষবারের মতো ফিরলেন পেলে। অনন্তপথে যাত্রার আগে প্রিয় ক্লাবে কাটাবেন মরেও অমর ফুটবলের রাজা। তাকে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় পেলের শেষ বিদায়ের দুদিনব্যাপী আনুষ্ঠানিকতা। পেলেকে একে একে সাধারণ মানুষ-ভক্ত থেকে শুরু করে বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। সেই তালিকায় ছিলেন ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো থেকে শুরু করে সাবেক খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদসহ আরও অনেকে। ব্রাজিল মহাতারকার কফিনের পাশে ছিলেন তার স্ত্রী মার্সিয়া আওকি, ছেলে এদারসনসহ পরিবারের অনেকে।
পেলের ছেলে এদারসন শ্রদ্ধা জানান বাবাকে। বাবার কপালে হাত রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। পেলের স্ত্রী মার্সিয়া আওকি কফিনে রাখেন জপমালা। সে সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। উপস্থিত সবাই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। বিশেষ করে জীবনসঙ্গিনী আওকি। বেশ কয়েকবারই তাকে চোখ মুছতে দেখা যায়। সান্তোসের হোম ভেন্যু ভিলা বেলমিরোর মাঝ বরাবর বসানো হয় অস্থায়ী তাঁবু। সেখানে রাখা আছে ফুটবলের রাজার কফিন। কফিনের চারপাশ ছিল ফুলে ফুলে সাজানো। কফিনে শায়িত পেলের দেহের ওপরের অংশ সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। মুখটা ঢাকা ছিল সচ্ছ সাদা নেটের কাপড়ে। যেন প্রিয় তারকার মুখ শেষবারের মতো দেখতে পায় সবাই। কফিনের ডানদিকে সামান্য দূরে ছিল ব্যারিকেড। সেই ব্যারিকেডের পাশ দিয়ে শত শত সাধারণ মানুষ লাইন ধরে এসে পেলেকে শেষবারের মতো দেখে যান। এখানে ব্যারিকেড থাকলেও সাধারণ মানুষের মনে পেলে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন যুগের পর যুগ ধরে। ভিলা বেলমিরো মাঠের গ্যালারিতে লেখা ছিল ‘লং লিভ দ্য কিং’।
পেলেকে শ্রদ্ধা জানানোর পর ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনো বলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি দেশকে অনুরোধ করব তাদের একটি করে স্টেডিয়াম মহান পেলের নামে নামকরণ করার।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিশুরা যেন পেলের গুরুত্ব বুঝতে পারে সেটি ভেবে এমন প্রস্তাব দেওয়া হবে। আমরা এখানে খুব দুঃখ নিয়ে এসেছি। পেলে চিরন্তন। তিনি ফুটবলের বৈশ্বিক আইকন।’ ইনফান্তিনো ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকা ফুটবল ফেডারেশন (কনমেবল) প্রধানসহ আরও অনেকে শুরুর দিকে শ্রদ্ধা জানান।
পেলেকে প্রথম শ্রদ্ধা জানানো সাধারণ ব্যক্তিটি ১৪ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। হুইল চেয়ারে করে এসেও পেলেকে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায় অনেককে। কার্লোস মোতা এবং তার ছেলে বের্নার্দো ৫০০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন ফুটবলের রাজাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। ৫৯ বছরের মোতা এএফপিকে বলেন, ‘আমার ছোটবেলা কেটেছে পেলের অসামান্য সব কীর্তি দেখে। তাকে বিশ্বজয়ী হতে দেখে।’ ভক্তরা এসেছিলেন হাতে ব্রাজিলের ১০ নম্বর জার্সি আঁকড়ে ধরে; অনেকের হাতে ছিল পেলের পোস্টার। কেউ কেউ বিশ্বকাপের ডামি নিয়ে এসেছিলেন। তাদের অনেকের চোখেই ছিল বিষাদের অশ্রু। পেলেকে শ্রদ্ধা জানাতে সান্তোস স্টেডিয়ামের বাইরে অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষ সারাক্ষণ গেয়েছেন পেলেকে নিয়ে লেখা একাধিক গান।
ফরাসি সংবাদমাধ্যম লেকিপ প্রথমে জানায়, পেলেকে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটি নিয়ে ব্রাজিলে গেছেন ব্রাজিল ও পিএসজি তারকা নেইমার। তবে নেইমারের বাবা নেইমার সিনিয়র গ্লোবোকে বলেন, ‘সে আসবে না। তবে তার মন খুব খারাপ। সে আমাকে এখানে তার পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকতে বলেছে। কাউকে হারানো কত কষ্টের সেটা আমরা বুঝি। আমরা শুধু একজন খেলোয়াড়কেই হারাইনি, একজন মানুষকেও হারিয়েছি।’
ব্রাজিলের সান্তোসের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের পার্থক্য ৯ ঘণ্টা। পেলেকে ভিলা বেলমিরোতে শ্রদ্ধা জানানো হবে আজ বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। আজ সান্তোসের রাস্তায় পেলের কফিন নিয়ে প্যারেড হওয়ার কথা রয়েছে। পেলেকে নেওয়ার কথা তার পৈতৃক ভিটাতে। সেখানে থাকেন তার শতবর্ষী মা দোনা সেলেস্তে আরান্তেস। তাকে দেখানোর পর পেলেকে সমাহিতের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। তবে ডেইলি মিরর এক সংবাদে জানায়, পেলের মাকে নিয়ে আসা হতে পারে ভিলা বেলমিরো স্টেডিয়ামে। এমনটি হলে আর পৈতৃক ভিটায় ফিরবেন না পেলে। পেলেকে সমাহিত করা হবে নিজের পছন্দ করে যাওয়া নেকরোপল একুমেনিকাতে। ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, পেলের শেষ ইচ্ছা ছিল নেকরোপল একুমেনিকার নবমতলায় চিরশায়িত হওয়ার। যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় প্রিয় ভিলা বেলমিরোর মাঠ।
চলতি করবর্ষের নিয়মিত সময়ে রিটার্ন জমা দিয়েছেন ইটিআইএনধারীর অর্ধেকেরও কম। ফলে কর পরিশোধে সক্ষমতা থাকার পরও যারা রিটার্ন জমা দেননি তাদের খোঁজে নামছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি করবর্ষে কেউ রিটার্ন জমা না দিলে বা রিটার্নে মিথ্যা তথ্য দিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গতকাল সোমবার থেকে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে এনবিআরের বিভিন্ন কর অঞ্চলের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একাধিক কমিটি। এসব কমিটি প্রথম ধাপে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, বিলাসবহুল গাড়ির মালিক, বিভিন্ন করপোরেট হাউজে কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্যরা রিটার্ন জমা দিয়েছেন কি না তার তথ্য খতিয়ে দেখবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাপে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন নামিদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অভিভাবকদের নামের তালিকা সংগ্রহ করা হবে। স্কুল থেকে অভিভাবকরা কে কী করেন, কোথায় থাকেন, সব তথ্যই সংগ্রহ করা হবে। এরপর খোঁজ নেওয়া হবে তারা রিটার্ন দাখিল করেছেন কি না। এর আগে এনবিআরের তদন্তে দেখা গেছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অনেক অভিভাবক রিটার্নে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। অনেকে ব্যবসায়ে লোকসান দেখিয়েছেন। অনেকে আবার ব্যবসা করলেও রিটার্ন জমা দেননি।
অতীতে এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে জাল কাগজপত্র নিয়ে রাস্তায় চলছে এমন প্রায় শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি চিহ্নিত করেছে এনবিআর। এসব গাড়ির মালিক মিথ্যা ঘোষণায় আনা গাড়ি কিনেছেন বা আমদানি করে ব্যবহার করেছেন। চলতি করবর্ষে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে বিলাসবহুল গাড়ির মাালিকদের চিহ্নিত করে রিটার্ন জমার তথ্য খতিয়ে দেখা হবে।
এনবিআর সূত্রে আরও জানা গেছে, সাধারণত বিভিন্ন করপোরেট হাউজ থেকে তাদের কর্মকর্তাদের কর পরিশোধ করে থাকে। অনেক সময় রিটার্ন জমা দিয়ে দেয় বা রিটার্ন জমার কাজে সহযোগিতা করে থাকে। এর আগে এনবিআরের তদন্তে দেখা গেছে, করপোরেট হাউজ থেকে এনবিআরের পাওনার কম রাজস্ব পরিশোধ করেছে।
ইটিআইএনধারীর অর্ধেকও রিটার্ন জমা দেননি : বর্তমানে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (ইটিআইএন) আছেন ৮২ লাখের কিছু বেশি। অর্থাৎ এসব ব্যক্তি করজালের আওতায় আছেন। প্রত্যেক ইটিআইএনধারী করদাতার রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এবার নিয়মিত সময়ের মধ্যে (১ জানুয়ারি) রিটার্ন জমা দিয়েছেন ২৮ লাখ ৫১ হাজার করদাতা। আরও ২ লাখ ৫০ হাজার করদাতা চলতি করবর্ষে রিটার্ন জমা দেওয়ার সুযোগ চেয়ে আবেদন করেছেন।
চলতি করবর্ষে নিয়মিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দিয়ে আয়কর পরিশোধ হয়েছে ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার রিটার্ন দাখিলে প্রবৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গত বছর এ সময় পর্যন্ত রিটার্ন দাখিল করেছিলেন ২২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৫ করদাতা। গত করবর্ষে আয়কর আদায় হয়েছিল ৩ হাজার ২৮১ কোটি টাকা।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।