
রাজধানীর ৬৪/১, শান্তিনগর এলাকায় ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করছেন শিবপ্রসাদ চন্দ্র নামের এক ব্যক্তি। তিনি বিদ্যমান ইমারত আইন না মেনে অর্থাৎ নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাজ করে চলেছেন। তিনি ভবনের সেটব্যাক সামনে রেখেছেন ১ দশমিক ৬০ মিটার, পেছনে দশমিক ৭৮ মিটার, ডানে দশমিক ৮০ মিটার ও বামে দশমিক ৮০ মিটার। ভবনটির মালিকের জমি ছাড়ার বিষয়টি আইনসম্মত না হওয়ায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) গত ৯ সেপ্টেম্বর নোটিস দেয়।
বনশ্রী এলাকার জে-ব্লকের ৩ নম্বর রোডে আবুল বাশার নামে এক ব্যক্তি একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত আইনের ধার ধারছেন না। গত ১১ আগস্ট তাকে নোটিস দিয়েছে রাজউক। এর আগে এ ভবন মালিককে আরও চারটি নোটিস দেওয়া হয়েছে। রাজউকের মতে, এটি চূড়ান্ত নোটিস।
একইভাবে মোশারফ হোসেন শিকদার নামে এক ব্যক্তি সূত্রাপুরের ২১, প্যারীদাস রোডে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। তাকেও দুই দফা নোটিস দিয়েছে রাজউক। কিন্তু তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ইতিমধ্যে ভবনের আটতলার নির্মাণকাজ শেষ করেছেন।
রাজউকের বিধান না মানার মতো এমন ঘটনা রাজধানীতে হাজারও আছে। গত নভেম্বরে ভবন নির্মাণসংক্রান্ত রাজউকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থার আটটি জোনে ৩ হাজার ৪৬৮টি ভবনের নকশা পাস হয়েছে। এর মধ্যে নির্মাণাধীন রয়েছে ২ হাজার ৫৬৯টি। এসব ভবনের মধ্যে ২ হাজার ২৩টি ভবন নির্মাণে অনুমোদিত নকশা মানা হয়নি। অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ ভবনের ক্ষেত্রে নকশার ব্যত্যয় ঘটেছে। নকশার ব্যত্যয় করা ২ হাজার ২৩টি ভবনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৩৮১টি ভবনের। আর নির্মাণাধীন রয়েছে ১ হাজার ৬৪২টি। অনিয়ম করায় ১ হাজার ৫৮৮ ভবন মালিকের বিরুদ্ধে নোটিস দেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে ২২৯টি ভবনে। ব্যাপক অনিয়মের পরও উচ্ছেদ অভিযানের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ ভবনে।
রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, নন্দীপাড়া ও আফতাবনগর এলাকা নিয়ে রাজউকের জোন-৬ গঠিত। এ জোনে গত নভেম্বর মাসে পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজউকের পরিদর্শক দল ৩২১টি ভবন পরিদর্শন করে নকশার ব্যত্যয় পেয়েছেন। এর মধ্যে ২৮৫টি ভবন মালিককে নোটিস দেওয়া হয়েছে। আর ৩৪টি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, ইমারত পরিদর্শকরা তাদের ইচ্ছেমতো দায়সারা প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে অনিয়মের আসল চিত্র উঠে আসে না। ইমারত পরিদর্শকের পরও প্রধান ইমারত পরিদর্শক, সহকারী অথরাইজড অফিসার, অথরাইজড অফিসার, জোনাল পরিচালক ও সর্বশেষ দুজন পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) রয়েছেন। এ বিশাল চেইন যদি নকশা ব্যত্যয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে এত অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে নগরবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজউক আগে বলত ৯২ শতাংশ মানুষ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশা মানছে না। এখন ৬০ বা ৫৮ শতাংশ নথিপত্রে দেখানো হচ্ছে। এসব আসলে রাজউকের মতো করেই তৈরি করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রাজউক বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ বা আইন পালনে নাগরিকদের বাধ্য করার বিষয়ে অনেকটাই অকার্যকর। তাদের সেই সক্ষমতা নেই।’ তিনি মনে করেন, নকশা না মানার ঘটনা ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হতে পারে। এখানে আইনের ফাঁক দিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে মদদ দেওয়ার একটা বিষয় আছে। আরেকটি বিষয় হলো, যে আইন রাজউক মানাতে চাচ্ছে তা বাস্তবায়ন যোগ্য কি না তাও পরীক্ষা করতে হবে। যারা অন্যায় করছে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল কথা হলো, রাজউককে গঠনতান্ত্রিকভাবে কারিগরি ও দক্ষ জনবলের সমাগম ঘটাতে হবে।’
জানা যায়, রাজউকের আওতাধীন ১ হাজার ৫০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ১৬টি জোন রয়েছে। এর মধ্যে আটটি জোনে পরিদর্শন করে নানা অনিয়মের চিত্র দেখতে পায় রাজউক। ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) ও সেটব্যাক না মানা (ভবনের চারপাশে জায়গা ছাড় দেওয়া), অকুপেন্সি (ভবন ব্যবহার উপযোগী) সদন না দেওয়ার ঘটনা বেশি। এসব ঘটনায় রাজউকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ভবন মালিককে চিঠি দেওয়া হয়। তবে তাদের বেশিরভাগই চিঠিকে পাত্তা না দিয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যান।
পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকায় ক্লাসিক ডেভেলপার্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদিত নকশা না মেনে ভবন নির্মাণ করায় নোটিস দেয় রাজউক। ১০/বি, নওয়াব স্ট্রিটের এ প্লটে প্রথম নোটিসের পরও তা আমলে নেননি ভবন মালিক। এরপর একে একে তিনটি নোটিস দিয়ে সর্বশেষ চূড়ান্ত নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু এ নোটিস কার্যক্রম চলার মধ্যেও ১২ তলার নির্মাণের কাজ শেষ করেছেন তিনি। বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর ইম্পেরিয়াল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানও রাজউকের বিধান না মেনে ভবন নির্মাণকাজ করে যাচ্ছে। এ ভবন মালিককেও পরপর তিনটি নোটিস দিয়েছে রাজউকের সংশ্লিষ্ট অথরাইজড অফিসার। রাজউকের এ নোটিস পাত্তা না দিয়ে ইতিমধ্যে আটতলা নির্মাণকাজ শেষ করেছেন ভবন মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজউকের অথরাইজড অফিসার যদি মনে করেন তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় এসব ভবনের নির্মাণকাজ আর করতে পারবে না; তবে তাই হবে। তারা আইন অনুযায়ী কাজ বন্ধ করে দিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে পারেন। কিন্তু তা না করে ভবন মালিকদের সঙ্গে অদৃশ্য যোগাযোগ রেখে তাদের নির্মাণকাজ চালিয়ে যেতে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন।’
ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে নকশার ব্যত্যয় ঘটানোর বিষয়টি নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিয়ার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২) তানজিলা খানম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নকশা না মেনে যেসব ভবন মালিক নির্মাণকাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে নোটিস দেওয়ার বিষয়টিও আইনি বাধ্যবাধকতা। যারা নোটিস না মেনে কাজ করছে তাদের স্থাপনা উচ্ছেদে রাজউক অভিযান করবে। রাজউক নিয়মিত এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।’
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ বুধবার। ১৯৪৮ সালের ৪ জুন সময়ের প্রয়োজনে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকল লড়াই-সংগ্রামে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এই ছাত্র সংগঠনটি। নব্বই দশকের পর এই সংগঠনে পচন ধরতে শুরু করে শীর্ষ নেতৃত্বের একগুঁয়েমিতে। টেন্ডারবাজি,চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মতো অনেক অপকর্মে নাম এসেছে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি করোনা মহামারীতে যখন থেমে যায় পুরো বাংলাদেশ, তখন এদেশের কৃষক-শ্রমিক, ক্ষেতমজুরসহ দরিদ্র জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে সংগঠনের অনেক কর্মী। যখন করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আক্রান্ত মানুষ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছিল ছাত্রলীগের একটি অংশ অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আক্রান্ত মানুষের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সাহায্য নিয়ে। কিন্তু ভালো কাজগুলো ছাপিয়ে যখন শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিতর্ক পিছু ছাড়ছিল না তখন সম্মেলন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে সংগঠনের মাদার অর্গানাইজেশন আওয়ামী লীগ।
৬ ডিসেম্বর সম্মেলন করে এবং ২১ ডিসেম্বর কমিটি করে নতুন নেতৃত্বের হাতে তুলে দেওয়া হয় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব।
দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদকের সঙ্গে নতুন নির্বাচিত সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সংগঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে একান্ত আলাপে উঠে আসে নানা দিক।
সাদ্দাম হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশ্বের শিক্ষা মানচিত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগুলোকে জায়গা করে নেওয়ার দিকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের অন্যতম লক্ষ্য বিশ্বের শিক্ষা মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়া। তিনি বলেন, যেহেতু স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণাটি আমাদের শিক্ষার্থীদের মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে সেহেতু আমাদের ক্যাম্পাসগুলো যেন স্মার্ট হয়, সেটা করা।
সাদ্দাম বলেন, অর্থনৈতিক রূপান্তর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিশ্চিত করা। সে অর্থনৈতিক রূপান্তরের উপযুক্ত শিক্ষা যেন শিক্ষার্থীদের ভেতরে জাগ্রত হয়। কারণ শ্রমনির্ভর শিল্পব্যবস্থা থেকে আমরা যখন যান্ত্রিক শিল্পব্যবস্থায় চলে যাব তখন আমাদের বর্তমানে বিশ্বে যেসব বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করানো বা প্রথাগত যেসব দক্ষতা আছে সেসব হয়তো কাজে নাও লাগতে পারে। সেজন্য আমাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও যেন এই সংস্কার সাধিত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যেন শিল্পের সম্পর্ক তৈরি হয় সেসব বিষয়কে আমরা ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে পরিণত করতে চাই।
তিনি বলেন, আমাদের বৈশ্বিক কিছু বিষয় রয়েছে, যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কিন্তু বৈশ্বিকভাবে তরুণদের একটি আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের যে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক আন্দোলনের কণ্ঠস্বর সেখানে আমরা চাই এটি বৈশ্বিক ছাত্র আন্দোলনের একটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হোক।
আমাদের সংগঠনের অভ্যন্তরে মেধাবী শিক্ষার্থীদের যারা প্রযুক্তিতে অগ্রগণ্য তাদের আমরা সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। এই প্যারাডাইমগুলো ছাত্রলীগ-রাজনীতিতে নিয়ে আসতে চাই।
যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশে এখনো বাস্তবায়ন করতে চায়, গণতন্ত্রের নামে যারা মানুষ হত্যার রাজনীতি করে এবং যারা বিভিন্ন দুর্নীতি মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত আসামি, খুনের মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত আসামি, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের যারা সাহায্য দিয়েছে; আমরা মনে করি এটি কোনো রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
সাদ্দাম বলেন, এটি অন্ধকারের শক্তি এবং এই অপশক্তির বিনাশ যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও সাংবিধানিক অগ্রযাত্রা অনিরাপদ এবং বাংলাদেশের জনগণের যে অভূতপূর্ব বিজয় নিশ্চিত করেছেন দেশরতœ শেখ হাসিনা সেটিও নষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা, দুর্নীতিবাজ ও হত্যাকারীদের রাজনৈতিক দল আমরা বাংলাদেশের মাটি থেকে বিনাশ করতে চাই। এটি আমাদের শপথ। এর জন্য একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করছি আমরা।
ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সব সময় ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধান করতে জানে। ছাত্রলীগ আমাদের স্বাধিকার স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সাফল্যের সঙ্গে। একই সঙ্গে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় যে পরিবর্তনগুলো এসেছে যেমন প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন নতুন অনেক বিষয় সম্পৃক্ত হয়েছে, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রভৃতি আমাদের পাঠক্রমে সম্পৃক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সবচেয়ে জোরালো যে সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য সেটি হচ্ছে আমরা পরিবর্তনশীল বিশ্ব বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে জানি। ছাত্রলীগ একটি আধুনিক ছাত্র সংগঠন।
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ; অর্থাৎ আজ ছাত্রলীগের প্লাটিনাম জয়ন্তী। প্রতিষ্ঠার পর ভাঙাগড়া কম হয়নি দেশের প্রাচীনতম এই ছাত্র সংগঠনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একাধিকবার ভাঙন হয়েছে এ সংগঠনে। নামে অদল-বদল হয়েছে কিছু। তবু এখনো এটি টিকে আছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এর চরিত্র বদলেছে, অনেক সমালোচনার জন্মও দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
মত-পথ ও আদর্শের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছেড়ে চলে গেছেন বড় অনেক নেতা। ছেড়ে গিয়ে নতুন ছাত্র সংগঠন গড়েছেন ছাত্রলীগ নামেই। ছাত্রলীগের নামের আগে শুধু অন্য শব্দ জোড়া হয়েছে অথবা ব্র্যাকেটে ভিন্ন নাম যুক্ত হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (আওয়ামী লীগপন্থি), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), জাতীয় ছাত্রলীগ (বাকশালের ছাত্র সংগঠন), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বাসদ), ছাত্রলীগ (জাগপা) প্রভৃতি। অনেক ছাত্রলীগ এখন আগের প্রতাপে নেই। অনেকগুলো ক্ষীয়মাণ, কোনোটা প্যাডসর্বস্ব।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হলে ছাত্রলীগও মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামে পরিচিত হয়। তখন এ সংগঠন এদেশের শীর্ষ ছাত্র সংগঠন ছিল না। ’৬৬-এর পর শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলে ছাত্রলীগ ক্রমশ শীর্ষ সংগঠন হতে থাকে। ’৬৯-এর পর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে না হলেও সামগ্রিকভাবে সারা পূর্ব পাকিস্তানে শীর্ষ সংগঠন হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ।
’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য তোফায়েল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রলীগই পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগ ভেঙেছে, কিন্তু ছাত্রলীগ নাম কেউ ছাড়েনি এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শেখ শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছাত্রলীগের একটি গৌরব আছে, ইতিহাস আছে, ঐতিহ্যপূর্ণ অতীত আছে। এই গৌরবপূর্ণ অতীত হলো ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ। এসব ভূমিকা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ছাত্রলীগের সেই গৌরব কেউ ছাড়তে চায়নি। সবাই সেই ঐতিহ্য ধারণ করতে চেয়েছে বলেই ছাত্রলীগের নাম কেউ পরিবর্তন করেনি। গৌরবের অংশীদার হতে ছাত্রলীগ নামটা রাখার চেষ্টা করেছে সবাই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের হাত ধরেই ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছি। ওই ছাত্রলীগই ৬ দফা আন্দোলনকে জনপ্রিয় করেছে। ওই ছাত্রলীগই ১১ দফা ও শিক্ষা আন্দোলন করেছে। ওই ছাত্রলীগই ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান করেছে। ওই ছাত্রলীগই ’৭০-এর নির্বাচন করেছে। ওই ছাত্রলীগই মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছে। ওই ছাত্রলীগই বাংলাদেশ। পাকিস্তানের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে ধাপে ধাপে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
গৌরবোজ্জ্বল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৫তম জন্মদিনে অনেকটাই ম্রিয়মাণ এই সংগঠন। নব্বই দশকের পর নেতৃত্বের নৈতিক অবক্ষয় শুরু হওয়ায় একে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। শীর্ষ নেতৃত্বের নৈতিক অধঃপতন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এই সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে দেশের মানুষ।
প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। প্রথম সভাপতি মনোনীত হন দবিরুল ইসলাম। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খালেক নেওয়াজ খান। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বিজয় ছিনিয়ে এনে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল সংগঠনটির।
শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান করে তোলে ছাত্রলীগ। নেতাকর্মীদের অনমনীয় লড়াই-সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা জোগাতে থাকে।
১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা ইতিহাসে আলোকম-িত হয়ে আছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে বাংলার ছাত্রসমাজ সারা দেশে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে, যা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বাংলার ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন, যা ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের গতিকে ত্বরান্বিত করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচিত করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে ছাত্রলীগ।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী শহীদ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদসহ তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায়, থানায়, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
জাতিকে স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও যুক্ত করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অবদান ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নাম হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকা প্রশংসনীয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ছাত্রলীগ। এর ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয় এবং গণতান্ত্রিক সরকারের উত্থান হয়।
এ প্রসঙ্গে শেখ শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা পেশ করেন তখন ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে সমর্থন জানায় এবং ৬ দফাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ছাত্রলীগের মধ্যে তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাষ্ট্রভাবনায় নতুন গতি আসে। সেই ভাবনা থেকে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার রক্ষার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সামনে চলে আসে।
সংগঠনের সাবেক এ সভাপতি বলেন, ১৯৬৯ সালে সম্মেলনের পর ছাত্রলীগে প্রথম ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ফেরদৌস আহমদ কোরেশী ও আল মোজাহেদী। ছাত্রলীগ ভেঙে তারা নতুন সংগঠন ‘বাংলা ছাত্রলীগ’ করে। তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের সংগঠন বিলুপ্ত হয়ে যায়।
’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদ গঠিত হয়।
শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগে আবার ভাঙনের সৃষ্টি হয়। তখন ছাত্রলীগের একটি দল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সেøাগান দিয়ে শ্রেণি-সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে যায়। নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আ.স.ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজ। এর ধারাবাহিকতায় জাসদ গঠিত হয়। জাসদের অঙ্গ-সংগঠন হয় ছাত্রলীগ।
১৯৮০ সালে জাসদ ভেঙে বাসদের সৃষ্টি হয়। বাসদ একটি ছাত্র সংগঠন করে; সেটিও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পরে জাসদ একাধিকবার ভাঙে। তারা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামে ভিন্ন ছাত্র সংগঠন তৈরি করে।
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেন আ খ ম জাহাঙ্গীরকে (প্রয়াত)। তা মানেননি আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক। তিনি বাহালুল মজনুন চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক রেখে ফজলুর রহমানকে সভাপতি করে ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটি দাঁড় করান।
জালাল-জাহাঙ্গীর (জা-জা) ও ফজলু-চুন্নু (ফ-চু) উভয় গ্রুপই নিজেদের প্রকৃত আওয়ামী লীগপন্থি ছাত্রলীগ দাবি করে।
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৮২ সালের পর অন্তত পাঁচটি ছাত্রলীগের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ছাত্রলীগ (জালাল-জাহাঙ্গীর) (শেখ হাসিনাপন্থি), ছাত্রলীগ (ফজলু-চুন্নু) (রাজ্জাকপন্থি), ছাত্রলীগ (মামুন-জহিরুল), ছাত্রলীগ (শাজাহান সিরাজ-ইমদাদুল হক) ও ছাত্রলীগ (শফিউল আলম প্রধান-লুৎফর রহমান)।
পঁচাত্তরের পর ১৯৮১ পর্যন্ত ডাকসুর নির্বাচনে বাসদের ছাত্রলীগের আধিপত্য ছিল। জাসদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (ইনু)। আরেক জাসদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (আম্বিয়া)। জাগপা শফিউল আলম প্রধানের পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। আর ছাত্রলীগ (অদলীয়) সিরাজুল আলম খানের অনুসারী।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ’৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য ছাত্রলীগের সম্মুখ ভূমিকা ছিল। সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক পথে যাবে নাকি গতানুগতিক পথে যাবে এই রাজনৈতিক বিরোধের মুখে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। এই বিরোধের মুখেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মনে করে যে, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা হচ্ছে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সেই স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের দর্শন কার্যকর করার জন্য তারা ভূমিকা রাখে।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইনু বলেন, ছাত্রলীগের একটি অংশ সমাজতন্ত্রের সেøাগানকে সামনে রেখে মুজিববাদকে সামনে রেখে যেটা আসলে কোনো মতবাদ নয়, বিভক্ত হয়। তারা মনে করেন যে, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ধারক-বাহকরাই হচ্ছে ৪৮ সালের ছাত্রলীগের মূল ধারা। সেই হিসেবে তারা ছাত্রলীগ নামটা ব্যবহার করে।
ইনু বলেন, ছাত্রলীগে দুই ধারাই আছে একটা আওয়ামী সমর্থক ধারা; আরেকটা জাসদ সমর্থক ধারা। এর বাইরে আর যারা আছে তারা কী করে বা কীসে ভূমিকা রাখছে, আমরা জানি না।
ফুটবলের রাজা শায়িত হলেন রাজার স্থানেই। ফুটবল বিশ্বে তিনি যেমন শীর্ষে ছিলেন, প্রয়াত ফুটবলারদের মধ্যেও তেমনি সবার ওপরে। বিশ্বে বহুতলবিশিষ্ট একমাত্র সেমেট্রি (কবরস্থান) আছে ব্রাজিলের সাও পাওলো রাজ্যের সান্তোসে। পেলের জন্ম শহরেই। মেমোরিয়াল নেক্রোপল একুমেনিকা নামের এই সেমেট্রি ১৪তলা বিশিষ্ট। এই অভিনবত্বের জন্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নামও উঠেছে এই সেমেট্রি। ১৯৮৩ সালে উদ্বোধন হওয়া এই ভবনের নবম তলাতেই শায়িত হলেন পেলে। প্রয়াত সাবেকরা যখন মাটিতেই শুয়ে; পেলে তখন ৯ তলার ওপর! ব্রাজিল কিংবদন্তি নিজে থেকেই এ জায়গা ঠিক করেছিলেন। এই ভবনের নবম তলা থেকে ৯৫০ মিটার দূরের সান্তোস ক্লাবের স্টেডিয়াম আরবানো কালদেইরা দেখা যায়। পেলে তাই সান্তোসেই থাকছেন। তার শেষ নেই। সবসময় নিজের ক্লাব, প্রিয় ক্লাব সান্তোসের খেলা দেখে যাবেন।
সান্তোসে গতকাল ছিল পেলেময়। আগের দিন সকাল ৭টা থেকে পরদিন সন্ধ্যা ৭টা মোট ২৪ ঘণ্টা তার মরদেহ রাখা হয়েছিল সান্তোসের মাঠে। সেখানে ভক্ত-সমর্থকরা পেলেকে শেষ ভালেবাসা জানান। ক্লাব সান্তোস জানিয়েছে ভিলা বিলমোরে অবস্থিত মাঠটিতে এই ২৪ ঘণ্টায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ পেলেকে সম্মান জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা এসেছিলেন সস্ত্রীক। রবিবার নিজের অফিসে এক মিনিট নীরবতা দিয়ে দাপ্তরিক কাজ শুরু করেন প্রেসিডেন্ট। পরে সোমবার পেলেকে শ্রদ্ধা জানাতে হেলিকপ্টারযোগে স্ত্রীসহ সান্তোসে যান। সেখানে পেলের বিধবা স্ত্রী মার্সিয়া সিবেলে আওকি, পেলের শতবর্ষী মা সেলেস্তে আরান্তেস, পেলের ছেলে এডারসন ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সান্ত¡না জানান। রাতের সময়টা সমর্থকদের ভিড় বন্ধ রেখে কাল সকালে পেলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সেমেট্রির দিকে। পথে পুরোটা সময় রাস্তার দুধারে সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা দাঁড়িয়ে ভালোবাসা জানান ফুটবলের রাজাকে।
পেলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় একটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে। বিষয়টি একটু ব্যতিক্রম। মরদেহ সাধারণত অ্যাম্বুলেন্স বা কোনো খোলা ছাদের পিক আপে করে নেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ব্রাজিলে বিশেষ কারও মরদেহ সেমেট্রিতে নিতে হলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ব্যাবহার করাটা ঐতিহ্য। এর আগে মানে গারিঞ্চার মরদেহও এভাবেই সেমেট্রিতে নেওয়া হয়েছিল। ওই গাড়িতে পেলের কফিন মোড়ানো ছিল ব্রাজিল ও সান্তোসের পাতাকায়। কফিনের বেশিরভাগ অংশ ছিল ব্রাজিলের পতাকা আর অল্প অংশ ছিল সান্তোসের। এদিন পেলের জন্য রাস্তার দুপাশে থাকা সমর্থকরা কেউ কেঁদেছেন আবার কেউ রাজার স্বর্গযাত্রায় হেসেছেন, বাদ্য বাজিয়ে তাকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছেন।
শুধু বিদায় নয়, পেলেকে ভালোবেসে ব্রাজিলের নানা জায়গায় হচ্ছে নানা স্মরণিকা। বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তা পেলের নামে নামকরণ করা হচ্ছে। ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের ভবনে পেলের ছবিযুক্ত বিশাল পোস্টার টানানো হয়েছে। তাতে লিখা চিরস্থায়ী। ব্রাজিলে দেয়ালচিত্র অনেক বিখ্যাত। তেমনিভাবে ফুটবলের দুই বিখ্যাত ব্যক্তিকে ধরে রাখা হয়েছে দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে। সেখানে দেখা যাচ্ছে সামনে মুখ করে থাকা দিয়াগো ম্যারাডোনা পেছন ফিরে থাকা পেলের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। ব্রাজিলের রাস্তায় পেলেকে স্মরণ করে এমন অনেক কিছুই এখন নজরে পড়ছে।
সবকিছুই পেলের জন্য। শেষ বিদায়ের রাস্তায় দুপাশে থাকা লাইন থেকে শুরু করে ব্রাজিলের আমাজন বনের বিশালতা পেলেকে স্মরণ করবে আজ থেকে। তবে পেলে অবিনশ্বর। ঠিক যেমন বাকি কিংবদন্তিরা ছিলেন। তারা তো মাটিতে শুয়ে এখনো ফুটবলের আওয়াজ শোনেন। পেলে সবার ওপরে থেকে শুনবেন সান্তোসের মাঠ থেকে। আর স্বর্গে সবাই এক হবেন হাতে হাত রেখে।
সবচেয়ে কম সময়ের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন কবির বিন আনোয়ার। তিনি মাত্র ১৯ দিন এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। কম সময়ের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী। তিনি এ পদে ছিলেন ১ মাস ৪ দিন। আবু সোলায়মান চৌধুরী ৩ মাস ২ দিন এ পদে থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব হচ্ছে প্রশাসনের শীর্ষ পদ। প্রশাসন ক্যাডারের সবচেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে এ পদের সমমানে মুখ্য সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার ২৪তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে মো. মাহবুব হোসেনের আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তিনি চলতি বছর ১৩ অক্টোবর চাকরি থেকে অবসরে যাবেন। সেই হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না পেলে তিনি হবেন ১০ মাসের মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে দীর্ঘ সময় থেকে রেকর্ড গড়েছেন এম কেরামত আলী। তিনি ৪ বছর ১১ মাস ২৯ দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ বছর ৭ মাস ২২ দিন এ পদে ছিলেন মোহাম্মদ আইয়ুবুর রহমান। ৪ বছর ৭ মাস ৯ দিন থেকে এ তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন মো. মাহবুবউজ্জামান। দেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম ৪ বছর ১ মাস ১১ দিন এ পদে ছিলেন। হাল আমলের মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা এবং মোহাম্মদ শফিউল আলমও দীর্ঘ সময় এ দায়িত্ব পালন করেছেন। মোশাররাফ ৪ বছর ২৬ দিন এবং শফিউল ৪ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। গত মাসে বিদায় নেওয়া খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করেন ৩ বছর ১ মাস ২৭ দিন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার পর সাধারণত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, মোহাম্মদ শফিউল আলম ও মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা নির্ধারিত সময়ের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব করা হলেও কবির বিন আনোয়ারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
সাধারণত মন্ত্রিপরিষদ সচিবকেই বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী হিসেবে সরকার নিয়োগ দেয়। সম্প্রতি মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউসকে এ পদে নিয়োগ দেওয়ার পর আর কোনো সুযোগ নেই। কবির বিন আনোয়ার ১৫ ডিসেম্বর এ পদে যোগ দেন। ১৯ দিনের মাথায় গতকাল মঙ্গলবার এ পদ থেকে তিনি অবসরে যান।
ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ১ মাস ৪ দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। তিনি ২০০২ সালের ২ এপ্রিল এ পদে যোগ দেন। বহাল ছিলেন ৬ মে পর্যন্ত। এরপর তিনি মুখ্য সচিব পদে যোগ দেন। নতুন পদের কারণেই ড. কামাল সিদ্দিকী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ ছেড়ে যান। চারদলীয় জোট সরকারের প্রশাসন সাজাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ড. সিদ্দিকী। চাকরি ছাড়ার পর বাংলাদেশি এ অর্থনীতিবিদ অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। এই ক্যারিয়ার সিভিল সার্ভেন্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি নড়াইলের সাবডিভিশনাল অফিসার (এসডিও) ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে খুলনার ডিসি নিয়োগ করা হয়।
৩ মাস ২ দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন আবু সোলায়মান চৌধুরী। ২০০৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ৩ মাস ১৮ দিনের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন সৈয়দ আহমদ। মাত্র ৯ মাস মন্ত্রিপরিষদ সচিব থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ড. আকবর আলি খান। কৃতী এ অর্থনীতিবিদ পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদে যোগ দেন এবং প্রধান উপদেষ্টার পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন।
দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করে রেকর্ড সৃষ্টিকারী এম কেরামত আলী এ পদে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই থেকে ১৯৮২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। চাকরি থেকে অবসরের পর এ আমলা রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য কেরামত আলী এবং অন্য সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম কে আনোয়ারকে এরশাদ জমানায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত করে। পরে তারা আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র কিনে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান। কিন্তু শেখ হাসিনা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সিদ্ধান্ত মেনে তাদের মনোনয়ন দেননি। তারা রাতারাতি বিএনপিতে যোগ দেন এবং নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন। তারা দুজনই ১৯৯১ সালের বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হন। কেরামত আলী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, ডাক-তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৯২ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত আইয়ুবুর রহমান ৪ বছর ৭ মাস ২২ দিন থেকে এ তালিকায় দ্বিতীয়। ১৯৮২ থেকে ’৮৬ সাল পর্যন্ত ৪ বছর ৭ মাস ৯ দিন দায়িত্ব পালন করে দীর্ঘ সময় থাকার তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন মো. মাহবুবউজ্জামান।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে মো. মাহবুব হোসেন জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ছিলেন। একই দিনে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদারকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে। তার আগে তিনি ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব। অতিরিক্ত সচিব ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগে।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের অষ্টম ব্যাচের কর্মকর্তা মাহবুব হোসেন সরকারি চাকরিতে যোগ দেন ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। চাকরি জীবনে বিভিন্ন সময়ে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির প্রশিক্ষক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের উপপ্রধান (জেন্ডার), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব এবং বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের পরিচালক (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) পদেও তিনি কাজ করেছেন।
বরিশাল রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ (বর্তমানে বরিশাল ক্যাডেট কলেজ) থেকে এসএসসি এবং বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন মাহবুব হোসেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে পড়ালেখা করেছেন। তার বাড়ি বরিশালের মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে। ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের জনক।
রাত পোহালেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে দশম ঢাকা লিট ফেস্ট। চার দিনের এবারের আসরে ১৭৫টির বেশি অধিবেশনে অংশ নেবেন পাঁচ মহাদেশের পাঁচ শতাধিক লেখক সাহিত্যিক শিল্পী ও চিন্তাবিদ বক্তা। আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হবে লিট ফেস্টের এ আয়োজন।
বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ২০১১ সাল থেকে ঢাকায় হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক এ আসর। তবে এবারই প্রথম এ উৎসব উপভোগ করতে টিকিট কাটতে হবে। একজন পূর্ণবয়স্কর জন্য চার দিনের উৎসবে প্রতিদিনের টিকিটের দাম রাখা হয়েছে ৫০০ টাকা। আবার চার দিনের টিকিট একসঙ্গে কাটলে তার দাম দিতে হবে ১ হাজার ৫০০ টাকা। শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের টিকিটের জন্য গুনতে হবে ২০০ টাকা। ভিআইপি ক্যাটাগরির জন্য চার দিনের টিকিট কেনা যাবে ১০ হাজার টাকায়।
টিকিট কেটে সাহিত্য উৎসব উপভোগের ব্যাপারটি নিয়ে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তবে খোদ বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা টিকিটের বিষয়টি জানেই না। এ বিষয়ে কোনো অনুমতিও নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘টিকিটের কথা আয়োজকরা আমাকে এখন পর্যন্ত (৩ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, বিকেল) জানায়নি। এমনকি বাংলা একাডেমিতে টিকিট কেটে কোনো আয়োজন করবেন বলেও লিট ফেস্টের আয়োজকরা আলাপ করেনি। এটা তারা নীতিগতভাবে করতেও পারেন না।’
এ সময় তিনি আয়োজকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করে আরও বলেন, ‘বাংলা একাডেমির কর্মীরা কি টিকিট কেটে লিট ফেস্টের চার দিন অফিস করবেন? আর যে লেখকরা কোনো কাজে প্রতিদিন একাডেমিতে আসেন তারা টিকিট ছাড়া ঢুকবেন কীভাবে?’
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা আরও বলেন, ‘নিয়ম মেনে উৎসব করলে বাংলা একাডেমির কোনো আপত্তি নেই। তবে আয়োজকরা নিয়ম মানছেন না। একাডেমির মিলনায়তন ও প্রাঙ্গণের যা ভাড়া তার মাত্র ৫০% দিচ্ছেন আয়োজকরা। তার একটা মাত্র অংশ আগাম দেওয়া হয়েছে।’ তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ‘আয়োজকরা বাকি টাকা না দেওয়ার জন্য বাংলা একাডেমির অসহযোগিতার কথা নানা গণমাধ্যমে বলছেন।’
এ ব্যাপারে ঢাকা লিট ফেস্টের অন্যতম পরিচালক কাজী আনিস আহমেদকে মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
তবে গত ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা লিট ফেস্টের অন্যতম পরিচালক কাজী আনিস আহমেদের সঙ্গে আলাপ হলে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেছিলেন, ‘আমরা দেখেছি অনেকে এ টিকেটিংয়ের ব্যাপারটা নেতিবাচকভাবে নিচ্ছেন। আমরা মনে করি এটা খুব ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত, যারা সমালোচনা করছেন তারাই কিন্তু অতীতে বলেছেন এখানে করপোরেট স্পন্সরশিপ কেন, এখানে গভর্নমেন্ট সাপোর্ট কেন? আমি যদি করপোরেট বা গভর্নমেন্ট সাপোর্ট কমাই তাহলে টিকেটিং না থাকলে এটা চলবে কী করে? খরচটা তো কোথাও থেকে আসতে হবে! আমরা মনে করি দর্শক-শ্রোতাকে এ টিকেটিংয়ের মাধ্যমে আমরা আরও সদর্থে এ আয়োজনে শরিক করে নিচ্ছি এবং তারা শরিক হলে এ ফেস্টিভ্যাল আরও টেকসই হবে। সেখানে স্টুডেন্টদের জন্য আমরা দিনপ্রতি মাত্র ২০০ টাকা রেখেছি বা চার দিনের জন্য মাত্র ৫০০ টাকা রেখেছি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলা একাডেমি এবার রেকর্ড ২১ লাখ টাকা নিচ্ছে ভেন্যুর ভাড়া হিসেবে।’
টিকিট নিয়ে লিট ফেস্টের আয়োজক ও বাংলা একাডেমির মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যেই শুরু হচ্ছে এবারের লিট ফেস্ট। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক উরহান পামুকের আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে উৎসবে যোগ দিচ্ছেন না তিনি। এবারের আসরে অন্যতম আকর্ষণ ২০২১ সালে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আবদুল রাজাক গুরনাহ। এ ছাড়া আসছেন ২০২২ সালের বুকারজয়ী দুই কথাশিল্পী গীতাঞ্জলী শ্রী (আন্তর্জাতিক ক্যাটাগরি) ও শিহান কারুনাথিলাকা। আরও থাকছেন পুলিৎজার, নিউস্ট্যাড ইন্টারন্যাশনাল, পেন বা পিন্টার, প্রিক্স মেডিসিস, একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, উইন্ডহাম ক্যাম্পবেল পুরস্কার, অ্যালার্ট মেডেল, ওয়াটারস্টোন চিলড্রেনস বুক প্রাইজ, আগা খান অ্যাওয়ার্ডসহ অন্যান্য খ্যাতিসম্পন্ন পুরস্কারজয়ী।
লিট ফেস্ট নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও ফেস্টের অন্যতম পরিচালক কাজী আনিস আহমেদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার থাকছে বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরের সাহিত্য পাতা ধ্রুপদিতে।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’