
জামালপুরের ইসলামপুরের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনকে গত বছর ১৮ আগস্ট সাদা পোশাকের পুলিশ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে ঢাকায়। পরিবারের কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা নিয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পল্লবী থানায় মাদকের (ইয়াবা) মামলা ঠুকে তাকে চালান করে দেয় আদালতে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে রাফসানকে (ছদ্মনাম) সন্দেহভাজন দেখিয়ে আটক করে সাদা পোশাকের পুলিশ। তাকে ছেড়ে দিতে ২ লাখ টাকা দাবি করা হয়। ডিএমপির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার আত্মীয় হওয়ায় তার হস্তক্ষেপে ‘সরি’ বলে রাফসানকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দুটি কাহিনীতে সাদা পোশাকের পুলিশ কী করে না করে তা পরিষ্কার। এক কথায় একে বলে ‘জননিবর্তন’। সন্দেহ হলেই বা ‘সন্দেহ হচ্ছে মর্মে সন্দেহ’ হলেই পুলিশ কাজটি করে। এ ক্ষেত্রে প্রাইম মোভার টাকাকড়ি। অর্থাগমসম্ভবে সন্দেহ স্বাভাবিক! মানুষকে নিয়ে কেন এত সন্দেহ? এ সন্দেহের নিরসন কবে হবে? আদৌ হবে কি!
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে সারা দেশে সাদা পোশাকে পুলিশের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে; উঠছে যুগ যুগ ধরে। ১৮৯৮ সালের আইন ২০২৩ সালেও কার্যকর থাকলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। যারা আইন করেছিল সেই ব্রিটিশরাই এখন বাঙাল কায়দায় কাউকে আর সন্দেহ করে না। সন্দেহভাজন কাউকে জেরা ও তল্লাশিতে ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের ঘটনাও এ দেশে নিয়মিত। ড্রাকোনিয়ান ল’ বহাল থাকলে যা হয় আরকি!
প্রসঙ্গত, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারসংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হাইকোর্টের ভাষ্য, এ সংক্রান্ত রায় কার্যকর করার দিকে নজর দেওয়া উচিত। সবার অনুসরণ করা উচিত। করোনাকালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরত ২১৯ প্রবাসীকে সিআরপিসির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারসংক্রান্ত মামলার শুনানিতে এ মন্তব্য করেছিল আদালত।
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল যুগান্তকারী রায়ে হাইকোর্ট ৫৪ ধারা প্রয়োগে কারও সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতা না করা, আটক বা গ্রেপ্তারের সময় পরিচয় দেওয়া, কাউকে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ না দেওয়া, রিমান্ডে নির্যাতন না করা, ধারা সংশোধনের তাগিদ প্রভৃতি ১৫ দফা নির্দেশনা দেয়। ২০১৬ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগে এ রায় বহাল থাকে। ওই বছরের ১০ নভেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ সংক্রান্ত নীতিমালা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্যবিষয়ক নির্দেশনায় বলা হয়, নাগরিকের সম্মান রক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উঁচুমানের পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। সংবিধানে স্বীকৃত নাগরিকের অধিকার রক্ষার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সতর্কতামূলক নির্দেশনা থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক বা গ্রেপ্তারে কৌশল পাল্টেছে। এখন মাদক বা অন্য কোনো মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫ ধারায় পুলিশকে ভবঘুরে, অভ্যাসগত অপরাধী, চোরাই মাল বহনকারী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হলেও তারা যখন-তখন যাকে-তাকে আটক বা গ্রেপ্তার করে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ উঠছে প্রায়ই।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের ভাষ্য, নিবর্তনমূলক ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের তাগিদ ছিল উচ্চ আদালতের। তাদের আপত্তি রয়েছে ৫৫ ধারা ও তল্লাশিসংক্রান্ত ১০৩ ধারা নিয়েও। দীর্ঘদিনেও আইনের সংস্কার ও সংশোধন হয়নি। উপরন্তু ৫৪ ও ১৬৭ ধারা নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউ চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ১৯ জানুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি রয়েছে। তারা বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ নিবর্তনমূলক আইনের সংশোধন না চাইলে আইনের ব্যত্যয় ও অপপ্রয়োগ হবেই।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব ঘটছে ৫৪ ধারার মতো নিবর্তনমূলক আইন আছে বলেই। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র জনগণের। অথচ ব্রিটিশের তৈরি নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে দেশ চলছে। জনগণকে শাসন করার জন্য নিবর্তনমূলক আইন থাকা উচিত নয়। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ ভালো কোনো পদক্ষেপ নয়। কেন নয় তা আদালতে বলব।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘৫৪ ধারা নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানা তো হচ্ছেই না, বরং কৌশলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগেই ব্যক্তিকে আসামি বানিয়ে দিচ্ছে। গত তিন-চার মাসে দেখেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাদা পোশাকধারীরা মানুষকে উঠিয়ে নেয়। অনেক ভিডিও ফুটেজ আমরা পাচ্ছি। এক সংস্থা আরেক সংস্থার নাম বলছে এবং আটকের বিষয়টি অস্বীকার করছে। পুলিশের পর্যবেক্ষণমূলক ব্যবস্থা কার্যকরী নয়।’
সাদা পোশাকে কতিপয় পুলিশের তৎপরতা : প্রতিদিনই বিভিন্ন থানার সাদা পোশাকের টিমের বিরুদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আইজিপি কমপ্লেইন সেলেও প্রতিদিন অভিযোগ জমা পড়ছে। সাদা পোশাকে অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার স্বীকারও হন পুলিশ সদস্যরা। তাদের অপতৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় সুযোগ নিচ্ছে পেশাদার অপরাধীরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা। এ কারণে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
এ সপ্তাহের শুরুতে রাত ১২টার দিকে রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন হাসান ও পারভেজ নামে দুই বন্ধু। মিরপুর দুই নম্বর ফলপট্টি এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ পরিচয়ে দুই ব্যক্তি রিকশার গতিরোধ করে দেহ তল্লাশি করতে চায়। বাধা পেয়ে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে দাবি করা হয় চা-নাশতার টাকা। পরে স্থানীয়রা জড়ো হলে দ্রুত তারা সটকে পড়ে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মদের বার থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তিরা সাদা পোশাকধারীদের টার্গেটে পরিণত হন। বিভিন্ন ক্লাব থেকে আসা নারী-পুরুষরাও নিয়মিত হয়রানির শিকার হন। নারীদের খারাপ মেয়ে বলে বাজে মন্তব্যও করা হয়। মান-সম্মানের ভয়ে অনেকে টাকা দিয়ে নিষ্কৃতি পান। অনেক সময় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হয়। মাঝেমধ্যে হয়রানি বন্ধ থাকে। আবারও পুরনো রূপে ফেরে।
সিভিল টিম বলে কিছু নেই : পুলিশ সূত্র জানায়, থানা-পুলিশের সিভিল টিম গঠনের বা সাদা পোশাকে অভিযান চালানোর আইনগত ভিত্তি নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও থানা এলাকায় নজরদারির জন্য ওসি নিজ থানার আয়তন অনুসারে সিভিল টিম গঠন করেন। তারা রাতে তৎপর থাকে বলেই সন্দেহভাজনদের আটকের নামে টাকা আদায়ের অভিযোগ ওঠে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাদা পোশাকে পুলিশ অভিযান চালাতে পারে না।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাদা পোশাকে একমাত্র স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকজন চলাফেরা করে। ডিবি ও সিআইডি অভিযানের সময় ডিবি ও সিআইডির মনোগ্রামযুক্ত ‘কটি’ ব্যবহার করে। এ ছাড়া সাদা পোশাকে অভিযান চালানোর এখতিয়ার কারও নেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিএমপির সব থানার ওসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিধিবদ্ধ ব্রাঞ্চ (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) ছাড়া আর কেউ সাদা পোশাকে অভিযানে যেতে পারবে না। গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
হয়রানি থামছে না : আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারা অনুযায়ী কাউকে তল্লাশি করতে হলে একাধিক ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে করতে হবে। এ বিধান মানা হয় না বললেই চলে। গত ৪ জানুয়ারি রাত ১২টার দিকে কাজ শেষে রিকশায় করে মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসায় ফিরছিলেন স্বনামধন্য পত্রিকার একজন সাংবাদিক। কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনের কাছে তাকে আটকানোর পর জেরার নামে মানসিকভাবে হেনস্তা করে পুলিশের একজন উপপরিদর্শক ও কনস্টেবল। শেষে পুলিশের পরিচিত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে রেহাই পান তিনি। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘আমার পেশার যেন কোনো মূল্যই নেই তাদের কাছে। সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হয় সহজেই অনুমেয়।’
গত বছর ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকা থেকে ছাত্র অধিকারের পরিষদের দুই নেতাকে তুলে নিয়ে যায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাতেই তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। নূর খান লিটন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা না থাকায় এমন হচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা সরকারের ‘শীতল’ সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। দেশটির মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর দুদিনের সফরে বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে এ ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। শুধু লুর সফরই নয়, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা (বিশেষ সহকারী) ও হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচারের সফরেও দেশটির সরকারের ইতিবাচক মনোভাব পাওয়া গেছে। তবে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসনের তরফে এ বার্তা দেওয়া হয়েছে যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চায় তারা। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) নিষেধাজ্ঞা বিষয়েও বার্তা দিয়েছে। তারা চায় র্যাবের সংস্কার অর্থাৎ বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ ও র্যাবের পক্ষ থেকে যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন করা না হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, র্যাবের নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন আলোচনা এবং লবিস্ট নিয়োগের ফলাফল ইতিবাচক। যুক্তরাষ্ট্র চায় র্যাবের সংস্কার এবং এ লক্ষ্যে তারা সরকারকে কিছু প্রস্তাবও দিয়েছে। র্যাব সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়েছে।
র্যাব সংস্কারের বিষয়ে সরাসরি কিছু না বললেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শেই র্যাব গঠন করা হয়েছে। তারা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলে সেটা দেখা হবে। র্যাবের সব কাজ ভালো হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ডোনাল্ড লুর সফর সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হয়েছে। আর র্যাবের সংস্কার ইস্যুতে সরকারের ইতিবাচক সাড়া এ দুটি বিষয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশগুলো যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতা চায় সে ব্যাপারেও সরকারপ্রধানের প্রতিশ্রুতির কথা জানানো হয়েছে লুকে।
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুদিনের সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে লু দেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের অনুমতি এবং আগামী সংসদ নির্বাচনে সরকারের মনোভাব নিয়ে জানতে চেয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তাদের সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে তার বাস্তবায়নের ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। লু বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষ অবলম্বন করছে না এবং করবেও না। যুক্তরাষ্ট্র চায় সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক চর্চা।
বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ডোনাল্ড লু। যৌথ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় করতে এসেছেন এবং সেক্ষেত্রে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রতিনিধির বৈঠকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ও মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, সমাবেশ করার অধিকার, ভোটার ও বিরোধীপক্ষকে ভয়ভীতি দেখানো থেকে বিরত থাকা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। ডোনাল্ড লু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে আলোচনায় বলেছেন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ে যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেবে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে পরামর্শ দেবে। তারা বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে অবশ্যই দাঁড়াবে। বাংলাদেশের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করবে তারা। মানবাধিকারের বিষয়টি তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
ডোনাল্ড লুর এ সফর সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। লুর সঙ্গে বৈঠকেও গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। কীভাবে সম্পর্কটাকে আরও অর্থবহ করা যায়, এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের মধ্যে কোনো প্রশ্ন তৈরি হলে সেটি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা সবসময়ই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। এ বিষয়টি আমরা আবারও মার্কিন প্রতিনিধিকে জানিয়েছি। আওয়ামী লীগ সংবিধানের রক্ষক এবং সংবিধান অনুযায়ী আমরা নির্বাচন করব। আওয়ামী লীগ সবসময় গণতান্ত্রিক পন্থায়ই সরকারে এসেছে। এটা আমরা সবাইকে বলে আসছি এবং জনগণও সেটি জানে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিদেশিরা আমাদের গণতন্ত্র ও সুশাসন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং কোনো প্রশ্ন এলে তা জানতে চাইতে পারে কিংবা পরামর্শ দিতে পারে। কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রও তাই চায়। কিন্তু আমরা দেখেছি বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো বারবার বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা মোটেও ঠিক না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডোনাল্ড লুর সফরে এবং তিনি যে ব্রিফিং দিয়েছেন তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে তারা বাংলাদেশের নির্বাচনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে না এবং তারা কারও পক্ষে না। তারা তাদের পর্যবেক্ষণের বিষয় জানিয়েছে এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমি মনে করি এটি একটি ইতিবাচক সফর।’
সরকারের বিরুদ্ধে গতকাল সোমবার বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচির বিরুদ্ধে সরব উপস্থিতি দেখিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ঢাকায় বেশিরভাগ থানা, ওয়ার্ডের সড়কে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল। তারা মিছিল-সমাবেশ করেছে বিভিন্ন এলাকায়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি সমাবেশও করেছে ক্ষমতাসীনরা। ওই সমাবেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে দাবি করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সরকার হটানো-টটানো বাদ দেন। আসেন ঠান্ডা মাথায়। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হবে।’
গতকাল বিএনপির সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের অবস্থান কর্মসূচি ও শান্তি সমাবেশে বিএনপিকে উদ্দেশে এ কথা বলেন তিনি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এ সমাবেশের আয়োজন করে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমেরিকান সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান। আমাদের দেশে আইন দিয়ে নির্বাচন কমিশন হয়েছে। ত্রুটিমুক্ত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সবই থাকবে ইসির অধীনে। শেখ হাসিনার সরকার অন্যান্য দেশের মতো রুটিন দায়িত্ব পালন করবে।’
বিএনপিকে উদ্দেশ্যে করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘নির্বাচনে আসতে ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জানি শেখ হাসিনার উন্নয়ন, অর্জন দেখে দেশের মানুষ খুশি, কিন্তু আপনাদের (বিএনপির) মন খারাপ।’
সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনে আসলে বিএনপি হেরে যাবে এ ভয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মাঝেমধ্যে রেগে যান। হেরে গেলে রেগে যান। আগেভাগে হারার আগে হারছেন কেন? আপনাদের যদি এতই জনপ্রিয়তা থাকে সেই সক্ষমতা নির্বাচনে এসে দেখান। সেই সক্ষমতার পরীক্ষাটা নির্বাচনে দেখান। আমরা রেডি, আপনারা আসেন।’
১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে হটাতে বিএনপি গোলাপবাগের গরুর হাটে গিয়েছে।’
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনারা প্রস্তুত হয়ে যান। কাজ আছে সামনে। বিশৃঙ্খলা ঘটানো, মানুষের জানমাল নিয়ে খেললে খেলা হবে। মানুষের জানমাল নিয়ে খেলবেন আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ললিপপ খাব? হবে না। আপনারা প্রস্তুত হয়ে যান, খেলা হবে। খেলা হবে, জোরে খেলা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার খেলা হবে। যারা দুর্নীতি করে, মিথ্যাচার করে তাদের বিরুদ্ধে খেলা হবে। আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে বিজয়ী করার জন্য খেলা হবে।’
জনগণের জানমাল রক্ষায় আওয়ামী লীগ রাজধানীতে শান্তি সমাবেশ করছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় আছি, সরকারে আছি। আমাদের দায়িত্ব দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আর ওদের আয়োজন হচ্ছে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার জন্য বিক্ষোভ সমাবেশ।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাবেন। আমিও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছি বারবার। বিএনপি নেতারা অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাবেন। এটা নিয়ে কটাক্ষ করার কিছু নেই। তবে অসুস্থ রাজনীতি করে অসুস্থ হলে অসুস্থ বিএনপিকেও হাসপাতালে যেতে হবে।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘ফখরুল সাহেব বলেন আমার কথার উত্তর তিনি দিতে চান না। তিনি নাকি দেন না। আমার কথার উত্তর দেওয়ার মতো সামর্থ্য, সত্য কথা বলার সাহস ফখরুল সাহেবের নেই। আমি সত্য কথা বলি। আর তারা মিথ্যাচার করেন, বিষোদগার করেন। এটাই হচ্ছে তাদের রাজনীতি।’
জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ইস্পাতকঠিন গণঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে বিদায় করা হবে। আগামী দিনে সরকার বিদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে। তাই আজকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের এ দায়িত্ব নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, যেখানেই গণতন্ত্র সেখানেই বিএনপির অবদান। আর যেখানে আওয়ামী লীগ সেখানেই গণতন্ত্রকে হত্যা।
ছোট ছোট মিছিল নিয়ে গতকাল সোমবার সকাল থেকেই রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমবেত হতে থাকেন বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ অনুষ্ঠানে। দুপুর হতেই নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে ভরে উঠে নয়াপল্টন সড়কে। বিকেলে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহানগর উত্তর-দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে ১০ দফাসহ বিদ্যুতের মূল্য কমানোর দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে ড. মোশাররফ ছিলেন প্রধান বক্তা। এ সময় ২৫ জানুয়ারি দেশব্যাপী মহানগর ও জেলা সদরে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশে শেষে মিছিল বের হয়। মিছিলটি কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় ঘুরে ফকিরেরপুল মোড় প্রদক্ষিণ করে আবার নয়াপল্টনে এসে শেষ হয়। ঢাকা ছাড়াও অন্য ৯টি মহানগর ও উপজেলায় একযোগে এ কর্মসূচি পালিত হয়। ১০ দফা দাবিতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছে এটি তার তৃতীয় কর্মসূচি।
ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিকভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করে এ সরকারকে বিদায় করব। কয়েক দিন আগে সরকার কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে, বিদ্যুতের যে একটি কমিশন আছে তাদের কোনো মতামত না নিয়ে, গণশুনানি না করে সরকার প্রশাসনিক হুকুমের মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে এবং বলেছে, মাসে মাসে নাকি দাম সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে বিদ্যুতের দাম তারা বাড়াবে। কেন এ দাম বাড়ছে? কারণ সরকার ক্ষমতায় এসে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে লুটপাট করেছে। আবার পার্লামেন্ট থেকে ইনডেমনিটিও পাস করেছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সময় বেশি দিন নেই, বলাবলি বন্ধ হয়ে যাবে। শতচেষ্টা করলেও এই সরকারকে রাখা যাবে না। সরকার ও প্রশাসন এক হয়ে লুটপাট করছে। কারণ এ সরকার ফ্যাসিস্ট ও অত্যাচারী। বিএনপি অন্য কোনো দেশের গোলামি করতে পারে না। রক্তচক্ষু হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার উপেক্ষা করে অধিকার আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাব। নেতাকর্মীদের ওপর আঘাত এলে অন্যায়কারীর প্রতি পাল্টা হাত তোলা নৈতিক অধিকার।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। আজকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে উচ্চ ট্যাক্স, উচ্চবিলের মাধ্যমে টাকা লুট করা হচ্ছে। আর এ টাকা ভোটচোরদের কাছে যাচ্ছে। তারা ১০ হাজার কোটি টাকার কাজ ৩০ হাজার কোটি টাকা করে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে এবং ঢাকা মহানগরের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু ও উত্তরের আমিনুল হকের সঞ্চালনায় বিক্ষোভ সমাবেশে অন্যদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম খান, বরকত উল্লাহ বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
বিক্ষোভ সমাবেশে ঘিরে নয়াপল্টনের বিভিন্ন গলিতে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা যায়।
যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল দুপুরে রাজধানীর এফডিসিসংলগ্ন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) কার্যালয়ের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে দলটির নেতাকর্মীরা। মিছিলটি দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে মালিবাগ মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের বিক্ষোভ মিছিল হয়। মিছিলটি মৎস্য ভবনের কাছে গিয়ে শেষ হয়। ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের ড. ফরহাদের সভাপতিত্বে মিছিলপূর্বক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে এনপিপির মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, জাগপার একাংশের সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, গণদলের চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মওলা চৌধুরী, ডেমোক্রেটিক লীগের (ডিএল) সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মনিসহ জোটের নেতারা বক্তব্য দেন। ফরহাদ জানান, ২৫ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বেলা ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে।
২৫ জানুয়ারি বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেয় গণতন্ত্র মঞ্চ। গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন মঞ্চের পক্ষে এ কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, ২৫ তারিখ প্রেস ক্লাবের সামনে বেলা ১১টায় এবং জেলায় জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ পালন করা হবে।
এ সময় গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, এ সরকারের অধীনে কোনো ভোট হবে না। ১৪ বছরে এ সরকার এত অপরাধ করেছে, এত লুট করেছে ভোটের মুখোমুখি হওয়ার সাহস তাদের নেই। জামানত হারানোর যুগে প্রবেশ করেছেন।
স্বপনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বাংলাদেশ ভাসানী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুম, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সারা দেশে বিচ্ছিন্ন ঘটনায় কর্মসূচিতে বাধার অভিযোগ : এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যুগপৎ কর্মসূচি পালনে বাধার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের কাজীরদেউরি এলাকায় গতকাল বিকেলে বিএনপি কার্যালয় নাসিমন ভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলছিল। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সংঘর্ষ বাধে। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। তাদের দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিএনপি নেতাকর্মীরা কাজীরদেউরি এলাকার টাইলসের দোকানগুলোতে ভাঙচুর এবং ট্রাফিক পুলিশের একটি মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। সন্ধ্যায় পর্যন্ত ১৬ জনকে আটকের খবর পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) দক্ষিণ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কাজীরদেউরি মোড়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর পাওয়ার পর ফোর্স নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিলে তারা স্থান ত্যাগ করে। এ সময় স্টেডিয়ামের সামনে জেলা পুলিশের গাড়ি থেকে এক পুলিশ সদস্যকে নামিয়ে মারধর করে গুরুতর আহত করে।
খুলনা প্রতিনিধি জানান, মহানগর বিএনপির উদ্যোগে সমাবেশ হয় নগরীর কে ডি ঘোষ রোডের দলীয় কার্যালয়ের সামনে। মিছিল কর্মসূচি নবনির্মিত রেলস্টেশন এলাকা থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সেখানে অবস্থান নেয়। বিএনপি কার্যালয় সংলগ্ন থানার মোড় ছিল কাঁটাতারের ব্যারিকেডে অবরুদ্ধ। ফলে কেসিসি মার্কেট এলাকায় জমায়েত ও মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার কাপাসিয়ায় গতকাল সকালে বিক্ষোভ মিছিলে থানা পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। এ সময় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের অন্তত ১০ জন নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানান গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজ।
ঢাকার ধামরাইয়ে বিএনপি নেতা আলহাজ তমিজ উদ্দিনের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল করার সময় বিক্ষোভকারীদের হামলায় মহিলা পুলিশ সদস্যসহ চারজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ তমিজ উদ্দিনসহ বিএনপির ৯ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় ধামরাই থানা পুলিশ। এ ঘটনায় করা মামলায় ১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভৈরবে পুলিশি বাধায় কেন্দ্র ঘোষিত পূর্বনির্ধারিত বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করতে পারেনি স্থানীয় বিএনপি। পরে দুপুরে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামের বাংলোতে সংবাদ সম্মেলন করে।
নাটোরের প্রতিনিধি জানান, সিংড়ায় উপজেলা ও পৌর বিএনপির একটি মিছিল সোমবার বেলা ১১টায় উপজেলা কার্যালয়ের সামনে থেকে বাসস্ট্যান্ড অভিমুখে বের হলে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। সামনে এগোতে না পেরে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন তারা।
এদিকে নরসিংদীর পলাশ উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান পাপন দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুরে সমাবেশে যাওয়ার পথে উপজেলার সামসুরটেকে এ গুলিবিদ্ধের ঘটনা ঘটে। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল রাজধানীর মগবাজারের বিশাল সেন্টারের সামনে অবস্থান নেয়। সেখানে সন্দেহজনক এক ব্যক্তিকে তল্লাশি করে। তখন শার্ট দিয়ে মোড়ানো একটি মোবাইল ফোনের বক্স উদ্ধার করে তারা। ওই বক্সের ভেতর থেকে ৪ রাউন্ড গুলি ভর্তি একটি ৭.৬৫ অটোমেটিক পিস্তল পায়। পরে মো. বাচ্চু শেখ নামে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাচ্চু গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের গাছা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের গাড়িচালক। তার সঙ্গে থাকা জিপ গাড়িটিও জব্দ করে ডিবির ওই দলটি।
ঘটনা ২০১১ সালের ১৪ জানুয়াারির। ওই অভিযানের পর রমনা থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দেয় তারা। এতে বলা হয়, অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার বাচ্চু শেখের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মতো কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। আদালত এই প্রতিবেদন গ্রহণ করেনি। পরে ঘটনাটি অধিক তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)।
সিআইডি অস্ত্র মামলাটির তদন্ত শেষে চারজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। অভিযুক্তরা হলেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, তার গাড়িচালক মো. বাচ্চু শেখ, সিএম গালিব চৌধুরী ওরফে সোর্স খোকন ও বকুল মোল্লা।
সিআইডির তদন্ত সূত্রে জানা যায়, সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম লাভলী নামে এক নারীকে পছন্দ করতেন। তাকে পাওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। একবার গাজীপুরে এক বিচিত্রা অনুষ্ঠানে লাভলীকে চা খাইয়ে অচেতন করেন। এই পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে তিনি লাভলীকে অপহরণ করার জন্য তার গ্রামের বাড়িতে হামলা করেও ব্যর্থ হন। অপরদিকে চেয়ারম্যান সিরাজের হাত থেকে বাঁচতে লাভলী তার এলাকার সাংবাদিক কলিমুল্লাহ নয়নের দারস্থ হন। তাদের মধ্যে যোগাযোগের একপর্যায়ে কলিমুল্লাহ নয়নকে বিয়ে করেন লাভলী। এদিকে সিরাজুল ইসলাম লাভলীকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ জন্য কলিমুল্লাহর কাছ থেকে লাভলীকে সরাতে নান পরিকল্পনা করতে থাকেন। একপর্যায়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর পরিকল্পনা করেন সিরাজ। মিথ্যা মামলা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জনকে টাকা দেন তিনি। পরিকল্পিতভাবে অস্ত্র মামলায় নয়নকে ফাঁসিয়ে লাভলীকে বিয়ে করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সিএম গালিব চৌধুরীর মাধ্যমে একটি গুলিসহ অটোমেটিক পিস্তল সংগ্রহ করেন। সিরাজুল ইসলামের এ পরিকল্পনায় যুক্ত হয় বকুল মোল্লা। তারা কলিমুল্লাহ নয়নকে মগবাজারে এনে ডিবি পুলিশের মাধ্যমে অস্ত্রসহ ফাঁসিয়ে দেওয়ার ছক আঁকেন। এ জন্য ডিবি পুলিশের কয়েকজনকে টাকার বিনিময়ে তাদের পরিকল্পনায় যুক্ত করেন।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিন সিরাজুলের সহযোগীদের সঙ্গে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কলিমুল্লাহ নয়নকে বিভিন্ন কৌশলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হন। ফলে পরিকল্পনায় যুক্ত থাকা গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা ওই পিস্তলসহ সিরাজুলকে তার সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে তারা গ্রেপ্তার এড়াতে নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকেন। একপর্যায়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গ্রেপ্তার এড়িয়ে যান তারা। পরে সিরাজের গাড়িচালক বাচ্চু শেখকে প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজান। পুলিশ বাচ্চু শেখকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামলা করে।
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক পরিদর্শক মো. লুৎফর রহমান। তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মামলাটির তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছি। এখন এটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আমি ঘটনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
জানা গেছে, পরিকল্পনার মূলহোতা সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১১টি জিডি রয়েছে। তার ছেলে তৌহিদুল ইসলাম দীপ বলেন, তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে অসুস্থ, চোখেও দেখতে পান না। এ জন্য বাড়িতেই থাকেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে সিআইডি অভিযোগপত্র দেওয়ার পর অভিযোগ গঠন করা হয়। তবে এখনো এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আশরাফ বলেন, বাচ্চু শেখ এবং বকুল মোল্লা জামিনে রয়েছেন। বকুলকে এই ঘটনার দশ বছর পর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালত তাকে জামিন দেয়।
সাজানো এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করা বাচ্চু শেখ বলেন, ‘সিরাজ চেয়ারম্যান পরিকল্পনা করে আমাকে ফাঁসিয়েছিলেন। আমার কোনো দোষ ছিল না। সেটা আমি ডিবি অফিসারদেরও তখন জানিয়েছিলাম। এরপরও আমাকে এক বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। এখন নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।’
সিরাজুল ইসলামের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে জানতে চাইলে কলিমুল্লাহ নয়ন বলেন, ‘সিআইডির একজন অফিসার জানিয়েছিলেন এই অস্ত্র মামলায় আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আমি তাদের পরিকল্পনার বিষয়ে কিছু জানতাম না। তবে তারা ওই দিন আমাকে ঘটনাস্থলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছিল।’
গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে এ ঘটনাটির পর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি বিভাগীয় তদন্ত করা হয়েছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মগবাজারে ঘটনার দিন কলিমুল্লাহ নয়নকে না পেয়ে গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন সদস্য সিরাজুল ও গালিবকে ফকিরাপুলের একটি আবাসিক হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে তার কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। সিরাজুল তার ভাইদের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে তাদের দেন।
জানা গেছে, অবৈধভাবে টাকার বিনিময়ে সিরাজুল ইসলামের ষড়যন্ত্রে যুক্ত হওয়া, অন্যদিকে তাদের আটকে রেখে টাকা নেওয়ায় গোয়েন্দা পুলিশের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রে ওই অভিযানে থাকা চার কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়। তারা হলেন সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মতিয়ার রহমান, উপপরিদশক (এসআই) প্রদীপ, এসআই ইউসুফ ও এসআই দেলায়ার। তবে অভিযুক্ত গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তাদের মন্তব্য জানতে ডিবি কার্যালয়সহ পুলিশের একাধিক দপ্তরে যোগাযোগ করেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, পুলিশের কেউ দায়িত্বে অবহেলা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ওই ঘটনাতেও তাই হয়েছিল, যে কারণে এরপর এমন ঘটনা আর ঘটেনি। আইজিপির নির্দেশে পুলিশের সব ইউনিটের দায়িত্বরতদের কার্যক্রমে নজর রাখা হচ্ছে। ফলে কেউ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানোর সাহসও করছে না।
বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের যে প্রস্তাব দিয়েছে তা আগামী ৩০ জানুয়ারি সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদের সভায় অনুমোদিত হতে পারে। বাংলাদেশ সফররত আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত বছরের ৯ নভেম্বর আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি জানায়। তবে সেটি ছিল কর্মকর্তা পর্যায়ের ঐকমত্য। তখন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, সাত কিস্তিতে এই ঋণ দেবে তারা। প্রথম কিস্তির ঋণ দেওয়া হবে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। আর সর্বশেষ কিস্তির ঋণ পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। আইএমএফের ঋণের সুদহার হবে বাজারদর অনুযায়ী, তাতে গড় সুদহার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
গতকাল বিবৃতিতে আইএমএফের ডিএমডি অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ নির্বাহীদের সঙ্গে আলোচনায় আমরা কর রাজস্ব বাড়ানো এবং আরও দক্ষ আর্থিক খাত গড়ে তোলার দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জসহ এই প্রোগ্রামের মূল কাজের ওপর নজর দিয়েছি। বেসরকারি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণের সুবিধার্থে সংস্কারের কথা আলোচনা হয়েছে। এসব সংস্কার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও স্থিতিস্থাপক করে তুলতে এবং দীর্ঘমেয়াদি, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।’
বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা করেছি, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে। আইএমএফের লক্ষ্য বাংলাদেশের জলবায়ু বিনিয়োগের চাহিদাকে সমর্থন করার জন্য সাশ্রয়ী ও দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য করা।’
কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে বিবৃতিতে আইএমএফ ডিএমডি বলেন, তাক লাগানো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য নিরসনে স্থির অগ্রগতি এবং জীবনমানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক নীতি মুদ্রাস্ফীতিকে স্থিতিশীল রাখতে, ঋণ-জিডিপি অনুপাত কমাতে এবং বাহ্যিক সংকটগুলো পর্যাপ্ত রাখতে সাহায্য করেছে।
তিনি বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশও এখন বৈশ্বিক ধাক্কার প্রভাব মোকাবিলা করছে। প্রথমে কভিড মহামারী, তারপরই ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের ফলে হওয়া সংকটটি তারাও মোকাবিলা করছে।
গতকাল আইএমএফ ডিএমডির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, জ্যেষ্ঠ অর্থসচিব ফাতেমা ইয়াসমিন ও ঢাকায় আইএমএফের আবাসিক প্রতিনিধি জয়েন্দু দে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ বেলআউটের (পুনরুদ্ধার) জন্য আইএমএফের কাছ থেকে কোনো সহায়তা চায় না; বরং পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আইএমএফের ঋণসহায়তা চাইছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইএমএফ প্রতিনিধির কাছে এক দশকে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, কৃষি, ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের অগ্রগতির গতি কমে গেছে। এ অবস্থায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে।’
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তার জন্য সরকার সামাজিক সুরক্ষার জাল ও খাদ্য কর্মসূচি বাড়িয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পতিত জমিগুলো চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের প্রশংসা করেন আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও। তিনি বলেন, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণে সহায়তা অব্যাহত রাখবে আইএমএফ।
আইএমএফ ডিএমডি অ্যান্তইনেত এম সায়েহের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠকে বৈশি^ক অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি এবং এর পাশাপাশি বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর করণীয়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
কোনো জেলায় কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন রয়েছে কি না তা জানতে তালিকা তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেক ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমার সরকারের লক্ষ্য হওয়ায় আমি প্রত্যেককে বাড়ি দেব। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ বাড়ি, আশ্রয় এবং জীবিকার সুযোগ পাবে। তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না। আমরা চাই প্রত্যেকে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে।’
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপে বাড়ি হস্তান্তরের সময় এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি সাতটি জেলা ও ১৫৯টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা।
এর আগে তিনি পঞ্চগড় ও মাগুরার সব উপজেলাসহ ৫২টি উপজেলাকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনি গতকাল ৯টি জেলা এবং ২১১টি উপজেলা গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। খবর বাসসের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির পিতা দেশকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে একটি উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন দিতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তার সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না বলে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি বলেন, তার সরকার ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বাড়িঘর ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে বাড়িপ্রাপ্তদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ওপর একটি ভিডিও-প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সরকার প্রধান বলেন, ‘কেউ ঠিকানা ছাড়া থাকবে না। আমরা তাদের শুধু ঘরই দিইনি, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। তাদের জীবিকার জন্য ঋণও দিয়েছি। তারা এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন, একজন ব্যক্তি ১০০ বিঘা জমির অধিকারী হতে পারবে এবং এর অতিরিক্ত পরিমাণ জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র গড়তে রোডম্যাপ জরুরি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভৌগোলিক-কৌশলগত সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। গতকাল ঢাকায় প্রথম অ্যাভিয়েশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে দেওয়া এক ভিডিও ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন সামিট-২০২৩’-এর আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী এই শীর্ষ সম্মেলনকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, দেশটির এই অঞ্চলে একটি বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা রয়েছে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা যাত্রী ও মালামাল উভয়ের জন্যই একটি উন্নত ও টেকসই বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারি সংস্থা, এয়ারলাইনস ও সংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সরকার ই-ভিসা সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ও পর্যটনে আসা যাত্রীদের সুবিধা দেবে ও ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের যুবকদের অবশ্যই পাইলট, বিমান প্রকৌশলী, মেকানিক, ক্রু ও আরও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি দেশের বিমানশিল্পে লোকবলের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই বিমানশিল্প এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী ও ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বক্তব্য দেন।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনার কামরুজ্জামান ফকির (৩৫) নামে এক পল্লি চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। এ সময় জাহিদ (২৮) নামে আরেকজন আহত হন। আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে উপজেলার শেখপুর বাজারসংলগ্ন মির্জারচর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত কামরুজ্জামান মাদারীপুর সদর উপজেলার আদিত্যপুর গ্রামের আবদুর রব ফকিরের ছেলে।
হাসপাতালে, ফায়ার সার্ভিস ও নিহতের আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, ভোরে কামরুজ্জামান তার আপন ভায়রা জাহিদকে নিয়ে তাবলিগ জামাতে অংশ নিতে গাজীপুরের টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশে শিবচরের পাঁচ্চর বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হন। পাঁচ্চর থেকে বাসযোগে টঙ্গী যাওয়ার কথা ছিল তার। এ সময় তার মোটরসাইকেলটি শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কে শিবচরের শেখপুর মির্জারচর নামক স্থানে আসলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মোটরসাইকেল থাকা দুজন গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা কামরুজ্জামানকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আহত জাহিদকে উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শিবচর ফায়ার সার্ভিসের লিডার তরুনুর রশিদ খান বলেন, ভোরে আমরা খবর পেয় ঘটনাস্থলে যাই। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, সকালে রোগীকে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে। পরে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পাই হাসপাতালে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।