
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে সখ্য গড়ে তোলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মো. রুবেল রানা (৩৫)। জুনায়েদ রুহানি রুবেল নামে খোলা তার ফেইসবুক আইডিতে ভুয়া সব তথ্য ও ছবি দিয়ে ওই ছাত্রীর বিশ্বস্ততাও অর্জন করেন। কিন্তু ওই ছাত্রী যখন জানতে পারেন রুবেল ভুয়া পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়েছেন, তখন যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এরপর রুবেল ওই ছাত্রীকে ভয় দেখানো থেকে শুরু করে আপত্তিকর ছবিসংবলিত পোস্টার করে সাঁটান ক্যাম্পাসে। দুর্বিষহ করে তোলে ওই ছাত্রীর জীবন।
আরেক ভুক্তভোগী ময়মনসিংহের ভালুকার মো. রুবেল খান। তার সঙ্গেও ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে সখ্য গড়েন প্রতারক রুবেল রানা। পরে রুবেল খানের স্ত্রীকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে নিয়োগের কথা বলে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেন প্রতারক রুবেল রানা। এ ঘটনায় ঢাকার পল্লবী থানায় মামলা করেন রুবেল খান। একইভাবে চাকরি দেওয়ার নাম করে ময়মনসিংহের আশরাফুলের কাছ থেকে ২ লাখ এবং নুরুল আমিনের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকাসহ অসংখ্য ব্যক্তির কাছ থেকে রুবেল রানা টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরে ১১ জানুয়ারি রাজধানীর ধানমণ্ডি থানা এলাকা থেকে রুবেল রানা ওরফে জুনায়েদ রুহানী ওরফে রুহানী রুবেলকে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
ডিবির তদন্তে উঠে এসেছে এই রুবেলের নানা অপকর্মের তথ্য। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারক রুবেল নিজেকে কখনো ম্যাজিস্ট্রেট, কখনো মন্ত্রী-এমপির পিএস আবার কখনো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন। তার টার্গেটে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া নারী শিক্ষার্থীরাও। রুবেলের খপ্পরে পড়ে প্রায় অর্ধশত নারী প্রতারণার শিকার হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই সামাজিকভাবে মর্যাদাহানির ভয়ে থানায় অভিযোগ করেননি। তবে রুবেলকে গ্রেপ্তারের পর অসংখ্য ভুক্তভোগী ডিবির কাছে অভিযোগ করছেন।
এ প্রসঙ্গে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারকের বিষয়ে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। ফেইসবুকে পরিচিত ব্যক্তি ছাড়া বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ না করা, চাকরি দেওয়ার নামে প্রলোভনে না পড়া ও অর্থ লেনদেন না করার বিষয়ে আমরা সব সময় সতর্ক করি। এরপরও মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। আমরা অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
প্রতারক রুবেলের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী ৬ জানুয়ারি ডিএমপির তেজগাঁও থানায় মামলা করেন। মামলাটির এজাহারে উল্লেখ করা হয়, নরসিংদীর রায়পুরা থানার শ্রীরামপুর রেলগেট এলাকার গিয়াস উদ্দিনের ছেলে রুবেল রানার সঙ্গে ২০২০ সালের প্রথম দিকে পরিচয় হয় ওই ছাত্রীর। রুবেল নিজেকে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচয় দেন। এর পর থেকে রুবেলের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ফেইসবুকের মেসেঞ্জারে বিভিন্ন সময়ে আলাপ হতে থাকে। এ সময় ছাত্রীর বিভিন্ন ছবি সংরক্ষণ করে রাখেন রুবেল। ২০২১ সালে রুবেলের ভুয়া পরিচয় সম্পর্কে জানতে পেরে ওই ছাত্রী সম্পর্ক থেকে সরে আসেন। কিন্তু রুবেল তখন আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। কারসাজির মাধ্যমে ওই ছাত্রীর ফেইসবুক আইডির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এ ছাড়া গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অবকাঠামোর দেয়াল ও আশপাশে পোস্টার সাঁটান। যাতে ওই ছাত্রীর ব্যক্তিগত ছবি এবং অন্য আরেকটি সম্পাদনা করা ছবিসহ ‘চিনে রাখুন ডিভোর্সি, বহুরূপী, মিষ্টভাষী প্রতারক..., চোখ রাখুন, ফেইসবুক, ইউটিউবে’ এমন আপত্তিকর কথা লেখে। রুবেল ওই ছাত্রীর বাড়ির ঠিকানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভুয়া কাগজ পাঠান বলেও মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
ভুক্তভোগী মো. রুবেল খানের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৫ সালে ফেইসবুকের ম্যাসেঞ্জারে আলাপের মাধ্যমে রুবেল রানার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরে স্ত্রীর চাকরির জন্য দেওয়া ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ফেরত চাইলে প্রতারক রুবেল রানা ফোন নম্বর বদলে ফেলেন। এরপর মেসেঞ্জারে রুবেল রানা জানান, টাকা ফেরত চাইলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের দিয়ে তুলে এনে শায়েস্তা করবেন।
প্রতারক রুবেল রানার ‘জুনায়েদ রুহানী রুবেল’ নামের ফেইসবুক আইডি ঘেঁটে দেখা গেছে, জাতীয় সংসদ ভবনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড করেছেন। পোশাকে ম্যাজিস্ট্রেটদের মনোগ্রাম লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানো অফিসে বসে ছবি তুলে সেই ছবিও ফেইসবুকে আপলোড করেছেন। তার চাকচিক্য দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল হক বলেন, ‘রুবলের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা এলাকায়। তিনি আপাদমস্তক প্রতারক। তার এলাকার বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নাম করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে এত দিন আত্মগোপনে ছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় সরকারের বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে থাকেন। নিজেকে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচয় দিয়ে চাকরি দেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া কখনো কখনো নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপির পিএস হিসেবেও পরিচয় দিয়ে থাকেন।’
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘নিজেকে উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে করোনাকালে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান নিয়েছেন রুবেল রানা। এভাবে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।’
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হয় তিন শতাধিক কর্মকর্তা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন তখন এমএ আজিজ। নন গেজেটেড এ কর্মকর্তাদের নিয়োগ পরীক্ষা নেয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান তারা। তাদের মধ্যে বড় অংশই এখন জ্যেষ্ঠ ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার পদে পদোন্নতি পেয়ে কর্মরত। অন্তত ৩০ জেলা ও কমপক্ষে ১৮০ উপজেলায় জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন ওই কর্মকর্তারা।
অবশ্য আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সিআরআইয়ের তথ্যনুযায়ী এ সংখ্যা আরও বেশি। তাদের অপেশাদার আচরণ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার আশঙ্কা করছে আওয়ামী লীগ।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই সদস্য দেশ রূপান্তরের কাছে উদ্বেগের কথা প্রকাশ করে বলেছেন, ২০০৫ সালে নিয়োগ দেওয়া বেশিরভাগ কর্মকর্তা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। এদের বেশিরভাগই ছাত্রদল অথবা শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক ওই পরিচয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা বড় দুশ্চিন্তার হয়ে উঠতে পারেন। এ কর্মকর্তারা রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এলাকার।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি শাসনামলে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সবসময়ই নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করেছেন। ফলে বিতর্কিত হয়েছে সাংবিধানিক এ কমিশনটি। শুধু নির্বাচন কর্মকর্তাই নয়, ভুয়া ভোটারও বানিয়েছে বিএনপি। বিতর্কিত নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়ে আমরা সতর্ক আছি, কমিশনকে সজাগ থাকতে হবে বেশি।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ের পদে থাকা নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব কর্মকর্তার অপেশাদার দায়িত্ব দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারার এমন ভয় দেখছে দলটি। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারাও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য উদ্বেগের। এসব কর্মকর্তাকে কীভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে পাওয়া যায় সেই কৌশল খুঁজছে ক্ষমতাসীনরা। তা না হলে নিষ্ক্রিয় করারও চিন্তা করেছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ওই নেতারা আরও বলেন, ওই কর্মকর্তাদের অনেকের সঙ্গে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা নতুন করে যোগাযোগ বা সম্পর্ক ঝালাই করতে শুরু করেছেন। তবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সোর্স ওই কর্মকর্তাদের ওপর কড়া নজরদারি করছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনে ভোট বন্ধের যে নজির স্থাপন করেছে নির্বাচন কমিশন, তাতে বিএনপির আমলের নিয়োগ দেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকতে পারে বলে মনে করছে ক্ষমতাসীরা। ওই কর্মকর্তারা নানা নেতিবাচক ঘটনা তুলে ধরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছেন বলে সন্দেহ করছে আওয়ামী লীগ।
ভোট একেবারেই বন্ধ করে দেওয়ার নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দাবি করে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, গাইবান্ধার উপনির্বাচন প্রথম দফায় বন্ধ করার ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ দূরত্ব কমাতে কমিশনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তাতে সায় দেয়নি আওয়ামী লীগের কেউ।
সভাপতিম-লীর ওই নেতা আরও বলেন, ভোট বন্ধ করে দেওয়ার নজির সৃষ্টি করে যে জটিলতা তৈরি করা হয়েছে তা কমিশনকেই দূর করতে হবে এমন অবস্থান নেয় ক্ষমতাসীনরা। তিনি বলেন, অবশেষে নির্বাচন সম্পন্ন করে দূরত্ব কমাতে অনেকখানি সফল হলেও কমিশনের প্রতি এক ধরনের সন্দেহ দানা বেঁধেছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। এসব নানাদিক চিন্তা করে বিএনপির আমলে নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তাদের নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কর্মকর্তাদের নিয়ে গত বছর ৩১ জুলাই নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগও দিয়েছে।
ওই সংলাপে ইসিতে দেওয়া ১৪ প্রস্তাবের মধ্যে ৩ নম্বরে আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং এর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ আচরণ দাবি করে। দলটি বলেছে, ‘এটি সর্বজন স্বীকৃত, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য সব সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে একদিকে যেমন দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত অশুভ জোট সরকারের সময় কর্মকর্তা পর্যায়ে হাওয়া ভবনের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক দলীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওইসব দলীয় ব্যক্তি এখন নির্বাচন কমিশনের আওতাভুক্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত রাখার লক্ষ্যে এ বিষয়ে কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
একই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় দলীয়করণের অংশ হিসেবে পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনে ব্যাপকভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের দেওয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই এখন জেলা পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অথবা দায়িত্ব পাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ। এসব কর্মকর্তার তালিকা প্রস্তুতপূর্বক তাদের সব ধরনের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বাইরে রাখতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংসদের সরকারদলীয় হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে কারচুপি করার অসৎ উদ্দেশ্যে বিএনপি নির্বাচন কমিশন দলীয়করণ করেছিল। তাদের দলীয় ক্যাডারদের দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি করেছিল। ভুয়া ভোটার বন্ধ করা গেছে। কিন্তু বিএনপির নিয়োগকৃত ছাত্রদলের দলীয় ক্যাডারদের চাকরিচ্যুত করা হয়নি। মানবিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হৃদয়ের বিশালতার কারণে তারা বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। পদোন্নতি পেয়ে উচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। এরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।’
অবশ্য তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন সেসব কর্মকর্তার দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা নেন। পরবর্তী সময় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় একটি অংশ চাকরিচ্যুত হয়।
আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে আমরা বিএনপির সময়ে নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তাদের ব্যাপারে আমাদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছি কমিশনকে।’
শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোররাতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। অ্যাম্বুলেন্সটি বরিশাল থেকে রোগী ও স্বজনদের নিয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। পুলিশ বলছে, পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কাছে গতিনিরোধক পার হতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দেয়। এতে অ্যাম্বুলেন্সটি ট্রাকের পেছনে ঢুকে দুমড়েমুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন ছয়জন।
শিবচর হাইওয়ে থানার পরিদর্শক আবু নাঈম মোহাম্মদ মোফাজ্জেল জানান, নিহতরা হলেন পটুয়াখালীর বাউফলের জাহানারা বেগম (৫৫), তার মেয়ে লুৎফুন নাহার লিমা (৩২), তাদের স্বজন ফজলে রাব্বী (২৮), স্বজন নবচেতনা পত্রিকার ব্যুরোপ্রধান মাসুদ রানা (৩৮), অ্যাম্বুলেন্সের চালক রবিউল ইসলাম (২৮) ও তার সহকারী হিরু মৃধা (২৭)।
জাহানারা বেগমের স্বজনরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় থাকতেন লুৎফুন্নাহার লিমা। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে এক বছর আগে বাংলাদেশে আসেন। দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে মা জাহানারা বেগমকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু মায়ের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পথে মায়ের সঙ্গে প্রাণ গেল তারও।
লিমার বাবা লতিফ মল্লিক ২০০০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় থাকেন। ২০১০ সালে বাবার কাছে যান লিমা। পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার লিমা ফ্লোরিডায় একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলেন। তার মা জাহানারা বেগম গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। লিমার মামাতো ভাই রুবেল বলেন, দুই-তিন মাসের মধ্যে মাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল লিমার। জীবনের কী নির্মম বাস্তবতা, মাকে নিয়ে তিনি না-ফেরার দেশে যাত্রা করলেন।
পুলিশ পরিদর্শক আবু নাঈম মোহাম্মদ মোফাজ্জেলের ভাষ্য, চালকের ঘুমের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। তিনি বলেন, বিরতিহীনভাবে দীর্ঘ সময় অ্যাম্বুলেন্স চালানোর কারণে চালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সে কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহত অ্যাম্বুলেন্সচালক রবিউলের ছোট ভাইয়ের বরাত দিয়ে আবু নাঈম মোহাম্মদ মোফাজ্জেল বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সচালক রবিউল গত রবিবার রাত ২টার দিকে ঢাকা থেকে রোগী নিয়ে ভোলা যান। কোনো বিরতি না দিয়ে সোমবার রাতেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন এবং মঙ্গলবার ভোর ৪টা ২০ মিনিটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। হিসাব করলে দেখা যায়, ২৬ ঘণ্টারও বেশি সময় তিনি কোনো বিরতি না দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছিলেন। আমরা ধারণা করছি, টানা ২৬ ঘণ্টা নির্ঘুম থাকায় অ্যাম্বুলেন্স চালানোর সময় তিনি ক্লান্তি অনুভব করছিলেন। তার চোখে ঘুম ছিল। সে কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
পুলিশ পরিদর্শক নাঈম জানান, রবিউল খুলনার চন্দ্রানীমহল উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের কাউসার আলীর ছেলে। পাঁচ বছরের ছেলে ইয়ামিন ও স্ত্রী সোনিয়া আক্তারকে (২৩) নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। থাকতেন ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলা। সোনিয়া চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দ্বিতীয় সন্তানের মুখ না দেখেই না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন রবিউল।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত ব্যক্তিদের দাফনের জন্য ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে টাকা হস্তান্তর করেন।
কামরুল হাসান সোহেল বলেন, ‘আজকের (গতকাল) দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক ও দুঃখজনক। অর্থ দিয়ে তাদের ক্ষতির পরিমাণ কখনোই নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তবুও আমরা মৃতের পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন থেকে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে অর্থ সহযোগিতা দিয়েছি। বেলা ২টার মরদেহগুলো তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে।’
হাইওয়ে পুলিশের ফরিদপুর সার্কেলের এএসপি মো. মারুফ হোসেন বলেন, দুর্ঘটনার পর ট্রাক ফেলে চালক পালিয়ে যান। পুলিশ ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্স উদ্ধার করে শিবচর হাইওয়ে থানায় নিয়ে জব্দ করে রাখে। দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় মামলা হবে।
এদিকে এদিন গোপালগঞ্জ ও মাগুরায় পৃথক দুই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন আরও দুজন। গোপালগঞ্জে বাসচাপায় নিহত হয়েছেন মনির শেখ (৪৪) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী।
গত সোমবার গভীর রাতে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পিজয়পাশায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া হাইওয়ে পুলিশের এটিএসআই শহিদুল ইসলাম দুর্ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, নিহত মনির শেখের বাড়ি সদর উপজেলার চন্দ্রদীঘলিয়া গ্রামে।
এদিকে মাগুরা শহরের ভায়না মোড়ে সোমবার রাতে ট্রাকচাপায় শরিফুল ইসলাম (৫৬) নামে এক প্রকৌশলী নিহত হয়েছেন। শরিফুল মাগুরা সদরের নরসিংহাটি গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে। তিনি মাগুরা সদর উপজেলা স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শহরের ভায়না চোপদারপাড়া এলাকায় বাড়ি করে সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।
এদিকে রাজধানীর বনশ্রীতে ফরাজী হাসপাতালের সামনে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে আশিকুর রহমান আশেক (২৬) নামে একজন নিহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সোয়া ১১টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের মামাতো ভাই নয়ন বলেন, ‘সকালে ফরাজী হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে আমার ভাই গুরুতর আহত হন। আশেক রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে। ঘটনার পর অটোরিকশাচালক পালিয়ে যায়।’
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্প অনুমোদনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাড়াহুড়া করলেও গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভার আলোচ্যসূচিতে আসেনি। ফলে এ মাসে আর প্রকল্পটি অনুমোদনের সম্ভাবনা প্রায় নেই। এ কারণে জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ নিয়ে একধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে।
প্রকল্পটি অনুমোদনের পর প্রস্তুতি নিতে অন্তত ৯ মাস সময় লাগবে বলে ইসি জানিয়েছে। তারা আশা করেছিল, জানুয়ারির মাঝামাঝি প্রকল্পটি অনুমোদন হলে পুরো প্রস্তুতি নিতে পারবে।
পরবর্তী একনেক সভা আবার কবে হবে, সেটা নির্ধারণ করা নেই। এর আগের একনেক সভা হয়েছিল দুই মাস আগে। নতুন প্রকল্প ও সংশোধনী প্রকল্প হাতে আসার পর পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদন হয়ে প্রকল্পগুলো একনেক সভায় তোলা হয়। ইভিএম প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন ইসিতে পাঠিয়েছে। সেটা সংশোধিত হয়ে আবার পরিকল্পনা কমিশনেও এসেছে। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন এ বিষয়ে কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করছে। কমিশনের তরফ থেকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী চাইলে প্রকল্পটি টেবিলে উঠবে।
গতকাল একনেক সভায় প্রকল্পটি টেবিলে ওঠেনি বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছু জানতে চাননি।
প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘ইভিএম আমাদের তালিকায় ছিল না। এটা আইন অনুযায়ী প্রক্রিয়াধীন আছে। যদি এটা অনুমোদন না হয়, তবে সংশ্লিষ্টরা দেখবেন। এটা আমার আওতায় নেই। আমরা নিজেরাও এ বিষয়ে কিছু বলিনি।’
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের লক্ষ্য নিয়ে ‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক নতুন (দ্বিতীয়) প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইসি। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর পর কমিশন কিছু বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে সংশোধন করতে বলেছে।
ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী, আগামী বছরের জানুয়ারির ২৯ তারিখের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইভিএম সেট নির্বাচন উপযোগী করার জন্য ৯ মাস সময়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে ইসি। ইভিএম সেট কেনা, সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউজ নির্মাণ, বিভাগীয় পর্যায়ের ১০টি ওয়্যারহাউজের জন্য জমি কেনা, পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন কেনার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে খরচ জোগানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। ভোটকেন্দ্রে ইভিএম ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট অবকাঠামো তৈরি করতে কমপক্ষে ছয় মাস লাগতে পারে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রপোজাল (প্রস্তাব) দিয়ে রেখেছি। এখন পাস করানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এটি পাস না হলে আমাদের ব্যালটেই যেতে হবে।’ ইভিএম প্রকল্প পাস করানো নিয়ে তাদের অতিরিক্ত তদবির নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
ইসির এই প্রকল্পের মেয়াদ হবে ৫ বছর। এই প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ ইভিএম কেনাসহ ইসি খরচ করতে চায় ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ ২৩ হাজার টাকা। পাঁচ বছর মেয়াদি ইভিএম সংক্রান্ত বর্তমান প্রকল্প (প্রথম) ২০২৩ সালের জুনে শেষ হচ্ছে। ২০১৮ সালে নেওয়া ওই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
প্রথম প্রকল্পের জন্য কেনা দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে ১২ হাজার নষ্ট হয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রকল্পেও খরচের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে। ভোটগ্রহণে ধীরগতি, আঙুলের ছাপ না মেলা, মেশিন নষ্ট হওয়া, কোথাও কোথাও নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগার মতো নেতিবাচক ঘটনাও রয়েছে। তুলনামূলক চিত্রে দেখা গেছে, ইভিএমে ভোটগ্রহণ ব্যালটের চেয়ে কম।
বিপুল খরচ: চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে জাতীয় সংসদের অর্ধেক আসনে ইভিএমের মতো বিতর্কিত পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের ইসির লক্ষ্য ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বাজারদর যাচাই না করেই ২ লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। প্রতিটি ইভিএমের দাম ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। দেশে এখন যেসব ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো কেনা হয় ২০১৮ সালে। তখন প্রতিটি ইভিএমের দাম পড়েছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
এর আগে ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রথমবার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে। প্রথম পর্যায়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১১ হাজার ৫৫৬ টাকা দরে ১৩০ ইউনিট ইভিএম সংগ্রহ করে ওই কমিশন। দ্বিতীয় ধাপে একই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩২ হাজার ৫৪৭ টাকা দরে ৪০০টি ও তৃতীয় পর্যায়ে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) থেকে ৪৬ হাজার ৫০১ টাকা দরে ৭০০টি সব মিলিয়ে ১ হাজার ২৩০ ইউনিট কিনেছিল ড. হুদা কমিশন।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৯৩টি ইভিএম দিয়ে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারের সাধারণ ও উপনির্বাচন করা হয়েছে। নতুন প্রকল্পের জন্য ৫৩৪টি ডবল কেভিন পিকআপ কেনা হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রথম প্রকল্পে থাকা আরও ৪টি জিপ ও ১টি মাইক্রোবাস। এর বাইরেও অতিরিক্ত ৪টি জিপ ও ৬টি মাইক্রোবাস আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিতে চায় ইসি। প্রকল্পের জন্য আনসার সদস্য ছাড়াও জনবল লাগবে ১ হাজার ১৩৫ জন। পাঁচ বছরে ৫টি সেমিনার বাবদ ২ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে চায় ইসি। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ৬ ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। পরামর্শকদের জন্য ৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতিবছরের জন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা চায় ইসি। ইভিএম প্রচারে ১৫ কোটি ৯৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়েছে।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শুধু প্রচারণার জন্যই যদি ১৫ কোটি টাকা ব্যয় করে, সেটি অনেক খরচ বলে আমার মনে হয়। ইভিএম প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয়ে খরচ হবে। কিন্তু এ পরিমাণ হবে বলে আমি মনে করি না। ইভিএম এ ভোট হবে কি না, সেটাই তো চূড়ান্ত না। ইভিএম প্রচারণার জন্য তো বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার আছে। আমি জানি না তারা বন্দুক পাওয়ার আশায় কামান চাইল কি না।’
কতটা কার্যকর হবে ইভিএম : এ পর্যন্ত ইভিএমে যত নির্বাচন হয়েছে, এর বেশির ভাগেই ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশের নিচে। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, কেবল আঙুলের ছাপ মুছে যাওয়াজনিত সমস্যা নয়, অনেক সময় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ঠিকমতো প্রশিক্ষণ না নেওয়ার কারণে ভোটের ধীরগতি হয়। অনেক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিজেই কারিগরি বিষয় ভালো বোঝেন না। যে কারণে তারা ভোটের দিন কিছুটা পিছিয়ে থাকেন।
সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক কম। এসব নির্বাচনে গড়ে ২৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। অন্যদিকে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। এসব নির্বাচনে গড়ে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ। ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে ধীরগতি।
গত বছর ৫ নভেম্বর ফরিদপুর-২ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম, ভোট পড়েছে মাত্র ২৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। একই অবস্থা দেখা যায়, গাইবান্ধা উপনির্বাচনে। এখানে ভোট পড়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ।
আঙুলের ছাপ না মেলায় বিপাকে পড়তে হয়েছে অনেককে। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ের পরে গিয়েও ভোট নিতে হয়ে ভোটারদের।
গত ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশনে ভোট হয়। এই নির্বাচনে ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। সেখানে ইভিএমে ভোটগ্রহণ বেলা সাড়ে ৪টায় শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হয় রাত ৮টায়।
ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল। রংপুরের ভোট শেষে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তুলনামূলকভাবে ইভিএমটা ব্যালটের চেয়ে সেøা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলছিল না। কেন ভোট বিলম্বিত হচ্ছে, অভিযোগটা এর আগে আমরা কখনো পাইনি। এটা আমাদের খুব উদ্বিগ্ন করে তুলল।’
২০১১ সালে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোটগ্রহণ চালু করে। ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম বিকল হয়ে পড়ে। ওগুলো কেনা হয়েছিল বুয়েটের কাছ থেকে।
তবে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে জটিলতা হবে না বলে মনে করেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘তরুণদের ইভিএম নিয়ে জটিলতায় পড়তে হবে না। কারণ তারা এ বিষয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু যারা সিনিয়র সিটিজেন (বয়স্ক) রয়েছেন, তাদের ভোটদানে একটু জটিলতা হতে পারে।’ ইসি চাইলে এ জটিলতা নিরসন করতে পারে, তাদের কাছে যথেষ্ট সময় রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক মনিরা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় নির্বাচনে যতটা মানুষের আগ্রহ ছিল, সংসদীয় উপনির্বাচনে সে আগ্রহ ছিল না। এ কারণে উপনির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ভোট দিতে আসে। সেখানে কিন্তু বর্তমানে ইভিএম নিয়ে যে সংকট দেখা দিচ্ছে, সেটা প্রকট হতে পারে।’
প্রতি বছরই নানা ধরনের পরিমার্জন করা হলেও পাঠ্যবইয়ে থেকেই যাচ্ছে ভুল আর অসংগতি। কিন্তু দীর্ঘ পরিকল্পনা ও যাচাই-বাছাই শেষে এ বছর থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের বইয়ে ভুলত্রুটি খুবই কম থাকবে সেটাই আশা ছিল সবার। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের ভুল আর অসংগতি চোখে পড়ছে। এতে অনেকটাই হতাশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
এ বছরের মাধ্যমিক স্তরের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির ‘Science Exercise Book’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের অনেক প্যারাগ্রাফ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট ‘nationalgeographic.org’ থেকে নেওয়া হয়েছে। কিছু প্যারাগ্রাফ ওয়ার্ড-বাই-ওয়ার্ড কপি করা হয়েছে। এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে ‘বায়োডায়ভারসিটি’ অধ্যায়ে ৫ নম্বর পৃষ্ঠার প্রায় বেশিরভাগ লেখাই হুবহু কপি করা হয়েছে। আর ৩ নম্বর পৃষ্ঠার কিছু অংশও কপি করা হয়েছে। এভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন বইতে অসংখ্য বানান ভুল ও বাক্য গঠনে অসংগতি পাওয়া গেছে।
এ বইটির লেখক প্যানেলে ছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. হাসিনা খান, ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান খান, ড. মুশতাক ইবনে আইয়ূব ও রনি বসাক। আর সম্পাদনা করেছেন ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণির ‘Science Exercise Book’ বইয়ের একটি অংশ ‘ইন্টারনেট থেকে হুবহু কপি করা হয়েছে’ বলে যে অভিযোগ উঠেছে তার দায় স্বীকার করেছেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।
জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ের কোথায় কোথায় ভুলত্রুটি আছে তা খুঁজতে ইতিমধ্যে একটি কমিটি কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে একাধিক কমিটি মার্চ মাসে স্কুলে স্কুলে ঘুরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত সংগ্রহ করবে। আগামী বছরের বই পরিমার্জনে তাদের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে। যতটা নির্ভুল পরিমার্জন করা যায়, সেটা আমরা করব।’
সূত্র জানায়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৫ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং দশম শ্রেণি যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি যুক্ত হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রায় তিন বছর আগে কাজ শুরু হয়। ২০২২ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর কথা ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও যথাযথ পা-ুলিপি তৈরি না হওয়ায় তা শুরু করা যায়নি। তবে ওই বছর কিছু স্কুলে পাইলটিং করা হয়। এরপর এ বছর থেকে তিনটি শ্রেণিতে তা চালু করা হয়।
নতুন শিক্ষাক্রমের একাধিক বই বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের ব্যাক কভারে লেখা হয়েছে, ‘Government of the Peoples’ Republic of Bangladesh’. কিন্তু বাংলাদেশের অফিশিয়াল নাম ‘Government of the People’s Republic of Bangladesh’. এ ছাড়া এই শ্রেণির একাধিক বইয়ের অনেক জায়গায় একই শব্দের একেকভাবে লেখা হয়েছে। যেমন কেন/কেনো, পড়/পড়ো, নিচে/নীচে, যে কোন/যেকোন ইত্যাদি।
নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের নানা ভুলত্রুটি খুঁজে বের করেছেন মাসুম হাসান নামের একজন শিক্ষক। তিনি এতে ৪৮টি ভুল পেয়েছেন। এই বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় ‘লিটল থিংস’ কবিতাটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে কবির নাম দেওয়া হয়নি। অথচ এই বহুল প্রচলিত কবিতাটি লিখেছেন আমেরিকান কবি জুলিয়া অ্যাবিগেল ফ্লেচার কার্নি। একইভাবে ১০১ পৃষ্ঠায় ‘মাই বুকস’ কবিতাটিতেও কবির নাম নেই।
এ ছাড়া বইটির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় বানান, বাক্য গঠন ও গ্রামারের ব্যবহারে অসংখ্য ভুল রয়েছে। ১৭ নম্বর পৃষ্ঠার ৮ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে agesz, সঠিক হবে ধমবং. ১৮ পৃষ্ঠার ১১ নম্বর লাইনে আছে things, হবে Things. ২৩ পৃষ্ঠার ৭ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘প্রাত্যাহিক’, সঠিক হবে ‘প্রাত্যহিক’। ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় মোটা অক্ষরে লেখা হয়েছে anoter, সঠিক হবে other. ৪০ পৃষ্ঠায় ১১ ও ১২ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে dinner, হবে supper. ৪৪ পৃষ্ঠায় ৭ নম্বর লাইনে আছে hand, হবে hands. ৫২ পৃষ্ঠায় ২ নম্বর লাইনে আছে his head, হবে her head. ৬৯ পৃষ্ঠায় ২৩ নম্বর লাইনে আছে Modal verb, হবে Modal verbs. ৮০ পৃষ্ঠায় ১ নম্বর লাইনে আছে has recently transferred, হবে has recently been transferred এবং ৫ নম্বর লাইনে আছে যব attends, হবে she attends. ৮২ পৃষ্ঠায় ১৭ নম্বর লাইনে আছে conversion, হবে conversation. ৮৪ পৃষ্ঠায় ১৮ নম্বর লাইনে আছে younger, হবে youngers. ৮৫ পৃষ্ঠায় ৬ নম্বর লাইনে আছে word means, হবে words mean. ৯২ পৃষ্ঠার নিচ থেকে ৩ নম্বর লাইনে লেখা parent’s, হবে parents. ১০২ পৃষ্ঠার নিচ থেকে ২ নম্বর লাইনে লেখা word, হবে words. ১০৪ পৃষ্ঠার ১০ নম্বর লাইনে লেখা ‘You’, হবে ‘you’ এবং শেষ লাইনে আছে ণড়ঁ, হবে ুড়ঁ. ১০৬ পৃষ্ঠার চিঠিতে শুরুতেই লেখা হয়েছে Assalamu Alaaikum, স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম বাদে অন্যান্য ধর্মের শিক্ষার্থী এ শব্দটি গ্রহণ করবে না। একই পৃষ্ঠায় নিচ থেকে ৩ নম্বর লাইনে আছে ঈড়ারফ, হবে ঈঙঠওউ.
১০৮ পৃষ্ঠায় ২ নম্বর লাইনে লেখা ওভ, হবে রভ এবং ৪ নম্বর লাইনে আছে Dear madam/sir, হবে Dear Madam/Sir. ১০৯ পৃষ্ঠায় ৫ ও ১৮ নম্বর লাইনে আছে expressions, হবে Expression. ১১০ পৃষ্ঠার নিচ থেকে ৭ নম্বর লাইনে আছে ‘অংশ গ্রহণ’ হবে ‘অংশগ্রহণ’। ১৩১ পৃষ্ঠায় নিচ থেকে ৯ নম্বর লাইনে আছে oldest, হবে eldest. ১৩৩ পৃষ্ঠায় নিচ থেকে ২ নম্বর লাইনে লেখা ‘কার্য্যক্রম’, লেখা উচিত ‘কার্যকলাপ বা কর্মকা-’ এবং নিচ থেকে ১ নম্বর লাইনে আছে ‘শ্রেনি’, হবে ‘শ্রেণি’। ১৩৪ পৃষ্ঠায় ৯ নম্বর লাইনে আছে ‘তাছাড়াও’, লেখা উচিত ‘এছাড়াও বা তাছাড়া’ এবং একই লাইনে আছে ‘বৈশিষ্ট্যবলী’ তবে লেখা উচিত ‘বৈশিষ্ট্যগুলো’।
১৩৮ পৃষ্ঠার নিচ থেকে প্রথম লাইনে আছে Eid-al-Azha, হবে Eid-al-Adha. ১৩৯ পৃষ্ঠার ৩ ও ৪ নম্বর লাইনে আছে each other, হবে one another. ১৪২ পৃষ্ঠার ৬ নম্বর লাইনে আছে I ate, হবে I have eaten. ১৪৫ পৃষ্ঠার ১০ নম্বর লাইনে আছে each othe's, হবে one another's. ১৪৮ পৃষ্ঠার ১৪ নম্বর লাইনে আছে ‘শব্দলোর’, হবে ‘শব্দগুলোর’। ১৪৯ পৃষ্ঠার ১৪ নম্বর লাইনে আছে Four Friend's, হবে Four Friends এবং একই লাইনে আছে ‘খুজে’, হবে ‘খুঁজে’। ১৫১ পৃষ্ঠার ৭ নম্বর লাইনে লেখা আছে ‘সব বন্ধু-বান্ধবদেরকে’, লেখা উচিত ‘সব বন্ধুকে’ এবং একই লাইনে আছে ‘উৎসবমূখর’, হবে ‘উৎসবমুখর’। ১৫৬ পৃষ্ঠার নিচ থেকে ১০ নম্বর লাইনে আছে it’s paws, হবে its paws. ১৬০ পৃষ্ঠার ৫ নম্বর লাইনে লেখা religion, হবে religions. ১৬৪ পৃষ্ঠার ৬ নম্বর লাইনে listening, হবে listening to. ১৬৫ পৃষ্ঠায় নিচ থেকে ২ নম্বর লাইনে লেখা ‘কৃত্তিমভাবে’, হবে ‘কৃত্রিমভাবে’। আর ১৬৭ পৃষ্ঠার ৫ নম্বর লাইনে আছে Celerate, হবে Celebrate এবং নিচ থেকে ২ নম্বর লাইনে আছে Starring, হবে Staring.
শুধু নতুন শিক্ষাক্রমই নয় পুরনো কারিকুলামের বইতেও রয়েছে অনেক ভুল। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালায় ও নৃশংসভাবে গণহত্যা ঘটায়।’ এখানে তথ্যগত দুটি ভুল আছে। প্রকৃতপক্ষে রাজারবাগে ছিল পুলিশ লাইনস, আর পিলখানায় ছিল ইপিআর সদর দপ্তর। গত বছরের বইয়েও একই ভুল ছিল। একই শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা আছে, ‘১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।’ এ তথ্যও সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। একই বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যা’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’ প্রকৃত তথ্য হলো, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা শুরু হয় ২৫ মার্চ কালরাতে।
গতকাল নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় এবং পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ে মোট ৯টি সংশোধনী দিয়েছে এনসিটিবি। এতে মূলত ইতিহাসভিত্তিক কিছু তথ্যের সংশোধন করা হয়েছে।
ড. জাফর ইকবাল ও ড. হাসিনা খানের বিবৃতি : গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে ড. জাফর ইকবাল ও ড. হাসিনা খান বলেন, একই পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে অনেকে জড়িত থাকেন, যাদের শ্রম ও নিষ্ঠার ফল বইটি। বিশেষত জাতীয় পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে এসব লেখকের কাছ থেকেই একধরনের দায়িত্বশীলতা আশা করা হয়। সেখানে কোনো একজন লেখকের লেখা নিয়ে এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তা আমাদের টিমের জন্য হতাশা ও মন খারাপের কারণ। ওই অধ্যায়ের আলোচিত অংশটুকু লেখার দায়িত্বে আমরা দুজন না থাকলেও সম্পাদক হিসেবে এর দায় আমাদের ওপরও বর্তায়, সেটি আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি। অবশ্যই পরবর্তী সংস্করণে বইটির প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করা হবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ বছর বইটির পরীক্ষামূলক সংস্করণ চালু হয়েছে এবং সামনের শিক্ষাবর্ষ থেকে এতে যথেষ্ট পরিমার্জন ও সম্পাদনার সুযোগ রয়েছে। কাজেই উল্লিখিত অভিযোগের বাইরেও যেকোনো যৌক্তিক মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হবে এবং সে অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হবে।
বিদেশি ওমরাহ হাজিদের জন্য সমন্বিত বীমা ব্যয় ২৩৫ সৌদি রিয়েল থেকে কমিয়ে ৮৭ সৌদি রিয়েল করেছে সৌদি সরকার। যা চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে বিদেশি ওমরাহ হাজিদের ব্যয় ১৪৮ সৌদি রিয়েল বা ৬৩ শতাংশ হ্রাস পেল। গালফ নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে একটি ঘোষণা দিয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘ওমরাহ’র এ বীমা পলিসিটি একটি সমন্বিত পলিসি, যার মাধ্যমে সৌদি আরবের বাইরে থেকে ওমরাহ করতে আসা হাজিদের জন্য কার্যকর হবে।
সৌদি আরবে যাওয়ার আগে ভিসা প্রসেসিংয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এ বীমা পলিসির মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবে অবস্থানকালে চিকিৎসা, হাসপাতালে ভর্তি, চিকিৎসা, গর্ভাবস্থায় চিকিৎসা, জরুরি প্রসব, জরুরি দাঁতের চিকিৎসা, ট্রাফিক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা, ডায়ালাইসিস এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ চিকিৎসা স্থানান্তরের মতো জরুরি অবস্থা।
এ বীমাটি মূলত দুর্ঘটনাজনিত স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মৃত্যু, মৃত ব্যক্তির দেহ তার দেশে ফেরত দেওয়া এবং আদালতের রায়ের মাধ্যমে জারি করা মামলার ক্ষতিপূরণের মতো সাধারণ মামলাগুলোও কভার করে। এর মধ্যে ফ্লাইট বিলম্বের ক্ষতিপূরণ ও ফ্লাইট বাতিলের ক্ষতিপূরণও অন্তর্ভুক্ত। হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ বীমার মেয়াদ সৌদি আরবে প্রবেশের দিন থেকে ৯০ দিন কার্যকর থাকবে।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’