
সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পাঁচ দিনের মাথায় বাড়ানো হলো গ্যাসের দাম। পরিবহনে ব্যবহৃত সিএনজি, আবাসিক, সার ও চা শিল্প ছাড়া অন্য খাতে গ্যাসের দাম ১৪ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গতকাল বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। নতুন দাম ফেব্রুয়ারিতে কার্যকর হবে।
গত ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ায় বিদ্যুৎ বিভাগ, যা চলতি মাসে কার্যকর হয়েছে। আর গণশুনানির মাধ্যমে সর্বশেষ গত ৪ জুন সব শ্রেণির গ্রাহকের গ্যাসের দাম গড়ে ২২.৭৮ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে চলতি মাসে দুই দফা বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বেড়েছে কোনো ধরনের গণশুনানি ছাড়াই।
নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৫.০২ থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছে। শিল্পকারখানায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত বিদ্যুতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং বাণিজ্যিক (হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য) খাতে ২৬.৬৪ থেকে বাড়িয়ে ৩০.৫০ টাকা করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে শিল্প খাতে। বর্তমানে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র (কুটির ও অন্যান্য) শিল্পে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম যথাক্রমে ১১.৯৮, ১১.৭৮ এবং ১০.৭৮ টাকা। তবে সরকারের নির্বাহী আদেশে সব ধরনের শিল্পে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, প্রতি ঘনমিটার সিএনজির মূল্যহারের মধ্যে ফিড গ্যাসের মূল্যহার ৩৫ ও অপারেটর মার্জিন ৮ টাকা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ ছাড়া আবাসিক ছাড়া অন্যান্য শ্রেণির গ্রাহককে প্রতি ইউনিট অনুমোদিত লোডের বিপরীতে মাসিক ১০ পয়সা হারে ডিমান্ড চার্জ দিতে হবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রমতে, গত ডিসেম্বরে পাইকারি দাম বৃদ্ধির পরও লোকসান করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য সরকার এ বছর ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে। বর্তমান দামে কয়লা, জ্বালানি তেলসহ সব জ্বালানি পেলেও পিডিবির ঘাটতি হতে পারে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এখন গ্যাসের দাম বাড়ায় তা আরও বেড়ে যাবে। তাই আবার বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম। কারণ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫১.০৮ শতাংশ আসে গ্যাসচালিত কেন্দ্র থেকে।
এতদিন গণশুনানির মাধ্যমে শুধু বিইআরসি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত। কিন্তু বিইআরসির পাশাপাশি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ যাতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতে পারে সে জন্য চলতি মাসে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
এর আগে গত ২৮ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। গত ১ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২’ জারি করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এ অধ্যাদেশ বলে বিইআরসির পাশাপাশি সরকার চাইলেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়াতে বা কমাতে পারবে।
ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ার ফলে জনজীবন অতিষ্ঠ। গতকাল বুধবার আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে দৈনন্দিন ব্যয়ের পাশাপাশি জনদুর্ভোগ আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকার বলছে, ভর্তুকি সমন্বয় ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের ভুলনীতি ও কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এর মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সরকার আন্তরিক হলে দাম না বাড়িয়ে বিকল্প কোনো পথেও যেতে পারত।
জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দাবি করছে, গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর তা ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু খোদ সরকারি আরেক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসেবেই দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে।
বিবিএস সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম কমেছে দাবি করলেও বাজারের চিত্র পুরোটাই উল্টো। বরং টিসিবির এক মাসের হিসাবে প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়েছে।
বিবিএসের হিসেবেই গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ক্রমেই বাড়ছে। নভেম্বরে তা ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি গ্রামে লাগামছাড়া। নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি দেখিয়ে গত বছর আগস্টে সরকার অস্বাভাবিকহারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়। ওই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা বাড়িয়ে একলাফে ১১৪, পেট্রোল ৮৬ থেকে ১৩০ এবং অকটেনের দাম ৮৯ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে কয়েক দিনের মাথায় লিটারপ্রতি দাম ৫ টাকা কমিয়ে যথাক্রমে ১০৯, ১২৫ ও ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। পরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফা কমলেও দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেনি।
তেলের মূল্যবৃদ্ধির ধকল সামলাতে না সামলাতেই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দেয় বিতরণ কোম্পানি। তা নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি গণশুনানিও শুরু হয়। কিন্তু কমিশনের মূল্যবৃদ্ধির এ প্রক্রিয়া শেষ হতে না হতেই ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ বিভাগ বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে যা চলতি মাস থেকেই কার্যকর হয়েছে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। সপ্তাহ না ঘুরতেই গণশুনানি ছাড়াই গতকাল আবারও নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম খাতভেদে ১৪ থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়ায় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এ মূল্যবৃদ্ধি একেবারেই অযৌক্তিক মনে করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক ভালো বিকল্প থাকলেও সরকার সে পথে যায়নি। এখন বলা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ঘাটতি মেটাতে দাম বাড়ানো হচ্ছে। অথচ জ্বালানি খাতের এ দূরবস্থার জন্য সরকার নিজেই দায়ী।’
‘বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী অনেক আগে থেকেই বিদেশ থেকে চড়া দামে এলএনজি আমদানির কথা বলে আসছেন। তিনি যতদিন ধরে এটা বলছেন, সেই সময়ের মধ্যে সরকার আন্তরিক হলে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলন করে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে পারত। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। কিন্তু সরকার তা না করে কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এটা বড় অপরাধ। আর এ অপরাধের দায় বারবার পড়ছে জনগনের কাঁধে’ যোগ করেন তিনি।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে কিছু গোষ্ঠীকে যে পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে তা পদ্মা সেতুর ব্যয়ের দ্বিগুণ। অনেক কম খরচে দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান না করে চড়া দামে এলএনজি আমদানিতে আগ্রহ বেশি সরকারের। কিন্তু এলএনজির দাম দিন দিন বাড়তেই থাকবে। সবকিছু করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। জেনেশুনে কিছু মানুষকে লাভবান করতে গিয়ে দায় মানুষের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।’
সূত্রমতে, ২০১৯ সালে দৈনিক ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম ৩২ শতাংশের কিছু বেশি বাড়ানো হয়। যদিও পরে সরকার আমদানি ততটা করেনি। এ কারণে বাড়তি আদায় করা ৯ হাজার কোটি টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয় জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। পেট্রোবাংলা সেই টাকা ফেরত দেয়নি।
২০২২ সালে আবারও দিনে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। বিইআরসি গত জুনে ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। তখন আমদানি ধরা হয়েছিল দিনে ৬৮ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরকার পরের মাস জুলাইয়ে খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয়। এতে এলএনজি সরবরাহ কমে যায়। সেটা একসময় দৈনিক ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে যায়। এখন দিনে এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ার প্রভাবে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়বে ক্রেতার ওপর। এমনিতেই গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে কারখানায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। নতুন করে এত দাম বাড়ার কারণে শিল্পমালিকরা দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে গেলেন। এরপরও যদি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়া যেত তাতেও ক্ষতি কিছুটা কমানো যেত। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা এখনো দিতে পারেনি। সামগ্রিকভাবে এ দাম বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশ-বিদেশে সবখানে।’
“আমাদের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। দফায় দফায় দাম বাড়ার ফলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে এখন ‘ফরেন কারেন্সির’ ব্যাপক সংকট চলছে। এ সময়ে যদি রপ্তানি আয় কমে যায় তাহলে সংকট আরও বাড়বে। তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে” বলেন তিনি।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, “সরকার এখন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এ জন্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা দরকার। এ টাকা সমন্বয় করে গ্যাস-বিদ্যুতের যে দাম হবে তা সোনার চেয়েও দামি হবে। এ পরিস্থিতিতে চড়া দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন মুনাফায় রয়েছে। এখন দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। করোনায় এমনিতেই মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। তারা এ মূল্যবৃদ্ধির চাপ নেওয়ার অবস্থায় নেই।’
সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় জানতে চাইলে এ জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘প্রথমত বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে বাণিজ্যিকীকরণ মুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত নিজস্ব জ¦ালানি সম্পদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সাশ্রয়ী হতে হবে। সর্বশেষ উপায় হলো, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক সব ব্যয় বন্ধ করতে হবে। তবেই সংকট কমবে। না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।’
কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পণ্যের বাড়ানোর কারণে সরকারের ভর্তুকি বেড়েছে। এখন সেই ভর্তুকি ব্যয় কমবে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কিছু বাড়বে। সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে। সরকারকেও এ ব্যাপারে সহায়তা করতে হবে। ভর্তুকি কমিয়ে সরকারের যে অর্থ সাশ্রয় হবে তা দিয়ে নাগরিক সুবিধা বাড়াতে হবে। আরও বেশি উন্নয়ন করতে হবে, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’
‘আমরা যেহেতু আত্মনির্ভরশীল হতে চাই, তাই ভর্তুকি থেকে আস্তে আস্তে বের হতে হবে। কারণ কভিড-পরবর্তী চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও কম। ভর্তুকি কমিয়ে দেশের উন্নয়ন হলে সেটা অবশ্যই ভালো। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে’ বলেন তিনি।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর গতকাল রাতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ গণমাধ্যমে পাঠানো ব্যাখ্যায় বলেছে, ভর্তুকি সমন্বয় ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের দাবি, বর্তমান বৈশ্বিক বিশেষ জ্বালানি পরিস্থিতিতে ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী সব ধরনের জ্বালানির মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। জ্বালানিসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়, যেমন বীমা খরচ, ঝুঁকি ব্যয়, ব্যাংক সুদ, ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ায় সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এলএনজির আমদানি মূল্যও অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছিল।
চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং রপ্তানিমুখী বিভিন্ন কলকারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে করণীয় সম্পর্কে সব অংশীজনের মতামত গ্রহণ করা হয়। যেহেতু স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানিপূর্বক ওই বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে হবে, সে কারণে সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বান্দরবানের তমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন ‘আরসা ও আরএসও’ এর মধ্যে দিনভর গোলাগুলির পর আশ্রয় শিবিরটিতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে শত শত ঘর পুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল বুধবার সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত আশ্রয় শিবিরটিতে ‘আরসা ও আরএসও’ এর মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি চলছিল। গুলিতে কমপক্ষে ৩ রোহিঙ্গা নিহত এবং কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
আগুনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করলেও হতাহত কিংবা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেননি। ক্যাম্পে আগুন লাগার পর ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কিছু রোহিঙ্গা পরিবার শূন্যরেখার আশ্রয় শিবির ছেড়ে তমব্রু বাজার এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে বলে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। আবার অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলে গেছেন। তমব্রু বাজার এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে বিজিবির সদস্যরা কড়া নিরাপত্তায় ঘিরে রেখেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসব রোহিঙ্গাকে শূন্যরেখায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ঘটনাস্থল শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হওয়ায় আন্তর্জাতিক রীতি মতে প্রশাসন বা বিজিবিসহ সীমান্ত সংশ্লিষ্টরা ঘটনার প্রকৃত কারণ ও চিত্র সম্পর্কে সম্যক অবগত নন। একই কারণে ঘটনার ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সীমান্তে উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি কড়া সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
জানা গেছে, গতকাল সকাল ৬টার পর থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ঘুমধুমের তমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি চলে। এতে কমপক্ষে ৩ রোহিঙ্গা নিহত হন। তাদের মধ্যে একজন হামিদ উল্লাহ (২৭)। অন্য দুইজনের মরদেহ পাওয়া গেলেও নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শিশুসহ দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা হলো- টেকনাফের ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৫ ব্লকের বাসিন্দা দিলদার আহমদের ছেলে মুহিব উল্লাহ (২৫) ও তমব্রু কোনারপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর হোসেনের ছেলে মো. হোসেন (১২)। নিহতদের লাশ উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন। প্রথম দফার গোলাগুলি শেষে বিকেল ৫টার দিকে ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগে। কে বা কারা আশ্রয় শিবিরটির কিছু ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সেখানে আগুন জ্বলছিল। একইসঙ্গে থেমে থেমে চলছিল গোলাগুলি।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিকেল ৫টার দিকে তমব্রু শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বসতঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই ক্যাম্পে আশ্রয়রত রোহিঙ্গাদের অনেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলে গেছেন। গোলাগুলির শব্দ আগের চেয়ে বেড়েছে। স্থানীয়রা চরম আতঙ্কে রয়েছেন।’
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোমেন শর্মা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘বিস্তারিত খবর নিয়ে জানাতে হবে। তবে স্থানীয়দের দাবি মিয়ানমানের দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে।’
উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘তমব্রু সীমান্তে শূন্যরেখা থেকে ওই দুজনকে উদ্ধার করে কুতুপালং ক্যাম্পের পাশে এমএসএফ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হামিদ উল্লাহকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে গোলাগুলিতে হামিদ উল্লাহ নামে একজনের মৃতদেহ উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে রয়েছে। সেখানে গুলিবিদ্ধ শিশুসহ আহত আরও ২ জন চিকিৎসা নিচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নিচ্ছি।’
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন বান্দরবান প্রতিনিধি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়লেও মূল্যস্ফীতি আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। গ্যাস যে মূল্যে কেনা হবে, সেই মূল্য গ্রাহককে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে দাম বাড়তে পারে।’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশ কোনো শর্ত দিয়ে ঋণ নিচ্ছে না বলেও জানান তিনি। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আইএমএফ কেবল তখনই (যেকোনো দেশকে) ঋণ দেয়, যখন দেশটি ঋণ পরিশোধের যোগ্যতা অর্জন করে। আমরা তো তেমন কোনো শর্ত দিয়ে ঋণ (আইএমএফ থেকে) নিচ্ছি না।’
তিনি বলেন, (রাশিয়া-ইউক্রেন) যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। তারপরও সব মানুষ খাদ্য যাতে কম দামে পায়, সে ব্যবস্থা করেছি আমরা। যারা কিছুই করতে পারে না, তাদের জন্য বিনা মূল্যে খাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষিতেও ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তো বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি দিচ্ছি। আমার প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর কোন দেশ গ্যাস আর বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়? কেউ দেয় না।’
শিল্পকারখানার মালিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চাইলে যে মূল্যে কিনে আনব, সেই মূল্য তাদের দিতে হবে। এখানে ভর্তুকি দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
সংসদ সদস্য এম আব্দুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সরকার জোর দেওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য টিসিবির ফেয়ার প্রাইস কার্ড দিয়ে দিয়েছি। যেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল কিনতে পারে। তেল, চিনি, ডাল সীমিত আয়ের মানুষ ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারে। সেই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছি। এর থেকে যারা নিম্ন আয়ের, তাদের জন্য আমরা ১৫ টাকায় চাল দিচ্ছি। সেই সঙ্গে তেল, ডাল ও চিনিও দেওয়া হচ্ছে। আর একেবারে হতদরিদ্র যারা কিছুই করতে পারে না, তাদের বিনা পয়সায় খাদ্য সরবরাহ করছি। স্বল্প আয়ের মানুষ যাতে কষ্টে না পড়ে, সেদিকে দৃষ্টি রেখে এই ব্যবস্থা করছি। কৃষিতে আমরা ব্যাপকভাবে ভর্তুকি দিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ হচ্ছে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি। এটা একটা উন্নত দেশের কথা বললাম। পৃথিবীর সব দেশে এ অবস্থা বিরাজমান। বাংলাদেশ এখনো সেই অবস্থায় পড়েনি।’ ভর্তুকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণ; বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে যদি ৪০, ৫০ ও ৬০ হাজার কোটি টাকা আমাকে ভর্তুকি দিতে হয়, তাহলে সেটা কী করে দেব? এর ফলে দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার যে চেষ্টা, সেটা করে কিছুটা সফলতা দেখাতে পেরেছি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।’
সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবনে বিদ্যুতের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছি। এভাবে যদি সবাই উদ্যোগ নেয়, তাহলে বিদ্যুৎ ব্যবহার সাশ্রয়ী হতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ টেনে জাপার এমপি চুন্নু বলেন, ‘ডোনাল্ড লু পাকিস্তান সফরের পর তেহরিক-ই-ইনসাফ ক্ষমতাচ্যুত হয়। তিনি বাংলাদেশে আসার পরে অনেকে মনে করেছিল সরকারের কিছু একটা হবে। জানি না, তিনি যাওয়ার পরে সরকারকে খুব খুশি খুশি লাগছে। আবার একটি দল মনে হয় খুবই অখুশি। আমরা জাতীয় পার্টি এটাকে ওভাবে নিচ্ছি না। এটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছি। রাজনৈতিকভাবে বর্তমান যে অবস্থাটা মানুষের মাঝে একটি গুঞ্জন আছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কারণে কিছু একটা যেন হয়। এ ধরনের কিছু আছে কি না?’ একপর্যায়ে তার বক্তব্য চলাকালেই মাইক বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী তার এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি।
সর্দি-জ¦রে আক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সংসদে এম আব্দুল লতিফের মৌখিক প্রশ্নের দীর্ঘ ১৭ পৃষ্ঠার জবাব দেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে উত্তর দিতে গিয়ে তিনি কিছুটা অসুস্থ বোধ করেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার অস্থির লাগছে।’ এরপর বসে উত্তর দেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে অনুরোধ করেন। তবে তিনি বসে তার বক্তব্যের বাকি অংশ পঠিত বলে গণ্য করার অনুরোধ করেন।
আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা নিশ্চিত করার কাজ চলছে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তার সরকার সবার জন্য বিশ^মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। সবাই যাতে আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবা পায় তার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ সারা দেশের ১৩টি জেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও ৪৫টি কমিউনিটি ভিশন সেন্টার উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি তৃতীয় ধাপে এই কমিউনিটি ভিশন সেন্টারগুলোর উদ্বোধন করেন। যার মাধ্যমে এর সংখ্যা ১৩৫-এ পৌঁছেছে।
সরকারপ্রধান রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন। পাশাপাশি অনুষ্ঠানে ভোলার চরফ্যাশন, বরগুনার আমতলী, চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং কক্সবাজারের পেকুয়ার কমিউনিটি ভিশন কেন্দ্রগুলোয় ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন। সেখানে তিনি উপকারভোগীদের সঙ্গে পরে মতবিনিময়ও করেন।
৪৫টি কমিউনিটি ভিশন সেন্টার উদ্বোধনের পর শেখ হাসিনা বলেন, তিনি এর আগে দুই ধাপে ৯০টি কেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন এবং সব মানুষকে বিনা মূল্যে আধুনিক ও উন্নত চক্ষু চিকিৎসার আওতায় আনার জন্য পর্যায়ক্রমে সারা দেশে কমিউনিটি ভিশন সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা তার সরকারের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কমিউনিটি ভিশন সেন্টার থেকে চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই অন্ধ হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা কমিউনিটি ভিশন সেন্টারের কার্যক্রম সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেন।
অনুষ্ঠানে কমিউনিটি আই ভিশন সেন্টার থেকে বিনা মূল্যে চোখের চিকিৎসা প্রদানসংক্রান্ত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
কমিউনিটি ভিশন সেন্টার থেকে এ পর্যন্ত ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৭৭ ব্যক্তি চোখের চিকিৎসা নিয়েছে এবং ২ লাখ ১০ হাজার ৮৬৮ জন কেন্দ্র থেকে বিনা মূল্যে চশমা পেয়েছেন।
আ.লীগ নিজে কী পেল তা নিয়ে কখনো ভাবে না : প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণের জন্য কাজ করে তার দল কী পেল, তা নিয়ে কখনোই ভাবে না; বরং জনগণের কল্যাণে তারা কী করতে পারে, তাই বিবেচনা করে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় উদ্বোধনকালে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ও এর জনগণের জন্য কী করতে পারলাম তা বিবেচনায় আমরা ১৪ বছরে দেশ ও এর জনগণের ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন করেছি।’ তিনি গতকাল সকালে তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি আওয়ামী লীগের এ কার্যালয় উদ্বোধন করেন।
আওয়ামী লীগকে গণমুখী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে সরকারপ্রধান বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের পাশে থাকবে। তার সরকার ও দলের নেতা-কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৪ বছরে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে এবং জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরনের পরিষেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। তার দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনায় দেশবাসী ও জনগণকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।
গাজীপুরে টাকার জন্য পুলিশের নির্যাতনে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর অভিযোগ এনে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী। গতকাল বুধবার সকাল ১০টা থেকে ভোগড়া এলাকায় শুরু হওয়া ওই বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ বক্সে হামলা এবং পুলিশের চারটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় দুই ঘণ্টা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।
মারা যাওয়া ব্যবসায়ীর নাম রবিউল ইসলাম (৪৫)। তিনি গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া বাইপাস পেয়ারাবাগান এলাকার বাসিন্দা। পেশায় ছিলেন সুতা ব্যবসায়ী। তার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জের শাহজাদপুর গ্রামে। বাবার নাম আব্দুল বাকী। রবিউলের ইসরাত (১০) ও নুসরাত (৫) নামে দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। এই ব্যবসায়ীর মৃত্যুর ঘটনায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) বাসন থানার দুই এএসআইকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে
স্বজন ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, মোবাইল ফোনে বিটকয়েন দিয়ে জুয়া খেলার অভিযোগে গত শনিবার রাতে চারজনকে আটক করে বাসন থানা পুলিশ। পরদিন তিনজনকে ছেড়ে দিলেও ব্যবসায়ী রবিউল ইসলামকে থানায় আটকে রাখা হয়। পরে গত মঙ্গলবার রাতে বাসন থানার একদল পুলিশ সদস্য ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে আসেন। পরে রাতে তারা জানতে পারেন রবিউল মারা গেছেন।
সকালে এ ঘটনা এলাকায় জানাজানি হলে বিক্ষিপ্ত এলাকাবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রথমে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক এবং পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে তারা পুলিশের চারটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া বাইপাস মোড়ে পুলিশ বক্সে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধরা তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরে আরও পুলিশ সদস্য সেখানে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দেয় এবং সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণে আনে। এরপর দুপুর ১২টার দিকে ওই দুই মহাসড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়। পুলিশের লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেটে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ব্যবসায়ীর মৃত্যুর এ ঘটনায় দুই এএসআইকে প্রত্যাহারের পাশাপাশি জিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. দেলোয়ার হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- জিএমপির উপকমিশনার (ক্রাইম) আবু তোরাব মো. শামছুর রহমান ও অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. খায়রুল ইসলাম। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. দেলোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্বজন ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, রবিউল ইসলামসহ চারজনকে আটক করেন বাসন থানার এএসআই মাহবুব। এ সময় তার সঙ্গে একই থানার এএসআই নূরুল ইসলামও ছিলেন। পরদিন আটক তিনজনকে টাকার বিনিমেয়ে ছেড়ে দিলেও ব্যবসায়ী রবিউল ইসলামকে থানায় আটকে রাখা হয়।
প্রতিবেশী শাকিল মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শনিবার রাত ১টার দিকে রবিউল ইসলামকে পুলিশ আটক করলেও নানা অজুহাতে তাকে থানায় আটক করে রাখে। একপর্যায়ে রবিউলের পরিবারের কাছে এএসআই মাহবুব ১ লাখ টাকা দাবি করেন। তারা থানায় গিয়ে এএসআই মাহবুবকে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে আসেন। তার পরও রবিউলকে না ছেড়ে আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। চার দিন ধরে রবিউলকে থানায় আটকে রেখে টাকার জন্য পুলিশ নানা দেনদরবার করতে থাকে। কিন্তু রবিউলের পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তারা পুলিশকে চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারেনি।’
শাকিল আরও বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে রবিউলের স্ত্রী নূপুর আক্তারকে থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রাস্তার মধ্যে গাড়িতে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে তাকে বাসায় চলে যেতে বলেন এএসআই মাহবুব। দুই ঘণ্টা পর তার স্বামী বাসায় চলে যাবে বলে তাকে জানানো হয়। রবিউলের স্ত্রী তার স্বামীকে একনজর দেখার জন্য বারবার আকুতি জানালে ওই এএসআই সেই সুযোগ দেননি।’
মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে থানা থেকে মোবাইল ফোনে কল করে রবিউল ইসলাম সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন বলে তার স্ত্রীকে জানানো হয় উল্লেখ করে শাকিল বলেন, ‘পুলিশ বলে তাকে (রবিউল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। খবর পেয়ে নূপুর ও রবিউলের ছোট ভাই মহিদুল ইসলাম এবং বাড়িওয়ালা এমারত হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ওই হাসপাতালে গিয়ে রবিউলকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, রবিউল ইসলামকে মঙ্গলবার রাত ২টা ৫০ মিনিটে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়।
রবিউলকে টাকার জন্য নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাসন থানার ওসি আব্দুল মালেক খসরু খান বলেন, ‘অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে রবিউল ইসলামকে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাসা থেকে আটক করা হয়। তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। থানা থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি বাসায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।’
আর গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) আবু তোরাব মোহাম্মদ শামসুর রহমান বলেন, ‘এ ঘটনায় যারা অপরাধী, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
নানা উদ্যোগ নিয়েও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। মাদক কারবারের পাশাপাশি অপহরণ করে চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। প্রায় প্রতিদিনই অপহরণের ঘটনা ঘটছে ক্যাম্পগুলোতে। গত এক মাসে অন্তত দুই শতাধিক লোককে অপহরণের পর চাঁদা আদায় করা হয়েছে। ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও তৎপর। ইতিমধ্যে অপহরণকারী চক্রের একটি তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। তালিকায় ২৭৭ অপহরণকারী সক্রিয় থাকার কথা বলা হয়েছে। তারা সবাই রোহিঙ্গা।
স্থানীয় একটি চক্রও এই অপহরণকারীদের সহায়তা করছে বলে পুলিশের ওই প্রতিবেদন বলা হয়েছে। তাদের মূল টার্গেট স্থানীয় কৃষক ও ক্যাম্পের ভেতরে থাকা নিরীহ লোকদের ওপর। অপহরণের ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েকজনকে আটকের পর পুলিশ এসব তথ্য পেয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের একটি চক্র অপহরণ করাসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। তাদের কঠোরভাবে দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপহরণকারীদের নিয়ে কিছুদিন আগে একটি প্রতিবেদন এসেছে পুলিশ সদর দপ্তরে। স্থানীয় একটি মহল অপরাধী রোহিঙ্গাদের নানাভাবে সহায়তা করছে। তারা স্থানীয় কৃষকদের অপহরণ করছে। আবার ক্যাম্পের ভেতরেও একই ধরনের অপরাধ কর্মকা- চালাচ্ছে। তালিকায় যাদের নাম এসেছে তাদের ধরতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করেছে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) কক্সবাজার সফর করেছেন। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সব ধরনের অপরাধ নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছেন। মিয়ানমারের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কিছু সদস্য ক্যাম্পের ভেতরে ঘাপটি মেরে আছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আনরেজিস্টার-২১, হোয়াইংকা চাকমারকুল, উংচিপ্রাং ২২, লেদা-২৪, আলী-খালী-২৫, নয়াপাড়া মৌচনী-২৬ ও জাদিমুড়া ক্যাম্পসহ ৩৪টি ক্যাম্পে বসবাস করছে তারা। ভাষানচর ক্যাম্পেও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, আশ্রয় নেওয়ার কিছুদিন পরই রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি অংশ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তারা মাদক কারবার ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা ঘটাতে শুরু করে। তাছাড়া আছে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী একটি গোষ্ঠীর সদস্যদের আছে নানা তৎপরতা। ক্যাম্পগুলোতে অপহরণকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ।
পুলিশ সূত্র জানায়, মাসখানেক আগে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের একটি তালিকা তৈরি করে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠিয়েছেন স্থানীয় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তালিকায় থাকা সদস্যদের মধ্যে ২ নম্বর ক্যাম্পের কথিত কমান্ডার মৌলভী আয়াছ, কলিমউল্লাহ, জাহিদ হোসেন, মোহাম্মদ ফরিদ, ইউসুফ, জামাল, আরমান, বাইল্লা, ক্যাম্প ফরিদ, মো. মুছা, সানাউল্লাহ, সালাম, ছলিমউল্লা, মৌলভী ছামছু, কলিমউল্লাহ, জাহিদ হোসেন, ফরিদ, ইউছুফ, জামাল, সলিম উল্লাহ, মৌলভী সামছু, ৪ নম্বর ক্যাম্পের আরমান, আব্দুল মালেক, আব্দুল হালিম, মাস্টার সাইফ উদ্দিন, ১৭ নম্বর ক্যাম্পের সিরাজ, এনাম মাস্টার, হোসেন, ইলিয়াছ, নুর, সালাম, হাসিম মৌলভী হামিদ হোছন, নূর বশর, সেলিম, মাস্টার ফারুক, মাঝি আব্দুর ছবি, হাফেজ আয়াছ, লতিফ আলী, মাঝি সাইফুল্লাহ, ওসমান, হবির আহম্মদ, আইয়ুব, মোহাম্মাদ রফিক, ৭ নম্বর ক্যাম্পে আব্দুল মাবুদ, আইয়াছ উদ্দিন, হাফেজ, কেফায়েত উল্লাহ্, হয়দার লেংড়া হায়দার, ৫ নম্বর ক্যাম্পে ভুট্টু আব্দুল্লাহ, ওস্তাদ খালেক মাস্টার এনাম, হাবিবুল্লাহ, সাব মাঝি (ক্যাম্পের উপপ্রধান) সৈয়দুল আমিন, শাহ আলম, কালা মিয়া, মৌলভী হোসেন আহাম্মেদ, মৌলভী নুরুল আমিন, নুর সাফা, লিয়াকত আলী, এহসান উল্লাহ, মাস্টার মুন্না, শামসুল আলম, মো. জাফর, মুছা, মো. জাবেদ, মাস্টার দিল মোহাম্মদ, নবী হোসেন, নুরুল আমিন, সৈয়দুল ইসলাম, নুরুল আমিন, নুর কামাল, জাফর আলম প্রমুখ।
টেকনাফের এপিবিএন-১৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) সৈয়দ হারুন উর রশিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পারিবারিক সহিংসতা ছাড়াও মাদক, অস্ত্র, ছিনতাই, অপহরণ ও খুনের মতো ঘটনা বেশি ঘটছে।
সূত্র জানায়, গত এক মাসে ২শ’র বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তারা অপহরণের পর নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা আদায় করছে। পাশাপাশি গত পাঁচ বছরে ১৩৫ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ক্যাম্পে।
গত সপ্তাহে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চাকমারকুল ২১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ব্লকের বাসিন্দা আমির হাকিমের ছেলে মোহাম্মদ ফরোয়াজ, তার ভাই মোহাম্মদ জোহার, মোহাম্মদ ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ নূর, আবুল হোসেনের ছেলে নুরুল হক, ইউছুফ আলীর ছেলে জাহিদ হোসেন ও আব্দুস সালামের ছেলে মোহাম্মদ ইদ্রিসকে অপহরণ করা হয়। তারা ৫ লাখ টাকা মুুক্তিপণ দাবি করে। প্রায় ২১ ঘণ্টা পর অপহৃতদের স্বজনরা ৩ লাখ টাকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনে। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত মোহাম্মদ বেলাল নামে রোহিঙ্গা অপহরকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর আগে ১৯ ডিসেম্বর অপরহরণকারীরা টেকনাফের উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ উল্লাহ, মোস্তফা কামাল, করিম উল্লাহ, মো. রিদুয়ান, সলিম উল্লাহ, নুরুল হক, নুরুল আবছার ও নুর মোহাম্মদকে অপহরণ করা হয়। ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। পুরো টাকা দিয়েই তারা মুক্ত হন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় এখন অপহরণের ঘটনা বেশি আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অপরাধ রুখতে ক্যাম্পগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী ও রাস্তা নির্মাণের কাজও শেষের দিকে আছে। ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপত্তার জন্য নিয়মিত পুলিশের পাশাপাশি এপিবিএনের তিনটি ইউনিটের ১৯২৪ জন সদস্য মোতায়েন রয়েছেন।
যশরাজ ফিল্মসের হাত ধরে বড় পর্দায় শাহরুখ খানের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী বলিউড। তার 'পাঠান' বক্স অফিসে নজির গড়ছে। ভারতীয় ছবির সাফল্য পাড়ি দিয়েছে আমেরিকাতেও।
৪ বছর পর বড় পর্দায় ফিরেছেন শাহরুখ। 'পাঠান'-এ তার অ্যাকশন দেখতে দলে দলে হলে যাচ্ছেন অনুরাগীরা। মুক্তির পর প্রথম কয়েক দিনেই বিপুল টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে এই ছবি। গড়েছে একাধিক নজির। গত বুধবার, ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পায় 'পাঠান'। রবিবার পঞ্চম দিনে ছবিটি বিশ্বজুড়ে ৫০০ কোটির বেশি টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে দাবি, পঞ্চম দিনের শেষে 'পাঠান'-এর আয় সাড়ে ৫০০ কোটি। মুক্তির প্রথম ৪ দিনই দেশের বাজারে হাফ সেঞ্চুরি করেছিল 'পাঠান'। রবিবারও তার অন্যথা হয়নি। ৫০ কোটির গণ্ডি পেরিয়ে এই ছবি রবিবার দেশে প্রায় ৭০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। ভারতে এখন পর্যন্ত 'পাঠান'-এর মোট আয় ২৮২ কোটি টাকা। শনি ও রবিবার সপ্তাহান্তেই আরও বেশি করে এই ছবি দেখতে হলে যান মানুষ। চতুর্থ দিনে দেশের বক্স অফিসে শাহরুখের ছবির আয় ছিল ৫১ কোটি টাকা। সারা বিশ্বে এ ছবির মোট রোজগার শনিবার পর্যন্ত ছিল ৪২৯ কোটি টাকা। রবিবার এক লাফে ৫০০ কোটির গণ্ডি ছাড়িয়েছে 'পাঠান'।
দেশের বাইরে 'পাঠান' মোট ১০০টি দেশে মুক্তি পেয়েছে। বিদেশে ২৫০০টি পর্দায় এই ছবি দেখানো হচ্ছে। ভারতে এই ছবি চলছে সাড়ে ৫ হাজার পর্দায়। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৬৯৪টি সিনেমা হলে 'পাঠান' মুক্তি পেয়েছে। সেখানে রমরমিয়ে চলছে শাহরুখ, দীপিকা পাডুকোন এবং জন আব্রাহাম অভিনীত ছবিটি। নজির গড়েছে। উত্তর আমেরিকার বক্স অফিসে হিন্দি ছবি হিসাবে 'পাঠান'-এর প্রথম দিনের আয় সর্বোচ্চ। ছবিটি মুক্তির দিন ১৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১৫ কোটি টাকা) আয় করেছে আমেরিকায়। উত্তর আমেরিকার ৬৯৪টি সিনেমা হলে সাম্প্রতিককালে মুক্তিপ্রাপ্ত যেকোনো ছবির তুলনায় 'পাঠান'-এর গড় সবচেয়ে বেশি।
আয়ের গড় হিসাবে হলিউডকেও টেক্কা দিচ্ছেন শাহরুখ। এই নিরিখে হলিউডের ৩টি ছবি কেবল 'পাঠান'-এর সামনে রয়েছে। সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সেরা গড়ের তালিকায় তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে শেষ করতে পারে 'পাঠান'। তালিকায় 'পাঠান'-এর আগে রয়েছে 'অ্যাভাটার : দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’, 'পুস ইন দ্য বুটস : দ্য লাস্ট উইশ' এবং 'এ ম্যান কলড ওটো'।
কাস্টমস লাইসেন্সিং বিধিমালা বাতিলের দাবিতে আজ থেকে দুই দিন দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. সুলতান হোসেন খান।
লিখিত বক্তব্যে সুলতান হোসেন খান জানান, কাস্টমস এজেন্টস লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০১৬ তে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বিধি সন্নিবেশিত থাকায় বিধিমালা জারির পর ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বিধি সংশোধনের দাবি জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হলেও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিধিমালা সংশোধনের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
‘উপরন্তু ২০২০-২০২১ সালের বাজেট প্রস্তাবনার সঙ্গে আরও কঠিন শর্ত যুক্ত করে লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০২০ জারি করা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে উত্থাপিত লাইসেন্সিং রুলের কয়েকটি বিধি ও উপবিধি সংশোধনীর প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু গত বাজেটেও কোনোরূপ সংশোধনী আনা হয়নি।’
তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় গত বছরের জুনে সারা দেশে একদিনের কর্মবিরতি পালন করে সিঅ্যান্ডএফ সংশ্লিষ্টরা। জুন মাসের শেষে আবারও দুই দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা দিলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হতে লাইসেন্সিং রুলসহ অন্যান্য বিধিসমূহ সংশোধনের জন্য কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। এ বিষয়ে ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেও কার্যকর কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০২০ এর আইন ও বিধি পরিবর্তন ও সংশোধনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আগামী ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি সোম ও মঙ্গলবার দেশের সকল কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ফেডারেশন যে সকল বিধিবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আমদানিকারকের কাছে শুল্ক করাদি পাওনা থাকলে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের লাইসেন্স নবায়ন না করার বিধান বাতিল করা, উত্তরাধিকারের অনুকূলে লাইসেন্স হস্তান্তর সংশ্লিষ্ট শর্ত শিথিল করা, শুল্ককর পরিশোধ না করলে লাইসেন্স বাতিল ও অর্থদণ্ড আরোপের বিধান বাতিল করা, মূল লাইসেন্স বাতিল হলে রেফারেন্স লাইসেন্স বাতিলের বিধি বাদ দেওয়া, দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিকে লাইসেন্স প্রদান না করা, শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা-২০০০ এর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং ভুলের অজুহাতে ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ জরিমানার আদেশ বাতিলের দাবি উল্লেখযোগ্য।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ্ব শামছুর রহমান, সহসভাপতি জনাব শেখ মো. মোখলেছুর রহমান (লাভলু), অর্থ সচিব এ কে এম আকতার হোসেন, বন্দর বিষয়ক সচিব জনাব মো. খায়রুল বাশার প্রমুখ।
প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে দিনব্যাপী শীতকালীন পিঠা উৎসব-২০২৩। রবিবার সকাল ১১টায় বনানীস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচবিআর টাওয়ারের নীচতলায় ফিতা কেটে পিঠা উৎসব ২০২৩ এর উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নুরুন্নবী মোল্লা ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ইফ্ফাত জাহান।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাজী এ এস এম আরিফ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোফাজ্জেল মাওলা, ফার্মেসি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শেখ ফিরোজ উদ্দীন আহমেদ, ফাইন্যান্স ডিরেক্টর শিপার আহমেদ, ডেপুটি রেজিষ্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ও সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা বেগমসহ অন্যরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসবের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়ি থেকে হরেক রকম পিঠা তৈরি করে এনে স্টল সাঁজিয়েছেন। আটটি স্টলে ছিলো নানা রকম পিঠার সমাহার।
এর মধ্যে ছিলো- ভাজাপুলি, দুধপুলি, নারিকেল পাকন, ছেই পিঠা, পাটি সাপটা, ফুলঝুরি, নকশি পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, ঝালপুলি, দুধপিঠা, মিষ্টান্নের মধ্যে ছিলো- কুনাফা, কাস্টার্ড, পুডিং, বালুশাই ও পায়েস। নানা অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় পিঠার পসরা সাজিয়ে উৎসবে আগতদের মনোযোগ কেড়েছে আয়োজকরা।
বাহারি নামের এসব পিঠা খেতে শিক্ষার্থীদের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়েছে এসব পিঠা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইলেকট্রিক্যাল ও মেশিনারি পণ্য নিয়ে রাশিয়া থেকে আসা বিদেশি জাহাজ ‘এম,ভি আনকা সান’ ও ‘এম,ভি সাপোডিলা’ মোংলা বন্দরে ভিড়েছে। রবিবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়ে আনকা সান ও সন্ধ্যা ৭টায় ৮ নম্বর জেটিতে ভিড়ে সাপোডিলা।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইলেকট্রিক্যাল মালামাল নিয়ে ভেনুটা পতাকাবাহী জাহাজ এম,ভি আনকা সান রবিবার বিকেল পৌনে ৫টায় মোংলা বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়েছে। ১ হাজার ৯৭৯ প্যাকেজের ১ হাজার ৪শ মেট্রিক টন ইলেকট্রিক্যাল পণ্য নিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর রাশিয়ার নভরস্কি বন্দর থেকে ছেড়ে আসে এ জাহাজটি। এ ছাড়া রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর থেকে ৪৩৬ প্যাকেজের ৫১৮ মেট্রিক টন মেশিনারি পণ্য নিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় বন্দরের ৮ নম্বর জেটিতে ভিড়ে বিদেশি জাহাজ এম,ভি সাপোডিলা।
বিদেশি জাহাজ আনকা সান’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট কনভেয়ার শিপিং লাইনসের খুলনার ম্যানেজার (অপারেশন শিপিং) সাধন কুমার চক্রবর্তী ও সাপোডিলা’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট ইন্টারপোর্ট’র খুলনার ম্যানেজার অসিম মন্ডল জানান, বন্দর জেটিতে অবস্থান নেয়া এ জাহাজ দুটি থেকে রবিবার সন্ধ্যার পর অর্থাৎ রাত থেকে পণ্য খালাস শুরু হবে। এরপর জাহাজের এ পণ্য খালাস করে জেটিতে রাখা হবে। তারপর সোম বা মঙ্গলবার থেকে তা সড়ক পথে নেয়া হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
এর আগে গত ২২ জানুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল নিয়ে মোংলা বন্দরে এসেছিল বিদেশি জাহাজ এম,ভি কামিল্লা। এ জাহাজগুলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত।
উল্লেখ্যে, সম্প্রতি ৭টি জাহাজ কোম্পানির ৬৯টি জাহাজে রূপপুরের মালামাল পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রেক্ষিতে রূপপুরের মালামাল নিয়ে রাশিয়া থেকে মোংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা এম,ভি উসরা মেজরকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তখন। ওই জাহাজটির ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে ভেড়ার শিডিউল ছিল। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় তা আর সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য ওই জাহাজটি পণ্য খালাসে ভারতে গেলে সেখানেও পণ্য খালাস করতে না পারায় ফেরত যায় উসরা মেজর। যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বাংলাদেশ ও ভারতসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
চলছে শীত মৌসুম। এই সময় ফুলকপি খাবেন না, তা কি হয়? ফুলকপি খুবই পুষ্টিকর একটি সবজি; যা রান্না কিংবা কাঁচা যে কোন প্রকারে খাওয়া যায়। তবে ফুলকপির পাতাও কম উপকারী নয়। অনেকেই ফুলকপির পাতা ফেলে দেন। কিন্তু এর গুণ জানলে এমন করার আগে দু’বার ভাববেন।
ফুলকপিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, প্রোটিন, খনিজ পদার্থ, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি রয়েছে। যা দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন রোগের হাত থেকে মানবদেহকে রক্ষা করে।
ওজন কমাতে
মেদ ঝরাতে পরিশ্রম কম করেন না কেউই। অথচ হাতের সামনে এমন উপকারী জিনিস থাকতেও, অপ্রয়োজনীয় ভেবে ফেলে দিচ্ছি। ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভরপুর পরিমাণে ফাইবার। ওজন কমাতে চাইলে অতি অবশ্যই রোজের ডায়েটে রাখতে পারেন এই পাতা। শুধু লেটুস নয়, সালাদেও এই পাতা রাখতে পারেন।
দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে
গবেষণা বলছে, ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভিটামিন এ। যা দৃষ্টিশক্তি বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি, চোখ সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করে। চোখের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে চোখ বন্ধ করে ভরসা রাখতে পারেন ফুলকপির পাতার উপর। রাতকানা রোগের আশঙ্কা দূর করতে এই পাতা কার্যকর।
হাড়ের যত্নে
শীতকালে হাড়ের বাড়তি খেয়াল রাখার দরকার পড়ে। তাই চিকিৎসকরা ক্যালশিয়ামে সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার কথা বলে থাকেন। ফুলকপির পাতা হল ক্যালশিয়ামের সমৃদ্ধ উৎস। এমনকি, ঋতুবন্ধের পরেও অনেক শারীরিক সমস্যা এড়াতে খেতে পারেন ফুলকপির পাতা।
সন্তানের বেড়ে ওঠায়
ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভরপুর পরিমাণে প্রোটিন এবং খনিজ পদার্থ, যা শিশুর বেড়ে ওঠায় সাহায্য করবে। পুষ্টিবিদরা শিশুর বা়ড়ন্ত বয়সে এমন কিছু খাবার খাওয়ার কথা বলে থাকেন, যেগুলো তাদের উচ্চতা, ওজন এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করবে। ফুলকপির পাতা সেই খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’