
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশের অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পলাতক এ দুই আসামির সম্পত্তির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনটি পাওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা এ মামলায় তারেক ও জোবাইদাকে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি (গেজেট) প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. আছাদুজ্জামান এ আদেশ দেন। এদিন জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা মামলায় তারেক-জোবাইদার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমার তারিখ ছিল।
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে তাদের দুজনের (তারেক-জোবাইদা) কোনো সম্পত্তির হদিস তারা পাননি। দুজনকে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। অন্যথায় তাদের অনুপস্থিতিতে মামলার বিচার চলবে।’
গত ৫ জানুয়ারি তারেক রহমান ও জোবাইদা রহমানের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেয় একই আদালত। ক্রোকি পরোয়ানা তামিলের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের পর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিল আদালত। এর আগে গত বছরের ১ নভেম্বর অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল একই আদালত।
গত বছরের ২৬ জুন হাইকোর্ট তারেক ও জোবাইদাকে পলাতক ঘোষণা করে ৪ কোটি ৮২ লাখ টাকার দুর্নীতি মামলা দায়ের ও তার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে করা পৃথক রিট আবেদন খারিজ করে দেয়। রিট খারিজ করে দেওয়া রায়ে হাইকোর্ট একই সঙ্গে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে করা এ মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট নিম্ন আদালতকে যত দ্রুত সম্ভব বিচার কার্যক্রম শেষ করার নির্দেশ দেয়। ঘোষিত আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার তথ্য গোপন এবং বৈধ আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাফরুল থানায় এ মামলা করে দুদক। এজাহারে তারেক রহমান, জোবাইদা রহমান ও তার মা অর্থাৎ তারেক রহমানের শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানুকে আসামি করা হয়। ২০০৮ সালে এ মামলায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
এক দশকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভোট প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। স্থায়ী সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনেও বড় দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরেই অবস্থান দলটির। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে, সেখানে ইসলামী আন্দোলন আগেরবারের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে।
দলটির ভোট বাড়ার রহস্য খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, মূলত তিনটি কারণে দলটির ভোটব্যাংক ভারী হচ্ছে। প্রথমত, দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রতি অবিশ্বাস এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বিবেচনায় নিয়ে মানুষ ইসলামী আন্দোলনের প্রতি ঝুঁকছে। দ্বিতীয়ত, ধর্মভিত্তিক বা ইসলামী দল বলতে এতদিন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে বোঝানো হলেও যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে তারা নির্বাচনে নিষিদ্ধ এবং রাজনীতিতে কোণঠাসা। তাদের বিকল্প হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেড়েছে। অন্য ইসলামী দলগুলোর পক্ষে না ঝুঁকে পড়ার আরও কারণ হচ্ছে এসব ছোট ছোট দল ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো বড় দুই দলের সঙ্গে থাকছে।
তৃতীয়ত, বছরের প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী আন্দোলনের মাহফিল বা দাওয়াতি কর্মকান্ড চলে। এ ছাড়া ‘পীরভিত্তিক দল’ হওয়ায় ইসলামী আন্দোলনের সমর্থক সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে দেওবন্দ ও কওমি ঘরানার পীর হিসেবে ‘চরমোনাই ধারাটি’ বেশি গ্রহণযোগ্য।
তবে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বলছেন, সাংগঠনিক দক্ষতা আর নির্বাচনী কৌশলেই তাদের ভোট বাড়ছে। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া উপকমিটির সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে থাকা বিভিন্ন জোট আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা জোট বা নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট দুটোর কেন্দ্রেরই দুর্নীতিবাজরা বসে আছেন। আমরা দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতার যাওয়ার সহযোগী হতে চাই না।’ ভোট বাড়ার পেছনের রহস্য কী এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘মানুষ ভালো কিছু চায়। আমরা ভালো কাজ করছি, ভালোর জন্য রাজনীতি করছি। করোনায় আমরাই প্রথম টিম করে মানুষের লাশ দাফন করেছি। বন্যার সময় ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছি। এতদিন মানুষ আমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে জানত না। এখন দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলো আমাদের নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে, মানুষও জানছে, তাই হাতপাখার প্রতি সমর্থনও বাড়ছে।’
মুরিদ বা পীরের ভক্তের দল হিসেবে পরিচিতির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমাদের দলে তো হিন্দু সমর্থকও রয়েছেন। তাই এমন পরিচিতির ভিত্তি নেই। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সদস্য হতে হলে মুরিদ হতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের আনুকূল্য, রাজনীতির মাঠে জামায়াতে ইসলামীর না থাকা, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিচারিতা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ইসলামী আন্দোলনের ভোট বাড়ছে।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা দিন দিন ধর্মাশ্রয়ী হয়ে যাচ্ছি। উগ্রতার দিকে আমাদের নতুন প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার বল প্রয়োগ করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে রাখছে। কিন্তু ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলে, কিন্তু কাজ করে না। বরং অনেকাংশে তারা ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তারা গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতান্ত্রিক সমাধান না করে, ধর্মভিত্তিক সমাধান করে।’ তিনি জানান, কয়েক বছর আগে সহিংস উগ্রবাদবিষয়ক গবেষকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘রিজলভ’-এর করা এক জরিপে দেখা গেছে, ৯১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের একটি মর্মবস্তু হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব। তবে ৮০ শতাংশের বেশি মনে করেন, শরিয়াহ আইন মৌলিক সেবা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্নীতিকে নিরুৎসাহিত করে। ইসলামী আন্দোলনের ভোট বাড়ার পেছনে এ মনোভাবও খুব কাজ করছে বলে মনে হয়।
১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ একটি ইসলামী মোর্চা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। ’৯০ সালের দিকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে মোর্চাটি চরমোনাইয়ের পীর মুফতি ফজলুল করিমের (প্রয়াত) নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৮ সালে নিবন্ধনের সময় দলটির নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ করা হয়।
সংসদ নির্বাচনে ভোটচিত্র : ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এককভাবে ১৬০টি আসনে অংশ নেয় ইসলামী আন্দোলন। নব্বইয়ের পর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোর মধ্যে এ সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে দলটি ১ দশমিক ০৫ শতাংশ ভোট অর্থাৎ ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৪ ভোট পেয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েও অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না এমন অভিযোগ করে অংশ নেয়নি দলটি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনেই প্রার্থী দিয়ে আলোচনায় আসে ধর্মভিত্তিক দলটি। ওই নির্বাচনে একটি আসনে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়। ভোটগ্রহণের দিন নানা অনিয়মের অভিযোগে একপর্যায়ে ফলাফল বর্জনের ঘোষণা দিলেও প্রায় ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ ভোট পড়ে দলটির বাক্সে। অর্থাৎ প্রায় ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৩ ভোট যায় তাদের ‘হাতপাখা’ প্রতীকে।
স্থানীয় নির্বাচনে ভোটচিত্র : ২০১৭ সালে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘হাতপাখা’ প্রতীকে মেয়র পদে ভোট করেছিলেন গোলাম মোস্তফা বাবু। তিনি ২৪ হাজার ৩ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জয়ী হন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী দ্বিতীয় ও বিএনপির মনোনীত প্রার্থী তৃতীয় হয়েছিলেন। গত ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটির হয়ে আমিরুজ্জামান পিয়াল নির্বাচন করেন। তিনি ভোট পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার এবারও নির্বাচিত হন। বিএনপি এবার ভোটে অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তৃতীয় হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের ভোটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন তৃতীয় অবস্থানে ছিল। ঢাকা উত্তরে দলটি পেয়েছিল ১৮ হাজার আর দক্ষিণে ১৫ হাজার ভোট।
২০২০ সালে এসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৬ হাজার ২৫৮ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২৬ হাজার ৫২৫ পেয়ে তৃতীয় হয়েছে দলটি।
২০১৬ সালের নারায়ণগঞ্জ, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তৃতীয় হয় দলটি। ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তৃতীয় অবস্থানে ছিল। রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলেও অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেছিল ইসলামী আন্দোলন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৯টি ইউনিয়ন পরিষদে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। প্রায় ২০০-এর মতো নির্বাচিত ইউপি সদস্য রয়েছে। রাজধানী ঢাকার ডেমরায় হাজি ইব্রাহীম কাউন্সিলরসহ সারা দেশে সাতজন নির্বাচিত কাউন্সিল রয়েছে দলটির।
জানা গেছে, ইসলামী আন্দোলনের জনপ্রিয়তা বাড়ার বড় একটি কারণ প্রয়াত পীর মাওলানা ফজলুল করিম। তার নেতৃত্বেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে দলটির কার্যক্রম। তার সময়েই ৬৪টি জেলাসহ বহু উপজেলায় দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল। তার অবর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। তিনি ইসলামী আন্দোলনের আমির এবং চরমোনাই তরিকার বর্তমান পীর। সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের আরেক ভাই সৈয়দ ফয়জুল করিম দলটির এক নম্বর নায়েবে আমির। তিনি চরমোনাইয়ের তরিকা অর্থাৎ বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটিরও নায়েবে আমির।
দলটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘পীরভিত্তিক’ দল হওয়ার কারণেই দেশের গ্রামাঞ্চলে ইসলাম মূল্যবোধের প্রতি অনুরক্ত মানুষের মধ্যে দলটির জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে।
গত ২ জানুয়ারি সোমবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের ৮৭টি সাংগঠনিক জেলা, ৬৯১টি উপজেলা, ১১৯টি সিটি থানা, ৬১টি সদর পৌরসভা, ৩ হাজার ৫১৯টি ইউনিয়ন এবং ১২ হাজার ৬৭০টি ওয়ার্ডে ইসলামী আন্দোলনের কমিটি রয়েছে। এমনকি দলটি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে তাদের কমিটি গঠন করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল ও উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে পঞ্চগড়, দিনাজপুর, লালমনিরহাটসহ আশপাশের জেলাগুলোতে দলটির ভক্ত বা সমর্থক সংখ্যা বেশি। রাজধানী ঢাকায়ও তাদের কার্যক্রম বেশ শক্ত। রামপুরায় জামিয়া মহিলা মাদ্রাসা, ভাটরায় সাইদিয়া কারিমিয়া মাদ্রাসা, জুরাইন ও যাত্রাবাড়ীর বেশিরভাগ কওমি মাদ্রাসায় তাদের কর্মী ও সমর্থক রয়েছে।
দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড প্রসঙ্গে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে আমাদের প্রায় ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।’
মাংসের দোকানে ঝুলিয়ে রাখা সিনার একটি বড় টুকরো দেখিয়ে লাবিবা বলে, ‘বাবা, এটা নাও।’ কসাই পরিচিত। তিনি সিনার টুকরোটি ওজন দিয়ে বলেন, স্যার, তিন কেজির মতো আছে, পুরাটাই নিয়ে যান। বলি, দিয়ে দেন।
স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে ফিরছিলাম। ফেরার পথে মেয়ের খাতা-কলম ও কিছু মাছ ও সবজি কেনার জন্য মিরপুর-১৩ বাজারে ঢোকা। দারুল উলুম মাদ্রাসার সামনে বাইক রেখে বাজারে ঢুকতেই মেয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘বাবা আজ গরুর মাংস নেব।’ বাবার মতো মেয়েরও পছন্দ গরুর মাংস।
‘বিল্লাল গোশত বিতানের’ সামনে বাপ-বেটি দাঁড়িয়ে আছি। কসাই মাংস কাটছেন। সাত-আট বছরের দুই শিশু নিয়ে দুজন নারীও দাঁড়িয়ে আছেন সেই দোকানের সামনে। তারাও তাকিয়ে আছে মাংসের দিকে। লাবিবার মতো তাদেরও এক শিশু বলছে, ‘মা, গোশত কিনো আইজকা।’ কিন্তু তারা কেউ মাংসের দরদাম করছেন না।
আমার মাংস কাটা শেষ। মাপ দিয়ে পলিথিনে ঢুকিয়ে কসাই বলেন, স্যার নেন। সাড়ে তিন কেজির একটু বেশি হইছে। আমি মাংসের ব্যাগ হাতে নিয়ে টাকা দেওয়ার জন্য মানি ব্যাগ বের করি। বলি, কত দেব? কসাই বলেন, আড়াই হাজার হইছে। আপনি দুই হাজার চারশ টাকা দেন। আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, এত টাকা? কত টাকা কেজি? কসাই বলেন, আজকে সাতশ টাকা।
কোরবানি ঈদের পর আর মাংস কেনা হয়নি। আমার মানি ব্যাগে এত টাকা নেই। মেয়ের খাতা-কলম ও কিছু মাছ ও সবজি নিতে হবে। কসাইকে বলি, এক কেজি দেন ভাই। কসাই নাছোড়বান্দা। বলেন, টাকা পরে দিয়েন। নিয়ে যান।
এখন নিলে তো পরে আবার টাকা দিতেই হবে। মাস শেষে যে টাকা বেতন পাই তার অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি টাকা থেকে নেট বিল, ডিশ বিল, নিজের যাতায়াত, মেয়ের স্কুলের টিউশন ফি, প্রাইভেট টিউটরকে দিয়ে যা থাকে তা মাসের বাজার-সদাই করতেই শেষ হয়ে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। এমন সময় ওই নারী কসাইকে বলেন, বট (গরুর ভুঁড়ি) কত কইরা? কসাই বলেন, তিনশ টাকা কেজি। তখন ওই নারী বলেন, তাইলে হাফ কেজি মাপেন।
বেশি দিন আগের কথা নয়, কয়েক বছর আগেও ২৮০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস কিনেছি। এখন সেই মাংস কিনতে গেলে গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ ৭০০ টাকা রাজধানীর রিকশাচালক কিংবা হকারদের দুদিনের আয়ের সমান। গরুর মাংস অনেক আগেই তাদের নাগালছাড়া হয়েছে। আজকে নাগালছাড়া হচ্ছে সীমিত আয়ের আমার। শেষ পর্যন্ত এক কেজি মাংস নিয়েই মাছ বাজারের দিকে এগিয়ে যাই।
মানিকগঞ্জ থেকে মাছ এনে বিক্রি করেন কামাল। নিজের জেলা বলেই তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে আমার। তার কাছে গিয়ে বলি, হাফ কেজি কাচকি দেন কামাল ভাই। তিনি কাচকি মাছ ওজন দেওয়ার জন্য বাটিতে তোলেন। লাবিবা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দোকানে রাখা বড় একটি বোয়াল মাছের দিকে। দোকানদার বলেন, বোয়াল নেবেন? দেড় হাজার টাকা কেজি। পনেরো কেজির মতো হবে। আমি বলি, না। আপনি কাচকি মাপেন। লাবিবা আর মাছের দোকান থেকে সরে না। মাছটির মাথায় হাত দিতে চায়। সাহস পায় না। এত বড় বোয়াল লাবিবা এই প্রথম দেখল।
কাচকি ব্যাগে ঢুকিয়ে সবজি দোকানের দিকে হাঁটা দেব। তখন ট্রাউজার-হুডি পরা এক ভদ্রলোক বোয়াল মাছটি মাপতে বললেন। মেয়েকে নিয়ে সামনে এগোই। সবজির দোকানের আগে জাহাঙ্গীর আর মান্নান বসেন পাশাপাশি। একজন ইলিশ, আরেকজন রুই-কাতল মাছ বিক্রি করেন। আজকে কত টাকা কেজি ইলিশ? বলতেই মান্নান যেটি মাপছেন সেটি দেখিয়ে বলেন, এইটা বারোশ টাকা কেজি কইরা বেচতেছি। একজন নারী ছয়টি ইলিশ কিনছেন। লাবিবা আর আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। লাবিবা বলে, বাবা, ইলিশ নেবে? আমি কিছু বলি না।
ঝাঁকায় থাকা ছোট সাইজের ইলিশ দেখিয়ে দাম জানতে চাইছি। এমন সময় কানে শব্দ এলো ‘ওই, একটা ইলিশ নে।’ তাকিয়ে দেখি, তিন তরুণ দাঁড়িয়ে। দেখে মনে হলো, কলেজছাত্র। ছোট সাইজের একটি ইলিশ তারা নিতে চাইছে। দোকানদার মাপ দিয়ে বলে, ছয়শ গ্রামের বেশি হইছে। পাঁচশ টাকা দেন। তারা একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অন্য দোকানের দিকে চলে যায়। বলে, ‘থাক, আজ নেব না।’
দোকানদার বলেন, এরা প্রায়ই আসে। কিন্তু মাছ কিনে না। বলি, কেন? দোকানদার জানায়, তারা মেসে থেকে লেখাপড়া করে। শেষে দেখবেন, ঘোরাঘুরি করে ট্যাংরা কিনে নিয়ে যাবে।
বাজারের যে অবস্থা তাতে সীমিত আয়ের পরিবারগুলোরও আর এখন নিত্যদিন মাছ-মাংস কেনার সামর্থ্য নেই। সেখানে এই ছাত্ররা কীভাবে কিনবে? অনেক পরিবারে এখন গরুর মাংস বা ইলিশ কেনা হয় কেবল অতিথি এলে। ভবিষ্যতে হয়তো অতিথি এলেও তাদের পক্ষে মাছ-মাংস কেনা কঠিন হবে।
ষাটোর্ধ্ব এক নারী লাবিবার কাছে কিছু টাকা সাহায্য চাইছেন। আমি ডেকে জানতে পারি তার নাম কমলা। থাকেন পাশেই, বস্তিতে। বলেন, ‘এক কেজি আতপ চাল কিনে দেন। জাই (জাউ) রাইন্দ্যা খামু।’ দশ টাকা ধরিয়ে দিই তার হাতে।
আমিও আজ আর ইলিশ নিই না। লাবিবাকে নিয়ে সবজির দোকানে যাই। লাবিবা বলে, বাবা, ক্যাপসিকাম নাও। দুটি দোকানের পজিশনে একাই সবজি বেচেন মতলবের ছেলে মিজান। থাকেন মিরপুর-১৩ নম্বরে। জানান, এই বাজারে রাকিন সিটি ও ন্যাম গার্ডেনের বাসিন্দারাই বেশি বাজার করে থাকেন। তার কথায়, স্থানীয় বাড়িওয়ালারা খুব কমই বাজার করেন। তারা কোথায় করেন? মিজান বলেন, ভ্যান থেকেই বেশি কেনেন তারা।
দোকান ভাড়া কত দিতে হয়? মিজান বলেন, প্রতি দোকানে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। আর কারেন্ট বিল ও অন্যান্য খরচ দিয়ে আরও চার-সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ হয়। তাতে লাভ থাকে? বলেন, মোটামুটি চলে যাচ্ছে আর কি।
সবজি কিনে মেয়েকে নিয়ে বাইকের কাছে চলে আসি। ব্যাগগুলো বাইকের হুকের সঙ্গে লাগাচ্ছি। বাজারের গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। হাতে একটি ব্যাগ। মলিন চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। লাবিবাকে পেছনে উঠিয়ে বাইক স্টার্ট দেব। বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বলেন, একটু মাংস দেবেন? এক কেজি মাংস থেকে আর কী দেব তাকে। বিশ টাকার একটা নোট হাতে দিয়ে বাইক স্টার্ট দিই। লেগুনা, রিকশা আর প্রাইভেট কারের ভিড় ঠেলে আমার বাইক হারম্যান মেইনার, স্কলাস্টিকা স্কুল পেরিয়ে ন্যাম গার্ডেনের দিকে এগিয়ে যায়।
নিজ সমুদ্রসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত কোনো জাহাজই প্রবেশ করতে দেবে না বাংলাদেশ। সেটা হোক বাংলাদেশের অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশের প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনের জাহাজ। বিশেষ করে বাংলাদেশ এখন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও এর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত কোনো জাহাজ নিজ জলসীমায় প্রবেশ করতে দিয়ে নতুন ঝামেলায় জড়াতে চায় না ঢাকা। পরিস্থিতি উত্তরণে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন ও গ্রহণযোগ্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সরকার।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এমন জাহাজ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলে অথবা যে দেশই তাদের জলসীমায় প্রবেশের অনুমতি দেবে সেই দেশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। এছাড়া সমুদ্রসম্পদ রক্ষায়ও নড়চড়ে বসেছে সরকার। এমনকি সমুদ্রকেন্দ্রিক কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বিশেষ নজরদারির পাশাপাশি নিরাপদ সমুদ্র নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক জোট এবং দেশগুলোর সঙ্গেও নিয়মিত বোঝাপাড়ায় রয়েছে বাংলাদেশ।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, চলমান ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দুনিয়াজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নিজ বলয়ের শক্তি প্রদর্শন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে অন্য দেশগুলোকে; বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ঝুঁকি এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ৯০টি জাহাজের তালিকা এরই মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এখন থেকে বিদেশি কোনো জাহাজ বাংলাদেশে আসার আগে অনুমতি চাইলে এবং জলসীমা ব্যবহার করতে চাইলে আগেই যেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ওই তালিকা ধরে খুব সহজেই নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত জাহাজটি শনাক্ত করতে পারে। জাহাজটি যদি বাংলাদেশের পণ্য পরিবহন করে থাকে তবুও সেটি জলসীমায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এক কথায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ব্যবহার করতে পারবে না নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত কোনো জাহাজ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার একটি জাহাজ ‘স্পার্টা থ্রি’ সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল নিয়ে মোংলা বন্দরে ভিড়তে যাচ্ছিল। তখন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাংলাদেশের নজরে না থাকায় এবং জাহাজের নাম পরিবর্তন করে ‘উরসা মেজর’ রাখায় রাশিয়ার কৌশলগত কারণ নির্ণয় করতে পারেনি বাংলাদেশ। রূপপুরের মালামাল বহন করলেও সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল আপত্তির মুখে রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজটির প্রবেশ আটকে দেয় বাংলাদেশ। রুশ কৌশল এবং জাহাজের নাম পরিবর্তন ও নিবন্ধন নম্বর একই থাকার বিষয়টি মিলিয়ে হতবাক হয়েছিলেন স্বয়ং সরকারেরও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস গত বছর ২০ ডিসেম্বর এক কূটনৈতিক পত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে ‘উরসা মেজর’। তাই জাহাজটিতে পণ্য ওঠানো-নামানো, জ্বালানি সরবরাহ, নাবিকদের যেকোনো ধরনের সহযোগিতায় যুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট দেশের নিষেধাজ্ঞা বা বড় আর্থিক দণ্ডের মুখে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
এরপরও নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত জাহাজটি ভিড়তে দিতে বাংলাদেশের ওপর চাপও সৃষ্টি করেছিল রাশিয়া। এ নিয়ে সৃষ্ট বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। কড়া ভাষায় কূটনৈতিক বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি সব রকমের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি। এরপর পণ্য খালাসের জন্য ভারতে অপেক্ষা করছিল জাহাজটি। এটির পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাসের কথা ছিল। তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী এ নিয়ে বিবিসিকে বলেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আমাদের অবস্থান আগেও যা ছিল, এখনো তা-ই। ভারতের সেই নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। রুশ জাহাজটি যদি ভারতের কোনো বন্দরে ভিড়ে থাকে বা ভিড়তে আসে, তাহলে তাই।’ অবশেষে সেখানেও পণ্য খালাসের অনুমতি না পাওয়ায় গত সোমবার (১৬ জানুয়ারি) রাশিয়ার পথ ধরতে হয়েছে ‘উরসা মেজরকে’।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ভারত হয়ে বাংলাদেশ সফর করেছেন। তার এ সফরকে ঘিরে ঢাকায় বেশ জোরালো গুঞ্জন রয়েছে যে তিনি জাহাজটির পণ্য খালাসের অনুমতি দিতে বাদ সেধেছেন বলেই শেষ মুহূর্তে ভারত তাদের ‘ভারসাম্য কূটনীতি’ থেকে সরে গিয়ে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়েছে। এদিকে ঢাকায় ডোনাল্ড লু’র সঙ্গে আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে জাহাজটির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, এরই মধ্যে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমে অন্য জাহাজে করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল পাঠানোর বিষয়টি জানানো হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই মালামাল নিয়ে রাশিয়া থেকে অন্য জাহাজ আবার যাত্রা করবে এবং ঢাকায় এসে পৌঁছাতে পারে সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম এবং এ ঘটনায় বাংলাদেশ ও রাশিয়ার সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ নিয়ে কথা বলতে নারাজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারাও বিব্রতবোধ করার কথা জানিয়েছেন।
বিদ্যুতের দাম বাড়লেও পিছু ছাড়ছে না লোডশেডিং। চাহিদা কম থাকায় গত কয়েক বছরে শীতকাল লোডশেডিংমুক্ত ছিল, তবে এ বছর তার ব্যতিক্রম হয়েছে। পরিস্থিতি এমন থাকলে আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের লোডশেডিং আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে তারা আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলা সম্ভব নয়। সাশ্রয়ী নীতি অবলম্বন করলে পরিস্থিতি হয়তো কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।
গত ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। গ্যাসের দাম বাড়লে আবারও বাড়বে বিদ্যুতের দাম। গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দামের সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কারণে জীবন আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২,৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার মেগাওয়াটেরও কম। গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে ৪ হাজার ৭৩ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণজনিত কারণেও কিছু কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
সর্বোচ্চ ১৪,৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত বছরের ১৬ এপ্রিল। তখন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট। এ বছর গ্রীষ্মে চাহিদা বেড়ে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট হতে পারে বলে ধারণা করছে বিপিডিবি।
শীতকালে তাপমাত্রা কম হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। কিন্তু এবার শীতেও লোডশেডিং হচ্ছে। চলতি বছর ৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে এখনো চলছে লোডশেডিং। গত ১০ দিনে গড়ে ৫৫০ মেগাওয়াট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। অথচ চাহিদা ছিল ১০ হাজার মেগাওয়াটেরও নিচে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যাহত হয়। সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন সম্ভব না হওয়ায় জুলাই থেকে সরকার ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করে। পরে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় লোডশেডিং কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তা চরম আকার ধারণ করে অক্টোবরের শুরুর দিকে রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। ওই সময় গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। তবে তাপমাত্রা কমতে থাকায় নভেম্বরে লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমে যায়। ডিসেম্বর মাস অনেকটা লোডশেডিংমুক্ত থাকলেও এখন আবার শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিডিবির প্রক্ষেপণে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট ধরা হলেও এটা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যেই থাকবে। চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে আমাদের। কিন্তু জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে প্রয়োজনীয় যে জ্বালানির দরকার তার জোগান দিতে সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। সরকারও প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান করবে বলে আশ^স্ত করেছে। আশা করি, গ্রীষ্মে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
আগামী মার্চের শেষ দিকে ভারতের আদানি থেকে অতি উচ্চ দামে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। মে মাসের দিকে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ৬১২ মেগাওয়াট এবং আরও কিছু ছোট বা মাঝারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে পারে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হবে। তখন এসব কেন্দ্র উৎপাদনে এলেও বড়জোর ১৩ হাজার মেগাওয়াটের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এর বাইরে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে কিছু কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে। তবু ঘাটতি থেকে যাবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি সরবরাহ করতে সরকারের ডলার খরচের সক্ষমতা সীমিত হয়ে গেছে।
সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। কিন্তু এজন্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা দরকার। এই টাকা সমন্বয় করে গ্যাস-বিদ্যুতের যে দাম হবে তা সোনার চেয়েও দামি হবে। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব, বলেন তিনি।
সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় জানতে চাইলে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রথমত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে বাণিজ্যিকীকরণ থেকে মুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সাশ্রয়ী হতে হবে। সর্বশেষ উপায় হলো, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বন্ধ করতে হবে। তবেই সংকট কমবে। না হলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
সূত্রমতে ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় তেল ও গ্যাস আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। গত জুলাই থেকে খোলাবাজারের এলএনজি কেনা বন্ধ। অর্থাভাবে গ্যাসের আমদানি বিল ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা। জানুয়ারি মাস পর্যন্ত জমা বিলের অর্ধেক পরিশোধের মতো টাকা আছে পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাবে। নতুন করে ১০টি এলএনজি কার্গো আমদানি করতে হলে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে। টাকা না পেলে আমদানি করার সুযোগ নেই। অন্যদিকে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকেও উৎপাদন কমে গেছে।
ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় উৎপাদনে যাওয়ার ২৭ দিনের মাথায় গত শনিবার বন্ধ হয়ে গেছে বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট থেকে প্রতিদিন ৫৬০-৫৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল। পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার মজুদও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বিল বকেয়া থাকায় কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আমদানির এলসি খুলতে চাইছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার মূলত সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়ার আশায় ছিল। মার্চের মধ্যে এ বিদ্যুৎ আসবে বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। জ্বালানি কেনার বিষয়টিও এখনো পরিষ্কার হয়নি। ফলে আগামী গ্রীষ্মে প্রায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে।
সাশ্রয় নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে ১০০০ মেগাওয়াট এবং উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে আরও ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে সরকার। এরপরও অন্তত ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে, বলেন ড. ইজাজ।
৫৪ বছর আগে আজকের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ আইয়ুব সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচির মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি পুলিশের গুলিতে জীবন দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মানুষ সে সময় ভয় ভুলে গিয়ে পথে নামে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী সেই সাহস আর প্রতিবাদের ভাষায় উজ্জীবিত হয়ে বের করে এক শোক মিছিল। একে একে তাতে যোগ দেয় ছাত্র, সাধারণ মানুষ, ছোট-বড় অফিস আদালতের কর্মচারী সবাই। দুই মাইল দীর্ঘ এই মিছিল শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেছিল সেদিন আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে। আসাদের শার্ট হয়ে ওঠে প্রাণের পতাকা। কবি শামসুর রাহমান লিখে ফেলেন তার অমর কবিতা আসাদের শার্ট। কবি লিখলেনÑ গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
আসাদের মৃত্যুর খবরে ঢাকার বাইরেও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। যার পরিণতিতে ঘটে গেল ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান, আইয়ুব খানের পতন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ অন্য আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তিলাভ। এই অভ্যুত্থান শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যেও বিপুলভাবে জাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
শহীদ আসাদ ১৯৪৯ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ধানুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের। শহীদ আসাদের পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ। তবে তিনি শহীদ আসাদ নামে পরিচিত। আসাদ শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জগন্নাথ কলেজ ও মুরারী চাঁদ মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি বিএ ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। শহীদ আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল শাখার পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে দুই ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ ও এনএসএফের একাংশ নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরে ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেই ১১ দফা সারা দেশে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিল। ১১ দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পরে ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হয়েছিল। ১৮ তারিখের মিছিলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। পরদিন (১৯ জানুয়ারি) মিছিল বের হলে আসাদুল হক নামে একজন (তিনি শহীদ আসাদ নন) গুলিবিদ্ধ হন। ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে মিছিলটি বের হয়েছিল, তার প্রথম সারিতে ছিলেন আসাদুজ্জামান আসাদ। চানখাঁরপুল মোড় থেকে পুলিশের জিপ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছোড়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে আসাদের রক্তমাখা প্রাণহীন দেহ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে।
আসাদের মৃত্যুতে সারা দেশে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। আসাদ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) অন্যতম নেতা। একই সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের সংগঠক (প্রধানত শিবপুর এলাকায়) এবং গোপন কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসাদ যেখানে নিহত হয়েছিলেন তার পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের চেষ্টা করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত স্মৃতিস্তম্ভটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। শহীদ আসাদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার স্মৃতিস্তম্ভ স্মৃতির ধুলায় আচ্ছন্ন। বছরের এই একটি দিন ছাড়া সারা বছর অযত্নে পড়ে থাকে তা। স্মৃতিস্তম্ভটি পরিচ্ছন্ন রাখতে খুব একটা উদ্যোগ দেখা যায় না কখনো। স্তম্ভের ভেতরে কাগজ, বোতল পড়ে থাকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দেখা যায়, লাল-সবুজের রঙের তুলির আঁচড় দিচ্ছেন একজন। স্মৃতিস্তম্ভের উপরে রক্তবর্ণে চকচক করে তোলা হয়েছে। আশপাশের কিছুটা জায়গাও পরিষ্কার করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের পাশে চা বিক্রেতা মাসুদ বলেন, আমি গত চার-পাঁচ বছর এখানে চা বিক্রি করি। এখন যেভাবে পরিষ্কার করা হয় সারা বছর এমন থাকে না। একটু আবর্জনার মতো থাকে। এখন যেমন পরিষ্কার করা হয়েছে, এরকম আবার আরেক বছর আসলে করবে।
আমিনুল নামে আরেক বিক্রেতা বলেন, এখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ আছে আজকে জানলাম। কখনো খেয়াল করিনি। সকালে এসে দেখি পরিষ্কার করছে। পরে সকাল ৯টার দিকে কয়েকজন এসে দেখলাম রং লাগাচ্ছে। একজন এসে বলেছে কালকে যেন এখানে না বসি।
একই অবস্থা মোহাম্মদপুর এলাকায় আসাদের নামে নির্মিত তোরণের। তোরণটি এখনো আছে, কিন্তু পোস্টারে ঢাকা পড়েছে এর সৌন্দর্য। অথচ এই তোরণে পোস্টার সাঁটানো যে দণ্ডনীয় অপরাধ, তা স্পষ্ট করেই লেখা আছে সেখানে।
এখন পর্যন্ত আসাদের স্মৃতিসৌধ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শহীদ আসাদ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান মিলন। তিনি বলেন, এত বছর পর এসেও নিজেকে খুব লজ্জিত লাগে। কারণ এত বছর পার হয়ে গেলেও আসাদের নামে এখন পর্যন্ত কোনো স্মৃতিসৌধ হয়নি। আসাদ যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তার পাশে একটা স্মৃতিসৌধ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছি। কিন্তু বর্তমান সরকার আসার পরে সেটা স্থগিত হয়ে যায়।
আসাদ দিবস উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অনন্য মাইলফলক।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে শহীদ আসাদের এ অসামান্য অবদান দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে শহীদ আসাদসহ বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারী সকল শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে আত্মত্যাগকারী শহীদ আসাদ এদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার আত্মত্যাগ সবসময় আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রেরণা জোগাবে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
সৌদি আরবের আসির প্রদেশের আভা জেলায় বাস দুর্ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাগণকে আহত বাংলাদেশী নাগরিকদের চিকিৎসার সকল প্রকার উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
সৌদি আরবের জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের মতে, সোমবার সৌদি আরবের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় আসির প্রদেশের আভা জেলায় একটি ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় প্রায় ২৪ জন নিহত এবং প্রায় ২৩ জন আহত হয়।
বিকেল ৪টার দিকে আগাবত শার নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে যাত্রীদের অনেকেই বাংলাদেশী ছিলেন বলে জানা গেছে।
বাসটি ওমরাহ পালনরত হজযাত্রীদের নিয়ে পবিত্র নগরী মক্কায় যাচ্ছিল।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রেক সিস্টেমের ত্রুটির কারণে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায় এবং আগুন ধরে যায়।
স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কনস্যুলেট প্রতিনিধিকে জানিয়েছে যে, মৃতদেহ পুড়ে যাবার এবং বিকৃত হবার কারণে তাদের জাতীয়তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়েছে।
তাই, উল্লিখিত দুর্ঘটনায় কতজন বাংলাদেশি মারা গেছে তা হাসপাতাল বা ট্রাফিক সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’