
অশ্রুসজল চোখে গভীর আকুতিপূর্ণ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রবিবার শেষ হয়েছে দাওয়াতে তাবলিগের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে শুরু হয়ে ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ মিনিট আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন ভারতের হজরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দের বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সা’দ কান্ধলভী। ২০ লক্ষাধিক মানুষের কণ্ঠে আমিন ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে তুরাগতীর। দুনিয়া ও আখিরাত, দেশ ও বিশ্বের কল্যাণ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন মুসল্লিরা। তারা আত্মশুদ্ধি, গুনাহ মাফ ও সবক্ষেত্রে আল্লাহর রহমত চান।
মোনাজাতের প্রথম ১১ মিনিট পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন তিনি। শেষ ১৯ মিনিটে উর্দু ভাষায় দোয়া করেন। এর আগে সমাপনী (হেদায়েতের কথা) বয়ানও করেন তিনি। বাংলাদেশ ছাড়াও ৬৩ দেশের ৯ হাজারে বেশি বিদেশি মেহমান দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা ও আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার রাত থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে। সূর্য উঠতে না উঠতেই কুড়িল-বিমানবন্দর-আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী-কালীগঞ্জ, আশুলিয়া-সাভার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কসহ বিভিন্ন পথে হাজারও মানুষ হেঁটেই আসতে থাকেন ময়দানের দিকে। এমনকি নারীরাও ভিড় ঠেলে হেঁটে আসেন। মোনাজাতের সময় ইজতেমাস্থলের চারপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। মিল-কারখানার ভেতর ও ছাদ, ঘরবাড়ি, বেড়িবাঁধ, বিভিন্ন যানবাহন এবং নৌকায় বসেও মোনাজাতে শরিক হন বহু মানুষ। মোনাজাত শেষে হেঁটেই ফিরতে হয় এদের প্রায় সবাইকে। যে অল্প কজন মানুষ বাস, পিকআপ বা কোনো যানবাহনে উঠতে পেরেছেন তাদের গুনতে হয়েছে বহুগুণ বেশি ভাড়া।
আখেরি মোনাজাতের জন্য রবিবার আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না।
রবিবার বাদ ফজর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা মুরসালিন। তার বয়ান তরজমা করেন মাওলানা জিয়া বিন কাসিম। সকাল সাড়ে ৯টায় হেদায়েতি বয়ান শুরু করেন মাওলানা ইউসুফ বিন সা’দ কান্ধলভী। তা বাংলা তরজমা করেন বাংলাদেশে মাওলানা জিয়া বিন কাসিম।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম জানান, যেসব মুসল্লি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে চিল্লায় যাবেন ইজতেমা ময়দানে তাশকিলে কামরায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। রবিবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় এক হাজারের মতো তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
১ বদনা পানি ১০ টাকা : রবিবার ইজতেমা ময়দানের আশপাশে প্রতি বদনা পানি ১০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। অনেক মুসল্লি প্রতি পাতা পত্রিকা ৫ টাকা করে কিনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও আশপাশের ফুটপাতে বসে মোনাজাতে অংশ নেন।
অতিরিক্ত ভাড়া : মুসল্লিরা বাড়ি ফিরতে বেশ ভোগান্তিতে পড়েন। টঙ্গী ব্রিজ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ১০ টাকার ভাড়া একশ টাকা এবং টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ২৫ টাকার ভাড়া ১০০ টাকা আদায় করা হয়। বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের ক্ষেত্রেও কয়েক গুণ বেশি বাস ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ভোগান্তি থাকলেও অভিযোগ নেই : ইজতেমায় অংশ নেওয়া মুসল্লিরা আসা ও যাওয়ার পথে গাড়ি না পেয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হলেও তাতে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে আসা আকবর আলী জানান, সকালে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে ময়দানে এসেছি মোনাজাতে অংশ নেওয়ার জন্য। আল্লাহর রহমতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, বরং ভালোই লাগছে।
যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ : ভোর থেকে ইজতেমামুখী সব যানবাহন চলাচল ছিল নিয়ন্ত্রিত। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী ও বিমানবন্দর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত, ঢাকা-কালীগঞ্জ সড়কের মিরেরবাজার থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সব ধরনের যানবাহন চলাচল ছিল সীমিত।
বিশ্ব ইজতেমায় আরও দুই মুসল্লির মৃত্যু: বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে শনিবার রাতে ও রবিবার দুপুরে আরও দুই মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাতে মারা যান আবু তাহের (৬৫), তার পিতার নাম সৈয়দ আলী। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। তিনি শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার খিত্তায় মৃত্যুবরণ করেন। এ ছাড়া রবিবার আখেরি মোনাজাতের পর আরও এক মুসল্লি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার নাম মাসুদুর রহমান (৫৮), তিনি জামালপুরের বকশিগঞ্জ থানা এলাকার রাজা মিয়ার ছেলে। এ নিয়ে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে মোট সাত মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
১৯৪৬ সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে ইজতেমা আয়োজন করা হয়। ১৯৬৬ সালে গাজীপুরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বর্তমান ময়দানে স্থানান্তর করা হয় বিশ্ব ইজতেমা। এ বছর ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারি রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের (জুবায়েরপন্থি) বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটে। মাঝে চার দিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের অনুসারী (মাওলানা সাদপন্থি) মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেন। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এবারের বিশ্ব ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘটে।
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
দলকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দলকে শক্তিশালী করার জন্য সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার একাধিক নজির স্থাপন করেছে আওয়ামী লীগ। তবে এ নিয়ে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। তারা বলছেন, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঝুঁকি মনে করলে সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন?
অবশ্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, সংগঠন শক্তিশালী করার জন্যই যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সেই সিদ্ধান্ত দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে মূলত এমন মনে হলে সরে আসতে হয়। তারা বলেন, এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বাস্তবায়ন করতেই হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রত্যেকটি দলের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা থাকে। তেমনি সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য নানা পরিকল্পনায় এগিয়ে যেতে হয় আওয়ামী লীগকে। এ বিষয়টি পুরোপুরি সময় ও প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে।’
দলকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ঘটনায় দলের প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বেশ অসন্তুষ্ট। কেন্দ্রীয় কোনো কোনো নেতা অসন্তুষ্ট থাকলেও প্রকাশ্যে বলার সুযোগ নেই বলে দাবি করেন তারা। তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন মনোভাব জানা গেছে।
দলটির সভাপতিমন্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে না পারার কারণে দলের শৃঙ্খলাও ধরে রাখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ওই নেতার দাবি, যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে মনে করা হয় সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন?
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা দাবি করেন, জেলা-উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দল বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। দলীয় ঐক্য নষ্ট হওয়ার অন্যতম একটি কারণও সিদ্ধান্তে অটল থাকতে না পারা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরে এলে অপরাধীরা অপরাধ করতে ভয় পায় না। গত এক যুগে বেশি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগে।
তারা মনে করেন, এ কারণেই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার দলীয় ঐক্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আগামী নির্বাচনের আগে ঐক্যের এ মিশন কতখানি সফল হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগের ভেতরে। কারণ ত্যাগী ও আদর্শে অটল নেতাকর্মীদের হাতে এখন দল নেই। ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ এখন পাঁচমিশালি নেতাকর্মীতে পূর্ণ। ক্ষমতার এক যুগে এই পাঁচমিশালি নেতাকর্মীদের শেকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে থাকা এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত ১৪ বছরে দলে একটি বড় প্রেশার গ্রুপ তৈরি হয়েছে। ওই গ্রুপটি ভুলভাল বুঝিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে নেতৃত্বকে চাপে রাখে। ফলে দলের নেতাকর্মী ও দলের বাইরে সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে আস্থা রাখতে পারে না।
গত ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত চার বছরেই কমপক্ষে ২০টি সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা থেকে এসেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ৮১ সদস্যের এ কমিটির। অন্য ফোরামেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের স্বার্থে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করেন। পরে কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সেসব চূড়ান্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতেও ওই সভা করতে হয়।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দল ও সরকার আলাদা হবে। এ নীতি অনুসরণের কারণে ১৪ দলীয় জোটের কোনো নেতাকেও রাখা হয়নি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় দফার মন্ত্রিসভায়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে দলের আইন সম্পাদকের পদ ছাড়তে হয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হক চৌধুরী নওফেল মন্ত্রীর চেয়ারে বসায় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ ছাড়তে হয়েছে। অপরদিকে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ সাধারণ সম্পাদক, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে থেকেও তারা মন্ত্রী।
গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যিনি সংসদ সদস্য হবেন তিনি তৃণমূলে কোনো পর্যায়ের কমিটিতে শীর্ষ দুই পদে থাকতে পারবেন না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয় আওয়ামী লীগ থেকে। ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার ৪০টিরও বেশি জেলায় সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন সংসদ সদস্যরাই। ওই সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একাধিক জেলায় সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক দুজনই দলীয় সংসদ সদস্য। উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতেও ওই সিদ্ধান্ত মানা হয়নি।
২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইন করা হয়। ওই আইনে ২০১৫ সালে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করে স্থানীয় সকল পর্যায়ে নির্বাচন প্রথম শুরু হয়। ওই নির্বাচনে অধিকাংশ এলাকায় দল মনোনীত প্রার্থীকে তৃণমূল আওয়ামী লীগ সাদরে গ্রহণ করেনি। অথবা দলীয় সংসদ সদস্যের পছন্দ হয়নি নৌকা প্রতীক পাওয়া ওই প্রার্থীকে। ফলে দলেরই আরেকজন বিদ্রোহ করে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে নেমে পড়েন। ওই স্থানীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর চেয়ে বিদ্রোহী ও বিএনপির প্রার্থীরা বেশি জয়লাভ করে। দলীয় প্রতীকে প্রথম নির্বাচন হওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাপারে তেমন কোনো শক্ত অবস্থানে যায়নি আওয়ামী লীগ।
বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রার্থী নির্বাচনে তৃণমূল আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সাংগঠনিক ইউনিটগুলোকে তৃণমূল থেকে ভোটাভুটি করে অথবা সমঝোতার ভিত্তিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ। এজন্য ২০১৬ সালের জাতীয় সম্মেলনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। ওই বোর্ডের সভাপতিও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ওই বোর্ডই চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করবে। কেন্দ্র থেকে আরও বলা হয়, তৃণমূল থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী যার নাম আগে আসবে তাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু দেখা যায়, তৃণমূলের তালিকায় নাম আসেনি কিন্তু মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারগুলোও তৃণমূলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। বিদ্রোহের লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে তাদের দল থেকে বহিষ্কার ও প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। তৃণমূল পর্যায়ে তাদের বহিষ্কারের সুপারিশ করে কেন্দ্রকে।
২০২১ সালে স্থানীয় সরকারের অধীনে সিটি করপোরেশন মেয়র, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ভোট শুরু হয়। ভোটে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেন নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলতে স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন যে কেউ। তিনি বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ জিতুক সেটা চায় না আওয়ামী লীগ। এই ঘোষণায় স্থানীয় নির্বাচনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সকলে।
দলের শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ায় আওয়ামী লীগ আবারও সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তাকে বহিষ্কার করা হবে। তবুও ভয়হীন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। তারা মনে করতেন, ভোটে জিততে পারলে বহিষ্কার করা হবে না। ফলে নির্বাচন হলেই কেন্দ্র কঠোর অবস্থানে থাকলেও বিদ্রোহী প্রার্থীর লাগাম টানা যায়নি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তৃণমূল থেকে বহিষ্কারের সুপারিশও আসে।
গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, এই জেলার ঘুড়িদহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয় গত ডিসেম্বরে। সেখানে তৃণমূল থেকে তিনজনের নাম পাঠানো হয়। পরে দেখা যায়, মনোনয়ন বোর্ড এমন একজনকে মনোনয়ন দিয়েছে, যার নাম কেন্দ্রে পাঠানোই হয়নি।
সর্বশেষ গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বিদ্রোহী ও বিদ্রোহীদের মদদদাতাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করার দায়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করা হয়। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর দল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। পরে মেয়রের দায়িত্ব থেকেও সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত হন তিনি। কিন্তু অপরাধ ভিন্ন হলেও স্থানীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় তার বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার করা হয়।
স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সারা বিশে^র নজর কেড়েছে। সারা বিশে^র মতো বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিশ^ব্যাংকও। এ মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, শিক্ষায় উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিরসন বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ, যেখানে বিনিয়োগ সহযোগী হিসেবে এগিয়ে আসবে বিশ^ব্যাংক।
গতকাল রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ^ব্যাংকের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সেলিব্রেটিং এ জার্নি টুগেদার : বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ফিফটিথ অ্যানিভার্সারি ইভেন্ট’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এক্সেল ভন ট্রটসেনবার্গ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। অথচ ২০০০ সাল পর্যন্ত এ দেশের অর্থনীতির গতি ছিল খুবই ধীরগতির। এ সময় পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ৬ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি ছিল। এ সময়ে লাখো মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ১৯৭২ সাল থেকে বিশ^ব্যাংকের সঙ্গে এ দেশের পথচলা শুরুর পর এখন দেশের মানুষের গড় আয় ২১ শতাংশ বেড়েছে। ফলে ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয় তারা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সফলতা কডিভ মহামারী নিয়ন্ত্রণ।
বাংলাদেশের সাফল্যের একটি দিক হলো জলবায়ু সংকটে ভুক্তভোগীদের রক্ষায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র বানানোর এ মডেলটি প্রশংসনীয়। বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা সব দেশকে এটি অনুসরণ করার পরামর্শ দেব। আগামীকাল মঙ্গলবার দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করবেন ট্রটসেনবার্গ।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে এ দেশে আশ্রয় দিয়েছে দেশটি। বিশ^ব্যাংক কানাডার সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে আলোচনা করে এদের জন্য ৫৯ কোটি ডলার অর্থায়ন করেছে। ট্রটসেনবার্গ বাংলাদেশের সঙ্গে ৫০ বছরের ফলপ্রসূ অংশীদারিত্ব উদযাপনকালে, বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বব্যাংকের দৃঢ় সহায়তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। পরে বিশ্বব্যাংকের আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ এখন ডিজিটালাইজেশনের একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জও আছে। তবে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, ৭২ সালের পর এখন পর্যন্ত রপ্তানি আয় ১০ গুণ বেড়েছে।
অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা দেওয়া হবে কি না সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি নির্ভর করে বাংলাদেশের নেওয়া প্রকল্পের গুরুত্বের ওপর। আমরা এখন জলবায়ু ও শিক্ষায় জোর দিচ্ছি। এ ছাড়া সব দেশেই ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) মাধ্যমে সমান বিনিয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ প্রকল্প বিদেশি অর্থায়নে হয়। গত বছর অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) দেশগুলো থেকে অনেক মূলধন নিয়েছে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রটসেনবার্গ বলেন, এ ইস্যুকে আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। এটা এ দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে। সবাই আশা করছে তারা যেন রাজনৈতিকভাবে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে। মঙ্গলবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাব।
পদ্মা সেতুর বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়া ভুল ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতি বছর সারা বিশ্বের তিন শতাধিক প্রকল্প প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। এটিও সে তালিকাতেই পড়েছিল।
ট্রটসেনবার্গ বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশ অচিন্তনীয় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, কডিড-১৯, ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জের সময়ে আমরা বাংলাদেশকে এর উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উন্নয়ন শুরু। ৭২ সাল থেকে জিডিপির আকার ৭৪ গুণ বেড়েছে। ১৯৭২ সালে জিডিপির আকার ছিল ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আমাদের দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ২০ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলার। গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু, তবে আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি শেখ হাসিনা, এটা নিয়ে কারোর প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক অনেক সহায়তা করছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের পরবর্তী টার্গেট ২০৩১ সালে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ স্মার্ট ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ হবে।
এ সময় আরও বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান, বাংলাদেশ ও ভুটানে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লাই সেক প্রমুখ।
বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বলেন, স্বাধীনতার সময়ের দরিদ্র দেশের পরিচয় থেকে এ দেশ বিশে^র দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির সম্মানীয় পর্যায়ে। এ দেশের অগ্রযাত্রায় সবসময় অংশীদার হবে বিশ্বব্যাংক।
গত পাঁচ দশকের অসাধারণ যাত্রায় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অংশীদার। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য হয়। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক প্রথম প্রকল্প হাতে নেয়। যার মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষি ও শিল্পের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নির্মাণ ও বিদ্যুৎ খাতের সহায়তার জন্য ৫০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি পুনরুদ্ধার ঋণ দেওয়া হয়। একই সময়ে বিশ্বব্যাংক চারটি প্রকল্প পুনরায় চালু করে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রমে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) আওতায় অনুদান, সুদবিহীন ঋণ এবং নমনীয় ঋণ হিসেবে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ৫৩টি চলমান প্রকল্পে প্রায় ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন রয়েছে।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
ভারতীয় দৃশ্য গণমাধ্যম (ভিজ্যুয়াল মিডিয়া) এনডিটিভির নিয়ন্ত্রণ আদানির হাতে গেছে এ বছরেই অর্থাৎ ২০২৩ সালে, আনুষ্ঠানিকভাবে। আদানি নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করায় এনডিটিভি বোর্ড থেকে এর প্রতিষ্ঠাতারা অবশ্য কিছুদিন আগেই পদত্যাগ করেছেন। এনডিটিভির দাপ্তরিক নাম নিউ দিল্লি টেলিভিশন লিমিটেড। এর প্রতিষ্ঠাতা প্রণয় রায় এবং রাধিকা রায় ২০২২ সালের ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বিলিয়নেয়ার গৌতম আদানির বাণিজ্য-সাম্রাজ্য এ মিডিয়া কোম্পানিটির বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক এখন। এনডিটিভির পরিচালনার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। রায়দের সঙ্গে অন্য চারজন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও পদত্যাগ করেছেন।
আদানি অঁতরপ্রনর (আদানি এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড) তার সাবসিডিয়ারি আরআরপিআর হোল্ডিং এবং বিশ^প্রধান কমার্শিয়ালের মাধ্যমে এডিটিভির প্রায় ৬৫ শতাংশের (৬৪.৭২%) মালিক। নতুন মালিকানা-বিন্যাসে রায়রা ৫ শতাংশ (জনপ্রতি ২.৫ শতাংশ) মালিকানার অধিকারী। প্রণয় রায় বলেছেন, কোম্পানির মালিকানায় পরিবর্তন আসায় তিনি পদত্যাগ করেছেন। তার ভাষায়, এর আর কোনো কারণ নেই। ভারতের প্রথিতযশা এ সাংবাদিক এডিটিভির নির্বাহী সহ-চেয়ারপারসনের পদ থেকে সরে দাাঁড়িয়েছেন।
এনডিটিভির অধিগ্রহণকারী গৌতম আদানি বিশে^র তৃতীয় ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক এবং জেফ বেজোসের পরই তিনি। এখন তিনি আরেক ভারতীয় বিলিয়নেয়ার মুকেশ আম্বানির মিডিয়া সাম্রাজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবেন। মুকেশও তার মিডিয়া সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন বেশ আগে থেকেই। এনডিটিভির মালিকানা পেয়ে আদানির সুবিধাই হলো। বিশ্বমানের মিডিয়া-অবকাঠামো রয়েছে এনডিটিভির; মেধাবী সাংবাদিকও রয়েছে। এনডিটিভিকে একটি সমৃদ্ধ মাল্টি-প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল নিউজ অর্গানাইজেশনে পরিণত করতে চান আদানি। সুসংহত করতে এতে বিনিয়োগও বাড়াবেন।
এনডিটিভি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালে। সাংবাদিক দম্পতি প্রণয় রায় ও রাধিকা রায়ের মালিকানায়। কথা হচ্ছে, নিজস্ব বিনিয়োগ, আলাপ-আলোচনা এবং প্রতিষ্ঠাতাদের অজান্তেই আদানির হতে চলে গেছে এনডিটিভির মালিকানা। ফলে পাবলিক কনফিডেন্সে বেশ কিছুটা আঘাত লেগেছে। আদানির মালিকানা ঘোষিত হওয়ার পর শেয়ারবাজারে এনডিটিভির শেয়ারের দাম ২০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। অতিসম্প্রতি দাম ১.২ শতাংশ বেড়েছে বটে, কিন্তু জনতুষ্টি এখনো আগের অবস্থায় যায়নি।
দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক নামের একটামাত্র শো দিয়ে এনডিটিভির যাত্রা শুরু রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দূরদর্শনের ওপর প্রতিবেদন দিয়ে। কোনো গ্র্যান্ড প্ল্যান তখনো ছিল না প্রতিষ্ঠাতাদের। সাপ্তাহিক প্রতিবেদন দিয়ে শুরু করা চ্যানেলটিকে দিনে ২৪ ঘণ্টার প্রাইভেট চ্যানেলে এবং ভারতের প্রথম প্রাইভেট চানেলে পরিণত করার বিশেষ কোনো পরিকল্পনাও প্রণয়-রাধিকার ছিল না; তবে কালে সেটি হয়েছে। ক্রমে ইন্ডিপেনডেন্ট ব্রডকাস্টার হয়ে উঠেছে এনডিটিভি। তারপর তিন দশক পার হলো।
এখন মালিকানা গেল আদানির হাতে। অনেকে তাকে নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে জানেন। অবশ্য তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এমনই যে, সব দলের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য। ২০২২-এর মার্চে মি. আদানির নতুন কোম্পানি এএমজি মিডিয়া নেটওয়ার্কস লিমিটেড ডিজিটাল বিজনেস নিউজ কোম্পানি কিন্টিলিয়নের শেয়ার কেনে। কিন্টিলিয়নের ওই শেয়ার এতটাই নগণ্য যে, তা আদানির মনোযোগ আকর্ষণ করতে যথেষ্ট ছিল না। আদানির বড় কোনো প্ল্যান আছে কি না তা কিন্টিলিয়নর মালিকপক্ষের ভাবনায় আসেনি। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, এনডিটিভি কিনে নেওয়াটা কোনো ব্যাপার ছিল না আদানির কাছে। এখন তার অ্যাটেনশন বদলেছে। এক ধরনের চালাকি আছে তার মালিক হওয়ায়। এটাই আলোচনার সরস বিষয়। কৌশলে কি তিনি নিয়োগ করেছিলেন ‘অপ্সরা’! যেমন পুরাকালে করা হতো। সর অপসারণ করে নেয় যারা তারাই তো অপ্সরা। আদানি তাহলে বাণিজ্যদুধের সর গোপনে মেরে দিয়েছেন। পৌরাণিক চাতুর্যের লক্ষণ আছে তার মালিক হওয়ায়।
এনডিটিভি বেশ কিছু কারণে আলোচ্য বেসরকারি ভিজ্যুয়াল মিডিয়া। ভোট-বিশ্লেষণে পাইওনিয়ার; ডাডাভিত্তিক বিশ্লেষণে ভারতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রভাতি অনুষ্ঠানে, লাইফস্টাইল বিষয়ক অনুষ্ঠানেও এনডিটিভি জুড়িহীন। অনলাইনেও তার প্রবল উপস্থিতি আছে। অনলাইন ফলোয়ার ৩৫ মিলিয়ন। এনডিটিভিকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, আলজাজিরার মতো মিডিয়া আউটলেট বানাতে চান আদানি। ৭৬ শতাংশ লোক এনডিটিভির খবর বিশ্বাস করে। যদিও আদানির মালিকানা গ্রহণে অনেকেই বিরক্ত; তারা মনে করে আদানির টেকওভারের ফলে এনডিটিভির এডিটরিয়াল ইন্টিগ্রিটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও আদানি বলেছেন, Òthere’s nothing to fear. “Independence means if government has done something wrong, you say it’s wrong,” …. “But at the same time, you should have courage when the government is doing the right thing. You have to also say that.Ó”
ধনকুবেররা কত কথাই বলে, আদানির কথাও ওইরকম কথাই কি না দেখতে হবে চোখ-কান খুলে। মিডিয়া মালিক হওয়ার বৈশ্বিক প্রবণতা মোটে ভালো নয়। গণমাধ্যমের স্বকীয়তা মালিক হওয়ার সুবাদে বিকিয়ে দেওয়ার অনেক নজির আছে। আমাদের এখানেও আছে।
ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ থাকছে না বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে একটি মহল পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য এসেছে। আর ওই তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার পুলিশের সব রেঞ্জ অফিস ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষ বার্তা পেয়ে ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোমবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিদ্যুৎ স্টেশনে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি মহল লোডশেডিংয়ের অজুহাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশেষ বৈঠক করছি। এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তা সত্য। এ জন্য আমরা বেশ সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ অফিস ও স্টেশনগুলোর বিষয়ে থানার ওসিদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি বিশেষ মহল। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তা ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ অফিসের পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে ৫০ থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাইকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যা নিয়ে কোন মহল যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। আশা করি বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে না। তারপরও পুলিশ সতর্ক আছে।
সূত্র জানায়, লোডশেডিংকে পুঁজি করে কেউ যাতে অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনার পর সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস, সাবস্টেশনসহ কেপিআই স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সমিতি বা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশকে চিঠি দিয়ে বাড়তি নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
বছরে ৪০ কোটি ডলার পারিশ্রমিকের প্রস্তাব নিয়ে লিওনেল মেসির সংগে যোগাযোগ করছে আলো হিলাল। তারা মংগলবার চুক্তির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে বলে জানিয়ে রেখেছে। কিন্তু মেসি তাদেরকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রস্তাবটা পিছিয়ে দিতে বলেছেন বলে খবর দিয়েছে ফুটবল বিষয়ক ওয়েব পোর্টাল গোল ডটকম।
তবে সৌদি ক্লাব এ-ই প্রস্তাব এখনই গ্রহন না করলে আগামী বছর তা একই রকম থাকবে না বলে জানিয়েছে।
মেসি আসলে তার শৈশবের ক্লাবে আরো অন্তত এক বছর খেলতে চান। তাতে তার পারিশ্রমিক সৌদি ক্লাবের প্রস্তাবের ধারে কাছে না হলেও ক্ষতি নেই। জানা গেছে, বার্সা তাকে এক বছরে ১৩ মিলিয়েন ডলার পারিশ্রমিক প্রস্তাব করতে যাচ্ছে।
লা লিগা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ায় মেসিকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবে বার্সা। ধারনা করা হচ্ছে বুধ-বৃহস্পতিবারের মধ্যে এ ব্যাপারে একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।