
গত বছর সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করে দেশের চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। চিনির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে ব্যবসায়ীরা খোলা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম বাড়িয়েছে কেজিতে ৬ টাকা। তবুও নতুন দামে চিনি কিনতে পারেননি ভোক্তারা। ব্যবসায়ীরা তখন বলেছেন, বাজারে চিনির সরবরাহ কম। সেই থেকে চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাস কেটে গেলেও এখনো চিনি সংকটের সমাধান হয়নি। প্রতি কেজি চিনিতে সরকারের নির্ধারিত মূল্যেও বাজারে চিনি মিলছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার যখন আরেক দফা দাম বাড়ানোর ঘোষণা এলো তখনো বাজারে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছিল কমপক্ষে কেজি ১১৫ টাকা দরে। পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতেও প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ খুবই কম বলে জানান খুচরা ব্যবসায়ীরা।
গত বুধবার চিনি সরবরাহ ও দামের বিষয়ে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি চিনির প্রক্রিয়াজাতকরণ করে থাকে। তাদের কারণে বাজারে চিনির কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে সরকারের উচিত হবে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। প্রকৃতপক্ষে বাজারে কোনো ধরনের সংকট থেকে থাকলে সরকারের উচিত হবে সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া এবং চিনির আমদানি বাড়ানো।’
ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা ক্যাবের সভাপতি বলেন, ‘রমজানের পণ্যগুলোর মধ্যে চাহিদা শীর্ষে থাকে চিনি। রোজাদারদের স্বস্তির জন্য চিনির বাজার স্বাভাবিক হওয়া এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা শুধু গণমাধ্যমের মাধ্যমে বলতে পারি, ভোক্তার কথা চিন্তা করে রমজানের আগেই যেন সরকার দ্রুত চিনির বাজার স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।’
খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে চিনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কেজিপ্রতি খোলা চিনি ১০৮ ও প্যাকেটজাত চিনি ১০৯ টাকা করে বিক্রি করে থাকে। বিশেষ করে কারওয়ান বাজারে চিনির ডিলাররা পরিচিত ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে চিনি বিক্রি করেন না। অনেকে রসিদ না দিয়ে চিনি বিক্রি করেন।
তেজগাঁও মহিলা কলেজ এলাকার চাঁদপুর স্টোরের মুদি দোকানি সিদ্দিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত পাঁচ মাস ধরে ঠিকমতো চিনি বিক্রি করতে পারছেন না। বাজারে চিনির জন্য গেলে আজ আছে তো তো কাল নেই এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। কারওয়ান বাজারে রসিদ ছাড়া প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চিনি কিনে আনতে হয় ৫ হাজার ৫৫০ টাকা। দোকানে সরবরাহ করা কোম্পানির বিক্রিয়কর্মীরাও প্যাকেটের গায়ের মূল্যের চেয়ে ২ টাকা অর্থাৎ প্রতি কেজি ১০৯ টাকা ছাড়া তাদের থেকে কেনা যায় না।’
চিনি সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি দাবি করে কারওয়ান বাজারের চিনির ডিলার ইব্রাহিম স্টোরের স্বত্বাধিকারী ইব্রাহিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মোকাম কিংবা মিল কোথাও চিনি পাওয়া যায় না। অগ্রিম টাকা নিলেও চাহিদামতো চিনি দিতে পারে না। দৈনিক ১০০ বস্তা চিনির পরিবর্তে ৪০-৫০ বস্তা চিনি দিচ্ছে।’ রমজানের চিনির জন্য আরও হাহাকার চলবে বলেও এ ব্যবসায়ী আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের ম্যানেজার সিরাজুন্নবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিগগিরই বাজারে চিনির সরবরাহ ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সরকার নির্ধারিত মূল্যে বাজারে প্যাকেটজাত চিনি সরবরাহ করছি। রমজান আসার আগেই চাহিদা অনুযায়ী ভোক্তারা নির্ধারিত মূল্যে চিনি কিনতে পারবে বলে আশা করা যায়।’
পাকেটের গায়ের মূল্যের চেয়ে দাম বেশি নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোম্পানির পক্ষ থেকে দাম সমন্বয় করেই বিক্রি করছি, যেন সরকার নির্ধারিত মূল্যে সাধারণ ভোক্তারা চিনি ক্রয় করতে পারেন। তবে আমাদের অনুপস্থিতিতে বাজারভেদে ব্যবসায়ীরা চিনির দাম বেশি নিয়ে থাকতে পারেন।’
বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা বলছে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে অধিদপ্তর সবসময় মাঠে কাজ করছে। আসন্ন রমজানকে ঘিরে রোজাদারদের চাহিদার শীর্ষে থাকা সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চিনি পরিশোধনকারী মিলগুলোতে অধিদপ্তরের নজরদারি রয়েছে। মিল থেকে বাজারে আসা পর্যন্ত কোনো চক্র চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কি না তা জানা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য আমরা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চেয়েছি। যাতে করে চিনি সংকটের পেছনে কেউ থাকলে তাদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারি।’
বিরোধী দল থেকে ছিটকে পড়া বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসুক আওয়ামী লীগ চাইলেও দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও সমমনা অন্য দলগুলো তা চায় না। নির্বাচনী মিত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসুক তা চায় না। আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস মিলেছে। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও শরিক দলের এমন চাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওই নেতারা দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, ভোটে বিএনপি অংশ নিলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকা অন্য দলগুলোর চাওয়া-পাওয়ায় অপূর্ণতা থেকে যাবে বলে তারা মনে করছেন। আসন ভাগাভাগিসহ শরিক দলের নানা চাওয়ায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে এটাও ভাবছেন তারা।
জাতীয় পার্টি নির্বাচনে বিএনপিকে না চাওয়ার কারণ সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতারা বলেন, সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা নিশ্চিত রাখতে তারাও বিএনপিকে নির্বাচনে দেখতে চায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষ এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি যেসব দাবি-দাওয়া জানিয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাদের ক্ষমতার চেয়ারে বসাতে হবে। সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে বিএনপির সংবিধানের বাইরে চাওয়া মেনে নেওয়া অসম্ভব। ওই নেতা বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি যা চায় তা মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৯ আসন নিয়ে বিএনপি বিরোধী দলের আসনে বসলেও ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে নির্বাচন ঠেকানোর জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ফলে জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দলীয় আসনে বসে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপি সাতটি আসন পায়।
১৪ দলীয় জোটের শরিক ধর্মভিত্তিক দলের শীর্ষ এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচনে বিএনপি এলে অংশগ্রহণমূলক হবে, না এলে হবে না এ ধারণা থেকে দেশি-বিদেশি সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি ছাড়াও এ দেশে নির্বাচন হয়েছে, আগামী নির্বাচনও হবে। এ নেতা বলেন, জোটের অনেক বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগকে এ পরামর্শ দিয়েছেন। কারও অন্যায় চাওয়া মেনে নিয়ে তাদের নির্বাচনে আনার পদক্ষেপ নিতে তার দল ও জোটের আরও কয়েকটি দল আওয়ামী লীগকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা শরিক দলের এ পরামর্শ আমলে নেননি। তারা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে। সরকারও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। এ জন্য দেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক এ প্রত্যাশা করেন তারা। নির্বাচন প্রশ্নে শরিক দলগুলোর অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বলে দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিম-লীর এক সদস্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ চায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলই অংশগ্রহণ করুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবাধ, সুষ্ঠুু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক।’ তিনি বলেন, কোন দল নির্বাচনে আসবে, কোন দল আসবে না সেটা একেবারেই নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
জানা গেছে, বিএনপিকে ভোটে না চাওয়ার কারণ একেবারেই ওই দলগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থে। বিএনপি ভোটে না এলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন নিয়ে দরকষাকষিতে যাওয়া সহজ হবে এমনটাই মনে করে শরিকরা। বিএনপি ভোটে এলে জয়ের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছোট দলগুলোর দরকষাকষি ঠিক জমে উঠবে না। কারণ, তখন আওয়ামী লীগের মাথায় জয়ের হিসাব-নিকাশই থাকবে বেশি।
জাতীয় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতাও দেশ রূপান্তরকে বলেন, জাতীয় পার্টির সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা অনিশ্চিত হয়ে যাবে এ শঙ্কায় বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসুক তা চায় না। বিএনপি নির্বাচনে এলে সংসদে বিরোধী দলের আসন হারাবে জাতীয় পার্টি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সবাই সবার মতো করে রাজনৈতিক স্বার্থ দেখছে। জাতীয় পার্টিসহ আমাদের শরিক দলগুলোর ভেতরে এমন কিছু চাওয়া রয়েছে সেটা তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় ও বৈঠকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।’ তারা বলেন, আওয়ামী লীগ মনে করে বিএনপিকে বাইরে রেখে এবারে নির্বাচন করা ঠিক সহজ হবে না। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে সরকারের ওপর চাপ আছে বিদেশিদের। আছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপও। কোনো রাষ্ট্র এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে সরকারকেই। এ পরিস্থিতিতে সে চাপ কাটিয়ে যেনতেন নির্বাচনের সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির ভেতরে ইতিবাচক দিকে থাকতে বিদেশি চাপ আছে। আবার বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও মনে করেন, আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটবে বিএনপির। তাই নির্বাচন বর্জন নয়, নির্বাচন ঠেকাতে চাইবে তারা। নির্বাচন ঠেকাতে না পারলে বর্জন করবে না বিএনপি। নির্বাচন বর্জন করে রাজনীতি থেকে একেবারে হারিয়ে যাওয়ার রিস্ক এবার আর বিএনপি নেবে না। সভাপতিম-লীর ওই সদস্য আরও বলেন, বিএনপি তাদের দাবি আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। সম্ভব না হলে শেষমেশ নির্বাচনে আসবে। কারণ, বিএনপি সরকারে না আসতে পারলেও সংসদের বাইরে আর থাকতে চায় না। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিয়ে মাঠে থাকতে পারলে সফলতা আসবে এ চিন্তায় নির্বাচনে আসবেই বিএনপি।
ফলে ক্ষমতাসীন দলের জোটসঙ্গী ও সমমনারা বিএনপি ভোটে আসুক তা না চাইলেও রাজনৈতিক পূর্বাপর পরিস্থিতিতে বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন তুলতে অনাগ্রহী আওয়ামী লীগও। সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে একেবারেই সব ছেড়ে-ছুড়ে দেওয়ার মানসিকতাও দেখাবে না আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, সত্য হলো, নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশি চাপ যেমন সরকারের ওপর আছে, তেমনি বিএনপির ওপরও থাকবে। গত দুই দফার সংসদ নির্বাচনে বিদেশি শক্তিগুলোর নানা মত থাকলেও বিএনপি এবার নির্বাচনের বাইরে থাকুক তেমন ‘ব্যবস্থাপত্র’ নেই। ফলে বিএনপিও নির্বাচন বর্জন করবে না। আবার নির্বাচনে থাকবে সেই ঘোষণাও এখনই দেবে না বিএনপি। শেষ বেলায় নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেবে বিএনপি। এখন মাঠে অনড় থেকে কতটুকু দাবি আদায় করতে পারে সে চেষ্টায় আন্দোলন ও অনমনীয় অবস্থানে আছে দলটি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও শরিকরা জোট ছেড়ে যায়নি। হতাশার কথা জানালেও জোটে থেকেও গিয়েছিল অধিকাংশ দল। শেষ পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে জোট বিলুপ্ত করে। শরিকরা আলাদা জোট গঠন করে বিএনপির দাবি-দাওয়া সমর্থন করে তাদে সঙ্গে থেকে যায়। জোটের অন্তত চারজন নেতার বক্তব্য অনুযায়ী, এখনো তাদের হতাশা আছে। কিন্তু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কারণে বিএনপির সঙ্গে তারা থাকছেন।
গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশের আগের দিন হঠাৎ করেই ২০ দলীয় জোট বিলুপ্তির ঘোষণা করে বিএনপি। দলটির গুলশানের কার্যালয়ে জোটের সব শরিককে ডেকে জানানো হয়, আজ থেকে যার যার মতো চলবে। দলগুলোর কেউ আজ থেকে জোটের পরিচয় দেবে না। বিএনপির পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা আসবে-২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আঁচ করতে পারলেও আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি শরিকরা।
জোটের ওই বৈঠকেই শরিক নেতাদের ক্ষোভের মুখে পড়েন অনানুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্তির এ ঘোষণা দেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। হতাশা ব্যক্ত করে জোট নেতারা তাকে জানান, অন্তত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জোট বিলুপ্তির ঘোষণা আসতে পারত। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করেন নজরুল ইসলাম খান।
বিএনপির ঘোষণার পর অনেকটা কূল ছাড়া সাগরে পড়ে জোটসঙ্গীরা। উপায়ান্তর না দেখে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নতুন জোট গঠনের তৎপরতা শুরু করেন। দুভাবে বিভক্ত হয়ে ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট নামে যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গেই থাকে তারা।
জানতে চাইলে যুগপৎ আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দেশ রূপান্তরকে বলেন,‘২০ দলীয় জোটকে নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতিবাচক ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছিল, সেটি ভেঙে দিতে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই আমরা এটি করেছি।’ তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আমরা দেখাতে চেয়েছি বিএনপির রাজপথে বড় একক শক্তি এবং দেশের আপামর জনগণ দলটির সঙ্গে আছে। আবার যারা বিএনপির সঙ্গে আছে, তাদেরও একক অস্তিত্ব রয়েছে। তারাও কর্মসূচি পালন করতে পারে।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নেতা জানান, গত দুই যুগে ২০ দলীয় জোটের (আদতে ২৩ দল) কর্মসূচিতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ছাড়া মূলত কারোই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না। শক্তি-সামর্থ্যরে দিকে অনেক পিছিয়ে। মঞ্চে বক্তৃতার জন্য জোটের শীর্ষ নেতারা উন্মুখ হয়ে থাকলেও অধিকাংশেরই কর্মী সংকট থাকত। দেশি-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংখ্যার তত্ত্ব বিএনপি দেখাতে পারলেও এসব দলের দুই-একজন ছাড়া অধিকাংশেরই সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। বিরোধীপক্ষের মুখ বন্ধ রাখতে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও এই সিদ্ধান্ত নিতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের একাধিক নেতা বলছেন, বিএনপি না চাইলেও নানা কারণে বিএনপির সঙ্গে থাকতে চান তারা। বিএনপির নেতৃত্বে থাকা মানে মিডিয়া কভারেজ পাওয়া। দলকে টিকিয়ে রাখতে, জনগণের কাছে যেতে চাইলে মিডিয়া কভারেজের বিকল্প নেই। বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে যে মিডিয়া কভারেজ হয়, এখন যুগপৎ আন্দোলনে তার সিকিভাগও হয় না। দ্বিতীয়ত, বিএনপির নেতৃত্ব স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব জায়গায় সুবিধা মেলে। নির্বাচন এলেই জোটের শীর্ষ নেতারা সংসদ নির্বাচনের জন্য জোট থেকে মনোনয়ন চান। মনোনয়ন মিললে সংসদ সদস্য হিসেবে জয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা থাকে। জেলা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, ইউপি নির্বাচনে জোটের মনোনয়নে জনপ্রতিনিধিও হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে বিএনপি না চাইলেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাদের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে এসব দলকে।
আবার বিএনপির একেবারে ছেড়ে দিতে চায় না দলগুলোকে। তাই প্রকাশ্যে ও পর্দার অন্তরালে নানাভাবে তাদের সহায়তা করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নজরুল ইসলাম খানকে। সংগঠিত হওয়া, আন্দোলনে থাকার পরামর্শ তার কাছ থেকেই আসে বলে জোটের একাধিক নেতা জানান।
বিএনপি জোট ভাঙায় কোনো ক্ষোভ রয়েছে কি না এমন প্রশ্ন ছিল বিলুপ্ত ২০ দলীয় জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপির) একাংশের মহাসচিব সাহাদাত হোসেন সেলিমের কাছে। তিনি বর্তমানে ১২ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘বলা নেই, কওয়া নেই, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না মেনেই গত ডিসেম্বরের ৯ তারিখ আমাদের ডেকে বলে দেওয়া হলো ২০ দলীয় জোট আজ থেকে থাকবে না। এমনটা যে হবে সেটি ২০১৮ সালের পর থেকেই জোটসঙ্গীরা ধারণা করতে পারছিলেন। কিন্তু জোট যে প্রক্রিয়ায় গঠন হয়েছিল ভেঙে দিতেও সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারত। জোট ভাঙার পেছনে তারা কোনো জোরালো যুক্তিও উপস্থাপন করেনি। ওই ঘোষণা পর জোটের সব শরিকের মধ্যেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কিন্তু তারা সেটি প্রকাশ করছেন না।’
একাধিক শরিক নেতার আক্ষেপ, সারা বছর বিএনপির সঙ্গে থেকে রাজপথে সংগ্রামে থাকেন তারা। অথচ নির্বাচন এলেই বিভিন্ন নামে নতুন জোট তৈরি করে তাদের অবহেলিত রাখা হয়। বিএনপির দুর্দিনে তাদের দেওয়া কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জোট ভাঙা পর্যন্ত খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি প্রয়াত শফিউল আলম প্রধান, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মনিসহ কয়েকজন নেতা জেল খেটেছেন। আবার নানা চাপে জোট ত্যাগ করেন ন্যাপ ভাসানী, ইসলামী ঐক্যজোট, এনডিপি, এনপিপি, খেলাফত মজলিসের একাংশের নেতারা।
১২ দলীয় জোটের এক নেতা বলেন, ১৯৯৭ সাল থেকেই জোটের শরিকদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে। গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ২০ দলীয় জোটকে নিষ্ক্রিয় রাখে বিএনপি। এবারও গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিভিন্ন জোটের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলে দীর্ঘ বছরের জোট বিলুপ্তি করল। বিলুপ্ত করার আগে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করল না বিএনপি।
১৯৯৯ সালে বিএনপি, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, অবিভক্ত ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে গঠন করা হয় চারদলীয় জোট। ২০০১ সালের নির্বাচনের কিছুদিন আগে এরশাদ চারদলীয় জোট ত্যাগ করেন। জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ (বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি) রয়ে যায় এ জোটে। ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর চারদলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যস্ত ছিল। বাতিল হয়ে যায় তাদের নিবন্ধন। আরেক শরিক ইসলামী ঐক্যজোট কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পরে চার দলকে সঙ্গে রেখেই ২০১২ সালে গঠিত হয় ১৮ দলীয় জোট। পরে জাতীয় পার্টি (জাফর) এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলকে নিয়ে করা হয় ২০ দলীয় জোট।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নিয়ে বিএনপি গঠন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এ অভিমানে বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি এবং এনডিপির মূল নেতারা জোট ত্যাগ করেন। পরে অবশ্য ত্যাগ করা জোটের একাংশ নেতাদের নিয়ে জোট জিইয়ে রাখে বিএনপি।
ডিজিটাল সংযোগ দেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ পরিণত করার প্রধান হাতিয়ার হবে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মূল চাবিকাঠি হবে ডিজিটাল সংযোগ। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজের জন্য ডিজিটাল সংযোগ মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।’ গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলা-২০২৩-এর উদ্বোধন উপলক্ষে এক ভিডিও বার্তায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ভিডিও বার্তায় তিনি ডিজিটাল পণ্য বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় তিন দিনের এ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলার’ আয়োজন করেছে। দেশের আইটি ও আইটিইএস পণ্য ও সেবাগুলো প্রদর্শনই এ মেলার লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা। স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট জাতি গঠনই আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য পূরণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট, ভার্চুয়াল বাস্তবতা, উদ্দীপিত বাস্তবতা, রোবোটিকস অ্যান্ড বিগ ডেটা সমন্বিত ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে চায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিল্পাঞ্চলে ফাইভ-জি সেবা নিশ্চিত করা হবে।’
ডিজিটালাইজেশনে বাংলাদেশে বিপ্লব ঘটে গেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তরুণ প্রজন্ম এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখছে।
সরকারপ্রধান বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন রাঙ্গামাটি জেলার বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম স্যাটেলাইট আর্থ স্টেশন স্থাপন করেন। যার মাধ্যমে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচনী অঙ্গীকারে রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা করেছিল, যার মূল লক্ষ্য ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশি জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, তার সরকার ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করেছে, যা সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের স্যাটেলাইট পরিবারের ৫৭তম গর্বিত সদস্য উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে বহুমুখী কার্যক্ষমতা সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ স্থাপনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশকে আর বিদেশি স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভর করতে হবে না।
সরকারপ্রধান বলেন, তার সরকার ২০২৪ সালের মধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন করতে যাচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৩৪০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ক্ষমতা অর্জন করেছে। তিনি আরও বলেন, এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ব্যান্ডউইথের সক্ষমতা ৭২০০ জিবিপিএসে উন্নীত করা হবে। তৃতীয় সাবমেরিন কেব্ল স্থাপনের পর এটি ১৩২০০ জিবিপিএসে উন্নীত হবে। সৌদি আরব, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া ও ভারতকে ব্যান্ডউইথ লিজ দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৪ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার আয় করছে।
সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন যে, সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ ৫৬ হাজার ২৯৮ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ১০ গিগাবাইট ক্ষমতা নিশ্চিত করা হয়েছে; যা জনগণ ও সরকারি অফিসগুলোতে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করতে সহায়তা করে।
শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে ৮ হাজার ৬০০টি পোস্ট অফিসকে ডিজিটালে পরিণত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ১৮ কোটি মোবাইল সিম ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি। গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মধ্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ডিজিটাল বৈষম্য এবং দামের পার্থক্য দূর করা হয়েছে।
প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারা দেশে ‘এক দেশ এক দরের’ একটি সাধারণ শুল্ক চালু করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা চালু করার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ অ্যাসোসিও (এএসওসিআইও)-২০২২ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে টেলিকম খাতে প্রশংসনীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২২টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে ১৪টি ক্যাটাগরিতে প্রথম প্রবর্তিত পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন অ্যাওয়ার্ড বিতরণ করা হয়।
অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান বক্তব্য রাখেন।
আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, প্রস্তুতি নিচ্ছি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ভবনে কার্যালয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে এবং আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের পর সরকার সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন তদারকি করতে আসবে এবং তারা স্বাধীনভাবে তাদের কাজ করবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং এর ওপর এবং এর বাজেটের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল যার ভিত্তি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে। এই রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগ) জন্ম গণমানুষ থেকে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির জন্ম সেনানিবাস থেকে। তিনি আরও বলেন, এই দুই দলের প্রধান প্রথমে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হন, পরে তারা তাদের রাজনৈতিক দল গঠন করেন। জনগণের মধ্যে তাদের কোনো ভিত্তি নেই।
জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে সরকারপ্রধান বলেন, তারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল। জনগণের মধ্যে তাদের কোনো ভিত্তি নেই। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আগামী নির্বাচনে জনগণ ভোট দিলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে।
রোহিঙ্গা ইস্যু প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ১০ লাখের বেশি মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশের জন্য বোঝা। তিনি সব পশ্চিমা দেশকে মিয়ানমারের নাগরিকদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে সমর্থন প্রসারিত করার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কভিড এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কষ্টে ফেলেছে। আমরা এই প্রভাব বন্ধ করার চেষ্টা করছি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এ যুদ্ধে কাদের লাভ, শুধু অস্ত্র বিক্রেতারাই লাভবান হচ্ছে। বিশ্বের উচিত অবিলম্বে এ যুদ্ধ বন্ধ করা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দেশে নারীর ক্ষমতায়নের কথাও সংক্ষেপে বর্ণনা করেন।
সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে এবং তার দেশ মসৃণ উত্তরণে বাংলাদেশকে সমর্থন অব্যাহত রাখবে। তিনি বলেন, আমি সবসময় বাংলাদেশের শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে থাকব। আমি এ দেশের প্রতিটি কোণ পরিদর্শন করেছি এবং দেশের উল্লেখযোগ্য ও চিত্তাকর্ষক উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করে মুগ্ধ হয়েছি।
নাথালি চুয়ার্ড বলেন, ‘বাংলাদেশকে কভিড-১৯ মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আমি আশা করছি যে বাংলাদেশ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আরও এগিয়ে যেতে পারবে।’
এ সময় সুইজারল্যান্ডের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত গণতন্ত্রের মান, এর স্থিতিশীলতা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের প্রশংসা করেন। তিনি দেশের নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতিরও ভূয়সী প্রশংসা করেন। রোহিঙ্গা ইস্যু প্রসঙ্গে তিনি মনে করেন, তাদের দ্রুত স্বদেশে ফিরে যাওয়া উচিত।
এ সময় অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া উপস্থিত ছিলেন। বাসস
জেলা প্রশাসক সম্মেলন শুরুর ঠিক আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময়ের পাশাপাশি দিকনির্দেশনা দিতে প্রতি বছর জেলা প্রশাসক বা ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সম্মেলন বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি অধিবেশনে মন্ত্রী বা সচিবরা দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য গড়ে এক মিনিটের বেশি সময় পান না। এই স্বল্প সময়ে নীতিনির্ধারকরা যথাযথ নির্দেশনা দিতে পারেন না। তারা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে গেলেও সময়ের অভাবে কথা বলতে পারেন না।
নির্ধারিত সময়ে দিনের প্রথম অধিবেশন শুরু হলেও আর কোনো অধিবেশনই সময়মতো শুরু হয় না। এক অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই পরের অধিবেশনসংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিব-মহাপরিচালকসহ অন্যরা হাজির হয়ে যান। অনেক সময় পরবর্তী দুই-তিন অধিবেশনের নীতিনির্ধারকরাও উপস্থিত হয়ে যান। সম্মেলনে অধিবেশনের জট লেগে যায়। অধিবেশন শেষে তারা রাতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ভোজে অংশ নেন। এ কারণে দিনে শুরুর সময় এবং রাতে শেষের সময় ঠিক রাখতে হয়। এই ঠিক রাখতে গিয়ে অধিবেশন সংক্ষিপ্ত করা হয়। অধিবেশনে উপস্থিত থাকলেও বেশিরভাগ অতিথি কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। অথচ তারা বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ডিসি সম্মেলনের প্রস্তুতি নেন এবং সম্মেলনে গিয়ে বসে থাকেন।
গত বুধবার চলতি বছরের ডিসি সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশন ছিল শিল্প, বাণিজ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে। এই তিন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ সময় ছিল মাত্র ৪৫ মিনিট। ১২টা থেকে শুরু হয়ে এই অধিবেশন চলার কথা ছিল ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। এই অধিবেশন যথাসময়ে শুরু হতে পারেনি, তাই শেষ হওয়ারও সুযোগ নেই। এই অধিবেশনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ১৭ জন। অধিবেশনগুলোতে সাধারণত ৪-৫ জন ডিসি, ১ জন বিভাগীয় কমিশনার এবং অধিবেশন সভাপতি হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বক্তব্য রাখেন। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় দিনের চতুর্থ অধিবেশনে ২৩ জনের কথা বলার কথা। ৪৫ মিনিটের অধিবেশনে সব অতিথি এবং রেওয়াজ অনুযায়ী ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার বক্তব্য রাখলে একজনের ভাগে দুই মিনিটের কম সময় পড়ে।
স্বল্প সময় কথা বলার জন্য আমন্ত্রিত অতিথি তালিকায় ছিলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তিন মন্ত্রী। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন ছিলেন প্রধান অতিথি। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এবং প্রধানন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু। অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এই অধিবেশনে অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ওই অধিবেশনে মন্ত্রিবৃন্দ ও উপদেষ্টা কথা বলার পর আর সময়ই ছিল না। শুধু দ্বিতীয় দিনের চতুর্থ অধিবেশনই নয়, সব অধিবেশনই এভাবে শেষ হয়। দিনের প্রথম অধিবেশন সময়মতো শুরু হয়। বাকিগুলো শুরু হয় না তো শেষ হবে কীভাবে? তিনি আরও জানান, পুরো ডিসি সম্মেলনটাই তাড়াহুড়ার মধ্যে শেষ হয়। নীতিনির্ধারণী কথা কি এক-দুই মিনিটে শেষ হয়? যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে মন্ত্রীরাই কথা বলেন। অন্য অতিথিরা বহর হিসেবে থাকেন।
দ্বিতীয় দিবসের প্রথম অধিবেশন ছিল চার মন্ত্রণালয় নিয়ে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব, চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক, সিইও, পরিচালক এ অধিবেশনে বিভিন্ন অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিটি অধিবেশনই এভাবে ঠাসা থাকে অতিথিদের ভারে।
একজন ডিসি জানিয়েছেন, ডিসি সম্মেলনে তাদের যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয় তার মধ্যে অনেক বিষয়ের সঙ্গেই ডিসিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। তারপরও নানা ধরনের নির্দেশনা তারা পান। একইভাবে ডিসিরাও নানা কাজের এখতিয়ার চান। যদিও শেষ পর্যন্ত এসব নির্দেশনা বা প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ হয় না বলে ওই ডিসির মত।
গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া ডিসি সম্মেলন শেষ হয় গতকাল বৃহস্পতিবার।
গত কোরবানির ঈদে পল্লবী থানায় ঢুকলাম তৃতীয়বারের মতো। ব্যক্তিগত কাজে এসেছি এখানে। আগের সেই পল্লবী থানা আর নেই। নতুন ভবন, নতুন পরিবেশ। আধুনিক সাজসজ্জা, আলো ঝলমলে থানার অভ্যন্তর ঝকঝকে। বাইরের আলো-বাতাস যেন থানায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ঢুকতে পারে, এমনভাবে ভবনের নকশা করা। নিচে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা, রিসেপশন এবং নাগরিক বিভিন্ন সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে।
চওড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই একজন নারী ডিউটি অফিসারের দেখা মিলল। তিনি বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে যারা আগে এসেছে তাদের আগে সেবা দিচ্ছেন। আগে ভদ্রলোক গোছের বা একটু অবস্থাপন্নদের আগে সুযোগ দেওয়া হতো, সেই সংস্কৃতি এখন আর নেই। ক্ষমতাধর কেউ এলে কী হতো তা অবশ্য দেখার সুযোগ পাইনি।
আমার আসার কারণ ব্যাখ্যার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। এর মধ্যে একজনকে ধরে নিয়ে এলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সেই ব্যক্তি হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাকে ছেড়ে দিতে বলছেন। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা রাজি নন। এর আগে তাকে সুযোগ দেওয়া হলেও তার সংশোধন ঘটেনি। এবার তাই ছাড় নয়।
সিরিয়ালে আমার ডাক পড়লে ডিউটি অফিসারকে জানালাম সমস্যাটা। তিনি সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। আমি বের হয়ে এলাম ওই কক্ষ থেকে। দোতলায় দুটি অংশ। বাম দিকের একটি বড় ঘরে যার যার টেবিল সামনে রেখে কাজে ব্যস্ত অনেকে। ডান দিকে লম্বা করিডর ধরে কর্মকর্তাদের কক্ষ। তারা সবাই কাজের প্রয়োজনে বাইরে ছিলেন। মোবাইল ফোনে একজনকে বলতে শুনলাম, ডিসি সাহেব আসছেন এদিকে। তার প্রটোকলের ব্যবস্থা করতে হবে।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই সাধারণ ডায়েরি (জিডি) লেখার ডেস্ক। একজন পুরুষ সদস্য মনোযোগ দিয়ে লিখে দিচ্ছেন জিডি।
এসব দেখতে দেখতে আমার কাক্সিক্ষত কর্মকর্তা চলে এলেন। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তিনি সমস্যার কথা আগেই জানতেন। ফলে বিস্তারিত বলতে হলো না। তিনি আমাকে জিডির ডেস্কে নিয়ে গেলেন। এক তরুণ নির্দিষ্ট প্যাডে জিডির কপি লিখছেন। তার হাতের লেখা বেশ সুন্দর। দ্রুত লিখতে পারেন। জিডিতে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া বাড়তি কিছু লিখতে তিনি নারাজ। জিডিতে অভিযোগকারীর পক্ষের নামে যা খুশি তাই তিনি কিছুতেই লিখবেন না।
কিছুক্ষণ পর মাথায় কাটা দাগ নিয়ে এলেন এক নারী। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। ডেস্কে এসেই তিনি বলতে শুরু করলেন, আমারে আবার মারছে, আজ দুপুরে ভাতের কথা বইলা আবার মারছে। বুঝলাম, তার স্বামী তাকে পিটিয়েছেন আবার। তাকে আরেকজন ধরে ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে আগে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তারপর জিডি করতে বললেন।
আমার কাজও ততক্ষণে শেষ হয়ে এসেছে। ডেস্কের সামনে কিছু বসার চেয়ার। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ বসে আছেন। সবার বামে বসা এক নারী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তার কান্না আটকে রাখা যাচ্ছে না। স্বজন হারানোর বেদনা মাঝে মাঝে জানান দিচ্ছে আশপাশ। শোক তাকে চেয়ারেও বসতে দিচ্ছে না। ধরে রাখতে হচ্ছে। কেউ একজন মারা গেছেন তার। মামলা করতে থানায় এসেছেন। স্বাভাবিক কর্মপরিবেশেও তার শোক সঞ্চারিত হচ্ছে অন্যদের মধ্যে। তবে শোক থিতু হওয়ার অবকাশ নেই। যারা আসছেন তাদের সবাইকে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের।
আমার মনে হলো, প্রতিনিয়ত শোক, অপরাধের ঘটনা, সামাজিক নির্যাতনের ঘটনা সব দেখতে-শুনতে হয় পুলিশ সদস্যদের। সামাল দিতে হয়। তাদের কাজ আসলেই অনেক জটিল ও কঠিন।
অথচ পল্লবী থানার পরিবেশ এমন ছিল না। ২০১১-১২ সালের ঘটনা। আমার প্রথম ফোন চুরি হয় ওই সময়ে। খোলা জানালা দিয়ে লম্বা বাঁশের আগায় লোহার সঙ্গে চুম্বক জুড়ে আমার চার্জে রাখা ফোনটা নিয়ে যায় চোর। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে উঠে অনেক খুঁজেও যখন পেলাম না, বুঝলাম চুরি হয়েছে। চুরির এ পদ্ধতির কথা আগেই শুনেছিলাম। আমাদের ওপর তলার একজনের মোবাইল ফোনও এ পদ্ধতিতে চুরি হয়।
জীবনে প্রথম জিডি করার জন্য থানায় গেলাম। ‘ভদ্রলোকরা থানায় যান না’ এ রকম একটা কথা আমাদের সমাজে একসময় চালু ছিল। থানায় গেলেই ‘কলঙ্কের দাগ’ লেগে যাবে। তাই চুপি চুপি, পরিচিত কেউ যেন না দেখে এমন ভঙ্গিতে ঢুুকলাম পল্লবী থানায়।
পল্লবী থানা তখন ছিল ভাড়া বাড়িতে। পলেস্তারা ছিল না ওই ভবনের। ভবনটাও ছিল অনুজ্জ্বল, অনাধুনিক। সংকীর্ণ ঢোকার পথ, ছোট ছোট রুম। মরচে ধরা কলাপসিবল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। ঢুকতেই বাম দিকে দেখলাম, সিমেন্টের বস্তা দিয়ে অনেকটা বাঙ্কারের মতো একটা জায়গা। সেখানে একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে। বুঝলাম, এটা নিরাপত্তার প্রয়োজনে করা।
নিচতলায় আর কী আছে বুঝতে পারলাম না। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে এসেছি জানালে একজন পুলিশ দোতলায় যেতে বলেন। আবছা আলোয় সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলাম। সেখানে অপেক্ষাকৃত একটা বড় ঘর। তবে তাতে অপ্রতুল আলো। কাঠের চেয়ার-টেবিলে বসে আছেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তাদের কাছে নিজের প্রয়োজনের কথা জানালাম। তারা কক্ষের বাইরে একটা কাউন্টার দেখিয়ে দিলেন। কাউন্টারে বসা পুলিশ সদস্য জিডির কারণ জানতে চাইলেন। তিনি কেমন যেন গড়িমসি করছিলেন। তাকে বোঝাতে বোঝাতে হতাশ হয়ে যাব এমন সময় পরিচিত বড় ভাইকে পেলাম। আমার ইউনিভার্সিটির বড় ভাই। এ থানায় ইন্সúেক্টর (তদন্ত) হিসেবে যোগ দিয়েছেন। দীর্ঘদিন পরে দেখা। এ থানায় কবে এসেছেন জানতাম না। আমাকে দেখে তিনি নিয়ে গেলেন আরেক তলা ওপরে। প্রায়ন্ধকার ঘরে দেখলাম, বসার টেবিলের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থাও আছে। লুঙ্গি-গামছা ঝুলছে। ভাই আমাকে চা পানের সুযোগ দিলেন। তারপর নিচে থাকা সেই পুলিশ সদস্যকে ডেকে এনে আমার জিডি নিতে বললেন। ওনার সঙ্গে আবার দোতলায় এলাম। একটা নিউজপ্রিন্টের প্যাডের নিচে কার্বন পেপার রাখলেন। তারপর একপাশ খালি রেখে আমার অভিযোগ লিখলেন। তার মুখ কিঞ্চিৎ ভারী।
একবার যাওয়ার পর থানা নিয়ে আমার অস্বস্তি বা ভয় অনেকটা কেটে গেল। আমার মনে হলো, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা বা বিচার পাওয়ার শুরু হয় থানা থেকেই। সেখানে যেতে কারও মনে দ্ব্যর্থতা থাকা ঠিক নয়।
পল্লবী থানা আমার বাসার উল্টো পাশে। প্রতিদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে দেখতাম মানুষের জটলা। বুঝতাম কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার আত্মীয়-স্বজন থানার বাইরে জটলা করছে। আহাজারি করছে।
পল্লবী থানার এই দুই পরিস্থিতির মধ্যবর্তী আরেকটি পরিবর্তনেরও আমি সাক্ষী। সেটা মোবাইল ফোন চুরির বেশ কয়েক বছর পরের কথা। আরেকটা জিডি করার প্রয়োজন হলো আমার। তবে সেবার জিডি লেখাতে হলো বাইরে থেকে। থানার বাইরেই কিছু লোক থাকেন। তারা নির্দিষ্ট ফরম্যাটে জিডি লিখে দেন। এর জন্য তারা কিছু ‘পারিশ্রমিক’ নেন।
আমার দ্বিতীয় জিডিটিও ছিল মোবাইল ফোন সংশ্লিষ্ট। প্রথমবারের মোবাইল ফোনের খোঁজ পাইনি। পরেরবার বেশ দ্রুতই মোবাইল ফোনের সন্ধান মিলল। পুলিশ এখন অনেক আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন। নাগরিকদের সুবিধা দেওয়ার পরিসরও বেড়েছে। অনলাইনেও এখন জিডি করা যায়।
পুলিশ নিয়ে অনেক আপত্তি-অভিযোগ আছে এ কথা সত্য। তবে আমার এ লেখা তা নিয়ে নয়। আমি শুধু থানার সঙ্গে আমার যোগাযোগের স্মৃতি উল্লেখ করলাম। থানায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে একথা বলতেই হবে।
আমার পরিচিত সেই বড় ভাই এখন সিটিটিসিতে (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) ইউনিটে আছেন। তিনিও স্বীকার করলেন পল্লবী থানা বদলে গেছে অনেক। পুলিশ এবং নাগরিক সবার সুবিধা বেড়েছে। মনে মনে বললাম, নাগরিক সুবিধার অবারিত স্থান হয়ে থাক পুলিশ স্টেশন।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
দেশে এ বছর ভয়বাহ আকার ধারণ করছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বর। প্রায় প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর নানা ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুর জীবানুবাহী এডিস মশা এবং ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গেও।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যা পার করেছে হাজারের ঘর। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের মনে জাগছে নানা রকম প্রশ্ন। এমনই কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তক সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা। যা দেয়া হল এখানে,
ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহনকারী মশার নাম এডিস এজিপ্টি যা আমাদের দেশে ডেঙ্গু মশা নামেই বেশি পরিচিত।
এডিস মশা কামড়ানোর কারণেই ডেঙ্গু জ্বর হয়। যদিও এই মশা কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জ্বর হয় না।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা সাবেরা গুলনাহার বলেন, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হবার পর থেকে লক্ষ্মণ দেখা দিতে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে।
এই সময়কে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড।
সাধারণত এডিস মশা কামড়ানোর পাঁচ থেকে সাত দিন মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর আসে। আর এই জ্বর থাকে পাঁচ থেকে ছয় দিন পর্যন্ত।
চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু ভাইরাসের চার রকম সেরোটাইপ পাওয়া যায়। এগুলো হলো- ডেন - ১, ডেন - ২, ডেন - ৩ এবং ডেন - ৪।
সহজ কথায়, একজন মানুষ তার সারা জীবনে সর্বোচ্চ চার বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন।
অর্থাৎ একবার একটি ধরনে আক্রান্ত হবার পর তা সেরে গেলে, তার শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, তা সারা জীবনের জন্য কাজ করে।
এরপর যদি তিনি পুনরায় আক্রান্তও হন, সেটি হবে ডেঙ্গুর ভিন্ন কোন ধরন।
অধ্যাপক গুলনাহার বলছেন, যতদিন রক্তে ভাইরাস থাকবে, ততদিন রোগীর শরীরে জ্বর থাকবে।
কেবলমাত্র রক্ত জীবাণুমুক্ত হলেই ডেঙ্গু জ্বর সেরে যায় একজন আক্রান্ত ব্যক্তির।
অধ্যাপক গুলনাহার বলছেন, প্রথমবার ডেঙ্গু হলে অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। সামান্য শরীর ব্যথা ও একটু জ্বরের লক্ষ্মণ থাকলেও সাধারণত এসময় সর্দিকাশিও থাকে না।
একে ব্রেকবোন ফিভারও বলা হয়। পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই এই জ্বর ভালো হয়ে যায়।
তবে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে, অর্থাৎ অন্য আরেকটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে রোগীর শরীরে জটিলতা তৈরি হয়।
কারণ প্রথম বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, সেটার সঙ্গে নতুন ভাইরাসের এন্টিজেনের এক ধরনের রিএকশন হয়। যার ফলে হেমোরেজ বা প্লাটিলেট কমে যাওয়ার মতো জটিলতা তৈরি হয়।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে, ক্ষেত্রবিশেষে প্রথমে খুব জ্বর ওঠার পর তা কমে যায়। এসময় কিছুটা সুস্থ বোধ হলেও, এটিই আসলে সবচেয়ে জটিল পর্যায়। কেননা এসময়েই আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্লাটিলেট কমে যায় এবং রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এ সময় সুস্থ বোধ করায় শিশুরাও খেলাধুলা করতে চায়। তবে এটা একেবারেই করা যাবে না। এই সময়ে যেকোনো ধরনের পরিশ্রমের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সম্পূর্ণ বিশ্রাম করতে হবে।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলছেন, একটি পূর্ণ বয়স্ক এডিস মশা গড়ে ১৫-৪০ দিন বাঁচে।
মূলত তাপমাত্রার ওপর এডিস মশার আয়ু নির্ভর করে।
যেমন, শীতকালে এডিস মশা বেশি বাঁচে, আবার গরম কালে এডিস মশার বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার দ্রুত হয় বলে এ সময়ে এডিস মশা কম বাঁচে।
একসময় বলা হতো ডেঙ্গু মশা শুধুমাত্র দিনের বেলা কামড়ায়। কিন্তু সে ধারণা এখন আর কাজ করছে না।
কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা তার চরিত্র বদলেছে। এখন দিনে বা রাতে সব বেলাতেই কামড়াতে পারে এডিস এজিপ্টি, বিশেষ করে রাতে যদি ঘর আলোকিত থাকে।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাসার বলেছেন, ল্যাবে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি এডিস মশা জীবদ্দশায় গড়ে চার থেকে ছয় বার কামড়ায়।
কেবল মাত্র স্ত্রী মশাই কামড়ায়। ফলে একমাত্র স্ত্রী এডিস মশাই ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে। আর স্ত্রী এডিস মশাও কেবল মাত্র পেটে ডিম থাকা অবস্থাতে কামড়ায়।
এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয়- এমন একটি ভুল ধারনা অনেকের মধ্যেই প্রচলিত রয়েছে, যা সঠিক নয়।
আরেকটি ভুল ধারনা হলো যে আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর পর পরই সুস্থ একজনকে কামড়ালে তারও ডেঙ্গু জ্বর হবে।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার মাধ্যমে তখনই একজন ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হবেন, যখন মশাটি ভাইরাস ইনফেক্টেড অথবা ভাইরেমিক হবে।
একটা এডিস মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড়ে যখন ভাইরাস ছড়ানোর উপযোগী হয় তখন এটাকে বলা হয় ভাইরেমিক। মূলত আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর পর ডেঙ্গু মশাকে ভাইরাস বিস্তারের উপযোগী হতে একটি জীবনচক্র পূরণ করতে হয়।
অর্থাৎ আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর মাধ্যমে মশার দেহে ভাইরাসটি প্রবেশ করে। এরপর ডিম পারা এবং বংশবিস্তারের মাধ্যমে ওই মশা ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম হয়, অর্থাৎ ভাইরেমিক হয়। এরপর যতদিন মশাটি বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়াতে পারবে।
এছাড়াও জীবাণু বহনকারী ওই মশা যত ডিম পারে, তার সবগুলোতেই ভাইরাস থেকে যায়। আর সেই ডিম যদি প্রকৃতিতে অনুকূল পরিবেশ পায় তবে সেখান থেকে জন্মানো মশার কামড়েও ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সওভারিয়াল ট্রান্সমিশন।
এভাবে ভাইরাসের বাহক হয়ে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ ডেঙ্গু মশা জন্মাতে পারে বলে জানান কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার।
ডেঙ্গু কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়, এটি কেবল মাত্র মশার মাধ্যমেই ছড়ায়। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।
অর্থাৎ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে, একই বিছানায় ঘুমালে কিংবা তার ব্যবহৃত কিছু ব্যবহার করলে, অন্য কারো এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
এডিস মশা ব্যতীত স্পর্শ বা অন্য কোনভাবে এই রোগ ছড়ানোর উপায় নেই।
এমনকি অন্য প্রজাতির মশার মাধ্যমেও ডেঙ্গু ছড়ায় না।
রোগীকে স্বাভাবিক সব ধরণের নরম খাবার খেতে দেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা
ডেঙ্গু হলে রোগীকে স্বাভাবিক সব ধরণের নরম খাবার খেতে দেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
অধ্যাপক গুলনাহার বলেন, ডেঙ্গু হলে রোগীর শরীরে পানি স্বল্পতা হয়। তাই এই সময় তরল জাতীয় খাবার বেশি খাওয়াতে হয়।
সেইসাথে বাড়িতে ফল থেকে বের করা জুস, স্যুপ, ডাবের পানি, ওরস্যালাইন, বা অন্যান্য তরল খাবার প্রচুর পরিমাণে দেয়া যেতে পারে। এগুলো শরীরের পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে খাবারে কিছু বিধিনিষেধ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
“খাবারের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে, অনেককে দেখেছি দিনে ১০-১২টা ডাব খেতে, অনেকে লিটারে লিটারে পানি খাচ্ছে এগুলো অস্বাভাবিক।
আবার কিছু না করাও ঠিক না। যদি কারও দিনে তিন চার ঘণ্টা পর পর প্রস্রাব হয়, প্রস্রাবের রং হলুদ না হয়, তারমানে তার আর্দ্রতা স্বাভাবিক আছে” বলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ।
বাড়ির আশপাশ যতটা সম্ভব পরিষ্কার রাখতে চেষ্টা করুন।
ঘরের ভেতরে থাকা ফুলের টব কিংবা ভাঙা প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসা, টায়ার অথবা পলিথিন থাকলে তা দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলুন এবং ফুলের টব থেকে জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করুন।
মশা নিধনের জন্য সপ্তাহে অন্তত তিন বার স্প্রে বা ফগিং করুন।
বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় মশা নিধনে ব্যবহৃত ক্রিম রাখতে পারেন সঙ্গে।
সন্ধ্যার পর বাড়ির ছোট থেকে বড় সদস্যরা মশারি ব্যবহার করতে পারেন।
যেখানে সেখানে জমে থাকা বৃষ্টির পানি পরিষ্কার করে ফেলুন কারণ এতে এডিস মশা ডিম পেড়ে থাকে এই সময়।
মশার প্রকোপ থেকে বাঁচতে মশারির পাশাপাশি ম্যাট ব্যবহার করতে পারেন।
বাড়ির ছোট সদস্যদের ফুল হাতা জামা পরিয়ে রাখুন এবং মশা যাতে না কামড়াতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। প্রয়োজনে মশা নিধন ক্রিম ব্যবহার করুন।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।