
প্রথম বিদেশ সফরে আজ ঢাকা আসছেন মালয়েশিয়ার নবনিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইল। মূলত তার আগ্রহ থেকেই এ সফরের প্রস্তুতি শেষ করেছে বাংলাদেশ। কম সময়ের ব্যবধানে এ সফরের প্রস্তুতি ও দ্বিপক্ষীয় সব অয়োজন চূড়ান্ত করতে এরই মধ্যে ঢাকায় এসেছেন মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর চলমান শ্রমবাজার সংকট সমাধানসহ দেশটিতে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিদের বৈধতা পাওয়ার বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে সরকারের সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে। এসব বৈঠকে অবৈধ বাংলাদেশিদের বৈধতার পাশাপাশি চলমান সংকট নিরসনকে গুরুত্ব দেবেন তারা। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্তকরণ, সিন্ডিকেটের কবল থেকে শ্রমবাজরকে মুক্ত রাখা ও কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণে জোর দেওয়া হবে। এ সফর বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও গতি সঞ্চারে সহায়ক হবে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র বলছে, মালয়েশিয়ায় অবৈধ কর্মীদের ২৭ জানুয়ারি থেকে বৈধতা দেওয়া আবারও শুরু হয়েছে, যা চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। যার বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশনে অভিযোগ আছে, শ্রমিক ও ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে এমন অভিবাসী ছাড়া যে কেউ বৈধ হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। কর্মীর বয়স ১৮ থেকে ৪৯ বছর হতে হবে। সর্বনিম্ন আবেদন ফি ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৮ হাজার টাকা। এর সঙ্গে মেডিকেল ও অন্যান্য ফি মিলিয়ে খরচ হবে ৩ হাজার রিঙ্গিতের ওপর।
তারা জানায়, মালয়েশিয়া ১৫টি দেশের কথা উল্লেখ করলেও বাংলাদেশকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি এগিয়ে রাখছে। এই তালিকায় বরাবরই ওপরের দিকে থাকে বাংলাদেশ। বৈধ হলে কর্মীরা উৎপাদন, নির্মাণ, খনি ও খনন, নিরাপত্তা রক্ষী, সেবা, কৃষি, বাগান এবং গৃহকর্মী হিসেবে সেখানে কাজ করতে পারবেন। এ ছাড়া চাইলে দেশেও ফিরে আসার সুযোগ পাবেন অবৈধরা। ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬৭৭ জন বিদেশি কর্মীকে অস্থায়ী কাজের ভিজিট পাস দিয়েছে তারা, যার মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা সর্বোচ্চ ৪ লাখ ৪৬ হাজার ২২৯ জন।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বিশেষ করে মধ্যস্বত্বভোগী চক্রের বাধা দূর হওয়া নিয়ে আশাবাদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় আমরা যে কর্মী পাঠাই, এগুলোতে অনেক সময় উল্টো-পাল্টা কাজ হয়। আশা করি, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে সেগুলো দূর হবে। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এসব বিষয় সুরাহা করার জন্য মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসছেন। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা হয়তো স্বল্প খরচেই মালয়েশিয়া যেতে পারবেন।’
সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইলের এ সফরকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন। দেশটিতে নিযুক্ত হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ২৫ জানুয়ারি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেই মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১০ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে তার সফরটি চূড়ান্ত করা হয়। ওই বৈঠকে হাইকমিশনার মালয়েশিয়ায় বসবাসরত অনথিভুক্ত বাংলাদেশিদের রিক্যালিব্রেশনের আওতায় সহজ প্রক্রিয়ায় বৈধ করার জন্য দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। তার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দেন।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
একাদশ সংসদে উপনির্বাচনের সুযোগ আবার তৈরি হোক তা চায় না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। উপনির্বাচন নিয়ে একধরনের জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে মনে করছে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দলটি। উপনির্বাচনের পরে নানা আলোচনা-সমালোচনায় বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি পড়তে হয় সরকার ও দলকে। বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ৬টি আসনে গত বুধবার অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন ঘিরেও নানা বিষয় সামনে আসছে। এর আগে গাইবান্ধা উপনির্বাচন নিয়েও বিতর্কের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ।
তাই নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অঙ্কে আগের চিত্র পাল্টে ফেলেছে সরকারি দল। যে কারণে একাদশ সংসদের সদস্য থাকা কারও জন্য রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ ওই নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আলোচনায় থাকা স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন না, অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র আরও জানিয়েছে, সব বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি আলোচনায় এখন সবচেয়ে এগিয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। টেকনোক্রেট কোটায় টানা তিনবার সরকারের মন্ত্রী তিনি। আস্থা-বিশ্বাসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই মন্ত্রীর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি রয়েছে মনে করেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাকে নিয়ে আলোচনা এখন সবচেয়ে বেশি। তবে গণমাধ্যমে আসা অন্য নেতাদের নামও কমবেশি আলোচনায় রয়েছে এখনো। দুই দিন পর আগামী রবিবার সবাই জেনে যাবেন কে হচ্ছেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপনির্বাচনে অনীহার কারণে রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নিতে পারেননি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। সংসদ নেতা শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে কেন্দ্রীয় ওই নেতারা আরও বলেন, বর্তমান সংসদে থাকা কোনো সদস্যকে রাষ্ট্রপতি বানানোর ব্যাপারে এই মুহূর্তে নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছেন আওয়ামী লীগপ্রধান। এর অন্যতম কারণ উপনির্বাচনে অনীহা দেখা দেওয়া।
সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের জন্য উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। গাইবান্ধার উপনির্বাচন তাদের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে। দেশের ইতিহাসে ভোট বাতিল করার নজির সৃষ্টি করেছে ওই উপনির্বাচন। ফলে আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে একধরণের ভুল-বোঝাবুঝি ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে নানা মহলে আলোচনা আছে; যা একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত আওয়ামী লীগের জন্য। সর্বশেষ গত বুধবার বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ৬টি আসনের উপনির্বাচনেও সমালোচনামুক্ত থাকেনি।
দলের আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম ও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রায় চূড়ান্ত জানিয়ে দিলেও তিনি রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন না, তা মোটামুটি নিশ্চিত। তার এ দাবির পেছনে দুটি যুক্তি দাঁড় করান তিনি। আওয়ামী লীগের প্রবীণ এ নেতা বলেন, স্পিকার হিসেবে শিরীন শারমিন বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। টানা স্পিকার হিসেবে অভিজ্ঞতাও হয়ে গেছে। ফলে একাদশ সংসদ পরিচালনায় এমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ স্পিকার প্রয়োজন রয়েছে। তাকে রাষ্ট্রপতি বানানো হলে সংসদ সামলে নেওয়া যে কারও জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। সেটা ভেবে তার সম্ভাবনা কম বলে দাবি করছেন ওই নেতা। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই একজন নারী নেতাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন বলেই স্পিকারকে এগিয়ে রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ, উপনির্বাচনে অনীহা। স্পিকারকে রাষ্ট্রপতি করা হলে তার ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচন করতে হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবেন ওই ব্যক্তি, যাকে প্রধানমন্ত্রী ‘আপনি’ সম্বোধন করেন তাকে। মহামান্য পদটি প্রধানমন্ত্রী ‘তুই’ বা ‘তুমি’ সম্বোধন করা কাউকে সেভাবে চাচ্ছেন না। সে ক্ষেত্রে স্পিকারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ কমই দেখছেন তিনি।
দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি। ১২ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র জমা এবং পরদিন যাচাই-বাছাই। ১৪ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি কে হবেন এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমে যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে স্পিকার ছাড়াও রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এ ছাড়া দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের নামও আলোচনায় এসেছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি বলে আমি জানি। সেই জন কে, সংসদ নেতা নিজের ভেতরে রেখেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন নারী রাষ্ট্রপতি দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী, এটা তার বহু আগের স্বপ্ন। আবার রাজনীতির বাইরে কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চান না আওয়ামী লীগ সভাপতি এমন একটি ব্যাপারও আমার জানা ছিল।’
উপদেষ্টা পরিষদের ওই সদস্য বলেন, ‘এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো চাওয়ার প্রতিফলন না-ও ঘটতে পারে। পরিস্থিতির কারণে রাজনৈতিক নেতার বাইরে রাষ্ট্রপতি হলেও হতে পারে।’ তিনি বলেন, নানা দিক বিবেচনায় রেখে রাজনীতিবিদ না হলেও রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসা কোনো সজ্জন ব্যক্তিও এবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে আসতে পারেন। খানিকটা অস্পষ্টতা রেখেই প্রবীণ এ নেতা আরও বলেন, ‘চমকও থাকতে পারে এ ক্ষেত্রে। আমাদের কারোরই আলোচনায় নেই এমন একজন নারীও চলে আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে চমকে দেওয়ার মতো কিছু ঘটারও সুযোগ আছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নিয়ে এখনো কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা চলছে। তবে যিনি হবেন, নিশ্চয়ই তিনি গ্রহণযোগ্য হবেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত ব্যক্তিটির নাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের ভেতরেই রেখেছেন।’
আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয়ে জানার আগ্রহও আমার কম।’
দেশে প্রথমবারের মতো আগামী ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি (রবি ও সোমবার) দুই দিনব্যাপী রাজস্ব সম্মেলনের আয়োজন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই সঙ্গে রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআরের নতুন ভবন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলন ও নতুন ভবন উদ্বোধন করবেন।
রাজস্ব সম্মেলন-২০২৩ ও রাজস্ব ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রবিবার সকাল ১০টায় দুই দিনব্যাপী সম্মেলন ও এনবিআরের নতুন ভবন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব ভবন উদ্বোধন ও রাজস্ব সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনা দেবেন; যা রাজস্ব সৈনিকদের দায়িত্ব পালনে অধিকতর অনুপ্রাণিত করবে। দুই দিনব্যাপী রাজস্ব সম্মেলনে রাজস্ব আদায়, ভ্যাট ও আয়করের ভূমিকা নিয়ে একাধিক সভা-সেমিনার হবে। সম্মেলনে মতবিনিময় ও স্টল স্থাপনের মাধ্যমে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাটবিষয়ক সেবাগুলোর বিষয়ে সাধারণ জনগণকে বাস্তবিক ধারণা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে অস্থায়ীভাবে নির্মিত রাজস্ব মিউজিয়ামে ভ্যাট, আয়কর ও কাস্টমস বিভাগের ঐতিহাসিক দলিল, গেজেট, ঐতিহাসিক বস্তুগুলো সর্বসাধারণের প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
তিনি বলেন, রাজস্ব সম্মেলনে ভ্যাট, আয়কর এবং কাস্টমসের তিনটি স্টল থাকবে। স্টলগুলোতে ভ্যাট নিবন্ধন, আয়কর সনদপত্র, ভ্যাট ও আয়করের দাখিলপত্র জমা প্রদানসহ ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়করসংক্রান্ত অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হবে।
এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি এনবিআরের নবনির্মিত রাজস্ব ভবন আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর। এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, নতুন রাজস্ব ভবনটি ২০তলা ফাউন্ডেশনে নির্মিত হলেও ১২তলা পর্যন্ত কাজ শেষ করা হয়েছে। ভবনটি কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ সর্বাধুনিক সুবিধাসংবলিত। ভবনের আয়তন ৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৭ বর্গফুট। প্রতিটি ফ্লোরের উচ্চতা ১৩ ফুট। বেজমেন্টের আয়তন ৬৬ হাজার বর্গফুট। নিচতলা থেকে চতুর্থতলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরের আয়তন ৪৪ হাজার বর্গফুট করে। পঞ্চম থেকে বাকি সব তলার আয়তন ৪৬ হাজার বর্গফুট। এনবিআরের সব অফিসের পাশাপাশি সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিইসি), কর জরিপ দপ্তর, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-কর), বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-ভ্যাট), কর আপিলাতসহ কয়েকটি কর অঞ্চলের কার্যালয় আগারগাঁওয়ের নতুন ভবনে চলে যাবে।
২০০৮ সালে রাজস্ব ভবন নির্মাণে পাঁচ বছর মেয়াদে ১৪১ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়েছিল। প্লট নিয়ে মামলা নিষ্পত্তির পর ২০১৪ সালে সেটি বুঝে পায় এনবিআর। এর মধ্যে ২০১৩ সালে মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। নকশা পরিবর্তনে প্রকল্পের খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫১ কোটি টাকা। একাধিকবার মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের জুনে প্রকল্পটি শেষ করার সময়সীমা ঠিক করা হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় যাত্রা শুরু করছে রাজস্ব ভবন।
এমপি, মন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার সব স্তরের স্বাদ নিয়েছেন তিনি। রাজনীতি ও ক্ষমতা, দুটোর কেন্দ্রবিন্দুতেই থেকেছেন জীবনের অধিকাংশ সময়। সব রাজনৈতিক দলেই রাজনীতি করার সুযোগ নিয়েছেন। তাই সমালোচনাও পিছু ছাড়েনি তার। শেষ বয়সে নিজ দল বিএনপিতে বিতর্কিত হতে হয়েছে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন হলেও শেষ বয়সে বিতর্কমুক্ত থাকার সুযোগ হয়নি। জীবদ্দশায় অর্জিত অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে তাকে। তিনি প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
তার সম্পর্কে কথা চালু রয়েছে লেখেন সত্য, বলেন সত্য-মিথ্যা। চোখ বুজে সংবিধান, আইনকানুন মুখস্থ বলতে পারতেন। যে কজন সদস্য সংসদ জমিয়ে রাখতে পারতেন তিনি তাদের একজন। শুরু করেছিলেন আওয়ামী লীগ দিয়ে। শেষ করেছেন বিএনপি দিয়ে। মাঝে ছিলেন জাতীয় পার্টিতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আইনবিদ, রাজনীতিক ও লেখক এ তিন পেশায় ছিলেন তিনি। প্রভাতি ও সন্ধ্যাতারা দুটোই ছিলেন তিনি। শেষ জীবনে চাপা মনোকষ্টে ভুগেছেন। প্রথমে ছেলের মৃত্যু, পরে তিন দশকের বেশি সময়ের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ জীবনটাই তছনছ হয়ে গিয়েছিল। বক্তব্যে, কলামে মনের যন্ত্রণা বেরিয়ে এলেও মুখে হাসি থাকতই নেতৃত্ব ছাপিয়ে পিতৃত্বে উত্তীর্ণ মানুষটির।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই প্রয়াত সদস্য বিয়ে করেছিলেন পল্লীকবি জসীমউদদীনের মেয়ে হাসনা জসীমউদদীনকে। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে আসিফ মওদুদ ছেলেবেলাতেই মারা যান। দ্বিতীয় ছেলে আমান মওদুদ প্রতিবন্ধী ছিলেন। তিনিও ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মারা যান। মেয়ে আনা আসপিয়া মওদুদ স্বামীসহ থাকেন নরওয়েতে।
আমান ও বাবা মওদুদ সম্পর্কে স্মৃতিরোমন্থন করে হাসনা মওদুদ বলেন, সে (মওদুদ) খুব একটা সময় দিতে পারত না। তবে যখনই সময় পেত, পিতাপুত্র মিলে কোয়ালিটি টাইম কাটাত। বড় ছেলে মারা যাওয়ার পর আমানই ছিল তার চোখের মণি। মৃত্যুর আগপর্যন্ত মওদুদের বিশ্বাস হয়নি, আমান নেই। যখনই সময় মিলেছে আমানকে নিয়ে থাকত।
হাসনা মওদুদ বলেন, আমান বলত, আমি প্রতিবন্ধী বা অক্ষম নই। কিন্তু সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু আলাদা ছিল আমান। নিজে বুঝতে পারত বলেই, যারা তার মতো সমস্যায় ছিল, তাদের বেশি সাহায্য করত আমান। তিনি বলেন, মওদুদের জন্য প্রথম ছিল রাজনীতি। তারপর ছিল তার পরিবার। সবশেষে সে নিজে। সুযোগ মিললেই ছেলেকে গোসল করানো থেকে শুরু করে ভাত খাইয়ে দেওয়া, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া সবই করেছে। আমানের মৃত্যু মওদুদ সামলাতে পারেনি। আমানের মৃত্যুর পর মওদুদ একেবারে চুপ হয়ে যায়। স্তব্ধ। আমান ছিল স্টার অব দ্য হাউজ, স্টার অব দ্য ফ্যামিলি।
ছেলের খুব একটা আবদার না থাকলেও বাবা হিসেবে মওদুদ আহমদ সবই পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। হাসনা মওদুদ বলেন, আমার মনে আছে, মওদুদের মতিঝিলের চেম্বারটা যখন সুন্দর করে সাজানো হলো, আমান গিয়েছিল। মওদুদ ছেলের কাছে জানতে চাইল, কেমন লাগছে? আমানের এত পছন্দ হয়েছিল যে, সঙ্গে সঙ্গে আবদার, তোমার বইয়ের পাশাপাশি আমি আর্ট গ্যালারি করব। মওদুদ বলেছিল, এটা তো চেম্বার। আমান তার আঁকা ছবিগুলো সেখানে রাখবেই। ছেলের আঁকা ছবি নিয়ে ছোট্ট গ্যালারি করেছিল মওদুদ। ইংল্যান্ড, যেখানে আমান পড়ত, সেখান থেকেও ছবি আনানো হয়েছিল।
পল্লীকবির মেয়ে বলেন, ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা ছিল আমানের প্যাশন। সবসময় বলত, বড় আর্টিস্ট হবে। মওদুদ আর আমি যখন বিদেশে যেতাম তখন আমান নানাবাড়ি থাকত। ওই সময় চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম, কনক চাঁপা চাকমা, খালিদ মাহমুদ মিঠুদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তাদের দেখেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক বাড়ে তার। কমলাপুরে বাবার কাছ থেকে পাওয়া দুটি ফ্ল্যাটের একটিতে আমানের ছবির গ্যালারি ছিল। অন্যটিতে বাচ্চাদের গান, তবলা শেখানো হতো।
ছেলে দেশে ফিরলে মওদুদ যত কাজই থাক বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির হতো। এরশাদ সরকারের সময় সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি হাসনা মওদুদ বলেন, মওদুদ বিশেষ করে সন্ধ্যায় আমানকে সময় দিত। সকালের নাশতা আমরা সবাই একসঙ্গে করতাম। দুপুরে যে যার মতো খেয়ে নিলেও ডিনারে আবার একসঙ্গে। ছেলের পছন্দের খাবার যেন রান্না হয়, কঠোর নির্দেশ ছিল তার।
তিনি বলেন, আমান বই খুব ভালোবাসত। আর ছবি আঁকার উপকরণ চাইত। তার আঁকা ছবিগুলো মওদুদ বা আমি যখন বাঁধিয়ে দিতাম সে খুব খুশি হতো। ছোট মোটর গাড়ি বা রেসিং কারের শখ ছিল। মওদুদের চোখে পড়লে ছেলের জন্য এই উপহার আনতে ভুল করত না। আমান যখন অসুস্থ হতো মওদুদ তখন সারা দিন বাসায় থাকত। আমানের সাঁতার কাটা খুব পছন্দ ছিল। গ্রামের বাড়িতে পুকুরে বা গুলশানের বাড়িতে সুইমিং পুলে সময় পেলেই সাঁতার কাটত পিতা-পুত্র।
আমানের শূন্যতা ছিল মওদুদের জন্য অনেক বড় ধাক্কা এ কথা জানিয়ে হাসনা মওদুদ বলেন, আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শূন্যতা তৈরি হয় আমানের মৃত্যুতে। মওদুদ তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কভিডের মধ্যে আমাদের বাড়িটা নিয়ে গেল সরকার। আমান বেঁচে থাকলে এটা মানতে পারত না। সে জন্যই হয়তো আমান আগেই চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, জীবন সায়াহ্নে এসে মওদুদ পরিবার নিয়ে শিপক্রুজে যেতে চেয়েছিল। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। মওদুদ ফার্স্ট ক্লাস জাহাজে সফর করতে চাইল। আমান যখন ছোট ছিল তখন আমরা ডিজনিল্যান্ডে একবার ক্রুজ করেছিলাম। সেটা মওদুদের মনে ছিল।
ব্যারিস্টার মওদুদের কাছের মানুষ ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ জানান, সন্তানের পড়াশোনার জন্য অন্য পিতাদের মতোই উদগ্রীব ছিলেন তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি কলেজে আমান পড়াশোনা করত। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার তো সবই আছে। এ বয়সে এত খাটাখাটি করছেন! জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমার তো দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের খরচ আমারই চালাতে হবে।
প্রতি ঈদে মওদুদ নতুন পাঞ্জাবি কিনলেও সেটি আমান পরতেন না। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন পাঞ্জাবি কিনে দিলে তবেই ঈদের জামাত পড়তেন। মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান, একবার পাঞ্জাবি পাঠাতে দেরি হয়েছিল, তাই ঈদের প্রথম জামাত পড়তে যাননি আমান। পরে পাঠানো পাঞ্জাবি পরে দ্বিতীয় জামাতে শামিল হন।
মওদুদ আহমদ সত্যটা লেখার চেষ্টা করতেন। লিখেছেন ১৭টি বই। নিজের সহকর্মী থেকে শুরু করে দলের সর্বোচ্চ নেত্রী, মুক্তিযুদ্ধ, এক-এগারো, জঙ্গিবাদ কোনো প্রসঙ্গই বাদ যায়নি। ১৭টি বইয়ের দুটি এখনো প্রকাশ পায়নি। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন এ বই দুটি তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হবে। বই দুটি হচ্ছে চলমান ইশতেহার-২ জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৯১-২০১৯ এবং বাংলাদেশ : ডিমাইস অব ডেমোক্রেসি, অন দ্য ওয়ে টু এ ফেইলিওর স্টেট, ২০০৯-২০১৯।
বইগুলো নিয়ে হাসনা মওদুদ বলেন, দেশের প্রকাশকরা তার বই এখন ছাপতে চাচ্ছে না। দেশের অবস্থা ভালো নয়। মওদুদ বলে গিয়েছে, তার মৃত্যুর পর বই দুটি ছাপাতে। তার হয়তো ধারণা ছিল, সরকার বইগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। তিনি বলেন, আমি ভারতের একজন প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তবে দেশের বড় কোনো প্রকাশক এগিয়ে এলে, তাদের অগ্রাধিকার দেব। মৃত্যুর আগেই তার নিজের লেখা রাজনৈতিক বইগুলো বাসার লাইব্রেরিতে এনে রেখেছিল মওদুদ। চেম্বারে রয়েছে লিগ্যাল বইগুলো।
তিনি বলেন, মতিঝিলের চেম্বারে নিয়ে মওদুদ যা করত আমি তাই করব। আমি এখনো চালাচ্ছি। ভালো অর্গানাইজার যদি এগিয়ে আসে আমি তাদের গ্রহণ করব। চেম্বারে যারা ব্যারিস্টার আছে তারাই সেটা চালিয়ে নিয়ে যাবে। যারা ইন্টার্ন করতে আসতে চায় তাদের স্বাগত জানাই।
মওদুদের উল্লেখযোগ্য বই বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি (১৯৭৬), বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা (১৯৯২), বাংলাদেশ : এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৮৩), বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল (১৯৮৩), ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট : এ স্টাডি অব পলিটিকস অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ (১৯৯৫), গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ (২০০০), সাউথ এশিয়া : ক্রাইসিস অব ডেভেলপমেন্ট : দ্য কেস অব বাংলাদেশ (২০০২), সংসদে যা বলেছি স্পিচ ইন পার্লামেন্ট (২০০৫), চলমান ইতিহাস (২০০৯), দক্ষিণ এশিয়া : উন্নয়নের সংকট বাংলাদেশ প্রেক্ষিত (২০১০), বাংলাদেশ : এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিম ১৯৯১-২০০৬ (২০১২), কারাগারে কেমন ছিলাম ২০০৭-০৮ (২০১৪), বাংলাদেশ : ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ (২০১৪), সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০০৭-০৮ (২০২১); এবং ইন লাভিং মেমোরি অব আমান মওদুদ, হিজ লাইফ অ্যান্ড আর্ট।
ধাপে ধাপে জোরদার কর্মসূচিতে যেতে চায় বিএনপি। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সরকারের পদত্যাগসহ চলমান ১০ দফা দাবির আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে সারা দেশে কর্মসূচি পালন করছে দলটি। তাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে। আজ শনিবার সারা দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ কর্মসূচি রয়েছে। ধারণ করা হচ্ছে এই সমাবেশ থেকে ‘চলো চলো ঢাকা চলো’, মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র মতো কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে। ইতিমধ্যে সমাবেশ সফল ও পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে সরকারবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা।
কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ধাপে ধাপে জোরদার কর্মসূচি আসবে। ১০ দফা দাবির পক্ষে জনমত গঠনে সারা দেশে কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। চলো চলো ঢাকা চলো, মার্চ ফর ডেমোক্রেসিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচি ব্যাহত করতে আওয়ামী লীগ একই দিন কর্মসূচি ঘোষণা করে আমাদের উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা ইতিমধ্যে এভাবে কর্মসূচি না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। এ ছাড়া ঐক্যে ফাটল ও আন্দোলন কর্মসূচি বানচালে সরকারের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে বলা হয়েছে। ভুল-বোঝাবুঝি এড়াতে আমরা নিজেদের মধ্যে বেশি বেশি বৈঠক করব।’
ধারাবাহিক বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু গতকাল বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যুগপৎ কর্মসূচি সফল ও পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে আমরা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বৈঠক করেছি। বৈঠকে সবার কাছ থেকে কর্মসূচির ধরন সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। এরই আলোকে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি চূড়ান্ত করব।’
বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ আমাদের ১৪ দফা ও বিএনপির ১০ দফা দাবি আদায়ে আমরা যখন ঐক্যবদ্ধভাবে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চলছে। নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। এটি কাটিয়ে উঠতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বৈঠক করছি। এটি অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘যুগপৎ কর্মসূচির বাইরে বিএনপি রাজধানী ঢাকায় চারটি পদযাত্রা করেছে। আমরা ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকায় পথসভা করব। এভাবে আমরা পৃথক কর্মসূচি পালন করে জনসম্পৃক্ততা বাড়াব।’
বিএনপির দপ্তর সংশ্লিষ্ট নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, শনিবারের বিভাগীয় সমাবেশ সফল করতে বিএনপি মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ও নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৈঠক করে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইতিমধ্যে সাংগঠনিক ১০টি বিভাগে সমাবেশ সমন্বয় করতে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। তারা বিভাগীয় সাংগঠনিক, সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে আলোচনা করে জেলা নেতাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। জেলা নেতারা নিজ নিজ জেলার ইউনিটগুলোর নেতাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বিভাগীয় সমাবেশ সফল করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে তাদের মাঝে লিফলেট বিতরণ করছেন।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিভাগের জেলাগুলোর নেতাদের নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি। ১০ দফাসংবলিত লিফলেট বিতরণ করছি। প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছি। আশা করছি, ময়মনসিংহ বিভাগের সমাবেশ হবে সর্বকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ।’
রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দায়িত্ব পেয়ে আমরা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করেছি। সমাবেশ সফল করতে জেলা নেতারা ১০ দফা দাবিসংবলিত লিফলেট সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। চালাচ্ছেন গণসংযোগ।’
এদিকে বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। পরে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদের নেতৃত্বে দলটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, বরকত উল্লা বুলু ও সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বৈঠকে অংশ নেন। এর আগে গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয়তাবাদী জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।