
দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি কে হতে যাচ্ছেন সে ব্যাপারে ‘টপ সিক্রেট’ নীতি অনুসরণ করছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। রাজনীতিক, বিচারপতি না আমলা কাকে বেছে নেবেন তা নিয়েও দোটানায় রয়েছেন সরকারপ্রধান। গত মঙ্গলবার সংসদীয় সভার পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক সূত্র দাবি করেছে, রাজনীতিক ব্যক্তির ওপরই ভরসা রাখতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।
টপ সিক্রেট নীতি প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রপতি পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মর্যাদাপূর্ণ এ চেয়ারের ব্যক্তিটি কে হচ্ছেন তা প্রকাশ পেয়ে গেলে কারণে, অকারণে সমালোচনামুখর হয়ে উঠবে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী। রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর সমালোচনা তেমন হবে না। যিনিই রাষ্ট্রপতি হন তাকে কম বিব্রত করতেই ‘টপ সিক্রেট’ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধায়ক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে। এখনো মনস্থির করে উঠতে পারেননি তিনি। তাই ঘনিষ্ঠজনদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো ক্লু দেননি সভাপতি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, শেষ বেলায় ছয়জনকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান, প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য স্থপতি ইয়াফেস ওসমান এবং দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাতবারের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার রয়েছেন। ফিজার প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তিনি বলেন, পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাসই আমি পেয়েছি।
ওই আত্মীয় আরও বলেন, এবারের রাষ্ট্রপতিকে দেশের ও জনগণের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থির অবস্থা, দেশি-বিদেশি শক্তির বিভিন্ন ধরনের তৎপরতার ভেতর দিয়ে সময় অতিবাহিত হবে এ বছর। পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। সেইজনকেই বেছে নিতে অনেক ভাবতে হচ্ছে সংসদ নেতা শেখ হাসিনাকে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, আদর্শে অবিচল ও দলের প্রতি অনুগত এমন একজন রাজনীতিবিদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিতে চেষ্টা করছেন সংসদ নেতা।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন নিয়ে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের মধ্যে আলোচনায় মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের নাম আসে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত মঙ্গলবার সংসদীয় দলের সভায় সংসদ নেতা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে, বিভিন্ন মহল আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে রাষ্ট্রপতিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রপতি বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও মনোবলের সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছেন।
ওই বৈঠকে দেওয়া বক্তব্যে দলীয় সভাপতি বলেন, রাষ্ট্রপতি এমন একজনকে হতে হবে যিনি রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে পারবেন। অন্য কোনো শক্তির প্ররোচনায় অরাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেবেন না তেমন একজনকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে চান সংসদ নেতা, যিনি দলের ভেতরে জনপ্রিয় এবং সাহস-শক্তি ও মনোবলসম্পন্ন।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও মন্ত্রিসভায় থাকা একজন দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে রাজনীতিকে গুরুত্ব দেবেন তেমন ব্যক্তিকে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসাতে চান শেখ হাসিনা। এ বিবেচনা থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে এগিয়ে রাখছেন ওই মন্ত্রী।
তিনি বলেন, সংসদীয় দলে সংসদ নেতার বক্তব্যের শানেনজুল হলো, রাজনৈতিক ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসাতে চান বঙ্গবন্ধুকন্যা। সততা ও বিশ্বস্ততার প্রশ্নে মতিয়া চৌধুরী আপসহীন ভূমিকায় থাকবেন সবসময়।
বাম রাজনীতিকে আদর্শ ধরে উঠে আসা মতিয়ার ওপর আওয়ামী লীগ সভাপতির বিশ্বাস তৈরি হয়েছে বহু আগে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সাহসিকতার পরিচয় দেবেন তিনি। তাছাড়া নারী রাষ্ট্রপতি বানানোর শেখ হাসিনার আগ্রহও পূর্ণ হবে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা দুই নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সংসদ সদস্য কাউকে রাষ্ট্রপতি না বানানোর ভাবনা থাকলেও রাজনৈতিক নেতারই রাষ্ট্রপতি হওয়া প্রয়োজন, শেখ হাসিনা এমন বিবেচনাই করছেন এখন।
নতুন করে কোনো খাতেই আর শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। বর্তমানে যেসব খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে, তা কমাতে হবে বা তুলে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এসব শর্ত মেনেই ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। শর্ত না মানলে ঋণের কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি।
অর্র্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব খাতে বা পণ্যে শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আছে অর্থাৎ শুল্ক-ভ্যাট আরোপ নেই বা কম ধরা হয়েছে, সেসব খাত থেকে এ সুবিধা কমানো বা তুলে নেওয়ার মানেই হলো নতুনভাবে শুল্ক-ভ্যাট যোগ হওয়া। নতুন শুল্ক-ভ্যাট যোগ হওয়া মানেই হলো উৎপাদন ও আমদানিতে খরচ বাড়বে। যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ হবে এবং ক্রেতাকেই দিতে হবে। বৈশি^ক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দেশের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তা আরও বাড়বে, যা ভোক্তার দুর্দশা আরও বাড়াবে।
বৈশি^ক অর্থনীতির মন্দার প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতেও অস্থিরতা চলছে। ডলার সংকট বাড়ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এলসি বা ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের রিজার্ভ তলানিতে। আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার অংশ হিসেবে রাজস্ব খাত সংস্কারের কথা রয়েছে। এখানে সেখানে শুল্ক ও কর অব্যাহতি না দেওয়া বা কমানোর শর্তটি অন্যতম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুমিন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন বলেন, ‘যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা কাজ করি। তবে আইএমএফের কথামতো এখনই সব ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়নে চেষ্টা করা হবে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তৈরি প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে কোনো ভ্যাট নেই। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে, এমন খাতগুলোতে ভ্যাট আরোপ করা নেই। উৎপাদন খাতে পোশাকশিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। এ ছাড়া বিদেশি পণ্যের নির্ভরতা কমিয়ে দেশি শিল্পের বিকাশ, টেকসই শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, লিফট, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে এবং ক্ষেত্রে বিশেষে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া আছে। ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে এপিআই এবং সাবান ও শ্যাম্পুর প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পণ্য যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড এ জাতীয় পণ্য উৎপাদনে এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে একই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পলিব্যাগের পরিবর্তে জিওব্যাগ ব্যবহার উৎসাহিত করতে কাঁচামাল হিসেবে পিপি ও পিপি স্ট্যাপল ফাইবার, রিসাইক্লিংয়ের লক্ষ্যে ওয়েস্ট পেপার/কটন/পুরাতন ব্যাটারি/স্ক্র্যাপ, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ও ফটো-ভোল্টাইক, সেলে ভ্যাট অব্যাহতি আছে। পাইকারি/খুচরা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভ্যাট অব্যাহতি প্রাপ্ত পণ্যের ব্যবসা সংশ্লিষ্ট এবং ভ্যাটের আওতাবহির্ভূত। পরিবহন সেবায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পণ্য পরিবহন ও সাধারণ যাত্রী পরিবহনসংশ্লিষ্ট হওয়ায় ভ্যাটের আওতামুক্ত।
হিসাব করে দেখা গেছে, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২৯১২ এর প্রথম তফসিল অনুযায়ী ৪৮৯ এইচএস কোডভুক্ত প্রাথমিক পণ্য, জীবনধারণের জন্য মৌলিক পণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। এ ছাড়া একই তফসিল অনুযায়ী প্রায় ৫০টি সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রায় ৫০০ পণ্যকে বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট অব্যাহিত দেওয়া হয়েছে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতাভুক্ত।
এনবিআর বলছে, এ সুবিধা থাকায় ভ্যাট জিডিপি তথা কর জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না।
এনবিআর সূত্র জানায়, রাজস্ব খাতে আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে হলে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে হবে। এর মধ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ে তিন খাতের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ খাত হলো ভ্যাট, যা পরোক্ষ কর। এ করপণ্যের মূল্যের সঙ্গে ক্রেতা পরিশোধ করে। আদায়কৃত ভ্যাট ব্যবসায়ী বা বিক্রেতারা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়ে থাকেন। আইএমএফের হিসাবে, প্রতি অর্থবছরে শুধু আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় সরকার গড়ে ৪৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় করে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভ্যাট অব্যাহতিতেও এ অর্থের সমান আদায় কম হয়। এসব অর্থ নিশ্চিত আদায়। তাই এখানেই হাত দিয়েছে ঋণদানকারী সংস্থাটি।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আইএমএফের সিদ্ধান্তগুলো যাচাই-বাছাই করেই মানতে হবে। ভ্যাট অব্যাহতি তুলে নেওয়ার মতো সক্ষমতা এখনো আমরা অর্জন করিনি। এতে দেশি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
এনবিআর সূত্র আরও জানায়, রাজস্ব খাতে সংস্কারের মাধ্যমে আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ করার শর্ত দিয়েছে। এ শর্ত পূরণ করতে গেলে বর্তমানে আমাদের যে রাজস্ব আয় আছে, তার থেকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হবে। এরপরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত দিয়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজস্ব থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত আয় করতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে বলেছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এ অর্থবছরে এনবিআরকে বর্তমান আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত আরও ৯৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। সব মিলিয়ে আগামী তিন অর্থবছর শেষে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হবে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আগের অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের গত সাত মাসে ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা জানি যে পণ্য বা সেবার উৎপাদন বা আমদানি যে কোনো পর্যায় থেকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেওয়ার মানেই হলো নতুন ভ্যাট যোগ হওয়া। যা উৎপাদকরা বা আমদানিকারকরা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ করে দেয়। তাই আইএমএফের শর্ত মেনে যেসব পণ্য থেকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কমানো বা তুলে নেওয়া হবে তার প্রতিটি ক্ষেত্রের সেবা নিতে হলে ভোক্তাকে বেশি দাম দিতে হবে। ভ্যাট অব্যাহতি কমানো বা তুলে নেওয়া প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে। বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে শুধু ঋণ নেওয়ার জন্য পণ্যের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলবে।
তিনি আরও বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে যে হিসাব দিয়েছে আইএমএফ তা অবাস্তব বলে মনে করি। এসব হিসাব বাস্তবায়ন করতে গেলে সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়বে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ছয়টি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। এরপর আমি আশা করি আর কেউ নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা উত্থাপন করার সুযোগ পাবে না। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র কয়েক দিন আগে ছয়টি উপনির্বাচন হলো। একটিতে জাতীয় পার্টি জিতেছে। একটিতে বিএনপির একজন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন, তারপর তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়ে আজ সংসদে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘তাছাড়া একটা আমরা দিয়েছিলাম রাশেদ খান মেননকে সেখানে জাতীয় পার্টি জিতে এসেছে। হাসানুল হক ইনুকে দিয়েছি বগুড়ায় সেটা জিতে এসেছে। বগুড়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুই সিটে নৌকা মার্কা জয়লাভ করেছে।’
বিএনপির এমপিদের পদত্যাগ করা ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোট হয়। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে পদত্যাগ করা বিএনপির এমপি আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন।
রংপুর সিটির মেয়র নির্বাচন নিয়ে কেউ অভিযোগ করতে পারেনি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সে ইলেকশনে কিন্তু জাতীয় পার্টি জয়লাভ করেছে, আওয়ামী লীগ হেরে গেছে। কাজেই নির্বাচন যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুষ্ঠু হয়, অবাধ নিরপেক্ষ হয় সেটাই কিন্তু এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমি আশা করি এরপর আর কেউ নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা উত্থাপন করার সুযোগ পাবে না। কারণ আমরা ক্ষমতায় থাকলেও মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য আমরাই সংগ্রাম করেছি। ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করি।’
সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল সেবা চালু করা হচ্ছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এখন দলিল পর্চা ঘরে বসে নিতে পারে। যেকোনো বিল ঘরে বসে দিতে পারে। দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।
পরিবেশ দূষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহর অত্যন্ত ছোট। অধিকাংশ লোক... ও প্রচুর গাড়ি চলাচল করে। যার জন্য বায়ু ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা যারা বলি ঢাকা খারাপ, বসবাসের উপযোগী না... তারা তো ঢাকায়ই বাস করে। ঢাকা থেকে তো বাইরে যায় না।’
ঢাকার বাইরে পরিবেশ অনেক পরিশুদ্ধ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারপরও ঢাকায় থাকতে হবে। আমরা গালিও দেব, আবার থাকব, এটা কেমন কথা? এটা হয় না। তারপরও আমাদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই।’
ঢাকার অনেক খাল ও ঝিল ছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আইয়ুব খান, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া (সেগুলো) নষ্ট করেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু হৃদয় আছে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনায় সহায়তার জন্য বাংলাদেশ থেকে মেডিকেল টিম, ওষুধ, শুকনা খাবার পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশ সাধ্যমতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতিকে আবদুল হামিদকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ভাষণটাই বোধহয় তার শেষ ভাষণ। কারণ আমাদের সংবিধান অনুযায়ী কেউ পরপর দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি থাকতে পারেন না। রাষ্ট্রপতি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি শুরু করেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি মনে করি তিনি অত্যন্ত প্রাণবন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সময়ে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন এবং ভাষণ দিয়ে গেছেন। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার হিসেবেও তিনি সংসদকে প্রাণবন্ত রেখেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে সফল ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।’
স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে : চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে বলে সংসদকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপন করা হয়।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জানান, আমদানি করা তরল গ্যাসের ব্যবহার, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ, উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে সমন্বয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার মূল্যমানের সমন্বয়ের কারণে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়ে থাকে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার দাম কিছুটা বাড়িয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং রপ্তানিমুখী বিভিন্ন কলকারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করে বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে হবে। সে কারণে সরকার অন্যান্য ভোক্তা শ্রেণিকে অপরিবর্তিত রেখে শুধু বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ গত ছয় মাসে ১২ হাজার ৪৫২ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এসডিজি বাস্তবায়নে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বেলজিয়ামের রানী এবং জাতিসংঘের এসডিজিবিষয়ক বিশেষ দূত ম্যাথিল্ড ম্যারি ক্রিস্টিন তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি এ কথা বলেন।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য লেখক মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) এজেন্ডাগুলোকে অষ্টম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনা এবং ২০২১-৪১ সাল পর্যন্ত পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
বেলজিয়ামের রানী বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী ও শিশুর উন্নয়ন এবং নারীশিক্ষায় বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের অগ্রগতি দেখে খুব খুশি।’
বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসে।
শেখ হাসিনা রাজনীতি, প্রতিরক্ষা ও বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য তার সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে রানীকে অবহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি নারীশিক্ষার প্রসারে তার সরকারের প্রচেষ্টার কথাও সংক্ষেপে বর্ণনা করেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি। কক্সবাজার ক্যাম্পে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার গর্ভবতী নারীকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারপ্রধান বলেন, এ পর্যন্ত ৩৪ হাজার রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে, এতে আমাদের উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণপ্রবণ দেশ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তার সরকারের উদ্যোগের চিত্র তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। সবুজ বেষ্টনী তৈরি করেছে। উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ ও টেকসই বাড়ি নির্মাণ করেছে।
বৈঠকে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রবিষয়ক সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম উপস্থিত ছিলেন।
তিন দিনের সফরে গত সোমবার সকালে ঢাকায় আসেন বেলজিয়ামের রানী।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ৫৭৪ জনের। আর সিরিয়ায় মারা গেছে ২ হাজার ৬৬২ জন। গত সোমবার ভোরের ভয়াবহ ওই ভূমিকম্পে দুই দেশে ধসে পড়েছে কয়েক হাজার ভবন। এসব ভবনের নিচে আটকা পড়েছে বহু মানুষ। তবে বৈরী আবহাওয়া ও পরে অনেকগুলো শক্তিশালী আফটারশকের কারণে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার তৎপরতা। রয়েছে উদ্ধারকারী সরঞ্জামের ঘাটতি। তারপরও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া ব্যক্তিদের জীবিত উদ্ধারের আশায় উদ্ধারকারীরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও তিন দিন পরেও জীবিত উদ্ধার করা হচ্ছে শিশুসহ আহতদের। তবে সময় যত গড়াচ্ছে, ততই জীবিত উদ্ধারের আশা ফিকে হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অনেকেই বলছে, ভয়াবহ ওই ভূমিকম্পে দুই দেশে মৃত্যুর সংখ্যা হতে পারে আরও কয়েকগুণ বেশি।
বিবিসি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে বলছে, তুরস্ক ও সিরিয়াজুড়ে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ এই ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে। উত্তর সিরিয়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া লোকজন সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করছে কিন্তু তাদের ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো প্রায় কেউ নেই। তুরস্কেরও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে বহু মানুষ। তাদের মধ্যে জীবিতরা সেখান থেকেই নানা উপায়ে সাহায্যের আকুতি জানাচ্ছে। অনেকে সাংবাদিক ও পরিচিতদের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে। সেখান থেকে লাইভে জানাচ্ছে তাদের অবস্থান।
বিবিসির ভাষ্য, আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে আটকে পড়াদের জীবিত উদ্ধারের আশা প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও জাতিসংঘ, ইইউ, ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান, ইরাক, ইরান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, গ্রিস, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের সরকার থেকে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাঠানো হচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। এখন ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধ পথ্যের তীব্র সংকট রয়েছে। তীব্র শীত আর বৃষ্টির মধ্যেই খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে গতকাল তুর্কিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকা দেখতে যান। কাহরামানমারাস শহরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি স্বীকার করেছেন, দুর্যোগ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে কিছু সমস্যা ছিল।
উদ্ধারকাজে বিলম্ব হওয়ার জন্য তিনি ক্ষতিগ্রস্ত বিমানবন্দর ও রাস্তাঘাটকে দায়ী করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, উদ্ধারকাজ এখন স্বাভাবিকভাবেই চলছে। শুরুতে বিমানবন্দর এবং সড়কে কিছু সমস্যা ছিল। কিন্তু আজ পরিস্থিতি অনেক সহজ হয়ে এসেছে। আগামীকাল আরও সহজ হবে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় কয়েকটি শহর পরিদর্শনের সময় তুর্কিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমাদের কাছে যা কিছু আছে তার সবই আমরা কাজে লাগিয়েছি। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্র তার কাজ করে যাচ্ছে।’
তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর বাসিন্দারা উদ্ধারকাজে ধীরগতির অভিযোগ করছেন। পরিবারগুলো বলছে, তাদের যেসব সদস্য নিখোঁজ রয়েছে, তাদের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে খুঁজে বের করতে প্রয়োজনীয় সাহায্য তারা পাচ্ছে না। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর-নগরী ইসকেন্দেরুনের আরজু দেদেগলু বিবিসিকে বলেছেন, তাদের পরিবারের দুটি শিশু ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তাদের উদ্ধারের জন্য তারা নিজেরাই একটি খনন-যন্ত্র জোগাড় করেছেন। কিন্তু কর্মকর্তারা তাদের সেটি ব্যবহার করার অনুমতি দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। কিন্তু কেউ আসেনি। তখন আমরা নিজেরা একটি ডিগার নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা চায় না আমরা এটা ব্যবহার করি।’
অনেকে বলছেন, ভূমিকম্পের ৪৮ ঘণ্টা পরেও দুর্গত এলাকায় কোনো ত্রাণ-সাহায্য পৌঁছায়নি। তুরস্কের হাতায় প্রদেশের আন্তাকিয়া শহরে ৬৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলছেন, ‘ভূমিকম্প থেকে বেঁচে গেছি, কিন্তু এখন ক্ষুধা আর ঠাণ্ডায় মারা যাব।’
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তীব্র রাজনৈতিক ক্ষোভও তৈরি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এ রকম দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সরকারের কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছিল না। তুরস্কের প্রধান বিরোধী দলের নেতা কেমাল কিলিচাদারুগলু বলছেন, ‘এ জন্য যদি একজনকেও দায়ী করতে হয়, তাহলে তিনি এরদোয়ান।’
সিরিয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বরাত দিয়ে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সানা বলছে, সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় উদ্ধারকাজ চলছে। সেখানে সরকারি লোকজনের সঙ্গে বিদেশিরাও যোগ দিয়েছে উদ্ধার তৎপরাতয়। সরকারবিরোধীরা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় যেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, সেখানে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে হোয়াইট হেলমেটস নামের একটি সংগঠন। তারা বলছে, এখনো শত শত পরিবার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তার ফলে নিহতের সংখ্যা যে আরও বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সাংবাদিকরা বলছেন, যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এসব অঞ্চলে রুশ সমর্থিত সরকারি বাহিনী, জিহাদি, তুর্কি সমর্থিত বিদ্রোহী এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই চলছে। ভূমিকম্পে যেসব জায়গা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো সরকারবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে। দেশটিতে ১২ বছর ধরে এসব যুদ্ধ চলছে। এ কারণে এসব জায়গায় উদ্ধারকাজ কতটা চলছে তার তথ্য সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়েছে।
কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলায় সিরিয়ার সরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে। কিন্তু সেখানে কীভাবে ত্রাণ-সাহায্য পাঠানো হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। এর উপায় খুঁজে বের করতে ব্রাসেলসে আলোচনা চলছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাশার আল-আসাদকে সিরিয়ার বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকার করে না। এ ছাড়া তার সরকারের ওপর ইইউ বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। ফলে সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে তাদের তেমন একটা যোগাযোগও নেই বললে চলে। তবে ইইউর পক্ষ থেকে মঙ্গলবার বলা হয়েছে, সিরিয়ায় বর্তমানে যেসব ত্রাণ-সাহায্য নেটওয়ার্ক কাজ করছে, সেগুলোর মাধ্যমে সাহায্য পাঠানো যেতে পারে।
করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ২০২১ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হয়েছিল মাত্র তিনটি বিষয়ের ছয়টি পত্রে। ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি। পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ও অর্ধেক নম্বরে। পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতেও ছিল উল্লম্ফন। ২০২২ সালে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও অর্ধেক নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হলেও শিক্ষার্থীদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয় বাদে বাকি ১২ বিষয়েই দিতে হয়েছে। আবার ইংরেজি বিষয়ে ভালো করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। ফলে পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তি দুটি সূচকই কমেছে।
২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট অংশ নিয়েছিল ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৭ জন। পাস করেছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন। পাসের হার ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন, যা মোট উত্তীর্ণের ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ।
২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষাও মহামারীর কারণে দেরিতে হয়েছিল। সেবার ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ পাস করেছিল। জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন। এ হিসাবে ২০২২ সালে পাসের হার কমেছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ১২ হাজার ৮৮৭ জন। ২০২০ সালে মহামারীর কারণে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হয়নি। জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়নে সবাই পাস করে; জিপিএ ৫ পায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন। করোনা শুরুর আগে ২০১৯ সালে পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছিল ৪৭ হাজার ২৮৬ জন।
প্রতি বছর সাধারণত এপ্রিলের শুরুতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হয়। কিন্তু করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ঠিকমতো ক্লাস করতে পারেনি। তাই কিছুদিন পিছিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বন্যায় তা আরও পিছিয়ে যায়। গত ৬ নভেম্বর এই পরীক্ষা শুরু হয়। গত বছরের পরীক্ষার ফল ২০২৩ সালে প্রকাশ করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের অনুলিপি হস্তান্তর শেষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৩৩০টি। ৫০টি প্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করতে পারেনি। ২০২১ সালের তুলনায় শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৬০৪টি এবং শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ৪৫টি।
২০২১ সালের তুলনায় পাসের হার কমা ও শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ার কারণ হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গতবার মাত্র তিনটি বিষয়ে ছয়টি পত্রে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা হয়েছে। তাতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ভালো করেছে। পাসের হার প্রায় ৯৫ শতাংশ ছিল। এবার ১২টি পত্রে পরীক্ষা হয়েছে, তাতে সবাই তেমন ভালো করতে পারেনি। ৫০টি প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি। আমরা সেগুলো দেখব। দেখা গেছে, শূন্য পাসের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্ত নয়। অল্প কয়েকটি এমপিওভুক্ত। এদের অধিকাংশই মাদ্রাসা। আমরা বলছি বটে শতভাগ ফেল করেছে, কিন্তু এ-রকমের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিয়েছে একজন বা দুজন। শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে ওয়ার্কশপ করা হবে। কীভাবে তাদের সহযোগিতা করা যায় সে চেষ্টা করব আমরা।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইংরেজিই এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ভাগ্য নিরূপণ করে দেয়। ২০২১ সালে ইংরেজি পরীক্ষা হয়নি; মাত্র ছয়টি পত্রের পরীক্ষা হয়েছিল। এবার ইংরেজিসহ ১২টি পত্রের পরীক্ষা। ফল কিছুটা নিম্নগামী, এটাই স্বাভাবিক। এর আগে পূর্ণ পরীক্ষা হয়েছে ২০১৯ সালে। সেই বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এবার ফল অনেক ভালো হয়েছে।
বিষয়ভিত্তিক ফল : দুয়েকটি বোর্ড বাদে এবার ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বোর্ডে এবার ইংরেজিতে পাসের হার ৯২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ৮৮ দশমিক ১৬, কুমিল্লায় ৯৪ দশমিক ৬৪, যশোরে ৮৮ দশমিক ৭৪, চট্টগ্রামে ৮৬ দশমিক ৮৫, বরিশালে ৮৮ দশমিক ৭৪, সিলেটে ৮৫ দশমিক ৫৬, দিনাজপুরে ৮৫ দশমিক ৩৭ ও ময়মনসিংহ বোর্ডে ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।
মেয়েরা এগিয়ে : আগের বছরগুলোর মতোই এবারও এগিয়ে মেয়েরা। পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে তারা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে। এবার ৬ লাখ ৯ হাজার ৫২২ জন ছেলে অংশ নিয়ে পাস করেছে ৫ লাখ ১৫ হাজার ২৪৪ জন। তাদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৮০ হাজার ৫৬১ জন। অন্যদিকে ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮৬৫ জন ছাত্রী অংশ নিয়ে পাস করেছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪৩ জন। পাসের ৮৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৯৫ হাজার ৭২১ জন। ছাত্রের চেয়ে ছাত্রী ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি পাস করেছে এবং ১৫ হাজার ১৬০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছে।
বোর্ডভিত্তিক পাসের হার : বোর্ডভিত্তিক পাসের হারে এবার সবচেয়ে বেশি ভালো করেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, পাসের হার ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। সবচেয়ে কম পাস করেছে দিনাজপুর বোর্ডে, পাসের হার ৭৯ দশমিক ০৮ শতাংশ। ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৮৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ৮১ দশমিক ৬০, কুমিল্লায় ৯০ দশমিক ৭২, যশোরে ৮৩ দশমিক ৯৫, চট্টগ্রামে ৮০ দশমিক ৫০, বরিশালে ৮৬ দশমিক ৯৫, সিলেটে ৮১ দশমিক ৪০, ময়মনসিংহে ৮০ দশমিক ৩২ ও মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে ঢাকা বোর্ড, ৬২ হাজার ৪২১ জন। সবচেয়ে কম সিলেট বোর্ডে, ৪ হাজার ৮৭১ জন। রাজশাহী বোর্ডে ২১ হাজার ৮৫৫ জন, কুমিল্লায় ১৪ হাজার ৯৯১ জন, যশোরে ১৮ হাজার ৭০৩ জন, চট্টগ্রামে ১২ হাজার ৬৭০ জন, বরিশালে ৭ হাজার ৩৮৬ জন, দিনাজপুরে ১১ হাজার ৮৩০ জন, ময়মনসিংহে ৫ হাজার ২৮ জন, মাদ্রাসা বোর্ডে ৯ হাজার ৪২৩ জন এবং কারিগরি বোর্ডে ৭ হাজার ১০৪ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে।
যেভাবে হয়েছে পরীক্ষা : ২০২২ সালে পরীক্ষা হয়েছে বাংলা, ইংরেজি ও গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক ও একটি ঐচ্ছিক বিষয়ে। অর্থাৎ ১২টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে এসএসসি ও সমমান এবং জেএসসি বা জেডিসি ও সমমান থেকে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে এইচএসসিতে নম্বর দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জেএসসির ২৫ শতাংশ ও এসএসসির ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
পুনর্বিন্যস্ত বা সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে এবারও বিষয়, নম্বর ও সময় কমিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। দুই ঘণ্টার পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী প্রশ্নের জন্য ছিল ২০ মিনিট, সৃজনশীল বা রচনামূলকের জন্য ছিল ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। যেসব বিষয়ে ব্যবহারিক আছে, সেগুলোতে ৪৫ নম্বরের (রচনামূলক ৩০ ও নৈর্ব্যক্তিক ১৫ নম্বর) এবং ব্যবহারিক না থাকলে ৫৫ নম্বরের (রচনামূলক ৪০ ও নৈর্ব্যক্তিক ১৫) পরীক্ষা দিতে হয়েছে।
ফল পুনর্নিরীক্ষা : ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করা শুরু হবে আজ। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। শুধুমাত্র টেলিটকের প্রি-পেইড নম্বর থেকে উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করা যাবে। প্রতি পত্রের জন্য ১৫০ টাকা ফি দিতে হবে। বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
শিক্ষার হার বাড়াতে গুরুত্বারোপ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার হার বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গতকাল বুধবার সকালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, শিক্ষার হার বর্তমান ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ থেকে আরও বাড়াতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে তার কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে কম্পিউটারের বোতাম চেপে ২০২২ সালের মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসহ ১১টি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হতে এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বোর্ড পরীক্ষার পর অবসর সময়ে শিক্ষার্থীদের বুনিয়াদি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণে মনোনিবেশ করা উচিত। যাতে তারা নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়। তাহলে দেশ-বিদেশে চাকরি পেতে সুবিধা হবে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণের জন্য তার সরকার ইনকিউবেশন সেন্টার ও ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অনেক সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
সরকারপ্রধান বলেন, তার সরকার প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারি করে দিয়েছে। বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দিচ্ছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সরকার বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান, বিদেশে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা করে দিচ্ছে। সরকার গবেষণার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছে।
২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা পাস করতে পারেনি, তারা যেন মন খারাপ না করে। সামনে ভালো করার জন্য নতুন করে যেন উদ্যোগ নেয়।
দীর্ঘদিন নিশ্চুপ থাকার পর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষে (রাজউক) ফের সক্রিয় হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী অনুসারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরই মধ্যে তারা ভেতরে ভেতরে জোটবদ্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। আর সরকারি এ সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও আরবান রেজিলেন্স প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালী বিএনপি-জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ অংশটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের ব্যবসায়িক অংশীদার ও অর্থের অন্যতম জোগানদাতা হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই আবদুল লতিফ হেলালী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে) পড়ার সময় প্রথমে ছাত্রদলের দুর্ধর্ষ ক্যাডার এবং পরে সংগঠনটির নেতা বনে যান। আর ছাত্রদলের নেতা হওয়ার সুবাদে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের নজরে চলে আসেন এবং তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব পান। মির্জা আব্বাস গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী থাকাকালীন (১৯৯১-৯৬ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষদিকে) আবদুল লতিফ হেলালী এবং তার সহযোগী নুরুল ইসলাম রাজউকে মাস্টার রোলে (অস্থায়ী/দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে) সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) পদে নিয়োগ পান। নুরুল ইসলাম বর্তমানে রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। যিনি ছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসালামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর আবদুল লতিফ হেলালী নিজেকে আড়াল করে নেন। তখন তিনি রাজউকে চাকরির পাশাপাশি মির্জা আব্বাসের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা এবং তার শাহজাহানপুরের বাসায় থাকতেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ফের ক্ষমতায় এলে হেলালী ও নুরুল ইসলাম রাতারাতি যেন আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে যান। হেলালী-নুরুল ইসলাম এবং শ্রমিক দলের তৎকালীন সভাপতি আমির খসরুর নেতৃত্বে রাজউকে শুরু হয় টেন্ডারবাজি, প্লটবাণিজ্য, নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য। হেলালী এবং নুরুল ইসলাম দায়িত্ব নেন রাজউকের অথরাইজড অফিসারের। আর এ দায়িত্ব নিয়ে নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে ৪-৫ ফুট প্রশস্ত সড়কে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেন। শুধু তাই নয়, আবাসিক এলাকায় দেন বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের অনুমোদন। হেলালী-নুরুল ইসলাম আমলে অনুমোদিত নকশার নথিপত্র যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করলে এসবের সত্যতা মিলবে।
অভিযোগ রয়েছে, এই হেলালী, নুরুল ইসলাম ও খসরুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজউকে নিয়োগ পাওয়া ৩৭২ জন কর্মচারীকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। তাদের ছাঁটাইয়ের পরপরই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাতারাতি ৯৬ জন কর্মচারী নিয়োগ দেয় হেলালী-নুরুল ইসলাম-খসরু সিন্ডিকেট। তবে তারা সেখানেই ক্ষান্ত দেননি, নিজেদের কর্র্তৃত্ব আরও জোরালো করতে আওয়ামী লীগ সমর্থক কর্মকর্তাদের ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করাসহ সাময়িক বরখাস্ত করে রাখেন। কারও কারও বেতনভাতাও বন্ধ করে রাখা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই সিন্ডিকেটের নিয়োগবাণিজ্যের মধ্যে রয়েছে দুজন সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কোনো লিখিত পরীক্ষা না নিয়েই দুজনের পরিবর্তে ১৬ জন সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ। যার অধিকাংশই ছিল ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতা। তাদের অন্যতম একজন তৎকালীন আলোচিত হাওয়া ভবনের মালিক ও বিএনপি নেতা আলী আজগর লবীর ভাগ্নি। আবদুল লতিফ হেলালী ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার ধামরাই থেকে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। তবে পরে ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসায় তার সেই আশা ভেস্তে যায়। এই আবদুল লতিফ হেলালী বর্তমানে রাজউকের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ‘আরবান রেজিলেন্স প্রকল্প’-এর প্রকল্প পরিচালক। যার প্রধান কার্যালয় রাজউকের গুলশান-১ কার পার্কিং বিল্ডিংয়ে। এ প্রকল্পের অধীনে নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী হেলালীর নিকটাত্মীয় এবং বিএনপি-জামায়াতের আশীর্বাদপুষ্ট বলে অভিযোগ রয়েছে। যার ফলে প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় রাজউকের বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভয়ারণ্য হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প পরিচালক হেলালী কখনোই এ কার্যালয়ে দিনের বেলায় অফিস করেন না। বরং তাকে সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে তদবিরবাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। হেলালীর সঙ্গে দেখা করতে হলে তার গুলশানের অফিসে না গিয়ে সচিবালয়ের ফটকে গিয়ে অপেক্ষা করলে সাক্ষাৎ মেলে বলে লোকমুখে শোনা যায়। অভিযোগ রয়েছে, হেলালী সচিবালয়ে কর্মরত বিএনপি-জামায়াতঘেঁষা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বিএনপির হাইকমান্ডের যোগাযোগ ঘটানো ও সম্পর্ক বজায় রাখার কাজ করে আসছেন। সারাদিন সচিবালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যার পর গুলশানের প্রকল্প অফিসে হাজির হন হেলালী ও নুরুল ইসলাম। এরপর একে একে সেখানে আসতে থাকেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থক ও আশীর্বাদপুষ্ট অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার ছক কষেন বলে অভিযোগ।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ২০১৯ সালের মার্চে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলীর (বাস্তবায়ন) পদটি শূন্য হয়। তখন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের দিয়ে মন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাশ কাটিয়ে সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের যোগসাজশে কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে পদটি বাগিয়ে নেন আবদুল লতিফ হেলালী। তিনি কাজটি সহজে করতে সক্ষম হয়েছিলেন তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের বাড়ি বগুড়া জেলায় হওয়ায় এবং তার সঙ্গে বিএনপির হাইকমান্ডের গোপন যোগাযোগ থাকার সুবাদে। প্রধান প্রকৌশলীর (বাস্তবায়ন) দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রকাশ্যে চলে আসেন হেলালী এবং বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের ঠিকাদাররা জানান, ২০১৯ সালে জাতীয় শোক দিবস পালনের কথা বলে রাজউকের ছোট-বড় সব পর্যায়ের ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে তার পুরোটাই নিজে আত্মসাৎ করেন হেলালী।
তারা আরও জানান, যেসব ঠিকাদার চাঁদা দিতে পারেননি ছয় মাস তাদের বিলের ফাইল আটকে রেখেছিলেন হেলালী। চাঁদাবাজি করে তার অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি জানাজানি হলে রাজউক শাখা শ্রমিক লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা নড়েচড়ে বসেন। তারা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিবকে বিষয়টি অবহিত করেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার হেলালীকে তলব করেন। তবে তলবে সাড়া না দেওয়ায় হেলালীর মোবাইল ফোনে কল করেন সচিব। কিন্তু হেলালী তাতেও সাড়া দেননি এবং সচিবের কল রিসিভ করেননি। একপর্যায়ে সচিবের কল না রিসিভ করা ও নিয়মিত অফিস না করার অভিযোগ এনে হেলালীকে মন্ত্রণালয় থেকে শোকজ করা হয়। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ডিপি (ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিউর) রুজু করতে রাজউককে নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ পেয়ে সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম হেলালীর বিরুদ্ধে ডিপি রুজু করেন। প্রধান প্রকৌশলীর পদে থেকে তার চাঁদাবাজির তথ্য প্রকাশ্যে এলে রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। চাঁদাবাজির ঘটনা জানাজানির পর থেকে হেলালী আর নিয়মিত অফিস করতেন না। প্রধান প্রকৌশলীর (বাস্তবায়ন) পদে থেকে নিয়মিত অফিসে না আসা, চাঁদাবাজি, প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহণ ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অবশেষে ওই পদ থেকে হেলালীকে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর কিছুদিন নীরব থেকে সম্প্রতি তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও দেশ ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে রাজউক ও সচিবালয়ে কর্মরত বিএনপি-জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উসকানি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এসব কর্মকাণ্ডে তার প্রধান সহযোগী রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম। যদিও বিএনপির নৈরাজ্যে সরাসরি ইন্ধন ও সম্পৃক্ততার অভিযোগ এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নুরুল ইসলামকে গত বছর ডিসেম্বরে সরকারি এক আদেশবলে রাজউক থেকে গাজীপুর উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষে বদলি করা হয়েছে। গত বছর ২৬ ডিসেম্বর রাজউক থেকে অবমুক্ত করা হয় তাকে। আর এরপর থেকেই সাবেক শিবির নেতা, বর্তমানে জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক ও বিএনপি-জামায়াতের অর্থের অন্যতম জোগানদাতা এই নুরুল ইসলাম প্রকাশ্যে সরকারবিরোধী অবস্থান নেন। তিনি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় রাজউক ও সরকারের সমালোচনা করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছেন। একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় ও রাজউক নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দ্রুতই বিভাগীয় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ছাড়া তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় নুরুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
কোনো জেলায় কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন রয়েছে কি না তা জানতে তালিকা তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেক ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমার সরকারের লক্ষ্য হওয়ায় আমি প্রত্যেককে বাড়ি দেব। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ বাড়ি, আশ্রয় এবং জীবিকার সুযোগ পাবে। তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না। আমরা চাই প্রত্যেকে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে।’
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপে বাড়ি হস্তান্তরের সময় এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি সাতটি জেলা ও ১৫৯টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা।
এর আগে তিনি পঞ্চগড় ও মাগুরার সব উপজেলাসহ ৫২টি উপজেলাকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনি গতকাল ৯টি জেলা এবং ২১১টি উপজেলা গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। খবর বাসসের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির পিতা দেশকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে একটি উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন দিতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তার সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না বলে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি বলেন, তার সরকার ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বাড়িঘর ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে বাড়িপ্রাপ্তদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ওপর একটি ভিডিও-প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সরকার প্রধান বলেন, ‘কেউ ঠিকানা ছাড়া থাকবে না। আমরা তাদের শুধু ঘরই দিইনি, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। তাদের জীবিকার জন্য ঋণও দিয়েছি। তারা এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন, একজন ব্যক্তি ১০০ বিঘা জমির অধিকারী হতে পারবে এবং এর অতিরিক্ত পরিমাণ জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র গড়তে রোডম্যাপ জরুরি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভৌগোলিক-কৌশলগত সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। গতকাল ঢাকায় প্রথম অ্যাভিয়েশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে দেওয়া এক ভিডিও ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন সামিট-২০২৩’-এর আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী এই শীর্ষ সম্মেলনকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, দেশটির এই অঞ্চলে একটি বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা রয়েছে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা যাত্রী ও মালামাল উভয়ের জন্যই একটি উন্নত ও টেকসই বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারি সংস্থা, এয়ারলাইনস ও সংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সরকার ই-ভিসা সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ও পর্যটনে আসা যাত্রীদের সুবিধা দেবে ও ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের যুবকদের অবশ্যই পাইলট, বিমান প্রকৌশলী, মেকানিক, ক্রু ও আরও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি দেশের বিমানশিল্পে লোকবলের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই বিমানশিল্প এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী ও ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বক্তব্য দেন।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনার কামরুজ্জামান ফকির (৩৫) নামে এক পল্লি চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। এ সময় জাহিদ (২৮) নামে আরেকজন আহত হন। আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে উপজেলার শেখপুর বাজারসংলগ্ন মির্জারচর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত কামরুজ্জামান মাদারীপুর সদর উপজেলার আদিত্যপুর গ্রামের আবদুর রব ফকিরের ছেলে।
হাসপাতালে, ফায়ার সার্ভিস ও নিহতের আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, ভোরে কামরুজ্জামান তার আপন ভায়রা জাহিদকে নিয়ে তাবলিগ জামাতে অংশ নিতে গাজীপুরের টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশে শিবচরের পাঁচ্চর বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হন। পাঁচ্চর থেকে বাসযোগে টঙ্গী যাওয়ার কথা ছিল তার। এ সময় তার মোটরসাইকেলটি শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কে শিবচরের শেখপুর মির্জারচর নামক স্থানে আসলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মোটরসাইকেল থাকা দুজন গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা কামরুজ্জামানকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আহত জাহিদকে উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শিবচর ফায়ার সার্ভিসের লিডার তরুনুর রশিদ খান বলেন, ভোরে আমরা খবর পেয় ঘটনাস্থলে যাই। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, সকালে রোগীকে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে। পরে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পাই হাসপাতালে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।