
অনেক ত্যাগ আর প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলা ভাষা, সেটি সমুন্নত রাখার দৃপ্ত শপথ এসেছে কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠে। গতকাল মঙ্গলবার ভাষার দিনে সব পথ মিলে গিয়েছিল শহীদ মিনারে। দিনটি বাঙালির জন্য একই সঙ্গে গর্বের ও শোকের। দেশে ও দেশের বাইরে শোক আর শ্রদ্ধায় অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার এ দিনটিতে স্মরণ করা হয় ভাষার আন্দোলনে প্রাণ দেওয়া শহীদদের। করোনাভাইরাস মহামারীর পর গত দুই বছর বাঙালির এই গর্বের দিনটি উদযাপিত হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে। এবার পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই ভিন্ন। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একুশের প্রথম প্রহর থেকেই ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল নামে। প্রভাতফেরিতে আসা নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কণ্ঠে ছিল কালজয়ী সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। এরপর শ্রদ্ধার ফুলে ছেয়ে যায় শহীদ মিনারের বেদি।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির আত্মত্যাগের এই দিনটিকে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে দেশে ও দেশের বাইরে দিবসটি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। গতকাল নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করেছেন দেশবাসী। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরসহ বিদেশে বাংলাদেশের সকল মিশনে এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর রাষ্ট্রপতি পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান তাকে স্বাগত জানান। প্রথমে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানান। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এ সময় নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযোদ্ধা, বিদেশি কূটনীতিক, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এরপর মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা দলের পক্ষে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবকের মাধ্যমে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানান।
এরপর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনীপ্রধান অ্যাডমিরাল এম শাহীন ইকবাল, বিমানবাহিনীপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও জাতীয় পার্টির পক্ষে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের পক্ষে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ ছাড়া পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, র্যাব, বিজিবি, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, জাসদের নেতারা শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর সর্বস্তরের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শহীদ মিনার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এ সময় মানুষের ঢল নামে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের সারি দীর্ঘ হতে থাকে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলা ৩৫ কোটি মানুষের মায়ের ভাষা। অথচ এই ভাষা আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি পায়নি। আমরা আবারও জাতিসংঘের কাছে দাবি জানাব।’ এ সময় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যারা একুশের চেতনায় বিশ্বাস করে না, তারা একাত্তরের চেতনাকেও বিশ্বাস করে না। একাত্তরের চেতনা আর একুশের চেতনা একই চেতনা। আজকে বিএনপির নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী, অপশক্তি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।’ এ সময় ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কখনো একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেনি। ৭৫-এ কৃষক, শ্রমিক নিয়ে আওয়ামী লীগ যে দল গঠন করেছিল, সেটা এক দল নয়। সব দলের সমন্বয়ে এটা ছিল জাতীয় দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জিয়াউর রহমান দরখাস্ত করে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। তাই কাউকে কটাক্ষ করার কোনো অধিকার বিএনপির নেই।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। তবে দুপুরে দলের নেতারা অভিযোগ করেন ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসে তারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষার পর তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শ্রদ্ধা জানানো শেষে দুপুর ১২টার দিকে খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের চেতনা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন, ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক। সেই চেতনা ছিল দেশ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হবে, এ দেশের জনগণ নিজের হাতে ভোট দিয়ে নিজেদের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু বর্তমানে সরকারে যারা আছে তারা এ দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। আজকে দেশে গণতন্ত্র নাই, মানবাধিকার নাই। চলছে ক্ষমতাসীনদেরে লুটপাট, দুর্নীতি।’ বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
শহীদ মিনারে বিদেশি কূটনীতিকদের শ্রদ্ধা ও বাংলায় স্মরণ : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাদের বাংলা ভাষায় স্মরণ করেছে ঢাকায় অবস্থিত বিশে^র বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, মিশন, হাইকমিশন ও কনস্যুলেট।
শহীদ মিনারে বাংলাদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিদেশি কূটনীতিকরা ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডিনের নেতৃতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এ সময় ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ডেলিগেশন প্রধান ও অন্যান্য দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত, মিশনপ্রধান ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
গত সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিটে একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর কূটনীতিকরা শ্রদ্ধা জানান।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে দূতাবাসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘দিনটিতে সেই সব সাহসী বাংলাদেশিকে স্মরণ করা হয়, যারা বাংলা ভাষায় পড়া, লেখা ও কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।’
ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, ‘চার বছর ধরে এখানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত এবং আমি প্রত্যক্ষ করেছি মাতৃভাষার প্রতি দৃঢ় ভালোবাসা।’
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘আমি ডাচ ও ফ্রেঞ্চ জানি। তবে যদি সম্ভব হয়, আমরা সবাই মাতৃভাষায় কথা বলতে পছন্দ করি। আমি বাংলা শিখতে চাই এবং আমি আশা করি সামনের বছর আমি বাংলায় বক্তব্য রাখব।’
ফ্রান্স দূতাবাসের কালচারাল অ্যাটাশে ইয়োহান গিগারেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শিরোনামের গানটি পরিবেশন করেন।
ভারতীয় হাইকমিশনের বার্তায় বলা হয়, ‘আসুন, আমরা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন এবং এই দুই দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের যৌথ অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করি।’ অন্যান্য দূতাবাসের ফেসবুক পেজেও ভাষাশহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং সবাইকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা জানানো হয়।
বাংলাদেশে যেহেতু বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ হতে পারে। ঢাকা সফরে আসা বিদেশি প্রতিনিধিরা সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এমন বার্তাই দিতে চেয়েছেন। এ কারণে আওয়ামী লীগও সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক থেকে রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়েই এগোতে চায়। দলটির পরিকল্পনা হলো, পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে সহশীলতা দেখিয়ে বিএনপির রাজনীতিকে নির্বিষ রাখা। সে কারণে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলের সফরের পরদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সংলাপের প্রসঙ্গটি আসে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেছে, তার মূল বিষয় হলো বিএনপির চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখাই আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য। সরকারবিরোধী এ আন্দোলন দুর্বল করে রাখতে পারলে বিদেশি চাপও সামলে নিতে পারবে ক্ষমতাসীনরা। তাই সরকারি দলের সব মনোযোগ এখন বিএনপির আন্দোলন দুর্বল করে রাখা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক দাবিতে মাঠে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি অবস্থান ও চাপ বিএনপির আন্দোলনের ধরন দেখে ওঠানামা করবে। তাই নির্বাচনের আগে বিএনপির আন্দোলন চাঙ্গা করার মতো কোনো সুযোগ আওয়ামী লীগ দিতে চায় না। তারা আরও বলেন, বিএনপির দাবিগুলো জোরালো নয়। তাদের সাত দফায় জনগণের কথা নেই। আছে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করার কথা। ফলে জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যু না থাকায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন জমবে না ধরে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এর ফলে বিদেশি চাপও দুর্বল হয়ে পড়বে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির অন্যায়-অন্যায্য দাবি যেমন মানা হবে না, তেমনি ভোটের আগে ভোট বানচাল করার যে পরিকল্পনা রয়েছে, বিএনপির সেটাও সহ্য করা হবে না। পেট্রলবোমা, অগ্নিসন্ত্রাস করার কোনো সুযোগ বিএনপিকে দেওয়া হবে না।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সামনে রোজা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং বর্ষাকাল। এ সময়ে কঠোর আন্দোলন করতে গেলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হবে। এভাবে বছরও কেটে যাবে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসবে। এ বিবেচনা থেকে নির্বাচন ডিসেম্বরে করে ফেলারও পরিকল্পনা নিতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা বলেন, সে কারণেই দলের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়ে রাখা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, বিএনপির পক্ষে জনসম্পৃক্ততা ঘটানো সম্ভব হলে শুধু বিদেশিদের চাপ বাড়তে পারে। তা না হলে সরকারের পক্ষেই থাকবে বিদেশিরা। তারা আরও বলেন, বিদেশিদের এমন অবস্থানের বার্তা তারা পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত জানুয়ারিতে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় খাতরা গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করেছেন। এ সময় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। তাদের কেউ বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেননি। এরপর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও সক্রিয় হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কারণ হলো আন্দোলনের নামে সংঘাত-সহিংসতার সুযোগ যাতে বিএনপি ও তাদের সমমনারা না পায়। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের ভাবনা সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারলে বেগতিক অবস্থা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। তা না হলে নিশ্চিন্তেই কাটাতে পারবে সরকারÑ এমন তৃপ্তিও আছে অনেকের ভেতরে। নানা সমালোচনার ভেতরেও বিএনপির কর্মসূচির দিন মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কারণও মাঠের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এ নেতা বলেন, মাঠে থাকার বিষয়ে সমালোচনা আমলে নেবে না দল। ‘পাহারাদার’ হিসেবে আওয়ামী লীগ মাঠে থাকছে, এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চান তারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি সন্ত্রাস-সহিংসতা ও অরাজকতা সৃষ্টি করবে আর আওয়ামী লীগ ও সরকার তা বসে বসে দেখবে? তাহলে বিএনপির কর্মসূচি সারা বছর থাকবে, আওয়ামী লীগ বা অন্য রাজনৈতিক দল কর্মসূচি পালন করবে না? ফলে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পাল্টাপাল্টি হিসেবে দেখা বা বলা কতটুকু প্রাসঙ্গিক।’
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি অবস্থান এখন যেরকম তাতে নির্বাচন পর্যন্ত দেশে স্বাভাবিক ও শান্ত পরিবেশ বজায় রাখতে পারাই বড় চ্যালেঞ্জ তাদের জন্য। তাই বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তবে মাঠে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ সহনশীলতাও দেখাবে। কারণ তাদের লক্ষ্য রাজনীতির মাঠ নিস্তরঙ্গ রাখা। এ কারণে উত্তপ্ত পরিস্থিতি এড়াতে আওয়ামী লীগ নিজেরাও সতর্ক থাকবে। যাতে অন্য কেউ অর্থাৎ দেশি-বিদেশি কেউ সুযোগ নিতে না পারে।
বিদেশিদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার করে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, তারা সরকারের সঙ্গেই আছে, সব পরিস্থিতি ঠিক থাকলে তাদের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে বিদেশি চাপ বাড়বে। জনগণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থাকলে বিদেশিরাও থাকবে না। ফলে বিএনপির চলমান আন্দোলন বেশ সতর্কভাবে মোকাবিলা করা হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে সরকার ও আওয়ামী লীগ। নির্বাচন পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি শান্ত রাখতে নরম ও গরম দুই পন্থা গ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ আছে। ওই সময় তিনি প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে বলেন, বিএনপি তো সংলাপে আসতে চায় না।
আওয়ামী লীগের নেতারা সেদিন সংলাপের সম্ভাবনার কথাও বলেছেন দেশ রূপান্তরকে। এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু করণীয়ও ঠিক করেছেন তারা। কেউ কেউ বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হবে।
এর পরই বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীর জামিন হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া আইনমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে আইনি বাধা নেই। দুটি দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাজা হয়। এরপর তাকে জেলে পাঠানো হয়। দেশের করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না এবং বিদেশে যেতে পারবেন না। এরপর বহুবার আবেদন করেও অসুস্থ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে পারেননি তার স্বজনরা।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, চাপ সৃষ্টিকারী বিদেশি শক্তিগুলো সরকারকে অবহিত করেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না তারা। সরকারে যেই থাকুক তারা সে সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। তবে পরিস্থিতি সংঘাতময় হওয়া যাবে না।
ভাষা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে বিদ্যমান সব ভাষা সংরক্ষণের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের। আমি মনে করি সারা বিশ্বে বিদ্যমান সব ভাষাকে সংরক্ষণ, এর ওপর গবেষণা করা এবং এগুলোর ইতিহাস জানা এ ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব।’
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমরা চাই বিশ্বের বিপন্ন ভাষাগুলো এখানে সংরক্ষণ এবং তার ওপর গবেষণা করা হোক। এ গবেষণার ওপরই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ভাষা সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অনেক অবদান রাখতে পারে। এখানে যে কেউ যেকোনো ভাষা শিখতে চাইলেও আসতে পারবেন। ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।’
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাংলা ভাষাকে হিন্দুর আর উর্দুকে মুসলমানের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে তা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো মন-মানসিকতার অধিকারীদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের মানসিক দৈন্যতায় যারা ভোগেন তাদের জন্যই ভাষার ইতিহাস ও উৎপত্তিস্থল জানা একান্তভাবে দরকার।
এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বিশ্বের ১৬টি ভাষায় বহুভাষী পকেট অভিধান করার ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি মাতৃভাষা পিডিয়া তৈরির প্রকল্প গ্রহণ এবং ভাষা-সাহিত্যকর্ম, বাংলা অনুবাদ ও বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন শীর্ষক প্রামান্য চিত্র বিভিন্ন ভাষায় করার উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ হাসিনা ভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক’ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক পদক’ তুলে দেন।
হাবিবুর রহমান ও রঞ্জিত সিংহকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয় এবং মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মহেন্দ্র কুমার মিশ্র ও মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডাকে আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সোসাইটির পক্ষে এর সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম পদক গ্রহণ করেন।
শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান। আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের অফিসার ইনচার্জ সুসান মারি ভাইজ।
অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার ‘বহুভাষিক বিশ্বে বহুভাষিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’র ওপর আলোকপাত করে একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এর আগে জাতীয় সংগীত এবং অমর একুশের সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ পরিবেশিত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, জাপান, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের শিশুরা প্রধানমন্ত্রীকে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শুভেচ্ছা জানায়।
সরকারপ্রধান তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমি মনে করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার এবং সে জন্য ফান্ড লাগলে আমি তার ব্যবস্থা করে দেব। কারণ আমি সবসময় গবেষণায় বেশি জোর দিই। গবেষণা ছাড়া কোনো বিষয়েই উৎকষর্তা সাধন করা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশের অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে ইংরেজি ভাষাটা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমনভাবে চলে গেছে, শিক্ষা-দীক্ষাসহ সবকিছুতে এ ভাষাই পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে গেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের ভাষা শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। নিজের ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি অন্য যেকোনো এক বা দুটি ভাষা আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখতে পারে। আর এখন ডিজিটাল যুগে ডিজিটালি ও শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি নিউ স্টার্ট স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ভøাদিমির পুতিন। গতকাল মঙ্গলবার তার বার্ষিক স্টেট অব দ্য ন্যাশন ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এ ঘোষণা দিলেন। ওই ভাষণে তিনি যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের দায়ী করে বলেছেন, রাশিয়াকে ধ্বংস করতে বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে চায় তারা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আকস্মিক সফরের পরদিনই পুতিনের এমন ঘোষণা বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ বিষয়ে এখনো যুক্তরাষ্ট্র কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও পুতিনকে বিষয়টি ফের বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে শুধু নিউ স্টার্ট চুক্তিই কার্যকর ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ ২০১০ সালে এ চুক্তিতে সই করেছিলেন। চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া মোট কী পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে, তার সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। তাতে উভয় দেশের সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫০টি দূরপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের সুযোগ ছিল। ২০২১ সালে চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বাড়িয়েছিল সামরিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই দেশ। সে হিসেবে ২০২৬ সাল অবধি মেয়াদ ছিল ওই চুক্তির। তবে পরিস্থিতির বিবেচনায় গতকাল তা বাতিল ঘোষণা করেন পুতিন।
পুতিন তার ভাষণে বলেন, আমি আজ এ ঘোষণা দিতে বাধ্য হলাম যে স্ট্র্যাটেজিক অফেনসিভ আর্মস ট্রিটিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র যদি দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তাহলে রাশিয়ারও পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া দরকার।
রয়টার্স বলছে, পুতিন তার ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ বাড়িয়ে তোলার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক সংঘাতের মঞ্চে মস্কোকে পরাজিত করতে পারবে, এমন একটি ভুল ধারণা নিয়ে তারা এটা করছে।
পশ্চিমাদের বৈশ্বিক সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক করে পুতিন বলেছেন, রাশিয়াকে এ যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের দুঃখ-কষ্ট তিনি অনুধাবন করেন। তিনি বলেন, ইউক্রেনের জনগণ কিয়েভের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও তাদের পশ্চিমা তাঁবেদারদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যারা দেশটিকে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরোপুরি দখল করে আছে।
পশ্চিমা দেশগুলো আঞ্চলিক একটি যুদ্ধকে বৈশ্বিক সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় মন্তব্য করে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, পশ্চিমাদের তৎপরতাকে রাশিয়া ঠিক এভাবেই দেখছে। এর যথাযথ জবাব দেওয়া হবে। কারণ এটা রাশিয়ার অস্তিত্বের বিষয়।
যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজিত করা অসম্ভব বলে মন্তব্য করে পুতিন বলেন, রুশ সমাজকে বিভক্ত করতে পশ্চিমাদের যে চেষ্টা, তার সামনে কখনো নতিস্বীকার করবে না রাশিয়া। আর ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনে বেশিরভাগ রুশ নাগরিকের সমর্থন রয়েছে।
ভাষণে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। পাশাপাশি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়া যেসব বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছে, তা ‘সাবধানে ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার’ মধ্য দিয়ে সমাধান করা হবে।
এদিকে পুতিনের এমন ঘোষণার তাৎক্ষণিক অফিশিয়াল কোনো প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে আসেনি। তবে গ্রিস সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, রাশিয়ার সিদ্ধান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং মস্কো আসলে কী করে তা দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করবে।
অন্যদিকে গতকাল ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জোটটির প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক জায়গায় পরিণত করেছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা এবং ইইউ পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেলের পাশে দাঁড়িয়ে স্টলটেনবার্গ সাংবাদিকদের বলেন, আরও পারমাণবিক অস্ত্র এবং কম অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
পশ্চিমারা রাশিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে বলে পুতিনের অভিযোগের জবাবে স্টলটেনবার্গ বলেন, প্রায় এক বছর আগে মস্কো ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছিল। প্রেসিডেন্ট পুতিনই এ সাম্রাজ্যিক বিজয়ের যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তিনি আরও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এটা আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা এবং পুরো বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হবে। তিনি মস্কোকে চুক্তির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রভৃতি ১০ দফা দাবি জানিয়েছে বিএনপি। অভিন্ন দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট।
গণতন্ত্র মঞ্চ পেশ করেছে ১৪ দফা দাবি। আবার গণফোরামের একাংশ ঘোষণা করেছে ৮ দফা দাবি। সবার দাবি আলোচনার ভিত্তিতে সমন্বয় করে ৭ দফায় প্রকাশ করা হবে। দাবিনামা চলতি মাসের শেষের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। এই ৭ দফাই হবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ‘যৌথ ইশতেহার’। গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা দেশ রূপান্তরকে এ কথা জানিয়েছেন।
‘যৌথ ইশতেহার’-এর বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য বিএনপি-গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আলাদাভাবে তাদের দাবি পেশ করেছে। এসব দাবি পর্যালোচনা করে সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম দফা চূড়ান্ত করে যৌথ ইশতেহার হিসেবে ঘোষণা করা হবে।’
কবে নাগাদ ঘোষণা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজ চলছে। সময় হলেই ঘোষণা করা হবে।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি তাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে যৌথ ইশতেহার চূড়ান্ত করবে। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকরা নিজেদের ফোরামে আলোচনা করব। বিএনপি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করবে। তারপর যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি-গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দফা ছিল ১০টি। গণতন্ত্র মঞ্চের দফা ছিল ১৪টি। ১৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে দফাগুলোর পর্যালোচনা হয়। প্রাথমিকভাবে ন্যূনতম ৭ দফা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মাসের শেষের দিকে যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য বরকতউল্লা বুলু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল ও ৫ বাম দলÑ এই ৩ জোট সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘যুক্ত ঘোষণা’ দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে বর্তমান অবৈধ সরকারকে হঠাতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। শিগগির আলোচনা করে যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হবে।’
বিএনপি-গঠিত লিয়াজোঁ কমিটি ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে যৌথ ইশতেহারে যে দফাগুলো আসতে পারে তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো
এক. বর্তমান অনির্বাচিত ও অবৈধ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য স্বাধীন নিরপেক্ষ ইসি গঠন করতে হবে। নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে, মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, অগণতান্ত্রিক আরপিআর সংশোধন করতে হবে, প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পরিবর্তন আনতে হবে, ইভিএম বাতিল করে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার বাতিল করবে।
দুই. রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে সাংবিধানিক ক্ষমতাকাঠামো এবং রাষ্ট্র পরিচালনার আইনকানুনের ন্যূনতম সংস্কার করতে হবেÑ প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক জবাবদিহিহীন স্বেচ্ছাচারী ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথককরণ ও যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ন্যায়পাল ও সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ইসিসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন করতে হবে।
তিন. বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দন্ডপ্রাপ্ত সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর সাজা বাতিল, হয়রানিমূলক সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং সব রাজনৈতিক কারাবন্দির অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-সহ মৌলিক অধিকার হরণকারী আইন বাতিল করতে হবে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করে আগের সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, খুনের যথাযথ তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশি ব্যবস্থার নামে শ্রমিক আন্দোলনের নেতাকর্মীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সাংবিধানিক অধিকার সভা, সমাবেশ, মিছিল ও মিটিংয়ে কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। নতুন কোনো মামলায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দলীয় পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।
চার. বিগত সময়ে বিদেশে অর্থ পাচার এবং ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, শেয়ার মার্কেট, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতসহ সব খাতে দুর্নীতি ও এর দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করতে কমিশন গঠন করতে হবে। এসবের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাশাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে ব্যবস্থা নিতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রাম-শহরের গরিব ও স্বল্প আয়ের পরিবারের জন্য রেশন ও নগদ অর্থসহায়তার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানিসহ সব সেবার মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের, বিশেষ করে কুইক রেন্টাল প্রকল্পবিষয়ক দায়মুক্তি আইন বাতিল করতে হবে। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; সুলভে গণপরিবহনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসী শ্রমিক ও প্রবাসী বাংলাদেশিদর জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা এবং দেশে হয়রানিমুক্ত সেবা ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ. রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ও বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে বিনিয়োগে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিমালা করতে হবে। ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে, বন্ধ কলকারখানা চালু করতে হবে, শ্রমিক ও শ্রমজীবীর বাঁচার মতো মজুরি ঘোষণা এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণ বাড়াতে ও বেসরকারি খাতে মুনাফার লাগাম টেনে ধরতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডে প্রকৃতি-পরিবেশকে প্রাধান্য দিতে হবে।
ছয়. নারীর অধিকার ও ধর্মীয় অধিকার, সব জাতিগোষ্ঠীর নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
সাত. জাতীয় স্বার্থ, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পররাষ্ট্রনীতিতে সমতা, ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পারস্পরিক স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান করতে হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানের উড়ালপথগুলো দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এগুলো আখ্যা পাচ্ছে ডেঞ্জারাস ফ্লাইওভারের। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে এসব স্থান। বিশেষ করে ছিনতাইকারী ও ভাসমান অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। অন্য কোথাও হত্যা করে লাশ ডাম্পিং করা হয় ফ্লাইওভারে।
গত দশ বছরে অন্তত ৪০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ফ্লাইওভার থেকে। ফ্লাইওভারে নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি ফ্লাইওভারে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা থাকার কথা থাকলেও নেই। এই নিয়ে মহানগর পুলিশ ও সিটি করপোরেশন চিঠি চালাচালি করছে। কিন্তু এখনো অবস্থার বদল হয়নি।
গত মাসেও পুলিশ সদর দপ্তর বলেছে, সবকটি ফ্লাইওভারে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে। সড়কবাতি নিয়মিত জ¦ালানো ও পুলিশ টহল বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, সন্ধ্যার পর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত পুলিশের টহল থাকতে হবে। এই নির্দেশ না মানলে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে পুলিশের বার্তায়।
নগর পরিস্থিতির বিশ্লেষকরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, উড়ালপথগুলোকে ঘিরে সক্রিয় রয়েছে সংঘবদ্ধ একাধিক অপরাধীচক্র। ছিনতাই, খুন এবং বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেলের কারণে ফ্লাইওভারগুলো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা অন্ধকারে ফ্লাইওভারের ওপর গাড়ি পার্কিং করে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে। এদের কারণে রাতে ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল আরোহীরা বিপদে পড়ছেন। আবার ফ্লাইওভারের নিচে ও আশপাশের এলাকায় মাদকের কেনাবেচা চলে।
বেশিরভাগ ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে দোকান, অবৈধ পার্কিং, ফলের দোকান, মাছের হাট বসিয়ে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট। কিছু ফ্লাইওভার যৌনলীলার অবৈধ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। উড়ালপথগুলোতে সিসি ক্যামেরা নেই। থাকে না পুলিশি টহল ব্যবস্থাও। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নিরাপত্তা না বাড়ালে ফ্লাইওভারে যানবাহন ওঠা এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফ্লাইওভারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাতে পুলিশি টহল বাড়ানোর পাশাপাশি উড়ালপথগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সব প্রস্ততি নেওয়া হয়েছে। অপরাধীরা যাতে ফ্লাইওভারগুলো ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য বিশেষ নজর দিতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
একই কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকায় যেসব স্থানে ফ্লাইওভার আছে সেখানে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ফ্লাইওভারগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পুলিশি টহল বাড়াতে সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় দেশ রপান্তরকে বলেন, ফ্লাইওভারে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত পুলিশের টহল রাখতে আমরা কাজ করছি। থানা-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, রাত যত গভীর হয়, ফ্লাইওভারগুলো ততই নীরব হয়ে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা ফ্লাইওভারগুলোতে ছিনতাইসহ নানা অপর্কম করে। ছিনতাইকারীরা মানুষ খুন করতে দ্বিধা করছে না। নিরাপদ জোন মনে করে লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। গত ১০ বছরে প্রায় ৪০টি লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত দুই বছরে ফ্লাইওভারে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে অন্তত বিশ জন মারা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সন্ধ্যার পর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনের সড়কে ও ফ্লাইওভারে ভুতুড়ে অন্ধকার থাকে। সড়কে ও ফ্লাইওভারে অধিকাংশ লাইটপোস্টে বাতি জ¦লে না। রেলক্রসিং পার হয়ে এফডিসির সামনে দিয়ে হাতিরঝিলের শুরু পর্যন্ত এই অবস্থা। মগবাজার, মহাখালী, মৌচাক, বাংলামোটর ফ্লাইওভারের অধিকাংশ ল্যাম্পপোস্টে বাতি না জ্বলায় ভুতুড়ে অবস্থা তৈরি হয়। ভ্রাম্যমাণ মাদকসেবী আর ভাসমান যৌনকর্মীরা তখন সক্রিয় থাকে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। স্থানীয়দের অভিযোগ, ফ্লাইওভারে মাসে ২৫-৩০টি ছিনতাই ঘটছে। বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই থানায় অভিযোগ করেন না। রাতে ফ্লাইওভার বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ছিনতাই হয় অহরহ। পথচারীরা নগদ টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়ান। পুলিশকে অভিযোগ করে কেউ প্রতিকার পায় না। অপরাধীর আনাগোনার পাশাপাশি উচ্ছৃঙ্খল তরুণরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত এসব হয়।
খিলগাঁও উড়ালসেতু রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম উড়ালসেতু। একদিক রাজারবাগকে, অন্যদিক মালিবাগকে এবং তৃতীয় দিকের লুপ মাদারটেক, কদমতলী, বাসাবো এলাকাকে যুক্ত করেছে। এখানে দিনরাত টানা পার্টি থাকে ও মাদকের কেনাবেচা চলে। রাতে ছিনতাইকারী ও ভাসমান যৌনকর্মীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। প্রতিদিন অনেকে ছিনতাইয়ের শিকার হয়।
কুড়িল উড়ালসেতু চারটি লুপের সমন্বয়ে নির্মিত দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন একটি উড়ালপথ। সড়কটি রাত বাড়লে অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। সেখানে মাদকের কেনাবেচা চলে এবং ভাসমান যৌনকর্মীদের আনাগোনা বেড়ে যায়।
পুলিশ-সূত্র জানায়, ফ্লাইওভারগুলোতে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে একট বৈঠক হয়েছে। বৈঠক থেকে মহানগর পুলিশ কমিশনারদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফ্লাইওভারগুলো সিটি করপোরেশনের দেখভাল করার কথা। তারা সে কাজটি করে না। বাধ্য হয়ে পুলিশকে করতে হচ্ছে। তবে পুলিশের টহল থাকে না। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, সব ফ্লাইওভারেই সারা রাত অপরাধ সংঘটিত হয়। থানা পুলিশকে বলা হয়েছে, রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নিয়মিত ফ্লাইওভারে টহল দিতে। তাছাড়া সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। ইতিমধ্যে সেই বার্তা পাঠানো হয়েছে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোতে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র মিজানুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়। ঘটনায়-সংশ্লিষ্ট তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিতে জানায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে মিজানকে খুন করা হয় বিমানবন্দর সড়কের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। পরে তার লাশ মগবাজার ফ্লাইওভারে ফেলে যাওয়া হয়। হাতিরপুল উড়াল সড়কের পাশের ঝিল থেকে আজিজুল ইসলাম মেহেদী নামে এক শিক্ষার্থীর বিকৃত লাশ উদ্ধার হয়। তাকে খুন করে উড়াল সড়কের পাশের ঝিলে ফেলে যাওয়া হয়। এই রকম আরও অনেক ঘটনার তথ্য আমরা পেয়েছি।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফ্লাইওভারগুলোর রক্ষাণাবেক্ষণ আসলেই করা হয় না। কোনো ফ্লাইওভারেই সিসি ক্যামেরা নেই। পুলিশকে আমরা বলেছি, দুই সংস্থার খরচে প্রতিটি ফ্লাইওভারে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। বিষয়টি দুই মেয়র অবগত আছেন। আমরা চেষ্টা করছি ফ্লাইওভারের দেখভাল বাড়াতে। পুলিশি টহল থাকলে এসব স্থানে কোনো অপরাধ হতো না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
বুধবার (২৯ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
হেফাজতে সুলতানার মৃত্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘হঠাৎ করে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আপনি প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের দুর্ঘটনা দেখতে পাবেন।’
‘এই সপ্তাহে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণগুলিতে শিশু নিহত হয়েছে। কারও সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে? আমি মনে করি না এই ধরনের দুর্ঘটনা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট করবে।’
এর আগে, নওগাঁ পৌরসভা-চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানাকে (৩৮) র্যাব-৫ এর একটি টহল দল ২২ মার্চ সকালে কাজে যাওয়ার সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ধরে নিয়ে যায়। হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং তারপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
মোমেন বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে অন্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার নেই।
‘বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। অন্য দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কোনো পাঠের প্রয়োজন নেই।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন খুবই শক্তিশালী।
যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সমস্যা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের গণতন্ত্র খুবই দুর্বল। তাই তারা দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে ওকালতি করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। আমরা এটি সম্পর্কে একই পৃষ্ঠায় আছি। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত এক দশকে ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা ভুয়া ভোটারদের মোকাবিলা করার জন্য ছবিসহ ভোটার আইডি তৈরি করেছি। বিগত ১৪ বছরে নির্বাচন কমিশন হাজার হাজার নির্বাচন পরিচালনা করেছে। তাদের প্রায় সবগুলোই ছিল স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য। এবং ভবিষ্যতেও আমাদের নির্বাচন হবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য।’
মোমেন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন বৈশ্বিক গণমাধ্যমে ‘জাদুকরী’ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্বব্যাপী আমাদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এবং ক্রমাগত উন্নয়নের কারণে, বিশ্বের অনেক দেশ এখন আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।’
তিনি আরও বলেন,‘এই স্বাধীনতা দিবসে এবং রমজানের শুরুতে, আমরা অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছ থেকে অভিনন্দনমূলক চিঠি পেয়েছি।’
মেয়েদের বয়সভিত্তিক দল নিয়ে বাফুফে যতটা তৎপর, সিনিয়র জাতীয় দল নিয়ে ততটাই উদাসীন। আরো একবার দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থার সিদ্ধান্ত সেটাই প্রমাণ করল। অর্থাভাবের অজুহাত দিয়ে সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাফুফে বলেছে, ‘মায়ানমার যাতায়াতের বিমান ভাড়া, ইনস্যুরেন্স ফি, সেখানে থাকা-খাওয়া ও ট্রান্সপোর্টশনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের সংকুলান না হওয়ায় উক্ত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
অলিম্পিক বাছাইয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা আছে ‘বি’ গ্রুপে। স্বাগতিক মায়ানমারের সঙ্গে গ্রুপে আরও আছে ইরান ও মালদ্বীপ। গ্রুপের খেলাগুলো হবে আগামী ৫ থেকে ১১ এপ্রিল।
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে চেয়েছিলাম এই বাছাই পর্বের স্বাগতিক হতে। কিন্তু স্বাগতিক মর্যাদা মায়ানমারকে দেওয়া হয়। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী এখানে অংশ নিতে হলে সব খরচ নিজেদের বহন করতে হবে, যা বহন করার মতো অবস্থায় নেই বাফুফের।’
আবু নাঈম সোহাগ আরও বলেন, ‘আমরা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। সেই সাহায্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপরই আমরা দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
গত সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি সাবিনারা। এই সফর বাতিল হওয়ায় মাঠে নামার অপেক্ষাটা তাদের আরো বাড়ল।
মেয়েদের জাতীয় দল নিয়ে বাফুফের উদাসীনতার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালের এসএ গেমসে মেয়েদের দল পাঠায়নি বাফুফে।
সেবার যুক্তিটা ছিল অদ্ভুত। যেহেতু তখন মেয়েদের জাতীয় দলটি মূলত বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ছিল, তাই শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খারাপ করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে। এই কারণের কথা বলে সেবার এসএ গেমসে দল পাঠায়নি বাফুফে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’