
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবারের এসব সহিংসতায় কমপক্ষে ৩১ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ক্রম ভেঙে জুতা পায়ে বেদিতে ওঠার প্রতিবাদ করায় ছাত্রলীগের হামলায় পাঁচ নেতাকর্মী আহত হওয়ার অভিযোগ করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। ফেনীর সোনাগাজীতে ছাত্রলীগের হামলায় দলের আট কর্মী আহত হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। আর ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে বিএনপি-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া মানিকগঞ্জে শ্রমিক লীগের দুপক্ষের মারামারিতে ১০ জন এবং বগুড়ার ধুনটে মহিলা আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে দুই নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বিস্তারিত চট্টগ্রাম ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে :
চট্টগ্রামে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে মহানগর ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্র ইউনিয়নের পাঁচ নেতাকর্মী আহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলে অস্থায়ী শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি ইমরান চৌধুরী, কোতোয়ালি থানার সাধারণ সম্পাদক এসএম নাবিল, পাহাড়তলী থানার সভাপতি ডেনি বিশ্বাস, সাংগঠনিক সম্পাদক বর্ষা দেবী এবং হালিশহর থানার সহসভাপতি মিজানুর রহমান আরিফ।
ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ইমরান চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, ‘সিরিয়াল ভঙ্গ করে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা বেদিতে জুতা নিয়ে ওঠেন। প্রতিবাদ করায় আমাদের নেতাকর্মীর ওপর কোতোয়ালি থানা ছাত্রলীগ ও দক্ষিণ জেলা যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়।’ তবে এ হামলায় তাদের সংগঠনের কেউ জড়িত নয় বলে দাবি করেন মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর।
সোনাগাজীতে ছাত্রলীগের হামলায় ফুল দিতে পারেনি বিএনপি : ফেনীর সোনাগাজীতে ফুল দিতে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগের হামলায় দলের আট কর্মী আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। গত সোমবার রাতে শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সোনাগাজী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও শহীদ জিয়া মঞ্চের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুর হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার দিকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে রওনা হয়। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছলে ছাত্রলীগের ২০-২৫ জন নেতাকর্মী হঠাৎ লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। তারা পিটিয়ে আমাদের আট কর্মীকে আহত করে। এ ছাড়া ছাত্রলীগের লোকজন আমাদের হাত থেকে ফুলের তোড়া কেড়ে নিয়ে ভেঙে রাস্তায় ফেলে দেয়।’
তবে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রাসেল বলেন, ‘বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে মারামারি হয়েছে। ছাত্রলীগ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত না।’
সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মো. খালেদ হোসেন বলেন, ‘রাতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও বিএনপির নেতাকর্মীরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মুখোমুখি হয়ে যান। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। তাৎক্ষণিক পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং দুপক্ষকে সরিয়ে দেয়।’
মানিকগঞ্জে শ্রমিক লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ : মানিকগঞ্জে শহীদ মিনারের পাদদেশে জেলা শ্রমিক লীগের দুপক্ষে মারামারি হয়েছে। এতে উভয়পক্ষের ১০ জন আহত হয়। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম মহীউদ্দীনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা শেষে ফুল দেওয়ার জন্য শ্রমিক লীগের সভাপতির নাম বলার পর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে জেলা শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল জলিল ও বাবুল সরকারের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই সংঘর্ষ বাধে। জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা ও পুলিশের হস্তক্ষেপে আধা ঘণ্টা পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ ঘটনায় শহীদ বেদিতে ফুল দিতে আসা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে ফুল না দিয়ে অনেকে শহীদ বেদি থেকে চলে যান।
কালীগঞ্জে বিএনপি-ছাত্রলীগ সংঘর্ষ : ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে সরকারি মাহাতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে বিএনপি ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় একটি ককটেলের বিস্ফোরণ হয়। গতকাল সকালে সরকারি মাহাতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ফিরছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। কলেজের গেটের সামনে পৌঁছলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয় তাদের। একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে পথচারীসহ উভয়পক্ষের অন্তত ছয়জন আহত হন। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আহতদের উদ্ধার করে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে ছাত্রলীগকর্মী ইরফান রাজা রুকুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।
কালীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমাদের ছেলেরা দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীরা এসে হামলা চালায়। তারা পরিকল্পিতভাবেই আগে থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে এসেছিল। ফিরে যাওয়ার সময় তারা একা পেয়ে ছাত্রলীগকর্মী ইরফান রাজা রুকুকে কুপিয়ে আহত করে। একটি ককটেল বিস্ফোরণও ঘটানো হয়।’
তবে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পথে পেছন থেকে আমাদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধাওয়া করলে জনতা প্রতিরোধ করে। সে সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ককটেল বিস্ফোরণও ঘটায়। এ ঘটনায় আমাদের ৮-১০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে।’
ধুনটে মহিলা আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ : বগুড়ার ধুনটে মহিলা আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয়েছেন সংগঠনের দুই নেতাকর্মী। গতকাল দুপুর ২টার দিকে উপজেলা পরিষদ সড়কের একটি খাবার হোটেলে সামনে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে সোমবার রাতে দুপক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন চৌকিবাড়ী ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক লিপি আকতার (৩৮) ও মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মী কাউসার জাহান কেয়া (৩০)। লিপিকে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আর কেয়াকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জানা গেছে, উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পপি রানী পোদ্দার ও সাধারণ সম্পাদক সুলতানা জাহানের মধ্যে দলীয় কর্মকা- নিয়ে বিরোধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দুপক্ষের নেতাকর্মীরা পাল্টাপাল্টি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে রাত ১২টা ১ মিনিটে মুজিব চত্বর এলাকায় শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ সময় উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণকালে উভয়পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে। এরই মধ্যে গতকাল দুপুর ২টার দিকে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পক্ষের নেত্রী লিপি আকতার উপজেলা পরিষদ চত্বরে একটি হোটেলে খাবার খেতে বসেন। এ সময় সাধারণ সম্পাদকের পক্ষের কর্মী কাউসার জাহান কেয়া ওই হোটেলে ঢুকে তাকে গালাগাল করতে থাকেন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে মারামারিতে তারা আহত হন।
* প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছে চট্টগ্রাম ব্যুরো এবং সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা
বাংলাদেশে যেহেতু বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ হতে পারে। ঢাকা সফরে আসা বিদেশি প্রতিনিধিরা সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এমন বার্তাই দিতে চেয়েছেন। এ কারণে আওয়ামী লীগও সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক থেকে রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়েই এগোতে চায়। দলটির পরিকল্পনা হলো, পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে সহশীলতা দেখিয়ে বিএনপির রাজনীতিকে নির্বিষ রাখা। সে কারণে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলের সফরের পরদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সংলাপের প্রসঙ্গটি আসে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেছে, তার মূল বিষয় হলো বিএনপির চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখাই আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য। সরকারবিরোধী এ আন্দোলন দুর্বল করে রাখতে পারলে বিদেশি চাপও সামলে নিতে পারবে ক্ষমতাসীনরা। তাই সরকারি দলের সব মনোযোগ এখন বিএনপির আন্দোলন দুর্বল করে রাখা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক দাবিতে মাঠে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি অবস্থান ও চাপ বিএনপির আন্দোলনের ধরন দেখে ওঠানামা করবে। তাই নির্বাচনের আগে বিএনপির আন্দোলন চাঙ্গা করার মতো কোনো সুযোগ আওয়ামী লীগ দিতে চায় না। তারা আরও বলেন, বিএনপির দাবিগুলো জোরালো নয়। তাদের সাত দফায় জনগণের কথা নেই। আছে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করার কথা। ফলে জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যু না থাকায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন জমবে না ধরে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এর ফলে বিদেশি চাপও দুর্বল হয়ে পড়বে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির অন্যায়-অন্যায্য দাবি যেমন মানা হবে না, তেমনি ভোটের আগে ভোট বানচাল করার যে পরিকল্পনা রয়েছে, বিএনপির সেটাও সহ্য করা হবে না। পেট্রলবোমা, অগ্নিসন্ত্রাস করার কোনো সুযোগ বিএনপিকে দেওয়া হবে না।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সামনে রোজা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং বর্ষাকাল। এ সময়ে কঠোর আন্দোলন করতে গেলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হবে। এভাবে বছরও কেটে যাবে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসবে। এ বিবেচনা থেকে নির্বাচন ডিসেম্বরে করে ফেলারও পরিকল্পনা নিতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা বলেন, সে কারণেই দলের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়ে রাখা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, বিএনপির পক্ষে জনসম্পৃক্ততা ঘটানো সম্ভব হলে শুধু বিদেশিদের চাপ বাড়তে পারে। তা না হলে সরকারের পক্ষেই থাকবে বিদেশিরা। তারা আরও বলেন, বিদেশিদের এমন অবস্থানের বার্তা তারা পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত জানুয়ারিতে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় খাতরা গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করেছেন। এ সময় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। তাদের কেউ বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেননি। এরপর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও সক্রিয় হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কারণ হলো আন্দোলনের নামে সংঘাত-সহিংসতার সুযোগ যাতে বিএনপি ও তাদের সমমনারা না পায়। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের ভাবনা সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারলে বেগতিক অবস্থা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। তা না হলে নিশ্চিন্তেই কাটাতে পারবে সরকারÑ এমন তৃপ্তিও আছে অনেকের ভেতরে। নানা সমালোচনার ভেতরেও বিএনপির কর্মসূচির দিন মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কারণও মাঠের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এ নেতা বলেন, মাঠে থাকার বিষয়ে সমালোচনা আমলে নেবে না দল। ‘পাহারাদার’ হিসেবে আওয়ামী লীগ মাঠে থাকছে, এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চান তারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি সন্ত্রাস-সহিংসতা ও অরাজকতা সৃষ্টি করবে আর আওয়ামী লীগ ও সরকার তা বসে বসে দেখবে? তাহলে বিএনপির কর্মসূচি সারা বছর থাকবে, আওয়ামী লীগ বা অন্য রাজনৈতিক দল কর্মসূচি পালন করবে না? ফলে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পাল্টাপাল্টি হিসেবে দেখা বা বলা কতটুকু প্রাসঙ্গিক।’
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি অবস্থান এখন যেরকম তাতে নির্বাচন পর্যন্ত দেশে স্বাভাবিক ও শান্ত পরিবেশ বজায় রাখতে পারাই বড় চ্যালেঞ্জ তাদের জন্য। তাই বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তবে মাঠে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ সহনশীলতাও দেখাবে। কারণ তাদের লক্ষ্য রাজনীতির মাঠ নিস্তরঙ্গ রাখা। এ কারণে উত্তপ্ত পরিস্থিতি এড়াতে আওয়ামী লীগ নিজেরাও সতর্ক থাকবে। যাতে অন্য কেউ অর্থাৎ দেশি-বিদেশি কেউ সুযোগ নিতে না পারে।
বিদেশিদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার করে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, তারা সরকারের সঙ্গেই আছে, সব পরিস্থিতি ঠিক থাকলে তাদের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে বিদেশি চাপ বাড়বে। জনগণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থাকলে বিদেশিরাও থাকবে না। ফলে বিএনপির চলমান আন্দোলন বেশ সতর্কভাবে মোকাবিলা করা হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে সরকার ও আওয়ামী লীগ। নির্বাচন পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি শান্ত রাখতে নরম ও গরম দুই পন্থা গ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ আছে। ওই সময় তিনি প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে বলেন, বিএনপি তো সংলাপে আসতে চায় না।
আওয়ামী লীগের নেতারা সেদিন সংলাপের সম্ভাবনার কথাও বলেছেন দেশ রূপান্তরকে। এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু করণীয়ও ঠিক করেছেন তারা। কেউ কেউ বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হবে।
এর পরই বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীর জামিন হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া আইনমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে আইনি বাধা নেই। দুটি দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাজা হয়। এরপর তাকে জেলে পাঠানো হয়। দেশের করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না এবং বিদেশে যেতে পারবেন না। এরপর বহুবার আবেদন করেও অসুস্থ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে পারেননি তার স্বজনরা।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, চাপ সৃষ্টিকারী বিদেশি শক্তিগুলো সরকারকে অবহিত করেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না তারা। সরকারে যেই থাকুক তারা সে সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। তবে পরিস্থিতি সংঘাতময় হওয়া যাবে না।
ভাষা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে বিদ্যমান সব ভাষা সংরক্ষণের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের। আমি মনে করি সারা বিশ্বে বিদ্যমান সব ভাষাকে সংরক্ষণ, এর ওপর গবেষণা করা এবং এগুলোর ইতিহাস জানা এ ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব।’
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমরা চাই বিশ্বের বিপন্ন ভাষাগুলো এখানে সংরক্ষণ এবং তার ওপর গবেষণা করা হোক। এ গবেষণার ওপরই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ভাষা সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অনেক অবদান রাখতে পারে। এখানে যে কেউ যেকোনো ভাষা শিখতে চাইলেও আসতে পারবেন। ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।’
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাংলা ভাষাকে হিন্দুর আর উর্দুকে মুসলমানের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে তা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো মন-মানসিকতার অধিকারীদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের মানসিক দৈন্যতায় যারা ভোগেন তাদের জন্যই ভাষার ইতিহাস ও উৎপত্তিস্থল জানা একান্তভাবে দরকার।
এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বিশ্বের ১৬টি ভাষায় বহুভাষী পকেট অভিধান করার ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি মাতৃভাষা পিডিয়া তৈরির প্রকল্প গ্রহণ এবং ভাষা-সাহিত্যকর্ম, বাংলা অনুবাদ ও বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন শীর্ষক প্রামান্য চিত্র বিভিন্ন ভাষায় করার উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ হাসিনা ভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক’ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক পদক’ তুলে দেন।
হাবিবুর রহমান ও রঞ্জিত সিংহকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয় এবং মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মহেন্দ্র কুমার মিশ্র ও মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডাকে আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সোসাইটির পক্ষে এর সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম পদক গ্রহণ করেন।
শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান। আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের অফিসার ইনচার্জ সুসান মারি ভাইজ।
অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার ‘বহুভাষিক বিশ্বে বহুভাষিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’র ওপর আলোকপাত করে একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এর আগে জাতীয় সংগীত এবং অমর একুশের সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ পরিবেশিত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, জাপান, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের শিশুরা প্রধানমন্ত্রীকে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শুভেচ্ছা জানায়।
সরকারপ্রধান তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমি মনে করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার এবং সে জন্য ফান্ড লাগলে আমি তার ব্যবস্থা করে দেব। কারণ আমি সবসময় গবেষণায় বেশি জোর দিই। গবেষণা ছাড়া কোনো বিষয়েই উৎকষর্তা সাধন করা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশের অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে ইংরেজি ভাষাটা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমনভাবে চলে গেছে, শিক্ষা-দীক্ষাসহ সবকিছুতে এ ভাষাই পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে গেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের ভাষা শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। নিজের ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি অন্য যেকোনো এক বা দুটি ভাষা আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখতে পারে। আর এখন ডিজিটাল যুগে ডিজিটালি ও শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি নিউ স্টার্ট স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ভøাদিমির পুতিন। গতকাল মঙ্গলবার তার বার্ষিক স্টেট অব দ্য ন্যাশন ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এ ঘোষণা দিলেন। ওই ভাষণে তিনি যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের দায়ী করে বলেছেন, রাশিয়াকে ধ্বংস করতে বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে চায় তারা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আকস্মিক সফরের পরদিনই পুতিনের এমন ঘোষণা বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ বিষয়ে এখনো যুক্তরাষ্ট্র কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও পুতিনকে বিষয়টি ফের বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে শুধু নিউ স্টার্ট চুক্তিই কার্যকর ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ ২০১০ সালে এ চুক্তিতে সই করেছিলেন। চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া মোট কী পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে, তার সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। তাতে উভয় দেশের সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫০টি দূরপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের সুযোগ ছিল। ২০২১ সালে চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বাড়িয়েছিল সামরিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই দেশ। সে হিসেবে ২০২৬ সাল অবধি মেয়াদ ছিল ওই চুক্তির। তবে পরিস্থিতির বিবেচনায় গতকাল তা বাতিল ঘোষণা করেন পুতিন।
পুতিন তার ভাষণে বলেন, আমি আজ এ ঘোষণা দিতে বাধ্য হলাম যে স্ট্র্যাটেজিক অফেনসিভ আর্মস ট্রিটিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র যদি দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তাহলে রাশিয়ারও পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া দরকার।
রয়টার্স বলছে, পুতিন তার ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ বাড়িয়ে তোলার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক সংঘাতের মঞ্চে মস্কোকে পরাজিত করতে পারবে, এমন একটি ভুল ধারণা নিয়ে তারা এটা করছে।
পশ্চিমাদের বৈশ্বিক সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক করে পুতিন বলেছেন, রাশিয়াকে এ যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের দুঃখ-কষ্ট তিনি অনুধাবন করেন। তিনি বলেন, ইউক্রেনের জনগণ কিয়েভের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও তাদের পশ্চিমা তাঁবেদারদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যারা দেশটিকে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরোপুরি দখল করে আছে।
পশ্চিমা দেশগুলো আঞ্চলিক একটি যুদ্ধকে বৈশ্বিক সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় মন্তব্য করে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, পশ্চিমাদের তৎপরতাকে রাশিয়া ঠিক এভাবেই দেখছে। এর যথাযথ জবাব দেওয়া হবে। কারণ এটা রাশিয়ার অস্তিত্বের বিষয়।
যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজিত করা অসম্ভব বলে মন্তব্য করে পুতিন বলেন, রুশ সমাজকে বিভক্ত করতে পশ্চিমাদের যে চেষ্টা, তার সামনে কখনো নতিস্বীকার করবে না রাশিয়া। আর ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনে বেশিরভাগ রুশ নাগরিকের সমর্থন রয়েছে।
ভাষণে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। পাশাপাশি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়া যেসব বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছে, তা ‘সাবধানে ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার’ মধ্য দিয়ে সমাধান করা হবে।
এদিকে পুতিনের এমন ঘোষণার তাৎক্ষণিক অফিশিয়াল কোনো প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে আসেনি। তবে গ্রিস সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, রাশিয়ার সিদ্ধান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং মস্কো আসলে কী করে তা দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করবে।
অন্যদিকে গতকাল ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জোটটির প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক জায়গায় পরিণত করেছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা এবং ইইউ পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেলের পাশে দাঁড়িয়ে স্টলটেনবার্গ সাংবাদিকদের বলেন, আরও পারমাণবিক অস্ত্র এবং কম অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
পশ্চিমারা রাশিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে বলে পুতিনের অভিযোগের জবাবে স্টলটেনবার্গ বলেন, প্রায় এক বছর আগে মস্কো ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছিল। প্রেসিডেন্ট পুতিনই এ সাম্রাজ্যিক বিজয়ের যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তিনি আরও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এটা আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা এবং পুরো বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হবে। তিনি মস্কোকে চুক্তির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রভৃতি ১০ দফা দাবি জানিয়েছে বিএনপি। অভিন্ন দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট।
গণতন্ত্র মঞ্চ পেশ করেছে ১৪ দফা দাবি। আবার গণফোরামের একাংশ ঘোষণা করেছে ৮ দফা দাবি। সবার দাবি আলোচনার ভিত্তিতে সমন্বয় করে ৭ দফায় প্রকাশ করা হবে। দাবিনামা চলতি মাসের শেষের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। এই ৭ দফাই হবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ‘যৌথ ইশতেহার’। গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা দেশ রূপান্তরকে এ কথা জানিয়েছেন।
‘যৌথ ইশতেহার’-এর বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য বিএনপি-গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আলাদাভাবে তাদের দাবি পেশ করেছে। এসব দাবি পর্যালোচনা করে সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম দফা চূড়ান্ত করে যৌথ ইশতেহার হিসেবে ঘোষণা করা হবে।’
কবে নাগাদ ঘোষণা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজ চলছে। সময় হলেই ঘোষণা করা হবে।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি তাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে যৌথ ইশতেহার চূড়ান্ত করবে। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকরা নিজেদের ফোরামে আলোচনা করব। বিএনপি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করবে। তারপর যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি-গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দফা ছিল ১০টি। গণতন্ত্র মঞ্চের দফা ছিল ১৪টি। ১৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে দফাগুলোর পর্যালোচনা হয়। প্রাথমিকভাবে ন্যূনতম ৭ দফা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মাসের শেষের দিকে যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য বরকতউল্লা বুলু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল ও ৫ বাম দলÑ এই ৩ জোট সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘যুক্ত ঘোষণা’ দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে বর্তমান অবৈধ সরকারকে হঠাতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। শিগগির আলোচনা করে যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হবে।’
বিএনপি-গঠিত লিয়াজোঁ কমিটি ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে যৌথ ইশতেহারে যে দফাগুলো আসতে পারে তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো
এক. বর্তমান অনির্বাচিত ও অবৈধ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য স্বাধীন নিরপেক্ষ ইসি গঠন করতে হবে। নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে, মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, অগণতান্ত্রিক আরপিআর সংশোধন করতে হবে, প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পরিবর্তন আনতে হবে, ইভিএম বাতিল করে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার বাতিল করবে।
দুই. রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে সাংবিধানিক ক্ষমতাকাঠামো এবং রাষ্ট্র পরিচালনার আইনকানুনের ন্যূনতম সংস্কার করতে হবেÑ প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক জবাবদিহিহীন স্বেচ্ছাচারী ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথককরণ ও যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ন্যায়পাল ও সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ইসিসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন করতে হবে।
তিন. বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দন্ডপ্রাপ্ত সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর সাজা বাতিল, হয়রানিমূলক সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং সব রাজনৈতিক কারাবন্দির অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-সহ মৌলিক অধিকার হরণকারী আইন বাতিল করতে হবে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করে আগের সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, খুনের যথাযথ তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশি ব্যবস্থার নামে শ্রমিক আন্দোলনের নেতাকর্মীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সাংবিধানিক অধিকার সভা, সমাবেশ, মিছিল ও মিটিংয়ে কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। নতুন কোনো মামলায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দলীয় পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।
চার. বিগত সময়ে বিদেশে অর্থ পাচার এবং ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, শেয়ার মার্কেট, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতসহ সব খাতে দুর্নীতি ও এর দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করতে কমিশন গঠন করতে হবে। এসবের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাশাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে ব্যবস্থা নিতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রাম-শহরের গরিব ও স্বল্প আয়ের পরিবারের জন্য রেশন ও নগদ অর্থসহায়তার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানিসহ সব সেবার মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের, বিশেষ করে কুইক রেন্টাল প্রকল্পবিষয়ক দায়মুক্তি আইন বাতিল করতে হবে। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; সুলভে গণপরিবহনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসী শ্রমিক ও প্রবাসী বাংলাদেশিদর জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা এবং দেশে হয়রানিমুক্ত সেবা ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ. রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ও বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে বিনিয়োগে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিমালা করতে হবে। ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে, বন্ধ কলকারখানা চালু করতে হবে, শ্রমিক ও শ্রমজীবীর বাঁচার মতো মজুরি ঘোষণা এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণ বাড়াতে ও বেসরকারি খাতে মুনাফার লাগাম টেনে ধরতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডে প্রকৃতি-পরিবেশকে প্রাধান্য দিতে হবে।
ছয়. নারীর অধিকার ও ধর্মীয় অধিকার, সব জাতিগোষ্ঠীর নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
সাত. জাতীয় স্বার্থ, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পররাষ্ট্রনীতিতে সমতা, ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পারস্পরিক স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান করতে হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানের উড়ালপথগুলো দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এগুলো আখ্যা পাচ্ছে ডেঞ্জারাস ফ্লাইওভারের। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে এসব স্থান। বিশেষ করে ছিনতাইকারী ও ভাসমান অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। অন্য কোথাও হত্যা করে লাশ ডাম্পিং করা হয় ফ্লাইওভারে।
গত দশ বছরে অন্তত ৪০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ফ্লাইওভার থেকে। ফ্লাইওভারে নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি ফ্লাইওভারে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা থাকার কথা থাকলেও নেই। এই নিয়ে মহানগর পুলিশ ও সিটি করপোরেশন চিঠি চালাচালি করছে। কিন্তু এখনো অবস্থার বদল হয়নি।
গত মাসেও পুলিশ সদর দপ্তর বলেছে, সবকটি ফ্লাইওভারে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে। সড়কবাতি নিয়মিত জ¦ালানো ও পুলিশ টহল বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, সন্ধ্যার পর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত পুলিশের টহল থাকতে হবে। এই নির্দেশ না মানলে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে পুলিশের বার্তায়।
নগর পরিস্থিতির বিশ্লেষকরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, উড়ালপথগুলোকে ঘিরে সক্রিয় রয়েছে সংঘবদ্ধ একাধিক অপরাধীচক্র। ছিনতাই, খুন এবং বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেলের কারণে ফ্লাইওভারগুলো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা অন্ধকারে ফ্লাইওভারের ওপর গাড়ি পার্কিং করে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে। এদের কারণে রাতে ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল আরোহীরা বিপদে পড়ছেন। আবার ফ্লাইওভারের নিচে ও আশপাশের এলাকায় মাদকের কেনাবেচা চলে।
বেশিরভাগ ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে দোকান, অবৈধ পার্কিং, ফলের দোকান, মাছের হাট বসিয়ে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট। কিছু ফ্লাইওভার যৌনলীলার অবৈধ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। উড়ালপথগুলোতে সিসি ক্যামেরা নেই। থাকে না পুলিশি টহল ব্যবস্থাও। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নিরাপত্তা না বাড়ালে ফ্লাইওভারে যানবাহন ওঠা এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফ্লাইওভারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাতে পুলিশি টহল বাড়ানোর পাশাপাশি উড়ালপথগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সব প্রস্ততি নেওয়া হয়েছে। অপরাধীরা যাতে ফ্লাইওভারগুলো ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য বিশেষ নজর দিতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
একই কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকায় যেসব স্থানে ফ্লাইওভার আছে সেখানে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ফ্লাইওভারগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পুলিশি টহল বাড়াতে সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় দেশ রপান্তরকে বলেন, ফ্লাইওভারে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত পুলিশের টহল রাখতে আমরা কাজ করছি। থানা-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, রাত যত গভীর হয়, ফ্লাইওভারগুলো ততই নীরব হয়ে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা ফ্লাইওভারগুলোতে ছিনতাইসহ নানা অপর্কম করে। ছিনতাইকারীরা মানুষ খুন করতে দ্বিধা করছে না। নিরাপদ জোন মনে করে লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। গত ১০ বছরে প্রায় ৪০টি লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত দুই বছরে ফ্লাইওভারে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে অন্তত বিশ জন মারা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সন্ধ্যার পর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনের সড়কে ও ফ্লাইওভারে ভুতুড়ে অন্ধকার থাকে। সড়কে ও ফ্লাইওভারে অধিকাংশ লাইটপোস্টে বাতি জ¦লে না। রেলক্রসিং পার হয়ে এফডিসির সামনে দিয়ে হাতিরঝিলের শুরু পর্যন্ত এই অবস্থা। মগবাজার, মহাখালী, মৌচাক, বাংলামোটর ফ্লাইওভারের অধিকাংশ ল্যাম্পপোস্টে বাতি না জ্বলায় ভুতুড়ে অবস্থা তৈরি হয়। ভ্রাম্যমাণ মাদকসেবী আর ভাসমান যৌনকর্মীরা তখন সক্রিয় থাকে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। স্থানীয়দের অভিযোগ, ফ্লাইওভারে মাসে ২৫-৩০টি ছিনতাই ঘটছে। বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই থানায় অভিযোগ করেন না। রাতে ফ্লাইওভার বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ছিনতাই হয় অহরহ। পথচারীরা নগদ টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়ান। পুলিশকে অভিযোগ করে কেউ প্রতিকার পায় না। অপরাধীর আনাগোনার পাশাপাশি উচ্ছৃঙ্খল তরুণরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত এসব হয়।
খিলগাঁও উড়ালসেতু রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম উড়ালসেতু। একদিক রাজারবাগকে, অন্যদিক মালিবাগকে এবং তৃতীয় দিকের লুপ মাদারটেক, কদমতলী, বাসাবো এলাকাকে যুক্ত করেছে। এখানে দিনরাত টানা পার্টি থাকে ও মাদকের কেনাবেচা চলে। রাতে ছিনতাইকারী ও ভাসমান যৌনকর্মীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। প্রতিদিন অনেকে ছিনতাইয়ের শিকার হয়।
কুড়িল উড়ালসেতু চারটি লুপের সমন্বয়ে নির্মিত দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন একটি উড়ালপথ। সড়কটি রাত বাড়লে অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। সেখানে মাদকের কেনাবেচা চলে এবং ভাসমান যৌনকর্মীদের আনাগোনা বেড়ে যায়।
পুলিশ-সূত্র জানায়, ফ্লাইওভারগুলোতে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে একট বৈঠক হয়েছে। বৈঠক থেকে মহানগর পুলিশ কমিশনারদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফ্লাইওভারগুলো সিটি করপোরেশনের দেখভাল করার কথা। তারা সে কাজটি করে না। বাধ্য হয়ে পুলিশকে করতে হচ্ছে। তবে পুলিশের টহল থাকে না। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, সব ফ্লাইওভারেই সারা রাত অপরাধ সংঘটিত হয়। থানা পুলিশকে বলা হয়েছে, রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নিয়মিত ফ্লাইওভারে টহল দিতে। তাছাড়া সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। ইতিমধ্যে সেই বার্তা পাঠানো হয়েছে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোতে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র মিজানুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়। ঘটনায়-সংশ্লিষ্ট তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিতে জানায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে মিজানকে খুন করা হয় বিমানবন্দর সড়কের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। পরে তার লাশ মগবাজার ফ্লাইওভারে ফেলে যাওয়া হয়। হাতিরপুল উড়াল সড়কের পাশের ঝিল থেকে আজিজুল ইসলাম মেহেদী নামে এক শিক্ষার্থীর বিকৃত লাশ উদ্ধার হয়। তাকে খুন করে উড়াল সড়কের পাশের ঝিলে ফেলে যাওয়া হয়। এই রকম আরও অনেক ঘটনার তথ্য আমরা পেয়েছি।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফ্লাইওভারগুলোর রক্ষাণাবেক্ষণ আসলেই করা হয় না। কোনো ফ্লাইওভারেই সিসি ক্যামেরা নেই। পুলিশকে আমরা বলেছি, দুই সংস্থার খরচে প্রতিটি ফ্লাইওভারে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। বিষয়টি দুই মেয়র অবগত আছেন। আমরা চেষ্টা করছি ফ্লাইওভারের দেখভাল বাড়াতে। পুলিশি টহল থাকলে এসব স্থানে কোনো অপরাধ হতো না।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।