
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি নিউ স্টার্ট স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ভøাদিমির পুতিন। গত মঙ্গলবার পুতিনের এ ঘোষণার পরই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা পুতিনের এ ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আশঙ্কা করেছে পারমাণবিক যুদ্ধের। যদিও পোল্যান্ডে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, পুতিন এখনো পশ্চিমাদের দৃঢ়তা বুঝতে পারেননি। তিনি চুক্তি স্থগিত করে কত বড় ভুল করেছেন সে বিষয়েও কোনো ধারণা নেই তার।
গতকাল বুধবার পোল্যান্ড সফরের দ্বিতীয় দিনে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন বাইডেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে পুতিন বিরাট ভুল করেছেন। আর গত মঙ্গলবার বাইডেন বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে গেলে পশ্চিমাদের শক্তি কমে আসবে বলে মনে করছেন মস্কোর নেতারা। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এখনো পশ্চিমাদের দৃঢ়তা বুঝতে পারেননি।
পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে দেওয়া ভাষণে বাইডেন বলেন, ‘(ভেঙে যাওয়া) একটি সাম্রাজ্য পুনর্গঠনে একজন স্বৈরশাসকের অভিলাষ কখনই স্বাধীনতার প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে কমিয়ে দিতে পারবে না। বর্বরতা কখনই স্বাধীন মানুষের ইচ্ছাকে দমিয়ে দিতে পারবে না। ইউক্রেন কখনই রাশিয়ার কাছে বিজয় রূপে আসবে না।’
তিনি বলেন, তিনি (পুতিন) মনে করেছিলেন, তার মতো স্বৈরশাসকরা কঠোর হন, আর গণতন্ত্রের নেতারা নরম হন। তবে এরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ়সংকল্পের মুখোমুখি হলেন। আর সারা বিশ্বে এমন সব দেশের সামনে পড়লেন, যারা ভয়ের মাধ্যমে শাসিত বিশ্বব্যবস্থা মেনে নিল না। এ সময় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো নিয়ে বাইডেন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় এক বছর পর এসে ন্যাটো এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি একতাবদ্ধ। ভাষণে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদেশগুলো রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে বলেও জানান বাইডেন।
ওইদিন তিনি কিয়েভ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, প্রায় এক বছর আগে আমি এখানে এসেছিলাম। এক বছর আগে মানুষের প্রশ্ন ছিল, কিয়েভের পতন নিয়ে। কিন্তু আমি কিয়েভ ঘুরে আসছি। আমি আপনাদের জানাচ্ছি, কিয়েভ শক্ত হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিয়েভ গর্বিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা কিয়েভ স্বাধীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
বাইডেন বলেন, সামনে আরও কঠিন ও তিক্ত দিন আসছে। আমেরিকা ও ইউরোপ আগামী দিনেও একইরকমভাবে ইউক্রেনের পাশে থাকবে।
প্রতি অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক পরিশোধ করে মাত্র ১১০টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান বদলালেও সংখ্যাটি বেশ কয়েক বছর ধরে একই আছে। অথচ এখন অনলাইনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩ লাখ। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এনবিআরে ভ্যাট-নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত লাখ।
প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে বাজেটের জোগান বাড়ানোর চাপ। ভ্যাট বা মূসক খাতে লক্ষ্যমাত্রা থাকে সবচেয়ে বেশি। ভ্যাট বা মূসক সরাসরি ভোক্তার কাছ থেকে কড়ায়গ-ায় আদায় করা হয়। আদায় করা হলেও ভ্যাট-ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীরা সরকারি কোষাগারে জমা দেয় সামান্যই বা একেবারেই দেয় না। তারা নিজের পকেট ভরে। যারা নিয়মিত ভ্যাট দেয় শেষ পর্যন্ত সেই ১১০ প্রতিষ্ঠানই গড়ে মোট লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক পরিশোধ করে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রায় প্রতি বছর ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। ভ্যাট আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগ পরিশোধ করে বড় মাপের প্রতিষ্ঠানগুলো। যারা নিয়মিত ভ্যাট দেয় তাদের ওপরই বাড়তি ভ্যাট পরিশোধের চাপ বাড়ে। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হলে ভ্যাট প্রদানে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাড়বে। এতে নিয়মিত ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ কমলেও মোট আদায় বাড়বে।
গত অর্থবছরে মোট আদায়কৃত ভ্যাট ১ লাখ ৩০০ কোটি টাকা। ১১০টি প্রতিষ্ঠান আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৫৩ শতাংশ পরিশোধ করেছে, যার পরিমাণ ৫২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ভ্যাটের অর্ধেকের বেশি এসেছে সিগারেট খাত থেকেÑ ২৭ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হিসাব কষে ভ্যাট নেয় এনবিআরের এলটিইউ (ভ্যাট) শাখা। পর পর তিন বছরের যে কোনো এক বছর বার্র্ষিক লেনদেন ১০ কোটি টাকার কম হলে এখানকার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। এ দপ্তরের আওতায় দুইশর বেশি প্রতিষ্ঠান থাকলেও গত দশ বছরে কিছু প্রতিষ্ঠানের লেনদেন ১০ কোটি টাকার কম হওয়ায় তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার বার্ষিক লেনদেন ১০ কোটির বেশি হওয়ায় নতুন করে কিছু প্রতিষ্ঠান যুক্তও হয়েছে। যোগ-বিয়োগের পর গত চার বছর ধরে এদিক-ওদিক করে ১১০টি প্রতিষ্ঠানই ভ্যাটদাতার তালিকায় রয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরেও ১১০টি প্রতিষ্ঠান আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৫২ শতাংশ দিয়েছে, যার পরিমাণ ৪৮ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। সে বছর ভ্যাট খাতে আদায় হয়েছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ৮৪ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। ১১০টি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে ৪২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৫০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভ্যাট আদায় হয়েছে আগের বছরের মতো।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বড় মাপের ১১০টি প্রতিষ্ঠান আদায়কৃত ভ্যাটের ৫৫ শতাংশ দিয়েছিল। তারা দিয়েছিল ৪৫ হাজার ২০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
গত চার অর্থবছরের প্রতি বছরই বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত ভ্যাটের ৫০ শতাংশ ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো লিমিটেড কোম্পানি (বিএটিবি) একাই পরিশোধ করেছে।
বিএটিবি ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, ২০১৯-২০-এ ২০ হাজার ৭৬৬ কোটি, ২০১৮-১৯-এ ১৯ হাজার ৬৯৬ কোটি এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকার ভ্যাট দিয়েছে।
গত অর্থবছরে ভ্যাটপ্রদানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিল যথাক্রমে মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি। আগের অর্থবছরও এই দুই প্রতিষ্ঠান একই অবস্থানে ছিল। গত অর্থবছরে গ্রামীণফোন দিয়েছে ৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এই ১১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে সিমেন্ট খাতের শাহ সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, সেভেন রিং সিমেন্ট; ওষুধ খাতের স্কয়ার, বেক্সিমকো, ইনসেপটা; ব্যাংক খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও আরএকে সিরামিকস প্রভৃতি।
সম্প্রতি এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করে গত অর্থবছরের সেরা ভ্যাটদাতা হিসেবে ৯ প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করেছে। উৎপাদন খাতে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট দিয়ে এনবিআরের তালিকায় আছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ও এসএমসি এন্টারপ্রাইজ। ব্যবসায়-শ্রেণিতে আছে ওয়ালটন, আগোরা লিমিটেড ও ইউনিমার্ট লিমিটেড। সেবা-শ্রেণিতে তিন সেরা ভ্যাটদাতা হলো বিকাশ লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক ও নগদ লিমিটেড।
গত চার অর্থবছর সিগারেট, মুঠোফোন, ওষুধ, ব্যাংক, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিতরণ, কোমল পানীয়, সাবান, সিমেন্ট ও পানি সরবরাহকারীÑ এই ১০ খাত থেকে এলটিইউ বেশির ভাগ ভ্যাট আদায় করেছে।
এনবিআর অনলাইনে ভ্যাট-নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে। অনলাইন ভ্যাট-নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। এর আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভ্যাট-নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখ। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তৃতাকালে দাবি করেছিলেন, দেশে ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০ লাখ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, এনবিআরের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। আরও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও লোকবলের স্বল্পতার কারণে তারা ভ্যাট ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে পারছে না।
এনবিআর সদস্য (মূসক মূল্যায়ন ও কার্যকর করা) মইনুল খান বলেন, ভ্যাট ফাঁকিবাজদের চিহ্নিত করতে এনবিআর জরিপ শুরু করেছে। আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে এরই মধ্যে সারা দেশের বিক্রয়কেন্দ্রে ইএফডি যন্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। গত নভেম্বরে ইএফডির মাধ্যমে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৩২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৮৩০টি ইএফডি যন্ত্র বসানো হয়েছে। প্রথম ধাপে তিন লাখ ইএফডি যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে ইএফডি যন্ত্রের মাধ্যমে ভ্যাট আদায় করা হবে।
ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে ইএফডি (ইলেকট্রিক ফিসক্যাল ডিভাইস) ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। প্রাথমিকভাবে আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান, মিষ্টির দোকান, আসবাবপত্র বিক্রয়কেন্দ্র, পোশাক বিক্রয়কেন্দ্র, বুটিক শপ, বিউটি পার্লার, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, মোবাইল ও মোবাইলের যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকান, গৃহস্থালি সামগ্রী বিক্রয়কেন্দ্র, অলংকার বিক্রিয়কেন্দ্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, ইএফডি সরবরাহে একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইএফডি সরবরাহের ধীরগতি রয়েছে। এ যন্ত্র কাউকে দেওয়া হচ্ছে আর কাউকে দেওয়া হচ্ছে না। আমার পরামর্শ, এই কাজে একাধিক কোম্পানিকে কাজে লাগানো হোক। তাহলে ইএফডি দ্রুত সরবরাহ করা যাবে। রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
মিরপুরের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকার সঙ্গে রাজশাহীর এক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে বিয়ে হয় ২০১১ সালে। তাদের এক কন্যাসন্তান। টানাপড়েনের জেরে ২০১৮ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজতের অধিকার পেতে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন শিশুর মা।
মামলার সময় শিশুর বয়স ছিল পাঁচ বছর। একই দাবিতে শিশুর বাবা ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর রাজশাহী পারিবারিক আদালতে পাল্টা মামলা করেন। বাবা-মায়ের মামলার জেরে বিপাকে পড়ে ওই শিশু। আদালত সন্তানকে বাবার হেফাজতে দিলেও মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার এবং সন্তানকে দেখভাল করার আদেশও ছিল। সন্তানকে একান্তে পাওয়ার জন্য ২০২১ সালের মার্চে হাইকোর্টে রিট করেন মা। হাইকোর্ট ঢাকার মামলাটি অবিলম্বে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে বাবার পক্ষের আইনজীবীরা ঢাকার মামলা রাজশাহীতে বদলি চেয়ে রিট করলে গত বছর মার্চে ওই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে বদলি প্রশ্নে রুল দেয় হাইকোর্ট। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, রুলটি এখনো বিচারাধীন। এর মধ্যে শিশুটির বয়স হয়েছে আট বছর।
সন্তানের অভিভাবকত্ব কিংবা হেফাজত পাওয়ার এমন অনেক মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পারিবারিক আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭৬ হাজার ৪৮৮।
বেসরকারি সংস্থা ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ফ্লাড) হিসাবে প্রতি কর্মদিবসে ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালতের একটিতে ৯০ থেকে ৯৮টি, একটিতে ১০০ থেকে ১১২টি এবং একটিতে ৮০ থেকে ৮৫টি মামলার শুনানি হয়। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মামলার শুনানি হয় সন্তান নিয়ে।
ভূমিবিরোধবিষয়ক মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা প্রায়ই বলেন, দেওয়ানি মামলার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। পারিবারিক আদালতের মামলা নিয়েও আইনজীবীদের মুখে এমন হতাশার কথা শোনা যায়। অধস্তন পারিবারিক আদালত থেকে হাইকোর্ট, হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগ; এরপর আদালতের আদেশ পালনে অনীহা প্রভৃতির আরজি নিয়ে আবারও অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালত এভাবে মামলা চলতেই থাকে। সন্তান বড় হতে থাকে, কিন্তু বাবা-মায়ের মামলা শেষ হয় না।
অনেক ক্ষেত্রে আদালত কিংবা আইনজীবীদের আপস-মীমাংসার পরামর্শ থাকলেও আবেগের কাছে তা ঠুনকো হয়ে যায়। কোনো কোনো বাবা-মায়ের ইগো বা অহং অর্থাৎ ছাড় না দেওয়ার মানসিকতার কাছে পরাস্ত হয় সব যুক্তি বা আইন। ফলে ব্যাঘাত ঘটে শিশুর মানসিক ও অন্যান্য বিকাশে। হাইকোর্ট প্রায় দুই বছর আগে পারিবারিক আদালতে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে করা মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিলেও তার প্রায় কিছুই প্রতিপালিত হয়নি।
প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লিখিত মামলায় শিশুর বাবাকে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘মামলাজটের কারণে পারিবারিক আদালতের মামলা এখন অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আদালত আদেশ দিলেও কিছুদিনের মধ্যেই কোনো কোনো অভিযোগে আবারও আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় এসব মামলার সমাধান পাওয়াই যায় না। সন্তানসম্পর্কিত আবেগের বিষয়ে আদালতও কঠোর হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘অসংখ্য শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। এখনই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এসব ব্যাপারে মামলা করার আগে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির বিধান বাধ্যতামূলক করতে পারলে এবং সংশ্লিষ্ট আইনে কিছু সংশোধন আনতে পারলে সমাধান আসতে পারে।’
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একজন আইনজীবীর চেম্বারে কথা হয় মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে। দুই ছেলেকে কাছে পেতে ২০২১ সালের মার্চে রিট করেছেন তিনি। বড় ছেলেটির বয়স এখন ১২ আর ছোট ছেলেটির ৯ বছর। ওই বছরের ১৫ মার্চ হাইকোর্ট রুল দিয়ে দুই শিশুকে হাজির করার নির্দেশ দেয়। ৩১ মার্চ হাইকোর্ট শিশুদের সঙ্গে একান্তে কথা বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, বাস্তবতা বিবেচনায় শিশু দুটি থাকবে বাবার কাছে। তবে মা যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানদের সান্নিধ্য পাবেন।
ওই নারীর অভিযোগ, হাইকোর্টের কোনো নির্দেশনাই মানছে না শিশু দুটির বাবা। ফলে আবারও তিনি হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ছেলেদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে। মায়ের সান্নিধ্যও পাচ্ছে না। বাবার পরিবার প্রভাবশালী। আমাকে ছেলেদের কাছে ভিড়তে দেওয়া হয় না। ছেলেদের আমি কাছে পেতে চাই।’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টানাপড়েন এখন বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে কর্মজীবী নারী ও পুরুষের মধ্যে। এখন যৌথ পরিবার কমে যাচ্ছে। ফলে সন্তানের দেখাশোনার বিষয়টি এখন কঠিন। ফলে মামলা বাড়ছে। মামলার নিষ্পত্তি হতে সাত বছরও লেগে যায়। আমার মনে হয়, সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে উভয়পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। সমঝোতার বিকল্প নেই।’
সুপ্রিম কোর্টে এ ধরনের মামলায় প্রায়ই বাবা অথবা মাকে আইনি সহায়তা দেন এমন একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত সাত বছরে অন্তত ৬৫টি অভিভাবকত্ব কিংবা জিম্মার মামলা পরিচালনা করেছি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সন্তানের ভবিষ্যতের চাইতে বাবা-মার জেদ অর্থাৎ হার না মানার মানসিকতা বেশি কাজ করে। তারা মনে করে, কোনোভাবে মামলা পক্ষে এলেই অন্যপক্ষ হেরে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার বাদী কিংবা বিবাদীদের আস্থায় আনা যায়; কিন্তু বাবা-মায়ের মামলায় সমঝোতার চেষ্টায় আদালত এবং আমাদের ব্যর্থ হতে হয়। ফলে মামলার নিষ্পত্তিও জটিলতায় পড়ে।’
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘দুপক্ষের আপস-মীমাংসার উদ্যোগের ব্যাপারেই এখন গুরুত্ব দিতে হবে। বিচারক ও আইনজীবীদের উপলব্ধি করতে হবে যে, এখানে শিশুর সুস্থ বিকাশের মতো স্পর্শকাতর বিষয় রয়েছে। তারা দুপক্ষকে আস্থায় নিয়ে সমাধান দিতে পারেন। এ উপলব্ধি না এলে পরিস্থিতি সুখকর হবে না।’
আপত্তি আদালতের পরিবেশ নিয়েও : ঢাকার জেলা আদালতের নিচতলায় দুটি পারিবারিক আদালত ঘুরে দেখেছেন দেশ রূপান্তরের এ প্রতিবেদক। ঢাকা জেলা জজ আদালতের নিচে ছোট দুটি কক্ষে কোনোরকমে বসানো হয়েছে আদালত। এজলাসের সামনে কয়েকটি পুরনো কাঠের বেঞ্চ। বসতে হয় গাদাগাদি করে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিচারপ্রার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আদালতের বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বাবা কিংবা মায়ের সঙ্গে আসা শিশুদেরও এ যন্ত্রণাময় পরিবেশে থাকতে হয়। আশপাশে কোনো বিশ্রামকক্ষ বা শৌচাগার নেই।
একাধিক আইনজীবী বলেছেন, আদালতের এমন পরিবেশে অনেক শিশু ভড়কে যায়। কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে। গরমের সময়ে পরিস্থিতি হয় খুব নাজুক। ঢাকা বারের সদস্য, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিয়েশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট নাসিমা আখতার লাভলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এগুলোকে কোনোভাবেই পারিবারিক আদালত বলার সুযোগ নেই। এজলাস আরও বড় হওয়া দরকার। নারী ও শিশুরা যাতে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে না পড়ে তার ব্যবস্থাও রাখতে হবে।’
বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ ও গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০-এ নাবালক শিশু সন্তানের অভিভাবকত্ব, তত্ত্বাবধান বা ভরণপোষণের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। আইন অনুযায়ী, নাবালকের স্বাভাবিক ও আইনগত অভিভাবক বাবা হলেও বাবার অনুপস্থিতি কিংবা অযোগ্যতায় মা অভিভাবক হতে পারেন। আর নাবালক শিশুর সার্বিক কল্যাণ ও তত্ত্বাবধানে মায়ের অগ্রাধিকার রয়েছে। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে সাত বছর ও কন্যার ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় থাকার কথা বলা আছে।
তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া উদ্ধারকারীদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এরপরও তারা সফলভাবে উদ্ধারকাজ সমাপ্ত করায় তুরস্ক সরকার ও সেখানকার মানুষ বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। উদ্ধার অভিযান শেষে দেশে ফিরে এসব কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর কাজী আলাউদ্দীন রোডে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, তুরস্কে সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজ পরিচালনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্ধারকারী দল পাঠানো ছাড়াও আমরা তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য উষ্ণ বস্ত্র পাঠিয়েছি।
সংবাদ সম্মেলনে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পাঁচ সদস্যের উদ্ধারকারী একটি দলের দলনেতা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, ‘একটি ছয়তলা ভবন ভেঙে একতলা হয়ে গিয়েছে। সেখান ভেতর থেকে একজন ভুক্তভোগী বের করা কঠিন চ্যালেঞ্জ। বড় একেকটি ভবন বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে ছিল, সেখানে আমরা যখন প্রবেশ করি আমাদের জীবনের ঝুঁকি ছিল। সেটি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। আর সেখানে বারবার আফটার শক হচ্ছিল। প্রতিনিয়ত আমাদের কষ্ট করে থাকতে হয়েছে। আমরা দুই থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে গেছি, আমাদের যন্ত্রপাতিগুলো কাঁধে করে নিয়ে গেছি। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু সেখানকার মানুষ আমাদের বলেছে, আমরা বন্ধু না, আমরা ভাই। আমরা সেখানে কাজ করে ভুক্তভোগী উদ্ধার করেছি, আমাদের মিশন সফল হয়েছে। সেখানকার মানুষ আমাদের কাজ দেখে এত অভিভূত হয়েছিল যে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন আদিয়ামানে গেলাম তখন দেখলাম পুরো শহর বিধ্বস্ত জনমানবশূন্য, কিন্তু শহরটি ছিল পুরো পরিকল্পিত। বড় বড় রাস্তাঘাট সব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দুই-একটি বাড়ি দাঁড়ানো ছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল ফাটল ধরা, বসবাসের অনুপযোগী। কোনো মানুষ নেই, কিছু পালিত পশুপাখি বিড়াল, কুকুর হাঁটাহাঁটি করছে। যেসব ভবনে ভুক্তভোগীর উপস্থিতি ছিল সেগুলোতে আমরা কাজ করেছি।’
উদ্ধার অভিযানে থাকা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, উদ্ধার অভিযানে সেখানকার শীত আমাদের কষ্টের কারণ ছিল। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য। আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা পরে বাংলাদেশে এমন দুর্যোগ এলে কাজে লাগাতে পারব।
বাংলাদেশে এমন ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস কতটা সক্ষমÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন বলেন, ফায়ার সার্ভিসের বর্তমানে ১৪ হাজার কর্মী সবাই প্রশিক্ষিত। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা দেশি-বিদেশি উন্নত যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করছি। এ প্রস্তুতি আমাদের জন্য অবশ্যই পর্যাপ্ত নয়। আমরা ড্রি (ডিজাস্টার রেসপন্স এক্সারসাইজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ) নামের একটি এক্সারসাইজ করছি।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন আছে, ৬২ হাজার ভলান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবক) তৈরি করার জন্য। আমরা ৫০ হাজার ইতিমধ্যে তৈরি করেছি। ২০২২ সালে ১ লাখ ৩৩ হাজারের ওপর শুধু গার্মেন্টস কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমরা বলব আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বিএমডিসি কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে।’
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ৯ ফেব্রুয়ারি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজে অংশ নিতে ৪৬ সদস্যের উদ্ধারকারী দল ঢাকা ত্যাগ করে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ২৪ জন, সেনাবাহিনী মেডিকেল টিমের ১০ ও ফায়ার সার্ভিসের ১২ জন। তারা দুটি প্রদেশের ১১টি ভবনে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে। অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে তারা একজন তরুণীকে জীবিত এবং ২৩ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেন।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখার বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত এ-সংক্রান্ত কমিটি। নীতিমালার খসড়ায় চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ ফি ৩০০ ও সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী ১ মার্চ থেকে ঢাকায় ও আগস্টের মধ্যে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে এই ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
তবে এই খসড়া নীতিমালার কিছু প্রস্তাবনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন কমিটির কয়েকজন সদস্য। তারা সর্বোচ্চ ৬০০ ও সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা নির্ধারণের পক্ষে মত দিয়েছেন। তারা আরও বলেছেন, তাড়াহুড়ো না করে ভেবেচিন্তে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন করা উচিত; বিশেষ করে তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পক্ষে। তারা মনে করছেন, এই উদ্যোগে চিকিৎসকরা অসন্তুষ্ট হলে মানুষের কাছে সরকারের ব্যাপারে ভুল বার্তা যাবে এবং নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কমিটি এ পর্যন্ত দুটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজন সদস্য দেশ রূপান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের ‘ব্যক্তিগত চেম্বার’ চালুর বিষয়ে গত ২২ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমানকে কমিটির প্রধান করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি এবং সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও পরিচালকদের নিয়ে গঠিত এই কমিটির সদস্যসংখ্যা ২৬।
কমিটি ব্যক্তিগত চেম্বার পরিচালনায় ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ নামের একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে এবং এখন পর্যন্ত দুটি বৈঠক করেছে। আজ বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কমিটির আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে গত দুই দফায় সদস্যদের মধ্য থেকে আসা বিভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে কমিটির প্রধান সাইদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নীতিমালা এখনো খসড়া পর্যায়ে আছে। বিষয়টি নতুন। সময় লাগবে চূড়ান্ত হতে। এখন এ ব্যাপারে কিছুই বলা যাবে না।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখনো চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ হয়নি। এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা আরও বসব। সবার মত নেব। সবকিছু ঠিক করতে সময় লাগবে। এখন পর্যন্ত মন্ত্রী মহোদয়ের কথা অনুযায়ী মার্চ থেকে শুরু করার চিন্তাভাবনা আছে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, দেখা যাক।’
খসড়া নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে, এসব চেম্বারে চিকিৎসকরা বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত রোগী দেখবেন। রোগীদের আগে থেকেই সিরিয়াল নিতে হবে না। তবে হাসপাতালে এসে টিকিট কাটতে হবে।
কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ ধরনের চেম্বারে বসার ব্যাপারে কোনো চিকিৎসককে বাধ্য করা হবে না। তারা এখানে রোগী দেখার পর হাসপাতালের বাইরে তাদের চেম্বারেও রোগী দেখতে পারবেন।
এসব চেম্বারে আসা রোগীরা ওই হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করাতে পারবেন এবং এ জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতালের পরীক্ষাগার খোলা থাকবে। এ জন্য তাকে সরকার নির্ধারিত পরীক্ষা ফি দিতে হবে। চেম্বারে একজন অধ্যাপক সপ্তাহে দুই দিন, সহযোগী অধ্যাপক দুই দিন ও সহকারী অধ্যাপক দুই দিন রোগী দেখবেন।
তবে এখনো কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান কমিটির সদস্য বিএমএর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তিনি গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের ফি নির্দিষ্ট হয়নি। জুনিয়র চিকিৎসকদের জন্য ৩০০ হতে পারে এবং সিনিয়র অভিজ্ঞদের জন্য ৬০০ টাকা। আরেকটু চিন্তাভাবনা করে ঠিক করা দরকার। জুনিয়র চিকিৎসকরা বাইরে চেম্বার করেন। বাইরে তারা যেটা নেন, এখানেও সে রকমই করতে হবে। যাতে এটা নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ধরনের অসন্তোষ তৈরি না হয়। আমরা মনে করি হিসাব করে করা উচিত। এখন অনেক তরুণও অধ্যাপক হয়েছেন। অধ্যাপকদের মধ্যে যারা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তাদের একটা আলাদা ফি নির্ধারণ করা উচিত। সরকার যদি এ রকম চিন্তা করে, তাহলে ভালো হবে।’
খসড়া নীতিমালার প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত কিছু বিষয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বাইরের কয়েকজন সদস্য। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা মত দিয়েছি এই সিদ্ধান্ত জাতীয় নির্বাচনের পর বাস্তবায়নের। এখন এগুলোর দরকার নেই।’
চিকিৎসকদের ফির ব্যাপারে এসব সদস্য বলেন, আমাদের যে জুনিয়র চিকিৎসকরা, তারা তাদের চেম্বারে ফি নেন ৫০০ টাকা। সিনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখলে তার ফি অবশ্যই বাড়াতে হবে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী ফি নির্ধারণ করতে হবে।
এই সদস্যরা সর্বশেষ বৈঠকে বলেন, এখন বারডেম করছে। তাদের আরও সক্রিয় করতে বলেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় সপ্তাহে মাত্র দুই দিন করে। সপ্তাহে ওদের ছয় দিন করতে বলেন। তা হলে মানুষের আগ্রহ আসবে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড হাসপাতাল), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু করা হোক। পরে ধাপে ধাপে সারা দেশে করেন। ঢাকা শহরের সরকারি হাসপাতালে চালু করতে করতে জাতীয় নির্বাচন চলে আসবে। পরে দেশের অন্যান্য স্থানে শুরু করা যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেন, ‘নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করল। পরে এগুলো চালু করলে মানুষ সেটা আরও ভালোভাবে নেবে। এগুলো যদি আগেই ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে চিকিৎসকদের মধ্যে ভিন্ন ধারণা জন্ম নিতে পারে। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বলেছি পরে করেন। আমলারা বাস্তবতার সঙ্গে থাকেন না।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) প্রথম বর্ষের ছাত্রীকে নির্যাতনের পর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়েছেন নির্যাতনের শিকার ছাত্রী ও অভিযুক্তরা। গতকাল বুধবার দুপুর ৩টার দিকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন অ্যাকাডেমিক ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তদন্ত কমিটির আহ্বায়কের কক্ষে তাদের মুখোমুখি করা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে উভয়পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। কথা বলা শেষে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেও মুখ খুলেননি অভিযুক্তরা। তারা গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে মুখ লুকিয়ে চলে যান।
এদিকে নির্যাতনের শিকার ফুলপরী খাতুনের কাছে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীরা হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছেন বলে জানা গেছে। গতকাল তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলে বের হওয়ার সময় ফুলপরী সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তবে ফুলপরীর এই বক্তব্যের বিষয়ে অভিযুক্ত সানজিদা চৌধুরী কোনো কথা বলেননি।
তদন্ত কমিটির ডাকে গতকাল বেলা ১২টার দিকে পাবনার গ্রামের বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে আসেন ফুলপরী খাতুন। এ সময় সঙ্গে তার ভ্যানচালক বাবাও ছিলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন সহকারী প্রক্টরের তত্ত্বাবধানে তাদের দেশরতœ শেখ হাসিনা হলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হল কর্র্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা ফুলপরীর সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বলেন। অন্যদিকে নির্যাতনে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীরা গোপনে ক্যাম্পাসে ঢোকেন। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ ও তদন্ত কমিটি। পরে দুপুর ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. রেবা ম-লের কক্ষে ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তদের ঢোকানো হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে অন্তরা ছাড়াও ছিলেন তাবাসসুম ইসলাম, মোয়াবিয়া জাহান, হালিমা খাতুন উর্মি ও ইশরাত জাহান মীম।
সেখান থেকে বেরিয়ে ফুলপরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তদন্ত কমিটির কাছে আমি নির্যাতনকারীদের চিনিয়ে দিয়েছি। এ সময় তারা আমার হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু আমি যা সত্য তাই বলেছি। এছাড়াও তারা কান্না কান্না ভাব নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। তদন্ত কমিটির কাছে আমি নির্যাতনে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছি।’
নির্যাতনকারীদের দেখে ভয় পেয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কোনোরকম ভয় পাইনি। বরং তাদের সামনেই সব বলেছি।’
পরে ফুলপরীর বাবা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্যাতনের ঘটনার পরে মেয়েকে নিয়ে চারবার ক্যাম্পাসে এলাম। মেয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তবুও তদন্তের স্বার্থে আসতে হয়েছে। এছাড়াও আর্থিকভাবে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তবুও এর সুষ্ঠু বিচার চাই আমি।’ সঠিক বিচার না পেলে মামলা করবেন বলেও জানান তিনি।
ফুলপরীর হাত-পা ধরে অভিযুক্তদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সত্য কি না, তদন্ত কমিটির আহ্বায়কের কাছে তা জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি ক্যাম্পাসে : নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে গতকাল বেলা ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে আসেন হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তারা প্রক্টরের সঙ্গে এক ঘণ্টা কথা বলেন। পরে দেশরতœ শেখ হাসিনা হলে যান তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
এদিকে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনার বিচার চেয়ে ক্যাম্পাসে গতকাল মানববন্ধন করেছে শিক্ষকদের সংগঠন ‘সাদা দল’। মানববন্ধন থেকে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।