
ঘোষণা ছাড়াই সেবা খাতের আয় করা বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার সুযোগ দ্বিগুণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে এ খাতে উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকরা ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনতে কোনো ঘোষণা দিতে হবে না। আগে এ সীমা ছিল ১০ হাজার ডলার। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সি-ফরমে ঘোষণা ছাড়াই দ্বিগুণ অর্থ দেশে আনার এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেবা খাতের রপ্তানিকারকদের। এক্ষেত্রে অহেতুক সময়ক্ষেপণ ছাড়াই প্রাপ্ত আয় নগদায়ন করতে পারবেন তারা।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এতদিন সেবা খাতের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ঘোষণা ছাড়া ১০ হাজার ডলার দেশে আনা যেত। এখন তা বাড়িয়ে ২০ হাজার ডলার বা সমতুল্য অন্য মুদ্রায় প্রাপ্ত আয় ঘোষণা ছাড়াই আনা যাবে। তবে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা যতখুশি তত পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে পারেন, এজন্য কোনো প্রকার ঘোষণার প্রয়োজন হয় না।
গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সেবা দিয়ে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার দেশে আনার প্রক্রিয়া সহজ করে।
ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, সেবার বিনিময়ে পাওয়া আয় আনতে কাগজের ফরম পূরণ (ফরম-সি নামে পরিচিত) করতে হবে না। ইলেকট্রনিক উপায়ে অনলাইনে ঘোষণা দিয়ে আনা যাবে। তবে নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, সি-ফরমে ঘোষণা ছাড়াই এখন থেকে সেবা খাতের ২০ হাজার ডলার বা সমতুল্য অন্য মুদ্রায় প্রাপ্ত আয় আনা যাবে বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতি অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক পরিশোধ করে মাত্র ১১০টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান বদলালেও সংখ্যাটি বেশ কয়েক বছর ধরে একই আছে। অথচ এখন অনলাইনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩ লাখ। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এনবিআরে ভ্যাট-নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত লাখ।
প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে বাজেটের জোগান বাড়ানোর চাপ। ভ্যাট বা মূসক খাতে লক্ষ্যমাত্রা থাকে সবচেয়ে বেশি। ভ্যাট বা মূসক সরাসরি ভোক্তার কাছ থেকে কড়ায়গ-ায় আদায় করা হয়। আদায় করা হলেও ভ্যাট-ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীরা সরকারি কোষাগারে জমা দেয় সামান্যই বা একেবারেই দেয় না। তারা নিজের পকেট ভরে। যারা নিয়মিত ভ্যাট দেয় শেষ পর্যন্ত সেই ১১০ প্রতিষ্ঠানই গড়ে মোট লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক পরিশোধ করে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রায় প্রতি বছর ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। ভ্যাট আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগ পরিশোধ করে বড় মাপের প্রতিষ্ঠানগুলো। যারা নিয়মিত ভ্যাট দেয় তাদের ওপরই বাড়তি ভ্যাট পরিশোধের চাপ বাড়ে। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হলে ভ্যাট প্রদানে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাড়বে। এতে নিয়মিত ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ কমলেও মোট আদায় বাড়বে।
গত অর্থবছরে মোট আদায়কৃত ভ্যাট ১ লাখ ৩০০ কোটি টাকা। ১১০টি প্রতিষ্ঠান আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৫৩ শতাংশ পরিশোধ করেছে, যার পরিমাণ ৫২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ভ্যাটের অর্ধেকের বেশি এসেছে সিগারেট খাত থেকেÑ ২৭ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হিসাব কষে ভ্যাট নেয় এনবিআরের এলটিইউ (ভ্যাট) শাখা। পর পর তিন বছরের যে কোনো এক বছর বার্র্ষিক লেনদেন ১০ কোটি টাকার কম হলে এখানকার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। এ দপ্তরের আওতায় দুইশর বেশি প্রতিষ্ঠান থাকলেও গত দশ বছরে কিছু প্রতিষ্ঠানের লেনদেন ১০ কোটি টাকার কম হওয়ায় তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার বার্ষিক লেনদেন ১০ কোটির বেশি হওয়ায় নতুন করে কিছু প্রতিষ্ঠান যুক্তও হয়েছে। যোগ-বিয়োগের পর গত চার বছর ধরে এদিক-ওদিক করে ১১০টি প্রতিষ্ঠানই ভ্যাটদাতার তালিকায় রয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরেও ১১০টি প্রতিষ্ঠান আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৫২ শতাংশ দিয়েছে, যার পরিমাণ ৪৮ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। সে বছর ভ্যাট খাতে আদায় হয়েছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ৮৪ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। ১১০টি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে ৪২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৫০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভ্যাট আদায় হয়েছে আগের বছরের মতো।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বড় মাপের ১১০টি প্রতিষ্ঠান আদায়কৃত ভ্যাটের ৫৫ শতাংশ দিয়েছিল। তারা দিয়েছিল ৪৫ হাজার ২০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
গত চার অর্থবছরের প্রতি বছরই বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত ভ্যাটের ৫০ শতাংশ ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো লিমিটেড কোম্পানি (বিএটিবি) একাই পরিশোধ করেছে।
বিএটিবি ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, ২০১৯-২০-এ ২০ হাজার ৭৬৬ কোটি, ২০১৮-১৯-এ ১৯ হাজার ৬৯৬ কোটি এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকার ভ্যাট দিয়েছে।
গত অর্থবছরে ভ্যাটপ্রদানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিল যথাক্রমে মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি। আগের অর্থবছরও এই দুই প্রতিষ্ঠান একই অবস্থানে ছিল। গত অর্থবছরে গ্রামীণফোন দিয়েছে ৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এই ১১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে সিমেন্ট খাতের শাহ সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, সেভেন রিং সিমেন্ট; ওষুধ খাতের স্কয়ার, বেক্সিমকো, ইনসেপটা; ব্যাংক খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও আরএকে সিরামিকস প্রভৃতি।
সম্প্রতি এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করে গত অর্থবছরের সেরা ভ্যাটদাতা হিসেবে ৯ প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করেছে। উৎপাদন খাতে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট দিয়ে এনবিআরের তালিকায় আছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ও এসএমসি এন্টারপ্রাইজ। ব্যবসায়-শ্রেণিতে আছে ওয়ালটন, আগোরা লিমিটেড ও ইউনিমার্ট লিমিটেড। সেবা-শ্রেণিতে তিন সেরা ভ্যাটদাতা হলো বিকাশ লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক ও নগদ লিমিটেড।
গত চার অর্থবছর সিগারেট, মুঠোফোন, ওষুধ, ব্যাংক, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিতরণ, কোমল পানীয়, সাবান, সিমেন্ট ও পানি সরবরাহকারীÑ এই ১০ খাত থেকে এলটিইউ বেশির ভাগ ভ্যাট আদায় করেছে।
এনবিআর অনলাইনে ভ্যাট-নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে। অনলাইন ভ্যাট-নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। এর আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভ্যাট-নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখ। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তৃতাকালে দাবি করেছিলেন, দেশে ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০ লাখ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, এনবিআরের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। আরও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও লোকবলের স্বল্পতার কারণে তারা ভ্যাট ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে পারছে না।
এনবিআর সদস্য (মূসক মূল্যায়ন ও কার্যকর করা) মইনুল খান বলেন, ভ্যাট ফাঁকিবাজদের চিহ্নিত করতে এনবিআর জরিপ শুরু করেছে। আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে এরই মধ্যে সারা দেশের বিক্রয়কেন্দ্রে ইএফডি যন্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। গত নভেম্বরে ইএফডির মাধ্যমে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৩২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৮৩০টি ইএফডি যন্ত্র বসানো হয়েছে। প্রথম ধাপে তিন লাখ ইএফডি যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে ইএফডি যন্ত্রের মাধ্যমে ভ্যাট আদায় করা হবে।
ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে ইএফডি (ইলেকট্রিক ফিসক্যাল ডিভাইস) ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। প্রাথমিকভাবে আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান, মিষ্টির দোকান, আসবাবপত্র বিক্রয়কেন্দ্র, পোশাক বিক্রয়কেন্দ্র, বুটিক শপ, বিউটি পার্লার, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, মোবাইল ও মোবাইলের যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকান, গৃহস্থালি সামগ্রী বিক্রয়কেন্দ্র, অলংকার বিক্রিয়কেন্দ্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, ইএফডি সরবরাহে একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইএফডি সরবরাহের ধীরগতি রয়েছে। এ যন্ত্র কাউকে দেওয়া হচ্ছে আর কাউকে দেওয়া হচ্ছে না। আমার পরামর্শ, এই কাজে একাধিক কোম্পানিকে কাজে লাগানো হোক। তাহলে ইএফডি দ্রুত সরবরাহ করা যাবে। রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
মিরপুরের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকার সঙ্গে রাজশাহীর এক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে বিয়ে হয় ২০১১ সালে। তাদের এক কন্যাসন্তান। টানাপড়েনের জেরে ২০১৮ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজতের অধিকার পেতে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন শিশুর মা।
মামলার সময় শিশুর বয়স ছিল পাঁচ বছর। একই দাবিতে শিশুর বাবা ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর রাজশাহী পারিবারিক আদালতে পাল্টা মামলা করেন। বাবা-মায়ের মামলার জেরে বিপাকে পড়ে ওই শিশু। আদালত সন্তানকে বাবার হেফাজতে দিলেও মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার এবং সন্তানকে দেখভাল করার আদেশও ছিল। সন্তানকে একান্তে পাওয়ার জন্য ২০২১ সালের মার্চে হাইকোর্টে রিট করেন মা। হাইকোর্ট ঢাকার মামলাটি অবিলম্বে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে বাবার পক্ষের আইনজীবীরা ঢাকার মামলা রাজশাহীতে বদলি চেয়ে রিট করলে গত বছর মার্চে ওই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে বদলি প্রশ্নে রুল দেয় হাইকোর্ট। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, রুলটি এখনো বিচারাধীন। এর মধ্যে শিশুটির বয়স হয়েছে আট বছর।
সন্তানের অভিভাবকত্ব কিংবা হেফাজত পাওয়ার এমন অনেক মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পারিবারিক আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭৬ হাজার ৪৮৮।
বেসরকারি সংস্থা ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ফ্লাড) হিসাবে প্রতি কর্মদিবসে ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালতের একটিতে ৯০ থেকে ৯৮টি, একটিতে ১০০ থেকে ১১২টি এবং একটিতে ৮০ থেকে ৮৫টি মামলার শুনানি হয়। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মামলার শুনানি হয় সন্তান নিয়ে।
ভূমিবিরোধবিষয়ক মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা প্রায়ই বলেন, দেওয়ানি মামলার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। পারিবারিক আদালতের মামলা নিয়েও আইনজীবীদের মুখে এমন হতাশার কথা শোনা যায়। অধস্তন পারিবারিক আদালত থেকে হাইকোর্ট, হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগ; এরপর আদালতের আদেশ পালনে অনীহা প্রভৃতির আরজি নিয়ে আবারও অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালত এভাবে মামলা চলতেই থাকে। সন্তান বড় হতে থাকে, কিন্তু বাবা-মায়ের মামলা শেষ হয় না।
অনেক ক্ষেত্রে আদালত কিংবা আইনজীবীদের আপস-মীমাংসার পরামর্শ থাকলেও আবেগের কাছে তা ঠুনকো হয়ে যায়। কোনো কোনো বাবা-মায়ের ইগো বা অহং অর্থাৎ ছাড় না দেওয়ার মানসিকতার কাছে পরাস্ত হয় সব যুক্তি বা আইন। ফলে ব্যাঘাত ঘটে শিশুর মানসিক ও অন্যান্য বিকাশে। হাইকোর্ট প্রায় দুই বছর আগে পারিবারিক আদালতে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে করা মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিলেও তার প্রায় কিছুই প্রতিপালিত হয়নি।
প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লিখিত মামলায় শিশুর বাবাকে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘মামলাজটের কারণে পারিবারিক আদালতের মামলা এখন অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আদালত আদেশ দিলেও কিছুদিনের মধ্যেই কোনো কোনো অভিযোগে আবারও আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় এসব মামলার সমাধান পাওয়াই যায় না। সন্তানসম্পর্কিত আবেগের বিষয়ে আদালতও কঠোর হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘অসংখ্য শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। এখনই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এসব ব্যাপারে মামলা করার আগে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির বিধান বাধ্যতামূলক করতে পারলে এবং সংশ্লিষ্ট আইনে কিছু সংশোধন আনতে পারলে সমাধান আসতে পারে।’
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একজন আইনজীবীর চেম্বারে কথা হয় মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে। দুই ছেলেকে কাছে পেতে ২০২১ সালের মার্চে রিট করেছেন তিনি। বড় ছেলেটির বয়স এখন ১২ আর ছোট ছেলেটির ৯ বছর। ওই বছরের ১৫ মার্চ হাইকোর্ট রুল দিয়ে দুই শিশুকে হাজির করার নির্দেশ দেয়। ৩১ মার্চ হাইকোর্ট শিশুদের সঙ্গে একান্তে কথা বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, বাস্তবতা বিবেচনায় শিশু দুটি থাকবে বাবার কাছে। তবে মা যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানদের সান্নিধ্য পাবেন।
ওই নারীর অভিযোগ, হাইকোর্টের কোনো নির্দেশনাই মানছে না শিশু দুটির বাবা। ফলে আবারও তিনি হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ছেলেদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে। মায়ের সান্নিধ্যও পাচ্ছে না। বাবার পরিবার প্রভাবশালী। আমাকে ছেলেদের কাছে ভিড়তে দেওয়া হয় না। ছেলেদের আমি কাছে পেতে চাই।’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টানাপড়েন এখন বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে কর্মজীবী নারী ও পুরুষের মধ্যে। এখন যৌথ পরিবার কমে যাচ্ছে। ফলে সন্তানের দেখাশোনার বিষয়টি এখন কঠিন। ফলে মামলা বাড়ছে। মামলার নিষ্পত্তি হতে সাত বছরও লেগে যায়। আমার মনে হয়, সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে উভয়পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। সমঝোতার বিকল্প নেই।’
সুপ্রিম কোর্টে এ ধরনের মামলায় প্রায়ই বাবা অথবা মাকে আইনি সহায়তা দেন এমন একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত সাত বছরে অন্তত ৬৫টি অভিভাবকত্ব কিংবা জিম্মার মামলা পরিচালনা করেছি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সন্তানের ভবিষ্যতের চাইতে বাবা-মার জেদ অর্থাৎ হার না মানার মানসিকতা বেশি কাজ করে। তারা মনে করে, কোনোভাবে মামলা পক্ষে এলেই অন্যপক্ষ হেরে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার বাদী কিংবা বিবাদীদের আস্থায় আনা যায়; কিন্তু বাবা-মায়ের মামলায় সমঝোতার চেষ্টায় আদালত এবং আমাদের ব্যর্থ হতে হয়। ফলে মামলার নিষ্পত্তিও জটিলতায় পড়ে।’
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘দুপক্ষের আপস-মীমাংসার উদ্যোগের ব্যাপারেই এখন গুরুত্ব দিতে হবে। বিচারক ও আইনজীবীদের উপলব্ধি করতে হবে যে, এখানে শিশুর সুস্থ বিকাশের মতো স্পর্শকাতর বিষয় রয়েছে। তারা দুপক্ষকে আস্থায় নিয়ে সমাধান দিতে পারেন। এ উপলব্ধি না এলে পরিস্থিতি সুখকর হবে না।’
আপত্তি আদালতের পরিবেশ নিয়েও : ঢাকার জেলা আদালতের নিচতলায় দুটি পারিবারিক আদালত ঘুরে দেখেছেন দেশ রূপান্তরের এ প্রতিবেদক। ঢাকা জেলা জজ আদালতের নিচে ছোট দুটি কক্ষে কোনোরকমে বসানো হয়েছে আদালত। এজলাসের সামনে কয়েকটি পুরনো কাঠের বেঞ্চ। বসতে হয় গাদাগাদি করে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিচারপ্রার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আদালতের বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বাবা কিংবা মায়ের সঙ্গে আসা শিশুদেরও এ যন্ত্রণাময় পরিবেশে থাকতে হয়। আশপাশে কোনো বিশ্রামকক্ষ বা শৌচাগার নেই।
একাধিক আইনজীবী বলেছেন, আদালতের এমন পরিবেশে অনেক শিশু ভড়কে যায়। কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে। গরমের সময়ে পরিস্থিতি হয় খুব নাজুক। ঢাকা বারের সদস্য, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিয়েশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট নাসিমা আখতার লাভলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এগুলোকে কোনোভাবেই পারিবারিক আদালত বলার সুযোগ নেই। এজলাস আরও বড় হওয়া দরকার। নারী ও শিশুরা যাতে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে না পড়ে তার ব্যবস্থাও রাখতে হবে।’
বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ ও গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০-এ নাবালক শিশু সন্তানের অভিভাবকত্ব, তত্ত্বাবধান বা ভরণপোষণের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। আইন অনুযায়ী, নাবালকের স্বাভাবিক ও আইনগত অভিভাবক বাবা হলেও বাবার অনুপস্থিতি কিংবা অযোগ্যতায় মা অভিভাবক হতে পারেন। আর নাবালক শিশুর সার্বিক কল্যাণ ও তত্ত্বাবধানে মায়ের অগ্রাধিকার রয়েছে। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে সাত বছর ও কন্যার ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় থাকার কথা বলা আছে।
তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া উদ্ধারকারীদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এরপরও তারা সফলভাবে উদ্ধারকাজ সমাপ্ত করায় তুরস্ক সরকার ও সেখানকার মানুষ বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। উদ্ধার অভিযান শেষে দেশে ফিরে এসব কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর কাজী আলাউদ্দীন রোডে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, তুরস্কে সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজ পরিচালনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্ধারকারী দল পাঠানো ছাড়াও আমরা তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য উষ্ণ বস্ত্র পাঠিয়েছি।
সংবাদ সম্মেলনে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পাঁচ সদস্যের উদ্ধারকারী একটি দলের দলনেতা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, ‘একটি ছয়তলা ভবন ভেঙে একতলা হয়ে গিয়েছে। সেখান ভেতর থেকে একজন ভুক্তভোগী বের করা কঠিন চ্যালেঞ্জ। বড় একেকটি ভবন বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে ছিল, সেখানে আমরা যখন প্রবেশ করি আমাদের জীবনের ঝুঁকি ছিল। সেটি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। আর সেখানে বারবার আফটার শক হচ্ছিল। প্রতিনিয়ত আমাদের কষ্ট করে থাকতে হয়েছে। আমরা দুই থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে গেছি, আমাদের যন্ত্রপাতিগুলো কাঁধে করে নিয়ে গেছি। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু সেখানকার মানুষ আমাদের বলেছে, আমরা বন্ধু না, আমরা ভাই। আমরা সেখানে কাজ করে ভুক্তভোগী উদ্ধার করেছি, আমাদের মিশন সফল হয়েছে। সেখানকার মানুষ আমাদের কাজ দেখে এত অভিভূত হয়েছিল যে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন আদিয়ামানে গেলাম তখন দেখলাম পুরো শহর বিধ্বস্ত জনমানবশূন্য, কিন্তু শহরটি ছিল পুরো পরিকল্পিত। বড় বড় রাস্তাঘাট সব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দুই-একটি বাড়ি দাঁড়ানো ছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল ফাটল ধরা, বসবাসের অনুপযোগী। কোনো মানুষ নেই, কিছু পালিত পশুপাখি বিড়াল, কুকুর হাঁটাহাঁটি করছে। যেসব ভবনে ভুক্তভোগীর উপস্থিতি ছিল সেগুলোতে আমরা কাজ করেছি।’
উদ্ধার অভিযানে থাকা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, উদ্ধার অভিযানে সেখানকার শীত আমাদের কষ্টের কারণ ছিল। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য। আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা পরে বাংলাদেশে এমন দুর্যোগ এলে কাজে লাগাতে পারব।
বাংলাদেশে এমন ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস কতটা সক্ষমÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন বলেন, ফায়ার সার্ভিসের বর্তমানে ১৪ হাজার কর্মী সবাই প্রশিক্ষিত। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা দেশি-বিদেশি উন্নত যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করছি। এ প্রস্তুতি আমাদের জন্য অবশ্যই পর্যাপ্ত নয়। আমরা ড্রি (ডিজাস্টার রেসপন্স এক্সারসাইজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ) নামের একটি এক্সারসাইজ করছি।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন আছে, ৬২ হাজার ভলান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবক) তৈরি করার জন্য। আমরা ৫০ হাজার ইতিমধ্যে তৈরি করেছি। ২০২২ সালে ১ লাখ ৩৩ হাজারের ওপর শুধু গার্মেন্টস কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমরা বলব আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বিএমডিসি কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে।’
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ৯ ফেব্রুয়ারি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজে অংশ নিতে ৪৬ সদস্যের উদ্ধারকারী দল ঢাকা ত্যাগ করে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ২৪ জন, সেনাবাহিনী মেডিকেল টিমের ১০ ও ফায়ার সার্ভিসের ১২ জন। তারা দুটি প্রদেশের ১১টি ভবনে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে। অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে তারা একজন তরুণীকে জীবিত এবং ২৩ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি নিউ স্টার্ট স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ভøাদিমির পুতিন। গত মঙ্গলবার পুতিনের এ ঘোষণার পরই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা পুতিনের এ ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আশঙ্কা করেছে পারমাণবিক যুদ্ধের। যদিও পোল্যান্ডে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, পুতিন এখনো পশ্চিমাদের দৃঢ়তা বুঝতে পারেননি। তিনি চুক্তি স্থগিত করে কত বড় ভুল করেছেন সে বিষয়েও কোনো ধারণা নেই তার।
গতকাল বুধবার পোল্যান্ড সফরের দ্বিতীয় দিনে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন বাইডেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে পুতিন বিরাট ভুল করেছেন। আর গত মঙ্গলবার বাইডেন বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে গেলে পশ্চিমাদের শক্তি কমে আসবে বলে মনে করছেন মস্কোর নেতারা। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এখনো পশ্চিমাদের দৃঢ়তা বুঝতে পারেননি।
পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে দেওয়া ভাষণে বাইডেন বলেন, ‘(ভেঙে যাওয়া) একটি সাম্রাজ্য পুনর্গঠনে একজন স্বৈরশাসকের অভিলাষ কখনই স্বাধীনতার প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে কমিয়ে দিতে পারবে না। বর্বরতা কখনই স্বাধীন মানুষের ইচ্ছাকে দমিয়ে দিতে পারবে না। ইউক্রেন কখনই রাশিয়ার কাছে বিজয় রূপে আসবে না।’
তিনি বলেন, তিনি (পুতিন) মনে করেছিলেন, তার মতো স্বৈরশাসকরা কঠোর হন, আর গণতন্ত্রের নেতারা নরম হন। তবে এরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ়সংকল্পের মুখোমুখি হলেন। আর সারা বিশ্বে এমন সব দেশের সামনে পড়লেন, যারা ভয়ের মাধ্যমে শাসিত বিশ্বব্যবস্থা মেনে নিল না। এ সময় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো নিয়ে বাইডেন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় এক বছর পর এসে ন্যাটো এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি একতাবদ্ধ। ভাষণে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদেশগুলো রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে বলেও জানান বাইডেন।
ওইদিন তিনি কিয়েভ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, প্রায় এক বছর আগে আমি এখানে এসেছিলাম। এক বছর আগে মানুষের প্রশ্ন ছিল, কিয়েভের পতন নিয়ে। কিন্তু আমি কিয়েভ ঘুরে আসছি। আমি আপনাদের জানাচ্ছি, কিয়েভ শক্ত হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিয়েভ গর্বিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা কিয়েভ স্বাধীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
বাইডেন বলেন, সামনে আরও কঠিন ও তিক্ত দিন আসছে। আমেরিকা ও ইউরোপ আগামী দিনেও একইরকমভাবে ইউক্রেনের পাশে থাকবে।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখার বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত এ-সংক্রান্ত কমিটি। নীতিমালার খসড়ায় চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ ফি ৩০০ ও সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী ১ মার্চ থেকে ঢাকায় ও আগস্টের মধ্যে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে এই ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
তবে এই খসড়া নীতিমালার কিছু প্রস্তাবনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন কমিটির কয়েকজন সদস্য। তারা সর্বোচ্চ ৬০০ ও সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা নির্ধারণের পক্ষে মত দিয়েছেন। তারা আরও বলেছেন, তাড়াহুড়ো না করে ভেবেচিন্তে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন করা উচিত; বিশেষ করে তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পক্ষে। তারা মনে করছেন, এই উদ্যোগে চিকিৎসকরা অসন্তুষ্ট হলে মানুষের কাছে সরকারের ব্যাপারে ভুল বার্তা যাবে এবং নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কমিটি এ পর্যন্ত দুটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজন সদস্য দেশ রূপান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের ‘ব্যক্তিগত চেম্বার’ চালুর বিষয়ে গত ২২ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমানকে কমিটির প্রধান করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি এবং সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও পরিচালকদের নিয়ে গঠিত এই কমিটির সদস্যসংখ্যা ২৬।
কমিটি ব্যক্তিগত চেম্বার পরিচালনায় ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ নামের একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে এবং এখন পর্যন্ত দুটি বৈঠক করেছে। আজ বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কমিটির আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে গত দুই দফায় সদস্যদের মধ্য থেকে আসা বিভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে কমিটির প্রধান সাইদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নীতিমালা এখনো খসড়া পর্যায়ে আছে। বিষয়টি নতুন। সময় লাগবে চূড়ান্ত হতে। এখন এ ব্যাপারে কিছুই বলা যাবে না।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখনো চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ হয়নি। এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা আরও বসব। সবার মত নেব। সবকিছু ঠিক করতে সময় লাগবে। এখন পর্যন্ত মন্ত্রী মহোদয়ের কথা অনুযায়ী মার্চ থেকে শুরু করার চিন্তাভাবনা আছে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, দেখা যাক।’
খসড়া নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে, এসব চেম্বারে চিকিৎসকরা বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত রোগী দেখবেন। রোগীদের আগে থেকেই সিরিয়াল নিতে হবে না। তবে হাসপাতালে এসে টিকিট কাটতে হবে।
কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ ধরনের চেম্বারে বসার ব্যাপারে কোনো চিকিৎসককে বাধ্য করা হবে না। তারা এখানে রোগী দেখার পর হাসপাতালের বাইরে তাদের চেম্বারেও রোগী দেখতে পারবেন।
এসব চেম্বারে আসা রোগীরা ওই হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করাতে পারবেন এবং এ জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতালের পরীক্ষাগার খোলা থাকবে। এ জন্য তাকে সরকার নির্ধারিত পরীক্ষা ফি দিতে হবে। চেম্বারে একজন অধ্যাপক সপ্তাহে দুই দিন, সহযোগী অধ্যাপক দুই দিন ও সহকারী অধ্যাপক দুই দিন রোগী দেখবেন।
তবে এখনো কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান কমিটির সদস্য বিএমএর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তিনি গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের ফি নির্দিষ্ট হয়নি। জুনিয়র চিকিৎসকদের জন্য ৩০০ হতে পারে এবং সিনিয়র অভিজ্ঞদের জন্য ৬০০ টাকা। আরেকটু চিন্তাভাবনা করে ঠিক করা দরকার। জুনিয়র চিকিৎসকরা বাইরে চেম্বার করেন। বাইরে তারা যেটা নেন, এখানেও সে রকমই করতে হবে। যাতে এটা নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ধরনের অসন্তোষ তৈরি না হয়। আমরা মনে করি হিসাব করে করা উচিত। এখন অনেক তরুণও অধ্যাপক হয়েছেন। অধ্যাপকদের মধ্যে যারা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তাদের একটা আলাদা ফি নির্ধারণ করা উচিত। সরকার যদি এ রকম চিন্তা করে, তাহলে ভালো হবে।’
খসড়া নীতিমালার প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত কিছু বিষয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বাইরের কয়েকজন সদস্য। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা মত দিয়েছি এই সিদ্ধান্ত জাতীয় নির্বাচনের পর বাস্তবায়নের। এখন এগুলোর দরকার নেই।’
চিকিৎসকদের ফির ব্যাপারে এসব সদস্য বলেন, আমাদের যে জুনিয়র চিকিৎসকরা, তারা তাদের চেম্বারে ফি নেন ৫০০ টাকা। সিনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখলে তার ফি অবশ্যই বাড়াতে হবে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী ফি নির্ধারণ করতে হবে।
এই সদস্যরা সর্বশেষ বৈঠকে বলেন, এখন বারডেম করছে। তাদের আরও সক্রিয় করতে বলেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় সপ্তাহে মাত্র দুই দিন করে। সপ্তাহে ওদের ছয় দিন করতে বলেন। তা হলে মানুষের আগ্রহ আসবে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড হাসপাতাল), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু করা হোক। পরে ধাপে ধাপে সারা দেশে করেন। ঢাকা শহরের সরকারি হাসপাতালে চালু করতে করতে জাতীয় নির্বাচন চলে আসবে। পরে দেশের অন্যান্য স্থানে শুরু করা যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেন, ‘নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করল। পরে এগুলো চালু করলে মানুষ সেটা আরও ভালোভাবে নেবে। এগুলো যদি আগেই ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে চিকিৎসকদের মধ্যে ভিন্ন ধারণা জন্ম নিতে পারে। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বলেছি পরে করেন। আমলারা বাস্তবতার সঙ্গে থাকেন না।’
বর্তমান সময়ে একটি খবর অনেক শেয়ার হতে দেখেছি ফেসবুকে। সেট হলো বিয়ে বিচ্ছেদের খবর। আধুনিক তরুণ-তরুণীরা একসঙ্গে বেশি দিন থাকতে চান না। এ মানসিকতা কেন গড়ে উঠল? এমনকি প্রেমের বিয়েও টিকছে না। এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথা মনে পড়ল। যেমন-
‘আমাদের সোসাইটির সমস্যাটাই এখানে। আমরা সব সময় সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে চিন্তা করি। আরে বাবা প্রেমটা তো প্রেমই। প্রেমের আবার পরিণতি থাকতে হবে কেন? সম্পর্কের আগে অবশ্যই মানুষ চিন্তা ভাবনা করে সম্পর্কে জড়াবে না। কারণ এটা মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে হয়ে যায়। কারো সাথে জোর করে তো সম্পর্ক হয় না।’
কথাগুলো বলেছে কুঞ্জ। সুশ্রী, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কুঞ্জ অবশ্য বাস্তব কোনো চরিত্র নয়। একটি উপন্যাসের চরিত্র। উপন্যাসটির নাম ‘প্রেম যমুনার মাতাল হাওয়া’। এর লেখক মাহবুব নাহিদ।
কুঞ্জ বাস্তবে বিচরণ না করলেও আধুনিক সময়ের নাগরিকদের মনের এক জটিল জিজ্ঞাসাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই যে ‘প্রেমের আবার পরিণতি থাকতে হবে কেন?’ কিংবা বিয়ের পরও প্রেম থাকে কি না-এ সংকট অনেকের বেঁচে থাকাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
উপন্যাসেও কুঞ্জকে আমরা পাই বিপন্ন অবস্থায়। সৌহার্দ্যের সঙ্গে তার প্রেমের পর বিয়ে হলেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
আমাদের সমাজে বিয়ের পর সেপারেশনে থাকা একজন নারীকে কী যন্ত্রণা পোহাতে হয় তার উদাহরণ এই কুঞ্জ। ঘরের মা থেকে শুরু করে সমাজের নানা অংশের মানুষ তাদের জীবন বিষিয়ে তোলে।
‘বিষ’ দিয়ে শুরু হয় মাহবুব নাহিদের উপন্যাস ‘প্রেম যমুনার মাতাল হাওয়া’। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের হাসি, কষ্ট, রাগ, অভিমান নিয়ে শুরু হওয়া উপন্যাসটি এগিয়ে যেতে থাকে কুঞ্জকে কেন্দ্র করে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কুঞ্জ সৌহার্দ্যের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর এক বান্ধবীর বাবার রিসোর্টে কাজের অফার পায়। তবে পরিবারের নির্দেশে একা শ্রীমঙ্গলে যাওয়া হয় না তার। বোন বৃন্তকে সঙ্গে নিতে হয়। এই বৃন্ত খুব মজার এক চরিত্র উপন্যাসে। নিজের দুষ্টু বুদ্ধি দিয়ে পরিবারের সব মুশকিল আসান করে সে।
শ্রীমঙ্গলে কুঞ্জর সঙ্গে দেখা হয় দিহানের। দিহানও মজার একটি চরিত্র। ক্ষণে ক্ষণে পাঠককে হাসাতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। দিহানের আচরণে কুঞ্জ মাঝে মাঝে রেগে যায় আবার হেসেও দেয়।
তাদের দুজনের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হওয়ার সময়ে রিসোর্টে এসে হাজির সৌহার্দ্য। উপন্যাসের শুরু থেকে যে কষ্ট কুঞ্জর মনকে আবদ্ধ করে রাখছিল, পাঠকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এখানে এসে।
এরপর এক বৃষ্টির দিনে কুঞ্জ আর সৌহার্দ্য দেখা থেকে শুরু করে প্রেমের ঘটনা জানা যায়। আধুনিক মনস্ক দুটি ব্যক্তি কত যে টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যায়! তারপর তাদের যখন সংসার হয়, যতই প্রেম থাকুক, দুজন মানুষ যখন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতে শুরু করে-তখন তাদের একে অপরের অন্য রূপ দেখতে পায়। যেমন সৌহার্দ্য বলে, ‘আমরা পুরুষ মানুষ ভারী অদ্ভুত এ বুঝলে। তুমি হয়তো জান না। প্রায় প্রত্যেক পুরুষের মাঝেই এক ধরনের অচেনা সত্তা বাস করে। ভয়ংকর সত্তা। অবচেতন মনে এরা ভয়ংকর কল্পনায় মেতে ওঠে। অথচ নিজেও সেটা কোনো দিন টের পায় না। তুমি সেই রূপ দেখেছ তাই তোমার কাছে আমার অপ্রকাশ্য আর কিছুই নেই। তুমি যদি শাস্তিস্বরূপ আমাকে আজীবন দূরে সরিয়ে রাখতে চাও, রাখতে পারো। কিন্তু বিশ্বাস করো কুঞ্জ, আমরা দুজন দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসি। আমরা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারব না। অযথা এই শাস্তি নিজেকে দিও না।’
কুঞ্জও যেমন ভাবে, ‘প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে গেলো কুঞ্জ। পুরুষ মানুষ এমনও হয়! এ আবেগের নাম কি দেবে সে? তার নিজের একজন ইস্পাতের মতো কঠিন পুরুষ মানুষ আছে। সেই মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত এই পুরুষ মানুষটি। তার মানুষটা উদাসীন, প্রিয়তমা ও সংসারের বাইরে ভিন্ন একজন মানুষ। আর দিহান, প্রচণ্ড সংসারীমনা, প্রিয়তমাকে ভালোবেসে সর্বক্ষণ নিজের উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ধরনের একজন। জগতে কত অদ্ভুত প্রজাতির মানুষ বাস করে তা বোঝা মুশকিল।’
শেষ পর্যন্ত কুঞ্জ ভাবে, ‘ভালোবাসা এমন একটা অসহ্য বিষয়, না একেবারে ছেড়ে থাকা যায়, না পুরোপুরি নিয়ে থাকা যায়!’
একটি সরল উপন্যাসে জীবনের জটিল দিকটি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন মাহবুব নাহিদ। তার উপন্যাসে এমন একটি মেসেজ আছে যা বিয়ে বিচ্ছেদ, সম্পর্কের টানাপোড়েনের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কী সেই মেসেজ তা অবশ্য পাঠককে পড়েই জানতে হবে।
বইটি প্রকাশ করেছে দাঁড়িকমা, প্রচ্ছদ করেছেন সাদিতউজ্জামান। ৮০ পৃষ্ঠার বইটির দাম ২৫০ টাকা।
রাজধানীর বনানীর একটি ক্লাবে গোপন বৈঠক চলাকাল বিএনপির ৫৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
রোববার (১৯ মার্চ) রাতে তাদের আটক করা হয়। সোমবার (২০ মার্চ) সকালে এই তথ্য জানিয়েছেন বনানী থানার ডিউটি অফিসার এসআই সিদ্দিক।
তিনি জানান, রোববার রাতে বনানী ক্লাবে গোপন বৈঠকে রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনা করছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে রাত একটার দিকে সেখানে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরে ৫৪ জনকে আটক করা হয়।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলার বিএনপির নেতৃবৃন্দ বনানী ক্লাবে গোপন বৈঠক করছে বলে খবর আসে পুলিশের কাছে। পরে ক্লাবটিতে অভিযান চালানো হয়।
আটকদের বিরুদ্ধে বনানী থানায় রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনার মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাই প্রতিটি সেক্টরকে উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কারণ সরকারের একার পক্ষে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
সোমবার (২০ মার্চ) সরকারি বাসভবন গণভবনে রপ্তানি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ১১তম সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার কথা বিবেচনা করে নতুন দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি নীতি প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালের পর যখন আমরা এলডিসি থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হব, আমরা কিছু সুযোগ পাব... আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং দেশের আরও উন্নয়ন করতে আমাদের সেই সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন যে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর লক্ষ্য হবে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগাতেও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে থাকায় বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সামগ্রী আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে আমরা খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি করতে পারতাম। আমরা এর জন্য উদ্যোগ নিতে পারি।তিনি বলেন, দেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন এবং সেসব পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার রপ্তানি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে। তিনি বলেন, ভারত গ্রহণের পর, আমরা এক বছরের ভিত্তিতে নীতির পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি নীতি প্রণয়নের পদক্ষেপ নিয়েছি। অর্জনগুলো ধরে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, সরকার ২০২৪ (২০২১-২০০৪) পর্যন্ত রপ্তানি নীতি প্রণয়ন করেছে।...কিন্তু এর পর আমরা কী করব? এরই মধ্যে, আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছি। আমি মনে করি আগামী দিনে আমরা কী করব বা আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব তা বিবেচনা করার এটাই সঠিক সময়।
তিনি বিশ্বব্যাপী বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার কথা মাথায় রেখে অর্থনীতির জন্য পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নির্ধারণের ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, আমাদের সারা বিশ্বে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আমাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে, আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নতুন আইটেম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি খাতের উন্নয়নের জন্য একটি কৌশল গ্রহণ করতে হবে এবং পণ্য চিহ্নিত করতে হবে। এজন্য আমরা একটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি-২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে।
প্রধানমন্ত্রী আইসিটি এবং ডিজিটাল ডিভাইস, আরএমজি, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা ও মাঝারি ওজনের শিল্প, মোটরযান এবং ইলেকট্রনিক মোটর গাড়ির কথা উল্লেখ করে পণ্য বৈচিত্র্যের কথা বলেন।
তিনি বলেন, সরকার দেশ-বিদেশের বিনিয়োগ নিয়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানান তিনি।
দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির (জাপা) ভেতর বিভক্তি আবারও প্রকট হয়ে উঠছে। আজ সোমবার পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে সেই বিভাজন ও দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এরশাদের স্ত্রী, পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং এরশাদের ভাই ও পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আলাদা কর্মসূচি নিয়েছেন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জন্মদিন পালন করছেন দুপক্ষের নেতাকর্মীরা। কেউ কাউকে আমন্ত্রণ জানাননি। এমনকি যৌথভাবে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালনে কোনো উদ্যোগও নেয়নি কোনোপক্ষ।
জাপায় অভ্যন্তরীণ বিভাজন এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দুপক্ষের শীর্ষনেতারা পরস্পরকে দলের ‘কেউ না’ বলেও মন্তব্য করেছেন। জিএম কাদেরপন্থিরা বলছেন, তাদের অংশই পার্টির মূল। রওশন এরশাদের সঙ্গে যারা আছেন, তারা পার্টির কেউ না। আবার রওশনপন্থিদের অভিমত, পার্টির মূলধারার নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে আছেন। সুতরাং তারাই জাপার মূল অংশ। এই পক্ষ জিএম কাদেরপন্থিদের ‘প্রতারক’ বলেও মন্তব্য করেছেন ও কাদেরপন্থিরা তাদের ‘কেউ না’ বলে জানিয়েছেন।
৯৪তম জন্মদিন আজ : আজ পালিত হচ্ছে এরশাদের ৯৪তম জন্মদিন। ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ কুড়িগ্রাম শহরের ‘লাল দালান’ বাড়িখ্যাত নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাবেক এ রাষ্ট্রপতি ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান ১৯৫২ সালে। ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত দল জাপার প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন। বিরোধী দলের লাগাতার আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। এরপর গ্রেপ্তার হয়ে ছয় বছর কারারুদ্ধ ছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক কীর্তি গড়েছেন এরশাদ। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারাগারে থাকাকালীন ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে জয়ী হন। এরশাদের হাতে গড়া জাপা এখন সংসদে প্রধান বিরোধী দল। দশম জাতীয় সংসদেও প্রধান বিরোধী দল ছিল জাপা। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এরশাদ।
পরস্পরকে অস্বীকার দুপক্ষের : পৃথকভাবে জন্মদিন পালনের ব্যাপারে জিএম কাদেরপন্থি জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পার্টির পক্ষ থেকে আমরা জন্মদিন পালন করছি। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল (আজ সোমবার) জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্যারের (এরশাদ) প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও বিকেল ৩টায় বনানী কার্যালয়ে কেক কাটব। আর স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে ২২ মার্চ আলোচনা সভা হবে। সেখানে কাদের সিদ্দিকীসহ আরও কয়েকজন অতিথি অংশ নেবেন।’
এরশাদের জন্মদিন উপলক্ষে রওশনপন্থিদের কর্মসূচির ব্যাপারে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘ম্যাডামের পক্ষ থেকে তার বাসভবনে পারিবারিকভাবে মিলাদের আয়োজন করেছে। তারা একসঙ্গে জন্মদিন পালনের কোনো আলাপ-আলোচনা জাপার কারও সঙ্গে, বিশেষ করে আমার সঙ্গে করেনি।’
পৃথক এ জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ব্যাপারে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘পার্টির বাইরে কেউ কিছু বললে আমাদের বলার কিছু নেই। তারা পার্টির কেউ কিছু না।’
কিন্তু রওশনপন্থি জাপার নেতা ও এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু স্যার জীবিত নেই, ম্যাডাম জীবিত আছেন, তাই তার বাসায় একটা কোরআন তেলাওয়াত দোয়ার আয়োজন করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আছি। জিএম কাদের আমাদের কোনোদিন ডাকেন না। সুতরাং আমরা তো স্বাভাবিকভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালন করব।’
কাদেরপন্থি জাপার ব্যাপারে এ নেতা বলেন, ‘পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হয়েছিল জানুয়ারিতে। ওই অনুষ্ঠানটা একসঙ্গে করার কথা ছিল। এর জন্য একটা যৌথ বিবৃতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানে দেখা গেল, একটা প্রতারণা করে জিএম কাদেররা শুধু ম্যাডামকে নিয়ে গেছেন। আমাদের মঞ্চে আনুপাতিক হারে আসন দেবে বা কোথায় বসবে, সেটা আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। তাদের এখন আমরা প্রতারক হিসেবে জানি। ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য হবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।’
দুপক্ষের পৃথক কর্মসূচি : জন্মদিন উপলক্ষে জিএম কাদেরপন্থি জাপা সকাল ১০টায় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইল চত্বরে এরশাদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। এ ছাড়া আগামীকাল বুধবার বিকেল ৩টায় কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মাল্টিপারপাস হলে আলোচনা সভা রয়েছে। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন জিএম কাদের। জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি-০২ খন্দকার দেলোয়ার জালালী এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচির তথ্য জানান।
অন্যদিকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, আজ বেলা ১১টায় গুলশানের ৬৭ নম্বর সড়কের ৪/১-এ বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবনে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বিশেষ দোয়া ও কেক কাটার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ প্রধান অতিথি হিসেবে এবং এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ এমপিসহ পার্টির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া স্বাধানীতা দিবস উপলক্ষে ২৭ মার্চ আলোচনা সভা, দোয়া ও ইফতার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়েছে : গত বছর নভেম্বরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ দলের ভেতর ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগও নিতে দেখা গেছে এরশাদের ছোটভাই ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে। এরই অংশ হিসেবে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপার নেতারা রওশন এরশাদের সঙ্গে কয়েক দফা দেখা করেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনায় বেশ কিছু অঙ্গীকারও করেন।
ঐক্যের অংশ হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে ১ জানুয়ারি জাপার ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন করা হয়। প্রায় চার বছর পর ওই অনুষ্ঠানে একমঞ্চে পাশাপাশি বসেন দেবর-ভাবি কাদের-রওশন। এমনকি টানা ১১ মাস পর সেদিন পার্টির কোনো অনুষ্ঠানে সশরীরেও যোগ দেন রওশন এরশাদ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দলের এক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে মঞ্চে ছিলেন এ দুই নেতা।
জাপা নেতরা জানান, জানুয়ারির পর দুপক্ষের মধ্যে আর কোনো ধরনের সমঝোতা বা ঐক্যের আভাস পাওয়া যায়নি। বরং জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে রওশনপন্থি দুই নেতার মামলার কারণে দেবর-ভাবির সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। সেই অবনতির সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে দেখা দেয় এরশাদের জন্মদিন।
এ ব্যাপারে রওশনপন্থি নেতারা দেশ রূপান্তরকে জানান, জিএম কাদের গত ৬ মার্চ এরশাদের জন্মদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সেই কর্মসূচির ব্যাপারে রওশন এরশাদকে কিছুই বলেননি। জিএম কাদের ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করতে রাজি না। উনি বিভাজন রেখেই যাচ্ছেন।
দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে জানিয়ে রওশনপন্থি শীর্ষ নেতারা জানান, রওশনপন্থি জাপা ইতিমধ্যেই দেশের ৫২ জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। এসব জেলায় যারা পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন ও এরশাদের সময় থেকে পার্টির সঙ্গে আছেন, জিএম কাদের তাদের বাদ দিয়ে নিজের লোকজনদের নিয়ে কমিটি করেছেন। মূলধারার লোকজনদের বাদ দিয়ে রাজনীতি করছেন। এরই অংশ হিসেবে সর্বশেষ ১৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহ্বায়ক কমিটির তথ্য জানানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রওশনপন্থি এক নেতা বলেন, রওশন এরশাদ আবারও জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রোজার পর থেকে সম্মেলনের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। ২৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি সম্মেলন স্থগিত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে পারেন। সম্মেলন হবে।
জিএম কাদেরের মামলার ব্যাপারে রওশনপন্থি নেতারা বলেন, আমরাও চাই মামলা থেকে জিএম কাদের অব্যাহতি পাক। সে জন্য আমরা নতুন করে আপিল করিনি। আপিল করেও ঝুলিয়ে রেখেছি। উনি যদি সোজা পথে আসেন তাহলে মামলাটা শেষ করব। কিন্তু উনি সেটা চাইছেন না বলে আমরাও সময়ক্ষেপণ করছি। আমরা ওনাকে সুযোগ দিচ্ছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) হল দখল, উন্নয়নকাজের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী ও সাংবাদিক হেনস্তাসহ নানা বিশৃঙ্খলায় অছাত্র ও বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের নাম আসছে বারবার। সেই সব অছাত্র, বহিষ্কৃত ও বহিরাগতদের ক্যাস্পাস ত্যাগের নির্দেশ দিলেও তারা এখনো বহাল।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বোর্ড অব রেসিডেন্স, হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ১৫ মার্চের মধ্যে ছাত্রত্বহীন ও বহিরাগতদের আবাসিক হল ও ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি; বরং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তরও পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে ক্যাম্পাসের পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখতে রাতে অভিযান চলমান আছে বলে জানিয়েছেন সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিয়মিত রাতে অভিযান চালানো শুরু করেছি। ক্যাম্পাসে বহিরাগত লোকজনকে আমরা সতর্ক করে দিচ্ছি। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতে দেখলেই আমরা তাদের সতর্ক করে দিই, যেন তারা অকারণে ঘোরাঘুরি না করে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যারা হলে আছেন ও যারা বহিষ্কৃত, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাই প্রশাসন তাদের ক্যাম্পাস ত্যাগের নির্দেশনা দিলেও সেটা বাস্তবায়নে উদাসীনতা দেখাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে যারা অছাত্র আছে, তাদের হাত ধরেই অধিকাংশ অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে অনিরাপদ। আবার যেসব জুনিয়র শিক্ষার্থী বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও এই অছাত্ররাই নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ, উপগ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ, উপাচার্যের কক্ষ ভাঙচুর, শিক্ষক প্রার্থীকে মারধর, হল দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী হেনস্তা, সাংবাদিক হেনস্তাসহ ইত্যাদি ঘটনায় সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। অধিকাংশ ঘটনায় জড়িত বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে বেশির ভাগ ছাত্রলীগ নেতার ছাত্রত্ব নেই। এতে ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই সংকট কাটাতে অছাত্র ও বহিরাগতদের ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও আবাসিক হলগুলো ছাড়েনি তারা। অংশ নিচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এমনকি বোর্ড অব রেসিডেন্স, হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনের সদস্য সচিব ও প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার তার দায়িত্ব গ্রহণের সময় ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে অনেক অছাত্র ও বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ বলেন, ‘সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে না পেরে প্রশাসনিক দেউলিয়াত্বের পরিচয় দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করা তাদের ব্যর্থতা।’
প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে লোক দেখানো বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী।
তবে সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলেছেন আরেক সহকারী প্রক্টর সৌরভ সাহা জয়। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো প্রক্টরিয়াল বডি নতুন নিয়োগ পেয়েছি। আমরা এ বিষয়ে অবগত আছি। তবে আমরা কিছুটা সময় নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এ বিষয়টির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব। কারণ, এতে অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয় প্রয়োজন।’
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।