
বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আনতেই হবে সরকারকে এ অবস্থান নিয়েছে বিদেশিরা। কোন পথে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে হবে তা নিয়ে সরকারকে বিদেশিরা সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন দেয়নি। অন্যদিকে বিএনপির প্রতিও তাদের বার্তা নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি নির্বাচনের ছয় মাস আগে সরকারকে নির্বাচনী রোডম্যাপ পরিষ্কার করতে বিদেশিদের কৌশল নিতে অনুরোধ করেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে সরকার যেমন বিএনপিকে বাইরে রেখে আগামী সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে পারবে না। তেমনি বিএনপিও নানা কারণে নির্বাচনের বাইরে থাকতে পারবে না। তাই সরকারকে যেমন নমনীয় অবস্থানে দেখা যাচ্ছে, তেমননি বিএনপির মধ্যেও ভাবনা-চিন্তার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিদলীয় একাধিক সূত্রে দুই দলের ওপর বিদেশিদের চাপ থাকার বিষয়টি জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শক্তিগুলো সুনির্দিষ্ট করে কোনো পথ এখন পর্যন্ত বাতলে দেয়নি। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের বাইরে যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারেও তারা কোনো কথা বলেনি। নির্বাচনকেন্দ্রিক উদ্ভূত রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান হয়েছে বিদেশিরা সেটা দেখতে চায়।
ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, বিএনপিকে তারাও নির্বাচনে আনতে চান। তবে বিএনপির দাবির কাছে নতি স্বীকার করে নয়। এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থান হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়ে যাচ্ছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। সেই নিশ্চয়তাকে আমলে নিতে হবে বিএনপির। বিএনপির দাবি, সংবিধানের বাইরে গিয়ে হলেও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। সেই ক্ষেত্রে সংবিধানের বাইরে এক চুলও সরবে না সরকার এমনটাই এখন পর্যন্ত বলে আসছেন সরকারের মন্ত্রীরা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ‘সাপও মরতে চায়, আবার লাঠিও ভাঙবে না’ এ নীতি অনুসরণ করতে চায়। কিন্তু কোন পথে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটাবে, তা এখনো খুঁজে পায়নি ক্ষমতাসীনরা।
দলটির সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতেই হবে বিদেশি এ অবস্থান টের পেয়ে সংলাপের ব্যাপারে আগ্রহ আছে জানিয়ে আওয়ামী লীগ এক ধাপ এগিয়েছে।
গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসেছেন। দেশের রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের তৎপরতাও বেশ চোখে পড়ছে। তারা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাশাপাশি সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ভারত ছাড়া প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রদূতরা সব দলের অংশগ্রহণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে চান বলে জানিয়েছেন।
উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর কাছ থেকে এমন ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে, কোনো দলের ভগ্নাংশ নির্বাচনে এলেও হবে না, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রমাণ করতে সব দলকেই আনতে হবে নির্বাচনে। তাদের এ চাওয়া কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব, সেটাই চিন্তা করতে শুরু করেছে সরকার। সাজা স্থগিত হওয়ায় খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে না পারলেও রাজনীতি করতে পারবেন আইনমন্ত্রী নিয়মিত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তবে দলের নেতা ও সরকারের অন্য মন্ত্রীরা উল্টো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
হঠাৎ উদয় হওয়া খালেদা ইস্যুতে আলাদা আলাদা বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিষয়ে আওয়ামী লীগ একেবারেই নেতিবাচক। আর বিএনপি এখন তারেকের হাতের মুঠোয়। তার হাত থেকে বিএনপিকে বের করে আনতে খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেনএমন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা করছে রাজনৈতিক মহল। এ ব্যাপারে বিএনপির মনোভাব বোঝার পাশাপাশি রাজনৈতিক চাপে ফেলার জন্য খালেদা জিয়াকে পুনরায় কারাগারে পাঠানো সহজ হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আওয়ামী লীগের এমন একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা, গণতন্ত্র হুমকির পাশাপাশি তাদের বড় বিনিয়োগের ক্ষতিসাধন হবে। তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকা- চলমান রয়েছে। বিদেশিদের এমন অবস্থান ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা বিএনপিকেও জানিয়েছে বিদেশিরা। বাংলাদেশ সফরে আসা বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপির আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক না হলেও কূটনীতিকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিষয়টি তাদের জানানো হয়েছে।
বিএনপিকে নির্বাচনে আনতেই হবে উন্নয়ন সহযোগীদের এমন অবস্থানে আওয়ামী লীগের ভেতরে উদ্বেগের কথা উঠে এলেও এই মূহূর্তে পর্দার অন্তরালের থাকা বিষয় নিয়ে প্রকাশ্য কোনো বক্তব্য দিতে চান না ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। উন্নয়ন সহযোগীদের অনুরোধ নিয়ে দলটির সভাপতি ও সম্পাদকমন্ডলীর একাধিক নেতা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজনীতিতে সব সময় সংলাপের সম্ভাবনা আছে।’ তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীরা সংলাপ নিয়ে কোনো পরামর্শ আওয়ামী লীগকে দেয়নি। তবে তারা চায় আগামী নির্বাচন যাতে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, সংলাপ কখন ও কীভাবে হবে তা সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।
শুধু আওয়ামী লীগের ওপরই নয়, নির্বাচনে আসতে হবে- বিদেশিদের এমন চাপ রয়েছে বিএনপির ওপরও। বিএনপির সঙ্গে কূটনীতিকদের একাধিক বৈঠকে এ চাপ দেওয়া হয়েছে। কোন পথ অনুসরণ করে তারা আসবে, সে ব্যাপারে বিএনপিকে সুনির্দিষ্ট কোনো পরামর্শ দেয়নি বিদেশিরা। তবে বিএনপি মনে করছে, সম্প্রতি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা ও বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীদের মন্তব্য তাদের আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা।
দলটি বলছে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে তারা কোনো সংলাপেও বসবেন না।
গত মঙ্গলবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও জ্যেষ্ঠ এক নেতা মন্তব্য করেছেন, ‘সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য তাদের কাছ থেকে আরও আসবে। এসব কথার প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
সংলাপ হলে কীভাবে এগোবে, তা নিয়ে অন্যদের মতো বিএনপির নেতাদেরও বড় ধরনের কৌতূহল রয়েছে। রাজনৈতিক মহলে এরই মধ্যে পর্দার আড়ালে সংলাপের গুঞ্জন চাউর হলেও বিএনপি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চায় না।
দলটির তৃণমূল থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত সবাইকে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে, সংলাপের নামে চায়ের আসর বা আসন ভাগাভাগির মতো কোনো প্রস্তাবে সমঝোতা হবে না। কেননা, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের তৎকালীন রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার চেষ্টাও সফল হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও সংলাপ হয় গণভবনে। ফল হয়েছে উল্টো।
বিএনপির বরং নির্বাচনের ছয় মাস আগে সরকারকে নির্বাচনী রোডম্যাপ পরিষ্কার করতে বিদেশিদের কৌশল নিতে অনুরোধ করেছে। দলটির একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে থাকা বিদেশি দপ্তরগুলোতে গত বছর চিঠি দিয়ে এই অনুরোধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের পর সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে নির্বাচনের অন্তত ৬ মাস আগে নির্বাচনী রোডম্যাপ পরিষ্কার করতে সরকার যাতে বাধ্য হয়, সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে বিএনপি।
ওই চিঠিতে বলা হয়, সরকার কি বর্তমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন করবে, নাকি সব দলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চায়, সেটি যেন তারা পরিষ্কার করে। বিএনপি যে বিদেশি দপ্তরগুলোতে চিঠি দিয়েছে তা নিয়ে চলতি মাসের শুরুতে অভিযোগ করেছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, ‘শুধু জাপানকে কেন আমরা তো চিঠি দিয়েছি বহু দেশকে। এটা সত্য।’
চিঠি তৈরি ও বিদেশি মিশনগুলোতে পাঠানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে য্ক্তু বিএনপির দুজন নেতা দেশ রূপান্তরকে জানান, নানা বিষয়ের পাশাপাশি আগামী দ্বাদশ নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে ওই চিঠিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা জানান, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ আরেকটি একতরফা সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে টানা ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না; বরং বিরোধী দলের ওপর মামলা, নির্যাতন, কর্মসূচিতে বাধার হার আরও বেড়েছে।
ঈদুল ফিতরের পর সংলাপ হতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে। তবে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এ বিষয়ে স্পষ্ট করেনি। সমঝোতা ছাড়াই সরকার একতরফা নির্বাচনের ব্যবস্থা নিলে সে ক্ষেত্রে কী হবে? বিএনপির নেতারা মনে করছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই সরকার যত বেশি সম্ভব দলগুলোকে নানা পন্থায় নির্বাচনে আনার প্রচেষ্টা চালাবে। সেটি আমলে নিয়ে বিএনপি মাঠে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালনে মনোযোগী। মার্চ মাসের পর সমঝোতার দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলে আন্দোলনকে নতুন পর্যায়ে নিতে কাজ করবেন তারা। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, সেটির ওপর ভিত্তি করেই তাদের নির্বাচনী পদক্ষেপ পরিচালিত হবে বলে মনে করছেন জ্যেষ্ঠ নেতারা।
জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সংলাপ নিয়ে সরকার ও তার দলের লোকেরা যেসব কথা বলছে, সেটা আমরা আমলেই নিচ্ছি না। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো না। আমাদের কথা একেবারেই স্পষ্ট। আমরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। সরকার সেটার ব্যবস্থা না করলে আমাদের আন্দোলন চলমান আছে, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে।’ বিদেশি মিশনগুলোতে বিএনপি চিঠি দিয়েছে এমনটি জানিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানবাধিকার, হত্যা-গুম-খুনসহ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তাতে উল্লেখ রয়েছে।
বিদেশিদের চাপ বিএনপির ওপর নেই দাবি করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশিরা বাংলাদেশের জনগণের দাবির পক্ষে কথা বলছে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফেরত পেতে চায়। স্বাভাবিক জীবনযাপনের গ্যারান্টি চায়।’
বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির দায়িত্বে থাকা এই নেতা আরও বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলের চিত্র চিঠির মাধ্যমে বিদেশিদের আমরা জানিয়েছি। সরকারের অপকর্ম তুলে ধরে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি।’
পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বাধার মধ্য দিয়ে জেলা পর্যায়ে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল শনিবারের এই কর্মসূচি ঘিরে বেশ কয়েকটি জায়গায় দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব সহিংসহতায় কমপক্ষে ৪০ জন আহত এবং বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের ৪১ নেতাকর্মীকে আটকের খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে বিভিন্ন জেলায় দলের পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলার অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার বিএনপির গণআন্দোলনে ভীত হয়ে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলা, গুলি ও নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। বিস্তারিত প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে :
কুমিল্লায় পুলিশের টিয়ারশেল, ফাঁকা গুলি ও লাঠিপেটা : কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির পদযাত্রায় পুলিশ বাধা দিয়ে টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ার পাশাপাশি লাঠিপেটা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। গতকাল বিকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খাদঘর ও চান্দিনা এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে। বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গোমতা এলাকায় পদযাত্রা কর্মসূচির আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হাবিবুন নবী খান সোহেল। কিন্তু ওই স্থানে পুলিশ কর্মসূচি পালনের অনুমতি না দেওয়ায় তারা চলে আসেন মহাসড়কের খাদঘর এলাকায়। সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে পদযাত্রা শুরু করলে পুলিশ আবারও বাধা দেয়। তখন পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের বাগ্বিত-া শুরু হলে এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা এবং টিয়ার শেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে। এতে ২০ নেতাকর্মী আহত হন।
কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মো. শাহজাহান মোল্লা বলেন, ‘পুলিশ বিনা উসকানিতে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ এবং গুলিবর্ষণ করে।’
তবে চান্দিনা থানার ওসি শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘বিএনপি নেতাকর্মীরা মহাসড়কে নাশকতার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় তাদের ইটপাটকেলে আমাদের দুজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।’
ঝালকাঠিতে সংঘর্ষ, আটক ১৬ : ঝালকাঠিতে পদযাত্রা ঘিরে সংঘর্ষে পুলিশ সদস্য ও বিএনপির ১৪ জন আহত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় সদর থানার ওসিসহ ছয় পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। আর জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলায় তাদের অন্তত ৮ নেতাকর্মী আহত হয়েছে। তবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে পুলিশের ওপরে হামলার অভিযোগে জেলা যুবদলের সদস্য সচিবসহ ১৬ কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় শহরের আমতলা সড়কে পদযাত্রা কর্মসূচি শেষে এসব ঘটনা ঘটে।
বিএনপির নেতাকর্মীদের দাবি, কর্মসূচি শেষে তারা দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। এ সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাদের কার্যালয়ে হামলা চালায়। এতে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ হোসেন এবং সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাৎ হোসেনসহ ৮ নেতাকর্মী আহত হয়।
বাগেরহাটে কেন্দ্রীয় নেতাসহ গ্রেপ্তার ২৫ : বাগেরহাটে পদযাত্রা কর্মসূচি থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ অন্তত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে বিএনপি’র অভিযোগ পদযাত্রা কর্মসূচি থেকে অন্তত ৪০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় বাগেরহাট প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শেখ ওবায়দুল ইসলাম এই দাবি করেন। অন্যদিকে প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে পদযাত্রা কর্মসূচি থেকে শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। এর আগে সকাল ১০টার দিকে শহরের মুন্সীগঞ্জ এলাকায় জেলা বিএনপি’র কয়েকশ নেতাকর্মী জড়ো হয়ে পদযাত্রা শুরু করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। পরে সেখান থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান, বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এ টি আকরাম হোসেন তালিম ও সাবেক সভাপতি এম এ সালাম। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘একই সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিএনপিকে আজকের কর্মসূচি স্থগিত রাখতে বলা হয়। কিন্তু বিএনপি পুলিশের নির্দেশনা উপেক্ষা করে পদযাত্রা বের করে। এই পদযাত্রাটি ছিল মারমুখী। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায় সেখানে অভিযান চালিয়ে ২০-২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
পটুয়াখালীতে পদযাত্রায় পুলিশের ধাওয়া : পটুয়াখালীতে পদযাত্রায় ধাওয়া ও লাঠিচার্জ করে ব্যানার ফেস্টুন কেড়ে নেয় পুলিশ। সকালে কলেজ রোডে জেলা বিএনপি’র কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে পদযাত্রা শুরু করে বিএনপি। পদযাত্রাটি পৌরসভা মোড়ে যাওয়ার পথে পুলিশ পেছন থেকে ধাওয়া ও লাঠিচার্জ করে নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ঘটনায় ৬ নেতাকর্মী আহত হওয়ার দাবি করেছে জেলা বিএনপি। সদর থানার ওসি মনিরুজ্জামানের দাবি, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পদযাত্রা বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
এদিকে বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শহরে মোটরসাইকেল বহর নিয়ে শোডাউন করে ছাত্রলীগ। অন্যদিকে ‘বিএনপি-জামায়াত অশুভ শক্তির সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্রমূলক অপরাজনীতির’ বিরুদ্ধে পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করে।
নীলফামারীতে আ. লীগ-বিএনপি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া : নীলফামারীতে একই সময়ে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ ও বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের পৌর সুপার মার্কেটের সামনে শান্তি সমাবেশ শুরু করে জেলা আওয়ামী লীগ। একই সময়ে ৫০ গজ দূরে ওই মার্কেটে জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে তৈরি করা মঞ্চে পদযাত্রার জন্য সমবেত হয় জেলা বিএনপির একাংশের নেতৃবৃন্দ। নেতৃত্ব দেন জেলা বিএনপির সভাপতি আ খ ম আলমগীর সরকার। উভয় দিক থেকে পাল্টাপাল্টি সেøাগানে উত্তেজনা সৃষ্টির এক পর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ সরকারসহ কয়েকজন যুবক বিএনপির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়ে সেখানে টাঙানো ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে চেয়ার ভাঙচুর করে। তখন উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফেনীতে পদযাত্রা পুলিশের বাধা : ফেনী শহরের বড় মসজিদের সামনে থেকে শুরুর পর পুলিশের বাধায় প্রায় ২০০ গজের মাথায় প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়েই শেষ হয়ে যায় পদযাত্রা। পরে বড় বাজারের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সমাবেশ করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সংক্ষিপ্ত পদযাত্রার জন্য পুলিশকে দায়ী করেছেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল। এদিকে রাজপথে ছিল যুবলীগ। সকালে পৌরসভার সামনে শান্তি সমাবেশ করে জেলা যুবলীগ নেতাকর্মীরা। সমাবেশের আগে একটি মিছিল ফেনী শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
মির্জা ফখরুলের প্রতিবাদ : বিভিন্ন জেলায় দলের পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলা হয়েছে অভিযোগ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিএনপির গণআন্দোলনে ভীত হয়ে দলের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলা, গুলি ও গ্রেপ্তার করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় জড়িয়ে নির্যাতন-নিপীড়নের পন্থা অবলম্বন করেছে। এর একমাত্র লক্ষ্যই হচ্ছে দেশের মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত রেখে আবারও প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও তাদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালিয়ে চলমান গণআন্দোলনকে দমন করা যাবে না। মানুষ এখন জেগে উঠেছে। অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না ঘটিয়ে জনগণ ঘরে ফিরে যাবে না।’
প্রতিবেদনটি নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা এবং সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিদের তথ্যে তৈরি
‘বিএনপি জনগণের কল্যাণ চায় না। তারা মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। আর আওয়ামী লীগ মাটি ও মানুষের দল, জনগণের কল্যাণে কাজ করে। তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো তুলনা হতে পারে না।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শনিবার বিকেলে কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের তালিমপুর তেলিহাটি (টিটি) উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির গঠনতন্ত্রেই আছে সাজাপ্রাপ্ত আসামি দলের নেতা হতে পারে না। আর বিএনপি একজন নেতাও কি পায় না, যে অন্তত সাজাপ্রাপ্ত আসামি নন। খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমান দুজনই সাজাপ্রাপ্ত আসামি। খালেদা জিয়ার ছেলে যাকে নেতা বানিয়েছে, সে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা নিজের দলের গঠনতন্ত্র মানে না, নিয়ম মানে না, আইন মানে না, সেই দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা চলে কীভাবে। যারা ওই দুই দল বড় দল বলেন তারা ভুল করেন।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এ দেশের মাটি ও মানুষের সংগঠন। এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দল গড়ে উঠেছে। তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নতি হয়। আর বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা যে দলগুলো আছে, জামায়াত এরা কারা?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়া, সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করেছে। উচ্চ আদালতের রায় আছে। ক্ষমতায় বসে থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে যে দল তৈরি করেছিল সেই দল হচ্ছে বিএনপি। এরা মানুষের কল্যাণও চায় না মঙ্গলও চায় না। এরা মানুষকে আগুন দিয়ে পোড়ায়, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। কাজেই এদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা চলে না। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি এবং স্বাধীনতার সুফল আজ বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাবে ইনশাল্লাহ।
সরকারপ্রধান বলেন, এখানে একটি কথা বলতে চাই, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ৩০০ সিটের মধ্যে মাত্র ৩০টি পেয়েছিল। আর আওয়ামী লীগ মহাজোট করেছিল। তারা পেয়েছিল বাকি সব আসন। তাহলে এই দুই দল এক পর্যায়ের হয় কীভাবে।
বিএনপি সরকারের আমলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, গ্রেনেড হামলা, ৬৩ জেলার ৫শ’ জায়গায় একযোগে বোমা হামলা হয়েছে। দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন তারা। ওরা মানুষকে কিছু দেয়নি, বরং মানুষের অর্থকড়ি সব লুটপাট করে বিদেশে নিয়ে গেছে।
সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ আয়নাল হোসেনের সঞ্চালনায় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র ও স্থানীয় নেতারা।
এর আগে, দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে সমাবেশস্থলে প্রধানমন্ত্রী এসে পৌঁছালে সেøাগান ও করতালির মাধ্যমে সমাবেশে আগত জনতা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। প্রধানমন্ত্রীও হাত নেড়ে এর উত্তর দেন। কোটালীপাড়া উপজেলার শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ মাঠে আগের নির্বাচনী জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী সমাবেশস্থলে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে ৩২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং অপর পাঁচটি প্রকল্পের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত বিধি ভেঙে দুই শিক্ষক নেতাকে সহযোগী অধ্যাপক (গ্রেড-৪) বানাতে নানা আয়োজন করছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকরা হলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের প্রচার, প্রকাশনা ও দপ্তর সম্পাদক সাব্বীর আহমেদ চৌধুরী এবং একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বেরোবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ম-ল আসাদ।
তারা দুজনই আবার নিয়োগসংক্রান্ত প্ল্যানিং কমিটির সদস্য। তারা নিজেরাই নিজেদের যোগ্য ঘোষণা করেছেন। আগামীকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় বাছাই বোর্ডের দিন ধার্য করা হয়েছে।
গতকাল রাতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ কথা বলতে রাজি হননি। জনসংযোগ বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেন তিনি। জনসংযোগ উপপরিচালক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিধি ভেঙে প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ডাকা হয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। প্ল্যানিং কমিটির সদস্যরা ভালো বলতে পারবেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৭ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি বিভাগে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একজন অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে একজন সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগে দুজন সহযোগী অধ্যাপক ও ইংরেজি বিভাগে একজন সহযোগী অধ্যাপকের পদ রয়েছে। গত বছরের ২২ নভেম্বর এসব পদে আবেদনের শেষ সময় ছিল।
সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদনের যোগ্যতা চাওয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও অন্যূন দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসহ পিএইচডি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চার বছরসহ কমপক্ষে সাত বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। এমফিল ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঁচ বছরসহ মোট ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে অভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে একটি শর্ত শিথিলযোগ্য।
জানা গেছে, লোকপ্রশাসন বিভাগের দুটি সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে চারজন প্রার্থী আবেদন করেছেন। তাদের তিনজন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তারা হলেন, লোকপ্রশাসন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. জুবায়ের ইবনে তাহের, মো. আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ এবং সাব্বীর আহমেদ চৌধুরী। বেরোবির শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী তাদের কেউই সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে আবেদনের যোগ্য নন। তবে অভ্যন্তরীণ শিক্ষক পদ আপগ্রেডেশন নীতিমালা অনুযায়ী শুধু জুবায়ের ইবনে তাহের সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদের সর্বসাকল্যে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আট বছর এক মাস নয় দিন এবং সাব্বীর আহমেদ চৌধুরীর মোট চাকরিকাল আট বছর এক মাস আট দিন। তাদের কারোরই পিএইচডি বা এমফিল ডিগ্রি না থাকায় বর্তমান অভিজ্ঞতায় তারা সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদনের যোগ্য হননি। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী শূন্যপদে আবেদন করা অপর প্রার্থী ড. মো. রুহুল আমিন। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তার সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ১২ বছরের বেশি। ২০টি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে তার। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন শাখা থেকে জানা গেছে, প্রার্থীদের মধ্যে যে তিনজন বেরোবির তারা প্ল্যানিং কমিটিরও সদস্য। তারা আবেদনকারী চার প্রার্থীকেই সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে যোগ্য মনোনীত করেছেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টায় বাছাই বোর্ডের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। বোর্ডের সদস্যদের কাছে প্রার্থীদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট পাঠানো হয়েছে।
যোগ্যতা না থাকার পরও কীভাবে প্রার্থী হিসেবে সুপারিশ করা হলো জানতে লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রধান ও প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদকে গতকাল রাতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, শর্ত শিথিল করে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগের ব্যাপারটি জানেন ভিসি অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ। নিয়োগ নির্বিঘ্ন করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিতর্কিত শিক্ষককে বোর্ডের বিশেষজ্ঞ-সদস্য হিসেবে মনোনয়নও দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে তার গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। তিনি আবার আসাদুজ্জামান মন্ডল ও সাব্বীর আহমেদ চৌধুরীর এমফিল প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তাদের প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন।
বেরোবির একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, যোগ্যতা অর্জনের আগেই বিধি ভেঙে দুজন জুনিয়র শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক তাদের জ্যেষ্ঠতা হারাবেন। একাডেমিক ডিগ্রি শিথিল করে শিক্ষক নিয়োগের নজির বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হারুনুর রশীদ খান দুর্বৃত্তের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে শিবপুর থানা সংলগ্ন বাড়িতে ঢুকে তাকে গুলি করে মুখোশ পরা দুর্বৃত্তরা। পরে উপজেলা চেয়ারম্যানকে উদ্ধার করে প্রথমে শিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। তার ওপর হামলার পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ইটখোলা মোড়ে নেতাকর্মীরা অবস্থান নিলে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ৪ ঘণ্টা পর বেলা দেড়টার দিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হারুনুর রশীদ খানের ওপর হামলাকারীদের দ্রুততম সময়ে গ্রেপ্তারের আশ্বাসে অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয় বিক্ষোভকারীরা।
স্বজন এবং অনুসারী দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খানকে গুলি করার পুরো মিশনটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন উপজেলার পুটিয়া ইউনিয়নের পুটিয়া গ্রামের আরিফ সরকার নামে এক ব্যক্তি। জেলা ছাত্রলীগ নেতা মাহিন হত্যা ও একটি অস্ত্র মামলার আসামি এই আরিফ স্থানীয় রাজনীতিতে এলাকার সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঞা মোহনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
এদিকে জেলার রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের বটতলীকান্দী থেকে গতকাল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এক সদস্যের (মেম্বার) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। একই দিনে দুই জনপ্রতিনিধিকে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার দুটি ঘটনায় জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
ছেলে তাপস খান জানান, চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খান গতকাল ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করতে বাড়ি থেকে বের হয়ে মসজিদে যান। নামাজ শেষে শিবপুর থানা থেকে ১০০ গজ দূরে শিবপুর বাজারের বাড়িতে আসেন। তখন তিনজন লোক মসজিদের অনুদানের ব্যাপারে কথা বলতে চান জানিয়ে তার কাছে আসেন। তাদের সঙ্গে কথা বলা শেষে বাড়ির অফিস কক্ষে ঢোকার সময় পেছন থেকে তারা হারুনুর রশীদকে লক্ষ্য করে পরপর ৩টি গুলি করেন। যার সবগুলোই তার পিঠে বিদ্ধ হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে শিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
চেয়ারম্যানের ওপর হামলার ঘটনা জানাজানি হলে তার অনুসারী নেতাকর্মীরা উপজেলার কলেজ গেট মোড়ে ইটখোলা-মঠখোলা আঞ্চলিক সড়কে অবস্থান নেয়। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ইটখোলা মোড়ে নেতাকর্মীরা টায়ার জ্বালিয়ে অবস্থান নিলে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যার প্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ততম এই মহাসড়কের দুই পাশে উপজেলার বরইতলা থেকে কুন্দারপাড়া পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে যাত্রীরা।
পরে দুপুর দেড়টার দিকে জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান এবং পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীমসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে এসে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস ও জনভোগান্তির কথা জানালে তারা মহাসড়ক থেকে অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে চলে যায়। এরপর ধীরে ধীরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
উপজেলার প্রবীণ ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হারুনুর রশীদ খানকে বাড়িতে ঢুকে গুলির ঘটনায় পুরো জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে, মান-অভিমান থাকবে, কিন্তু প্রতিহিংসা থাকবে না। চেয়ারম্যানের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে শিবপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি খোকন ভূঁইয়া বলেন, ‘হারুনুর রশীদ খান আমাদের শিবপুর আওয়ামী লীগের বটবৃক্ষ। তার ছায়াতলে হাজার হাজার নেতাকর্মী রাজনীতি করে। তাকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার নীলনকশা করা হয়েছে। যারাই এই বর্বর হামলার সাথে জড়িত থাক না কেন তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম ভূঁইয়া রাখিল বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক কারণে হামলা নাকি অন্য কোনো কারণে তার ওপর হামলা করা হয়েছে তা আমরা প্রশাসনকে দ্রুত সময়ের মধ্যে খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছি।’
কেন্দ্রীয় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হাসান মাহবুব বলেন, ‘হামলার মদদদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের একটাই দাবি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
স্বজন ও অনুসারী নেতাকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার রাতে পুটিয়ার আরিফ সরকার চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খানকে ফোন করে তার এলাকার মসজিদের জন্য অনুদান চান। চেয়ারম্যান সকালে লোক পাঠানোর কথা বললে আরিফ লোক পাঠান। সেই লোকরাই চেয়ারম্যানকে গুলি করেন। তবে চেয়ারম্যানের ওপর হামলা পরিকল্পনার মিশন গুছিয়ে শুক্রবার রাতেই আরিফ দেশ ছেড়েছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি।
এই আরিফ সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঞা মোহনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হওয়ায় স্থানীয় রাজনীতিতে উত্তাপের সৃষ্টি হয়েছে। চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের অনুসারী অধিকাংশ নেতাকর্মীর দাবি, এমপি মোহনের লোকেরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। নেতাকর্মীদের পাশাপাশি চেয়ারম্যানের স্বজনদেরও একই দাবি।
এদিকে গতকাল সকালে এম জহিরুল হক ভূঞা মোহন গুলিবিদ্ধ চেয়ারম্যানকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলেও দ্রুত ফিরে যান। হাসপাতালে আহত চেয়ারম্যানের চিকিৎসার বিষয়টি দেখভাল করছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, সহসভাপতি ডা. রউফ সরদার, মনোহরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরুসহ অন্য নেতাকর্মীরা।
গুলিবিদ্ধ চেয়ারম্যানের ভাতিজা রাব্বি খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কাকা সবাইকে চিনতে পেরেছেন। তারপর সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে। আমরা চাই দ্রুত সন্ত্রাসীদের আটক করা হোক।’
চেয়ারম্যানের ওপর হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঞা মোহন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সন্ত্রাসীর কোনো অন্য পরিচয় থাকতে পারে না। পুটিয়ার আরিফের কোনো দলীয় পদ নেই। গত ৫ বছরেও আমার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। সে অপরাধী হলে আমি তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। শিবপুরে হারুন খানের যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেখানে আমরা নিরাপদ থাকতে পারি না।’
জেলার পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, ‘হামলার রহস্য উন্মোচনে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি। এগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কী কারণে এই হামলা বা কারা হামলা করেছে সে বিষয়ে আমরা দ্রুততম সময়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারব। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
অন্যদিকে জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান বলেন, ‘এ ঘটনার সাথে যারাই জড়িত থাক না কেন তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে পুলিশ কাজ শুরু করেছে। অতিদ্রুত তারা জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে।’
এর আগে ১৯৮৬ সালের ২৮ এপ্রিল গুলিবিদ্ধ উপজেলা চেয়ারম্যানের বড় ভাই রবিউল আওয়াল খান কিরণ উপজেলার যোশর ইউনিয়নের লেটাবর বাজার থেকে নির্বাচনী প্রচারণার সভা শেষে শিবপুরের বাড়িতে ফেরার পথে সিঅ্যান্ডবি ব্রিজসংলগ্ন স্থানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
‘এটা কী প্যান্ট পরেছ? জিন্সের প্যান্ট নেই?’
‘ঠিক আছে ভাই জিন্সের প্যান্টই পরব।’
‘চুলও তো ঠিক নাই।’
‘চুলের কী সমস্যা ভাই?’
‘এই তেল দেওয়া চুলে চলবে না। চুলের দুটো স্টাইল আছে, একটা আর্মি কাট, মানে সাইড পাতলা। আরেকটা পাংকু স্টাইল। দুটোর একটা হতে হবে।’
‘পাংকুটা থাক ভাই। আর্মিটাই ভালো।’
‘আর গেস্টরুমে বসতে হবে। নেতৃবৃন্দ কোথাও গেলে সঙ্গে যেতে হবে।’
‘যাব ভাই। নেতৃবৃন্দকে সম্মান করতে হবে। তারা তো সম্মানীয় মানুষ।’
ছাত্ররাজনীতি কিংবা ছাত্রনেতাদের নিয়ে কোথাও আলোচনা শুরু হলেই ২৫ বছর আগের দৃশ্যটা স্মৃতি থেকে হানা দেয়। নিজের চোখের সামনে ঘটা এই ছবিটাই আমার কাছে ছাত্ররাজনীতির সারাংশ। যিনি সাক্ষাৎকারটা নিচ্ছিলেন তিনি উঠতি ছাত্রনেতা। যে দিচ্ছিল সে তার হবু কর্মী এবং এই এরা মিলেই ছাত্ররাজনীতি।
ছবি বদলেছে? তাহলে কয়েক মাস আগের একটা অভিজ্ঞতা শোনাই। পরীবাগে বন্ধুর বাসা। রাতের দিকে চায়ের দোকানে বসে আছি। সামনে শ’খানেক তরুণের ভিড়। গোটা পঞ্চাশেক মোটরসাইকেল। খুব বেশি খোঁজখবর করতে হলো না। জানা গেল, ছাত্রলীগের বড় এক নেতা এখানে থাকেন। তাকে প্রটোকল দিতেই এই জমায়েত। এসব উগ্র জমায়েত থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাই এখন এ দেশের নিয়ম। তবু খুব দেখার দৃশ্য বলে খেয়াল করছিলাম। হঠাৎ একটা উত্তেজনা দেখা গেল জটলায়। নেতা নেমেছেন। ভিড়ের দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি ফোন নিয়ে হেঁটে হেঁটে ভিড় ছেড়ে এগোলেন। ঠিক পেছন পেছন এগোলো মৌমাছির মতো একটা দল এবং একটা সময় ওরা নেতাকে পেছনে ফেলে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধ করে দিল রাস্তার যাতায়াত। পরের কয়েক মিনিটের দৃশ্যটা হলো, চারদিকে নেতাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে জনা পঞ্চাশেক তরুণ। নেতা ফোনে কথা বলছেন। ওদিকে রাস্তা বন্ধ। হলিউড-বলিউডের সিনেমায় দাপুটে ডনদের দেখেছি। মনে হলো এটা বোধ হয় সেরকমই কোনো ছবির শ্যুটিং।
ছবি তাই একটুও বদলায়নি। ২৫-৩০ বছর আগে যা। এখনো তা। ছাত্রদল যা, ছাত্রলীগও তা। প্রথম ঘটনাটা ছাত্রদলের রাজত্বের আমলের। পরেরটা! বুঝতেই পারছেন। ইদানীংকার ঘটনা। ছাত্রলীগ না হয়ে যায় না।
ছাত্ররাজনীতির গল্প বলতে শুরু করলে দেখি উপচে বেরিয়ে আসে অনেক গল্প। মধ্য নব্বইয়ের দশকে একবার একটা হল দখল করে নিল ছাত্রদলের একটা বিদ্রোহী গ্র“প। যিনি এই দখল কার্যে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তার নাম ‘ডগ অমুক (নামটা উল্লেখ করা বোধ হয় উচিত নয়)।’ নামের আগে ডগ কেন? প্রতিষ্ঠিত গল্পটা হলো, তিনি একবার কাঁটাবনে পশু-পাখির দোকানে গিয়ে দেখলেন টাকা দিয়ে মানুষ কুকুর কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তখন নিজে হলের সামনে থেকে একটা কুকুর ধরে নিয়ে সেটা বিক্রির চেষ্টা করলেন। দেশি বেয়াড়া শ্রেণির কুকুর তো আর বিক্রয়যোগ্য নয়। দোকানদার কিনবে না। ভাই গর্জে উঠলেন, ‘কেন নেবে না?’
‘স্যার এটা দেশি কুকুর। আমরা তো কিনি বিদেশি কুকুর।’
‘কী? শুধু বিদেশি কুকুর... তোমাদের তো দেশপ্রেম নেই। দেশদ্রোহী সব।’
এই গল্প ক্যাম্পাসে সংগত কারণেই সুপার হিট। গল্পে নানান শাখা-প্রশাখা যোগ হলো। আর তিনি হয়ে গেলেন ‘ডগ ...।’
সেই ডগ ভাইয়ের সমাপ্তিটা অবশ্য অত্যন্ত ট্র্যাজিক। দিন-রাত জেগে হল পাহারা দিতেন। কিছুদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা সংহত হয়েছে মনে করে তিনি একদিন গেলেন নিউমার্কেটে। সেই ফাঁকেই বিরোধী পক্ষ সাঁড়াশি আক্রমণে হল দখল করে নেয়। তিনি ফিরে দেখেন হল বেদখল। নিজে আর ঢুকতে পারছেন না। হলের সামনে দাঁড়িয়ে তার যে কী কান্না। একজন শিক্ষকও ছিলেন, হাউজ টিউটরই হবেন, ডগ ভাই তাকে উদ্দেশ করে আর্তনাদ করলেন, ‘স্যার আমার হল... আমার হল...।’ একেবারে আশির দশকের আলমগীর-শাবানার ছবির মতো ট্র্যাজেডি দৃশ্য।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের ছবির দৃশ্য আছে, ট্র্যাজেডি আছে। কমেডি! তা-ও আছে। একবার একজন ব্যবসায়ীকে ধরে আনা হলো। চাঁদা চাওয়া হয়েছিল। দেননি। গেস্ট রুমে অনেক হুমকিধমকির পরও ভদ্রলোককে নত করাতে না পেরে শেষে দোতলায় নিয়ে তাকে ওখান থেকে ফেলে দেওয়া হলো। যারা ফেলেছিল ওদের ধারণা ছিল, পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে এবার ভদ্রলোক রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু যে ঘটনা ঘটল, এর জন্য বোধ হয় কেউ প্রস্তুত ছিল না। পতিত হয়েও মানুষটির তেমন কোনো শারীরিক ক্ষতি হলো না। পায়ে সামান্য একটু চোট লেগেছিল বোধ হয়। তাই নিয়েই দিলেন দৌড়। দোতলা থেকে নেমে তাকে ধাওয়া করে ধরা হয়তো সম্ভব ছিল; কিন্তু ওরা মানুষটার প্রাণশক্তিতে এত বিস্মিত হয়েছিল যে, তাড়া করার কথা ভুলেই গিয়েছিল। ফলে সেটা হয়ে গেল হাসির গল্প। কমেডি দৃশ্য। আর সব মিলিয়ে ক্যাম্পাস-হল-ছাত্ররাজনীতি আসলে সিনেমার মতোই অবিশ্বাস্য।
না, ছবি বদলায়নি। একভাবে চিন্তা করলে বদলেছে। এখন আক্রমণ-নির্যাতনের নতুন নতুন শাখা যোগ হয়ে পুরো প্রক্রিয়াটা এমন ফলবান বৃক্ষ যে, তার আশেপাশে গেলেই মাথায় আঘাত পড়বে। আগে শুধু নিচে গেলে ঝামেলা হতো। এখন অতদূর যাওয়া লাগে না।
নতুন ছাত্ররা রাজনীতির কারণে আগে নির্যাতিত হতো, এখন স্রেফ নতুন হওয়ার কারণে আরেক দফা ঝামেলায় পড়ে। র্যাগিং বা নতুনদের নিয়ে খেলার ব্যাপারটা তখন বোধ হয় সেভাবে ছিল না। আরও ব্যাপার আছে। আগে, যেহেতু কোনো একপক্ষের চিরস্থায়িত্ব ছিল না; ফলে সবকিছুর মধ্যে একটা কিন্তু কাজ করত। পাঁচ বছর পর বিপদে পড়ার ভীতি। গত এক-দেড় দশকের একমুখিতায় সেই ভীতিও গেছে। ফলে ছাত্ররাজনীতির নামে নানা অপচর্চা আরও বেশি করে চলে। ও, হ্যাঁ, ছাত্রনেত্রীদের অতটা হিংস্র হওয়ার খবর শোনা যেত না। মোটামুটি ধরে নেওয়া হতো যে, ছাত্রীদের হলে রাজনীতি যেমনই থাকুক, তারা সীমা ছাড়াবে না। নারীরা কখনোই নিষ্ঠুরতার ছবি নন, রাজনীতিতে সেই ধারা কম বেশি ছিল। এখন আর নারী-পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রী ভেদাভেদ নেই। একভাবে দেখলে অবশ্য ভালো। বেশ একটা সাম্য চলে এসেছে। নির্যাতন-নিপীড়নে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রায় নজরুলের কবিতা, ‘যা কিছু অকল্যাণকর অর্ধেক তার করছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
ছাত্রলীগকে বাগে আনার অনেক চেষ্টা চলছে। সাংগঠনিক নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শাসন করেছেন একাধিকবার। শাস্তি-শাসন এসব চললেও কাজ হচ্ছে না কোনো। মোটা দাগে বলা যায়, দলের বা সরকারের কোনো না কোনো পক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় কাজের কাজ কিছু হয় না। প্রথমত, যারা তাদের শক্তিকে ভাড়া করে কাজে লাগায় তাদের আর ছাত্রদের শাসন করার নৈতিক শক্তি থাকে না। ফলে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয়ত, এই সমাজে ছাত্ররাই একমাত্র সংগঠিত শক্তি। ধরুন, একজন বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র কোথাও গিয়ে আক্রান্ত হলো, দেখবেন সঙ্গে সঙ্গে শত শত সঙ্গী জুটে যাচ্ছে প্রতিবাদে। সেই ছাত্রটিই কয়েক বছর পর, ছাত্রত্ব শেষ হলে একইরকম ঘটনার মুখে পড়লে তেমন প্রতিবাদ হবে না। কারণ বন্ধুরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। এখন আর দলবদ্ধতা নেই। আর এখানেই সমীকরণটা। এই দলবদ্ধ শক্তিটাকে উপরের স্তরের রাজনীতির জন্য খুব দরকার। এরা না থাকলে একটা বাহিনী পালতে হতো, এখানে একেবারে তৈরি দল। প্রশ্রয় দিলেই হয়। আর তরুণদের রক্তের নেশাই হলো রোমাঞ্চ, নিজেকে বড় করে দেখানো। রাজনীতির ছায়া বা অপচ্ছায়া তার সামনে ক্ষমতার, বড়ত্বের, বাহাদুরির মঞ্চটা বানিয়ে দেয়। অবাধ বাহাদুরির এই সুযোগ একজন ১৯-২০ বছরের তরুণ গ্রহণ করবে না ভাবলে আমরা সমাজ সম্পর্কে ভুল ধারণা করে বসে আছি।
বদলানোর উপায়! ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দাও। কেউ কেউ বলবেন। এবং অবশ্যই ভুল করবেন। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলেও দলবদ্ধ তরুণদের মধ্যে কোনো না কোনো বিনাশী প্রবণতা থাকবেই। ঠেকানোর উপায় হলো খুব সম্ভব, সেই দলবদ্ধতার মধ্যে শৃঙ্খলা আনা। বাহাদুরি ব্যাপারটাকে অন্যভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করা। এখন, একটা ছাত্র সংগঠনের নেতা সে-ই হয়, যাকে মূল দল পছন্দ করে। ফলে, নেতৃত্ব পাওয়ার পথ বড় ভাইয়ের পায়ে পায়ে চলা। হাতে হাত রাখা। মুখে হ্যাঁ-হুঁ বলে ফেনা তুলে ফেলা। এবং বড় ভাইরাও নিজের বশংবদ-পছন্দের জনকেই নিরাপদ ভেবে সামনে আনবেন। তাতে সমস্যা নেই কোনো। তিনি যাকে নেতা বানাচ্ছেন, তাকে দিয়েই কাজ চলছে। কিন্তু যদি, এমন হতো যে সে-ই নেতাকে ছাত্রদের মুখোমুখি হতে হবে, লড়াই করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে নেতৃত্ব, তাহলে হতো গুণের লড়াই। যে ভালো বক্তৃতা দেয় বা যে পরোপকারী বা যে ভালো ছাত্রতেমনি কোনো একটা গুণ থাকতে হতো। গুণভিত্তিক নেতৃত্ব হলে, সে-ই নেতৃত্বের কর্মী বাছাইয়ে গুণের কদর থাকত। আর এসবই সম্ভব হতো যদি সঠিক সময়ে, সঠিক প্রক্রিয়ায় ডাকসু ও নির্বাচন অক্ষুন্ন থাকত। জানি কেউ কেউ বলবেন, আরে, ডাকসু বা নির্বাচন মানেই তো আরেক দফা মারামারি। গোলাগুলি। বটে। সর্বশেষ যে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে সেটাও মানের দিক দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু মনে রাখতে হবে তোফায়েল আহমেদ, আখতারুজ্জামান, মাহমুদুর রহমান মান্না, ওবায়দুল কাদেররা সেই সময়েরই ছাত্রনেতাযখন ছাত্ররাজনীতির নির্বাচনী চরিত্র ছিল। তখনও গোলমাল হতো, গুলি-বোমাবাজি এখনকার চেয়ে বেশিই ছিল। কিন্তু তখন দুটো ভাগ ছিল। একদল লিডার। আরেক দল ক্যাডার। এখন লিডার আর ক্যাডার একাকার হয়ে গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আগে লড়াই ছিল রাজনৈতিক আধিপত্যের। এখন নিরীহদের নির্যাতনের।
ঠিক এই সময়ে ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছেন সাদ্দাম। এখনকার সময়ের মূলধারার নেতাদের তুলনায় পরিচ্ছন্ন ইমেজের। ভালো সাবজেক্টে পড়াশোনা। রাজনৈতিক বাগ্মিতা আছে। পড়াশোনার চর্চাও কম বেশি আছে বলেই জানি। কোথায় ভাবলাম, পরিস্থিতি বদলাবে। তার জায়গায় এত এত অপকীর্তির খবর যে, পত্রিকার এক পাতায় সব ধরানোও সম্ভব হয় না।
ভেবে ভেবে মনে হচ্ছে, নেতা বা মাথা দিয়ে বদলানোর দিনও বোধ হয় গেছে। আসলে দিনই তো নেই। ছাত্ররাজনীতিতে এখন নিশুতি রাত। ঘোর অন্ধকার।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে সিমিত চন্দ্র (১২) নামের এক স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (৭ জুন) ভোরে ওই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বেলগাছা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক কিশোরকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সিমিত চন্দ্র বেলগাছা গ্রামের মানিক চন্দ্র ড্রাইভারের ছেলে। অভিযুক্ত কিশোর (১৬) একই গ্রামের প্রদীপ চন্দ্রের (দর্জি) ছেলে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গীতা সংঘ অনুষ্ঠান দেখতে যায় সিমিত ও তার বড় ভাই। সিমিতকে অনুষ্ঠানস্থলে রেখে বাড়িতে ফেরে তার বড় ভাই। পরে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে সিমিতের সঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরের কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় সিমিতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ওই কিশোর। পরে তাদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের গর্তে সিমিতের মরদেহ পুতে রাখে। অনুষ্ঠান শেষে সিমিত বাড়িতে না ফিরলে স্বজনরা তার খোঁজে বের হয়। অভিযুক্ত কিশোরকে সিমিতের বিষয়ে জিজ্ঞাস করলে সে অসংলগ্ন আচরণ করে। পরে তার বাবা প্রদীপ চন্দ্র তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের একটি গর্তে সিমিতের মরদেহ দেখিয়ে দেন। বুধবার ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে।
আটক কিশোরের স্বীকারোক্তিতে সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ বলেন, অভিযুক্ত কিশোরের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। এ নিয়ে সিমিতসহ অনেকেই ওই কিশোরকে খোঁচা দিত। গত রাতে সিমিত ওই কিশোরের সাথে এ নিয়ে আবারও খোঁচা দিলে সে সিমিতের গলা চেপে ধরে। এত শ্বাসরোধ হয়ে শিশুটি মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত কিশোর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনা স্বীকার করেছে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।