
ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে যুগান্তকারী রায় দিয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এ রায়ের ফলে এখন থেকে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দুই নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অংশ নেবেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং লোকসভার বিরোধী দলের নেতাও। গতকাল বৃহস্পতিবার দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে এম যোসেফের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। আদালত বলেছে, এ বিষয়ে কেন্দ্র সরকার উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করবে। তা না হওয়া পর্যন্ত এই নতুন বিধি চালু থাকবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি স্বায়ত্তশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে যুগান্তকারী রায় নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্ত করেন রাষ্ট্রপতি। তাদের কার্যকালের মেয়াদ হয় ছয় বছর। সচরাচর দেশের প্রাক্তন আমলাদের এই পদে বেছে নেওয়া হয়। তবে এই মনোনয়ন নিয়ে বারবারই প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেস কিংবা বিজেপি, বিভিন্ন আমলেই বিরোধী দলগুলো দাবি করেছে, সরকারের ঘনিষ্ঠ আমলাদের নির্বাচন কমিশনার করা হচ্ছে।
তাই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার স্বার্থে এই প্রথা বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে একাধিক জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছিল। আবেদনকারীদের দাবি ছিল, নির্বাচনের স্বচ্ছতার জন্য নিযুক্তি প্রক্রিয়ায় বদল আনা জরুরি। গতকাল বিচারপতি কে এম যোসেফ, অজয় রাস্তোগি, অনিরুদ্ধ বসু, ঋষিকেশ রায় ও সি টি রবি কুমারের সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে জানিয়েছে, স্বচ্ছতার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত। বিচারপতিরা বলেন, গণতন্ত্রে নির্বাচন হতে হবে অবাধ। আর সেই দায়িত্ব কমিশনের। নির্বাচনের পবিত্রতা রক্ষা তাদেরই কাজ। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের প্রধান যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হন, নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্যকেও সেভাবে নিয়োগ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী নেতা ও প্রধান বিচারপতির সুপারিশ মেনে রাষ্ট্রপতি সেই নিযুক্তি দেবেন।
এনডিটিভি বলছে, এ রায়ের পর নির্বাচন কমিশন এক স্বাধীন সচিবালয় পাবে। স্বাধীনভাবে নিয়মনীতি তৈরি করতে পারবে। নিজেদের বাজেট স্বাধীনভাবে তৈরি করতে পারবে। তহবিলের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। এমনকি সরাসরি কেন্দ্রীয় ট্রেজারি থেকে টাকা তোলার ক্ষমতাও পাবে।
সংবাদমাধ্যমটি জানাচ্ছে, কিছুদিন আগে অন্যতম কমিশনার হিসেবে নিযুক্তি পান কেন্দ্রীয় আমলা অরুণ গোয়েল। গত বছরের ১৮ নভেম্বর তিনি স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার পরদিনই সরকার তাকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ করে। তার দুদিন পর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। সে সময় সুপ্রিম কোর্টও ওই নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। তার নিয়োগ-সংক্রান্ত নথিও তলব করেছিল সর্বোচ্চ আদালত।
এক দশক আগে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ কংগ্রেস নামের একটি রাজনৈতিক দল। শুরুর দিকে কিছু কর্মসূচি থাকলেও ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়ার পর রাজনীতির মাঠে তেমন কোনো সক্রিয়তা নেই দলটির। কালেভদ্রে কিছু ইস্যুতে ঢাকায় মানববন্ধন করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ দলের কার্যক্রম। একই অবস্থা নিবন্ধিত আরেক দল গণতন্ত্রী পার্টির। পুরানা পল্টনে ভাড়া করা ছোট একটি কক্ষে দলটির কার্যালয়। তবে সেখানে নেই কোনো সাইনবোর্ড বা নামফলক।
আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এমন কিছু দল সরব হতে শুরু করেছে। কোনো কোনো দল ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার কথা বলছে। যদিও বছরজুড়ে দলগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না রাজনৈতিক অঙ্গনে। তারা দেশের জনগণের কোনো চাওয়া-পাওয়ার কথা বলে না, যদিও দলগুলো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত। এ অবস্থায় গত বছর অদ্ভুত নামের প্রায় শখানেক দল নিবন্ধন চাওয়ার পরই বিষয়টি আলোচনা শুরু হয়।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সবশেষ তথ্যমতে, দেশে এখন ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ দলের অবস্থায়ই কাগজে আছে কাজে নেই অবস্থা। কয়েকটি দল ইস্যু বা দিবসভিত্তিক কর্মসূচি দিলেও তা পালন করার মতো লোকবলই নেই তাদের। আবার ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কয়েকটি বিদেশের ইস্যু নিয়ে মাদ্রাসা বা মসজিদকেন্দ্রিক কিছু কর্মসূচি করলেও জাতীয় ইস্যুতে তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। ৯০ শতাংশ দল ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্র সংগঠনও অকার্যকর।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মতো দলগুলোর গত কয়েক বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়।
কয়েক দলের কার্যালয়ে গিয়ে বা ফোনে যোগাযোগ করা হয় নেতাদের সঙ্গে। তবে কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া ঠিকানায় সন্ধান মেলেনি বেশ কয়েকটি দলের কার্যালয়ের। এমনকি যে ফোন নম্বর দেওয়া আছে তাতেও কয়েকটি দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটাধিকারপ্রাপ্ত প্রতিটি নাগরিকের রাজনীতি করা, সংগঠন করা, রাজনৈতিক দল করার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। বাংলাদেশের যেসব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে তারা বেশিরভাগই ক্রিয়াশীল নয়। ফলে দেশের রাজনীতির সংস্কৃতিতে যেমন এর প্রভাব পড়ছে। নিবন্ধনের এমন প্রক্রিয়া চলমান থাকলে অনেক ক্রিয়াশীল দলও রাজনীতি থেকে ছিটকে যাবে।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নিবন্ধন থাকার পরও যেসব দল রাজনীতির মাঠের সক্রিয় না, নির্বাচন এলে এক ধরনের জট সৃষ্টি করে। এর ফলে নির্বাচন নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করে তাদেরও বেগ পেতে হয়। আমার মনে হয় আরও বেশি যাচাই-বাছাই করে নিবন্ধন দেওয়া উচিত। ঢালাওভাবে নিবন্ধন না দিয়ে কমিশন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে এসব করে কি না? তবে নির্বাচন কমিশন চাইলে এসব দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কমিশনের সেই ক্ষমতা রয়েছে। তিনি বলেন, নিবন্ধন পাওয়া দলগুলোর মিনিমাম শর্ত পালন করা উচিত। অন্যদিকে অনেক দল আছে যারা ক্রিয়াশীল কিন্তু দীর্ঘ সময় তারা চেষ্টা করেও নিবন্ধন পাচ্ছে। না হলে দল ও রাজনীতির প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হবে।
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী রাজধানীর বাংলা মোটরে হ্যাপি রহমান প্লাজায় (চতুর্থতলা) বাংলাদেশ কংগ্রেসের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি কক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এক কক্ষবিশিষ্ট রুমে দুটি টেবিল ও ৮-১০ চেয়ার রয়েছে। মাঠের রাজনীতিতে সংক্রিয় না থাকলেও গত ১০ বছরে দুটি কাউন্সিল করছে দলটি। আগামী মাসে তৃতীয় কাউন্সিল হবে। তাছাড়া আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চায় তারা।
অফিসে দলের কোনো শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের পাওয়া না গেলেও কথা হয় দপ্তর সম্পাদক তুষারের সঙ্গে। তিনি জানান, মাঝেমধ্যে এখানে দলের নেতাকর্মীরা আসেন। এখান থেকেই দলীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তিনি বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর দলীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। বর্তমানে কেন্দ্রের কোনো কর্মসূচি না থাকলেও মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে। আমাদের ৫৪টি জেলা ও ২০০ উপজেলায় কমিটি রয়েছে। শিগগিরই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
তবে দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অনেক জেলায় দলটির কমিটি থাকলেও কোনো কার্যক্রম নেই। অনেক জেলায় আবার দলীয় অফিসও নেই। বরগুনা জেলা কমিটির আহ্বায়ক মো. ওলিউর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোকবল কম থাকায় জেলাপর্যায়ে বড় কোনো কর্মসূচি পালন করা হয় না। তবে বিভিন্ন দিবস ধরে কর্মসূচি পালন করা হয়।
দলটির মহাসচিব ইয়ারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, দল ছোট বলে আমরা মিডিয়া কাভারেজ পাই না। তাই আমাদের দলের প্রচার কম। এখন আমাদের ৪০টি জেলা কমিটি রয়েছে। নিবন্ধিত দলের সব স্তরে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বলা থাকলেও মাত্র কয়েকজন নারী প্রতিনিধি রয়েছে দলটিতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের নারীদের বিষয়ে যে শর্ত দিয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। নারীরা রাজনীতির প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমরা চাইলে নারীদের দলে ভেড়াতে পারছি না। তবে আমাদের চার-পাঁচ নারী প্রতিনিধি রয়েছে।
একই অবস্থা আরেক রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রী পার্টির। পুরানা পল্টন, ইশরাত টাওয়ার ১০ তলা ভবনটির ছোট একটি কক্ষ থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে দলীয় কোনো সাইনবোর্ড নেই। ১০ তলায় ছোট একটি রুম থেকে দলীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইস্যুভিত্তিক কোনো কার্যক্রম না থাকলেও বিভিন্ন দিবস ধরে কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়। তবে সেসব কার্যালয়ের ভেতরেই সীমাবদ্ধ।
কেন্দ্রের বাইরে কোনো কর্মসূচি নেই। ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় কমিটি রয়েছে তারাও নিষ্ক্রিয়। বিষয়টি স্বীকার করেছেন দলটির সভাপতি ব্যারিস্টার মো. আরশ আলী। তিনি বলেন, আমরা ১৪ দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ। বড় কোনো কর্মসূচি আমাদের নেওয়া হয় না। নানারকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঢাকা মহানগরের উদ্যোগে কিছু কর্মসূচি হয়। তবে কেন্দ্রের উদ্যোগে দিবস ধরে কর্মসূচি হয়। আমাদের ২৫-৩০ জেলায় কমিটি রয়েছে। সাইনবোর্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের স্থায়ী কোনো অফিস নেই। ভাড়া নিয়ে কার্যালয় পরিচালনা করতে হয়। ভবন কর্তৃপক্ষের কিছু নিয়ম রয়েছে। ফলে সাইনবোর্ড লাগানো যাচ্ছে না।
নিবন্ধন থাকলেও কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএলের। নির্বাচন কমিশনে তথ্যানুযায়ী, দলটির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত স্বজন টাওয়ার-২। ভবনের এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, এরকম দলের অফিস আছে বলে জানা নেই। তাদের কারও ফোন নাম্বার থাকলে যোগাযোগ করতে পারেন। তবে এ বিষয়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া ফোন নাম্বারগুলোও বন্ধ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি কার্যালয় রাজধানীর সেগুনবাগিচার তোপখানা রোড। ৫০০-৬০০ স্কয়ার ফিটের একটি ভাড়া কক্ষে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দলের তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিও না থাকলেও জোটের কর্মসূচিতে সক্রিয় দলটি। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে নিয়মিত বিবৃতি ও প্রেস রিলিজ নির্ভর দলটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে মাত্র কয়েকটি জেলায় দলীয় কার্যক্রম ও অফিস রয়েছে। নারীকর্মীও হাতেগোনা কয়েকজন।
দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, কোনো দলের পক্ষেই ইসির শর্তগুলো শতভাগ মেনে চলা সম্ভব নয়। তবে মেজর যে শর্ত রয়েছে আমাদের দল তা পূরণ করেছে। ইসি যেসব শর্ত দিয়েছে তা অগণতান্ত্রিক ও সংবিধান পরিপন্থী। রাজনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে এসব শর্ত শিথিল করা উচিত।
২০১৩ রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট। নিবন্ধন পাওয়ার পর দলটির কোনো কার্যক্রম নেই। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে দলটির কোনো সাইনবোর্ড বা অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি। কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া দুটি টেলিফোন নাম্বারেও তাদের পাওয়া যায়নি।
একই অবস্থা ইসলামি দলগুলোর। নির্বাচন কমিশনে তথ্যানুযায়ী ১০টি ধর্মভিত্তিক দল রয়েছে। ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে এসব দলের সরব উপস্থিতি থাকলেও বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে কোনো কর্মসূচি নেই। বিবৃতি আর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে দলীয় কার্যক্রম। অনেক দলের কার্যক্রম পরিচালিত হয় স্থানীয় মাদ্রাসাকেন্দ্রিক।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দল মূলত মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল পরিচালিত হয়। স্থানীয় মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে আমাদের কার্যালয়। বছরের অর্ধেক সময় ছাত্র-শিক্ষকরা পড়াশোনাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকছে। ফলে মাঠের রাজনীতিতে আমাদের বড় কোনো কাজ করতে পারছি না। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়মিত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকি। কমিশনের শর্ত মেনেই দল চলছে।
নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেকোনো জাতীয় নির্বাচনে আগ্রহী দলটিতে যদি অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকেন, যেকোনো একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী অংশ নেওয়া আসনগুলোয় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পেতে হবে। দলটির যদি একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ (২১টি) প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১০০টি উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সংবলিত দলিল থাকতে হবে।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো বিধিবিধানের আলোকে পরিচালিত হচ্ছে কি না, দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ে কমিটি নির্বাচন, দলের সব স্তরে নারী প্রতিনিধিত্ব, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনকে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে রাখা, বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থিতার জন্য তৃণমূলের ভোটে প্যানেল প্রস্তুত করা হচ্ছে কি না এসব বিষয়েও তথ্য চাওয়া হয়েছে।
গত বছর অক্টোবরে নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় শর্তগুলো মেনে চলছে কি না সে তথ্য চেয়ে এসব দলকে চিঠি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইতিমধ্যে সব দলই নির্বাচন কমিশনে তথ্য সরবরাহ করেছে। তবে সেসব এখন যাচাই-বাছাই চলছে।
এর আগে কেএম নুরুল হুদা কমিশনও দলগুলো শর্ত পালন করছে কি না, তা যাচাই করেছিল। শর্ত মেনে না চলায় ২০১৮ সালে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, ২০২০ সালে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি-পিডিপি এবং ২০২১ সালে জাগপার নিবন্ধন বাতিল করে।
এসব নিবন্ধিত দলগুলো শর্ত মেনে দল পরিচালনা করছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, নিবন্ধিত দলগুলোর কাছে তথ্য চেয়েছিলাম। সব দল তথ্য জমা দিয়েছে। এখন যাচাই-বাছাই চলমান রয়েছে। কোনো অসংগতি পেলে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।
আবাসিক হলের কক্ষ দখলকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহে তিন দিনের ব্যবধানে দুই দফা সংঘর্ষে জড়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের একটি উপপক্ষের দুই গ্রুপ। এ ঘটনার জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশ দুটি হল থেকে ৯টি রামদা, রড ও লাঠিসোঁটা উদ্ধার করে। কিন্তু এসব অস্ত্র উদ্ধারের পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা পুলিশের পক্ষ থেকে থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা হয়নি। আটক বা গ্রেপ্তারও হয়নি কেউ।
শুধু হলের কক্ষ দখল নয়, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গত এক মাসে অন্তত পাঁচবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপগুলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আগে কয়েকটি ঘটনায় জড়িতদের বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িতদের যেমন বিচার হয় না, তেমনি ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপকে যারা পৃষ্ঠপোষকতা করে তারাও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটির নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেপরোয়া কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিরা বলছেন, আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন এবং অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকা-ের কারণে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষ সংঘাতে জড়াচ্ছে।
হাটহাজারী থানার ওসি রুহুল আমীন দেশ রূপান্তরকে জানান, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ঘটনায় মামলা হয়েছে দুটি। এর মধ্যে ১৭ জুলাই যৌন নিপীড়নের অভিযোগে এক নারী শিক্ষার্থী নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে একটি মামলা করেন। আগস্ট মাসে অন্য মামলাটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওই মামলায় ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মী জোবায়ের হোসেনকে আসামি করা হয়েছে। এ দুটি মামলা এখনো তদন্তাধীন।
অথচ গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপপক্ষের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গত বছর ১৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে ভিত্তিক উপপক্ষ বিজয় ও সিএফসি, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সিক্সটি নাইন ও এপিটাপ, ৫ সেপ্টেম্বর সিএফসি ও সিক্সটি নাইন, ২ ডিসেম্বর রাতে ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স) ও বিজয়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মিজানুল ইসলাম জানান, কতটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে সে হিসাব তাদের কাছে নেই। একটি গোয়েন্দা সংস্থার হিসাবে গত বছর ১৬টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনায় মামলা হয়েছে তিনটি। ওই তিনটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ।
পুলিশের তথ্যমতে, গত ৩৩ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১টি হত্যাকা- ঘটেছে। অধিকাংশ খুনের ঘটনা রাজনৈতিক কারণে। খুনোখুনির এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অসংখ্য তদন্ত কমিটি গঠন করলেও রিপোর্টগুলো আলোর মুখ দেখেনি। ঘটনার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার, মামলা করলেও ৩০ বছরে এসব হত্যাকা-ের একটিরও বিচার শেষ হয়নি। ২২ বছর ধরে চলছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি আলী মর্তুজা চৌধুরী হত্যাকা-ের বিচার। কিন্তু ২১ খুনের মামলার একটিরও নিষ্পত্তি বা রায় হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর-পিপি অ্যাডভোকেট ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী।
ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মারামারি নিরসনে তাদের রাজনৈতিক ‘গুরুদের’ও কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই দুটি পক্ষে বিভক্ত। একটি পক্ষ সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী এবং আরেকটি পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। এ দুটি পক্ষের আবার ১১টি উপপক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে নাছির সমর্থকদের নয়টি ও নওফেল সমর্থকদের দুটি উপপক্ষ।
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের কোনো অনুসারী নেই বলে দাবি করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী। গত রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আদর্শিক কারণে মারামারি নেই। মূল হচ্ছে আসন সংকট। কারণ অনেকের ছাত্রত্ব নেই। তারা হলের আসন দখল করে আছে। দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিতে থাকছে। অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে।’
এমফিল বা পিএইচডির শিক্ষার্থী ছাড়া ১০ বছরের ঊর্ধ্বে একজন অছাত্র কেন হলে থাকবে এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন থাকার কারণে তারা পেশিশক্তি দেখাতে কক্ষ দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। র্যাগিং করছে। মূল অপরাধ ঢাকার জন্য বা নিজেকে সেফ করার জন্য তারা অমুক ভাই, তমুক ভাইয়ের অনুসারী বলে প্রচার করছে।’
একমাত্র শিক্ষকরাই এ সংকট নিরসন করতে পারেন, এমন দাবি করে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বলেছি হল থেকে অছাত্রদের বের করে দিলে সংঘাত, মারামারি ৯০ শতাংশ কমে যাবে। ব্যক্তিগত অনুসারী সৃষ্টির রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না এবং অনুসারী পরিচয়ে যারা অপরাধ করেছে বা করছে, তাদের পক্ষে থাকা বা সমর্থন আমি কখনোই করিনি এবং আগামীতেও করব না।’
সম্প্রতি ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে ধারালো অস্ত্র উদ্ধারের পরও থানায় মামলা না করা প্রসঙ্গে চবির প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মারামারি, সংঘাতের খবর পেলেই ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি। থানায় মামলা বা জিডি করা না হলেও সব ঘটনার তদন্ত হয়। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে জড়িত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
তিনি জানান, ২০২১ সালের অক্টোবরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে ছাত্রলীগের ১২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়। তবে এর মধ্যে আটজন মুচলেকা দেওয়ায় বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। চলতি বছর ১১ জানুয়ারি সাংবাদিক হেনস্তা, আবাসিক হলে ভাঙচুর ও ছাত্রী হলে মারামারিসহ ছয় ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের ১৭ নেতাকর্মীসহ ১৮ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে।
একাধিকবার ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরও মারামারি ও হানাহানি বন্ধ করতে পারেনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৮ সালের ১০ নভেম্বর প্রথম রাজনৈতিক কর্মকা-ের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর ২০০৮ ও ২০১৪ সালে আরও দুই দফা রাজনৈতিক কর্মকা-ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েও তা কার্যকর করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রশিবির বা ছাত্রদলের দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- নেই। এখন ছাত্রলীগ নিজেরাই নিত্যদিন মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়োগ নিয়ে নানা দুর্নীতির সংবাদ, ফোনালাপ গণমাধ্যমে ফাঁস হচ্ছে। যদি প্রশাসনিক দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে এর সুযোগগুলো কাজে লাগাচ্ছে ছাত্রলীগ নামধারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে চেইন অব কমান্ড নেই। নিজেদের মধ্যে বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখে পুলিশ হতাশ। হাটহাজারী থানা শুধু কি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণের জন্য? এ থানার তো অনেক কাজ আছে। যদি সরষের মধ্যে ভূত থাকে, ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়, তাহলে ছাত্রলীগের সংঘাত থামাতে পারবে না। এসব রোধ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আগে নিজেকে আস্থায় আনতে হবে। প্রশাসন যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় সেই সুযোগ নেবে বারবার সংঘাতে লিপ্ত ছাত্রলীগ নামধারীরা।’
চট্টগ্রাম আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে কিছু স্বার্থবাদী লোক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশকে ব্যবহার করছেন। ছাত্রলীগ নামধারীরা নিজেরা অপকর্মের দায় থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতার অনুসারী বলে প্রচার করছে। আমি জানি না যেসব নেতার সমর্থক বলে তারা প্রচার করছে সেসব নেতারা তাদের সমর্থন দিচ্ছে কি না।’
গন্তব্য কমলাপুর রেলস্টেশন। গুগল ম্যাপ জানাচ্ছে বাসে যেতে সময় লাগবে ৩৫ মিনিট আর হেঁটে এক ঘণ্টা। বাসে উঠে শাহবাগের জ্যাম দিয়ে শুরু। এরকম আরও কয়েকবার জ্যাম ও সিগন্যাল পেরিয়ে ১ ঘণ্টা ১১ মিনিট পর মতিঝিল পৌঁছলাম। জ্যামে আর বসে থাকতে ইচ্ছে হলো না। তাই এখানে নেমে গিয়ে বাকিটা পথ হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যখন কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছলাম তখন বিকেল ৪টা ৩ মিনিট।
স্টেশনে ঢুকতেই চোখে পড়ল বড় করে লেখা ‘ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন’ সাইনবোর্ডে। মুহূর্তেই থমকে দাঁড়ালাম। ভুল করে অন্য কোনো স্টেশনে চলে এলাম না তো। জানি না আমার মতো এমন করে আর কেউ বিভ্রান্ত হন কি না। তবে যারা প্রথমবার আসেন তাদের নিয়ে এরকম বিভ্রান্তি হলেও হতে পারে। আসলে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনটি বহুকাল ধরেই কমলাপুর রেলস্টেশন নামেই পরিচিত।
মনের দ্বিধা দূর করে পা বাড়ালাম। একটু সামনে এগোতেই কানে এলো রিকশা, বাইক আর সিএনজিচালিত অটোরিকশা ড্রাইভারদের চিল্লাচিল্লি। এই মামা কই যাবেন, মামা চলেন যাই। চালক-যাত্রী দেনদরবার। ঢাকা শহরে বাসিন্দাদের দৈনন্দিন সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভাড়া বিড়ম্বনা। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। এক যাত্রী স্টেশন থেকে মিরপুর-১ যেতে মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে দেনদরবার করছেন। যাত্রীর দাবিঅ্যাপসে যা আছে তাই দেবেন। চালক পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেনএখন অফিস টাইম, রাস্তায় জ্যাম, তাই ভাড়া বেশি। ভাড়া নিয়ে অন্য যাত্রী ও ড্রাইভারদের দরকষাকষি পেছনে রেখে আমি সামনে পা বাড়ালাম।
এর মধ্যে চোখে পড়ল কয়েকটি ছেলে হাতে আমড়া, বরই, পেয়ারা, ঠান্ডা পানি হাতে নিয়ে, বিক্রির চেষ্টা করছে। কথা বলতে চাইলে একজন জানাল, এখন কথা বলার সময় নেই। ট্রেন আসছে। যাত্রীরা স্টেশন থেকে বের হবে। বিক্রি করতে হবে বলেই সে চলে গেল।
স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে পা ফেলতেই মনে পড়ল আজ ১ মার্চ থেকে নতুন পদ্ধতিতে টিকিট দেওয়া হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ে অনলাইনে এবং অফলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে। টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণে জরিমানা করা এবং ভাড়া আদায় সহজ করার লক্ষ্যে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলযাত্রীদের একটা বড় অংশ প্রযুক্তি সুবিধার বাইরে, তাদের অনেকের অনলাইনে বা অফলাইনে নিবন্ধন বা লগ ইন করার পদ্ধতি জানা নেই, ডিভাইস নেই, ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা নেই। নতুন পদ্ধতিতে টিকিট নিয়ে মানুষের ভাবনা, অভিজ্ঞতা আর বিড়ম্বনার কথা শুনতে চাই।
এক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তার অ্যানড্রয়েড মোবাইল নেই। মগবাজারের একটা কম্পিউটারের দোকান থেকে ৫০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়েছে। প্রতিমাসে তিনি কয়েকবার ট্রেনে যাতায়াত করেন। এখন ট্রেনে চড়তে হলে প্রতিবার তার কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। যদিও পাশের যাত্রী জানালেন নতুন পদ্ধতিতে টিকিট চালু হওয়ায় ভালো হয়েছে। এখন কালোবাজারিরা টিকিট নিলেও বিক্রি করতে পারবে না। যার যার এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। ট্রেনে ভ্রমণের সময় এনআইডির ফটোকপি দেখাতে হবে, ফলে টিকিট কালোবাজারিদের দিন শেষ।
আজ টিকিট অন্যরকম। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট নিচ্ছে। আশপাশে কোনো দালাল নেই। আরএনবি, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা যাত্রীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন। ১৪ নম্বর টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখতে পেলাম, টিকিট বিক্রির দায়িত্বে নিয়োজিত এক মহিলা কাউন্টারে এক তরুণকে, তার এনআইডি সঙ্গে আছে কি না জানতে চাইলেন। বুঝলাম, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। একটু সময় নিয়ে কয়েকবার কম্পিউটারে যাচাই করে জানালেন, আপনার নিবন্ধন হয়নি। ৭ নম্বর কাউন্টারে গিয়ে আবার নিবন্ধন করে নিয়ে আসুন।
প্রায় প্রতিটি কাউন্টারের সামনে বাংলা ও ইংরেজিতে কাউন্টার টিকিটের জন্য ব্যবহারকারী নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে লেখা বিজ্ঞাপন আছে।
টিকিট কাউন্টার পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশে পা বাড়ালাম। প্রবেশপথেই দেখা মিলল ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক ও টিকিট কালেকটর গ্রেড-২ কর্মকর্তাদের তৎপরতা। টিকিট ছাড়া তারা কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। যাদের টিকিট নেই তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে বলা হচ্ছে। একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম, টাকার বিনিময়ে বা অন্য কোনো উপায়ে তারা কাউকে প্রবেশ করতে দেন কি না সেটা দেখার জন্য। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম তারা আজ সততার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে টাকা দিয়ে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে চায়নি বিষয়টা এমন নয়, তবে তারা প্রলোভনে রাজি হননি।
এর মধ্যে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন ট্রেনটি ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখলাম প্রতিটি বগির দরজা আটকানো। বাইরে দাঁড়িয়ে অ্যাটেনডেন্ট টিটিইরা টিকিট চেক করে তারপর যাত্রীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন।
কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকা থেকে প্ল্যাটফর্মের দূরত্ব অনেক বেশি। ভিড়ের মধ্যে বাচ্চাদের টেনে নিয়ে যাওয়া কিংবা তুলনামূলকভাবে যাদের বয়স একটু বেশি কিংবা শরীর অসুস্থ তাদের জন্য এ যাত্রাপথ কিন্তু বেশ ভোগান্তির। প্ল্যাটফর্ম কাছাকাছি হলে সুবিধা হতোএমন কথা জানান আনোয়ার হুসেন নামে এক যাত্রী। তিনি জানান, আপনাদের মতো বয়স থাকতে মাইলের পর মেইল হেঁটে গিয়েছি। দুই হাতে ব্যগ নিয়েও গিয়েছি। কিন্তু এখন শরীরের বল কমে এসেছে, সহজে ক্লান্ত হয়ে যাই।
কথা শেষ করতেই চোখে পড়ল লাল জামা পরিহিত এক কুলির সঙ্গে ঝগড়ার সুরে কথা বলছেন এক মধ্যবয়সী। তার সঙ্গে অনেকগুলো মালামাল। সেগুলো নিয়ে যেতে টাকার পরিমাণ নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে।
সুবর্ণ এক্সপ্রেসের হুইসেল বেজে ওঠে। গন্তব্যে যেতে যাত্রীরা উঠে বসেছেন ট্রেনে। ট্রেনের চাকা ঘুরতে শুরু করে। আমি ফিরে যাই আমার গন্তব্যের পথে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি রায় রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) চেয়ে করা আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ের ফলে দুজনের মৃত্যুদণ্ড ও দুজনের যাবজ্জীবনের সাজা বহাল রইল।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত আট বিচারকের আপিল বিভাগ রিভিউ খারিজের রায় দেয়।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন অধ্যাপক তাহেরের একসময়ের ছাত্র ও পরে একই বিভাগের শিক্ষক ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন ও নিহত অধ্যাপক তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম। যাবজ্জীবনের সাজা বহাল রয়েছে আবদুস সালাম ও নাজমুল আলমের।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলেন, দণ্ডের বিরুদ্ধে এই দুজনের আইনি লড়াই শেষ হলো। তাদের সামনে এখন শুধু দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার
আবেদনের সুযোগ রয়েছে। এ আবেদন খারিজ হলে কারাবিধি অনুযায়ী দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে কোনো বাধা থাকবে না।
এর আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রিভিউয়ের আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ২ মার্চ (গতকাল) রায়ের জন্য ধার্য করে আপিল বিভাগ। আদালতে আসামিদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ।
মোর্শেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত দুজনের মধ্যে সালাম রিভিউ আবেদন করেছিলেন। তার আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। ফলে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুজনকে দণ্ড ভোগ করতে হবে।
আপিল বিভাগের রিভিউ রায়ের সময় অধ্যাপক তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ, মেয়ে অ্যাডভোকেট সেগুফতা আহমেদ, তাদের পরিবারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যূথী ও শাকিলা রওশন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
হাইকোর্টে রায় থেকে খালাস চেয়ে আসামিদের আপিল ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের দণ্ড বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল গত বছরের ৫ এপ্রিল খারিজ করে রায় দেয় আপিল বিভাগ। এতে মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এ ছাড়া যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত নাজমুল আলম ও আবদুস সালামের সাজাও বহাল থাকে। বিচারিক আদালতের রায়ে এ চারজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর একটি আদালত রায়ে চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেয়। হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে এবং নাজমুল ও আবদুস সালামের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ নিখোঁজ হন। দুদিন পর শিক্ষক কোয়ার্টারের বাসার বাইরে ম্যানহোলে তার লাশ পাওয়া যায়। ওই ঘটনার পর ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় হত্যা মামলা করেন।
তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তাতে অধ্যাপক তাহেরের সহকর্মী মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর, জাহাঙ্গীরের ভাই আবদুস সালাম, তাদের (জাহাঙ্গীর ও আবদুস সালাম) বাবা আজিমুদ্দীন মুনশি এবং সালামের আত্মীয় নাজমুলকে আসামি করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর, নাজমুল ও সালাম আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, মহিউদ্দিন ও সালেহী তাদের কম্পিউটার, টাকা-পয়সা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অধ্যাপক তাহেরকে হত্যা করার কাজে লাগান। তবে মিয়া মহিউদ্দিন আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।
পরে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, তখনকার সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মহিউদ্দিন পদোন্নতি পেতে বিভাগে আবেদন করেছিলেন। পদোন্নতির ওই কমিটিতে ড. তাহেরও ছিলেন। তিনি মহিউদ্দিনের কয়েকটি প্রতারণা প্রাথমিকভাবে ধরে ফেলেন। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে পরে এসব প্রতারণা প্রমাণিত হয়।
সেই অসন্তোষ থেকে মিয়া মহিউদ্দিন এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তাহেরকে বাসায় হত্যা করে লাশ ম্যানহোলে ঢুকিয়ে রাখা হয়।
২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের কাছে শেষবার ওয়ানডে সিরিজ হেরেছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৪ থেকে ঘরের মাঠে টানা ছয় সিরিজ জয়ের সাফল্য ছিল টাইগারদের। ২০১৬তে ইংল্যান্ডের কাছে ২-১ এ সিরিজ হারের পর গত ডিসেম্বরে ভারতকে হারানো পর্যন্ত টানা সাত সিরিজ জয়ের তৃপ্তি আছে। সিরিজে ১-০তে এগিয়ে গিয়ে ইংল্যান্ড আবারও বাংলাদেশের দুর্গ ভাঙার পথে এগিয়ে আছে। শেষবার প্রথম ম্যাচ জয়ের পর দ্বিতীয়টিতে জিতে বাংলাদেশ সিরিজে সমতা আনে। তবে চট্টগ্রামে হেরে সিরিজ আর হাতে তোলা হয়নি বাংলাদেশের। ঠিক একই অবস্থা আবার। মিরপুরে আজ জয়ে না ফিরলে এক ম্যাচ আগেই সিরিজ হাতছাড়া হয়ে যাবে বাংলাদেশের। সেই সঙ্গে ওয়ানডে সুপার লিগে হোমে অক্ষত থাকার রেকর্ডও ভেঙে যাবে। অবশ্য আজ বাংলাদেশ জিতলে হোমে অজেয় থাকার রেকর্ড ধরে রাখার আশা টিকে থাকবে।
বাংলাদেশ সবশেষ নিজেদের ইতিহাসের সাফল্যের বছরেই প্রথম ম্যাচে পিছিয়ে পড়েও সিরিজ জিতেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ২০১৫ সালে প্রথম ম্যাচ হারের পর টানা দুই ম্যাচ জিতে ২-১ এ সিরিজ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। ওই সিরিজ বাদে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের সঙ্গেও লড়াইয়ে ফেরার দারুণ নজির গড়ে বাংলাদেশ। সেবার সিরিজে ২-০তে পিছিয়ে পড়েও শেষ তিন ম্যাচ জিতে ৩-২ এ সাফল্য পেয়েছিল বাংলাদেশ।
সিরিজে টিকে থাকতে কাল শেষ মুহূর্তে দলে পরিবর্তন এনেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। বিপিএল ভালো করা শামিম হোসেনকে যুক্ত করায় বাংলাদেশ দল এখন ১৫ জনের। আগে টি-টোয়েন্টি দলে থাকা যুব বিশ্বকাপজয়ী শামিম এই প্রথম ওয়ানডে দলে ডাক পেলেন। নির্বাচকরা বলছেন চোটগ্রস্ত দুজনের ব্যাকআপ হিসেবে আনা হয়েছে তাকে। তার খেলার সম্ভাবনা কম। খেললেও অতিরিক্ত ফিল্ডার হিসেবে নামতে পারেন।
প্রথম ম্যাচে সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিমই বেশি দায়ী থাকবেন। দুজনই স্পিনারদের বিপক্ষে সøগ শট খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন। মিরপুরের উইকেট বুঝে খেলার অভিজ্ঞতা তারা কাজে লাগাতে ব্যর্থ। এ নিয়ে মুশফিক চিন্তিত থাকলেও, সাকিব চিন্তায় ছিলেন বলে মনে হয় না। ম্যাচের পরদিন ঐচ্ছিক অনুশীলন থাকলেও মুশফিক দলের কোচিং স্টাফদের নিয়ে গতকাল চলে আসেন মিরপুরে। করেছেন ব্যাটিং অনুশীলন। প্রথম ম্যাচে ৩৪ বলে ১৬ রানে আউট হওয়ার ভুল নিয়ে কাজ করেছেন অবশ্যই। অনুশীলনের এক পর্যায়ে নেট বোলারের থ্রোতে বল হাতে লাগায় ব্যথাও পেয়েছেন। অবশ্য বিসিবি চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী জানিয়েছেন মুশফিকের চোট গুরুতর নয়। এদিকে সাকিব কাল ম্যাচে আগের দিন সন্ধ্যায় ছিলেন নিজের স্পন্সর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। টিম হোটেল ত্যাগ করে একটি ব্র্যান্ডের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এ কারণেই বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন কাল সন্ধ্যায় বিরক্তি নিয়েই উপস্থিত হয়েছিলেন টিম হোটেলে।
ক্রিকেটারদের ভুল শটে আউট হওয়াই প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের হারের কারণ। পাশাপাশি বিপক্ষে একজন ডাভিড মালান থাকলে চ্যালেঞ্জটা বেশি। প্রথম ম্যাচে জস বাটলার, জেসন রয়দের মতো বিধ্বংসী ব্যাটারদের দ্রুত ফেরাতে পেরেছেন বোলাররা। কিন্তু মালানকে ফেরাতে পারেননি। গত ১০ বছরে প্রিমিয়ার লিগ ও বিপিএল মিলিয়ে বাংলাদেশে ৫০টির মতো ম্যাচ খেলা মালান প্রথমবার দেশের জার্সিতে বাংলাদেশের মাটিতে খেলতে নামেন। আর প্রথম ম্যাচেই অপরাজিত সেঞ্চুরি করেছেন। এটা অবশ্যই ওই ৫০ ম্যাচ খেলার ফল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রথম ম্যাচে খাদের কিনারা থেকে তুলেছেন দলকে। দ্বিতীয় ম্যাচেও তাই বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মালান। তাকে দ্রুত ফেরানো গেলেই বাংলাদেশের অর্ধেক কাজ এগিয়ে থাকবে।
কোচ হাথুরুসিংহের অধীনে স্পিন শক্তি নিয়েই শুরু করেছে বাংলাদেশ। মিরপুরের পিচে স্পিন খেলা রপ্ত করা মালান সেই শক্তিকে দমিয়ে দিয়েছেন। আজও একই পরিণতি হলে সাত সিরিজ পর দেশের মাটিতে সিরিজ হারের স্বাদ নিতে হবে বাংলাদেশকে।
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
আজ বুধবার (২৯ মার্চ) ভোর ৫টায় দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগান এলাকার নিজ বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর একটি দল।
স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলো পত্রিকার আলোচিত রিপোর্টটির কারণে তাকে আটক করা হয়েছে বলে সিআইডির দলটি উপস্থিত ব্যক্তিদের জানিয়েছেন।
এভাবে গভীর রাতে তল্লাশি চালিয়ে একজন সংবাদকর্মীকে আটক বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত বলে মনে করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ।
কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বানানোর পর থেকেই বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তেমনি গণমাধ্যম কর্মীরাও নির্যাতিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামসহ সারাদেশে বহু গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরই সরকারি সংস্থা কিংবা দলের লোকের নির্যাতনের খবর এসেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে শামসুজ্জামান শামসকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। সেই সাথে গণমাধ্যম কর্মীসহ মত প্রকাশের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে তাদের মামলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী জানান নেতৃবৃন্দ।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’