
‘টাকা’ অথবা নিজস্ব নোট স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌম এখতিয়ারের প্রতীক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কাগজি মুদ্রার (টাকা বা টঙ্ক) প্রচলন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। প্রথম কাগজি মুদ্রার প্রচলনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তৃতীয়বারের মতো ‘টাকা দিবস’ পালিত হবে আজ।
মুদ্রা প্রচলনের আগে মানুষ লেনদেন করত বিনিময় প্রথায়। কোনো একটি পণ্যকে একক হিসেবে গণ্য করে পণ্যের সঙ্গে পণ্য বিনিময় করা হতো। ওই পণ্যটিই ‘মুদ্রা’র কাজ করত। কালক্রমে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। তখন মানুষ ‘কড়ি’র মাধ্যমে বিনিময় করত। তখন ‘গদ’ নারায়ণের যুগ।
ক্রমে ধাতব পদার্থ বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে ওঠে। প্রচলন শুরু হয় তামা, লোহা বা রুপার মুদ্রা। এর ধারাবাহিকতায় একসময় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়। এরপর স্বর্ণমুদ্রা থেকে কাগজি মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। ‘মুদ্রা’ প্রচলনের যুগটিই ‘নগদ’ নারায়ণের যুগ। এখনো মানুষ নগদ নারায়ণেই আছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রযুক্তির বিকাশের (বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির) ‘নির্ব্যক্ত-নিরুক্ত’ চাপে বা প্রভাবে আগামী দশকে কাগুজে বা বহনযোগ্য মুদ্রার প্রয়োজনীতা কমবে। টাকা ছাপানোর খরচও কমে আসবে।
তথ্য-সাবুদ বলে, প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে মিসরে বিনিময়প্রথার প্রচলন ছিল। আর পুরাণ-ব্যাকরণ বলে, এ প্রথার শুরু হয়েছিল ভারতে। প্রজাপতি বেণের সময়ে বিনিময়প্রথার শুরু। যা-ই হোক, নথিবদ্ধ তথ্যে গুরুত্ব দিয়ে বলতে হয়, বিনিময়ের জন্যই ‘একক’ পণ্যের ব্যবহার শুরু। মানবসমাজ অনেক কিছুই মুদ্রা বা টঙ্ক (টাকা) হিসেবে ব্যবহার করেছে। লবণ, কফি বিন, শস্যদানা, গরু ও হাঙরের দাঁত, মূল্যবান পাথর প্রভৃতি। আর ভারত উপমহাদেশে (বাংলাদেশসহ) চল ছিল কড়ির।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ বা পঞ্চম অব্দে তুরস্কের এশিয়া মহাদেশীয় অংশে (এশিয়া মাইনর) লিদিয়া অঞ্চলে প্রথম মুদ্রার চল তৈরি হয়। লিদীয়দের মুদ্রা প্রচলনের কাছাকাছি সময়ে প্রাচীন ভারতে ‘মুদ্রা’র প্রচলন হয়। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সুমেরীয়রা বার্লি বিক্রির জন্য প্রথম ধাতব মুদ্রা ব্যবহার করে।
ধাতব মুদ্রার পথ ধরেই আসে কাগুজে মুদ্রা। কাগুজে মুদ্রা বা নোটের প্রচলন শুরু হয় চীনে; তাঙ রাজবংশের রাজত্বকালে (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ)। ১৬৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বে কলোনিতে কাগজের নোটের প্রস্তাব করা হয়। ১৭৬০ সালে প্রথম ডলার ছাপানো হয় এবং তা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়।
আজকের যে অর্থব্যবস্থা তাতে স্বর্ণ-রৌপ্যের ভূমিকা সরাসরি তেমন নেই। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত মুদ্রাব্যবস্থায় কাগজের মুদ্রার সঙ্গে স্বর্ণের সরাসরি যোগসূত্র ছিল। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর আস্থা ছিল স্বর্ণ বা স্বর্ণমানের ওপর। মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে ও মুদ্রামান নির্ণয়ে স্বর্ণ হয়ে ওঠে নিয়ামক।
বাংলাদেশে টাকার প্রচলন
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্থান করে নেয়। স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের অন্যতম প্রতীক হলো নিজস্ব মুদ্রা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রচলন করে নিজস্ব ব্যাংক নোট। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশের ১ টাকা ও ১০০ টাকার ব্যাংক নোট চালু হয়।
আগে এ দেশে পাকিস্তানের ব্যাংক নোট চলত; মুদ্রার নাম ছিল রুপি। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম রাখা হয় টাকা। টঙ্ক কথা থেকে এর উদ্ভব। ৪ মার্চ ১৯৭২ প্রকাশিত দুটি ব্যাংক নোট ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপানো হয়। ১ টাকার নকশায় বাংলাদেশের মানচিত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কথাটি স্থান পায় এবং তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন তখনকার অর্থসচিব কে এ জামান। আর ১০০ টাকার নকশায় দেখা যায় বাংলাদেশের মানচিত্র এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এবং তাতে লেখা বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নোটটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর এ এন হামিদ উল্ল্যাহ্র স্বাক্ষর ছিল। এখন বাংলাদেশে ১, ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ এবং ১০০০ টাকা মূল্যমানের কাগুজে নোট রয়েছে। পাশাপাশি ১, ২ এবং ৫ টাকা মূল্যমানের ধাতব মুদ্রাও আছে। আগে ১, ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সার প্রচলন ছিল, যা বর্তমানে অচল। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পক্ষে কাগুজে নোট প্রচলনের ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ছাপানো টাকা ও কয়েন (মুদ্রা) মিলে রয়েছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক নোট ২ লাখ ৯০ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকার। আর সরকারের নোট ও কয়েন ১ হাজার ৭১৭ কোটি টাকার। তবে দেশে ব্রড মানির পরিমাণ ১৭ লাখ ৫৭ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।
চাইলেই কি নোট ছাপানো যায়?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই টাকা ছাপাতে পারে না। এর জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, তা মেনে কাজ করতে হয়। পুরো বিষয়টি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে বাড়িয়ে দেবে জীবনযাত্রার খরচ। অর্থনীতির স্বার্থেই ভারসাম্য রাখতে হয়।
পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই নতুন নোট ছাপা হয়। অনেক সময় বিশেষ পরিস্থিতিতে টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ছিঁড়ে যাওয়া, পুড়ে নষ্ট হওয়া বা রি-ইস্যু করা যায় না এমন নোট ব্যাংকিং চ্যানেলে মার্কেট থেকে তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঘাটতি পূরণেও নতুন নোট সরবরাহ করা হয়।
ডলার, সরকারের ট্রেজারি বিল বা বন্ডের বিপরীতে বাজারে টাকা ছাড়তে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার যদি বিদেশি ঋণ না পায়, তবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে ট্রেজারি বিল বা বন্ড ছাড়ে। এসব বিল বন্ডের বিনিময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় সরকার। ব্যাংকে তারল্যসংকট তৈরি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বিল বা বন্ডের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়। আবার বিল ও বন্ডের বিপরীতে ডিভলবিং ফান্ড (নতুন টাকা ছাপিয়ে) থেকে সরকারকে ঋণ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
টাকা ছাপাতে সরকারের খরচ
প্রতি বছর নতুন টাকা ছাপাতে সরকারের খরচ হয় সর্বনিম্ন ৫০০ কোটি টাকা। কোনো বছর ৭০০ কোটিও ছাড়িয়ে যায়। নানা কারণে টাকা নষ্ট হয়। প্রতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নষ্ট নোট বাজার থেকে তুলে নিয়ে তার বিপরীতে নতুন নোট ছাড়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ১০০০ টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা। ২০০ টাকার নোটে ৩ টাকা ২০ পয়সা, ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা, ১০, ২০, ৫০ টাকার সব নোটেই দেড় টাকা। আর ৫ টাকা, ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে ১ টাকা ৪০ পয়সা। সবচেয়ে বেশি খরচ হয় কয়েন তৈরিতে। প্রতিটি কয়েনে প্রায় সমপরিমাণ টাকা খরচ হয়। তবে কয়েন বেশি টেকসই। নোট ছাপানোর খরচের কথা চিন্তা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা তথা ক্যাশলেস ব্যবস্থার দিকে যেতে চায়।
টাকার প্রচলন কমানোর উদ্যোগ
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় বিশে^র বিভিন্ন দেশেই এখন নগদ টাকার ব্যবহার কমেছে। বাংলাদেশ সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তঃব্যাংকিং লেনদেনের সুবিধার্থে নিয়ে এসেছে ‘বিনিময়’ নামে অ্যাপ। এর সাহায্যে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে সহজে লেনদেন করা যাবে। আর কেনাকাটায় গ্রাহক ও দোকানির মধ্যে সহজ লেনদেনের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বাংলা কিউআর’।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, যদি ডিজিটাল কারেন্সিকে জনপ্রিয় করা যায়, তাহলে অর্থ বেঁচে যাবে।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আরফান আলী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, সেগুলো ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জ্বালানি তেল ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের দুর্দশা বাড়িয়েছে। ডলার সংকটে অর্থনীতিও বেকায়দায়। অন্যদিকে দুর্নীতি, অর্থ পাচারের অভিযোগ সব মিলে জাতীয় নির্বাচনের আগে ভাবমূর্তির সংকট দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার।
এ অবস্থায় সরকার ও দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চলতি বছর কঠোর কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি মনে করেন, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি আরও পরিচ্ছন্ন করে তুলতে হবে। সে কারণে মানুষকে খুশি করতে হবে। আর সে জন্যই কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোটের মাঠে মানুষকে চমক দিতে চান সরকারপ্রধান। তার এমন সিদ্ধান্তে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজনকে শাস্তির মুখোমুখি পড়তে হতে পারে।
চলতি বছর জনস্বার্থ বিবেচনায় রেখে আরও কিছু কাজ করতে চায় সরকার; বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সরকারকে যে বেকায়দায় ফেলেছে, তা পুষিয়ে নিতে চায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া সর্বজনীন পেনশন সুবিধা দেওয়ার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেটা এবারের বাজেটে স্বল্প পরিসরে হলেও বাস্তবায়ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে সরকারের। আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি নিশ্চিত করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলোচনা করেছেন। কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, সে জন্য পরামর্শও চেয়েছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু দেশের টাকা বিদেশে পাচার। পাচার রোধ করতে সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও অপরাধীদের চিহ্নিত করা ও আইনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
ওই সূত্রগুলো আরও জানায়, এপ্রিল থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশের টাকা বিদেশে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ দৃশ্যমান হবে।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে এমন আলোচনা আছে যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসতে গেলে নির্মোহভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সেটা কার্যকর করতে হবে। করা গেলে ভোটে তার সুফল মিলবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দুর্নীতিবাজ ধরতে আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও কার্যকর করে তোলা হচ্ছে; বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ আরও জোরদার ও দৃশ্যমান হবে নির্বাচনী বছরে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স নীতি আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশে টাকা পাচারকারীরা দেশের শত্রু। অন্যায়, অনিয়ম ও অপরাধীর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকার সব সময় আপসহীন। অর্থ পাচারকারী ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত যারাই রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। অন্যায়-অনিয়মের সঙ্গে আপস করা শেখ হাসিনার নীতি নয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে বলেছেন, “টাকা পাচারকারীদের তালিকা দেন, ব্যবস্থা নেব।” আমি মনে করি টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হবে।’
সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, নির্বাচনের আগে এমন কিছু অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু হবে, যা ভোটের মাঠে সরকার ও আওয়ামী লীগকে আলোচনায় রাখবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস আরও মজবুত করে তুলবে। তার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রশংসিত হবে তেমন কিছু আলোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নীতি অনুসরণ করা হবে।
সরকারের এ পরিকল্পনার কথা সর্বশেষ দলীয় এক কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেও জানিয়েছেন। ওই কর্মসূচিতে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হচ্ছেন! কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সবাই সাবধান ও সতর্ক হয়ে যান। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা তারই ইঙ্গিত ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য, এমনই দাবি করেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও।
কঠোর কী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকম-লীর একাধিক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার যারা করেছেন, প্রথমেই তাদের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশনে’ যাবেন সরকারপ্রধান। তারা বলেন, অপরাধীরা দলের হোক আর যত বড় প্রভাবশালীই হোক, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পিছপা হবেন না টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কেন্দ্রীয় ওই নেতারা আরও বলেন, অর্থ পাচারের বিষয়টি এই মুহূর্তে দেশে-বিদেশে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারলে সরকারের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ঊর্ধ্বমুখী হবে। মাদক কারবারি ও এর সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান জোরদার করা হবে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এ দুটি জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রূপরেখা তৈরির কাজও হয়েছে। অভিযান শুরু হবে সেখান থেকেই। এর সঙ্গে যুক্ত বা আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারাও শাস্তির আওতায় আসবেন। এ ক্ষেত্রে কে দলীয় বা দলীয় নয়, সে বিবেচনা করা হবে না।
আওয়ামী লীগের পদপদবি ব্যবহার করে ক্ষমতা প্রদর্শন করে যাচ্ছেন দলের এই অংশকেও শাস্তির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকে হাঁটবে সরকার। গত এক যুগে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, জনপ্রিয়তার রাস টেনে ধরেছেন সেসব আগাছা-পরগাছা উপড়ে ফেলার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘দানব’ বনে যাওয়া কিছু সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে এমন আভাসও পাওয়া গেছে। তবে ‘দানব’ বনে যাওয়া সংসদ সদস্যদের সবচেয়ে বড় শাস্তি হবে মনোনয়ন না দেওয়া।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত থাকা একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচনী প্রচারে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে যেসব উন্নয়ন শেখ হাসিনার সরকার করেছে সেসব। পাশাপাশি কঠোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি চমক সৃষ্টি করবে ভোটের মাঠে। তারা বলেন, ভোটের আগে ভোটের মাঠে অনেক চমকের মধ্যে এটিও অন্যতম। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে রাখবে তেমন পরিকল্পনা থেকে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অন্যায়-অনিয়মকে কখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্রয় দেননি। এ ক্ষেত্রে নিজের দল ও অন্য দল এ বিবেচনাবোধ নেত্রী (শেখ হাসিনা) করেন না।’ তিনি বলেন, অপরাধীর পরিচয় তার কাছে অপরাধীই।
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায় (কাদিয়ানি) আয়োজিত সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভের সময় পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় আরিফুর রহমান (২৮) নামে এক যুবক মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়াও পুলিশ সদস্য, সাংবাদিকসহ আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৬০ জন। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা জাহিদ হাসান (২৩) নামে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে। গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে দুপুর ২টার পর পঞ্চগড় শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গী মোড়ে সংঘর্ষের শুরু হয়; যা ছড়িয়ে পড়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায়, চলে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত। সংঘর্ষের সময় তৌহিদি জনতার ব্যানারে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বেশ কিছু বাড়িঘর ও দোকান ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।
রাত ৮টার দিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সালানা জলসা আয়োজনের অনুমতি বাতিলের ঘোষণা দিয়ে শহরে মাইকিং করার পর উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়। পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরে ১৭ প্লাটুন বিজিবি ও র্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। তবে কতজনকে আটক করা হয়েছে, সেটা তাৎক্ষণিক জানা যায়নি।
গতকাল জুমার নামাজের পর পঞ্চগড় পৌরসভা এলাকার কয়েকটি মসজিদ থেকে বিক্ষোভকারীরা পঞ্চগড় সিনেমা হল রোডসহ চৌরঙ্গী এলাকায় একত্র হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। তাদের সঙ্গে এলাকার বাইরের অচেনা অনেক মানুষকে যোগ দিতে দেখা যায়। বিক্ষোভকারীরা পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে লাঠিচার্জ শুরু করলে বিক্ষোভকারীরা পাল্টা পুলিশকে ধাওয়া দেয়। তখন পুলিশ পিছু হটে। পরে বিক্ষোভকারীরা সিনেমা হল রোডে আহমদিয়াদের মালিকানাধীন দুটি দোকান ভাঙচুর করে মালামাল বের করে সড়কে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া করতোয়া নদীর পাড়ে ট্রাফিক পুলিশ অফিস ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় সাতটি মোটরসাইকেলও পোড়ানো হয়। একই সময় ধাক্কামারা গোল চক্করে পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। সেখানেও কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর চলে। পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। ভাঙচুর ও আগুনের ছবি তুলতে গেলে এসএ টিভির জেলা প্রতিনিধি কামরুজ্জামান টুটুলকে বেধড়ক মারধর করে বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া আরও কয়েকজন সাংবাদিককে ছবি তুলতে গেলে লাঞ্ছিত করা হয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা জেলা শহরের অদূরে আহাম্মদনগর গ্রামে আহমদিয়াদের জলসা অভিমুখে মিছিল নিয়ে রওনা হলে চৌরঙ্গী মোড় এলাকায় পুলিশ মিছিলটিকে আটকে দেয়। সেখান থেকে বিক্ষোভকারীরা জেলা শহরের সিনেমা হল সড়কে পিছু হটে। বিকেলে করতোয়া নদী হেঁটে ও নৌকায় পার হয়ে কিছু মানুষ আহম্মদনগরে ঢুকে আহমদিয়াদের অন্তত ১৫টি বাড়িঘর ভাঙচুর করে তাতে আগুন জ¦ালিয়ে দেয়। এ সময় তাদের হামলায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কয়েকজন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও ধাক্কামারা এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিল একদল জনতা। এ সময় আহম্মদনগর এলাকার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে হামলা চলছিল বলে জানা গেছে। হামলার ঘটনায় শহরের বিভিন্ন এলাকার বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সঙ্গে বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা যোগ দেন। কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়েন তারা। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন পুলিশ ও বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছিলেন।
সংঘর্ষে নিহত আরিফুর রহমান পঞ্চগড় পৌরসভার মসজিদপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি শহরের একটি প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবস্থাপক ছিলেন। সংঘর্ষের সময় তিনি নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরছিলেন বলে তার স্বজনরা দাবি করেছেন। পঞ্চগড় পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাজেদুর রহমান চৌধুরী আরিফুরের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্বজনরা জানান, দুপুরে শহরের মসজিদপাড়া এলাকায় সংঘর্ষের সময় আরিফুরের মাথায় গুলি লাগে। তাকে প্রথমে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রংপুরে নেওয়ার পথে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তিনি মারা যান।
পঞ্চগড় সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রবিউল আলম দেশ রূপান্তরকে জানান, নিহত আরিফুরের মাথায় গুলির আঘাত ছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রংপুর মেডিকেলে পাঠানো হয়।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কুপিয়ে হত্যা করা জাহিদ হাসানের বাড়ি নাটোরের বনপাড়া এলাকায় বলে জানা গেছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশের চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, বিক্ষোভকারীরা জাহিদ হাসানকে করতোয়া নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা গতকালের সহিংসতায় দুজনের মৃত্যুর তথ্য গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে পঞ্চগড় সদর থানার এসআই কাউয়ুম আলী, ভবেশ চন্দ্র পাল, ট্রাফিক পরিদর্শক কাজী কামরুল ইসলাম, এএসআই মো. আবদুল্লাহ, পুলিশ সদস্য আল-আমিন, ফরিদুর রহমান ও কামরুজ্জামানের নাম পাওয়া গেছে। আহত অন্য ব্যক্তিরা স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রাথমিকভাবে তাদের নাম জানা যায়নি।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসার মিডিয়া সেলে কর্মরত মাহমুদ আহমাদ গণমাধ্যমকে বলেন, তাদের অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে হামলা করে অনেককে আহত করা হয়েছে।
রাত ৯টার দিকে পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তারা জলসা বন্ধ করে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।’
কাছাকাছি সময়ে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সালানা জলসা আয়োজনের অনুমতি বাতিল করেছি। আশা করছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ ছাড়া শহরে পর্যাপ্ত র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে তেঁতুলিয়া-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পঞ্চগড় শাখাসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। পরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। তবে গতকাল দুপুরে মিছিল বের করার বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা অস্বীকার করেছেন। মসজিদ থেকে লোকজন নিজেরাই মিছিল বের করে বলে তাদের দাবি।
সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে সিদ্ধিরগঞ্জে বিক্ষোভ : নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আহমদিয়াদের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। শিমরাইল মোড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল বাদ জুমা ‘অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি বাংলাদেশের’ উদ্যোগে এ সমাবেশ হয়। কমিটির বাংলাদেশের আমির আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সির নেতৃত্বে সমাবেশে পঞ্চগড়ে সালানা জলসা বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান বক্তারা।
দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দেশের জনগণের ক্ষোভ সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি কাজে লাগাতে পারছে না। এমনটাই মনে করছেন দলটির ওপরের সারির কয়েকজন নেতা। তাদের কারও কারও মধ্যে দলের আন্দোলন কর্মসূচি নিয়েও হতাশা আছে। তারা বলছেন, বিএনপি জনগণের দাবি নিয়ে রাজপথে সরব থাকুক তা দেখতে চায় মানুষ। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের অংশ হিসেবে জনগণ এগিয়ে রয়েছে, কিন্তু জনগণের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে বিএনপি।
অবশ্য দলের মহাসচিব বলছেন, রাজনীতির বাস্তবতা অনেক কঠিন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নয়াপল্টনে দলের এক বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর এক দফার কর্মসূচি আসবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এক দফা থেকে সরে গিয়ে দলের পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করা হলো। দেশের জনগণ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না বিএনপি। বিএনপি আদৌ জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের এক দফার আন্দোলনে যেতে হবে। তাই দেরি না করে আগেভাগে ঘোষণা দিয়ে দেওয়াই ভালো।’
বিএনপির আন্দোলনের ধীরগতির বিষয়ে দলটির এক ভাইস চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দেশের জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। জনগণ এর একটা বিহিত চায়। ডিসেম্বর মাসে দেশের জনগণ, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত ছিল। ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশে দলের নেতাকর্মীরা সব বাধা অতিক্রম করে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ সফল করেছে। এসব দেখে সরকাব ছিল আতঙ্কগ্রস্ত। কিন্তু বিএনপির ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এবং দলটির কিছু দায়িত্বশীল নেতার দায়িত্বহীন বক্তব্যে সব ভেস্তে যায়।’
দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের অনৈতিক অভিযানের ক্ষয়ক্ষতি আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ বেশ কিছু নেতাকর্মী এখনো জেলে আছেন। বিএনপি পিছিয়ে নেই। কারণ প্রতিটি আন্দোলনের একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছি। সেটি ছিল একটি পর্যায়ের আন্দোলনের শেষ ধাপ।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের মহাসচিব আগেই বলেছিলেন ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ শেষ কর্মসূচি নয়; বরং একটি ধাপের শেষ কর্মসূচি। তারপরও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আতঙ্কিত হয়ে কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিল। কার্যালয়ে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া কার্যালয়ে তান্ডব চালায়।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দায়িত্বশীল কিছু নেতার দায়িত্বহীন মেঠো বক্তব্যে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথায়। সমাবেশে যোগ দেবেন খালেদা জিয়া। নেতাদের এমন দায়িত্বহীন বক্তব্যে সরকার বিব্রত হয়। আর যার রেশ পড়ে দলের ওপর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভ্রান্ত হন। ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের অভিযান দায়িত্বশীল নেতাদের দায়িত্বহীন বক্তব্যে।’
রাজধানী ঢাকায় ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২২ নভেম্বর নয়াপল্টনে এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘এখনো তো আসল ঘোষণা দিইনি, আসল ঘোষণা আসবে ১০ তারিখ। সেদিন থেকে শুরু হবে এক দফার আন্দোলন।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্রদল নেতা নয়ন মিয়া হত্যার প্রতিবাদে নয়াপল্টনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমাদের জীবন নিয়ে খেলছেন। আমাদের সাতজনকে হত্যা করেছেন। ভাবছেন পার পেয়ে যাবেন? “এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি।” এখানে কোনো কম্প্রোমাইজ (আপস) নেই। যেতেই হবে। তাই শান্তিপূর্ণভাবে চলে যান।’ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে, জেগে উঠতে হবে। আন্দোলনে ফেটে পড়তে হবে। এমনি-এমনি কেউ সরে না, সরাতে হবে। জনগণের বল দিয়ে, শক্তি দিয়ে এ সরকারকে চলে যেতে বাধ্য করতে হবে।’
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের অভিযানের ক্ষত এখনো শুকায়নি। কার্যালয়ের কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক নিয়ে যাওয়ায় অনেক তথ্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী এখনো মুক্তি পাননি। গুরুতর অসুস্থ রিজভীকে নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। যেকোনো সময় যেকোনো অঘটনা ঘটে যেতে পারে। এক দফা আন্দোলনের যে ঘোষণা আসার কথা ছিল তার আগেই আমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। পরে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম ও সরকারবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের পরামর্শে বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফা কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়। এখানে তো আমি একা কোনো সিদ্ধান্ত নিই না। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণের কষ্ট লাঘব ও তাদের হারানো সব সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলনে রয়েছি। জনগণ অনেক সময় আবেগ নিয়ে অনেক কথা বলে। কিন্তু রাজনীতিতে আবেগের জায়গা নেই। আমরা এখন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছি। ধাপে ধাপে আমরা এ আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে নিয়ে যাব। রাজনীতিতে সময় বেঁধে সরকারের পতন ঘটানো যায় না; বরং পরিস্থিতি বলে দেয় কখন কীভাবে আগাতে হবে। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।’
বিভাগীয় সমাবেশের আগে দলের নেতাদের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মাঠের বক্তব্য আর বাস্তবতা এক নয়। তা ছাড়া দলের নীতিনির্ধারক ছাড়া অন্য কারও বক্তব্য বিএনপির সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নেওয়া ঠিক নয়। তবে দলের নেতাদের কথা বলার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। এ ছাড়া জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক সফলভাবে শেষ হওয়ায় জয়শঙ্করকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল শুক্রবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের বৈঠক হয়। গতকাল রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ ছাড়া গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ব্রাজিল, মেক্সিকো, স্লোভেনিয়া এবং সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয়ের বিষয়টি তুলে ধরেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সবার সহযোগিতা চান মোমেন। এ ছাড়া এসব বৈঠকে বাণিজ্য ও সম্পর্ক আরও বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। মেক্সিকোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় মেক্সিকোর দূতাবাস স্থাপনের বিষয়ে আগ্রহের কথা জানান।
‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ থিমের ওপর ভারতের সভাপতিত্বে দিল্লিতে গত বুধবার রাতে নৈশভোজের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিশে^র প্রধান অর্থনৈতিক জোটের (জি-২০) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দুই দিনব্যাপী বৈঠক। গত বৃহস্পতিবার মূল আলোচনা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। অতিথি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন এ বৈঠকে যোগ দেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে ভারত জি-২০ সভাপতির দায়িত্ব পায়। আগামী ৯ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে হবে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। এরই মধ্যে এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশেষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছেন।
ভারতে তিন দিনের সফর শেষ করে গতকাল রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন কাতারের রাজধানী দোহার উদ্দেশে দিল্লি ত্যাগ করেন।
অধ্যাপক ড. অনুপম সেন জীবনে একটি বই লেখার পর যদি আর কোনো বই নাও লিখতেন, তাহলেও তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হয়েই থাকতেন। কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তিনি যে বইটি লেখেন, সেই বইটি এখন ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। ১৯৮২ সালে এ বইটি প্রকাশ করেছিল ইংল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রাউটলেজ অ্যান্ড কেগানপল। গত ২৫০ বছরের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের সেরা ৩০টি বই প্রকাশনা করে এবং এর মধ্যে ড. অনুপম সেনের ‘দ্য স্টেট, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অ্যান্ড ক্লাস ফরমেশনস ইন ইন্ডিয়া’ নামে বইটি রয়েছে। পরে ২০১৭ সালে বইটির দ্বিতীয় দফায় প্রকাশ করা হয়।
বইটি উত্তর আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয় যেমন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়; সুইডেনের টিনবারজেন বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান, উন্নয়ন অর্থনীতি (ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশের আর কোনো লেখকের বই আন্তর্জাতিকভাবে এভাবে পাঠ্য তালিকায় যুক্ত হওয়ার নজির নেই উল্লেখ করে ড. অনুপম সেন বলেন, ‘আমার জানামতে দেশের আর কোনো লেখকের বই এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায় যুক্ত করার খবর আমার জানা নেই। আর এ যুক্ত করার মাধ্যমে শুধু আমি নিজে সম্মানিত হইনি, আমার দেশ বাংলাদেশও সম্মানিত হয়েছে।’
বইটি কেন এত বিখ্যাত হয়েছিল? বইটি কী নিয়ে লেখা হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. অনুপম সেন বলেন, ‘এটি ছিল আমার পিএইচডি থিসিস। এ বইয়ে ব্রিটিশদের পুঁজিবাদে লুণ্ঠনে কীভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ ভারতবর্ষ বা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ গরিব দেশে পরিণত হলো তা তথ্য ও তত্ত্বের সমাহারে তুলে ধরা হয়েছিল।’
বইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডা. আতিউর রহমান লিখেছিলেন, ‘বইটিতে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা হলেও এতে নয়া-মার্ক্সবাদী ভাবনার সংযোজন বেশ স্পষ্ট। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতনটি তিনি ধ্রুপদি মার্ক্সীয় ভাবনাতেই উপস্থাপন করেছেন। এর ওপর যে কাঠামো গড়েছেন তাতে সমকালীন নয়া-মার্ক্সবাদীদের ভাবনা বেশ মুনশিয়ানার সাথেই তিনি সংযোজন করেছেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন অনুপম সেনের ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলী প্রয়াসের প্রকাশিত বইয়ে লেখেন, ‘অধ্যাপক সেন দুটো জায়গায় অত্যন্ত উজ্জ্বল। শিক্ষাদীক্ষার পরিমণ্ডলে তাঁর পরিচিতি বাংলাদেশ ও এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও বিস্তৃত হয়েছে। দ্বিতীয়ত গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর গবেষণা করছে, এমফিল ডিগ্রি অর্জন করছে।’
ড. অনুপম সেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল থেকে এসএসসি, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নেওয়ার পর ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ ১৯ জন শিক্ষক চট্টগ্রামে চলে আসেন। সে সময় ড. অনুপম সেনও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। সেই থেকে তিনি চট্টগ্রামে রয়ে গেছেন। মাঝে ১৯৭২ থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত পিএইচডি ডিগ্রির জন্য কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। ২০০৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নামেই যিনি বিখ্যাত। বিশ্বের যেকোনো দেশে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। এমনকি রাজধানী শহর ঢাকায়ও থাকেননি, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা অনেক শিক্ষক পরবর্তী সময়ে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেও ড. অনুপম সেন আর যাননি। তিনি চট্টগ্রামে রয়ে গেলেন। এখন যেখানে মানুষ সুযোগ পেলেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উন্নত দেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, সেখানে তিনি কেন গেলেন না? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে ড. অনুপম সেন বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামকে ভালোবাসি। চট্টগ্রামের মায়া আমাকে কোথাও যেতে দেয় না। আর তাই এখানেই আছি ও থাকব।’
কিন্তু তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি যে চট্টগ্রামকে দেখেছি এখন আর সেই চট্টগ্রাম নেই। আমার স্বপ্নের চট্টগ্রাম আজ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। এখানের পাহাড়গুলোকে কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। এখানে সবুজকে কেটে বিনাশ করা হয়েছে। পাহাড়, নদী ও সমুদ্রের যে মিশেল চট্টগ্রাম ছিল সেই চট্টগ্রাম আজ বিপন্ন। অপরিকল্পিত নগরায়ণে ক্ষত-বিক্ষত চাটগাঁ।’
৮৩ বছর বয়সেও গত বৃহস্পতিবার প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ কক্ষে যখন দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, দিন, সাল অনুযায়ী সব সঠিক করে কথা বলছিলেন। এত বয়সেও পুরনো দিনের কথা কীভাবে মনে রাখেন? আবার নাগরিক আন্দোলনেও সামনের সারিতে থাকেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীরও সদস্য বরেণ্য এ শিক্ষাবিদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে ড. অনুপম সেন বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের গবেষণায় আছে যে ব্যক্তি সৃজনশীল কাজের সঙ্গে বই পড়া ও লেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন, বুদ্ধিবৃত্তীয় কাজ করেন তাদের মস্তিষ্ক উর্বর থাকে। একই সঙ্গে যারা কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের মস্তিষ্কও ভালো কাজ করে। আর আমি যেহেতু চিন্তাশক্তির কাজ করি তাই আমার স্মৃতিশক্তি এখনো প্রখর রয়েছে।’
অনুপম সেনের কৈশোর : পটিয়ার ধলঘাটে তার পৈতৃক নিবাস হলেও ড. অনুপম সেন ১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম মহানগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডে তাদের নিজস্ব বাড়িতে। তখনকার সময়ে ওই এলাকায় তেমন পাকাবাড়ি ছিল না। একমাত্র অনুপম সেনদের বাড়িটি পাকা ছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় অনুপম সেনদের পরিবার গ্রামের বাড়ি পটিয়ার ধলঘাটে চলে যান। যুদ্ধকালীন সেখানেই অবস্থান করেন। ছাত্রজীবনে ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন। তিনি মূলত ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নামতেন। চিটাগাং ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন।
পারিবারিক জীবন : ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক শ্রী লোকনাথ বলের ভাইয়ের মেয়ে উমা সেনগুপ্তার সঙ্গে ড. অনুপম সেনের বিয়ে হয় ১৯৬৬ সালে। তাদের একমাত্র মেয়ে ইন্দ্রানী সেনগুহ। পারিবারিক জীবনের কথা বলতে গিয়ে ড. অনুপম সেন বলেন, ‘২০০৯ থেকে ২০২০ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত আমার স্ত্রী শয্যাশায়ী ছিল। ব্রেন স্ট্রোকের পর থেকে তিনি আর বিছানা থেকে উঠতে পারেননি।’ জানা যায়, পুরো এ সময়টা সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার পর থেকে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পর্যন্ত ওষুধ খাওয়া থেকে শুরু করে পুরো শুশ্রুষা ড. সেন নিজেই করতেন। বর্তমানে তার মেয়েও একজন সমাজবিজ্ঞানী।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপম সেন : ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন অনুপম সেন। তখন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ড. শামসুল হক, পরে যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে লালদীঘি ময়দানে গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে প্রতিদিন কর্মসূচি শুরু করেন। এ সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের তখনকার শিক্ষক আবু জাফর, চট্টগ্রাম কলেজ বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমেদ এবং ইংরেজির অধ্যাপক কবি মোহাম্মদ রফিক ড. সেনের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করেন। এ সময় প্রতিদিন ট্রাকে করে র্যালি করার পর সবাই লালদীঘিতে এসে জমায়েত হতো। ২৪ মার্চ লালদীঘি থেকে তা চকবাজার প্যারেড মাঠে স্থানান্তর করা হয়েছিল। আর সেদিন রাতে মঞ্চে নাটক চলাকালীন চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ অস্ত্র নিয়ে ভেড়ানোর খবর পাওয়ার পর সবাই অনুষ্ঠান থেকেই সেখানে যায়। পরে যুদ্ধকালীন খাগড়াছড়ির রামগড় হয়ে ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুমে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে আগরতলা হয়ে কলকাতায় যান। আর কলকাতায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় প্রফেসর আনিসুজ্জামান, রামেন্দু মজুমদার, জহির রায়হান, কবি আল মাহমুদসহ একসঙ্গে ছিলেন বলেন জানান অনুপম সেন। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান অনুপম সেন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘অনুপম নেন একজন সমাজ সচেতন মানুষ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতিরূপে এবং ব্যক্তিগতভাবে আশির দশকের অধিকাংশ সময়ে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুুক্তিযুদ্ধের সময়ও তার একটা ভূমিকা ছিল। গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি তার অঙ্গীকার অত্যন্ত দৃঢ়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে নিয়েও তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সমর্পিত।’
প্রথম শিক্ষকতা জীবন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেওয়ার পর ফলাফল প্রকাশের আগে ১০ মাস (১৯৬৩-৬৪ সাল) শিক্ষকতা করেছিলেন চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজে। আর তখন এই কলেজের ছাত্র ছিলেন চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরে তিনি ১৯৬৫ সালে তিনি বুয়েটে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে সমাজবিজ্ঞানের পাশাপাশি টাউন প্ল্যানিং নিয়ে পড়াতেন। ১৯৬৬ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২০১৪ সালে একুশে পদকপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক সমাজবিজ্ঞানীয় ড. অনুপম সেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে অন্যতম প্রধান মানুষ হচ্ছেন অনুপম সেন। যাকে পন্ডিত বলে এবং পান্ডিত্যের সঙ্গে যাদের প্রজ্ঞা আছে, অনেকদূর পর্যন্ত চিন্তা করতে পারে, শুধু নলেজ নয়, উইজডম পর্যন্ত আছে, তাদের মধ্যে অনুপম সেন একজন। এ মানুষটিকে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি। আর আমি তার গুণের প্রমাণ অনেক পেয়েছি।’
এদিকে বিশিষ্ট লেখক আলী প্রয়াসের সম্পাদনায় অনুপম সেনকে নিয়ে কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ড. সেনের নিজের লেখা প্রায় ১৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কেমন চট্টগ্রাম দেখতে চান? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. অনুপম সেন বলেন, ‘চট্টগ্রামের সবুজ ফিরিয়ে আনতে হবে। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোকে রক্ষা করতে হবে। এ সবুজের জন্যই আমরা সিআরবি রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছিলাম।’
বাংলাদেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস রবিবার।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করে।
তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখণ্ডের, যার নাম বাংলাদেশ।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।
রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের আকাশে দেখা দিয়েছে শঙ্কার মেঘ। কয়েক মাস ধরেই খাতটির উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয় কমে যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। তারা বলছেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আগামীতে ওই সব অঞ্চলে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। তাদের ভাষ্য, ইতিমধ্যে তার প্রভাবও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। অর্ডার কমে যাওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও বলছে সে কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে এই খাতের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির পুরোটাই আমদানিনির্ভর; যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাপক হারে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) টেক্সটাইল ফেব্রিক্স আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৬২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৬৫ কোটি ডলার।
তবে প্রস্তুত কাপড়ের চেয়ে বেশি আমদানি কমেছে কাঁচামালের। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কাঁচা তুলা বা কটন আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে কাঁচা তুলা আমদানিতে ১৫৩ কোটি ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তুলা আমদানিতে ২৭২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আবার তুলার চেয়ে সুতা আমদানি আরও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুতা আমদানিতে এলসি খোলা হয় ১০৭ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৪২ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ। এই সময় টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৬৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। আর এটি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা নতুন কলকারখানা স্থাপন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ‘ধস’ নামার একটা অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক পতন, বিভিন্ন দেশে মন্দার শঙ্কাসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে দেশে ডলার সংকট দেখা দিলে এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। এতে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমানো গেলেও আমদানি জটিলতায় পড়েছে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি বাড়ায় রপ্তানি আয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব পড়েনি। যেহেতু সাধারণ পোশাক রপ্তানি কমেছে সে কারণে কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিও কমেছে। পাশাপাশি ডলার সংকটও আমদানি কমে যাওয়াতে ভূমিকা রেখেছে। ফারুকের আশঙ্কা, উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকিং খাতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার কারণেও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে এসব বিষয় মোকাবিলায় পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থের সংকট রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারছে না। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়নের কারণে মালিকরা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনছেন না। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমায় আমদানির পরিমাণে প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করেন ফজলে শামীম এহসান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দার আশঙ্কায় কেউ নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। তবে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়াটাকে তারাও আসন্ন সংকট হিসেবে দেখছেন। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে ডলারের সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানি করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। তবে তিনি আশাও দেখছেন। তার ভাষ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় মূলত আমদানি ব্যয় কম হয়েছে। আমদানির পরিমাণ খুব একটা কমেছে বলে মনে করেন না তিনি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন না হওয়ায় চাকরি স্থায়ীকরণ হচ্ছিল না। কিন্তু তার দেরি সয়নি। নিজের তত্ত্বাবধানে থাকা সার্ভিস বইয়ের পাতায় কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে স্থায়ী করে নিলেন নিজের চাকরি। এই ব্যক্তি হলেন ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. মনোয়ার হোছাইন। স্থানীয় সরকার বিভাগ তদন্তের পর থানায় মামলা হয়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের চারটির প্রমাণ মিলে। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইনের দুটি ধারায় তার ১২ বছর সাজা ও অর্থদ- হয়েছে। পুলিশ মনোয়ারকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ১৯ মে ‘ক্রু’ বা মশককর্মী পদে যোগ দেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, এলডিএ কাম টাইপিস্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি ওই পদও বাগিয়েছেন। ওই পদ থেকে উচ্চমান সহকারী (হেড ক্লার্ক) পদেও পদোন্নতি নিয়েছেন। এরপর দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নেন। তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেওয়া এই কর্মকর্তার বাদ ছিল চাকরিতে স্থায়ী হওয়া। প্রথমবার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি নেওয়ার পর তার উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়ে যায়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল স্বাক্ষর করে চাকরি স্থায়ী করেন। এর আগে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদারকে চাকরি স্থায়ী করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
এ ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দুদকের তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে তার স্বাক্ষর জাল করার বিষয়ে অভিযোগ করেন। ২০১১ সালে মনোয়ারকে বরখাস্ত করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদার তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন প্রমাণও জমা দেন। তিনি লিখিত বক্তব্যে জানান, অভিযুক্ত মনোয়ার হোছাইনের চাকরি স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত চাকরি বইয়ের দ্বিতীয় খ-ের নবম পৃষ্ঠায় যে স্বাক্ষর রয়েছে তা তার নয়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখের স্বাক্ষরটি মনোয়ারের সৃজনকৃত। চাকরিকালীন তার বিষয়ে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো হয়নি। এ জন্য তার চাকরিও স্থায়ী করা হয়নি। আর সার্ভিস বইয়ে যে সিল ব্যবহার করা হয়েছে তা তার সময়ে ব্যবহৃত সিল থেকে ভিন্ন। সিলের নিচে যে স্বাক্ষর রয়েছে তিনি বলতে পারবেন সেটা কীভাবে হলো। ইস্যু রেজিস্টার খাতায় ৪৬ নম্বর দিয়ে যে চিঠিটি তৈরি করা হয়েছে তার কোনো কপি কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। ৪৬ নম্বর ক্রমিকটি ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি লেখা রয়েছে। অন্যান্য কলাম খালি রয়েছে। পরের পাতায় ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি ২৬ নম্বর ক্রমিক দিয়ে একটি বদলির চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও জানান, ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের বিধি-বিধান অনুযায়ী নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বই তার কাছে রক্ষিত ছিল। এ কারণে জাল স্বাক্ষরের দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। দপ্তরে জমা দেওয়া তার এলএলবি পাসের সনদও সঠিক ছিল না। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে তার ওই সনদ সঠিক নয় বলে লিখিতভাবে দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
মনোয়ারের বিরুদ্ধে অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বাক্ষর জাল, নিজেই নিজের চাকরি স্থায়ীকরণ এবং নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বইয়ে ত্রুটি ঘটানোসহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে চারটি অভিযোগের প্রমাণ মেলে।
ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশে ২০১৩ সালের ১৮ জুন দপ্তরের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা (নম্বর-৪) করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়। দুদক তদন্ত করে মনোয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট আইনের একটি ধারায় তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদ- দেয় আদালত। আরেকটি ধারায় সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের বরখাস্ত উচ্চমান সহকারী মনোয়ার হোছাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল এবং আদালতের সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা কত কিছু করছে। কোথায় আবার কী করেছে বুঝতে পারছি না। এ প্রসঙ্গটি বারবার উত্থাপন করলেও তিনি এড়িয়ে যান।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তান যা বলে, তারাও (বিএনপি) তাই বলে। কারণ তারা পাকিস্তানি ভাবধারায় উজ্জীবিত, তাদের হৃদয়ে পাকিস্তানি চেতনা।
আজ রবিবার (২৬ মার্চ) ভোরে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দাবি 'আওয়ামী লীগের ভুলের জন্য গণহত্যা হয়েছিল'- এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, তাদের (বিএনপি) হৃদয়ে পাকিস্তানি চেতনা। তারা এমনটা বলবে, এটাই সমীচীন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার শত্রুরা সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ; এমন নানা পোশাকে স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করে। এই অপশক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সোনার বাংলা গড়ার পথে রয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া এখন অন্যতম অঙ্গীকার।
এর আগে, জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুলউল আলম হানিফ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)