
লেবাননে গিয়েছিলাম বছর কয়েক আগে। দেশটা অনেক দিক থেকে কৌতূহলের। একসময় পরিচিতি ছিল এশিয়ার ইউরোপ হিসেবে, সৌন্দর্যে-চিন্তায়-আধুনিকতায় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ছাপটা তাদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি ছিল। আবার উল্টোপিঠে যুদ্ধের বীভৎসতা। সিরিয়া-ইসরায়েলে পরিবেষ্টিত, আইএস-হিজবুল্লাহ সমীকরণে পিষ্ট দেশটার সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের আরেকটা সূত্র বিটিভির একসময়ের আটটার সংবাদ। বিরতির পর বেশির ভাগ দিনই খবর শুরুই হতো, ‘বৈরুতে বোমা হামলায়...’, সেই হামলা আর নানামুখী যুদ্ধে বৈরুত প্রায় শ্মশানের মতো কিছু একটা হবে ধরে বিমানবন্দরে নেমে চক্ষু যাকে বলে চড়কগাছ। ভূমধ্যসাগরের বুকে কেউ যেন ছবি এঁকে তৈরি করেছে শহরটাকে। এমন প্রাণবন্ত জীবনযাত্রা আর সুন্দরের বয়ে চলা যে দেখে মনে হলো, হাঁস যেমন গা থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে বৈরুত যেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলা সেভাবেই ঝেড়ে শামিল উত্তাল জীবনানন্দে।
এই উপভোগ্য বৈপরীত্যের মানে বের করতে নিজের মতো একটা তদন্তে নামলাম। যার সঙ্গেই দেখা হয়, তার সঙ্গেই ইতিহাস-জীবনাচরণের দিকে আলোচনা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কোথাও জমে। কোথাও জমে না। একজনের সঙ্গে জমল। বৈরুতের চরিত্র, বোধ-ভাবনার গভীর আলোচনার একফাঁকে জানতে চাইলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে।
‘তোমার দেশে ক্ষমতায় কে?’
‘শেখ হাসিনা।’
‘বাহ, বেশ ভালো। মুসলিম কোনো দেশে নারী নেতৃত্ব আনন্দের বিষয়। তা মানুষ সেটা মেনে নিচ্ছে! বিরোধী দলের তো ঝামেলা করার কথা।’
‘বিরোধীরা ঝামেলা করবে কী? তাদের প্রধানও তো একজন নারী।’
‘বলো কী’, ভদ্রলোকের হাতে পানীয়ের গ্লাস ছিল। ছিটকে পড়ার দশা।
‘আরও আছে। আমাদের তৃতীয় প্রধান দলের নেতাও নারী।’
‘তুমি মজা করছ!’
‘আরে না। মজা করার যুগ কি আছে।’ আমি হাতের মোবাইল দেখিয়ে বলি, ‘তুমি চেক করতে পার।’
‘এ তো দেখছি পুরো নারী রাজ্য।’
‘হুম, সেই রাজ্যের জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী।’
ভদ্রলোকের মুখ এমন হাঁ হলো যে সেখান দিয়ে একটা হাঙরও ঢুকে যেতে পারে। আর আমি বৈরুতের সেই সন্ধ্যায় যেন দেশকে নতুন করে চিনলাম। বিদেশিদের চোখে দেশ দেখার মধ্যে একটা মজা আছে। আমরা যা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত বলে মেনে নিই, প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয় না, বিদেশিরা সেগুলো যখন যুক্তি দিয়ে দেখতে চায়, তখন সবকিছু অন্যভাবে ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ তাই ফুটে উঠল, নারী ক্ষমতাপুষ্ট একটা দেশ হিসেবে।
ওপাশে যে মানুষটি তার কাছে সেটা আরও বিরাট ব্যাপার, কারণ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটির গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে ক্ষমতা ভাগাভাগির অদ্ভুত একটা প্রথা প্রতিষ্ঠিত। দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন একজন ম্যানোরাইট খ্রিস্টান। প্রধানমন্ত্রী হবেন সুন্নি মুসলিম। উপপ্রধানমন্ত্রী অর্থোডক্স খ্রিস্টান, স্পিকার শিয়া মুসলমান। যে দেশে নিয়ম করে একেকটা পদ একেকটা গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ করতে হয়, সে দেশের একজন মানুষের কাছে সব গুরুত্বপূর্ণ পদ নির্দিষ্ট কোনো ধরনের মানুষের কাছে যাওয়া বিস্ময়কর হবে। সেটা যখন হবে নারীদের এবং দেশটা হবে মুসলিম অধ্যুষিত, তখন পিলে চমকানো স্বাভাবিক। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম সেখানে আধো অন্ধকার, চেহারাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, তবু মনে সেই বিস্মিত মুখটা এমন গেঁথে আছে যে, চোখ বন্ধ করলে আজও পরিষ্কার দেখতে পাই।
বিস্ময় শেষে মুগ্ধতার গলায় বললেন, ‘যাক ভালো লাগল জেনে যে, এরকম একটা দেশে নারীরা ভালো আছে। তাদের নিশ্চয়ই বঞ্চিত হতে হয় না।’
বিদেশে গেলে এই আরেক ব্যাপার। দেশপ্রেমটা অন্য মাত্রা নিয়ে হাজির হয়। দেশের সম্পর্কে ভালো ভালো সার্টিফিকেট পেতে ইচ্ছে করে। সত্য চেপে গিয়ে ভুল স্বীকৃতি সগর্বে গ্রহণ করে নিলাম।
ওকে বলতে ইচ্ছে হলো না যে, এই দেশে এখনো ধর্ষণের খবর এত এত আসে যে, সবসময় পত্রিকায় জায়গাও পায় না। বখাটেদের উৎপাতে বালিকার আত্মহত্যা, বাল্যবিবাহে সম্ভাবনাময় শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার ঘটনাগুলোর বিপুলসংখ্যার কারণে আলাদা করে নজরেই পড়ে না। সময়ে নারীদের ক্ষেত্রে পৃথিবীর উদারতা বাড়ছে। আমরা বাড়াচ্ছি কঠোরতা। নারীশক্তির এমন অপচয় হয় যে, নারীমুক্তির বড় বড় কথা শুনলে হাসি পায়। তাদের আরও ঘরে থাকতে হবে, আরও বাধ্য হতে হবে পুরুষ অংশীদারেরউগ্র মৌলবাদীরা এসব অদ্ভুতুড়ে দাবি নিয়ে হাজির হয়। আর নষ্ট রাজনীতির অঙ্কে এগুলো একটা পর্যায়ে প্রশ্রয়ও পায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী নেত্রী-স্পিকার সবাই নারী হওয়া সত্ত্বেও।
কোনো ক্ষেত্রে নিজের চিন্তার বিপরীত ঘটনা থামার নয় দেখলে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার ঘটে। তাই ঘটেছিল আমার ক্ষেত্রে। ঠিক সেই সময় একটা অদ্ভুত আমন্ত্রণ। স্কয়ার গ্রুপের ‘রাঁধুনী কীর্তিমতী’ প্রতিযোগিতার বিচারক হতে হবে। অনুরোধ-সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে একটু দোনোমনা করেই রাজি হয়ে গেলাম। নারীদের কীর্তির ফিরিস্তিসংবলিত অনেকগুলো খাতা এলো। স্তূপ দেখে ভয়ই পেলাম। বেশ ঝক্কির কাজ হবে।
এক রাতে দেখতে বসেছি। শুরুতে নিরুৎসাহ। কিন্তু দেখতে দেখতে এমন উল্টো প্রবাহ যে, এক পর্যায়ে লাফ দিয়ে উঠলাম। স্তব্ধ হয়ে রইলাম কখনো। চোখে জলও এলো দুয়েকবার। নিজের অজ্ঞতার জন্য নিজের কাছে অত লজ্জা পাইনি কোনোদিন। সেদিন যেমন পেলাম। আমরা শহরে বসে, ফরমায়েশি সেমিনার আর সিম্পোজিয়াম করে আসলে আসল সত্য থেকে অনেক দূরে সরে আছি। জানি না, জানতেও পারি না, আমাদের সুবিধাবঞ্চিত নারীরা বাধার হিমালয় কীভাবে ডিঙাচ্ছে পাথুরে পায়ে। ওয়াসফিয়া আর নিশাত সত্যিকারের হিমালয় জয় করেছে, কিন্তু সেদিন থেকে মনে হয় প্রান্তিক নারীরা কেউ কেউ এর চেয়েও উঁচু হিমালয় পার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গত বছরই সম্ভবত, রাজশাহীর একজনের কীর্তির কথা এলো সামনে। হিতৈষী ক্যাটাগরিতে আসা নারীটি খুবই সাধারণ, দরিদ্র। তিনি রাজশাহীর হাসপাতালের সামনে বসে থাকেন। যেসব গুরুতর রোগীর দেখার কেউ নেই, এমনকি টাকা-পয়সা বা স্বজন নেই বলে হাসপাতালও রাখে না, নারীটি তাদের সেবা করেন। কুষ্ঠ বা জটিল রোগের কারণে হয়তো ডাক্তার-নার্সরাও যাদের ঠেলে দেন, তাদের গায়েই তিনি হাত রাখেন পরম মমতায়। ইনি তো আমাদের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল-মাদার তেরেসা।
এ বছর সাংবাদিকতায় সেরার পুরস্কার জিতেছেন রংপুরের এক নারী সাংবাদিক। ডিভোর্স হয়েছে, সন্তান স্পেশাল চাইল্ড, কিছুই কিছু না। খবরের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান স্কুটিতে চেপে। স্কুটি চলে। চাকার নিচে জীবনের সব না পাওয়া চাপা পড়ে। নারীত্ব আর বীরত্ব একাকার হয়। মিলেমিশে যে শক্তি সেই শক্তিই আসলে বাংলাদেশের জ্বালানি। আমাদের দেখার চোখ নেই। তাই সব দেখি না। কিছু সামনে আসে। অজস্র রয়ে যায় আড়ালে। আর এখানেই ‘রাঁধুনী কীর্তিমতী’র কীর্তি। এমন কিছু বীর নারীকে সামনে এনে যে কাজটা তারা করছে কোনো ধন্যবাদই এর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রত্যাশা করি, প্রচেষ্টাটা সময়ে আরও উজ্জ্বল হবে। ব্যাপ্তি হবে আরও বিস্তৃত।
কয়েক বছর আগে ঈদে বাড়ি গেছি। দাওয়াত মিলছে প্রচুর। যেতেও হচ্ছে কিছু জায়গায়। যাচ্ছি, খাচ্ছি, রান্নার প্রশংসা করছি। করতে করতে মনে হলো, এই রান্নাগুলো তো করছে পরিবারের নারী সদস্যরা। তাদের ঈদটা তাহলে কোথায়! একটু খোঁজখবর করে দেখলাম, তাদের ঈদ এটাই। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা দাওয়াত করবে, অন্যদের ডাকবে এবং রান্নায় কৃতিত্ব দেখিয়ে নারীরা সার্থকতা অর্জন করবে। মাঝেমধ্যে সান্তনা পুরস্কার হিসেবে কোথাও বেড়াতে যেতে দেওয়া হবে। কিংবা কিছু বকশিশ। ব্যাপারটা বেদনার, তার চেয়েও বড় বেদনার বিষয় হলো পুরো সমাজ এটাকেই গ্রহণযোগ্য মনে করে। একটু আধুনিক মনে হয়, এমন দুয়েকজনের কাছে বিষয়টা তুলে দেখলাম। লাভ হলো না। তাদের কাছে এসব ফালতু বাত। বিলাসী শহুরে চিন্তা।
এমন ফালতু বাতের আরেকটা ঝামেলায় পড়েছিলাম। ইংল্যান্ডে। বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেছি, তখনও রান্না শেষ হয়নি। তার খোঁজে রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখি, সে মোটামুটি টমি মিয়া সেজে এপ্রোন পরে পেঁয়াজ কাটছে। বন্ধুর স্ত্রীও ব্যস্ত অন্য একটা কাজে। দুজনের সমান অংশগ্রহণ।
খাওয়ার পর এক পর্যায়ে বললাম, ‘দেশে থাকতে তো তোমাকে কোনোদিন রান্নাঘরে দেখিনি। এখানে...’
‘উপায় নেই। এটা লন্ডন।’
‘দেশে তাহলে সম্ভব নয় কেন?’
বন্ধুর স্ত্রী হাসতে হাসতে বলল, ‘সম্ভব নয়, কারণ দেশে কেউ দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার হবে।’
‘আর এখানে?’
‘লজ্জাটা উল্টো। লজ্জার ব্যাপার হবে এটা, যদি কেউ দেখে আপনি নিজে বাবু হয়ে বসে অন্য কাউকে দিয়ে বেশি কাজ করাচ্ছেন। পার্টনারশিপ মানে সমান অংশগ্রহণ।’
তাহলে সমস্যা আমাদের বাবুগিরি মানসিকতার। সমাধান, সঠিক লজ্জাবোধ তৈরি।
সীতাকুণ্ডের কদম রসুল এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোর বিস্ফোরণের ক্ষত না শুকাতেই একই এলাকায় আবারও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল অক্সিজেন প্ল্যান্টে। ‘সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড’ নামের প্ল্যান্টে গতকাল শনিবার বিকেল ৪টার দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে কেঁপে ওঠে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা। দুর্ঘটনার পর প্ল্যান্টের ভেতরে পাঁচজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্ল্যান্টের বাইরে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ২২ জন। এ ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। দুর্ঘটনার কারণ এখনো জানা যায়নি।
বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল প্ল্যান্টটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আর পুরো প্ল্যান্টের ওপরের ছাউনি উড়ে গেছে। স্থাপনার লোহার রডগুলো বেঁকে রয়েছে।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্ল্যান্টের মধ্যে একটি বড় সিলিন্ডার রয়েছে যেখানে অক্সিজেন উৎপাদিত হয়ে জমা হয়। পাইপের মাধ্যমে একটি স্পটে আসে। সেই স্পট থেকে ছোট আকারের অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলোতে অক্সিজেন রিফিল করা হয়। পুরো প্ল্যান্টে অক্সিজেন রিফিল করার দুটো স্পট রয়েছে। প্রতিটি স্পটে ৬ জন করে দুই স্পটে ১২ জন ডিউটিরত ছিলেন। বিস্ফোরণের পরপরই ওপরের ছাউনিগুলো উড়ে যায় এবং পাশের অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলোর নিচে চাপা পড়ে ওখানে কর্মরত শ্রমিকরা।
এ ঘটনায় নিহত পাঁচজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন শামসুল ইসলাম (৪০), ফরিদ (৩৬), রতন লকরেট (৪৫), আবদুল কাদের (৫০) ও সালাহউদ্দিন (৩৫)। বাকি একজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিহতদের মধ্যে পাঁচজনের মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও একজনের মরদেহ ভাটিয়ারি বিএসবিএ হাসপাতালে রয়েছে বলে সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ জানান। এ ছাড়া ২২ জন আহত হলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মো. নূর হোসেন ( ৩০), মো. আরাফাত (২২), মোতালেব (৫২), ফেনসি (৩০), মো. জসিম উদ্দিন (৪৫), নারায়ণ (৬০), মো. ফোরকান দাদা (৩৫), নাসিম শাহরিয়ার (২৬), মো. জাহিদ হাসান (২৬), মাকসুদুল আলম (৩০), মোহাম্মদ ওসমান (৪৫), মোহাম্মদ সোলায়মান (৪০), মোহাম্মদ রিপন (৪০) ও রোজী বেগম (২০)।
পুরো প্ল্যান্ট ঘুরে দেখা যায়, অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া পাশের একটি ভবনের দেয়ালে ফাটল দেখা গেছে। কারখানার সীমানা দেয়ালটি ভেঙে গেছে। প্ল্যান্টের বাইরে আরেকটি কারখানা ছিল সেটিও লোহার পাতের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আশপাশের মানুষের ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে এক শ্রমিক বলেন, ‘প্ল্যান্টের এই পাইপটি (চিমনি) ১০০ ফুট উঁচু ছিল। এর ওপরে ছিল ছাউনি। নিচ থেকে কী পরিমাণ শক্তিতে বিস্ফোরণ হলে তা পুরো উড়ে গিয়ে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডে পড়ে চিন্তা করে দেখেন।’ আর পুরো প্ল্যান্টটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এদিকে বিস্ফোরণে অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে একটি লোহার খণ্ড প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে উড়ে গিয়ে শামসুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির মাথার ওপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এমনিভাবে আশপাশের সকল বাড়িঘরের গ্লাসও বিস্ফোরণের শব্দে ভেঙে যায় এবং আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে লোহার খণ্ড।
কীভাবে হয়েছে এই দুর্ঘটনা?
দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে কেউ কথা বলতে নারাজ। এখনই চটজলদি কোনো মন্তব্য করতে চায় না কেউ। ঘটনাস্থলে শুরু থেকে উপস্থিত থাকা সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো উদ্ধার করা। উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করার পর কী কারণে হয়েছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে।’
অক্সিজেন প্ল্যান্টের একাধিক শ্রমিক জানান, প্ল্যান্টের মধ্যে কারিগরি কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো। অথবা যে পয়েন্টে সিলিন্ডারে রিফিল করা হয় সেখানে কোনো সমস্যা হলো কি না সেটাও দেখার বিষয়। তবে এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় কেউ।
তবে এখনই কারণ বলতে নারাজ ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়া। তিনি বলেন, ‘আগে উদ্ধার শেষ করি, পরে কারণ অনুসন্ধান করব। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে।’
কিন্তু ধ্বংসস্তূপের নিচে কী পরিমাণ লোক চাপা রয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে কারখানার লোকজন জানান, এখনই এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। সাধারণত পুরো কারখানায় ২০০ শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু বিস্ফোরণের সময় কতজন কাজ করছিলেন তা জানা নেই।
গাউছিয়া কমিটির সদস্যদের একজন মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকায় আগুনের কু-লী ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে তা নিভে যায়। তবে এখান থেকে লোহার পাতগুলো আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।’
স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুল আলম বলেন, ‘অক্সিজেন কারখানা থেকে আমার বাড়ি অন্তত আধা কিলোমিটার দূরে। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘরের দরজা এবং জানালা ভেঙে নিচে পড়ে যায়।’
শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন উৎপাদিত হতো কারখানাটিতে শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন উৎপাদিত হতো কারখানাটিতে। এটি সীমা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রয়াত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। জাহাজভাঙা শিল্পে লোহা কাটার জন্য যে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় সেখানে এবং অন্যান্য কারখানায় অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় প্রতিষ্ঠানটি থেকে। ১৯৯৭ সালে কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কারখানাটি থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ সিলিন্ডার অক্সিজেন উৎপাদিত হতো। মূলত বাতাস থেকে অক্সিজেন পৃথককরণ করে সিলিন্ডারে অক্সিজেন সংরক্ষণ করা হয়। তাদের মালিকানাধীন সীমা স্টিল রিরোলিং মিলস রয়েছে। সেই কারখানায় বছর দশেক আগেও একবার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল।
জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। এ সময় তিনি আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা খরচ সরকারের পক্ষ থেকে বহন করা হবে বলে ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রাকিব হাসানকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদপ্তরের কর্মকর্তা ও সীতাকুন্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৪ জুন সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে প্রায় ৬০০ মিটার উত্তরের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল।
দেশের বিচারিক আদালতগুলোতে মৃত্যুদণ্ড কমছে। একই সঙ্গে এক মামলায় বেশিসংখ্যক আসামিকে সর্বোচ্চ এই সাজা দেওয়ার প্রবণতাও কমে আসছে। বিকল্প সাজা হিসেবে আমৃত্যু ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ের সঙ্গে এর আগের ছয় মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে এই প্রবণতা দেখা গেছে।
গত বছরের ৩১ মে দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকায় ‘কেন এত বেশি মৃত্যুদণ্ড’, ১ জুন ‘৮৬ শতাংশ মৃত্যুদণ্ডই টেকেনি হাইকোর্টে’ এবং ২ জুন ‘প্রাণদন্ডের পক্ষে-বিপক্ষে’ শিরোনামে ধারাবাহিক তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনগুলোতে ব্যাপকহারে মৃত্যুদণ্ড, সর্বোচ্চ সাজার প্রভাব, উচ্চ আদালতে বেশির ভাগ দন্ড বহাল না থাকা, দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক দুরবস্থা, দণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগেই বছরের পর বছর কনডেম সেলে রাখার বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও বিশ্লেষকদের নানা অভিমত উঠে আসে।
প্রতিবেদন তিনটি প্রকাশের পর থেকে দেশ রূপান্তর মৃত্যুদন্ডের রায়ের তথ্য সংরক্ষণ করতে শুরু করে। ছয় মাসের তথ্য সংরক্ষণের পর সেগুলো পর্যালোচনা করে বিচারিক আদালতে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার প্রবণতা কমার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়।
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ৩০ মে পর্যন্ত সারা দেশে বিচারিক আদালতে ৪২ মামলাতেই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ১৬২ জনের। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭৮টি মামলার রায় পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ১০৮ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
নিয়মিত ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেন এমন বেশ কয়েকজন আইনজীবী পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই বিচারকরা সতর্কতা, বিচক্ষণতা ও বিচার বিশ্লেষণ করে রায় দিচ্ছেন। যে কারণে ব্যাপকহারে ফাঁসির দন্ড কমে আসছে। এটি ইতিবাচক। মৃত্যুদন্ডের মতো সাজা নিয়ে বিশ্বজুড়েই নানা তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশেও এর পক্ষে ও বিপক্ষে নানা অভিমত ও বিতর্ক রয়েছে। ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীদের ভাষ্য, পৃথিবীজুড়ে প্রাণদন্ডের মতো সাজা দিয়ে অপরাধ নির্মূলের ধারণা ক্রমেই কমে আসছে। বেশির ভাগ দেশই মৃত্যুদন্ড বাতিল করেছে। সর্বশেষ মালয়েশিয়া গত বছরের জুনে বাতিল করেছে।
প্রাণদন্ডের মতো সর্বোচ্চ সাজা এবং এই দণ্ডের ফলে সমাজ ও মানুষের মধ্যে এর প্রভাব নিয়ে দেশে গবেষণা নেই বললেই চলে। ফাঁসির দন্ড পাওয়া কিছু আসামি নিয়ে গত কয়েক দশকে বেসরকারিভাবে দুই-একটি গবেষণার উদাহরণ রয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ নভেম্বর পর্যন্ত কারাগারের কনডেম সেলগুলোতে ২ হাজার ১৬২ মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে। বন্দিদের মধ্যে ৬৩ জন নারী। তবে বিচারিক আদালতে দেওয়া মৃত্যুদন্ডের ৮০ শতাংশের বেশিই হাইকোর্টে টেকে না।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যাপকহারে ফাঁসির রায় থেকে বেরিয়ে আসা আমি মনে করি সুখকর। তার মানে এই নয় যে নৃশংস অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হোক। বিকল্প তো আছে। আসলে সর্বোচ্চ এই সাজাটা সমাজ ও মানুষকে কিন্তু তেমন কিছু উপকারিতা এনে দেয় বলে মনে হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা লোককে যদি আপনি মৃত্যুদণ্ড দেন সমাজে তার অবস্থান, তার পরিবারের অবস্থান সব মিলিয়ে নড়বড়ে ও দুর্বল হয়ে যায়। এই টানাপোড়েনে পরিবারের অনেকেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। গত কয়েক বছরে যে হারে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে তাতে কি অপরাধ কমেছে? কমেনি। আমার মনে হয়, অপরাধ কেন বেশি হয়, কীভাবে কমানো যায় এটি নিয়ে বেশি বেশি কাজ করা উচিত। প্রাণদণ্ড নিয়ে এখন থেকেই চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসা উচিত।’
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পৃথিবীর জন্ম থেকে শুরু করে হত্যাসহ অসংখ্য বড় বড় অপরাধ হয়েছে। বহু মৃত্যুদণ্ডও হয়েছে। কিন্তু এতে কিন্তু অপরাধ কমেনি। আসলে এভাবে অপরাধ নির্মূলে কোনো সমাধান আসে না এই বাস্তবতাটা আমাদের অনুধাবন করা উচিত। মৃত্যুদ- তুলে দেওয়া একবারে তো হবে না। আস্তে আস্তে তুলে দেওয়া উচিত। তবে কমাতে গেলে যদি দেখি যে শাস্তিই হবে না খালাস হয়ে যাবে, এটাও কিন্তু কাম্য নয়। ফাঁসিতে না গিয়ে অন্য সাজাতে যেতে হবে। বিচারকদের তো সেই সুযোগ রয়েছে।’
রায় পর্যালোচনায় যা মিলেছে : জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে সারা দেশের বিচারিক আদালতে হওয়া ১৭৮টি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের মামলার রায় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হত্যার ১৫২টি মামলায় (৯ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা) সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে ৯৪ জনকে। আর ধর্ষণের পৃথক তিনটি মামলার একটিতে ৬ জনকে এবং অন্য দুটিতে ৪ জনকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাদকের একটি মামলায় ৪ জনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। মামলাগুলোর মধ্যে ১৪টি হত্যা মামলায় ২৫ জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে বিচারিক আদালত। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ৩৭৮ জনের।
এ সময়ের মধ্যে ময়মনসিংহের গৌরিপুরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হত্যায় গত ১০ অক্টোবর ৭ জনকে, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে মাকে টুকরো করে হত্যার মামলায় গত ২৪ জানুয়ারি ছেলেসহ ৭ জনকে, বান্দরবানে একটি হত্যা মামলায় গত ২২ সেপ্টেম্বর ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। এ ছাড়া খুলনার খালিশপুরে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে গত ৭ সেপ্টেম্বর ৬ জনকে, হবিগঞ্জে একটি ধর্ষণের মামলায় গত ১ ডিসেম্বর ২ জনকে এবং ঢাকায় দুই শিশুকে ধর্ষণের মামলায় গত ২৯ জানুয়ারি ২ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া গোপালগঞ্জে মাদকের মামলায় গত ১৩ নভেম্বর ৪ জনকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয় আদালত। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় এক কিশোরীকে ধর্ষণের অপরাধে গত ২৪ নভেম্বর ৫ জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত।
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত ছয় মাসে বিচারিক আদালতে ৪২টি মামলায় ১৬২ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়, যার ৯৮ ভাগ হত্যা মামলায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পৃথক দুটি হত্যা মামলায় ১৩ জন করে ২৬ আসামিকে প্রাণদন্ড দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অপরাধ কমানো এটা আধুনিক বিশ্ব আর বিশ্বাস করে না। মৃত্যুদণ্ড তো মেরে ফেলার মতোই। এটা তো মধ্যযুগীয় বিচারের মতো। তবে, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ফাঁসির দণ্ডই সমাধান এ ধারণা থেকে আমরা বেরোচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় এখনো কাজ করে যে ফাঁসি দিলেই অপরাধ কমবে। কিন্তু কই সেটি তো হচ্ছে না। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এটি বাতিল করেছে। তারা চিন্তা করেই এটি করেছে। সভ্যতা, শিক্ষা এবং মানুষের মৌলিক ও স্বীকৃত অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হলে অপরাধ কমবে ফাঁসিরও অবকাশ থাকবে না।’
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এস এম শাহজাহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এজাহার এবং অভিযোগপত্র যদি আরও দক্ষ লোক দ্বারা করা হয়, আমি নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড আরও কমে আসবে। এভাবে ১৫ জন যদি আসামি হয়, দেখা যাবে শুধু মূল আসামিদের সাজা হচ্ছে, অন্যরা নির্দোষ প্রমাণিত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নৃশংস ঘটনাগুলোতে সর্বোচ্চ সাজা হওয়াই সমীচীন। কেননা অপরাধীর সাজা না হলে সমাজ ভেঙে পড়বে। তবে, ফাঁসি এত সস্তা হওয়া উচিত নয়।’ অপরাধ অনুযায়ী বিচারের ওপর গুরুত্বারোপ করে এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘ফাঁসি কমানোরও দরকার নেই, বাড়ানোরও দরকার নেই এবং দিলে উচ্চ আদালতেও যেন তা বহাল থাকে।’
সার্বিক বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড বিচার বিশ্লেষণ করেই দেওয়া হয়। আর কমার কারণ হচ্ছে, আসামির অধিক বা কম বয়স, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, ঘটনার পরিস্থিতি ও বিচার বিশ্লেষণ, একই পরিবারের বেশি আসামি হলে কিংবা বিচারকদের বিচক্ষণতায় ফাঁসিটা কমে।’
দেশের মানুষ ও তার দল বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে দেবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘এবার আমরা আর কোনো নির্বাচন, সেই তামাশার নির্বাচন, আওয়ামী লীগের নির্বাচন হতে দেব না, এ দেশের মানুষ হতে দেবে না।’ গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায় (আজমপুর) বিএনপির পদযাত্রা-পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন দলটির মহাসচিব।
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ ১০ দফা দাবিতে গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের থানায় থানায় এই পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ সমমনা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। গতকালের সমাবেশ থেকে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১০ দফা দাবি আদায়ে ১১ মার্চ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব মহানগর ও জেলায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘বর্তমান সংবিধান মোতাবেক দেশে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে না। দেশের জনগণ গত দুটি সংসদ নির্বাচনের মতো আগামী সংসদ নির্বাচন হতে দেবে না। কারণ তারা অতীতে ভোট দিতে পারেনি।’
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মনে করেছে যে তারা যেভাবে গত দুইটা নির্বাচন করেছে, এবারও ওইভাবে নির্বাচন করে নিয়ে যাবে। আর আবারও সেভাবে জনগণকে শোষণ করবে, জনগণের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাবে। এভাবে মানুষ এটা আর হতে দেবে না। কারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। রাজপথে আন্দোলনের পর আন্দোলন হচ্ছে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সেই আন্দোলন সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার বলছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কোন সংবিধান? যে সংবিধান তোমার নিজের মতো করে কাটাছেঁড়া করে তোমাদের মতো করে ছাপিয়ে নিয়েছ, সেখানে জনগণের কোনো অধিকার নাই সেই সংবিধান? যেখানে মানুষ ভোট দিতে পারে না, ভোট দিতে যায় না। আপনাদের মনে আছে ২০১৪ সালে নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচন মানুষ ভোট দিতে পারে নাই, মানুষ ভোট দিতে যায়নি। ভোটকেন্দ্রগুলোতে কুকুর-বিড়াল দেখা গেছে। জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) প্রয়াত নেতা শফিউল আলম প্রধান বলেছিলেন, কুত্তা মার্কা নির্বাচন।’
তুরাগের কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের হামলার অভিযোগ : রাজধানীর তুরাগ থানাধীন ১০ নম্বর সেক্টরে পদযাত্রা শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ চলাকালে এক দফা এবং পদযাত্রা শেষে নেতাকর্মীরা ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আরেক দফা হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও দলের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপনের। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পদযাত্রার আগে নেতাকর্মীরা জড়ো হতে শুরু করলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা করে। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। এতে বিএনপির নেতাকর্মীরা আহত হন। ইটের আঘাত লেগেছে আমার শরীরে। পরে পদযাত্রা শেষ করে নেতাকর্মীরা নিজ নিজ ঘরে ফেরার সময় অতর্কিত হামলা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।’ এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ করেন স্বপন।
এ ছাড়া রাজধানীর ৬২টির বেশি থানায় পদযাত্রা করে বিএনপি। যাত্রাবাড়ীতে খন্দকার মোশাররফ হোসেন, শাহবাগে মির্জা আব্বাস, বংশালে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, পল্লবীতে আবদুল মঈন খান, গুলশানে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, শাহজাহানপুরে আলতাফ হোসেন চৌধুরী, পল্টনে আবদুস সালাম, কাফরুলে আবুল খায়ের ভূঁইয়া, রূপনগরে হাবিবুর রহমান হাবিব, চকবাজারে ফরহাদ হালিম ডোনার, মোহাম্মদপুরে মামুন আহমেদ, ভাষানটেকে আবদুল হাই শিকদার, কদমতলীতে শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, রামপুরায় খায়রুল কবির খোকন, শ্যামপুরে আসাদুজ্জামান রিপন এবং ধানমন্ডিতে নাসির উদ্দিন অসীমসহ বিভিন্ন থানায় কেন্দ্রীয় নেতারা পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেন। এসব পদযাত্রায় দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
এ ছাড়া গতকাল সকালে গণতন্ত্র মঞ্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে, ১২-দলীয় জোট বিজয়নগর পানির ট্যাংক থেকে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিজয়নগরে আল-রাজী কমপ্লেক্সের সামনে থেকে এবং সমমনা পেশাজীবী গণতান্ত্রিক জোট পুরানা পল্টন মোড়ে থেকে আলাদা আলাদাভাবে পদযাত্রা করে। বিকেলে এলডিপি রাজধানীর পান্থপথ, বাড্ডা ও যাত্রাবাড়ী থেকে তিনটি আলাদা পদযাত্রা বের করে।
ফখরুলের নিন্দা ও প্রতিবাদ : পদযাত্রা কর্মসূচি চলাকালে যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, কামরাঙ্গীরচর বিএনপি নেতা রাকিব, খিলগাঁও থানা বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির, ভাটারা থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ আলী, বিএনপি কর্মী মো. সুলতান হোসেন ও জাহাঙ্গীর বিশ্বাসকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া কামরাঙ্গীচরে বিএনপির সহমানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়ার গাড়ি ভাঙচুর, মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফার বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলার অভিযোগ করা হয়েছে। গতকাল রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এসব উল্লেখ করে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সতর্ক থাকার পাশাপাশি নৌকাকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগরের সংসদীয় আসনগুলোতে পৃথক শান্তি সমাবেশ থেকে দলের নেতারা এই নির্দেশনা দেন।
ওই কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের নেতারা আরও বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। আর এ ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি।’
সরকার পতন ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে থানায় থানায় পদযাত্রা করে বিএনপি। এসব কর্মসূচি থেকে সহিংসতা হতে পারে দাবি করে তা প্রতিরোধে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ।
সমাবেশে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলেছেন, ‘বিএনপি পদযাত্রার নামে আগুন সন্ত্রাসের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ আওয়ামী লীগকে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আনতে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়ার নির্দেশনা দেন নেতারা।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের আওতাধীন সাতটি সংসদীয় আসন এবং ঢাকা মহানগর উত্তর চারটি সংসদীয় আসনের এলাকায় শান্তি সমাবেশ করে। সমাবেশের পর মিছিল বের করা হয়। এসব কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি নগরের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অনুষ্ঠিত শান্তি সমাবেশে নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেন ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন আটটি আসনে বিজয়ী হতে এখন থেকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী আট মাস আপনারা পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো আচরণ করবেন। শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের খবর তাদের কাছে পৌঁছে দেবেন।’ ঐক্যবদ্ধভাবে দল করলে আগামী নির্বাচনে নৌকা মার্কাকে বিজয়ী করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চায় বলে জানান দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত শান্তি সমাবেশে তিনি বলেন, ‘সরকার বিরোধীদের ক্ষমতা ভাগাভাগির স্বপ্ন পুরণ হবে না।’
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শান্তি সমাবেশ থেকে ষড়যন্ত্রের পথ পরিহার করে বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ছাড়া কোনোভাবেই সরকার উৎখাত করা যাবে না। নির্বাচনই হলো ক্ষমতা বদলের একমাত্র পথ।’
অনির্বাচিত সরকার আনার মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে বিএনপি নস্যাৎ করতে চায় বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। দেশের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে দলটির নেতাকর্মীরা যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত বলে জানান তারা। মিরপুর-১ নম্বর গোল চত্বরে আয়োজিত শান্তি সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘দেশের মানুষ নির্বাচনে বিশ্বাস করে, দেশের মানুষ ভোট দিতে চায়, দেশের জনগণ আগামী নির্বাচনে ভোট দেবে। যদি আগামী নির্বাচনে কেউ কোনো প্রকার বানচালের চেষ্টা করে তাহলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তাদের প্রতিহত করে গণতন্ত্রকে রক্ষা করব।’
বিএনপির পদযাত্রা থেকে হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং নিউ মার্কেট এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে বলে দাবি করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কে আয়োজিত শান্তি সমাবেশে তিনি এ দাবি করেন। তার দাবি বিএনপি সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে জনগণ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না, দাঁতভাঙা জবাব দেবে।
তাপস বলেন, ‘আমরা চাইলে ঢাকা মহানগরের কোনো এলাকায় আপনাদের (বিএনপি) নামার সুযোগ ছিল না। তারপরেও গণতন্ত্রের স্বার্থে, সংবিধানের স্বার্থে আমরা কোনো বাধা দেব না।’
দেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলামের বিকল্প শক্তি হিসেবে জায়গা নিতে চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে ভোট এবং জোট দুটি পন্থায় এগোচ্ছে দলটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি ইসলামপন্থী ১২টি দলকে একটি প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে দলটি।
এদিকে নির্বাচনী মাঠে দলটি যে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে সেটি মনে করছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও। ফলে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি দলটির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে; বিশেষ করে আন্দোলন, ভোটের হিসাব কষে যোগাযোগ বাড়িয়েছে বিএনপি। বলা হচ্ছে, আপাতত নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মনোযোগী হলেও কিছু কমন এজেন্ডা নিয়ে মাঠে থাকবে তারা। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে দল দুটির এমন ইঙ্গিত দিলেও একটি পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত কোনো পক্ষই মুখ খুলতে নারাজ। তবে আলাদা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ব্যাপারে দৃশ্যমান বেশ কয়েকটি বৈঠক সেরেছে ইসলামী আন্দোলন। দলটির নেতারা বলছেন, আগামী জুনের মধ্যে জামায়াত ও হেফাজতের শূন্যতা পূরণে সমমনা ইসলামি দলগুলোকে এক কাতারে নিয়ে আসা এবং একটি রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য কাজ চলছে। ইতিমধ্যে সমমনা অন্তত ১২টি দলের সঙ্গে পৃথক পৃথক আনুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক হবে না জানিয়ে দলটির একাধিক নেতা জানান, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য ইসলামি শক্তিগুলোর বিকল্প সক্রিয় প্ল্যাটফর্ম তৈরিই তাদের লক্ষ্য। প্রাথমিকভাবে এই প্ল্যাটফর্মের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনী মোর্চা’।
এদিকে সরকারি দলের বিরূপ প্রচারের কারণে জামায়াত নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক ধারণার আগেই সচেতনভাবে দলটিকে এড়িয়ে চলছে বিএনপি। প্রায় দুই যুগ ধরে আন্দোলন ও নির্বাচনে থাকলেও সম্প্রতি যুগপৎ কর্মসূচিতে জামায়াতের কর্মকা-ে খুশি নয় বিএনপি। তাই এবার নির্বাচনে অংশ নিলে প্রার্থী বাছাইয়ে দলটিকে ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সে হিসেবে ভোটের মাঠে জামায়াতে ইসলামীর বিকল্প শক্তি হিসেবে সক্রিয় বাকি ইসলামি দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে রাখার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। সব রকমের যোগাযোগ রাখা হচ্ছে, দেশ রূপান্তরকে এমনটি জানিয়ে বিএনপির নেতারা বলছেন, দুই পক্ষই নিজ নিজ ফোরামে আলোচনা-পর্যালোচনার কাজটি সারছে। দুই দিক থেকে আসার ট্রেনে একটি জংশনে পৌঁছানোর পরই তা জানানো হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইসলামি বা অন্য দলগুলোর মতোই এসব প্রতিষ্ঠানেরও নির্দিষ্ট অনুসারী রয়েছে। ভোটের বাজারে এসব দল বা সংগঠনের চাহিদা রয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টির কাছে। তাই এসব দল বা সংগঠনের সঙ্গে সব দলই বন্ধুত্ব রাখতে চায়। সংগত কারণে বিএনপির কাছেও এদের চাহিদা রয়েছে। আছে বলেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তিনি জানান, আলোচনায় তারা যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, এতে বোঝা যাচ্ছে শিগগিরই একটা পরিণতির দিকে যাবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে ইসলামি শক্তির নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে ১০ থেকে ১২টি দলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। দলগুলো একটু সময় নিচ্ছে। তবে আশা করি আগামী জুনের মধ্যেই এই জোটের অস্তিত্ব একটি রূপরেখায় পৌঁছাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জোট হলে এবার এককভাবে নয়, শরিককে নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেব। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তাদের একটি লিয়াজোঁ কমিটি রয়েছে।’
সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে দলটির আমন্ত্রণে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল যায়। এ সময় ঘোষিত ১০ দফা দাবির পক্ষে রাজপথে থাকতে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হলে জবাবে ইসলামী আন্দোলন জানায়, তাদের ১৯ দফায়ও সুষ্ঠু ভোট, রাষ্ট্র সংস্কার ও জাতীয় সরকারের কথা আছে। নিজেদের এজেন্ডার বাইরে আপাতত না গেলেও বিএনপিকে আশ^স্ত করা হয়েছে, সুষ্ঠু ভোটের জন্য যেকোনো আন্দোলনে মাঠে থাকবেন তারা। গত জানুয়ারিতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের জাতীয় সম্মেলনে সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে যোগ দিতে দেখা গেছে।
ইসলামি দলগুলোর একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে জানান, জোট করার লক্ষ্যে গত বছর থেকেই কাজ চলছে। ক্রীড়নক হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা ইতিমধ্যে পৃথকভাবে গত বছরের ৪ আগস্ট খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে, ২৬ আগস্ট পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে, ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নেতাদের সঙ্গে, ৩ সেপ্টেম্বর একই স্থানে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সঙ্গে, ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সঙ্গে পুরানা পল্টনে কেন্দ্রীয় অফিসে বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টির সঙ্গে বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে শিক্ষাক্রম নিয়ে আয়োজিত একগোলটেবিল আলোচনা হয়েছে। সেখানে গোলটেবিলের বাইরে জোট গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন একাধিক ইসলামি দলের নেতারা।
সৌজন্য বৈঠকের কথা স্বীকার করে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি পরিস্থিতি ও সময় বলে দেবে। এখনো তো সময় আছে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের ইসি নিবন্ধিত অংশের দপ্তর সম্পাদক আব্দুল গফফার বলেন, ‘বিভিন্ন দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছে। সময় ও পরিস্থিতি হলে আমাদের শূূরা সদস্যরাই সিদ্ধান্ত নেবেন।’
জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আটটি দল প্রয়াত শায়খুল হাদিস প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (জিয়া উদ্দীন), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আতাউল্লাহ), খেলাফত মজলিস (ইসহাক), নেজামে ইসলাম পার্টি, ফরায়েজি আন্দোলন ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (আবুল খায়ের)। এই দলগুলো জোট গঠন প্রক্রিয়ায় সামনের কাতারে রয়েছে। নেজামে ইসলাম পার্টি, ফরায়েজি আন্দোলন ছাড়া বাকি ৬টি দলই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
ইসি সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে ৪০টি। এর মধ্যে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল ১০টি। আর কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দল রয়েছে ৬টি।
বিএনপি ২০-দলীয় জোট ভেঙে দিলেও ভিন্ন ফরম্যাটে ৫টি দল ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস বিএনপির সঙ্গে রয়ে গেছে। যদিও ইসি নিবন্ধিত মূল দলের কোনোটিই এখন বিএনপির সঙ্গে নেই। অন্যদিকে মুফতি ফজলুল হক আমিনী প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ঐক্যজোট ও আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর খেলাফত আন্দোলন কোনো জোটে না গেলেও সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও জাকের পার্টি আগে থেকেই সরকারের সঙ্গে রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।