
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকার বাণিজ্যিক ভবন শিরিন ম্যানশনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের আগে একাধিকবার আগুনের ঘটনা ঘটেছে। ভবনের পশ্চিম পাশ লাগোয়া স্যুয়ারেজের লাইনে মাঝেমধ্যে আগুন লাগলেও সেটিকে গুরুত্ব দেননি ভবন মালিক। তিনি দেশের বাইরে থাকায় নেওয়া হয়নি সংস্কারের উদ্যোগও। ফলে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলে আসছিল ভবনটিতে। বিস্ফোরণের পর ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত রবিবার সকালে ওই ভবনে বিস্ফোরণে তিনজন মারা গেছে। আহত হয়েছেন অর্ধশত ব্যক্তি। তাদের অনেকে এখনো চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের নিউমার্কেট অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) শরীফ মো. ফারুকুজ্জামান গতকাল সন্ধ্যায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে।’
অবহেলায় মৃত্যুর মামলা হবে না কেন জানতে চাইল তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের কেউ অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসেনি।’
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল জানায়, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে।
বিস্ফোরণে তিনজনের প্রাণ যাওয়ার পর ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। দুর্ঘটনায় আহতরা এখনো শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাদের উন্নত চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
ভবনটি আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ : শিরিন ম্যানশনের তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম দেশ রূপান্তরকে জানান, তিনি ৪০ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন। ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়া স্যুয়ারেজের লাইনে মাঝেমধ্যেই আগুন লাগত। ভবনটির উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে স্যুয়ারেজের প্রধান লাইন গেছে। ওই স্যুয়ারেজের লাইনের সঙ্গেই ভবনটির তিনতলার তিনটি টয়লেটের লাইনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ওই সংযোগ থেকে অনেকবার আগুন লেগেছে। বালু ও পানি দিয়ে আগুন নেভানো হয়েছে। ছোট আগুন হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া প্রয়োজন হতো না। তিনি বলেন, তিনতলা ভবনের নিচতলায় থাকা খাবারের হোটেলটিতে গ্যাসের লাইন রয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গ্যাসের লাইন নেই।
ভবনটির দোকানিরাও নানা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, স্যুয়ারেজের লাইনের জন্য টয়লেট প্রতি সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা নিত মালিকপক্ষ, কিন্তু কোনো সমস্যা হলে ঠিক করে দিত না।
ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে ভবনটি : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবন-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় কমিটি সায়েন্স ল্যাব এলাকার বিধ্বস্ত ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। গতকাল এ-সংক্রান্ত একাধিক ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছে ভবনের দেয়ালে। সেখানে লেখা, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ, আদেশক্রমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন’।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের গতকাল সকালে ড্রেসিং করা হয়েছে। ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, রবিবার বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঁচজনকে ভর্তি করা হয়। গতকাল সকালে ধানম-ির পপুলার হাসপাতাল থেকে আরও একজনকে আনা হয়। তার নাম স্বপ্না রানী সাহা (৩৯)। তার শরীরের ১৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, চিকিৎসাধীন অন্যদের মধ্যে যথাক্রমে আশরাফুজ্জামান ও হাফিজুর রহমানের শরীরের ৬ ও ৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। আশা, জহুর আলী ও আকবরের শরীরে ৩৮, ৪৪ ও ৩৭ শতাংশ দগ্ধ। তবে কাউকেই শঙ্কামুক্ত বলছেন না তিনি।
একই দুর্ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, নিউরোসার্জারি বিভাগে কবির, জাকির হোসেন জুয়েল, আইসিইউতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুর নবী, আর জরুরি বিভাগের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টারে (মিনি আইসিইউ) ভর্তি রয়েছেন সিএনজি অটোরিকশাচালক সোহেল। নুর নবী ও সোহেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আহতদের চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড : আহতদের চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বোর্ড গঠনের বিষয়টি জানান। তিনি বলেন, নুর নবীর মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে। গতকাল তার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হস্তান্তর : বিস্ফোরণে নিহত সাদিকুর রহমান তুষার (৩১), সফিকুজ্জামান (৪৪) ও আব্দুল মান্নানের (৬৩) মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে রবিবার রাতেই পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন প্রভাষক ডা. ফাহমিদা নার্গিস। এর আগে মরদেহ তিনটির সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন নিউমার্কেট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রমজান আলী।
সুরতহাল প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, তিনজনের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তাক্ত জখম রয়েছে। শরীরের কোথাও দগ্ধ হয়নি। ভবনের তৃতীয় তলায় বিস্ফোরণের ফলে ধ্বংসাবশেষ শরীরের ওপর পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন সেন্টমার্টিন নিয়ন্ত্রণ করছে ১৩ পরিবার। জমি বিক্রি, রিসোর্ট তৈরি কিংবা সেখানে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করতে গেলে লাগবে তাদের সুদৃষ্টি। পরিবারগুলো খুশি থাকলে যে কেউ প্রাসাদও তৈরি করতে পারেন সেখানে। ৫০ বছর ধরে তারা বলতে গেলে এলাকাটি শাসন করছেন। তাদের পেছনে আছেন উপজেলার প্রভাবশালীরা।
এ ছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ছোট ছোট দোকানপাটের মধ্যে বেশির ভাগেরই মালিক ওই ১৩ পরিবারের সদস্যরা। এক চেটিয়াত্বের কারণে যে যার মতো পারছে পর্যটকদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। পর্যটকরা কারও কাছে প্রতিকার চাইতে পারছেন না।
জানতে চাইলে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের উন্নয়নের জন্য আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি। তবে বেশ কিছু সমস্যা আছে। সেগুলোও সমাধানের চেষ্টা চলছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে রিসোর্টসহ অন্যান্য স্থাপনা যাতে কেউ নির্মাণ করতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। যারা আইন মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
১৩ পরিবারের বিষয়ে তিনি বলেন, এ পরিবারগুলোর কর্তাব্যক্তিরা কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তাদের স্বজনরা আছেন। তাদের জায়গা-জমি আছে। সেগুলো হয়তো তারা কেনাবেচা করেন।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন নিয়ে আমরা আলাদা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সেন্টমার্টিনে নিরাপত্তার বিষয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। কোনো গ্রুপ বা মহল পর্যটকদের জিম্মি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ট্রলার বা স্পিডবোটগুলো আলাদাভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। পর্যটকরা কোনো ধরনের সমস্যায় পড়লে তাৎক্ষণিক পুলিশকে অবহিত করার অনুরোধ জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত এ দ্বীপে প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক আসেন। এখানে স্থানীয়দের পাশাপাশি বাইরের প্রভাবশালীদেরও হোটেল ও রিসোর্ট আছে।
সেন্টমার্টিনে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের কথা বলে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন কারা নিয়ন্ত্রণ করেন। পর্যটন খাতসমৃদ্ধ হলেও যোগাযোগ, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক অনেক সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যোগাযোগ। জরুরি কাজে টেকনাফ ও জেলা সদর কক্সবাজার আসা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। বর্তমানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে বেশ কটি জাহাজে পর্যটকরা দ্বীপে আসা-যাওয়া করেন। টেকনাফ থেকে স্পিডবোট থাকলেও শুষ্ক মৌসুম ছাড়া চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে জাহাজভাড়া। তার সঙ্গে রয়েছে ঘাটে চাঁদাবাজি। বর্তমানে টেকনাফের দমদমিয়া থেকে জাহাজভাড়া যাওয়া-আসা জনপ্রতি ১২০০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন হাজার টাকার বেশি লাগে। এ ছাড়া ঘাটের ইজারাও বেশি আদায় করা হচ্ছে। সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়াদ্বীপে যাওয়ার সময় বেশি ভাড়া হাঁকা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি স্পিডবোটচালক জানান, প্রতি মাসে স্থানীয় নেতাদের চাঁদা দিতে হয়। ১৩ পরিবারের কেউ না কেউ চাঁদা তোলেন। তারা নিজেদের শ্রমিক লীগ নেতাকর্মী দাবি করেন। তবে চাঁদার বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয় না। চাঁদা দেওয়ার কারণে পর্যটকদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নিতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অদৃশ্য শক্তির’ ইশারায় ১৩ পরিবার সব অপকর্ম চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে একটি প্রভাবশালী মহলের ইন্ধন রয়েছে। জায়গা বিক্রি করতে হলে তাদের অনুমতি নিয়ে করতে হচ্ছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা দোকানপাট তৈরি করে ব্যবসা চালাচ্ছেন।
তাদের মধ্যে এক ব্যবসায়ী জানান, বছর-তিনেক আগে সেন্টমার্টিন বাজার থেকে পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে একটি আবাসিক হোটেল করতে ২০ শতাংশ জমি পছন্দ করেন। জমিটি টেকনাফের এক ব্যবসায়ীর। দর-কষাকষির পর্যায়ে জমির মালিক টালবাহানা করতে থাকেন। পরে স্থানীয় লোকজনের পরামর্শে হাসেনা বারোর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। পরে জানা যায়, হাসেনা বারোর পরিবারটি প্রভাবশালী পরিবারগুলোর একটি। মূলত তাদের মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকা দিয়ে জমিটি কিনতে হয়েছে। জমির মালিক সেন্টমার্টিন থাকেন।
একই কথা বলেছেন ঢাকার আরেক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ১৩ পরিবারের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন অবহিত আছে। জায়গা কেনাবেচার সঙ্গে তারা জড়িত। তাদের একটি পরিবারের মাধ্যমে ১০ বছর আগে সেন্টমার্টিন বাজারের পাশে একটি জায়গা কিনেছিলেন তিনি। বর্তমানে জমির দাম প্রায় দুই কোটি টাকা।
১৩ পরিবারের সদস্যরা সাগরের পাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে হকারদেরও নিয়ন্ত্রণ করেন। পর্যটকদের যারা ছবি তোলেন তারাও তাদের লোক। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় লোকজনও তাদের সহায়তা করেন।
স্থানীয় লোকজনের মধ্যে প্রচলিত ১৩ পরিবারের নাম দুইব্রা বারো, শেয়ানদারা বারো, তইজ্রাহাতু বারো, আহমেইদ্রা বারো, গুলাবারো, লোকমালা বারো, সারো বারো, হাসেনা বারো, ছইন্না বারো, লাঠিম মিয়া, জুলহাইস্রা বারো, আবদুল হক বারো ও ইসহাক বারোর পরিবার সেন্টমার্টিন নিয়ন্ত্রণ করে। এসব পরিবারের মধ্যে অনেকেই কোটি টাকার মালিক।
ইসহাক বারোর পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য আবদুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৩ পরিবার ছাড়া কেউ এখানে ব্যবসা করতে পারে না। সেন্টমার্টিনের বাইরে থেকে আসা লোকজন তাদের ম্যানেজ করে হোটেল, রিসোর্ট তৈরি করছে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার দাদি জুলেখা বিবির কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে ২২ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। পরে তিনি রিসোর্ট তৈরি করেন। বর্তমানে জমিটির মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। এখানে জমির দাম আকাশছোঁয়া।
রশীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৩ পরিবারকে ম্যানেজ করে কেউ কেউ অবৈধভাবে রিসোর্ট ও টংঘর তৈরি করে ব্যবসা করছেন। এজন্য প্রশাসনের একটি চক্রকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, কয়েক মাস আগে স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। তবে বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নির্মাণাধীন অবৈধ স্থাপনা অক্ষত রেখে শুধু লোকদেখানো অভিযানে ছোট ছোট টংঘর ও ত্রিপল দিয়ে করা দোকান, বাঁশের বেড়ার ভাসমান স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। প্রভাবশালীদের একটি অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ হয়নি। বরং অবৈধ ভবনগুলোর নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে।
রিসোর্টের রুম ভাড়াও নির্ধারিত থাকে না। যে রুমের ভাড়া হওয়ার কথা এক হাজার টাকা, সেই রুমের ভাড়া রাখা হয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম নিয়েও নৈরাজ্য আছে। ঘাটে হয়রানির সমস্যা তো আছেই।
আপেল শাহরিয়ার ও আজাদ রহমান নামের দুই পর্যটক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১৫ দিন আগে তারা ঢাকা থেকে টেকনাফ যাওয়ার পর জাহাজে সেন্টমার্টিন গিয়েছেন তারা। যাওয়ার পথে নানাভাবে হয়রানি হতে হয়েছে। সেন্টমার্টিনে একাধিক চক্রের কাছে পর্যটকদের জিম্মি থাকা, নিরাপত্তার অভাব, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার কথা জানান।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। ১৮ মিনিটের কালজয়ী এ ভাষণের শেষ কটি শব্দমালা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম... এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ঐতিহাসিক ভাষণের আটটি শব্দের শেষ দুটি লাইন হয়ে গেল সাত কোটি মানুষের মনের ভাষা। হয়ে গেল মুক্তিকামী বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র।
দিনটি ছিল রবিবার। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অপেক্ষায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। তিনি আসলেন মহাসমুদ্রে আর শুরু হলো গগণবিদারী স্লোগান, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর; পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা; তোমার দেশ, আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’ এই সেøাগানগুলো জনতার কাছ থেকে আসল। এগুলো কোনো নেতা দেয়নি, তার আগেই মুক্তিপাগল কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা এ স্লোগান তুলে ধরল।
২টা ৪৫ মিনিটে ডায়াসে এসে দাঁড়ালেন ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুহূর্তেই মহাসমুদ্রের গর্জন থেমে পিনপতন নীরবতা। মাইকে বজ্রকণ্ঠে রাজনীতির কবি যখন সম্বোধন করলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’, আবার রেসকোর্সের মহাসমুদ্র সেস্লোগানে স্লোগানে গর্জন তুলল, মহানায়ক বজ্রকণ্ঠে শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা যেমন দিলেন, দিয়ে গেলেন নির্দেশনাও।
বক্তব্যের শেষে তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’, কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল তার বজ্রকণ্ঠের ধ্বনি; কিন্তু মহাসমুদ্রে উপস্থিত কৃষক, শ্রমিক ছাত্র জনতা থামল না; তাদের গগনবিদারী গর্জন আরও বেড়ে গেল। মুক্তিকামী বাঙালি জানান দিল বজ্রকণ্ঠে আরও কিছু শুনতে চায় তারা। অতৃপ্ত বাঙালির আকাক্সক্ষা বুঝেই থেমে যাওয়া বজ্রকণ্ঠ বেজে উঠল আবার। বঙ্গবন্ধু শোনালেন পরের লাইন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের পড়ন্ত বিকেলে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে কয়েকটি শব্দমালায় গাঁথা দুটি লাইন অপ্রতিরোধ্য দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে।
এ ভাষণের ব্যাখ্যায় প্রবীণ রাজনীতিকরা দাবি করেন, মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘোষণা বঙ্গবন্ধু মূলত পরোক্ষভাবে দেন। কীভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু। রাজনীতিকরা বলেন, দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকা অথচ লিখেছিল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। ৫ মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দি অবজারভার ও ৬ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দিয়ে প্রতিবেদন ছাপে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের পূর্বাপর ঘটনা নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় দেশের প্রবীণ দুই রাজনীতিকের সঙ্গে। একজন হলেন তৎকালীন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফের) অন্যতম সদস্য সিরাজুল আলম খান ও তৎকালীন বাম রাজনৈতিক নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য। প্রবীণ রাজনীতিক সিরাজুল আলম খান ওতপ্রোতভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পঙ্কজ ভট্টাচার্য ভেতরে-বাইরে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জানতেন।
ব্রিটিশ গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এনডব্লিউ টিভিতে একটি সাক্ষাৎকার দেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চান ৭ মার্চের ভাষণে যুদ্ধের ঘোষণা আপনি দেননি কেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে, তাই ভাষণে আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’
ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি বললে কী ঘটত? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশেষ করে ওইদিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কারণ, বিশ^কে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে চাইনি। এমন কিছু হলে পাকিস্তান বিশ্বের সমর্থন পেত বাঙালির ওপর আঘাত হানার, সেই সুযোগটি তারা নিত। আমি চেয়েছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক, জনগণ তো প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। ওই ভাষণের ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ আঘাত হানে পাকিস্তান। মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালি তা প্রতিরোধ করে। ওই ভাষণই বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে।’
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে আলোচনায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান পর্বের শেষ ধাপ হলো ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। আমি মনে করি এর আগে গণজাগরণ ঘটে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকা- শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন বলে দিলেন ৩ তারিখ সংসদ বসবে না; তখন আওয়ামী লীগের প্রেস কনফারেন্স করছিলেন বঙ্গবন্ধু পূর্বাণী হোটেলে। প্রেস কনফারেন্স অর্ধসমাপ্ত রেখে তারা রাস্তায় নেমে পড়লেন। ৩ মার্চ সংসদ না বসার বিষয়টি মুহূর্তের মধ্যে মুখে মুখে রটে গেল, জনতার মধ্যে ছড়িয়ে গেল, জনারণ্য হয়ে গেল, মানুষ নেমে গেল রাস্তায়।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এত সহজ-সরল ও সাদামাটা ছিল যে, সবার হদয়ে গ্রথিত হয়ে গেল। উজ্জীবিত-উদ্বেলিত করল শেষ দুটি লাইন। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম... তারপর থেমে গেল বজ্রকণ্ঠ। অতৃপ্ত মুক্তিপাগল বাঙালি থামেনি, গর্জন উঠল। আবার বাজল এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনসমুদ্রের আকাক্সক্ষা বুঝেই বঙ্গবন্ধু শেষ লাইনটি বলে জয় বাংলা দিয়ে শেষ করলেন অমর কবিতা।’
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর; পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা; তোমার দেশ, আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ। এসব স্লোগানে মেতে উঠল চারদিক। এই স্লোগানগুলো জনতা থেকে এলো। এগুলো কোনো নেতা দেয়নি, দেওয়ার আগেই মানুষ এই স্লোগান ধরে ফেলল। ভুট্টোর মুখে লাথি মার এমন ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফেটে পড়া অবস্থা আমার জীবনে ওই প্রথম দেখেছিলাম। সে জন্য আমি বলছি এটা গণজাগরণের ঊর্ধ্বতন ধাপ, গণঅভ্যুত্থানে পৌঁছে গিয়েছিল। সরকারি দলের একপক্ষ মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন আমরা শুনলাম। সেদিনের মহাসমুদ্রে আমি সহস্রাধিক ন্যাপকর্মীসহ উপস্থিত ছিলাম।’
সিরাজুল আলম খান এক ঘরোয়া আড্ডায় বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৪/৫ ও ৬ মার্চ পর্যন্ত ২/৩ ঘণ্টা অন্তর অন্তর আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড ও বিএলএফ হাইকমান্ডের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আলোচনা করতেন। প্রতিটি বৈঠকেই প্রসঙ্গ থাকত ৭ মার্চের বক্তৃতা। ৬ মার্চ সন্ধ্যায় বিএলএফ বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি করে, ভাষণে সংক্ষেপে অতীত ইতিহাস, অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহতভাবে পরিচালনা করা ও স্বাধীনতার আহ্বান উল্লেখ করে বক্তৃতা শেষ করা। তবে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড স্বাধীনতার সংগ্রাম লাইনটি বলার বিষয়ে আপত্তি তোলে।’ বিএলএফের অন্যতম এ নেতা বলেন, ‘৫ মার্চ ৭ মার্চের ভাষণের বিষয় নিয়ে বিএলএফের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোদের প্রস্তাব নিয়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সঙ্গে আলাপ করেছি”। ভাষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে বিএলএফ সদস্যরা অনুরোধ করেন এ ভাষণ খুবই আবেগময় হতে হবে। তারা সে সম্পর্কিত তিনটি ভাগ করে দিলেন।’
তিনি বলেন, ‘এর আগে ৬ মার্চ সকাল থেকে বিএলএফ ও আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড নেতাদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড মুক্তির বিষয়টি দিয়ে বক্তৃতা শেষ করার পরামর্শ দেয়। তবে বিএলএফ দাবি করে দুটি প্রসঙ্গই থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে বিএলএফ ও আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডে আপস হয়। তবে মুক্তি ও স্বাধীনতার বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে থাকতে হবে অনুরোধ করে ৬ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় কয়েকটি বিষয় নোট দিয়ে চলে যায় বিএলএফ সদস্যরা।’
টাঙ্গাইলের ফজলুর রহমান ফারুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ৭০-এর নির্বাচনে গণপরিষদ মেম্বার হন তিনি। ওই জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। এ ভাষণ অমর এক কীর্তি। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর আবেদনও শেষ হওয়ার নয়।’ তিনি বলেন, ‘সেদিনের রেসকোর্স ময়দান বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের মহাকাব্যে মুক্তিকামী জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত হতে গেলে কী করতে হবে তার সবই তুলে ধরা হয়েছে। ভাষণের শেষ অংশে বজ্রকণ্ঠ থেমে গেলেও থামেনি বীরজনতা। তারা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে শুনতে চেয়েছেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
প্রসঙ্গত, বিএলএফের সদস্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান, প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনি, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। পরে আরও অনেকেই যুক্ত হন এ সংগঠনে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সদস্য ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত খুনি খন্দকার মোশতাক।
পবিত্র শবেবরাত আজ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় আজ মঙ্গলবার রাতে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত কামনায় ‘নফল ইবাদত-বন্দেগির’ মধ্য দিয়ে পবিত্র শবেবরাত পালন করবেন। হিজরি বর্ষের শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে সৌভাগ্যের রজনী। মহিমান্বিত এ রাতে মহান রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা এ রাতে মহান আল্লাহর রহমত ও নৈকট্য লাভের আশায় নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজগারসহ বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগি করে থাকেন।
শবেবরাত উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ‘মানুষের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির জন্য ইসলামের সুমহান আদর্শ আমাদের পাথেয়। শবেবরাতের এই পবিত্র রজনীতে আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে অশেষ রহমত ও বরকত কামনার পাশাপাশি দেশের অব্যাহত অগ্রগতি, কল্যাণ এবং মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্যের প্রার্থনা জানাই। সৌভাগ্যম-িত পবিত্র শবেবরাতের পূর্ণ ফজিলত আমাদের ওপর বর্ষিত হোক।’ খবর বাসসের।
পবিত্র শবেবরাত উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মুসলমানকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে শবেবরাতের মাহাত্ম্য উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবকল্যাণ ও দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, পবিত্র শবেবরাত উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ওয়াজ, দোয়া মাহফিল, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, হামদ, নাতসহ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ৫০ রানে হারানোর তৃপ্তিটা যেন খুব বেশি করে মনে করিয়ে দিল দিন পাঁচেক আগে ৩ উইকেটে হারের কষ্টটা। সেদিন রানটা ২০৯-এর একটু বেশি হলে আর মোস্তাফিজুর রহমান উইকেট পেলে ম্যাচটা জিততে পারত বাংলাদেশ। তাহলে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে ঘরের মাটিতে সাত বছর ধরে কোনো সিরিজ না হারার গৌরবও থাকত অক্ষুন্ন।
তিন ওয়ানডের সিরিজের শেষ ম্যাচে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডকে ৫০ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। হোয়াইটওয়াশ এড়ানো গেছে, পাওয়া গেছে সান্ত¡নার জয়। সাকিব আল হাসান ব্যাটে-বলে অনন্য, ৭১ বলে ৭৫ রানের ইনিংসের পর ৩৫ রানে ৪ উইকেট নিয়েছেন। হাফসেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম (৭০) ও নাজমুল হোসেন শান্তও (৫৩)। তারপরও টস জিতে আগে ব্যাট করে ৫০ ওভার পুরো খেলতে পারেনি বাংলাদেশ; ৪৮.৫ ওভারে ২৪৬ রানেই অলআউট। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এ রানটাই যে যথেষ্ট হবে, সেটা কে ভেবেছিল!
রান তাড়ার শুরুতেই মনে হচ্ছিল হেসেখেলেই জিতবে ইংল্যান্ড। বিনা উইকেটে দলীয় রান ৫০ হয়ে গেল ৮.৪ ওভারেই। নবম ওভারের শেষ বলে ফিল সল্টকে সাকিব যখন মাহমুদউল্লাহর ক্যাচ বানিয়ে আউট করলেন তখন স্কোর বোর্ডে ৫৪ রান। পুঁজিটা কম হলে চেপে ধরতে হয় দুই প্রান্ত থেকেই, সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে সাকিব-তাইজুল ইসলামরা উইকেট পেলেও মোস্তাফিজ পাচ্ছিলেন না। কাল পেস বোলাররাও শুরুতে উইকেটের দেখা পেলেন, ডাভিড মালানকে রানের খাতা খোলার আগেই মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ বানিয়ে ফিরিয়ে দিলেন এবাদত হোসেন। দুই বল পর সাকিব মাত্র ১৯ রানেই বোল্ড করলেন আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান জেসন রয়কে। টানা তিন ওভারে ৩ উইকেট হারাল ইংল্যান্ড, সেই যে চাপে পড়া, সেখান থেকে আর বের হয়ে আসা হয়নি।
জস বাটলার ম্যাচের পর বলেছেন, সিরিজ নিশ্চিত হওয়াতে আর উইল জ্যাকসের চোটের কারণে সুযোগ আসে স্যাম কারেনকে ওপরে ব্যাট করতে পাঠানোর। অপ্রত্যাশিতভাবে এ বোলারকে পাঁচে ব্যাট করতে আসতে দেখে অনেকেই বিস্মিত, তবে জেমস ভিনসের সঙ্গে ৪৯ রানের জুটি গড়ে পরিস্থিতি ভালোই সামাল দিয়েছিলেন। পথের কাঁটা দূর করলেন মেহেদী হাসান মিরাজ, কারেন ক্যাচ দিলেন লিটন দাসের হাতে। ভিনসকে ফেরালেন সাকিব, বল এ ইংলিশের ব্যাটে চুমু খেয়ে জমা পড়ল মুশফিকের গ্লাভসে।
জয়ের সুবাস পাওয়া যাচ্ছে বটে, তবুও তখনো বাটলার আর মইন আলি উইকেটে। এ দুজনের ব্যাটিং সামর্থ্য বিবেচনা করলে ম্যাচটা বাংলাদেশের হাত থেকে ফসকে যাওয়াটাও অসম্ভব নয়। এবারে উদ্ধারকর্তা হয়ে এলেন তাইজুল, বাটলারকে আউট করলেন লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে ফেলে। এবাদতের ভয়ংকর স্যালুট দেখে মাঠ ছাড়লেন মইনও। ক্রিস ওকস একটু লড়াই করছিলেন, আদিল রশিদকেও ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন তাইজুল। জয় তখন শুধু সময়ের ব্যাপার। নিজের বোলিং স্পেলের শেষ ডেলিভারিতে সাকিব পেয়েছিলেন পঞ্চম উইকেটের দেখা, মাঠের আম্পায়ার আউটও দিয়েছিলেন। কিন্তু রিভিউতে দেখা গেল বল যাচ্ছে লেগ স্টাম্পের বাইরে। তাই বেঁচে গেলেন জোফরা আর্চার, হলো না সাকিবের ৫ উইকেট শিকার। ৩০০তম উইকেট শিকারের দিনে হাফসেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্বটা একটুর জন্য ফসকে গেল।
সেই ফসকে যাওয়া শিকারটাই ওয়ানডে সিরিজে মোস্তাফিজের একমাত্র সাফল্য। ওকস সোজা ব্যাটে খেলেছিলেন, বল চলে যায় সরাসরি বোলার বরাবর। মোস্তাফিজ প্রথম দফায় ধরতে না পারলেও দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় ঠিকই ধরেছেন। তাতেই ৪৩.১ ওভারে ১৯৬ রানে অলআউট ইংল্যান্ড। বাংলাদেশের জয় ৫০ রানে যা রানের হিসাবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় জয়।
ম্যাচ শেষে সাকিব বললেন, ‘গত ছয়-সাত বছর ধরে ঘরের মাঠে আমরা ভালো খেলছি। আমরা এ ম্যাচটা কোনোরকমে খেলে হেরেই যেতে পারতাম, কিন্তু না, আমরা অনেক চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচটা জিতেছি। আমাদের বোলাররা নিজেদের মেলে ধরেছে আর ম্যাচটা জিতিয়েছে।’
বাটলার অবশ্য হারের চেয়ে আসন্ন বিশ্বকাপে অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগানোর ব্যাপারেই বেশি মনোযোগী, ‘এ সফরে আমরা যা চেয়েছি তাই হচ্ছে। আমরা এরকম উইকেটেই খেলতে চেয়েছি, নিজেদের চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছি। আমরা আজকেও (গতকাল) জিততে চেয়েছিলাম তবে সিরিজ জিতেই খুশি।’
দুদিন বিরতি দিয়ে চট্টগ্রামেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের সঙ্গে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরু করবে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে দুই সরকারের একটি কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যৌথ ব্যবসায়িক ফোরাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও কাতারের বেসরকারি খাতগুলোকে পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের জন্য একক প্ল্যাটফরমে আনতে হবে।
গতকাল সোমবার কাতারের রাজধানীতে দোহা ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৩ ‘দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার : পটেনশিয়ালস অব ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুই দেশকে পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্ককে পুনঃস্থাপন করতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি কাতারের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদলকে শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। একই সঙ্গে তিনি কাতারে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশিদের দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান এবং জাতিগঠন প্রচেষ্টায় তাদের অংশগ্রহণ কামনা করেন।
কাতারের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের কিছু থ্রাস্ট সেক্টরের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন সরকারপ্রধান। তিনি জানান, তার সরকার অবকাঠামো ও লজিস্টিক খাত বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ জ্বালানি খাতে কাতারের বিনিয়োগের সুযোগের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, অফশোর গ্যাস অনুসন্ধান ও জ্বালানি বিতরণ ব্যবস্থায় কাতারের দক্ষতা থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষি প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটিও কাতারের সঙ্গে বাই-ব্যাক ব্যবস্থায় কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে তিনি সরকারের তিনটি বিশেষ পর্যটন অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, সেখানে কাতার রিয়েল এস্টেট এবং হসপিটালিটি উভয় ক্ষেত্রেই জড়িত হতে পারে।
এ ছাড়া কাতারের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বিবেচনা করতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুঁজিবাজারের আরও উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করছে।
তিনি বলেন, আমাদের বন্ড মার্কেটকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি এবং আমরা শিগগিরই পুঁজিবাজারে ডেরিভেটিভ পণ্য অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে ব্যাঘাত বাংলাদেশের মতো দেশকে কঠিন জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমরা কাতার থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াতে আগ্রহী। আমরা বাংলাদেশ থেকে আরও রপ্তানির সুযোগ অন্বেষণ করতে কাতারকে অনুরোধ করছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ও কাতার দৃঢ় ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ এবং এখানকার প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায় দুদেশের মানুষের মধ্যে একটি চমৎকার সেতুবন্ধ। আমি আজ কাতারের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনেক বাংলাদেশি নাগরিককে দেখে আনন্দিত।’
শেখ হাসিনা বলেন, কাতার ন্যাশনাল ভিশন, ২০৩০ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। আমরা কাতারে উন্নত কর্মসংস্থানের বাজার পূরণে আমাদের কর্মীবাহিনীকে জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করতে পারি। আমাদের জনগণের ভালো যত্ন নেওয়ার জন্য আমরা কাতার সরকার ও জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি রেমিট্যান্স উপার্জনকারী দেশের মধ্যে রয়েছে এবং এটি এখন ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপিসহ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। আমরা ২০৩০-এর প্রথমার্ধের মধ্যে ২৪তম বৃহত্তম হয়ে উঠব বলে অনুমান করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্নপূরণে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং কাতারের নেতৃত্ব ও জনগণ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
স্মার্ট, উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে ৫ মূল সহায়তা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে স্মার্ট, উদ্ভাবনী এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য পাঁচটি মূল সহায়তা চেয়েছেন, যা একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সংগত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজকে উন্নীত করতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, ‘স্মার্ট, উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ একে একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে উন্নীত করতে সহায়তা করবে।’
কিউএনসিসি অডিটোরিয়াম-৩-এ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর জাতিসংঘের পঞ্চম সম্মেলনে ‘স্মার্ট অ্যান্ড ইনোভেটিভ সোসাইটির জন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ’ শীর্ষক একটি পার্শ্ব অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী এ মূল সমর্থনগুলো উপস্থাপন করেন।
প্রথম সহায়তা হিসেবে সরকারপ্রধান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় পদক্ষেপসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে কার্যকর প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য আন্তর্জাতিক বেসরকারি খাতকে যথাযথ প্রণোদনা প্রদান করুন।
দ্বিতীয়টিতে তিনি বলেন, এলডিসিগুলোতে ব্রডব্যান্ড বিভাজন ও প্রযুক্তিগত বৈষম্য কমাতে ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগে সহায়তা করুন।
তৃতীয় সহায়তা হিসেবে তিনি বলেন, এলডিসিভুক্ত দেশগুলো যেসব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তা মোকাবিলায় পেশাদার গবেষক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি।
তিনি আরও বলেন, চতুর্থত, উত্তরণের পরও বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যালস এবং কৃষি-রাসায়নিকের জন্য ট্রিপস চুক্তির অধীনে এলডিসি মওকুফের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা। পঞ্চম সহায়তার ব্যাপারে তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে উদ্ভাবন এবং উন্নয়ন দুটির জন্যই সহায়ক একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবস্থা বিকাশে সহায়তা।
২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার পরবর্তী রূপকল্পে আরও অনেক এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি অবহিত করেন। তিনি বলেন, এটি চারটি মূল উপাদানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে তার সরকার জনগণের কাছে ২০২১ সালের মধ্যে একটি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেন। ওই সময় এটিকে ‘রূপকথা’ বলেই মনে হয়েছিল।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘কিন্তু, কভিড-১৯ মহামারী প্রমাণ করেছে, আমরা আমাদের অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারি।’
তিনি বলেন, এই মহামারী আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যে, এলডিসিভুক্ত দেশগুলোকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বিনিয়োগের জন্য আর অপেক্ষা করা উচিত নয়। তাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ধরনের বিনিয়োগ করা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, যে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য এলডিসিগুলোর গড় জিডিপি ব্যয় এখনো ০.৬ শতাংশের নিচে রয়েছে ও তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকটি বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে রয়েছে। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাবের সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশগুলো পিছিয়ে থাকার মতো অবস্থায় নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, এলডিসি উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে তিনটি মানদণ্ডের সবগুলোতেই তার যোগ্যতা প্রমাণ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখন ২০২৬ সালের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই অন্তর্বর্তীকালে আমাদের সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয় হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ। জাতীয় প্রয়োজন নির্ণয়ে এলডিসির জন্য আমরা ইউএন টেকনোলজি ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছি।’ তার সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান-মনস্কতার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করছে বলেও জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার প্রযুক্তিগত বিষয়সহ দেশীয়ভাবে তৈরি জলবায়ু অভিযোজন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে।
তিনি বলেন, ‘আরও গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাসে আমাদের সহনশীলতা প্রযুক্তিতে যাওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সরকার পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দুটি পারমাণবিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করছে। আমাদের লক্ষ্য অগ্রাধিকারভিত্তিক ফ্লোটিং সোলার প্যানেল, অবশোর উইন্ড টারবাইন ও গ্রিন হাইড্রোজেনসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।’
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
আজ বুধবার (২৯ মার্চ) ভোর ৫টায় দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগান এলাকার নিজ বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর একটি দল।
স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলো পত্রিকার আলোচিত রিপোর্টটির কারণে তাকে আটক করা হয়েছে বলে সিআইডির দলটি উপস্থিত ব্যক্তিদের জানিয়েছেন।
এভাবে গভীর রাতে তল্লাশি চালিয়ে একজন সংবাদকর্মীকে আটক বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত বলে মনে করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ।
কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বানানোর পর থেকেই বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তেমনি গণমাধ্যম কর্মীরাও নির্যাতিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামসহ সারাদেশে বহু গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরই সরকারি সংস্থা কিংবা দলের লোকের নির্যাতনের খবর এসেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে শামসুজ্জামান শামসকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। সেই সাথে গণমাধ্যম কর্মীসহ মত প্রকাশের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে তাদের মামলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী জানান নেতৃবৃন্দ।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’