
রাজধানীর গুলিস্তানে বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবন মালিকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
যাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তারা হলেন, ভবনটির মূল মালিক হাজি মোহাম্মদ রেজাউর রহমানের দুই ছেলে মো. ওয়াহিদুর রহমান (৪৬) ও মতিউর রহমান (৩৫) এবং ওই ভবনের একটি স্যানিটারি দোকানের মালিক আব্দুল মোতালেব মিন্টু (৩৬)। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টার থেকে তাদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের তথ্য জানানো হয়।
এই প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ভবন মালিক ও যারা ভাড়া নিয়ে সেখানে ব্যবসা ও বসবাস করে আসছিল তারা ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না। সেপটিক ট্যাংক অপরিষ্কার রাখা, এসি মেরামত না করা, গ্যাসের লাইন বন্ধ না রাখার দায় এড়ানো যায় না। ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না, পার্কিং স্থানও ভাড়া দেওয়া ছিল। সব মিলিয়ে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এজন্য তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে ভবনের বেজমেন্টেই বিস্ফোরণের উৎস স্থল বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেইজমেন্টের স্পেসটি রাজউকের বিধান অনুসারে খোলামেলা থাকলে সেখানে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে নিরসন করা যেত। বায়ু গ্যাসসহ অন্যান্য সমস্যারও সমাধান করা যেত। বাড়ির মালিকরা টাকার লোভে এক সময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন যথাযথভাবে অপসারণ না করে তার ওপরেই সম্পূর্ণ এয়ার টাইট এসি করা নির্মাণ সামগ্রীর মার্কেট বানিয়ে দিয়েছেন।
ডিবি কর্মকর্তা বলেন, দোকান মালিক বিল্ডিং কোড না মেনে ভাড়া নিয়ে বেইজমেন্টের ১ ইঞ্চি জায়গাকেও ফাঁকা না রেখে ডেকোরেশন করে দোকান বানিয়ে সেখানেই তার কর্মচারী ও ক্রেতা সাধারণের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। এতগুলো প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি তাই ভবনের মালিক এবং দোকানদারের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং অবহেলারই ফল।
রাজউক-তিতাস-সিটি করপোরেশনের অবহেলাও তদন্ত করা হবে জানিয়ে ডিআইজি হারুন অর রশীদ বলেন, ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানার বিষয়টি রাজউকের দেখা উচিত ছিল। অনুমতি নিয়ে বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না তা তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, রাজউকের উচিত ছিল ভবন নির্মাণে অনুমতি নেওয়ার পর বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না সেটা নিশ্চিত করা। যারা ভবনটি থেকে ট্যাক্স আদায় করেন তাদেরও উচিত ছিল, যাদের ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছি, ট্যাক্স নিচ্ছি, তারা বিল্ডিং কোড ফলো করছে কি না! ডিবি পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা ঘটনার তদন্ত করছে। তাই রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ তিতাসের যেসব ব্যক্তিদের দেখার কথা ছিল তারা এগুলো দেখেছেন কি না সেটিরও তদন্ত চলবে।
মাসের শেষ সপ্তাহে শুরু হচ্ছে রোজা। বৈশি্বক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে এরই মধ্যে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিও দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। ফলে এবার রোজায় মানুষকে আরও বেশি খরচ করতে হবে। গড়ে চারজনের একটি পরিবারের খরচ বাড়তে পারে ১০ হাজার টাকার বেশি।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, গত বছরের মতো একই মানের ইফতারি, রাতের খাবার ও সাহরি খেতে হলে এবার খরচ হবে বেশি। বাড়তি খরচ চালাতে না পেরে খাবারের মান কমাতে বাধ্য হবেন অনেকে।
দেশে রোজার মাসে সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারে ইফতারিতে পেঁয়াজু, বেগুনি, আলু চপ, ছোলা, খেজুর, কলা, চিড়া, মুড়ি, শরবত কমবেশি খেয়ে থাকে। সাধারণ আয়ের বেশিরভাগ পরিবারে রাতের খাবার ও সাহরিতে মাছ বা মাংস, শাক বা সবজি, ডাল খাওয়া হয়। অনেকে দুধ-কলাও খেয়ে থাকে।
একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ৫২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন রাহাত হোসেন। রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে কলেজপড়–য়া দুই সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। তার পরিবারে গত রমজানে প্রতিদিনের ইফতারিতে গড়ে একজনের জন্য একটি খেজুর, দুটি পেঁয়াজু, একটি আলুর চপ, একটি বেগুনি, একটি কলা, একটি বড় জিলাপি, পরিমাণমতো চিড়া, দুজনের জন্য মাঝারি আকারের একটি শসা, ফল, শরবত খেতে খরচ ছিল ৭-৮ হাজার টাকা। রাতের খাবার ও সাহরিতে গত রমজানে গড়ে মাঝারি আকারের এক টুকরো মাছ বা মাংস, শাক বা সবজি ভাজি, ডাল, মাঝেমধ্যে রাতে দুধ-কলা খেতে খরচ ছিল ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা। রাহাত হোসেনের পরিবারে ইফতারি, রাতের খাবার ও সাহরিতে মোট খরচ ছিল ২২-২৫ হাজার টাকা। হিসাব করে দেখা যায়, একই খাবারে এবারের রমজানে ৩৫ হাজার টাকার বেশিই লাগবে।
রাহাত হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত রোজার মতো খেতে গেলে এবার খরচ ১২-১৫ হাজার টাকার বেশিই লাগবে। অন্য খরচ কমিয়ে যে খাবারের মান ঠিক রাখব তার উপায় নেই। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ও যাতায়াত খরচ, ছেলেদের পড়ার খরচ সবই বেড়েছে। আয় তো বাড়েনি। এবার রমজানে খাবার থেকে মাছ, মাংস, ডিম, দুধসহ অনেক কিছু কমাতে হবে। এখনই আমরা মাংস, ডিম, দুধ কম খাই।’
খুলনার টুটপাড়ায় বসবাসকারী গৃহিণী শামিয়া জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার পরিবারের আয় মাসে ৩২ হাজার টাকা। গত রোজায় ইফতারিতে পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, আলুর চপ, শসা, চিড়া-কলা খেয়েছি। এবারে খাবার তেলের দামই তো বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। চিনি, বেসন, ছোলা সবকিছুরই দাম বেশি। আগের মতোই আমার স্বামী একই বেতন পায়। এবারে ইফতারিতে একটি ভাজির পদ, সঙ্গে চিড়া ও কলা রাখব বলে ভেবেছি।’
মধ্যবিত্ত পরিবারের চেয়েও বিপাকে আছে কম আয়ের মানুষ। নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেকে শুধু ছোলা, মুড়ি দিয়েও ইফতারি সেরে ফেলার কথা বলেছেন। রাতের খাবার এবং সাহরি ভাতের সঙ্গে নিরামিষ তরকারি, ভর্তা বা ভাজি দিয়েই সারবেন বলে জানিয়েছেন।
রিকশাচালক মতি মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর রোজায় রাতের খাবার ও সেহেরিতে প্রায় প্রতিদিনই মাছ খাইতাম। মাঝেমধ্যে গোশত খাইতাম। এবার মাছ, মুরগি কেমনে খাইবো? রাতে আর সেহেরিতে বেশিরভাগ দিন ভাজি, ভর্তা দিয়েই খাইতে হইবো। ইফতারিতে ছোলা আর মুড়ি ছাড়া ভালো-মন্দ খাইবো কেমনে? সবকিছুর দাম ম্যালা বাইড়া গেছে।’
গত বছর ডিসেম্বরে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে হিসাব করে দেখিয়েছিল, চার সদস্যের একটি পরিবারে মাছ ও মাংস ছাড়া ‘কম্প্রোমাইজ ডায়েটে’ প্রয়োজন হয় ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা। এই ন্যূনতম খরচও মেটাতে পারছেন না ৩৯টি সেক্টরের ৩০টির কর্মীরা। ফার্মাসিউটিক্যাল, শিপব্রেকিং, ট্যানারি, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড অ্যানামেল, রি-রোলিং মিলস, প্রাইভেট রোড ভেহিক্যাল, লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার ফ্যাক্টরি এবং কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড টিম্বার খাত ছাড়া কোনো সেক্টরের কর্মীদের এ ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা নেই। অন্যদিকে মাছ-মাংসসহ রেগুলার ডায়েটের জন্য প্রয়োজনীয় ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা ব্যয় করার সক্ষমতা পাওয়া যায়নি ৩৯ খাতের কারোরই।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, গবেষণাটি করা হয়েছিল ডিসেম্বরে। এখন তো সময় আরও গড়িয়েছে। অনেক পণ্যের দাম আরও বেড়েছে। যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সেভাবে আয় না বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ পড়ছে।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে দাম বেড়েছে। তবে যা বাড়ার কথা অনেকে কৃত্রিম পণ্য সংকট দেখিয়েও তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে ফেলেছে। গত রমজানের তুলনায় এবারে ইফতারি, রাতের খাবার ও সাহরিতে খাবার খরচ দ্বিগুণ না হলেও তার কাছাকাছি বাড়বে। অনেকে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফল নিয়মিত খেতে পারবে না বলে মনে করছি।’
বেশিরভাগ পরিবারে শবেবরাতের পর থেকেই রমজানের জন্য খেজুর, আলু, ছোলা, বুট, ডাল, বেসন, পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, ভোজ্য তেল, চিনি, শরবত, গুঁড়া দুধ, চিড়া, মুড়িসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য কেনা শুরু করে। রমজান শেষ হওয়ার দুই-চার দিন আগপর্যন্ত এসব পণ্যের চাহিদা বাড়তি থাকে। অন্যদিকে বেগুন, শসা, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন শাকসবজি, মাছ, মাংস, তরল দুধ, ফলের চাহিদা বেশি থাকে রমজানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতি মাসে ৫-৬ হাজার টন খেজুরের চাহিদা থাকলেও শুধু রোজায় ৪০-৫০ হাজার টন লাগে। বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। রোজায় চাহিদা থাকে আড়াই থেকে তিন লাখ টনের মতো। সারা বছর ১৮ লাখ টন চিনির ৩ লাখ টনই লাগে রোজায়। সারা বছর পাঁচ লাখ টন মসুর ডালের শুধু রোজার এক মাসে লাগে ৮০ হাজার টন। বছরে ৮০ হাজার টন ছোলার ৮০ শতাংশই এ সময়ে লাগে। আর ২৬ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজের ৫ লাখ টনই দরকার হয় রোজায়।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বৈশি^ক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে এবারে ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও পণ্যের দাম গত রমজানের চেয়ে বেশি হচ্ছে। তবে কিছু সুযোগ-সন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ী রমজান সামনে রেখে এসব কারণকে অজুহাত দেখিয়ে দাম যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে বিক্রি করছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানুষ প্রোটিনের চাহিদা পূরণে সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করে মাছ, মাংস, ডিম ও ডাল। প্রোটিনের জোগান আসে এমন পণ্যের দাম গত এক বছরে বেড়েছে ২০.৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে রুই মাছের দাম ২১.২১ শতাংশ ও গরুর মাংসের দাম ২৪.৭৮ শতংশ বেড়েছে। ডালের কেজি গত এক বছরে ১৩০ থেকে বেড়ে ১৩৬ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ৪.৬২ শতাংশ। ডিমের হালিপ্রতি বেড়েছে ৩১.৫৮ শতাংশ। গত এক বছরে শর্করা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ৩৫.৫১ শতাংশ। নাজিরশাইলের দাম ২০.২৯ শতাংশ, মোটা চালের ১৭.৯৫ শতাংশ ও আটা ৬৪.২৯ শতাংশ বেড়েছে। চিনির কেজি ৪৩.৫৩ শতাংশ, মিল্ক ভিটার দুধ প্রতি লিটার ২৮.৫৭ শতাংশ বেড়েছে। সয়াবিন তেল লিটারে বেড়েছে সাড়ে ১৮ শতাংশ।
বাজার ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গতবার রোজায় মানভেদে প্রতি কেজি মোটা চাল ৩৮-৪০ টাকা থাকলেও এবারে ৫০-৫৫ টাকা, মাঝারি মানের চালও বেড়ে ৬০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। মসুরের ডাল গত রোজায় প্রতি কেজি ১২০ টাকা, এবার ১৪০, অ্যাংকর ডাল ৬০ থেকে বেড়ে এ বছর ৮০ টাকা। গতবার এক কেজি বেসন ৮০ টাকা ছিল, এবার তা ১২০, প্রতি কেজি ছোলা ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হলেও এবারে ৯০ টাকা। গত রোজায় খেজুর মানভেদে প্রতি কেজি ৩০০-৫৫০ টাকা ছিল, এবার ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। গতবার সয়াবিন তেল প্রতি কেজি ১২০ টাকা লিটার বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭৮ টাকায়। যে লবণ ছিল ৩৫, এবার সেটা ৪২ টাকা, চিড়া ৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আটার দাম ৬৬ শতাংশ বেড়ে কেজিপ্রতি ৭০ টাকা হয়েছে। চিনি ছিল ৬৫, এবার প্রায় দ্বিগুণ ১২০ টাকা। পেঁয়াজ প্রতি কেজি ২৫ থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা, গতবার মুড়ি ৬০, এবার ৭০ টাকা। গত রোজায় গুঁড়ো দুধ কেজি ৭০০-৭৫০ টাকার মধ্যে থাকলেও এবার ৮১৫-৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি প্যাকেটজাত পোলাওর চাল ১২০ থেকে বেড়ে ১৭০ এবং খোলাটা ১০০ থেকে বেড়ে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় বেড়েছে সব ধরনের মসলার দাম, সেমাই, সুজি এবং দেশি-বিদেশি ফলের দামও বাড়তি। গত রোজায় এক কেজি আপেলের দাম ছিল ১৭০-১৮০, এবার ২৮০-৩০০ টাকা।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, গত রোজায় গরুর মাংসের দাম ৫৫০ থেকে ৬০০ এবং খাসির মাংস ৮০০ টাকা ছিল। এরই মধ্যে দাম বেড়ে গরুর মাংস ৭০০ থেকে ৭৫০ এবং খাসি ১ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে।
গতবার ডিমের ডজন ১০০ টাকার মধ্যে ছিল। এবার ১৩৫ টাকা। তরল দুধ ও মাছের মতো সব ধরনের প্রোটিনজাতীয় খাবারের দাম চড়া। গত রোজায় বড় আকারের তেলাপিয়া মাছের দাম কেজিপ্রতি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা থাকলেও এবার ২২০-২৫০ টাকা। দেড় কেজির রুই, কাতলা, কালবাউশসহ বড় মাছের গত রোজায় গড়ে ২২০ থেকে ৩০০ টাকা ছিল। এরই মধ্যে দাম বেড়ে ৩৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। গত বছর পাঙ্গাশের কেজি ছিল ৯০-১১০ টাকা। এবার তা ১৬০-১৭০ টাকা।
গতবার রোজায় প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ছিল ১১০-১২০ টাকা। এবার রোজার আগেই দাম উঠেছে ২২০-২৩০ টাকা। সোনালি মুরগি কেজিপ্রতি ৫০-৬০ টাকা বেড়ে এখন ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত রোজায় বেগুন, শসা এ ধরনের সবজি অন্যগুলোর দাম গড়ে ২০-৩০ টাকার মধ্যে ছিল। এবার সবচেয়ে সস্তা সবজি পেঁপের কেজি ৩০ টাকা। মিষ্টি কুমড়া কেজি ৩৫-৪০, লম্বা বেগুন ৪০-৫০, শসা ৪০ ও লেবুর হালি ৪০-৫০ টাকা।
‘বাবারে আমার আগেই তুই চইলা গেলি। আমার বয়স হয়েছে। খোদা ক্যান আমারে তোর আগে নিয়ে গেল না’ এভাবেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশের লাশঘরের সামনে বিলাপ করছিলেন ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। তিনি গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ভবন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত মেহেদী হাসান স্বপনের বাবা গোলাম রাব্বানি। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে স্বপনের লাশ ভবনের বেজমেন্ট থেকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। তাছাড়া গতকাল রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইয়াসিন আরাফাত মারা যান। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২৩ জনে।
গত মঙ্গলবার ক্যাফে কুইন মার্কেট হিসেবে পরিচিত ভবনে বিস্ফোরণের পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন স্বপন। গতকাল ভবনের বেজমেন্টে তার লাশ পাওয়া যায়। বেজমেন্টের দক্ষিণ পাশের সিঁড়ির নিচে পড়েছিল স্বপনের লাশ। তার খোঁজে গত তিন দিন ভবনের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন স্বজনরা। স্বপনের লাশ উদ্ধারের পর তার বড় ভাই তানভীর হাসান কাঁদতে কাঁদতে মোবাইল ফোনে বাড়িতে খবর জানিয়ে বলছিলেন, ‘ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে, তোরা কবর খোঁড়।’ তিনি বলছিলেন, ‘ও (স্বপন) ছিল সবার ছোট, ওই সবার আগে চলে গেল।’
পরিবারের লোকজন শনাক্ত করার পর স্বপনের লাশ পুলিশের সহযোগিতায় নেওয়া হয় ঢামেক হাসপাতালে। সেখানে বাবাসহ পরিবারে অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার লাশ পরিবারকে দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়। এ সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারটিকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
বিধ্বস্ত সাততলা ভবনটির বেজমেন্টে থাকা বাংলাদেশ স্যানিটারি নামের দোকানের ব্যবস্থাপক ছিলেন স্বপন। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার পশ্চিম এনায়েতপুর গ্রামে। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান বলেন, ভবনটির বেজমেন্ট থেকে স্বপনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। স্বপনের বড় ভাই তানভীর হাসান সোহাগ মরদেহ শনাক্ত করেন। ভেতরে আর কোনো মরদেহ নেই।
এ সময় তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ভবনে দ্বিতীয় দফা অপারেশন বা উদ্ধারকাজের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর অবকাঠামোগত ক্লিয়ারেন্সের জন্য অপেক্ষা করছে ফায়ার সার্ভিস। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, উদ্ধারকাজ শুরুর জন্য ফায়ার সার্ভিস প্রস্তুত আছে। তবে অবকাঠামোগত ক্লিয়ারেন্স পেতে হবে। এ নিয়ে তারা আলাদা একটি টিম করেছেন। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় এর অবকাঠামোগত অবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরেই নতুন করে অভিযান শুরু করতে পারবে ফায়ার সার্ভিস। ভবনটির বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয়তলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয়তলার ছাদ ধসে বেজমেন্টের ওপর পড়েছে।
ভবনটি ১০ তলা করার পরিকল্পনা থাকলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বেজমেন্ট ও একতলা পর্যন্ত হয়। এর বেজমেন্টে ছিল রান্নাঘর আর একতলায় ছিল খাবার হোটেল ক্যাফে কুইন। এ রান্নাঘরে কমার্শিয়াল গ্যাসের সংযোগ ছিল, যা পরে লিখিতভাবে তিতাসের কাছে সারেন্ডার করা হয়। পরে ভবনটি তিনতলা পর্যন্ত করা হয়। ২০০৪ সালে ভবনটির সাততলা পর্যন্ত করা হয়। ভবনটির প্রকৃত মালিক মোহাম্মদ রেজাউর রহমান। ২০১১ সালে তার মৃত্যুতে তিন ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী বর্তমানে ভবনটির মালিক। ভবনটির বেজমেন্টে বড় একটি স্যানিটারি দোকান, নিচতলায় পাঁচটি দোকান, দোতলাতে কাপড়ের দুটি দোকান ছিল, যেগুলোর জন্য অনেক কাচ এবং ইন্টেরিয়রের কাজ করা হয় এবং বেশি শক্তির এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলো সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করালে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে যেটা দুই-তিন বছর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে ঘটেছিল।
ভবনটি নিয়ে রাজউক কী করবে : ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে নাকি সংস্কার করা হবে তা দ্রুত সময়েই জানানো হবে বলে জানিয়েছেন রাজউকের তদন্ত কমিটি সদস্য মেজর (অব.) শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানিয়ে বলেন, বেজমেন্টসহ নিচতলার কলাম ও পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রথমে এটাকে স্ট্যাবল (স্থিতিশীল) করতে হবে। এরপর সংস্কার করলে ভবনটি নিরাপদ হবে নাকি ঝুঁকি থাকবে তা জানানো হবে। ভবনের ২৪ কলামের মধ্যে ৯টি কলাম বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের তদন্তকাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তদন্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই জানাতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ভবনটি স্থিতিশীল করার কাজ গতকাল বিকেল থেকে শুরু করলে আজ শুক্রবারের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভবনের কলামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা ভবনের ভার নিতে পারছে না। কলামগুলোকে আলাদা করে সাপোর্ট দেওয়া হবে, যাতে ভার নিতে পারে। স্থিতিশীল করার পর ডিটেইল অ্যাসেসমেন্ট করা হবে। সেখানে বোঝা যাবে, ভবনটি ভেঙে ফেলতে হবে নাকি মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা যাবে।’
এখনো কমছে না উৎসুক জনতার ভিড় : সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটনার দুদিন পরও গতকাল ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় ছিল। যদিও কারোর কোনো অভিযোগ নেই, তারা শুধুই বিধ্বস্ত ভবনটি দেখছে। ফায়ার সার্ভিস, র্যাব ও পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণে উদ্ধার অভিযান ও উদ্ধার করা লাশ নিতে অ্যাম্বুলেন্স আসতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
সরেজমিনে বিস্ফোরণস্থলের আশপাশের এলাকায় দেখা গেছে, ভিড় এড়াতে পূর্ব পাশের গুলিস্তান ও বংশাল রোড দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। এরপরও উৎসুক জনতার ভিড়ে রাস্তায় যান চলাচলে বিঘœ হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে কিছুক্ষণ পরপর ধাওয়া দিয়ে তাদের হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই আবারও ঘটনাস্থলে ফিরে আসছে জনতা।
আহতদের অবস্থা : বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত ১৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে আইসিইউতে থাকা রাজন ছাড়া বাকিদের সবার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘একজন আইসিইউতে। আর বাকিরা সবাই বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকি পাঁচজনকে চিকিৎসকরা দেখে ছাড়পত্র দিয়েছেন। তবে তারা পরবর্তী চিকিৎসা নিতে আসবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইসিইউতে থাকা রাজনের গতকাল অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে তাকে শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। তার চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ডে বিভিন্ন বিভাগের প্রধানরা রয়েছেন।’
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া নয়জনের মধ্যে ইয়াসিন আরাফাত নামে একজন গতকাল মারা গেছেন। বাকি আটজন চিকিৎসাধীন। ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আটজনের মধ্যে দুজনকে রাখা হয়েছে আইসিইউতে। ২০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড মিলে সব রোগী দেখছে। গতকাল অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে তাদের শরীরে ড্রেসিং করা হয়েছে। আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হচ্ছে।’
চার দিনের ব্যবধানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভয়াবহ বিস্ফোরণের তিনটি ঘটনায় অনেক মানুষের হতাহত হওয়া এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব পালনে অবহেলার বিষয়টি আবারও জোরালো হয়েছে। জনসাধারণের অসচেতনতা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।
সাম্প্রতিক এবং অতীতের বিভিন্ন ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও স্যুয়ারেজের লাইনের ত্রুটির কারণেই বড় বিপর্যয় হচ্ছে। প্লাম্বিং সমস্যাই এখন যন্ত্রণার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ থেকে শুরু করে পরে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকে সরকারের একাধিক সংস্থা। কিন্তু তারা কেউই যথাদায়িত্ব পালন করছে না। তেমন কোনো জবাবাদিহিতার আওতায়ও নেওয়া হয় না তাদের। ভবনের পাশাপাশি কারখানায় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এর ফল হচ্ছে বিপর্যয়।’
তারা মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি জনসাধারণেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। প্রত্যেকে রাষ্ট্রের নিয়মকানুন মানলে ও সর্বস্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এম আনসার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে অনুমোদন ছাড়া ৮০ শতাংশের বেশি ভবন নির্মিত হয়েছে যেনতেনভাবে। অথচ ভবন রাতারাতি তৈরি হয় না। এ ক্ষেত্রে রাজউকের নজরদারির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তিতাস, ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থাও দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখন সবাই নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন পর আবার সবাই ভুলে যায়। দায়িত্বে অবহেলার জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। আইনের প্রয়োগও হয় না। ফলে একই ধরনের বা তার চেয়েও বড় দুর্ঘটনা ঘটে।’
তিনি বলেন, ‘ভবন নির্মাণের পর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পয়ঃনিষ্কাশন লাইন ঠিক আছে কি না; ভবনে নির্মাণত্রুটি বা অন্য সমস্যা হচ্ছে কি না তা নিয়মিত তদারকি করতে হয়। অসংগতি থাকলে মোটা অঙ্কের জরিমানা করতে হবে যাতে কেউ খরচ বাঁচাতে যেনতেন নির্মাণকাজ করতে না পারে। এটি করা হয় না। সব পর্যায়ে জবাবদিহির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। নৈতিকতারও বেশ অবনতি ঘটেছে। কারণ সেবা সংস্থাগুলোতে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের বেতনভাতা কিন্তু সাধারণ মানুষই বিভিন্নভাবে বহন করে। এখানে নৈতিকতা থাকলে দায়িত্বে অবহেলার মতো বড় অন্যায় কখনোই সম্ভব হতো না।’
‘সাধারণ মানুষেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে। যার যে কাজ তাকে দিয়ে তা করানো হয় না। প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ প্রকৌশলী বা স্থপতির সাহায্য ছাড়াই মিস্ত্রি দিয়ে তাদের ভবন নির্মাণ করছেন। আর গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সংযোগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ ইলেকট্রিশিয়ানদের ওপর নির্ভরশীল। সামান্য কিছু অর্থ বাঁচানোর জন্য রাজমিস্ত্রি কিংবা ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে কাজ করানোর এ মানসিকতা বদলাতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটলে এর আর্থিকমূল্য পরিমাপ অযোগ্য’ যোগ করেন তিনি।
এম আনসার হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনা এড়াতে নানা উদ্যোগের সঙ্গে সচেতনতাও বাড়াতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রচার-প্রচারণার সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনা বা অন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নাগরিকদেরও নিজের এবং অন্যের নিরাপত্তায় সচেতন হতে হবে। কারণ একটা ভবনের ভেতরে বিদ্যুৎ-গ্যাস কিংবা অন্যান্য লাইনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু কেবল সরকারের না। নাগরিকদেরও সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে।’
তিনি মনে করেন, ‘ঢাকায় জনবসতি এত ঘন যে, এটি এখন বসবাসের অনুপযোগী নগরী। মূলত পড়ালেখা ও আয়রোজগারের উদ্দেশ্যে মানুষ ঢাকায় আসছে। দেশের অন্যান্য এলাকায় এসব সুবিধা থাকলেও সেখানকার গুণগত মান নিম্নমানের। সরকার সারা দেশে এ দুটি বিষয় নিশ্চিত করলে রাজধানীর ওপর চাপ কমবে। তখন এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থাকবে না। নতুন ভবন নির্মাণেও মানুষ নিয়ম মানবে।’
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের ঢাকা ও তার চারপাশে জালের মতো জড়িয়ে থাকা গ্যাস পাইপলাইনের ৬০ শতাংশের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ৫০ বছরের পুরনো পাইপলাইনও রয়েছে। পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ এসব পাইপলাইনে ছিদ্র হয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। হতাহত হচ্ছে।
জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখন বিস্ফোরণকে দুর্ঘটনা বলে পার পাওয়ার আর সুযোগ নেই। এসব নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিতাসেরও বড় ধরনের গাফিলতি রয়েছে। তারা ঠিকমতো মনিটরিং করে না।’
তিনি বলেন, ‘তিতাসের অধিকাংশ লাইন অনেক পুরনো ও ঝুঁকিপর্ণ। পাইপলাইনগুলো কোথায় কী অবস্থায় আছে সে সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা তাদের নেই। জরিপের মাধ্যমে সংস্থাটির পুরো পাইপলাইন নেটওয়ার্ক মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। অব্যবহৃত লাইনগুলো বন্ধ করে ব্যবহৃত লাইনে গ্যাস ডিটেক্টর (পাইপলাইনে ছিদ্র শনাক্তকরণ যন্ত্র) বসাতে হবে, যাতে কোথায় লিকেজ হলে সহজেই জানা যায়। ঢাকা শহর এত দুর্গন্ধের নগরীতে পরিণত হয়েছে যে, অনেক সময় গ্যাস লিকেজের গন্ধও নাকে আসে না। তিতাসকে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার করে মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন সরিয়ে নতুন লাইন স্থাপন করতে হবে।’
ড. ইজাজ বলেন, ‘বাসাবাড়িতে ঠিকমতো গ্যাস না থাকায় অনেক সময় চুলা চালু রাখা হয়। পরে যখন লাইনে গ্যাস আসে তখন তা ঘরের মধ্যে জমে দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এ বিষয়ে মানুষকে সতর্ক হতে হবে। যতটা সম্ভব ঘরের জানালা খুলে রাখতে হবে, যাতে গ্যাস জমতে না পারে। বাসায় কেউ না থাকলে আগে দরজা-জানালা খুলে গ্যাসের চুলা পরীক্ষা করে কিছুক্ষণ পর বৈদ্যুতিক সুইচ অন করা দরকার। ছোটখাটো লিকেজ হলে অভিজ্ঞদের পরামর্শে তা বন্ধের চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে জানাতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।’
বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজধানীর সায়েন্সল্যাব ও সিদ্দিকবাজারে যে বিস্ফোরণ হয়েছে তা গ্যাস জমে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে মগবাজারে যে বিপর্যয় হয়েছিল, সেখানেও গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্যাসের এবং ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইনগুলো বেশ পুরনো। অনেক ক্ষেত্রে এসব লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে লিকেজ ঘটে। গ্যাসের লাইন ছিদ্র হয়ে সেই গ্যাস স্যুয়ারেজ লাইন ও শৌচাগারের পাইপের মাধ্যমে ভবনে জমতে পারে। বদ্ধ স্থানে জমে থাকা এসব গ্যাস পরে বিস্ফোরণ কিংবা বৈদ্যুতিক স্পার্কের মাধ্যমে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।’
বদ্ধ স্থানে গ্যাস জমলেই বিস্ফোরণের ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই ভবনে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে বিস্ফোরণের ঝুঁকি কমবে। গ্যাস বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের লাইনগুলো নিয়মিত চেক করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ লাইন দ্রুত মেরামত কিংবা পুনরায় স্থাপন করতে হবে। গ্যাস পাইপলাইনে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে লিকেজ হলে সহজে শনাক্ত করা যায়। জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে।
বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক দিশেহারা। জস বাটলারের মুখাবয়বে রাজ্যের হতাশা, ম্যাচ হেরে যাওয়ার একরাশ ভয়। জয়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে টেনে আনলেন সাত বোলার। তবুও এদিন বাংলাদেশকে থামাতে পারলেন না। অসম লড়াইয়ের কাগুজে পরিসংখ্যানকে স্রেফ কাগজ বানিয়ে ছুড়ে ফেলল টাইগাররা। এই ফরম্যাটে কোনো বড় দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ এমন দাপুটে জয় কখনো পেয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখার বিষয়। তবে যাই হোক দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকল। বাংলাদেশ বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারাল ৬ উইকেটে, তাও ১২ বল হাতে রেখে। আর এই দাপুটে জয়েই টাইগাররা রাঙাল টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের ৫০তম জয়। ২০২৪ বিশ্বকাপ সামনে রেখে নতুন চেহারার বাংলাদেশের এ যেন নতুন শুরু। যেখানে নেই কোনো সংকোচ-ভয়-দ্বিধা। থাকছে শুধুই দ্যুতি।
স্পষ্ট আত্মবিশ্বাসী এক ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে আগের ম্যাচেই ইংল্যান্ডকে হারানোর স্মৃতি টাটকা। ওয়ানডের সেই সাহস টি-টোয়েন্টিতে নিয়ে এসেছেন সাকিবরা। শুধু একার পারফরম নয়, পুরো দল হয়ে জ্বলে উঠলেন। তাতে পুড়ে ছারখার ইংল্যান্ড। একটি জয় এক দলকে কতটা আত্মবিশ্বাস দিতে পারে তা ম্যাচ শেষে সাকিবের কথায় স্পষ্ট। বাংলাদেশ অধিনায়ক এখনই আগামী বছরের বিশ্বকাপে ভালো করার স্বপ্ন দেখছেন, ‘আমরা দুর্দান্ত ভাবে ম্যাচটি নিয়ন্ত্রণ করেছি। আমরা শুরুর ১০ ওভারে চাপে ছিলাম, কিন্তু প্যানিক হইনি। মাথা ঠা-া রেখে সবাই নিজেদের দায়িত্বটা পূর্ণ করেছে। শুধু আমার ক্যাচ পড়া ছাড়া আজ দিনটি আমাদের সবার। টি-টোয়েন্টিতে যখন আপনি কম ভাববেন তখন ভালোও করবেন। আমাদের ড্রেসিংরুমের আবহাওয়াটা এখন দারুণ। আমার বিশ্বাস আমরা এই আবহাওয়াটা ধরে রাখতে পারব। ২০২৪ বিশ্বকাপের জন্য এর চেয়ে ভালো শুরু আর হয় না। বিশ্বকাপের আগে আমরা দারুণ একটি দল দাঁড় করাতে পারব।’
সাকিবের কথায় ‘ড্রেসিংরুমের আবহ’ বিষয়টি সত্যিই দেখার মতো। বোলিংয়ে দুর্দান্ত ভাবে ম্যাচে ফিরেছে বাংলাদেশ। সেই কথায় পরে আসা যাক তবে ব্যাটিংয়ে যে মানসিকতা বাংলাদেশ কাল দেখিয়েছে এটাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। এই ক্রিকেটের খোঁজে গত বছরগুলো মাথা খুঁটে মরেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। দল বদলের সঙ্গে সেই ক্রিকেটের শুরু হলো। নিজেদের ইনিংসে প্রথম ১০ ওভারে ৮০ রানের মতো করে বিশাল স্কোরের আভাষ দিচ্ছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু হাসান মাহমুদের আগুন ঝড়া বোলিংয়ে শেষ ৪ ওভারে মাত্র ২১ রান নিতে পেরেছে তারা। তাই স্কোর আটকে গেল ১৫০ পেরোতেই। এরপর টি-টোয়েন্টি রান তাড়ায় যা করতে হয় ব্যাটাররা তাই করলেন। টি-টোয়েন্টিতে হয়তো প্রথমবার পাওয়ার প্লেতে বিপক্ষের চেয়ে বেশি রান করল বাংলাদেশ। ৬ ওভার শেষে ২ উইকেটে বাংলাদেশ করেছে ৫৪, ইংল্যান্ডের চেয়ে তিন রান বেশি। রনি-লিটনের বিধ্বংসী শুরুটা টেনে নিয়ে গেলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। গত চার ইনিংসে তৃতীয় ফিফটি করা ব্যাটারের সঙ্গে যোগ দিলেন অভিষিক্ত তৌহিদ হৃদয়। শেষে অধিনায়ক সাকিব শেষ তুলির আঁচড় টেনেছেন। পুরো ইনিংস জুড়ে বাংলাদেশি ব্যাটারদের ‘ইনট্যান্ট’ ছিল অবিশ্বাস্য। জয়ের তাড়নায় এমন ছুটে চলা ওপেনার থেকে মিডলঅর্ডার; আগের দলগুলোয় যা ছিল অনুপস্থিত।
ইংল্যান্ডকে বাংলাদেশের পাল্টা ঘুসি উপহার দেওয়া শুরু হয় তাদের ইনিংস থেকে। বাংলাদেশি দর্শকরা এতদিন যা দেখে ক্লান্ত সেই চিত্রে আজ বিপক্ষ। গুরুত্বপূর্ণ শেষ ওভারগুলোতে রান তুলতে পারেননি ইংলিশরা। হাসান মাহমুদ দ্বিতীয় স্পেলে এলেন ১৭তম ওভারে। তার ওভার শুরুর আগেই ১৬তম ওভারের শেষ বলে ১৩ বলে ২০ রান করা বেন ডাকেটকে বোল্ড করেন মোস্তাফিজ। ৫.১ ওভারে তাদের ৪৭ রানের জুটি থামে। পরের বলেই মানে ১৭তম ওভারের প্রথম বলে বড় শট নিতে গিয়ে বাটলার ৪২ বলে ৬৭ রানে ডিপে ধরা পড়েন শান্তর হাতে। এমন গুচ্ছাকারে উইকেট হারিয়ে কতবার বিপদে পড়েছে বাংলাদেশ। আজ সেই জায়গায় ইংল্যান্ড। হাসান নিজের শেষ ওভারেও স্যাম কারেনের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেন। মিরপুরে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে কারেনের ঝড়ো ৩৩ রান বাংলাদেশের সিরিজে ফেরার স্বপ্ন শেষ করে। তবে এদিন ব্যর্থ এ অলরাউন্ডার। শেষ চার ওভারে ২১ রান হওয়ায় বড় রানের স্বপ্ন দেখতে পারেনি ইংল্যান্ড।
রান তাড়ায় বাংলাদেশ শুরু থেকেই ছিল আগ্রাসী। ২০১৫ সালের পর এই প্রথম আন্তর্জাতিকে ক্রিকেটে নেমেও স্বচ্ছন্দে খেলছিলেন রনি তালুকদার। তার ১৪ বলে ২১ রানের ইনিংস দেখে মনেই হয়নি তিনি আট বছর বিরতি শেষে ফিরেছেন। বিপিএলে খেলার মতো সাবলীল ব্যাটিং দিয়ে অপর ওপেনার লিটনের চেয়েও বেশি ছন্দে ছিলেন। মাত্র ৩.৩ ওভারে ৩৩ রানের জুটি গড়ে রশিদ খানের গুগলি পড়তে না পারায় বোল্ড হন রনি। ছন্দে থাকা শান্ত তিনে নেমে রনির রেখে যাওয়া হাল ধরেন। মার্ক উডকে এক ওভারে চারটি চারে লাইনছাড়া করেন। এখানেই না থেকে রশিদ খান-মঈন আলিদের ইনসাইড আউট-কাট দারুণ সব শটে বাউন্ডারি ছাড়া করেন। ক্যারিয়ারের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি ফিফটি তুলে নেন ১৭০ স্ট্রাইকরেটে। ৩০ বলে ৮ চারে তার ৫১ অনেক সমালোচনার জবাবও। অবশ্য বিশ্বকাপ থেকেই শান্ত ব্যাট দিয়ে সমালোচনার জবাব দিচ্ছেন। উডের দারুণ গতির বলে পরাস্ত হওয়ার আগে দুই সতীর্থ ১০ বলে ১২ রান করা লিটন ও ১৭ বলে অসাধারণ এক ছক্কা ও দুই চারে ২৪ করা হৃদয়কে হারিয়েছেন শান্ত। ১১২ রানে তার বিদায়ের পর আফিফ হোসেনকে নিয়ে আর বিপদ হতে দেননি সাকিব। ২৪ বলে ৬ চারে ৩৪ রানে অপরাজিত থেকে ম্যাচ শেষ করেন।
চান্দিকা হাথুরুসিংহে সবে এলেন। টি-টোয়েন্টি দলের কাউকে তেমন চেনেনও না। একাদশ সাজানোর দায়িত্বটা যে শুধু সাকিবের ওপরেই পড়ে তা আর বলতে হয় না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে দলে পরিবর্তন আসার পর সংস্কৃতি বদলেছেন সাকিব। বিশ্বকাপ চলাকালীন দলের অনুশীলনে-আলোচনায় প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ও টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজনকেও দূরে রেখেছিলেন দলীয় পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে! এবার নতুন কোচ আসায় আরও একটি বদল হলো বাংলাদেশ দলে। সাকিব প্রথমদিনই দলে নতুন এনে নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছেন। পারফরম করে নতুন যুক্তরা অধিনায়ককে সঠিক প্রমাণ করেছেন। সব মিলিয়ে আঁধারে থাকা ফরম্যাটে ‘নতুন’ বাংলাদেশ যেন উজ্জ্বল দ্যুতি পেল নতুন শুরুতে।
ঢাকার উত্তরায় গাড়ি থেকে কোনো অস্ত্র ছাড়াই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা লুট করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, টাকা পরিবহনের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কোম্পানিটির কর্মীদের কাছেও কোনো অস্ত্র ছিল না। ছিনতাইকারীরা টাকা পরিবহনের জন্য বিশেষভাবে রূপান্তরিত মাইক্রোবাসে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের খালি হাতেই কুপোকাত করেছিল। যদিও প্রথমে পুলিশ বলেছিল, ছিনতাইকারীরা অস্ত্র ঠেকিয়ে ওই টাকা লুট করেছিল।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানায়, ছিনতাইয়ের ৯ ঘণ্টার মধ্যে লুট হওয়া টাকার একটি বড় অংশ (প্রায় ৯ কোটি টাকা) উদ্ধার করা হয়েছে। একই সঙ্গে টাকা পরিবহনের দায়িত্বে থাকা মানি প্ল্যান্ট লিংকের দুই পরিচালক ও গাড়িচালকসহ সাতজনকে আটক করা হয়েছে।
ডিবির সূত্র জানায়, সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা টাকার চারটি বাক্স ছিনতাই করে পালিয়েছিল। খবর পেয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দ্রুত অভিযানে নামে। অত্যাধুনিক গোয়েন্দা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে ৯ ঘণ্টার মধ্যেই গাড়িচালককে আটকও করে। তার কাছ থেকে তিনটি টাকার বাক্স উদ্ধার করা হয়েছে। একটি বাক্স নিয়ে অন্য ছিনতাইকারীরা পালিয়ে গেছে।
ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, ছিনতাই হওয়া টাকাভর্তি চারটি ট্রাংকের মধ্যে তিনটি উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের অভিযান চলমান রয়েছে, অভিযান শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) খন্দকার মুহিদউদ্দিন বলেন, খিলক্ষেতসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ছিনতাই হওয়া টাকার একটি বড় অংশ এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। আশা করছি, বাকি টাকা উদ্ধার এবং দুর্বৃত্তদের শিগগিরই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, গতকাল সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকার গাড়ি ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা গাড়িটি ঘিরে ধরে গাড়িতে থাকা লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। গাড়িটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সাভারের ইপিজেডের বিভিন্ন বুথে টাকা রাখার জন্য যাচ্ছিল।
এ ঘটনার পর উত্তরা, তুরাগ ও সাভারসহ আশপাশের এলাকার তল্লাশি অভিযান জোরদার করা হয়। ছিনতাইকারীরা এ বিশাল অঙ্কের টাকা লুটে নিয়ে যে পথে পালায়, ওই পথের কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস কিংবা বাসাবাড়ির ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে কি না গোয়েন্দারা তা খুঁজতে শুরু করে। একই সঙ্গে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনাস্থল উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ব্রিজের পাশে যেসব মোবাইল ফোন ব্যবহৃত হয়েছে লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে গোয়েন্দারা তা শনাক্ত করার চেষ্টা চালায়।
তবে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ গতকাল বলেন, ‘রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার হোটেল রিজেন্সির আশপাশের এলাকা থেকে আমরা লুট হওয়া বেশিরভাগ টাকা উদ্ধার করেছি। এখনো অভিযান চলছে। কত টাকা উদ্ধার হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মোট চার ট্রাংক টাকা লুট হয়েছিল। এর মধ্যে তিন ট্রাংক উদ্ধার হয়েছে। এখনো গোনা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ৯ কোটি টাকার মতো উদ্ধার হয়েছে।’
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা সগীর আহমেদ বলেন, ‘মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি বার্ষিক চুক্তিতে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নির্ধারিত বুথে টাকা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে আছে। তাদের কাছ থেকেই টাকা ছিনতাই হয়।’
এ বিষয়ে মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি প্রতিদিনই এটিএম বুথে টাকা লোড করে। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে সাভার ইপিজেডে যাচ্ছিল। উত্তরা দিয়াবাড়ী দিয়ে যাওয়ার সময় কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস আমাদের টাকার গাড়ির সামনে এসে পথ আটকে দেয়। এরপর ওই মাইক্রো থেকে চার-পাঁচজন লোক বের হয়ে আমাদের ড্রাইভারসহ সিকিউরিটি গার্ডকে মারধর করে চাবি কেড়ে নেয় এবং গাড়ি থেকে লোকজনকে ফেলে দেয়। এরপর তাদের একজন আমাদের গাড়িটা ড্রাইভ করে চলে যায়।’ একে ‘ডাকাতি’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের গাড়ি নিয়ে কিছুদূর গিয়ে তারা দেখে তখনো আমাদের একজন লোক গাড়িতে ছিল। এরপর গাড়ি থামিয়ে তাকে মারধর করে ফেলে দেয়। এরপর চারটা (টাকার) ট্রাংক নিয়ে “ডাকাতরা” তাদের গাড়িতে উঠে চলে যায়।’
এরপর তুরাগ থানায় গিয়ে পুলিশকে অবহিত করলে তৎপরতা শুরু হয় বলে জানান যশোদা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সারা দিন আমরা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বিভিন্ন বুথ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ওই টাকা আবার ছেঁড়াফাটা বাছাই করে ভালো টাকাগুলো আবার লোড করি। এটাই আমাদের সার্ভিস।’
তুরাগ থানার ওসি মওদুদ হাওলাদার জানান, সিকিউরিটি কোম্পানির একটি গাড়িতে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ওই ব্যাংকের সাভার ইপিজেড বুথে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ছিনতাইকারীরা যেকোনো মাধ্যমে এ খবর পেয়ে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ব্রিজের পাশে ওতপেতে ছিল। টাকা বহনকারী গাড়ি সেখানে পৌঁছলে ছিনতাইকারীরা একটি মাইক্রোবাস রাস্তার মধ্যে আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে এর গতিরোধ করে। এরপর অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সব টাকা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
পুলিশের উপকমিশনার (উত্তরা জোন) মোর্শেদ আলম জানান, উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর ব্রিজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে ওই এলাকায় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা টাকা উদ্ধার এবং দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে। এ ঘটনায় তুরাগ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হচ্ছে।
জানা গেছে, সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায় র্যাব-পুলিশের একাধিক দল। তারা আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করছে। একই সঙ্গে ওই টাকা পরিবহনে যুক্ত গাড়ির চালক ও অন্য আরোহীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয়। তাদের মুখ থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা জোনাল টিমের এডিসি বদরুল রহমান জিল্লু জানান, ঘটনার পর থেকে টাকা উদ্ধারে এবং আসামিদের গ্রেপ্তারে ডিবির একাধিক দল কাজ করছে। আশা করা হচ্ছে দ্রুতই তাদের গ্রেপ্তার ও লুণ্ঠিত টাকার বাকি অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
এদিকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। তবে এতে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ টাকা বহন ও এটিএম বুথে জমার দায়িত্ব টাকা বহনকারী সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানের। আবার এ টাকা বীমার আওতায় রয়েছে। ফলে এ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এটি একটি বড় ধরনের ঘটনা। এ কারণে র্যাব ছায়াতদন্ত করছে। আশা করছি, ছিনতাইকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
কোনো জেলায় কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন রয়েছে কি না তা জানতে তালিকা তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেক ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমার সরকারের লক্ষ্য হওয়ায় আমি প্রত্যেককে বাড়ি দেব। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ বাড়ি, আশ্রয় এবং জীবিকার সুযোগ পাবে। তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না। আমরা চাই প্রত্যেকে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে।’
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপে বাড়ি হস্তান্তরের সময় এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি সাতটি জেলা ও ১৫৯টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা।
এর আগে তিনি পঞ্চগড় ও মাগুরার সব উপজেলাসহ ৫২টি উপজেলাকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনি গতকাল ৯টি জেলা এবং ২১১টি উপজেলা গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। খবর বাসসের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির পিতা দেশকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে একটি উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন দিতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তার সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না বলে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি বলেন, তার সরকার ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বাড়িঘর ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে বাড়িপ্রাপ্তদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ওপর একটি ভিডিও-প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সরকার প্রধান বলেন, ‘কেউ ঠিকানা ছাড়া থাকবে না। আমরা তাদের শুধু ঘরই দিইনি, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। তাদের জীবিকার জন্য ঋণও দিয়েছি। তারা এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন, একজন ব্যক্তি ১০০ বিঘা জমির অধিকারী হতে পারবে এবং এর অতিরিক্ত পরিমাণ জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র গড়তে রোডম্যাপ জরুরি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভৌগোলিক-কৌশলগত সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। গতকাল ঢাকায় প্রথম অ্যাভিয়েশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে দেওয়া এক ভিডিও ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন সামিট-২০২৩’-এর আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী এই শীর্ষ সম্মেলনকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, দেশটির এই অঞ্চলে একটি বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা রয়েছে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা যাত্রী ও মালামাল উভয়ের জন্যই একটি উন্নত ও টেকসই বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারি সংস্থা, এয়ারলাইনস ও সংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সরকার ই-ভিসা সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ও পর্যটনে আসা যাত্রীদের সুবিধা দেবে ও ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের যুবকদের অবশ্যই পাইলট, বিমান প্রকৌশলী, মেকানিক, ক্রু ও আরও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি দেশের বিমানশিল্পে লোকবলের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই বিমানশিল্প এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী ও ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বক্তব্য দেন।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনার কামরুজ্জামান ফকির (৩৫) নামে এক পল্লি চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। এ সময় জাহিদ (২৮) নামে আরেকজন আহত হন। আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে উপজেলার শেখপুর বাজারসংলগ্ন মির্জারচর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত কামরুজ্জামান মাদারীপুর সদর উপজেলার আদিত্যপুর গ্রামের আবদুর রব ফকিরের ছেলে।
হাসপাতালে, ফায়ার সার্ভিস ও নিহতের আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, ভোরে কামরুজ্জামান তার আপন ভায়রা জাহিদকে নিয়ে তাবলিগ জামাতে অংশ নিতে গাজীপুরের টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশে শিবচরের পাঁচ্চর বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হন। পাঁচ্চর থেকে বাসযোগে টঙ্গী যাওয়ার কথা ছিল তার। এ সময় তার মোটরসাইকেলটি শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কে শিবচরের শেখপুর মির্জারচর নামক স্থানে আসলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মোটরসাইকেল থাকা দুজন গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা কামরুজ্জামানকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আহত জাহিদকে উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শিবচর ফায়ার সার্ভিসের লিডার তরুনুর রশিদ খান বলেন, ভোরে আমরা খবর পেয় ঘটনাস্থলে যাই। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, সকালে রোগীকে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে। পরে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পাই হাসপাতালে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।