
পাঁচ বছর পর আজ শনিবার ময়মনসিংহ আসছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সফরে ৭৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেবেন ৩০ প্রকল্পের। পাশাপাশি নগরীর সার্কিট হাউজ মাঠের জনসভায় ভাষণ দেবেন তিনি। গতকাল শুক্রবার দুপুরে এসব তথ্য জানান ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজার রহমান।
তিনি আরও জানান, দুপুর ১টায় প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে ময়মনসিংহ স্টেডিয়াম মাঠে এসে নামবেন। সেখান থেকে সার্কিট হাউজে এসে বিশ্রাম নেওয়ার পর ৭৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৩০টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং স্থানীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। পরে বেলা ৩টায় সার্কিট হাউজ মাঠে ময়মনসিংহ বিভাগীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন জেলা প্রশাসক। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে নিিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর এই আগমনকে কেন্দ্র করে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছে গোটা ময়মনসিংহ। প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে ব্যানার, পোস্টার আর ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে সার্কিট হাউজ ময়দানের জনসভাস্থলসহ ময়মনসিংহ নগরীর প্রতিটি সড়ক ও পাড়া-মহল্লা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক ছাড়াও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। জনসভাকে সফল করতে রাত-দিন ব্যস্ত সময় পার করছেন দলের স্থানীয় নেতারাসহ কর্মীরাও।
ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত বলেন, ‘অতীতে কোনো সরকারের আমলে ময়মনসিংহে এমন উন্নয়ন হয়নি। দৃশ্যমান এসব উন্নয়নের ফলেই আগামীতে মানুষ নৌকায় ভোট দেবে।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ময়মনসিংহ সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ৫০০ শয্যা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার শয্যায় উন্নীত করেছেন। ময়মনসিংহকে বিভাগ ও পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীতকরণসহ শিক্ষা বোর্ড স্থাপন ও পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ ড্রেজিংয়ের দাবি ছিল ময়মনসিংহবাসীর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহবাসীর এসব দাবিও পূরণ করেছেন। ময়মনসিংহবাসী দৃশ্যমান এসব উন্নয়নের সুফল এখন ভোগ করছে।’
যেসব প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন : উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসংলগ্ন জায়গায় ছবির ভিত্তিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, ময়মনসিংহ সদরের চরসিরতায় ৫০ শয্যার ডা. মুশফিকুর রহমান শুভ মেমোরিয়াল ইসলামিক মিশন হাসপাতাল, ত্রিশালে এক হাজার আসনের অডিটরিয়াম কাম কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ, ময়মনসিংহ জেলায় ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি, গফরগাঁওয়ের চরআলগী ইউনিয়নকে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন থেকে রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সদর উপজেলা পরিষদ নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, হালুয়াঘাটে গোরবাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর, জেলা আইনজীবী সমিতির মূল ভবন শহীদ অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম ভবন ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ উদ্বোধন। এ ছাড়াও কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশরতœ শেখ হাসিনা হল, শেখ রেহানা হল, রোজী জামাল হল ও সরকারি আনন্দ মোহন কলেজে ৫০০ শয্যার পাঁচতলা ছাত্র হোস্টেল নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন।
বিরোধীদলীয় নেতার শুভেচ্ছা : প্রধানমন্ত্রীর ময়মনসিংহে আগমনকে স্বাগত জানিয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়কে তোরণ নির্মাণ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। এ ছাড়াও জাতীয় পার্টির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে ময়মনসিংহে স্বাগত জানিয়ে তোরণ, ব্যানার, পোস্টার আর ফেস্টুন সাঁটিয়েছেন। জেলা জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদ ময়মনসিংহ সদর আসনের সংসদ সদস্য। তাই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ময়মনসিংহে আগমন উপলক্ষে আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশস্বরূপ তাকে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।’
জনসভার মাঠ পরিদর্শনে ওবায়দুল কাদের : গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থল সার্কিট হাউজ ময়দান পরিদর্শন করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহের বিভাগীয় সমাবেশে আগামী নির্বাচনের বার্তা দেবেন। আওয়ামী লীগের যে উন্নয়ন তা জনগণের চোখের সামনে আছে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ করা হবে। সেটাই হবে নির্বাচনের মূল বার্তা।’ এ সময় কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহাম্মদ হোসেন ও মির্জা আজমসহ দলের অন্যান্য নেতা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর ময়মনসিংহ এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি হঠাৎ দেখাদেখির কৌশল গ্রহণ করেছে। জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে সম্প্রতি দেশের রাজনীতিতে বিদেশি তৎপরতা বাড়ায় দেখাদেখির কৌশল নিয়েছে দুই দলই। এর মধ্যে বিদেশি তৎপরতা কতটা ফলপ্রসূ হয় সেটাও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। প্রয়োজন পড়লে আটঘাট বেঁধে নামার প্রস্তুতিও নেওয়া যাবে দেখাদেখির ভেতর দিয়ে।
আওয়ামী লীগ ভালো করে বুঝে উঠতে চায় বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী করে, কোথায় গিয়ে ঠেকে। আবার বিএনপিও দেখতে চায়, আওয়ামী লীগ কতটা ঠেকাতে পারে তাদের চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন। এই দেখাদেখির ওপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়ই তাদের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করবে। দুই দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে তাদের এমন কৌশল গ্রহণের বিষয়টি জানা গেছে।
দুই দলের নেতারাই দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, আগামী মে মাস পর্যন্ত এক দল আরেক দলের কর্মকান্ড দেখবে। তারপর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দুই দলই চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা নেবে এবং সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে আসবে। সে পর্যন্ত বিএনপির সরকারবিরোধী সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ও আওয়ামী লীগের শান্তি-সমাবেশ অব্যাহত
থাকবে। মে মাসের পর বিএনপির আন্দোলন আরও বেগবান ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন আওয়ামী লীগও আরও শক্ত হাতে দমননীতি অনুসরণ করতে পারে।
ওই নেতারা বলেন, মে মাসের পর এক দল আরেক দলকে ‘হ্যাঁচকা টান মারার’ চিন্তা করছে। বিএনপি মনে করে, এখনই চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে নির্বাচন পর্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। এতে করে আন্দোলন নিষ্ফল হয়ে যেতে পারে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপি সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলনে নামলে তাদের ভুলগুলো পুঁজি করে অ্যাকশনে যেতে পারবে তারা।
তবে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপিকে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হবে, এমনটাই তারা মনে করছেন। সেই সুযোগের উপযুক্ত ব্যবহার করে সরকার বিএনপির আন্দোলন দুর্বল করতে পারবে, এমন বিশ্বাসও তাদের আছে। এ ছাড়াও দেখাদেখির মধ্য দিয়ে সময়ক্ষেপণ করার নীতি অনুসরণ করেছে আওয়ামী লীগ। কারণ রাজনীতির পরিবেশ শান্ত রেখে এগিয়ে যেতে পারলেও সুফল পাবে ক্ষমতাসীনরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ মনে করে, বিএনপিসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের ভেতর দিয়ে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশ পরিচালনা করবে। তিনি বলেন, ‘আসলে দেখাদেখি বলতে আমি বুঝি, বিএনপি যা করবে গণতান্ত্রিক পথে করতে পারবে। অগণতান্ত্রিক আচরণ করতে গেলে শক্তভাবে তার জবাব দেওয়া হবে।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কী হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে তারা এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছেন না, সেটি পরিষ্কার করেছেন। একই সঙ্গে তারা এ সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনড় থাকবেন। এ জন্য নিয়মমাফিক যে আন্দোলনের কর্মসূচি চলছে, সেটিই ভিন্ন আঙ্গিকে নতুনত্ব দিয়ে মে মাস পর্যন্ত টেনে নেবে।
জানা গেছে, ৬ মার্চ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। সে অনুযায়ী ১০ দফা দাবির আন্দোলন আরও বেগবান করে সরকারের পতনের লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাতে সহযোগী সংগঠনগুলোকে সেমিনার আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলটির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে রয়েছে যুবদল, কৃষক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, শ্রমিক দল, মহিলা দল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, জাসাস, তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দল ও উলামা দল। এরা প্রত্যেকে আলাদা কর্মসূচি পালন শেষ করতে করতে রোজা চলে আসবে। রোজায় কঠোর কোনো কর্মসূচি না রাখার বিষয়ে মত একাধিক নেতার।
তবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মাঝখান সময়ে রোডমার্চ বা লংমার্চের কর্মসূচি আসতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক নেতা। এ কর্মসূচি চলতি মার্চ মাসেই পালনের কথা ছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি রংপুর বিভাগ দিয়ে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফলে এটি পিছিয়ে যায়। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে এ ধারাবাহিক বৈঠক শেষ হবে ১৬ মার্চ ময়মনসিংহ বিভাগের নেতাদের সঙ্গে বসার মধ্য দিয়ে।
এখন পর্যন্ত রংপুর, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুরের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারেক রহমান। বৈঠকে প্রায় সব নেতাই একই সুরে বলেছেন, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মধ্যবর্তী সময়ে বড় ধরনের কর্মসূচি দিতে। দলটির হাইকমান্ডও মনে করছেন, ওই সময় রোডমার্চ বা লংমার্চের মতো কর্মসূচি দেওয়া যেতে হবে।
তবে দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা নিশ্চিত করেছেন, একতরফা নির্বাচনের ঘোষণা বা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করলে হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আন্দোলন বলেকয়ে হয় না। সময় ও পরিবেশ বলে দেবে কী ধরনের কর্মসূচি দিতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সময় সময় আমাদের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হবে।’
দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘৭ মার্চ ভাষণের পর যা হয়নি, ২৫ মার্চের ঘটনার পর স্বাধীনতার আন্দোলনের গতি কোথায় দাঁড়িয়েছে? এরশাদবিরোধী আন্দোলনও মিছিল, মিটিং, মানববন্ধনের মধ্যে কর্মসূচি সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ডা. শামসুল আলম খান মিলন হত্যার পর বলে দিতে হয়নি কী করতে হবে। আমরা সময় ধরে ধরে, পরিস্থিতি, পরিবেশ বুঝে কর্মসূচি দিচ্ছি। সময় যত ঘনিয়ে আসছে, আন্দোলনের ধারাও তার রূপ তত পরিবর্তন করবে।’
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, দল দুটি নিজেদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে পরোক্ষভাবে বিদেশিদের পরামর্শ রয়েছে। বিরোধ তুঙ্গে না তুলে দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে রাজনৈতিক সমাধানে আসুক তারা এটা চায় বিদেশিরা। এ জন্য প্রয়োজনে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করারও অনুরোধ রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি। দেখাদেখির রাজনীতির পর্বে সংলাপের সুযোগও এসে যেতে পারে।
বিদেশি তৎপরতার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের সবাই জানে বিএনপি কিছু হলেই বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়। দেশের মানুষের কাছে যায় না তারা।’ তিনি বলেন, দেশের মানুষের ওপর ভরসা না থাকায় বিদেশিদের কাছে দেশের বিরুদ্ধে বিচার নিয়ে যাওয়ার ফল কখনো ভালো হয় না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য বলেন, ক্ষমতাসীনদের ওপর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সব দলের অংশগ্রহণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ রয়েছে। আবার ইতিবাচক অবস্থানে গিয়ে বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারেও চাপ রয়েছে। বিএনপিবিহীন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক বলে বিবেচিত হবে না বলে বিদেশিরা বারবার বলছে।
তিনি বলেন, এ চাপ সামলাতে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার ব্যাপারে বিদেশিদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছে সরকারি দল। তাতে করে অনেকটা দায়মুক্ত হতে পারবে আওয়ামী লীগ। এসব হিসাব করে আওয়ামী লীগ বিশ^াস করে, বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকবে বললেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসতেই হবে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে সরকারকে।
দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচন করে পার পাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এবার তা মেনেও নেবে না বিদেশিরা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পর্যাপ্ত দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক কাজ করবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে ধরে নিয়েই ক্ষমতাসীনরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা সফরে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবার যেনতেন নির্বাচন হবে না বলেও জানান দিচ্ছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সেটাও নিশ্চিত করতে চান তিনি।
কাজী জাফর উল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সংবিধান সম্মতভাবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করবে, নির্বাচনকালীন সরকার কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’ তিনি বলেন, ‘এটাই সরকারের অবস্থান।’
আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠ মাঝেমধ্যেই উত্তাপ ছড়াচ্ছে। হামলা-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। নির্বাচন ঘিরে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সক্রিয় উঠতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট মহল। কিন্তু চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরির ব্যাপারে এখনো অনেকটা গা-ছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি)।
এ ছাড়া ২০২১ সালের মার্চে সিএমপির সন্ত্রাসী তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। ৩২৩ জনের ওই তালিকায় চিহ্নিত অনেকের নাম নেই। আবার এই তালিকায় রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। যে কারণে তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আ স ম মাহতাব উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীর তালিকা তো প্রতিদিন হয়। অপরাধের ধরন অনুয়ায়ী অপরাধীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (সিডিএমএস) ঢুকে যায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় সন্ত্রাসী তালিকা হয় না।’
এদিকে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হচ্ছে, মাঠপর্যায় থেকে এমন তথ্য পেয়ে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটে বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রামে কর্মরত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছে। তাদের নির্দেশে দেশে অবস্থানকারী সহযোগীরা খুন, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে। এমনকি হত্যাকা-ের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা।
সন্ত্রাসীদের নতুন তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মাহবুব আলম। গত বুধবার তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে আমরা সন্ত্রাসীদের তালিকা করছি। আগামী দুই মাসের মধ্যে ওই তালিকা তৈরির কাজ শেষ হবে।’
২০২১ সালে পুলিশের করা তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, কোতোয়ালি থানায় ৪৪, বাকলিয়ায় ২৪, চকবাজারে ১৪, পাঁচলাইশে ২১, চান্দগাঁওয়ে ২, খুলশীতে ১২, বায়েজিদ বোস্তামীতে ৮৫, ডবলমুরিংয়ে ১৮, হালিশহরে ৩৪, পাহাড়তলীতে ১২, আকবর শাহে ৭, ইপিজেডে ২৫, বন্দরে ৩, পতেঙ্গায় ১১ ও কর্ণফুলী থানায় ১১ জন আছে। তাদের মধ্যে বর্তমানে কতজন কারাগারে আছে, সে তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তালিকাভুক্তদের ৯৫ শতাংশ জামিনে আছে।
এই তালিকায় ৯৪ জনের রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪৩ ও বিএনপির ৩৮ এবং জামায়াতের ১৩ জন রয়েছে।
বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের যারা তালিকাভুক্ত তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একটি থেকে সর্বোচ্চ ২৮টি পর্যন্ত মামলা আছে। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের যারা তালিকাভুক্ত তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১৮-২০টি মামলা আছে। তবে সন্ত্রাসী তালিকাটি রাজনৈতিক, পেশাদার এ রকম কোনো ভাগ করে করা হয়নি।
এই তালিকায় নগরের বিভিন্ন থানায় খুন, অস্ত্র, চাঁদাবাজির মামলা আছে এমন ১১ জনের নাম তালিকায় আসেনি। তারা আওয়ামী লীগ-যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িত। তাদের মধ্যে চারজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
নগর পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, অপরাধী শনাক্তের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হলো সন্ত্রাসী তালিকা হালনাগাদ করা। আর তালিকা তৈরির সময় কোনো রাজনৈতিক নেতা বা প্রভাবশালীদের ছাড় দেওয়া হয় না।
কিন্তু ২০২১ সালের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তালিকাভুক্ত ওই চারজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের ৪৮ পৃষ্ঠপোষক বা নেতার তালিকা করে। ওই তালিকায় চার ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ সাত ‘গডফাদারের’ নাম উঠে আসে। তাদের মধ্যে আছেন চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর মোস্তফা ওরফে টিনু, ১৩ নম্বর পাহাড়তলীর ওয়ার্ডের ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী, চান্দগাঁও ওয়ার্ডের এসরারুল হক। এ ছাড়া আছেন লালখানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম। তিনি নগর ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত হত্যা মামলার আসামি।
কাউন্সিলর টিনুকে ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব-৭। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও হত্যাচেষ্টার পাঁচটি মামলা রয়েছে। তিনি কারাগারে থাকা অবস্থায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। টিনু মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক বা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদপ্রত্যাশী।
মহানগর যুবলীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের পদপ্রত্যাশী খোকন চন্দ্র তাঁতী ওরফে কে সি তাঁতী ২০১৩ সাল পর্যন্ত মহানগর পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন। হালিশহর থানা এলাকায় ১৯৯২ সালের জোড়া খুন, ২০১৩ সালের ২৪ জুন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর তথা সিআরবি এলাকায় জোড়া খুন এবং সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জি এস আমিনুল ইসলাম স্বপন হত্যা মামলার আসামি তিনি।
কাউন্সিলর এসরারুল হকের বিরুদ্ধে বহদ্দারহাট এলাকায় জমি দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগে এক ডজন মামলা আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল চান্দগাঁও থানার ফরিদের পাড়া এলাকায় চাঁদা চেয়ে না পেয়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে আমজাদ হোসেন নামের এক যুবকের পা জখম করার অভিযোগ আছে। ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলা ছিল ৬টি। তার বিরুদ্ধেও কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তাররের জেরে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট জাকির হোসেন নামের দশম শ্রেণিপড়ুয়া তার এক অনুসারী প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। বিগত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হলফনামায় তিনি ‘মামলার বর্তমান অবস্থা’ কলামে ‘প্রত্যাহার’ ও ‘খালাস’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার বিরুদ্ধে সিটি কলেজের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক সিনাউল হক আশিক হত্যা মামলা ছিল। পরে রাজনৈতিক বিবেচনায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পাঠানটুলি এলাকার সাবেক কাউন্সিলর আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদেরের বিরুদ্ধে সাক্ষীর অভাবে ২৮টি মামলায়ই খালাস ও রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়। এখন তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে।
২০১৩ সালে সিআরবি এলাকায় জোড়া খুন মামলার আরেক আসামি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাইফুল আলম লিমন। তিনি মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হতে চান। অভিযোগের বিষয়ে সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী। একটি স্বার্থান্বেষী মহল আমার বিরুদ্ধে লেগে আছে। সিআরবির মামলাটি পুরোটাই ষড়যন্ত্রমূলক। মামলাটি বিচারাধীন। আশা করি, বেকসুর খালাস পাব।’
বায়েজিদ থানা এলাকায় হত্যা ও চাঁদাবাজি মামলার আসামি আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দীন। তিনিও পেতে চান নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ। তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা ছাড়াও দখলবাজি ও কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে।
তালিকা সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকার বিষয়ে সিএমপির উপকমিশনার (অপরাধ) নিষ্কৃতি চাকমা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের তালিকা করে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। ২০২১ সালে করা তালিকাটি আমি দেখিনি। তবে সন্ত্রাসীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকা উচিত নয়।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় হতে পারে না। তালিকায় অপরাধীদের দলীয় পরিচয় থাকা উচিত নয়।’
সচেতন নাগরিক কমিটি, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘সন্ত্রাসী কারা তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানে। সন্ত্রাসীদের কোনো দলীয় পরিচয় থাকতে পারে না। তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে নির্ভরতা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা জরুরি। তা যদি না হয় পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে আস্থার সংকট বাড়বে।’
প্রাথমিকের শিক্ষকতায় মেধাবীদের নিয়োগের উদ্দেশ্যে বিসিএসের দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছিল। কিন্তু তারা বেশি দিন এ পেশায় থাকছেন না। অন্য চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। এমনকি দ্বিতীয় শ্রেণির যেকোনো চাকরিতে যেতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পদোন্নতির সুযোগ না থাকাই এর মূল কারণ।
প্রার্থীরা বলছেন, দ্বিতীয় শ্রেণির পদের কথা বলে নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা দশম গ্রেড পাচ্ছেন না।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু এ ব্যাপারে মামলা চলছে। মামলা নিষ্পত্তি হলেই আমরা তাদের দশম গ্রেড দেব। আমরাও চাই, তারা পদোন্নতি পান। এ ব্যাপারে নতুন বিধিমালা হচ্ছে। বিধি হলে পদোন্নতির ব্যাপারে সঠিক বলা সম্ভব হবে।’
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের জন্য দুই ধরনের গ্রেড চালু আছে। যাদের প্রশিক্ষণ নেই তাদের এক ধরনের আর যাদের প্রশিক্ষণ আছে তাদের আরেক ধরনের। যারা নতুন যোগ দেন তাদের প্রশিক্ষণ থাকার সুযোগ নেই, ফলে তারা চাকরি শুরু করেন ১২তম গ্রেডে ১১ হাজার ৩০০ টাকার বেতন স্কেলে। তারা সর্বসাকল্যে বেতন পান প্রায় ২২ হাজার টাকা। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তারা উন্নীত হন ১১তম গ্রেডে। তখন তাদের বেতন হয় ১২ হাজার ৫০০ টাকার স্কেলে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। যারা চাকরি শুরুর কিছুদিন পর প্রশিক্ষণ নেন, তারা ১১তম গ্রেডে বেতন-নির্দিষ্ট হলেও অনেক সময় ১২তম গ্রেডের চেয়ে এক হাজার টাকা কম পান। ফলে অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েও ১২তম গ্রেডেই রয়ে যান।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে ৩৪তম বিসিএস থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮৯৮ জন প্রধান শিক্ষক যোগদান করেন। ৩৬তম বিসিএস থেকে ২০১৯ সালে আরও ৩০৩ জন প্রধান শিক্ষক যোগদান করেন। দুই বিসিএস মিলিয়ে ১ হাজার ২০১ জন যোগদান করলেও ইতিমধ্যে দুইশোর বেশি শিক্ষক চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। আরও অনেকে মোটামুটি সম্মানজনক কোনো চাকরি পেলে চলে যাবেন স্থির করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকরা বলেছেন, ‘তিন কারণে বিসিএস থেকে আসা প্রধান শিক্ষকরা থাকতে চাইছেন না। প্রথমত পদোন্নতি না থাকা, দ্বিতীয়ত দ্বিতীয় শ্রেণির পদ হওয়া সত্ত্বেও দশম গ্রেড না পাওয়া, তৃতীয়ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কাক্সিক্ষত পরিবেশ না পাওয়া।’
৩৪তম বিসিএস থেকে ২০১৭ সালে নন-ক্যাডার দ্বিতীয় শ্রেণির পদে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন মো. সেলিম উদ্দিন। ২০১৯ সালে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়ে একটি ব্যাংকে যোগ দেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শুরুতেই ধাক্কা খেলাম। দশম গ্রেডের পরিবর্তে আমাদের দেওয়া হলো ১২তম গ্রেড। আমরা উচ্চ আদালতে রিট করলে দশম গ্রেড দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সে নির্দেশ কার্যকর করা হয়নি। এ ছাড়া প্রধান শিক্ষক পদ থেকে আর পদোন্নতির সুযোগও নেই। চাকরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই পদ। আমার পদায়ন হয়েছিল বাড়ি থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। দুজন মাত্র শিক্ষক। পরিবেশও অনুকূল ছিল না।’
প্রধান শিক্ষকরা জানান, ২০১৪ সালের ৯ মার্চ সরকার প্রধান শিক্ষকদের পদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। প্রধান শিক্ষকদের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আদালত তা কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছিল। তাতেও কার্যকর না হওয়ায় আদালত অবমাননার মামলা করেন শিক্ষকরা। এ ব্যাপারে রিভিউ আবেদন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। মামলাটি চলছে। সরকারের আচরণে সামন্ত-সংস্কৃতির ছাপ পুরোমাত্রায় বহাল।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেটেড অফিসার ও নন-গেজেটেড কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা-২০২১-এর কাজ চলমান রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের কাজ শেষ করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠিয়েছে। সেই খসড়া বিধিমালায় প্রধান শিক্ষকদের জন্য সরাসরি পদোন্নতির বিধান রাখা হয়নি। পরবর্তী পদ সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করতে বলা হয়েছে। তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বয়স ৫০ বছর পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে এবং তাদের জন্য ৮০ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করা হবে উল্লেখ রয়েছে। প্রধান শিক্ষক পদে তিন বছর ও সহকারী শিক্ষক পদে ১০ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলে তারা বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে আবেদন করতে পারবেন। বিভাগীয় প্রার্থীদের মধ্যে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে তা পূরণের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-১ ও মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ ছায়িদ উল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মর্যাদায় আমরা নিম্ন স্থানে রয়েছি। আট বছরেরও বেশি সময় আগে আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হলেও তা আজও কার্যকর হয়নি। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত আমাদের পদোন্নতির সুযোগ ছিল। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে। নতুন যে বিধিমালা তৈরি হচ্ছে তাতেও আমাদের পদোন্নতির সুযোগ নেই। বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে সুযোগের যে কথা বলা হচ্ছে, তা অনেকটা ‘মুলা’ ঝুলানোর মতো। এই যদি অবস্থা, তাহলে বিসিএসের মাধ্যমে এসে মেধাবীরা কেন এ পদে থাকবে!’
দিব্যকান্তি, সৌম্য পুরুষ দেখলে শরীরে শিহরণ জাগে। পবিত্র মুখাবয়ব, কথা বলা, হৃদয়-উথলানো হাসি সবার থাকে না। ধীরস্থির, নম্র, বিনীত এমন মানুষের কদাচিৎ দেখা মেলে। দীর্ঘ সময় ধরে অস্ত্রোপচার করে চলেছেন মানুষের হৃদয়ে অর্থাৎ হৃদযন্ত্রে। হাজারো মানুষের হৃৎপিণ্ড-ব্যবচ্ছেদক সফল চিকিৎসক ডা. জাহাঙ্গীর কবির। দেশে তো বটেই, বিশে^ও আলোড়ন তুলেছেন মেকানিক্যাল হার্ট ইমপ্ল্যান্ট বা কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড সংযোজন করে। ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন ও কার্ডিয়াক সেন্টারের পরিচালক জাহাঙ্গীর কবির যখন হাসেন তখন নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে। আহা, যদি পারতাম তার মতো হাসতে, কথা বলতে!
নিজেকে দায়িত্বশীল অথচ সাধারণ মানুষ মনে করে অপারেশন থিয়েটারে হাতে তুলে নেন বুক চেরার যন্ত্রপাতি। দেখেন, হৃদযন্ত্র চলছে অথচ মানুষটি অচেতন। নিপুণ দক্ষতায় দীর্ঘ সময় অপারেশন চালিয়ে সফলভাবে সম্পন্ন করেন হৃদয়ের চলাচল। কেমন লাগে, ওই মুহূর্তে! যখন একজন মানুষের হার্ট সংকুচিত-প্রসারিত হচ্ছে, আর আপনি এক মনে ব্যবচ্ছেদ করে চলেছেন? জাহাঙ্গীর কবির হোহো করে হাসেন। বলেন, অভ্যস্ত হয়ে গেছি। খুব সচেতনভাবে, সাবধানে অস্ত্রোপচার করতে হয়। কারণ, মানুষটি তো জীবিত! অস্ত্রোপচারের সময় যদিও কিছু টের পায় না। কিন্তু হৃদয় তো!
এ পর্যন্ত হাজার হাজার লোকের জীবনসঞ্জীবক হয়েছেন। অপারেশন সফল হলে কেমন লাগে? বলেন, সে এক ভিন্ন অনুভূতি। বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জুতসই ভাষা আমার জানা নেই। খুব, খুব ভালো লাগে।
১৯৯৯ সাল থেকে হার্ট অপারেশন করছেন। তখন কাজ করতেন, হার্ট ফাউন্ডেশনে। সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি করেন। বললেন, সেই থেকে চলছে।
আপনিই কি শুরু করলেন ওপেন হার্ট সার্জারি?
হ্যাঁ, বলা যায় আমিই পাইওনিয়ার। এখন সব হাসপাতালে আমার হাতে প্রশিক্ষিত ডাক্তাররাই কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে তারা আছেন। এখন কোনো রোগীকে আর বিদেশ যেতে হয় না। দেশেই আধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে। বলা যায়, ইউনাইটেড হাসপাতাল এ বিষয়ে লিড করছে। এখনো প্রতিদিন আমাকে কমপক্ষে ৮টা অপারেশন করতে হয়। জানুয়ারি মাসেই ২৬ দিনে ১৭০টি অপারেশন করেছি।
সবগুলোই কি সফল? হাহাহা। হুম, এখনো ব্যর্থতার কোনো খবর পাইনি। আসলে চিকিৎসার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে ম্যান পাওয়ার তৈরি করা। দক্ষ মানুষ তৈরি হলে কিন্তু দেশ তৈরি হয়ে যায়।
বললেন, আমরা প্রচুর ফরেন কারেন্সি সেভ করেছি। হবে কয়েকশ কোটি টাকা। এসব রোগী বিদেশ চলে যেতেন। আমরা তা হতে দিইনি। দেশেই এখন ব্যবস্থা হয়েছে। মানুষ মোটামুটি সাধ্যের মধ্যেই অপারেশন করাতে পারছে। মানুষ নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারছে। কারণ কি জানো? আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করেই আমরা অস্ত্রোপচার করছি।
এটা তো আপনারই সাফল্য। হাহাহা! তা, বলতে পারো। বাইপাস সার্জারি কিন্তু আমরাই করি।
দেশে প্রথম কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড সংযোজনের সাফল্যও তো আপনার। হুম, যে মেয়েটির অপারেশন হয়েছিল, সে এখন তুরস্কে আছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব ভালো আছে।
এসব করতে গিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন হয়? ভালো, অনেক ভালো। রোগী ভালো থাকলে, ভালো তো লাগবেই। রোগীর ভালো-মন্দ আমাদের প্রভাবিত করে। রোগী ভালো হলে যেমন আনন্দ লাগে; খারাপ হলে খারাপ লাগে। খুব খারাপ লাগে। রোগী ভালো না থাকলে কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও ভালো লাগে না। অস্থির লাগে। কেন এমন হয়, বলতে পারব না।
এক ছেলে এক মেয়ের বাবা ডা. জাহাঙ্গীর কবিরকে ঘিরে রয়েছে চিকিৎসকবলয়। মেয়ে কার্ডিওলজিস্ট; কাজ করছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে। মেয়ের স্বামীও হার্ট সার্জন; কাজ করছেন শ^শুরের সঙ্গে। বললেন, ও ভালো কাজ করছে। হার্টের সার্জারিতে বেশ সফল। আর ছেলে নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে। যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে পিএইচডি করছে। তার স্ত্রীও ডাক্তার। পেডিয়াট্রিক প্রফেসর।
নিরামিষ তার প্রিয়। ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির বললেন, ইদানীং আমার খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সবজি দারুণ পছন্দ করি। বয়স হচ্ছে। আর কত!
বয়স কত হলো? হাহাহা। তা, বলা যাবে না। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। শেষে বললেন, মানুষ যেন সুস্থ থাকে। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করতে হবে। খাদ্যাভ্যাস সঠিক রাখতে হবে। সুস্থ থাকুক সবাই। দেশের কল্যাণে নিজেকে যেন ব্যস্ত রাখতে পারি।
গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত সেই ভবন পুনরায় সংস্কার করা হবে নাকি ভাঙা হবে, তা নির্ধারণ করতে ৪৫ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক)। বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে একাধিক তদন্তকারী দল। তাদের মধ্যে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ধারাণা করছেন, তিতাসের গ্যাস জমে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল এখনো খুঁজে পায়নি সিআইডি। তারা বিস্ফোরণের উৎপত্তিস্থল খুঁজতে ভবনের বাইরে ও ভেতরের আলামত সংগ্রহ করেছে। এর আগে র্যাব ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করলেও এখনো কারণ জানাতে পারেনি তারা।
গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান রাজউকের জোন-৩ ও ৫-এর অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী রঙ্গন ম-ল। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ভিম-কলামে ফাটল দেখা গেছে। তাই সেখানে প্রপিং সাপোর্ট দেওয়ার কাজ চলছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার পর্যন্ত চারটি কলামের সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। ভেতরেরগুলো পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে। এই মুহূর্তে সামনের অংশের বেজমেন্টে ব্লকার দিতে হবে। সেটা কংক্রিট দিয়েও হতে পারে। সাপোর্ট না দেওয়া হলে আবার কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এ সময় রাজউকের এ প্রকৌশলী আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে। তারপর তারা জানতে পারবেন ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে, নাকি মেরামত করা যাবে। এ অ্যাসেসমেন্ট করতে কম করে হলেও ৪৫ দিন সময় লাগবে। তার আগে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। ভবনের নকশা ও নথি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভবন মালিকের কাছ থেকে আমরা একটি নকশা পেয়েছি। কিন্তু এই ভবনটি অনেক পুরাতন তাই এর নথি খুঁজে পেতে সময় লাগছে। নকশার নাম মিললেও তার লে-আউট মিলছে না। ভবন মালিক একটি বাণিজ্যিক ভবনের নকশা দিয়েছেন। সেই নকশাটি রাজউকের আবেদন শাখায় জমা আছে। অনুমোদনের পর ইস্যু পেলেও সেটি এন্ট্রি রয়েছে। তবে সেখানে ভবনের অনুমোদন ছিল পাঁচতলা।
গত মঙ্গলবার সিদ্দিকবাজারে এ বিস্ফোরণের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা একজনকে ছাড়পত্র দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়াও আশঙ্কাজনক একজন আইসিইউসহ ভর্তি রয়েছেন ১৪ জন। আর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন লাইফ সাপোর্টে থাকা দুজনসহ তিনজন। বাকি পাঁচজনের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন সেখানকার চিকিৎসকরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, বৃহস্পতিবার এখানে ১৫ জন রোগী ভর্তি ছিল। শুক্রবার তাদের মধ্যে একজনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। রাজন নামে একজন এখনো আইসিইউতে রয়েছেন। বাকি ১৩ জন বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসাধীন।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, ইনস্টিটিউটে বৃহস্পতিবার রাতে ইয়াসিন নামে একজন মারা যাওয়ার পর আটজন ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে হাসান ও আজম নামে দুজনসহ তিনজন রয়েছেন আইসিইউতে। আইসিইউতে থাকা বাকি আরেকজন হলেন জাহান আলী। এ ছাড়া পাঁচজন ভর্তি রয়েছেন হাই-ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ)। তাদের মধ্যে দুজনকে শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে।
এর আগে বার্ন ইনস্টিটিউটে বুধবার রাতে চিকিৎসাধীন মারা যান হাফেজ মুসা হায়দার (৪২) ও বৃহস্পতিবার রাতে ইয়াসিন আরাফাত। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ২২ জন। তবে সংবাদমাধ্যমের হিসাবে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২৩ জন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সিটিটিসি ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, তিতাসের পরিত্যক্ত লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাস জমে ভবনের বেজমেন্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তারা বলছেন, ভবনের বেজমেন্টে তিতাস গ্যাসের একটি পরিত্যক্ত লাইনের অস্তিত্ব তারা পেয়েছেন। বেজমেন্টে একসময় রান্নাঘর ছিল, আর নিচতলায় ছিল খাবারের হোটেল। এই রান্নাঘরে তিতাস গ্যাসের বাণিজ্যিক লাইন ছিল। ২০০১ সালে সরবরাহের সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে সংযোগ লাইন অপসারণ করা হয়নি। যে কারণে সেটিতে গ্যাসের সরবরাহ ছিল।
সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রহমত উল্লাহ চৌধুরী গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি গ্যাস থেকেই এ বিস্ফোরণ হয়েছে। তবে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ ও সেগুলো পরীক্ষার চেষ্টা করছি। এসব আলামাতের ফলাফলসহ অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার পর এর সঠিক কারণ বলা যাবে।’
তবে তিতাসের পরিচালক (অপারেশনস) প্রকৌশলী সেলিম মিয়া বলেন, ‘আমরা তিতাসের গ্যাসের কোনো আলামত পাইনি। ভবনটির নিচে আমাদের কোনো সংযোগ ছিল না। গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণ হলে আগুন লাগত কিন্তু এখানে অগ্নিকা-ের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আলামত সংগ্রহ শেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. মিজানুর রহমান জানান, বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল জানা যায়নি।
তিনি বলেন, ভবনের কোন জায়গা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে মূলত তার সন্ধানেই আমরা আলামত সংগ্রহ করছি। বিস্ফোরণে ভবনের কোন জায়গায় সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, সেখানের ধোঁয়া বা বিভিন্ন আলামত খুঁজে বের করা হচ্ছে।
সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ভবনের গ্রিল ধরে নাড়ালে সেটি নড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দেয়ালও নড়তে দেখা গেছে। ঘটনাস্থলে এখনো কোনো বিস্ফোরকদ্রব্য বা মিথেন গ্যাস রয়েছে কি না তা জানতেও আলামত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আলামতগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হবে। সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হবে। পরে বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত জানাতে পারবেন। কিন্তু যেখান থেকে মূলত বিস্ফোরণের সূত্রপাত সেই জায়গাতে আমরা এখনো যেতে পারিনি।
বিস্ফোরণের ঘটনায় অবহেলার অভিযোগ এনে পুলিশ বাদী হয়ে বংশাল থানায় আরেকটি মামলা করেছে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। এর আগে বিস্ফোরণের হতাহতের ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা করে পুলিশ।
বংশাল থানা সূত্রে জানা যায়, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে ভবনের গ্যাস সংযোগ ও নকশাসহ কী কী গাফিলতি রয়েছে। ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কোনো দায় আছে কি না সেটিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনায় দুই ভবন মালিকসহ তিনজনকে বৃহস্পতিবার ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
গত মঙ্গলবার বিকেলে সিদ্দিকবাজারের ক্যাফে কুইন নামে সাততলা ভবনটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে আবদুল মালেক মিয়া (১৩) নামে এক কিশোরকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন তার বাবা রতন মিয়া। তিনি জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের দিন তার ছেলের বাসে করে মুন্সীগঞ্জ থেকে গুলিস্তানে নামার কথা ছিল। সেখান থেকে তার সাভারের হেমায়েতপুরে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহায়তাকেন্দ্র ও নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, মালেক ছাড়াও ইমতিয়াজ হোসেন সেলিম নামে আরও একজন নিখোঁজ বলে দাবি করা হয়েছে। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুটি পরিবার দুই স্বজন নিখোঁজের দাবি করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোজার মাসে খাবারের জন্য শরীফুল আলমের বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, মাছ কিনলে মুরগি কেনা যায় না, মুরগি কিনলে মাছ বাদ দিতে হয়। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, তাই সে দোকানে নজরই দেননি তিনি। পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিনই তার পরিবারকে মাছ-মাংসের মতো প্রোটিন খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আর ইফতারিতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি আগেই নিয়েছেন। শুধু শরিফুলই নন, বাজার করতে আসা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।
গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। প্রায় একই হারে বেড়েছে পাকিস্তানি ককসহ অন্যান্য মুরগির দাম। সব ধরনের মাছের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
একটু সাধারণ হিসাব করা যাক। চারজনের একটি পরিবার যদি মাছ, মাংস বাদ দিয়ে সাহরিতে গড়ে ২০০ টাকা, সন্ধ্যা রাতের খাবারে যদি গড়ে ১৫০ টাকা আর ইফতারিতে ফল যোগ না করে গড়ে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন তবে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি মাছ-মাংস যোগ হয় তাহলে সাহরিতে ন্যূনতম ৩০০, রাতের খাবারে ৩০০ ও ইফতারিতে ফল যোগ করলে গড়ে ২০০ টাকা খরচ করলে মাসে খরচ হবে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ হিসাব চারজনের একটি পরিবারের সর্বনিম্ন হিসাব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত অক্টোবরের হিসাবে বলা হয়েছে, চারজনের একটি পরিবারে খাবার তালিকায় মাছ-মাংস যোগ করলে মাসে খরচ হবে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি শুধু খাবারের খরচ। যদি কোনো পরিবার মাছ-মাংস যোগ না করেন তাতে মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
সিপিডির গবেষণা সেলের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। পরিবারপ্রতি এ মাসে খরচ আরও বেড়ে গেছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে সেখানে সবাই উপকৃত হবে।
সিপিডির অক্টোবরের হিসাবই যদি ধরা হয়, তাহলে এবারের রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করা ছাড়া উপায় নেই ভোক্তাদের। ২২ হাজার টাকার সঙ্গে যদি বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাড়াসহ গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার টাকা।
অবশ্য সিপিডির এ তথ্য যখন প্রকাশ করা হয়, তখন মুরগির মাংসের কেজি ছিল ১৫০ টাকা, এখন তা ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, এখন তা ৭৫০ টাকায়। চিনির দাম ছিল ৯৮ টাকায় এখন তা ১২২ টাকায়। অর্থাৎ সব পণ্যেরই দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার। বেসরকারি স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। থাকেন ৩ কামরা একটি ফ্ল্যাটে। তার মাসিক খরচ ৩১-৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু মাত্র বাসা ভাড়ায় খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের পড়া ও পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচ হয় আরও ১৩-১৫ হাজার টাকা। বাদ বাকি খরচ আরও ২ হাজার। তবে এই শিক্ষক মাসে আয় করেন ২৮-৩০ হাজার টাকা। মাসিক আয় হিসেবে তার অতিরিক্ত খরচ হয় ২-৩ হাজার টাকা।
এ শিক্ষক খরচের সমন্বয় করতে সঞ্চয়ও ভেঙেছেন ইতিমধ্যে। তাতেও তার বাড়তি খরচের টাকা প্রতি মাসে ঋণের খাতায় যোগ হয়। উপায়ান্তর না দেখে পরিচয় গোপন করে মাঝেমধ্যে রাইড শেয়ার দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম মহাখালীতে। ভাবলাম একই সঙ্গে রোজার বাজার করে বাসাই ফিরি। তবে বাজারে প্রবেশ করে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ১ কেজি করে মুরগি, মাছ ও ছোলাসহ আরও দুএকটি পণ্য কিনতেই ১ হাজার টাকা শেষ। দামের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে চাহিদা মতো বাকি সদাইগুলো বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আর নয়তো অর্ধেকের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শুধু স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিনই নন, গেল কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মান ভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্য যে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও বলছেন। গত বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি মার্চে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুদের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি।
বিবিএসের চিত্রেই আবার ফেরা যাক। গত বছর চিনির কেজি ছিল ৮২ টাকা, সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। যদিও বাজারের চিত্র ব্যতিক্রম। গরুর মাংস গত বছরের মার্চে কেজি ছিল ৬১০ টাকা, কিন্তু বছর ঘুরতেই এ পণ্যের দাম এখন ৭৫০ টাকা। মানুষ বেশি দামে গরুর মাংস কিনতে না পেরে কিছুদিন আগেও ভরসা করত ব্রয়লার মুরগির ওপর, যার দাম এখন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে।
রমজানের ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে ফলের ওপর। কিন্তু সেই ফলের দামও লাগামছাড়া। ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ফলের ওপর শুল্কারোপ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম অনেক বেশি।
সাহরিতে রোজাদারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপাদান দুধ। গত বছরের মার্চে দুধের লিটার কিনতে হয়েছিল ৭০ টাকায়, এ বছর তা ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি বলেন, রমজানের ভোক্তা পর্যায়ে ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। মাঠ পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু পুরোপুরি না। সম্পূর্ণ দায় এ যুদ্ধের ওপর চাপানো ঠিক না। ভোক্তাদের দায় বেড়েছে, তাদের ওপর চাপও বেড়েছে।
সিন্ডিকেশন করে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে মাত্র ৫২ দিনে বড় উৎপাদকদের একটি চক্র ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের অন্য একটি সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ করে। এদিকে মুরগির দাম নিয়ে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। অন্য এক মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম না কমালে তা তারা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবেন। রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম কমল ৪০ টাকা : ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ উৎপাদনকারী ফার্মগুলো নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোজার মাসে ভোক্তা পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খামারি পর্যায়ে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যা গেল কয়েক সপ্তাহে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছে। হাতবদল হয়ে এসব মুরগি ভোক্তাপর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়।
‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত এই চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কনফারেন্স কক্ষে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, গতকাল আমরা ২৭০-২৮০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখেছি। এ দাম অযৌক্তিক। এটা ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না। ফার্ম পর্যায়ে ২২০-২৩০ টাকা দরে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাতবদল হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে এ অবস্থা। ব্রয়লার মুরগি এসএমএসের মাধ্যমে নিলাম হচ্ছে। আমি তাদের আহ্বান করেছি, আপনারা এ রমজান মাসে একটু কম লাভ করেন। তারা একমত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খামার থেকে আসা ব্রয়লার মুরগি হাতবদলে যেন দাম খুব বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে সংস্থাটি নজর রাখবে। ব্রয়লারের দাম কমাতে প্রয়োজনে বর্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সময় কাজী ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানান, তারা রমজানে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ব্রয়লার বিক্রি করবেন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করছে আফতাব, প্যারাগন ও সিপি কোম্পানি।
রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে : মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আগামী দুই-তিন মাসের জন্য মুরগি ও গরুর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবে সংগঠনটি। গতকাল এফবিসিসিআই বোর্ডরুমে ‘রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায়’ এ কথা জানানো হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ ও কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালে হবে না। ভোক্তার ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আছে। পর্যাপ্ত রয়েছে ছোলা, পামঅয়েল, সয়াবিনসহ অন্যান্য পণ্য। আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
জসিম উদ্দিন বলেন, এখন গরু ও পোলট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশীয় এ খাত বাঁচাতে এতদিন মাংস আমদানি বন্ধ ছিল। এখন তারা যদি সঠিক মূল্যে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগি দিতে না পারে তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, বাজার ঠিক রাখতে আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই।
এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যবসায়ীদের বলেন, এবার সরকার বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে কঠোরভাবে। কোনো বাজারে বেশি মূল্য রাখা হলেই সেই বাজার কমিটি বাতিল করবে সরকার। একই সঙ্গে দাম বেশি নেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে। আমরা চাই না, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হোক, কাউকে আটক করা হোক।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যাটি আমাদের জানাবেন। আমরা কথা বলব। আমাদের টিমও বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। আশা করব আপনারা কেউ বেশি মুনাফা করবেন না।
কয়েক দফা বাড়ার পর রমজানের প্রথম দিন কিছুটা কমেছে মুরগির দাম। শুক্রবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমনটা দেখা গেছে। এ ছাড়াও গতকাল শীর্ষ চার পোল্ট্রি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানকে তলব করে ভোক্তা অধিকার। পরে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় মুরগির দাম।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমে ২৪৫-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালির দাম ২০ টাকা কমে ৩৬০ টাকায়, আর দেশি মুরগি ৬৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম কমেছে। তারা জানান, আগের তুলনায় তাদের বিক্রি কমে গেছে। এ অবস্থায় দাম আরও কমতে পারে বলে জানান তারা।
আর ক্রেতারা বলছেন, এখনও তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে মুরগি ও ডিম।
এদিকে, বাজার তদারকিতে সকাল থেকে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রোজার প্রথম দিন শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযানে নামে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সকাল সাড়ে ১০টায় এ বাজারের কিচেন মার্কেটে অভিযান শুরু করেন সংস্থার সদস্যরা। অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। উপস্থিত আছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান আব্দুল জব্বার মণ্ডলসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা।
এর আগে, গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুরগির দাম সমন্বয়ের জন্য ডাকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেখানে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, 'মুরগির দাম ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না।'
ব্রাজিলের সমুদ্রতীরবর্তী শহর রিও ডি জেনেইরোর কাছে একটি অপরাধী চক্রের প্রধানের গ্রেপ্তারে অভিযানের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার রিও ডি জেনেইরোর উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সাও গনসালো শহরের শ্রমিকদের আবাসিক এলাকা সালগেইরোতে এ ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানায়। পুলিশের দাবি, নিহতরা সবাই সন্দেহভাজন অপরাধী।
ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য পারার মাদক-নেতা অভিযুক্ত লিওনার্দো কোস্তা আরাউজো সালগেইরোতে লুকিয়ে আছে- এমন খবরের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে আরাউজোও আছেন। পারার বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নিহতের ঘটনায় তার হাত আছে বলেও অভিযোগ।
পুলিশ জানিয়েছে, আরাউজোকে গ্রেপ্তারে বৃহস্পতিবার চালানো এই অভিযানে হেলিকপ্টার ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হয়।
রিও শহরের পুলিশ প্রায়ই এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে। শহরটির গভর্নর ক্লডিও কাস্টো সোশালে এক পোস্টে লেখেন, আমরা আমাদের এই শহরকে অন্য কোনো এলাকা থেকে আসা দুর্বৃত্তদের অভয়াশ্রম হতে দেব না।
এ ঘটনায় অপরাধী চক্রের স্থানীয় তিনজন সোর্সও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।