
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা আর বিশ্বাস বাড়াতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা ও গ্রেপ্তার এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী (ইন্দো-প্যাসিফিক) অ্যান-মেরি ট্রিভেলিয়ান। গতকাল রবিবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য অংশীদারত্ব’ শীর্ষক আলোচনায় এ পরামর্শ দেন তিনি।
অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা ট্রিভেলিয়ান বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করতে একে অপরের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের সহিংসতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সংসদীয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এটি করা গেলে সংবিধানের সঠিক মূল্যায়ন করা হবে।
একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারকে স্বাগত জানিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আশা করছি, নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন তাদের অঙ্গীকার রাখবে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান উল্লেখ করে ট্রিভেলিয়ান বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া। এ ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার জন্য যুক্তরাজ্যের অর্থায়ন অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
আলোচনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশের কৌশল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিকে কোনো সামরিক জোটের সঙ্গে নেই। বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক তথা অর্থনৈতিক আইপিসে থাকার বিষয়ে নীতিগতভাবে অটল সিদ্ধান্তে রয়েছে। এ সময় প্রতিমন্ত্রী আবারও ঢাকা ও লন্ডনের মধ্যে বিমান চালুর বিষয়ে ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক একটি চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে শাহরিয়ার আলম ও যুক্তরাজ্যের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন অ্যান-মেরি ট্রিভেলিয়ান।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর শাহরিয়ার আলম বলেন, এখন থেকে বাংলাদেশ ও ব্রিটেন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে কপ-২৬ ও কপ-২৭-এর সুপারিশ বাস্তবায়নে একসঙ্গে কাজ করবে। বিশেষ করে আমরা জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর পক্ষে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার বিষয়টি বাস্তবায়নে কাজ করব।
এর আগে সফররত ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমি তাকে (ট্রেভেলিয়ান) বলেছি যে, আমরা একটি গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচন চাই। আমরা এ ধরনের নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছি।
মোমেন বলেন, তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রীকে অবহিত করেছেন যে, সরকার একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে, যা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং যেকোনো নির্বাচন পরিচালনার জন্য অবাধে কাজ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বৈঠকে তারা মূলত রোহিঙ্গা সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন এবং যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রী সংকট সমাধানে ব্রিটিশ সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
নিরাপত্তা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাণিজ্য ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করতে গত শুক্রবার ঢাকায় আসেন ট্রেভেলিয়ান।
নভেম্বরের ১৩ তারিখে অ্যাডিলেডে পাকিস্তানকে হারিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর বিশ্বসেরার মুকুট মাথায় বাংলাদেশেই প্রথম বিশ ওভারের সংস্করণের সিরিজ খেলতে পা রাখা ইংল্যান্ডের। বিশ্বকাপ জয়টা ছিল ইংল্যান্ডের আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের প্রামাণ্য দলিল। অন্যদিকে একই আসরে শুধুই জিম্বাবুয়ে আর নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে জয় পাওয়াটা ছিল বাংলাদেশের জন্যও সতর্কবার্তা। মাস চারেকের ব্যবধানে দুই দলের পুরোই বিপ্রতীপ অবস্থান! দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের কাছে ৪ উইকেটের হার থেকে ইংল্যান্ড বুঝেছে যে স্পিনসহায়ক উইকেটে খেলার কৌশলটা আলাদা আর বাংলাদেশ পেয়েছে ঘরের মাঠে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হারানোর আত্মবিশ্বাস।
দুই দেশের টি-টোয়েন্টিতে সাফল্যের ব্যবধান এতটাই বেশি যে, কোনো তুলনাই চলে না। ইংল্যান্ড দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, তিনবারের ফাইনালিস্ট। অন্যদিকে বাংলাদেশ কখনো গ্রুপ পর্বই ডিঙ্গাতে পারেনি, এখন পর্যন্ত মূল পর্বে জয়ই মাত্র তিনটি। সেই ইংল্যান্ড দলকেই যখন বাংলাদেশ এক ম্যাচ হাতে রেখেই টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারিয়ে দেয়, তখন প্রেস বক্সে জনা পাঁচেক ব্রিটিশ সাংবাদিকের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। সংবাদ সম্মেলনে আসা জস বাটলার ও মেহেদী হাসান মিরাজের কাছে তাদের একটাই প্রশ্ন; ইংল্যান্ড কি খানিকটা হালকাভাবেই নিয়েছিল বাংলাদেশকে?
অবশ্য ম্যাচের পরিস্থিতি সেই আভাস দেয় না বরং জানান দেয় ইংল্যান্ড তাদের স্বভাবসুলভ ক্রিকেটটাই খেলতে চেয়েছিল। টস জিতে সাকিব বোলিং নেন, ইংল্যান্ড পাওয়ার প্লেতে ১ উইকেট হারিয়ে তোলে ৫০ রান। সপ্তম ওভারে সাকিব বোলিংয়ে এসে নিজের বলে নিজেই নেন ফিল সল্টের ক্যাচ। ঠিক পরের ওভারেই হাসান মাহমুদের দারুণ ইয়র্কারে বোল্ড বাটলার। ওয়ানডাউনে নামা মইন আলি মিরাজের বলে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন পরের ওভারেই। নিয়মিত উইকেট হারানোর এ চাপটা ধীর করে দেয় রানের চাকা, এ বৃত্ত থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।
ইংল্যান্ডের ইনিংসের মেরুদ-টা ভেঙেছেন মিরাজ; এক ওভারে দুই বলের ব্যবধানে তুলে নিয়েছেন স্যাম কারেন আর ক্রিস ওকসের উইকেট। দুজনই স্টাম্পড, লিটনের হাতে। পরের ওভারে মিরাজের শিকার ক্রিস জর্ডানও। ৪ ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়েছেন মিরাজ। সঙ্গে তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, সাকিব ও হাসান একটি করে উইকেট নিলে মাত্র ১১৭ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। মোস্তাফিজ ইনিংসের শেষ ওভারে নিজে উইকেট নিয়েছেন, লিটন দাসের সহায়তায় রানআউট করেছেন দুজন। লিটন আগে দুটি স্টাম্পিংও করেন।
জয়ের জন্য ১২০ বলে বাংলাদেশের চাই ১১৮ রান। এমন আপাত সহজ সমীকরণটাও কঠিন হয়ে গেল জোফরা আর্চারের সামনে। কাল বেশ জোরে বল করেছেন আর্চার, আফিফ হোসেনকে বোল্ড করেছেন যে ডেলিভারিতে তাতে বলের আঘাতে বেলস ছিটকে গিয়ে পড়েছে বাউন্ডারি লাইনের কাছে। লিটন ও রনি তালুকদার দুজনই আউট হয়েছেন ৯ রান করে, তৌহিদ হৃদয় করেন ১৭ রান। সাকিব নিজে আউট হয়েছেন তৃতীয় বলে, কোনো রান না করেই। ভরসা যে নাজমুল হোসেন শান্ত আর মিরাজ, ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সহঅধিনায়ক ও অধিনায়ক। তাদের ৩২ বলে ৪১ রানের জুটিটায় জয় নাগালের ভেতর আসে বাংলাদেশের। জয়ের খুব কাছে দলকে রেখে ২০ রানে আউট হয়ে যান মিরাজ, শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান আফিফ হোসেনও টিকতে পারেননি। শান্ত একটা দিক আগলে ছিলেন ঠিকই, তবে শেষটা ব্যাটসম্যান তাসকিনের। ক্রিস জর্ডানের করা ইনিংসের ১৯তম ওভারের চতুর্থ ও পঞ্চম বলে টানা দুই চার মেরে তাসকিন নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের জয়। তাতে ২-০-তে নিশ্চিত হয়েছে সিরিজও। এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হোয়াইটওয়াশ করাটাই যে মিস্টার হোয়াইট সিরিজে বাংলাদেশের লক্ষ্য, তা ঘোষণা করে দিয়েছেন ম্যাচসেরা মিরাজ, ‘আমরাই এখন ভালো দল। চেষ্টা থাকবে ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার।’
জয়ী দলটার নাম বাংলাদেশ হলেই সবাই খুশি আর সেই জয় যদি হয় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড কিংবা ইংল্যান্ডের মতো বড় দলের বিপক্ষে তখন জয়ের আনন্দ আরও বেড়ে যায়! কাল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ সংবাদ সম্মেলনে এসে বললেন বড় দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগই মেলে কালেভদ্রে, তাই তাদের হারানোর আনন্দটাও হয় বেশি।
ব্যাটে-বলে অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছেন মিরাজ, বল হাতে ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ের পর ব্যাট হাতেও গুরুত্বপূর্ণ ২০ রানের ইনিংস। সিরিজের প্রথম ম্যাচে চট্টগ্রামে একাদশের বাইরে থাকা মিরাজ কাল সুযোগ পেয়েই করেছেন বাজিমাত। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে ৭ উইকেট নেওয়া মিরাজকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ পেতে লেগে গেল আরও সাত বছর। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটাই টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ, মিরাজ খেললেন প্রথমবার এবং এবারও ম্যাচসেরা। এ অলরাউন্ডার বললেন, বড় দলের বিপক্ষে হারানোর কিছু নেই বলেই জয়ের আনন্দটা বেশি, ‘আলহামদুলিল্লাহ, এই প্রথম আমরা ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ জিতেছি, তাও টি-টোয়েন্টি। ওরা তো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলকে হারিয়ে নিজেদের কাছে খুব ভালো লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা, ওদের সঙ্গে আমাদের খেলা বেশি হয় না। খেলার তেমন সুযোগও পাই না। ২০ বছরে মনে হয় ১০টা টি-টোয়েন্টিও খেলিনি ওদের সঙ্গে (এখন পর্যন্ত ম্যাচ হয়েছে মোট তিনটি)। এটাই প্রথম সিরিজ ছিল। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া, যেহেতু আমরা সিরিজটা জিতেছি।’
চট্টগ্রামে আগের ম্যাচে একাদশে জায়গা হয়নি, ঢাকায় শামীম হোসেনকে বসিয়ে দলে নেওয়া হয় মিরাজকে। একাদশে জায়গা না পাওয়া ও ফেরা নিয়ে মিরাজ বললেন, ‘টিম ম্যানেজমেন্ট আমার ওপর ভরসা করে আমাকে এ ম্যাচে খেলিয়েছে। মনে করেছে, আমি এ ম্যাচে খেললে দলকে কিছু একটা দিতে পারব, বিশেষ করে এই উইকেটে। তারা যে আমাকে বিশ্বাস করেছিল, তার প্রতিদান দিতে পেরে নিজের কাছে খুবই ভালো লাগছে।’
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের পর ইংল্যান্ডও টি-টোয়েন্টিতে ধরাশায়ী বাংলাদেশের কাছে। এবারই প্রথম ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোনো সংস্করণের ক্রিকেটে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ, তাই মিরাজের আনন্দটা বেড়েছে বহুগুণে, ‘অবশ্যই প্রতিটি দেশের সঙ্গে জিতলে অনেক ভালো লাগে। নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন না নিউজিল্যান্ডকে হারালে, অস্ট্রেলিয়াকে হারালে ভালো লাগবে... অবশ্যই প্রতিটি দলকে হারালেই আমাদের অনুভূতি একইরকম থাকে। কারণ দিন শেষে, জিতছে কে? বাংলাদেশ। আমরা সবাই জিতেছি, এটা কিন্তু একটা আনন্দের বিষয়। আজকে দেখেন সবাই কিন্তু অনেক খুশি। আপনারা যারা আছেন খুশি, আমরা খুশি, ম্যানেজমেন্ট খুশি, সারা বাংলাদেশের মানুষ; সবাই খুশি। কারণ আমরা বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছি। আমরা যদি জিতি, বাংলাদেশই জেতে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জিতলে বাংলাদেশ জেতে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জিতলেও বাংলাদেশ জেতে। অবশ্যই বড় দলের সঙ্গে হলে আরও ভালো লাগে।’
বাংলাদেশের জয়ের উইকেটের ভূমিকার চেয়ে বাংলাদেশের বোলারদের ভালো বোলিংকেই বেশি কৃতিত্ব দিচ্ছেন মিরাজ, ‘ওরা (ইংল্যান্ড) কিন্তু শুরুটা খুব ভালো করেছিল। প্রথম ছয় ওভারে ৫০ রানে ১ উইকেট ছিল। সাকিব ভাই একটা ব্রেকথ্রু দিল, এপাশ থেকে হাসান মাহমুদ দিল। তারপর আমি টানা দুই উইকেট নিলাম। এটা ওদের মানসিকভাবে পিছিয়ে দিয়েছে। জুটি না হলে দলের জন্য রান তোলাটা কঠিন হয়ে যায়। ওরা এখানেই ভুল করেছে। ওরা যদি ভুল না করত, তাহলে ১৬০-এর বেশি রান হতো যেভাবে শুরুটা হয়েছিল। আমাদের বোলারদের অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে। আমাদের বোলাররা খুব ভালো করেছে। আপনি যতই বলেন, উইকেট খারাপ, খারাপ, অনেক টার্ন করছিল। কিন্তু এমন ছিল না যে খেলা যাচ্ছিল না। ওরা ভালো শুরু করেছিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের বোলাররা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
সিরিজ জয়ের পর মিরাজদের লক্ষ্য সিরিজে ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করা। সংবাদ সম্মেলনের শেষদিকে ব্রিটিশ এক সাংবাদিককে কথাটা শুনিয়ে দিয়েছেন মিরাজ, করেননি কোনো রাখঢাক। একই সঙ্গে বলেছেন, এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো দল। অতীত যাই বলুক, বর্তমান কিন্তু মিরাজেরই পক্ষে!
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সততার শক্তি, বস্তুনিষ্ঠতার প্রতিচ্ছবি আর দায়িত্বশীলতার প্রতীক হয়ে এগিয়ে যাবে দেশ রূপান্তর এমন প্রত্যাশা সুধীজনদের। সময়ের এই পাঠকপ্রিয় পত্রিকার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেন তারা। একই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পত্রিকাটি ভূমিকা রাখছে বলেও মন্তব্য করেন। গতকাল রবিবার রাজধানীর গুলশানের ‘ওয়েস্টিন’ হোটেলের বলরুমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে আনন্দঘন সন্ধ্যা।
পাঠকের ভালোবাসা ও আস্থায় দেশ রূপান্তর চার পেরিয়ে পাঁচ-এ পা রেখেছে। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাড়া দিয়ে এসেছিলেন সরকারের মন্ত্রী, সচিব, রাজনীতিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চিত্রতারকা, সংগীতশিল্পী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ নানা পেশার মানুষ। অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয় দেশ রূপান্তর পরিবার। অনুষ্ঠানের শুরুতে দেশ রূপান্তরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত অমিত হাবিবের ওপর একটি ভিডিও তথ্যচিত্র প্রচার করা হয়।
দেশ রূপান্তরের প্রধান প্রতিবেদক উম্মুল ওয়ারা সুইটি ও ডিজিটাল বিভাগের ইনচার্জ হাবিবুর রহমান পলাশের প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় এ মিলনমেলা শুধুই একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অতিথিদের একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে ভালোবাসার বন্ধন।
শুরু থেকেই মঞ্চে ছিলেন রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খাঁন মুকুল, কো-চেয়ারম্যান ও দেশ রূপান্তরের প্রকাশক মাহির আলী খাঁন রাতুল, রূপায়ণ গ্রুপের ডিরেক্টর রোকেয়া বেগম নাসিমা, বিজয়নগর উপজেলা চেয়ারম্যান নাছিমা মুকাই আলী, কুয়েত অ্যাম্বাসাডর গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান ওয়ালিদ মুকাই আলী, রূপায়ণ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নওরিন জাহান মিতুল, রূপায়ণ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাবরিনা রশীদ নোভা ও দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন। তারা আমন্ত্রিত অতিথিদের স্বাগত জানান এবং ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন।
‘দায়িত্বশীলদের দৈনিক’ এমন সেøাগান ধারণ করে ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে দেশ রূপান্তর। যখন কি না ছাপা পত্রিকা একরকম চ্যালেঞ্জের মুখে। অনলাইন পোর্টালে অবাধ তথ্যপ্রবাহ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাসছে ততক্ষণাৎ সংবাদ, ইউটিউবে চলছে নিউজের ভিডিও কনটেন্ট। এমন সময়ে ছাপা কাগজের পত্রিকা কতটুকু টিকবে এ নিয়ে ছিল শঙ্কাও। কিন্তু সব সংবাদ যে সংবাদ নয়, সংবাদ পরিবেশনে যে লাগে বস্তুনিষ্ঠতা, দায়িত্বশীলতা। এই প্রত্যয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে দেশ রূপান্তর। কিছুদিনের মধ্যে সব শঙ্কা ছাপিয়ে পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে পত্রিকাটি। দেশের অন্যতম শীর্ষ পত্রিকা হিসেবে সব শ্রেণির পাঠকের মন জয় করে। আর এর মূল কারিগর ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত অমিত হাবিব। তার আদর্শ ও চিন্তা অনুসরণ করে দেশ রূপান্তর এখনো এগিয়ে যাচ্ছে।
পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতা, নতুনত্ব, সব শ্রেণির পাঠকের রুচির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিদিন পাঠকের দোরগোড়ায় হাজির হয় দেশ রূপান্তর। পাঠকের কাছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের যে একপ্রকার খরা চলছে তা অনেকটাই পূরণ করে চলেছে দেশ রূপান্তর। গতকাল অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মুখেও ছিল এ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।
চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে মঞ্চে কেক কাটেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খাঁন মুকুল এ সময় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী, দেশ রূপান্তরের প্রকাশক ও রূপায়ণ গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুল, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খান, দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুনকে সঙ্গে নিয়ে কেক কাটেন।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি সাংবাদিকরা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করবে, নতুন প্রজন্মকে তুলে ধরবে। এককথায় দেশকে এগিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। দেশ রূপান্তরের কাছেও আমাদের সেই প্রত্যাশা রইল। এগিয়ে যাক দেশ রূপান্তর।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বস্তুনিষ্ঠ, ন্যায় ও সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে দেশ রূপান্তর বেশ জনপ্রিয় পত্রিকা হয়ে উঠছে। এমনভাবে তারা খবর প্রকাশ করে তাতে অচিরেই পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশ রূপান্তর একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। যখন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ছিলাম তখন বালিশ ওঠাতে কী পরিমাণ খরচ হয় এ পত্রিকায় এমন একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করেছিলাম। ৩৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর তাদের সবাইকে দুদকে পাঠানো হয়। এটি সম্ভব হয়েছিল শুধু দেশ রূপান্তরের জন্য। এতেই বোঝা যায় এই পত্রিকাটি কেমন।’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘বয়সে নবীন হলেও পরিপক্বতার জায়গায় বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে দেশ রূপান্তর। বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশন এবং দেশ ও জনগণের সমৃদ্ধি এবং কল্যাণের জন্য যে ভূমিকা রাখা দরকার তা দেশ রূপান্তর রাখবে সেই কামনা করি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘গণমাধ্যমের কাজ হলো সমাজের অসংগতিগুলো তুলে ধরে বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশ করা। সেই কাজটি নিরন্তর করে যাচ্ছে দেশ রূপান্তর। এখন যতই অনলাইন নিয়ে কথা উঠুক না কেন, প্রিন্ট মিডিয়ার গুরুত্ব মোটেও কমেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশকে ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব রয়েছে এবং সেটি যেন নেতিবাচক না হয় সেটিও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ দেশকে গড়ে তুলতে চাই। গণমাধ্যম সেখানে এই ব্র্যান্ডিংয়ের কাজটি করতে পারে।’
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দেশ রূপান্তর আলোড়ন তুলেছে। বর্তমানে পত্রিকাটি এখন আরও বেশি মসৃণ ও সুন্দর হচ্ছে। আমরা আশা করি পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং স্মার্ট বাংলাদেশের সঙ্গে থাকবে।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সাবেক কূটনীতিক ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সংবাদ পরিবেশেনের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পরিচয় দিচ্ছে দেশ রূপান্তর। খবরের পেছনের খবর তুলে ধরছে পত্রিকাটি। সংবাদ ছাড়াও পাঠকের যে নানারকম চাহিদা থাকে, সেটিও পূরণ করে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাচ্ছে দেশ রূপান্তর।’
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান দেশ রূপান্তরের অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ গ্রুপ, এর চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খাঁন মুকুলসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘রূপায়ণ গ্রুপ যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ায়, আমি দোয়া করি তারা আরও সামনে এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি দেশ রূপান্তর পত্রিকা আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।’
বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খান বলেন, ‘দেশ রূপান্তর অল্প সময়ের মধ্যে সুনামের সঙ্গে পাঠকের চাহিদা পূরণ করছে। আমরা আশা করি এ পত্রিকা মানুষের কথা বলবে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে থাকবে।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দেশ রূপান্তর পাঁচে পা রেখেছে এ কথাটি না বলে আমি বলতে চাই পাঁচে পাঁচ পেয়েছে। আশা করি তাদের পথচলা অব্যাহত থাকবে।’
বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি দেশ রূপান্তরের সার্বিক কল্যাণ কামনা করে বলেন, ‘আমি এ পত্রিকার সাফল্য কামনা করি।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘দেশ রূপান্তর একসময় সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে সেই প্রত্যাশা করি। সে জন্য সবাইকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র রক্ষায় পত্রিকাটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।’
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘পাঠকের কাছে সঠিক খবর পৌঁছে দিতে অবদান রাখছে দেশ রূপান্তর। আমি আশা করি ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাবে এ পত্রিকা।’
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমি শুধু এখানে এসেছি বর্তমানে যারা আপ্রাণ চেষ্টা করে মানসম্মত সাংবাদিকতা করে তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য। সেরকম একটি পত্রিকা হলো দেশ রূপান্তর। এই পত্রিকার প্রতিবেদন যখন দেখি তখন নিজেও উৎসাহবোধ করি।’
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘দেশ এখন রূপান্তরিত হচ্ছে। সেই রূপান্তরকে তুলে ধরবে দেশ রূপান্তর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ রূপান্তর দেশের কল্যাণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে, সেই প্রত্যাশা করি।’
দেশ রূপান্তরকে শুভেচ্ছা জানাতে এসে দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা ও গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে গত পাঁচ বছরে দেশ রূপান্তর যে অবস্থান তৈরি করেছে, তাতে ভবিষ্যতে এ পত্রিকাটি আরও বিস্মৃত ও আরও পাঠকপ্রিয় হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন সংগঠনের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক এজিএস সাদ্দাম হোসাইন। তিনি বলেন, ‘দেশ ও সমাজের উন্নয়নে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ এগিয়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় দেশ রূপান্তর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ও উন্নয়ন সাংবাদিকতার মাধ্যমে স্মার্ট বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করি।’
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ বলেন, ‘আজকের এ পরিবেশ দেখে আমি অভিভূত। দেশ রূপান্তরের সাফল্য কামনা করছি।’
দেশ রূপান্তরের প্রকাশক ও রূপায়ণ গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুল তার বক্তব্যের শুরুতেই দেশ রূপান্তরের পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, হকারসহ এর সঙ্গে যুক্ত সব সংবাদকর্মীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘বিগত চার বছরে আপনাদের আন্তরিকতার কারণে দেশ রূপান্তর এখন দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। দেশ রূপান্তর সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সততা নিয়ে কখনো আপস করেনি, অন্যায়ের কাছে মাথানত করেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশ রূপান্তরকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অমিত হাবিব। তার দেখানো পথ অনুসরণ করেই এ পত্রিকাটি এখনো পাঠক মহলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে।’ মাহির আলী খাঁন রাতুল বলেন, ‘বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপায়ণ গ্রুপ দেশ রূপান্তরের কোনো খবর এবং সংবাদকর্মীদের ওপর কোনোরকম খবরদারি করেনি। আমাদের প্রত্যাশা দেশ রূপান্তর আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।’
দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন বলেন, ‘ছাপা পত্রিকা টিকবে কি না এমন একটি চ্যালেঞ্জের সময়ে দেশ রূপান্তর প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অমিত হাবিবের মৃত্যুর পর সেই চ্যালেঞ্জটি আরও বেড়ে যায়। একটা কঠিন পরিস্থিতিতে আমাকে দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। অমিতদার শূন্যতা পূরণের চেষ্টা আমরা করছি। পাশাপাশি দেশ রূপান্তর পত্রিকাকে পাঠকমহলে আরও জনপ্রিয় করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হয় এর অনেকটাই পেরেছে দেশ রূপান্তর।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, গণমাধ্যমের জন্য একটি কঠিন সময় যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাপটের এ সময়ে কোনটা আসল খবর, কোনটা নয় এরকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতে হয়। তবে আমি বিশ্বাস করি, ছাপা পত্রিকাতে এখনো মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। আর সেই বিশ্বাসকে আরও সামনে নিতেই দেশ রূপান্তরের এ প্রচেষ্টা।’ এ সময় মোস্তফা মামুন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের ধন্যবাদ জানান।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন রূপায়ণ গ্রুপের উপদেষ্টা আবদুল গাফফার, রূপায়ণ গ্রুপের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর মেহেদী হাসান প্রমুখ।
দেশ রূপান্তরকে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতিক, আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম, ঢাকা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব নিপুণ রায় চৌধুরী, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক, দক্ষিণ বিএনপির প্রথম সদস্য প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া সেলের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার প্রমুখ।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক শুভেচ্ছা জানান ফুল দিয়ে।
শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দীন, ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন-অর-রশীদ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি মনজুর রহমান, উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহছান, গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার আবদুল আহাদ, র্যাবের মহাপরিচালকের পক্ষে মেজর আবদুল হাদি প্রমুখ।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে দেশ রূপান্তরকে শুভেচ্ছা জানান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বিশ্বজিত চন্দ, ইউজিসির পরিচালক শামসুল আরেফিন, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল আজিজ, ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফুল বারী মজুমদার, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি জনসংযোগ সমিতির সভাপতি মনিরুল ইসলাম রিন্টু, সাধারণ সম্পাদক আবু সাদাত। আরও এসেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন এইচআরপিবির সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এএম জামিউল হক ফয়সাল। এ ছাড়া সাবেক ফুটবল খেলোয়াড় কায়সার হামিদ, জনিসহ অন্যান্যরা এসেছিলেন শুভেচ্ছা জানাতে।
অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, ডিপিডিসির প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল আলিম, এলজিইডির প্রকল্প পরিচালক মাহবুব ইমাম মোরশেদ, প্রমি এগ্রো ফুডস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এনামুল হাসান খান, উপব্যবস্থাপক আমির হোসেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের সাউথ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সাল, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান আবু মিয়া আকন্দ তুহিন, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির পরিচালক মোহাম্মদ ইমতিয়াজ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ব্র্যান্ড মার্কেটিং ও কমিউনিকেশনসের প্রধান মোহাম্মদ তারেক উদ্দীন, দি ইবনে সিনহা ট্রাস্টের সহকারী ব্যবস্থাপক আল ইমরান, প্রবাসী পল্লী গ্রুপের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান শিকদার এম আরিফুল ইসলাম, হামদর্দ পাবলিক কলেজের অধ্যক্ষ, বিটিসিএলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী তাহেরুল ইসলাম, পারটেক্স গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. নাহিদ ইউসুফ, কনকর্ড গ্রুপের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. জামাল উদ্দীন ভূঁইয়া প্রমুখ।
শোবিজ তারকাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নুসরাত ফারিয়া, ফাহমিদা নবী, আজিজুল হাকিম, নিপুণ আক্তার, আঁখি আলমগীর, বাপ্পি চৌধুরী, সাইমন সাদিক, রোশান, দেবাশিষ বিশ্বাস, এস ডি রুবেল, নাদের চৌধুরী, নিরব, স্পর্শিয়া, বেলাল খান, পুতুল, বুলবুল টুম্পা, ফারিয়া শাহরিন, বিপ্লব সাহা, আবদুল আজিজ, সৈকত নাসির প্রমুখ।
মিথ্যা তথ্য দিয়ে অথবা কাগজপত্র জাল করে ব্যাংকিং চ্যানেলে এবং হুন্ডিতে নিজেরা অর্থ পাচার করেছে। অন্যকেও একইভাবে অর্থ পাচার করতে সহযোগিতা করেছে। অর্থ পাচারে জড়িত এমন নতুন ৫২৮ ব্যক্তির নামের তালিকা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ইতিমধ্যে শতাধিক ব্যক্তির বিষয়ে তথ্য তালাশের কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দেশ রূপান্তরকে জানায়, হুন্ডিতে মানি এক্সেচেঞ্জারের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। অন্যদিকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী, তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানির মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থের একাংশ দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকের চালান আনা হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার কুরিয়ার সার্ভিস, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ইমিগ্রেশনের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অর্থ পাচার করেছে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। অন্যদিকে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচারে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পাচারকারীদের সহযোগিতা করেছেন ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বেশির ভাগ অর্থ পাচার হয়েছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, চীন, তাইওয়ান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, কানাডা, নেপালসহ আরও কয়েকটি দেশে।
পুলিশ সূত্র জানায়, অর্থ পাচারে জড়িত এসব ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সিআইডি আলাদাভাবে তদন্ত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনও তৎপর। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), ট্রান্সফারপ্রাইসিং সেল এবং ট্যাক্সেস অ্যান্ড লিগ্যাল এনফোর্সমেন্ট শাখার কর্মকর্তারা অর্থ পাচার রোধে একযোগে কাজ করছে।
অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশে যারা অর্থ পাচার করছে, তাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করেছে। তালিকা নিয়ে কাজ চলছে।’
সিআইডির প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) মোহাম্মদ আলী মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইতিমধ্যে মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত কাউকে কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কয়েক শ ঘটনার তদন্ত চলছে। আবার কারও কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে পুলিশের বিশেষ ইউনিট সিআইডি ইতিমধ্যে অর্থ পাচারে জড়িত ৫২৮ জনের নামের তালিকা করেছে। তাদের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলের লোকই বেশি। এর আগে পুলিশের আরেকটি সংস্থা অর্থ পাচারকারী শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা দুদকে পাঠিয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছেন অনেকেই। এ জন্য একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় ৫২৮ জনের নাম উঠে এসেছে। তাদের আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। প্রয়োজনে তাদের ধরতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হবে। অনেকে বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, রেস্তোরাঁ, দোকান বা অন্য সম্পদ কিনেছেন। অবশ্য তালিকার কারও নাম জানাতে অনীহা প্রকাশ করেন তিনি।
অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে পাচার : অর্থ পাচারকারীদের নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে সহযোগিতা করে থাকে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিটি মানি এক্সচেঞ্জার যে দেশে অর্থ পাঠায়, সেই দেশে নিজস্ব প্রতিনিধি রাখে। প্রতিনিধি বাংলাদেশি বা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক হতে পারে। এ দেশ থেকে অনলাইন, ওয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, টেলিগ্রামে সাংকেতিকভাবে যোগাযোগ করে অর্থ পাঠানো হয়। রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরে এমন এক হাজারের বেশি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর বেশিও হতে পারে বলে ধারণা সিআইডির। সম্প্রতি সিআইডির অভিযানে অবৈধ পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জের মধ্যে তিনটির কার্যালয় পাওয়া গেছে। এই অভিযানে ১৪ ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। যে দুটির কার্যালয় পাওয়া যায়নি সেগুলো ‘প্রতারণামূলক বা ফেরারি’ বলে উল্লেখ করেছে সিআইডি। সংস্থাটি জানায়, তারা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মানি এক্সচেঞ্জ করেছে। ফোনে ফোনে যোগাযোগ করেও তারা বিভিন্ন দেশের মুদ্রা লেনদেন করেছে। এ ছাড়া তারা হুন্ডিতে অর্থ পাচার করেছে।
সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন ৭৫০ কোটি টাকা সমমূল্যের অর্থ লেনদেন হচ্ছে। এ হিসাবে সংখ্যাটি মাসে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৫০০ কোটি। এই পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে বলেই ধারণা সংস্থাটির।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, দেশে অনুমোদিত মানি একচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান দুই শর বেশি। বিএফআইইউর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে মানি এক্সচেঞ্জ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে সিআইডি।
মিথ্যা ঘোষণায় অর্থ পাচার : বাস্তবে অস্তিত্ব নেই অথচ কাগজে-কলমে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানির নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার করা হয়েছে। তবে পাচার করা অর্থের একাংশ দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকের চালান এনে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের নাম ব্যবহার করেও অর্থ পাচার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আমাদানিকালে কোকেনের বড় চালান আটকের নজির রয়েছে।
এনবিআরের সদস্য এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য আমদানি করা হচ্ছে কি না, তা কঠোরভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মিথ্যা ঘোষণায় আনা অনেক চালান আটক করা হয়েছে। জড়িত অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জড়িত অন্যদেরও আটকের চেষ্টা চলছে।
অর্থ পাচারে জড়িত নতুন করে যে ৫২৮ ব্যক্তির তালিকা করা হয়েছে, তাদের অনেকে জাল কাগজপত্র তৈরি করে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খোলে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিথ্যা তথ্যে অর্থ পাচারের পুরো বিষয়টি করে থাকে। এরাই বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করানো থেকে ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে থাকে। এর বেশির ভাগ কাজের প্রস্তাব এনে দেয় অন্য কেউ। এই ওপরের ব্যক্তিটি কে, তা তালিকার ব্যক্তিরা অনেক সময় জানে না। তবে সরাসরিও অনেক কাজের প্রস্তাব আসে।
অর্থ পাচার রোধে ২০০২ সালে প্রথম মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। এই আইনে ২৭ ধরনের অপরাধ করলে তা আমলে নেবে তদন্তকারী সংস্থা। পুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন, এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত করে।
পুলিশের বিশেষ ইউনিট সিআইডি আট বছরে ২৪৭টি মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা তদন্ত করেছে। মামলা করেছে ৪৭৭টি।
পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস ফাঁস হলে অর্থ পাচারে জড়িত অভিযোগে দেশের প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তিসহ ৬৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে তদন্ত শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) ২০২০ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়।
পাচার করা অর্থে কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে তোলার তথ্যও আসে সংবাদমাধ্যমে। গত বছর সরকার কর দিয়ে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ দেয়। বাংলাদেশের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে কানাডা, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীন, ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের দ্বৈত কর চুক্তি হয়েছে। এতে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে ওই সব দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সহযোগিতা মিলবে।
সিআইডির এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট টেকনাফের ইয়াবা কারবারি নূরুল ইসলাম ভুট্টু, সৈয়দ আলম, নূরুল আলম নামের তিন শীর্ষ ইয়াবা কারবারি এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে তিনটি মানি লন্ডারিং মামলা হয়। এগুলোই দেশে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রথম মানি লন্ডারিং মামলা। এর মধ্যে ভুট্টু ও তার ৪৩ সহযোগীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু মামলা আছে তদন্ত করতে গিয়ে নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় প্রভাবশালীরা তদন্ত বাধাগ্রস্ত করে।
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, অর্থ পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আইনের প্রয়োগ এবং কঠোর নজরদারি ছাড়া এটা কমানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন কৌশলে অর্থ পাচার হচ্ছে। হুন্ডিতে পাচারকারীরা আন্তর্জাতিকভাবে সংঘবদ্ধ।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) আট দেশের কূটনীতিকদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি। গতকাল রবিবার সকাল ১০টায় গুলশান-২-এ ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির বাসায় দেড় ঘণ্টা বৈঠক শেষে এ কথা জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিএনপি গঠিত পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খসরু বলেন, ‘দেশের বর্তমান অবস্থা ও নির্বাচনের বিষয়ে দেশের মানুষ যেভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো একইভাবে নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এরই অংশ হিসেবে ইইউ দেখছে, বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক অবস্থা কী? মানবাধিকার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেমন। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা কাজ করছে দেশের ভেতরে, দেশের বাইরে সেটার ওপর তো তাদের স্বাভাবিকভাবে একটা দৃষ্টি আছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আজকে এই বৈঠক।’
আমীর খসরু বলেন, ‘বাংলাদেশে যে নির্বাচনী ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে, এখানে যে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে একটা অবৈধ সরকার ক্ষমতায় বসে আছে। এই প্রেক্ষাপটেই তো আলোচনা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপট থাকার কারণেই তো এসব আলোচনা চলছে। আগামী নির্বাচনে যদি দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে তাহলে বাংলাদেশ যে সংকটের দিকে যাবে এই শঙ্কা তো দেশের ভেতরে যেভাবে কাজ করছে, দেশের বাইরেও কাজ করছে। এই শঙ্কা থেকেই তারা জানতে চেয়েছেন যে, কীভাবে আগামী নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে, কীভাবে এটাকে নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক করা যায়। সবার উদ্দেশ্য একটাই বাংলাদেশের মানুষের যে চিন্তা যে এটাকে নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যার মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ হবে, নির্বাচিত সরকার হবে।’
‘নির্বাচনের বিষয়ে দলের অবস্থান কি আপনারা পরিষ্কার করেছেন কি না?’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই এ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, সেটা আমরা খোলাখুলিভাবে বলেছি।’ বিষয়গুলো নিয়ে ইইউ কী মনে করে জানতে চাইলে খসরু বলেন, ‘তারা কী মনে করেন সেটা তারাই বলতে পারবে।’
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বিষয় নিয়ে আলোচনায় উঠেছে কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ইস্যু নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’
বৈঠকে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির নেতৃত্বে ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, জার্মানি, স্পেন, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতরা অংশ নেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। প্রতিনিধিদলে আমীর খসরু ছাড়াও অংশ নেন সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও মানবাধিকার-বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান।
সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় গণমিছিলের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যুগপৎ কর্মসূচি শুরু হয়। ইতোমধ্যে জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় শহরে সমাবেশ, পদযাত্রা, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সবশেষ গত শনিবার মানববন্ধন করেছে দলটি। আগামী ১৮ মার্চ সারা দেশে মহানগর পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোজার মাসে খাবারের জন্য শরীফুল আলমের বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, মাছ কিনলে মুরগি কেনা যায় না, মুরগি কিনলে মাছ বাদ দিতে হয়। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, তাই সে দোকানে নজরই দেননি তিনি। পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিনই তার পরিবারকে মাছ-মাংসের মতো প্রোটিন খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আর ইফতারিতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি আগেই নিয়েছেন। শুধু শরিফুলই নন, বাজার করতে আসা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।
গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। প্রায় একই হারে বেড়েছে পাকিস্তানি ককসহ অন্যান্য মুরগির দাম। সব ধরনের মাছের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
একটু সাধারণ হিসাব করা যাক। চারজনের একটি পরিবার যদি মাছ, মাংস বাদ দিয়ে সাহরিতে গড়ে ২০০ টাকা, সন্ধ্যা রাতের খাবারে যদি গড়ে ১৫০ টাকা আর ইফতারিতে ফল যোগ না করে গড়ে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন তবে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি মাছ-মাংস যোগ হয় তাহলে সাহরিতে ন্যূনতম ৩০০, রাতের খাবারে ৩০০ ও ইফতারিতে ফল যোগ করলে গড়ে ২০০ টাকা খরচ করলে মাসে খরচ হবে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ হিসাব চারজনের একটি পরিবারের সর্বনিম্ন হিসাব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত অক্টোবরের হিসাবে বলা হয়েছে, চারজনের একটি পরিবারে খাবার তালিকায় মাছ-মাংস যোগ করলে মাসে খরচ হবে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি শুধু খাবারের খরচ। যদি কোনো পরিবার মাছ-মাংস যোগ না করেন তাতে মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
সিপিডির গবেষণা সেলের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। পরিবারপ্রতি এ মাসে খরচ আরও বেড়ে গেছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে সেখানে সবাই উপকৃত হবে।
সিপিডির অক্টোবরের হিসাবই যদি ধরা হয়, তাহলে এবারের রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করা ছাড়া উপায় নেই ভোক্তাদের। ২২ হাজার টাকার সঙ্গে যদি বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাড়াসহ গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার টাকা।
অবশ্য সিপিডির এ তথ্য যখন প্রকাশ করা হয়, তখন মুরগির মাংসের কেজি ছিল ১৫০ টাকা, এখন তা ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, এখন তা ৭৫০ টাকায়। চিনির দাম ছিল ৯৮ টাকায় এখন তা ১২২ টাকায়। অর্থাৎ সব পণ্যেরই দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার। বেসরকারি স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। থাকেন ৩ কামরা একটি ফ্ল্যাটে। তার মাসিক খরচ ৩১-৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু মাত্র বাসা ভাড়ায় খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের পড়া ও পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচ হয় আরও ১৩-১৫ হাজার টাকা। বাদ বাকি খরচ আরও ২ হাজার। তবে এই শিক্ষক মাসে আয় করেন ২৮-৩০ হাজার টাকা। মাসিক আয় হিসেবে তার অতিরিক্ত খরচ হয় ২-৩ হাজার টাকা।
এ শিক্ষক খরচের সমন্বয় করতে সঞ্চয়ও ভেঙেছেন ইতিমধ্যে। তাতেও তার বাড়তি খরচের টাকা প্রতি মাসে ঋণের খাতায় যোগ হয়। উপায়ান্তর না দেখে পরিচয় গোপন করে মাঝেমধ্যে রাইড শেয়ার দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম মহাখালীতে। ভাবলাম একই সঙ্গে রোজার বাজার করে বাসাই ফিরি। তবে বাজারে প্রবেশ করে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ১ কেজি করে মুরগি, মাছ ও ছোলাসহ আরও দুএকটি পণ্য কিনতেই ১ হাজার টাকা শেষ। দামের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে চাহিদা মতো বাকি সদাইগুলো বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আর নয়তো অর্ধেকের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শুধু স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিনই নন, গেল কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মান ভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্য যে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও বলছেন। গত বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি মার্চে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুদের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি।
বিবিএসের চিত্রেই আবার ফেরা যাক। গত বছর চিনির কেজি ছিল ৮২ টাকা, সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। যদিও বাজারের চিত্র ব্যতিক্রম। গরুর মাংস গত বছরের মার্চে কেজি ছিল ৬১০ টাকা, কিন্তু বছর ঘুরতেই এ পণ্যের দাম এখন ৭৫০ টাকা। মানুষ বেশি দামে গরুর মাংস কিনতে না পেরে কিছুদিন আগেও ভরসা করত ব্রয়লার মুরগির ওপর, যার দাম এখন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে।
রমজানের ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে ফলের ওপর। কিন্তু সেই ফলের দামও লাগামছাড়া। ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ফলের ওপর শুল্কারোপ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম অনেক বেশি।
সাহরিতে রোজাদারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপাদান দুধ। গত বছরের মার্চে দুধের লিটার কিনতে হয়েছিল ৭০ টাকায়, এ বছর তা ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি বলেন, রমজানের ভোক্তা পর্যায়ে ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। মাঠ পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু পুরোপুরি না। সম্পূর্ণ দায় এ যুদ্ধের ওপর চাপানো ঠিক না। ভোক্তাদের দায় বেড়েছে, তাদের ওপর চাপও বেড়েছে।
জনগণের জানার অধিকার রয়েছে কাকে কোনো প্রকল্পের কাজ দেওয়া হচ্ছে, কার সঙ্গে কী চুক্তি হচ্ছে এবং তা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির কোনো কিছুই প্রকাশ করা হচ্ছে না। অদক্ষভাবে বিদ্যুৎ চুক্তির কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি)।
গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে আয়োজিত ‘নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ (খসড়া) : এটি কি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কোনো একটি পক্ষকে সুবিধা দিয়ে কাজ দেওয়ায় দুর্নীতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বিদ্যুতের বড় ঘাটতি মেটাতে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের প্রয়োজন ছিল। তবে বর্তমানে আইনটি অদক্ষতার জায়গা তৈরি করছে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটির মতে, জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের ফলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। কোনো কোনো পক্ষ পাচ্ছে বাড়তি সুবিধাও। অবিলম্বে আইনটি বাতিল করার দাবি জানিয়ে সিপিডি বলছে, নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে- এমন চুক্তিতে গেলে বাড়তি ভর্তুকির চাপ থেকে সরকার সরে আসতে পারবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০০৯ সালে জরুরি বিদ্যুৎ আইনের প্রয়োজন ছিল। ওই সময় বড় রকমের বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, সেটা মেটানোর জন্য চুক্তির দরকার ছিল। এরপর চারবার নবায়ন হয়েছে ওই আইন। আমরা মনে করি, এখন যে জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এরকম চুক্তির আর প্রয়োজন নেই।
দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আইন থেকে সরকারের সরে আসা দরকার। এই আইন বিভিন্নভাবে সমস্যা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর আগেও যেগুলো হয়েছে- সেগুলো এখন সরকারের জন্য বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ। এর মূল কারণ এই দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন।
সিপিডির এ গবেষণা পরিচালক বলেন, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি সমন্বয় নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কাজ করছে সরকার। বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির সমন্বয় করা হচ্ছে ভোক্তার ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে। ভুল পলিসির কারণে এমনটি হচ্ছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে ব্যাপক হারে। সেটির দায় ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনটি যদি অবলোপন করে নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে- চুক্তির দিকে যদি যাওয়া যায়, তাহলে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বাড়তি ভর্তুকির চাপ থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে। ফসিল ফুয়েল থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে গেলে বড় রকমের ভর্তুকির চাপ থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা শুনে এসেছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের মূল্য সবচেয়ে কম। অথচ নতুন চুক্তির অধীনে আমরা যে ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আনা শুরু করলাম, সেটার মূল্য তো ১৫ টাকা। এটা তো বোধগম্য না কী করে এরকম মূল্য, এরকম জায়গায় আমরা চুক্তি করতে পারি।
জ্বালানি চুক্তি খোলামেলা হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো চুক্তির ডকুমেন্টস আমরা পাই না। কী রেটে চুক্তিগুলো করা হচ্ছে- জনগণের সেটা জানার অধিকার রয়েছে।
নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ এর খুঁটিনাটি তুলে ধরে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এতে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেসব চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো কতটা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে করা হচ্ছে, তা আলোচনা হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি আহরণ, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ২০০৮ সালে গৃহীত পলিসির আওতায় সামগ্রিক উৎপাদনের ৮ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এটা পলিসির ব্যর্থতা।
তিনি আরও বলেন, নতুন নীতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসের কথা বলা হয়েছে। শুধু সোলার বলেই ছেড়ে দেওয়া হয়নি। রুফটফ সোলার, নেট মিটারিং, মিনি গ্রিড, ন্যানো গ্রিড, সোলার ইরিগেশন, চার্জিং স্টেশন, স্ট্রিট লাইটে রিনিউয়েবল এনার্জি, ফ্লোটিং সোলার সিস্টেম- এরকমভাবে ডিটেইল বলা আছে। একইভাবে উইন্ড এনার্জি, বায়োমাস এনার্জি, বায়ো ফুয়েলের কথা বলা হয়েছে। রিনিউয়েবল এনার্জির কিছু নতুন উৎসের কথাও এখানে বলা হয়েছে। এর ভিত্তিতে আগামীতে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথা বলা হয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। এতে কিছু টার্গেটের কথা বলা হয়েছে। রিনিউয়েবল এনার্জির ক্ষেত্রে কিছু টার্গেট দেওয়া হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কথা এতে উল্লেখ রয়েছে জানিয়ে এই গবেষণা পরিচালক বলেন, স্রেডাকে এখানে নোডাল এজেন্সি বলা হয়েছে। আমরাও তাই মনে করি। কিন্তু স্রেডাকে সব ধরনের ক্যাপাসিটি দিতে হবে। বড় পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রস্তাবনা দেখভাল করার ও অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা স্রেডাকে দেওয়া উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার দরকার আছে। তবে এই সংস্কার আবার খসড়া প্রস্তাবে অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, নুতন নীতিতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের আবার নীতি সংস্কার হয়েছে। মন্ত্রণালয় তার হাতে কর্তৃত্ব নিয়ে ফেলছে। এর ফলে রেগুলেটরি কমিশনের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানি নীতিতে যে গাইডলাইন দেওয়া আছে, আর সরকার এখন যেভাবে দাম নির্ধারণ করেছে, তাতে এটা এখন উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করছে।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি পলিসি-২০২২ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান বিদ্যুৎ খাতে যে সংকট রয়েছে তা অনেকটাই কমে যাবে।
সিন্ডিকেশন করে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে মাত্র ৫২ দিনে বড় উৎপাদকদের একটি চক্র ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের অন্য একটি সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ করে। এদিকে মুরগির দাম নিয়ে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। অন্য এক মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম না কমালে তা তারা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবেন। রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম কমল ৪০ টাকা : ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ উৎপাদনকারী ফার্মগুলো নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোজার মাসে ভোক্তা পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খামারি পর্যায়ে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যা গেল কয়েক সপ্তাহে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছে। হাতবদল হয়ে এসব মুরগি ভোক্তাপর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়।
‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত এই চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কনফারেন্স কক্ষে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, গতকাল আমরা ২৭০-২৮০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখেছি। এ দাম অযৌক্তিক। এটা ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না। ফার্ম পর্যায়ে ২২০-২৩০ টাকা দরে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাতবদল হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে এ অবস্থা। ব্রয়লার মুরগি এসএমএসের মাধ্যমে নিলাম হচ্ছে। আমি তাদের আহ্বান করেছি, আপনারা এ রমজান মাসে একটু কম লাভ করেন। তারা একমত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খামার থেকে আসা ব্রয়লার মুরগি হাতবদলে যেন দাম খুব বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে সংস্থাটি নজর রাখবে। ব্রয়লারের দাম কমাতে প্রয়োজনে বর্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সময় কাজী ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানান, তারা রমজানে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ব্রয়লার বিক্রি করবেন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করছে আফতাব, প্যারাগন ও সিপি কোম্পানি।
রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে : মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আগামী দুই-তিন মাসের জন্য মুরগি ও গরুর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবে সংগঠনটি। গতকাল এফবিসিসিআই বোর্ডরুমে ‘রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায়’ এ কথা জানানো হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ ও কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালে হবে না। ভোক্তার ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আছে। পর্যাপ্ত রয়েছে ছোলা, পামঅয়েল, সয়াবিনসহ অন্যান্য পণ্য। আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
জসিম উদ্দিন বলেন, এখন গরু ও পোলট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশীয় এ খাত বাঁচাতে এতদিন মাংস আমদানি বন্ধ ছিল। এখন তারা যদি সঠিক মূল্যে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগি দিতে না পারে তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, বাজার ঠিক রাখতে আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই।
এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যবসায়ীদের বলেন, এবার সরকার বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে কঠোরভাবে। কোনো বাজারে বেশি মূল্য রাখা হলেই সেই বাজার কমিটি বাতিল করবে সরকার। একই সঙ্গে দাম বেশি নেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে। আমরা চাই না, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হোক, কাউকে আটক করা হোক।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যাটি আমাদের জানাবেন। আমরা কথা বলব। আমাদের টিমও বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। আশা করব আপনারা কেউ বেশি মুনাফা করবেন না।
সকাল
‘বড় ভাই, গাবতলী কোন দিকে?’ কিছুটা দৌড়ে এসে জানতে চায় এক ছেলে। হাতের ইশারায় বাম দিকের রাস্তা দেখিয়ে বলি, ‘এখান থেকেই বাসে উঠতে হবে।’ ছেলেটি ফের জানতে চায়, ‘আমার কাছে টাকা নাই। গাবতলীতে হাঁইটা যাইতে কতক্ষণ লাগবে?’ বলি, ‘সে তো অনেক টাইম লাগবে। ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই।’
ছেলেটি সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। তারপর দেখানো রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। তার পায়ের দিকে আমার চোখ যায়। দুটি পা-ই খালি। ডান পায়ের তালু আবার গামছার কিছু অংশ দিয়ে বাঁধা। মনে হচ্ছে সেখানে কোনো ঘা রয়েছে বা কেটে গেছে। পরনে পুরনো একটা জিন্সের প্যান্ট; নিচের দিকটা ছেঁড়া ও কাদামাখা। গায়ে চেক ফুলশার্ট। মুখভরা ব্রণ। গোঁফ গজাচ্ছে। হাতে একটি লুঙ্গি!
আমি বলি, ‘এখানে ওয়েট করো, বিআরটিসি বাস এলে উঠে পড়বে। বলবে, টাকা নাই!’ ছেলেটি বলে, ‘আরে নাহ। টাকা না থাকলে ম্যালা কথা শুনতে হবে।’ সে গায়ে চাদর জড়ানোর মতো করে লুঙ্গিটি জড়িয়ে হাঁটতে থাকে। আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে। ইসিবি-চত্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে বসুমতী কিংবা রবরব পরিবহনে গাবতলীর ভাড়া ৩০ টাকা। বিআরটিসিতে ১০ টাকাতেই হবে। ছেলেটিকে কি আমি টাকাটা দেব? তাকে কি থামতে বলব? আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। ছেলেটি হেঁটে চলছে তো চলছেই! আমার বাস চলে আসে।
বিকেল
রঙিন কাগজে মোড়ানো প্যাকেট হাতে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা অ্যাপ্রন পরা মেয়েটি এসে তার পাশেই দাঁড়ায়। ইসিবি-চত্বরে পৌঁছামাত্র বৃষ্টি ধরে ফেলে আমাকে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটি দোকানের সামনে আশ্রয় নিই। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন।
কিছুক্ষণ পর কানে এলো একটি শব্দ। কীসের শব্দ? গাড়ির হর্ন, রিকশার বেল আর বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে যেটি আমাদের কানে এলোÑ গ্লাস ভাঙার শব্দ। ডান পাশে তাকাতেই দেখি ফুটপাতে একটি অর্ধেক লাল রঙের ভাঙা মগ পড়ে আছে, যেখানটায় সাদা অ্যাপ্রন পরা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সবার চোখ সেদিকে চলে যায়। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে মেয়েটির চেহারা দেখা যায় না। ছেলেটির চেহারা দেখা যাচ্ছে।
শুনতে পেলাম মেয়েটি বলছে, ‘আর কক্ষনো গিফট দিবা না। ছেলেটি বৃষ্টিতে ভিজছে; মেয়েটি ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে। ছেলেটি একেবারে চুপ, মুখটা মলিন।
‘বুঝলা?’ এবার মেয়েটির গলা বেশ চড়া; ধমকের সুর। ততক্ষণে ছেলেটি ফুটপাতে বসে পড়েছে। বৃষ্টির পানি আর তার চোখের পানি একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই দেখছি। ছেলেটি আর মেয়েটিও আমাদের দেখছে। কোনো শব্দ নেই। মেয়েটি অকারণে দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেটিও অকারণে বসে আছে। এ দৃশ্যের যেন সমাপ্তি নেই!
ছেলেটি মেয়েটিকে পছন্দ করে; মেয়েটি করে না। গিফট ছুড়ে দিয়েই মেয়েটির হাঁটা দেওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। কৌতূহল বাড়ছে আমাদের।
যাব যমুনা ফিউচার পার্কে। বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তা পার হয়ে ইসিবি-চত্বরের ডান পাশে গিয়ে দাঁড়াই। জাবালে নূর কিংবা আকিক পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছি আর ওই মেয়ে আর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছি। মিনিট দশেক পর দেখি, মেয়েটি চলে যাচ্ছে মাটিকাটা বাজারের দিকে। কিন্তু ছেলেটি সেখানেই বসে আছে।
আমি ছেলেটির কথা ভাবছি। ভাবছি বৃষ্টির কথাও। কী দারুণ কম্বিনেশন! হয়তো কিছুক্ষণ পর ছেলেটি উঠে চলে যাবে।
জাবালে নূর চলে এসেছে। আমি উঠতে যাব, ঠিক তখনই দেখি মেয়েটি ফিরে আসছে ছেলেটির দিকে। বাসে আর ওঠা হয় না আমার। শেষ দৃশ্য দেখার জন্য বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকি।
মেয়েটি বেশ দূরে চলে গিয়েছিল; কিন্তু ফিরল কেন? আমার হিসাব মেলে না। মেয়েটি ছেলেটির পায়ের কাছে পড়ে থাকা অর্ধেক ভাঙা মগটি তুলে নিল। ভাবলাম, রাগ কমেছে। ছেলেটির এভাবে বসে থাকা ওর মনে দাগ কেটেছে। কিন্তু নাহ। মেয়েটি অর্ধেক ভাঙা মগটি আবারও ছুড়ে ফেলে দিল ফুটপাতে। এবার মগটি টুকরো টুকরো হয়ে গেল। লাল রঙের মগটির টুকরো অংশগুলো দেখে মনে হলো, ছেলেটির হৃদয়টাও টুকরো হয়ে ফুটপাতে পড়ে গেল। আমি বাসে উঠে পড়ি।
সন্ধ্যা
সন্ধ্যা ৭টা। সাত-আট বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইসিবি-চত্বরের একটি দোকানের সামনে। আমাকে দেখেই কী যেন বলে। আমি বুঝতে পারি না। পরের কথাটা ঠিকই বুঝতে পারি। সে আইসক্রিম খাবে। আমাকে বলে, ‘একটা আইচকিরিম কিনে দিবেন?’
আমি মানিকদি এলাকার দিকে যাব। রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। রিকশা, বাইক, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক যাচ্ছেই। কোনো বিরাম নেই। মেয়েটিকে বলি, ‘তোদের বাসা কোথায়?’ মেয়েটি উত্তর না দিয়ে কয়েক বিল্ডিং পরের একটি বাসা দেখিয়ে বলে, ‘আমার মায় ওই বাসায় কাজ করে।’
রাস্তাঘাটে প্রায়ই সাত-আট বছরের ছেলেমেয়েদের আবদারের পাল্লায় পড়তে হয়। কখনো প্রশ্রয় দিই, আবার কখনো এড়িয়ে যাই। আজকেও বিষয়টি এড়িয়ে রাস্তা পার হতে যাব এমন সময় অজান্তেই পেছন ফিরে তাকাই। দেখি, মেয়েটিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। পারি না। তবে মনে হলো ওর চোখ কী যেন বলতে চায়। আমার পা থেমে যায়। বলি, ‘একটু দাঁড়া, আইসক্রিম কিনে দিচ্ছি।’
মেয়েটিকে দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ঢুকলাম ভেতরে। একটি ইগলু চকবার কিনলাম। দোকানদারের কাছে ভাংতি না থাকায় তিনি দুটি চকলেটও ধরিয়ে দিলেন। আমি মেয়েটির হাতে চকবারটি ধরিয়ে দিই। মেয়েটি আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই দৌড়। দুটো চকলেট আর দেওয়া হয় না। মেয়েটি আইসক্রিম হাতে নিয়েই রাস্তা দ্রুত পার হয়ে মানিকদির দিকেই যাচ্ছে। আমিও ওর পেছন পেছন দ্রুত হাঁটছি।
ইসিবি-চত্বর পার হয়ে মেয়েটি মানিকদির দিকে যেতে লাগল। মেয়েটি আইসক্রিম না খেয়ে কোথায় যাচ্ছে! আমার কৌতূহল বাড়ে। ওকে ফলো করতে থাকি। মেয়েটি কিছুদূর গিয়ে থামে। আমিও থামি। কবরস্থানের দেয়ালের পাশের ফুটপাতে এক বৃদ্ধার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। আমি একটু দূরে মোবাইলে কথা বলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ‘ও দাদি, তোমার লাইগা আইচকিরিম আনছি।’ নিয়নলাইটের আলোয় তার চেহারাটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। তবে বয়সের ভারে সে যে ন্যুব্জ সেটা বুঝতে পারছিলাম।
রাত
স্রেফ এক সেকেন্ড। হাইড্রোলিক ব্রেক না থাকলে কী যে ঘটত! তাকিয়ে দেখি, আমার বাইকের সামনে এক নারী দাঁড়িয়ে; তার কোলে এক-দেড় বছরের এক বাচ্চা। ফুটপাত থেকে হুট করে নেমে ওই নারী আমার বাইকের সামনে; আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছেন।
রাত ১১টা। অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। বাইকের গতি ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার পার হয়ে শুধুই মাটিকাটা ফুটওভার ব্রিজ পার হয়েছি। ইসিবি-চত্বরে আসামাত্রই ওই নারী সামনে এসে পড়লেন।
বাইক থামিয়ে ধমক দিতে যাব। কিন্তু সড়কবাতির আলোয় চোখ যায় তার কোলে থাকা বাচ্চার দিকে। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাইকটার ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যাই। নারী বলেন, ‘মাইয়াডা না খায়া আছে। কিছু টাকা দেবেন?’ আমার বুকটা ধুক করে ওঠে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক