
সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচন ঘিরে অপ্রীতিকর ঘটনা সরকার ও আওয়ামী লীগকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। উচ্চ আদালতে প্রভাব বিস্তার করা এক মন্ত্রী ও একজন জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা ও আইনজীবী নেতার।
আওয়ামী লীগের ওই নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চলতি বছর আমাদের আরও সতর্ক ও সংযম প্রদর্শন করে চলতে হবে। কারণ চলতি বছরই জাতীয় নির্বাচন।’ তারা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ভোটকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করা না করা নিয়ে বিতর্ককে আরও উসকে দেবে, যা সরকার ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। সুপ্রিম কোর্টে উদ্ভূত পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তিনি। ভোট শেষে এই ঘটনা নিয়ে তিনি বসবেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চেষ্টা করেছিলাম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়িয়ে যাতে সুন্দর নির্বাচন হয়। কিন্তু পারিনি। এর বেশি কিছু আর বলতে চাই না।’
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থ ও বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে এত বড় ঘটনা ঘটেছে। বিকল্প অনেক উপায় ছিল এমন লক্ষ্য পূরণে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হাইকোর্ট চত্বরে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন আইনজীবী নেতার কক্ষে বসে গত বুধবারের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। তাদের মুখেও শোনা গেছে অস্বস্তির কথা। সেদিন অনেক আইনজীবীকে তাদের আইন পেশা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। অথচ আদালত অঙ্গনে সুপ্রিম কোর্ট বারের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রথম দিনের ভোট চলছিল। ভোট নিয়ে ভ্রƒক্ষেপ ছিল না ওই সরকারি দল সমর্থক আইনজীবীদের। তারা কোনোভাবেই ভোটকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং সরকার সমালোচিত হয়েছে তা সমর্থন করছেন না।
উচ্চ আদালতে আইন পেশায় জড়িত এক প্রভাবশালী আইনজীবী ও সাবেক মন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বুধবারের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত। দুই জনের ব্যক্তিস্বার্থ ও এক মন্ত্রীর বাহবা নেওয়ার চেষ্টায় মূলত এ ঘটনা ঘটেছে। এটি বড় ক্ষতির মুখেমুখি করতে পারে সরকার ও আওয়ামী লীগকে।’ তিনি বলেন, এই নির্বাচন কি সরকার পরিবর্তনের? তাহলে এত বড় ঝুঁকি কেন নিতে হবে?
সিনিয়র এ আইনজীবী আরও বলেন, গত কয়েক বছরে আলোচনার মধ্য দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত যেমন গ্রহণ করা হয় না, তেমনি এখানে যাদের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন, যারা দক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য তাদের অন্তর্ভুক্ত করা বা পরামর্শ শোনা হয় না। ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের ভেতরে। এ কারণে সর্বোচ্চ আদালত চত্বরে আওয়ামী লীগের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক সিনিয়র-জুনিয়র কয়েকজন আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ বছরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন বিতর্কে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী একাধিক দল নির্বাচন নিয়ে আন্দোলন করছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। একেবারেই ব্যক্তিস্বার্থের কারণে এসব ছোটখাটো ভোটে জিতে মরিয়া অবস্থান নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলা অযৌক্তিক।
সুপ্রিম কোর্ট বারের এবারের (২০২৩-২০২৪) নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ (সাদা প্যানেল) থেকে সভাপতি পদে অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও সম্পাদক পদে অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলাল নির্বাচন করেছেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিপন্থি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য পরিষদ (নীল প্যানেল) সভাপতি পদে ব্যারিস্টার এম. মাহবুবউদ্দিন খোকন এবং সম্পাদক পদে সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
আইনজীবী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, মূলত ব্যালট নাকি ইসিএমে (ইলেকট্রনিক কাউন্টিং মেশিন) নির্বাচন হবে তা নিয়ে দুই প্যানেলের বিরোধ মারামারিতে গড়ায়। সাদা প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফকির ব্যালটে ভোটগ্রহণের পক্ষে অনড় থাকেন। এ নিয়ে দুই প্যানেলের বিরোধের কারণে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ভোটের আগে পদত্যাগ করেন। দুই পক্ষ মিলে তাকে ফেরানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হয় ব্যালটে অনড় অবস্থানের কারণে। পরে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ইসিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দেয়।
আওয়ামীপন্থি কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন, সামনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। তাদের কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাতে ‘ঘি না পড়ে’ সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এমন কোনো পরিস্থিতি যাতে তাদের দ্বারা সৃষ্টি না হয় যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভুল বার্তা দেয়।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানা কৌশল অনুসরণ করে চলেছে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোও গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে দুই দলের কাছে। ধর্মভিত্তিক বা ইসলামি দলগুলোকে আসন ছাড়ার প্রস্তাবসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এর মধ্যে আলাদা মোর্চা করে দলগুলোকে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনের প্রস্তাবও আছে। আওয়ামী লীগ ও ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার কথা জানা গেছে।
বিএনপি আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে যাবে না বললেও ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সঙ্গে রাখতে ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির দিকে ঝুঁকে থাকা ধর্মভিত্তিক দলকে সঙ্গে পেতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
সূত্র জানায়, খেলাফতে আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ অন্তত ছয়টি ধর্মভিত্তিক দলের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা। তবে উভয়পক্ষই বৈঠক ও প্রস্তাব নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছে না। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক ও প্রস্তাবের বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবেন জানিয়ে খেলাফতে আন্দোলনের আমির মাওলানা হাফেজ আতাউল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব এলে সেটি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব আমরা।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যোগাযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাজারে তো অনেক রকম কথা শোনা যায়। তবে আমাদের কাছে আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব আসেনি। আর আমরাও নিজেরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ এখনো করছি না।’ বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছে কি নতুন ফ্রন্ট নিয়ে আ.লীগে দোলাচল না জানতে চাইলে তিনি জানান, বিএনপির সঙ্গে তাদের কোনো লিয়াজোঁ নেই।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, কৌশলগত কারণে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছেন তারা। অনেকেই সঙ্গে থাকবে আশ্বাস দিয়েছে। আবার কোনো কোনো দল অন্য জোটে না গিয়ে নিজেদের আলাদা একটি ফ্রন্ট গঠনের কথাও জানিয়েছে। ওই নেতারা বলেন, আলাদা ফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে এলেও সরকারের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়া হতে পারে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সঙ্গী করার যে তৎপরতা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে দলের বড় একটি অংশের দ্বিমত পাওয়া গেছে। দলটির বিভিন্ন পদের চারজন কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচনে সরকারের সঙ্গে থাকবে যতই আশ্বাস দিক ইসলামি দলের নেতারা, শেষ পর্যন্ত সঙ্গে থাকা তো দূরের কথা, ভোটও দেবে না আওয়ামী লীগকে।
ওই নেতারা বলেন, ইসলামি দলগুলোর নেতারা সুযোগ বঞ্চিত হতে চান না, আবার তাদের মধ্যে ভয়ভীতিও আছে। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের দেশ রূপান্তরকে জানান, আগামী নির্বাচনে তার দল কোন জোটে যাবে সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরও কয়েক মাস লাগবে। তখন তারা বুঝতে পারবেন তাদের কোন দিকে যাওয়া উচিত।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সঙ্গী করা নিয়ে তোড়জোড় কেন জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের একটি অংশ ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন। ওই অংশটি বিভিন্ন সময়ে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে গুজব সৃষ্টি ও অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সুযোগ খুঁজবে। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ধর্মভিত্তিক দলকে। তাছাড়া সব দলই ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে রাজনীতি করা শুরু করেছে।
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ বড় একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠে। ওই বছরের ৫ মে ঢাকায় তা-ব চালায় তারা। পরে বিএনপি তাদের ওপর ভর করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে। সেটাও বিবেচনায় রেখেছে আওয়ামী লীগ।
দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভোটের আগে জোটের পরিধি আরও বাড়তে পারে। জোটে অন্তর্ভুক্ত করার পূর্বশর্ত থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে যে কেউ জোটে আসতে পারে।
ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা নির্বাচনের আগে জোটের পরিধি বাড়ার কথা জানালেও ইসলামি দলগুলোর ১৪ দলে আসার সুযোগ নেই বলে দেশ রূপান্তরকে জানান তরিকত ফেডারেশন চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারী। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মহাজোট করতেই পারে। তবে ১৪ দলীয় জোট আদর্শিক জোট। এ সংখ্যা বাড়বে না।’ তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে এলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী মহাজোট হবে। না এলে ওইসব দল আলাদা জোটেও নির্বাচন করতে পারে। তবে জুনের পরেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে মনে করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করা দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষার মতো।’ তিনি বলেন, এরা সুবিধা নেবে ঠিকই, সুবিধা নেওয়া শেষ হলেই বেকায়দায়ও ফেলবে। হেফাজত যেমন আচরণ করেছে ঠিক সেটাই করবে তারাও। ফলে এসব দল বাদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য উত্তম বলে মনে করেন ওই নেতা। তিনি বলেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সখ্য করা মূলত আদর্শচ্যুত হওয়া।
ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তাদেরই দুজন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ধর্মভিত্তিক দলের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। বিএনপির সঙ্গে তারা যাবে না এ আশ্বাসও দিয়েছে কয়েকটি দল।
কয়েকটি ইসলামি দলের শীর্ষসারির একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তাদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছেন। তবে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন কারোরই সঙ্গী হবেন না।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার আশ্বাস দিলেও ভোটের সময়ে পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে উল্টে যাওয়ার ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে মধ্যমসারির কয়েক নেতার কাছ থেকে। অর্থাৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তারা নাও থাকতে পারেন। হেফাজতের মতো হামলা-মামলার খড়গ এড়াতে এবং সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হতে চায় না বলেই ইসলামপন্থি ওই দলগুলো সরকারের সঙ্গী হওয়ার কথা ভাবছে।
দলগুলোর মধ্যম ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের শুভাকাক্সক্ষী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিস্থিতি ঠিক থাকলে ধর্মভিত্তিক দল ডানপন্থি দল বা জোটের সঙ্গেই ভিড়বে। আর বর্তমান পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে আওয়ামী লীগের সঙ্গী হবে তারা। তবে ভোট অন্য যাবে অন্য পক্ষে।
ওইসব দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে নেতারা ধ্যান-দরবার করছেন তারা বাদে অন্য নেতারাও দাবি করেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে যতই সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক, মিটিং-সিটিং হোক, তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে বললেও তলে তলে সমর্থন দিবে সরকারবিরোধী জোটকে। তারা সুবিধা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সঙ্গ দেবে, সঙ্গ ছাড়বে। কিন্তু ভোট নৌকার পক্ষে কখনোই যাবে না।
তবে আওয়ামী লীগের যে নেতারা ইসলামি ওই দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন তারা মনে করেন, যেসব দলকে তারা সঙ্গী করতে চান সেসব দল জামায়াতবিরোধী। ফলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দাবি তাদের।
খেলাফত মজলিস মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখনো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির পক্ষেই তার দলের অবস্থান। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তার দল আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এখনো পর্যন্ত তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে না গিয়ে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে আলাদা জোট করার চিন্তা করছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মদিন আজ। সারা দেশে দিনটি জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস হিসেবে উদযাপন করা হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এ নেতা ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে আজ দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস উপলক্ষে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষে জাতীয় শিশু সমাবেশ ও তিন দিনব্যাপী বইমেলারও আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই জাতীয় শিশু সমাবেশে যোগ দেবেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতার এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লির সদস্য নির্বাচিত হন। ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সোচ্চার এই অবিসংবাদিত নেতাকে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবরণ করতে হয়।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরবর্তী সময়ে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন। তার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির ওপর নানা নির্যাতন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা-সংগ্রামের ডাক দেন; যা ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
অন্যদিকে, ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির বহু আকাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি পরিষদ প্রদত্ত জুলিও কুরি পদকে ভূষিত হন। বিবিসির এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে শুরু করেন, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত শক্তি ও কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল তার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি ধানমণ্ডির বাসভবনে কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন।
বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। অনন্যসাধারণ এই নেতাকে ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ বা ‘রাজনীতির ছন্দকার’ খেতাবেও আখ্যা দেওয়া হয়। বিদেশি ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় তার উচ্চকিত প্রশংসা করেন।
বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তি কিউবার বিপ্লবী নেতা প্রয়াত ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষ্মণ কাদির গামা বাংলাদেশের এই মহান নেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছুকে ছাপিয়ে যান, তার স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে।’
‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাকে দেওয়া বঙ্গবন্ধু খেতাবে এই দেশপ্রেমিক নেতার প্রতি দেশের মানুষের গভীর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়।’ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ২০১৩ সালের ৪ মার্চ নগরীর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন শেষে মন্তব্য বইয়ে এমন মন্তব্য লিখেছিলেন।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মন্তব্য বইয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সম্মোহনী এবং অসীম সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধে তার জনগণের নেতৃত্ব দান করেছিলেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সোনিয়া গান্ধী বলেন, ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি স্বাধীনতার জন্য প্রতিকূলতা ও বিরূপ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে অটল সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছেন।’
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার বাংলাদেশ সফরের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় মন্তব্য বইয়ে তিনি লেখেন, এই উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা। মমতা বলেন, বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বে মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্মমত-নির্বিশেষে সব মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিত্রিত করলেও ইতিহাসই তার প্রকৃত অবস্থান নিশ্চিত করে, যখন তার এককালীন ঘোরতর শত্রু তাকে ‘মহান দেশপ্রেমিক’ হিসেবে অভিহিত করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাবেক পাকিস্তানি (বেলুচিস্তান) অফিসার মেজর জেনারেল তোজাম্মেল হোসেন মালিক পরে তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘বস্তুত মুজিব দেশদ্রোহী ছিলেন না (পাকিস্তানে তাকে সেভাবে চিত্রিত করা হলেও)। নিজ জনগণের জন্য তিনি ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক।’ আরেকজন সেনা কর্মকর্তা তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তার মুখপাত্র মেজর সিদ্দিক সালিক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ৭ মার্চের ভাষণের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। সালিক তার ‘পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ঘরমুখী মানুষের ঢল নামে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল আশাব্যঞ্জক বাণী শ্রবণ শেষে মসজিদ অথবা গির্জা থেকে তারা বেরিয়ে আসছেন।’ বাসস
দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরিবেশ শান্তই ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তারপর কয়েক দফায় ধস্তাধস্তি, হাতাহাতি; শেষ পর্যন্ত মারপিট। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোটের প্রথম দিনের মতো আগ্রাসী ছিল না পুলিশ। তবে ভোটকেন্দ্র ও আশপাশে সতর্ক অবস্থানে ছিল। বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের দ্বিতীয় ও শেষ দিনের চিত্র এরকমই ছিল।
ভোটের প্রথম দিনই নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। কার্যত ভোট থেকে সরে দাঁড়ায় তারা। গতকালও ভোটের প্রচারে কিংবা ভোট দেওয়ায় আগ্রহ ছিল না তাদের। নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা জানান, দুদিনে ভোট পড়েছে ৪ হাজার ১৩৭টি। প্রথম দিন ভোট পড়েছিল ২ হাজার ২১৭টি। দ্বিতীয় দিনে পড়েছে ১ হাজার ৯২০টি। সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৮ হাজার ৬০২ জন।
দুদিনে ভোট পড়েছে অর্ধেকের কম। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় ভোটগণনা শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। ভোটের প্রথম দিনে সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা গণমাধ্যমকর্মী ও আইনজীবীদের ওপর পুলিশের হামলা, ভোটকেন্দ্রে ভাঙচুর, সরকারপন্থি-বিএনপিপন্থিদের হট্টগোল, হাতাহাতি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, আইনজীবীদের চেম্বার ভাঙচুর, বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক সব মিলিয়ে নজিরবিহীন এক পরিস্থিতি ছিল সুপ্রিম কোর্টে।
প্রধান বিচারপতির কাছে নালিশ : আইনজীবী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশের বেপরোয়া আচরণের বিষয়ে অভিযোগ জানাতে আপিল বিভাগে গিয়েছিলেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীসহ আট বিচারপতি এজলাসে ছিলেন। ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত সভাপতি প্রার্থী এম. মাহবুব উদ্দিন খোকন, সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস কাজল।
বিস্তারিত শুনে প্রধান বিচারপতি তাদের বেলা ১১টায় তার খাসকামরায় যেতে বলেন। প্রয়োজনে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গেও কথা বলবেন বলে আইনজীবীদের জানান প্রধান বিচারপতি। ১১টার দিকে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন মাহবুব উদ্দিন খোকন ও রুহুল কুদ্দুস কাজল। কিছুক্ষণ পর হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে রুহুল কুদ্দুস কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা আমাদের কথা শুনেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডেকেছেন প্রধান বিচারপতি।’
প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই, অ্যাটর্নি জেনারেল : দুপুরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অ্যাটর্নি জেনারেল তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এটা যেহেতু বারের বিষয় (আইনজীবী সমিতির) এতে তার কিছু করণীয় নেই। বার অ্যাসোসিয়েশন ও সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টার সুরাহা করতে বলেছেন প্রধান বিচারপতি। পরিবেশ যেন ঠিক থাকে তা-ও বলেছেন।’
নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুপক্ষকেই দায়িত্ব নিতে হবে। একপক্ষ ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে গেলে আরেকপক্ষ বাধা দেবে। এরকম হলে অবশ্যই পরিবেশ ঠিক থাকবে না। তাই দায় সমানভাবে নিতে হবে। বিএনপিপন্থিরা কিন্তু নির্বাচনে আসতে চাচ্ছিল না।’ বিএনপিপন্থিদের নতুন নির্বাচনের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন নির্বাচন তারা চাইতেই পারেন। সমিতি ও বারের সদস্যরা যদি মনে করেন তাহলে সে দাবি বিবেচনা করে দেখবেন।’
কয়েক দফায় আইনজীবীদের ধস্তাধস্তি : সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দ্বিতীয় ও শেষ দিনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। সে সময় বিএনপিপন্থি কোনো প্রার্থী বা আইনজীবীকে দেখা যায়নি। সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনে ভোটকেন্দ্রের আশপাশে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ। দুপুর ১২টার দিকে বিএনপিপন্থি শতাধিক আইনজীবী ভোটকেন্দ্রের বাইরের প্যান্ডেলের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে। সরকারপন্থি আইনজীবীরাও কাছেই ছিলেন। একপর্যায়ে দুপক্ষ সেøাগান-পাল্টা সেøাগান দেয়। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় তাদের মধ্যে।
বিএনপিপন্থিরা ‘ভোট চোর’ ‘ভোট চোর’ স্লোগান দেয়। সরকারপন্থিরা ‘সাদা’ ‘সাদা’ ও ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দেয়। এরকম চলে অন্তত ৪০ মিনিট। একপর্যায়ে বিএনপিপন্থিরা পিছু হটলে কেন্দ্রের সামনে সরকারপন্থিরা অবস্থান নেয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ফের সংগঠিত হয়ে কেন্দ্রের সামনে এলে সরকারপন্থিরা তাদের ঠেকাতে চায়। সে সময় উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এবং ধস্তাধস্তি হয়।
ডিএমপি কমিশনারের দুঃখ প্রকাশ : গত বুধবার সাংবাদিকের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। দুঃখ প্রকাশ করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদও। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সুপ্রিম কোর্টে ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) কার্যালয়ে আসেন হারুন-অর-রশিদ। তিনি বলেন, ‘যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আমরা দুঃখিত, মর্মাহত। সুপ্রিম কোর্টের মতো জায়গায় এ ধরনের ঘটনা আমাদের কাম্য ছিল না। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করব।’ তার বক্তব্যের পর মোবাইল ফোনে এলআরএফ সভাপতি আশুতোষ সরকারের সঙ্গে কথা বলেন ডিএমপি কমিশনার। সে সময় অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশীদ সে সময় এলআরএফ কার্যালয়ে ছিলেন।
‘আরা যদি দেশত ফিরি যাইন ন ফারি আহারা মরি যামু। আরা এ দেশত ন থাকতি চাই। আরা আর বালা লাহে না। নিজ দেশে মরি গিয়ে ভালো’ কথাগুলো বলছিলেন উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৭ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা আবদুর রহমান। তার সঙ্গে সুর মেলান অন্তত শতাধিক রোহিঙ্গা। নিজ দেশে ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন তাদের মতো অন্য রোহিঙ্গরাও। তবে রোহিঙ্গাদের ভেতরে থাকা কিছু চক্র বাধা দিচ্ছে, যাতে তারা নিজ দেশে যেতে না পারেন। ওই চক্রগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশের কয়েকটি চক্র। দুপক্ষের এসব চক্র রোহিঙ্গাদের ঘিরে নানাভাবে লাভবান হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকেই প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে তারা ইয়াবার চালান আনছে নিয়মিত। মাদক কারবারিদের পাশাপাশি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার সদস্যদের তৎপরতা রয়েছে। মিয়ানমার থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে সাধারণ রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছেন। তাছাড়া বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মকা- নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আর এসবের কারণে ওইসব এনজিওর কর্মকা- নজরদারি করছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় দিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচিত হন। বিশ্বনেতারা সরকারপ্রধানের প্রশংসা করে বিবৃতি দেন। রোহিঙ্গাদের দেখতে বিশ্বনেতারা বাংলাদেশ সফর করেন। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরগুলোতে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের ভালো পরিবেশে রাখতে নোয়াখালীর ভাসানচরে একটি আবাসন পল্লীও গড়ে তোলে সরকার। সেখানে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তারপরও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে ব্যাকুল। এমনকি তাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহল চাপ দিচ্ছে মিয়ানমারকে। গত বুধবার মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ের জন্য টেকনাফে এসেছে। ওইদিনই সেখানে একজন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। গতকাল আরেক রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরেজমিনে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জুলেখা বিবি, আবিদুর রহিম, জুলহাস মিয়াসহ শতাধিক রোহিঙ্গা দেশ রূপান্তরকে জানান, তারা মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চান। স্বাধীনভাবে বসবাস করতে চান সেখানে গিয়ে। জান্তা সরকার তাদের মেরে ফেললেও দেশেই মরতে চান তারা। আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তারা জানান, যদি দেশে ফিরতে না পারেন তাহলে আত্মাহুতি দেবেন।
ক্যাম্পের লোকজন আরও জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক কারবারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা- চলে আসছে। প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে তাদের বসবাস। ক্যাম্পের ভেতরেই গড়ে উঠেছে একাধিক মাদক চক্র। এ ছাড়া খুন, ডাকাতি ও অপহরণকারী একাধিক চক্রও সেখানে ত্রাস ছড়াচ্ছে। কুতুপালংসহ কয়েকটি ক্যাম্পে অপরাধীদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব অপরাধী নিজেদের মধ্যে প্রায়ই মারামারি, খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে। এসব চক্রের মধ্যে মাস্টার রফিক, মৌলবি ইউনুছ, আনাস, আরসা ও মুন্না গ্রুপের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে।
তারা জানান, আরসাও চাচ্ছে রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমার না যেতে পারে। পাশাপাশি কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ার কিছু চক্রও চেষ্টা চালাচ্ছে তারা যেন নিজ দেশে ফেরত না যেতে পারে। তারা রোহিঙ্গাদের নানাভাবে বোঝাচ্ছে যে, মিয়ানমার সরকার আগের মতো দমনপীড়ন চালাবে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক মহলকে অনুরোধও করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালায়। আরসার বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। রোহিঙ্গাদের একটি চক্র অপহরণসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি।’
জানা গেছে, টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে দেশি-বিদেশি অর্ধশত এনজিও কাজ করছে। রোহিঙ্গা শিশুদের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি এনজিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে কয়েকজন রোহিঙ্গা। তারা নাম প্রকাশ না করে বলে, আরসা, স্থানীয় কিছু চক্র ও কয়েকটি এনজিও চায় না রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফেরত যাক। কারণ তারা চলে গেলে এনজিওগুলো সমস্যায় পড়বে।
রোহিঙ্গারা বলছে, তারা দেশে ফিরতে মরিয়া। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলকে জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া, সবাইকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া, মিয়ানমারের অন্য নাগরিকরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায় ওই ধরনের সুবিধা দেওয়া, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা তাদের সহায়-সম্পদ ফেরত দেওয়া, গৃহপালিত পশুগুলো ফেরত দেওয়া, সবুজ রঙে পরিচয়পত্র ফেরত ও নতুন করে কার্ড তৈরি করে বসবাস করার সুযোগ দেওয়া এ বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মহলকে নজরে রাখতে অনুরোধ জানায় রোহিঙ্গারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ক্যাম্পের ভেতরে হত্যাকা-সহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। এই নিয়ে মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে একাধিক বৈঠক হয়েছে। তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠতে সরকার নানাভাবে কাজ করছে। তাছাড়া রোহিঙ্গারাও দেশে ফেরত যেতে চাচ্ছে। কয়েকটি এনজিওর বিষয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আছে।’
আমি যখন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে পৌঁছাই, তখন শেষ বিকেল। কলেজের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে যাই। একসময় এই কলেজ ক্যাম্পাসে কত আড্ডা দিয়েছি। স্মৃতিকে পেছনে সরিয়ে সামনে পা বাড়ালাম। প্রধান ফটক থেকে মিনিট-চার হাঁটার পর নজরে পড়ে টিনের বোর্ডে খোদাই করা এক আহ্বান। ‘দাঁড়াও পথিকবর আমার নাম কাইজেলিয়া!’ এমন আহ্বান উপেক্ষা করা যায়। প্রবল বিস্ময়ে বোর্ডের বাকি লেখাগুলো পড়ে নিলাম।
বাংলাদেশে দুর্লভ প্রজাতির গাছ ‘কাইজেলিয়া’। একশ বছরের বেশি বয়সী গাছটির অবস্থান কলেজের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে। এর আদি নিবাস আফ্রিকা মহাদেশের সেনেগালে। বোর্ডে লেখা তথ্য অনুযায়ী, কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে ১৯২০ সালের দিকে কোনো এক বৃক্ষপ্রেমী কাইজেলিয়ার চারা রোপণ করেন। বর্তমানে গাছটির উচ্চতা ২০-২৫ মিটার। কাইজেলিয়া ‘বিগনোনিয়াসিয়া’ গোত্রের বৃক্ষ, বৈজ্ঞানিক নাম ‘কাইজেলিয়া আফ্রিকানা’। এর ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ রঙের, পাকলে বাদামি হয়ে যায়। তবে এটি বিষাক্ত হলেও প্রক্রিয়াজাত করে আলসার, সিফিলিস, বাত, ছত্রাক দমন, মেয়েদের প্রসাধনী সামগ্রী এমনকি ক্যানসারের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। শুরুর মতো করে শেষ লাইনে তার বেঁচে থাকার আকুলতা যে কারও হৃদয়ে নাড়া দেবে। ‘যদি তোমরা পরিচর্যা না করো অচিরেই আমি মারা যাব’ আমাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমাদের।
এদিকে কাইজেলিয়া বৃক্ষের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংগঠন ‘কারমাইকেল কাইজেলিয়া শিক্ষা-সংস্কৃতি সংসদ’ (কাকাশিস)। এই সংগঠনের এক সদস্য জানান, শতবর্ষী কাইজেলিয়া আমাদের কলেজের ঐতিহ্য। প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। এমনকি মাঝেমধ্যে বিদেশি অতিথিরাও গাছটি দেখতে আসেন।
কারমাইকেল কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দুলাল সরকার জানান, বিরল প্রজাতির ঔষধি গাছ কাইজেলিয়া। এটি বিশ্বে বিলুপ্তপ্রায় একটি বৃক্ষ। কলেজের মালী বাতুল সিং। বর্তমানে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে লাগানো কাইজেলিয়ার দুটি গাছ উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সামনে বড় হচ্ছে। একই কথা জানান, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ। তিনি জানান, মালী বাতুল সিংয়ের দেশীয় পদ্ধতিতে লাগানো কয়েকটি চারা ২০১৪ তার ক্যাম্পাসে লাগিয়েছিলেন। বর্তমানে গাছগুলো বেঁচে আছে এবং বড় হচ্ছে।
ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং কারমাইকেল কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের একদল বিজ্ঞানী টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে কাইজেলিয়ার কয়েকটি চারা উৎপাদন করেছিলেন। বাকৃবির বিজ্ঞানীরা সেই চারাগুলো রোপণ করলেও বাঁচাতে পারেননি। সেই ব্যর্থতা ঘুচিয়েছিলেন কারমাইকেল কলেজের সাবেক মালী বাতুল সিং। এ অসাধ্যসাধন করলেও বাতুলের চাকরি স্থায়ী হয়নি কারমাইকেল কলেজে।
বাতুল সিং জানান, ৮-৯ বছরের প্রচেষ্টার পর তিনি ২০১২ সালের দিকে কাইজেলিয়া গাছের চারা দেশীয় পদ্ধতিতে উৎপাদন করতে পেরেছিলেন। এমন সাফল্যের পর আমার প্রত্যাশা ছিল কারমাইকেল কলেজে স্থায়ী চাকরি পাব, কিন্তু পাইনি। বাতুল সিংয়ের স্বপ্ন নিজ হাতে দেশের প্রতিটি জেলায় এবং বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তত একটি করে কাইজেলিয়ার চারা রোপণ করে বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষটিকে বাঁচিয়ে রাখা। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ময়মনসিংহের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি ৫০টিরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন। এর বিনিময়ে কোনো টাকা নেন কি না জানতে চাইলে বাতুল সিং বলেন, ‘কাইজেলিয়া আমার সন্তানের মতো। এর চারা দিতে পারলেই আমি খুশি। যারা টাকার বিনিময়ে চারা নিতে চান, আমি তাদের চারা দিই না। আমি চাই গাছটা বাংলাদেশে বেঁচে থাকুক।’
বাতুলের আক্ষেপ আর প্রত্যাশার গল্প পেরিয়ে আমরা আবার অতীতে ফিরে যাই। ১৯১৬ সালের ১০ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড ব্যারন কারমাইকেল এই কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তারই নামানুসারে কলেজের নাম করা হয় ‘কারমাইকেল কলেজ’। শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন বাঙালি জমিদারের সহযোগিতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। শুরুর দিকে এর অস্থায়ী ভবন হিসেবে পাঠদান চলে রংপুরের বর্তমান জেলা পরিষদ ভবনে। ১৯১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কারমাইকেল কলেজের মূল ভবনের উদ্বোধন করা হয়। প্রায় ৩০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ। কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন ড. ওয়াটকিন।
৬১০ ফুট লম্বা ও ৬০ ফুট প্রশস্ত কলেজের মূল ভবন ইন্দোস্যারানিক আদলে নির্মিত স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য-নিদর্শন, যা বাংলার সমৃদ্ধিশালী ইতিহাস মোগলীয় নির্মাণ কৌশলকে মনে করিয়ে দেয়। মূল ভবনের অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যকীর্তি পর্যটকদের প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করে তুলতে যথেষ্ট। গম্বুজের ব্যাপক ব্যবহার মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের পরিচায়ক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গম্বুজ ভবনের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কার্নিশের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মারলন অলংকরণের কারুকাজ সন্নিবেশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে ইন্দোস্যারানিক স্থাপত্য সৌকর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন কারমাইকেল কলেজের মূল ভবনটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যকীর্তি। এই ভবন রংপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বছর জুড়ে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটকের আগমন ঘটে এই কলেজে।
কলেজে ঢুকতেই হাতের বামে পড়বে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন, একটু এগিয়ে গেলে শিক্ষকদের ডরমেটরি, যা হোয়াইট হাউজ নামে পরিচিত। পাশেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রাথমিক বিদ্যালয় (কলেজ প্রাইমারি স্কুল)। স্কুল পেরিয়ে সামনের দিকে এগোলে চৌরাস্তা বা জিরো পয়েন্ট। এ ছাড়া কলেজটিতে রয়েছে একটি সুদৃশ্য মসজিদ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, দ্বিতল ছাত্রী বিশ্রামাগার, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন, ক্যানটিন, শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল, শিক্ষক ডরমেটরি, সাব-পোস্ট অফিস, অডিটোরিয়াম (নির্মাণাধীন), প্রশাসনিক ভবন, বিশাল দুটি খেলার মাঠ।
বর্তমানে কলেজটিতে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী ও ১৯৫ জন শিক্ষক রয়েছেন। কভিডের সময় অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছেন এবং বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আগাম ভর্তির কারণে অনেকেই ভর্তি বাতিল করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছেন, ফলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আমজাদ হুসেন।
কলেজ ক্যাম্পাসেই কথা হয়, কারমাইকেল কলেজের নাট্য-সাহিত্য সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ হাসানের সঙ্গে। আরিফ জানান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে কারমাইকেল কলেজের সুনাম থাকলেও বর্তমানে তাদের কষ্ট করে সংগঠন চালাতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত আর্থিক সহযোগিতা নেই, ফলে ভালো প্রোগ্রাম করা যাচ্ছে না।
এখানকার ছাত্রীরা সান্ধ্য আইনে বন্দি বলে জানান ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মাইশা। তিনি জানান, মেয়েদের জন্য তিনটি হল থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে মেয়েশিক্ষার্থীদের মেসে থাকতে হয়। মেস মালিকরা সন্ধ্যার মধ্যে মেসে ঢোকার নির্দেশ জারি করেছেন। ফলে টিউশনি শেষ করে বাসায় ফেরা অথবা টাউন হলের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শেষ করে মেসে প্রবেশ করা তার মতো আরও অনেক ছাত্রীর জন্য এক বড় বিড়ম্বনা। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ফলে তারা সংকটে পড়েছেন। একদিকে খাবারের খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে মেসের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন মেস মালিকরা।
কলেজটিতে মেয়েদের জন্য আবাসিক হল রয়েছে তাপসী রাবেয়া হল, বেগম রোকেয়া হল ও জাহানারা ইমাম হল। ছেলেদের জন্য রয়েছে জিএল হল, ওসমানী হল, সিএম হল এবং কেবি ছাত্রাবাস (শুধু হিন্দু ছাত্রদের জন্য)। এর মধ্যে সিএম হল পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কলেজটিতে বহিরাগতদের অবাধ যাতায়াতের ফলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাঝেমধ্যে সংঘর্ষ বাধে শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের।
২৮ বছর থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে কলেজটিতে। কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো থেকে বারবার ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানালেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হলেও প্রতি বছর ছাত্র সংসদ বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি নেওয়া হচ্ছে।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডক্টর মো. আমজাদ হুসেন বলেন, ১০৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তি পড়াশোনা করেছেন, যা আমাদের ক্যাম্পাসের পড়াশোনার মানের পরিচয় বহন করে। কলেজের সোনালি অতীতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আগামীতে আরও সোনার সন্তান তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছেন কলেজের শিক্ষকরা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ভারতীয় পারিবারিক হিন্দি চলচ্চিত্র ‘অভিমান’। ১৯৭৩ সালের সাড়া জাগানো এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি। অর্ধশত বছর পার করলেও অভিমানের আবেদন এখনো অটুট। লিখেছেন নাসরিন শওকত
অমিতাভ-জয়া জুটি
১৯৬৯ সালে ‘সাত হিন্দুস্থানি’ চলচ্চিত্র দিয়ে বলিউডে অভিষেক হয় অমিতাভ বচ্চনের। তখন একের পর এক চলচ্চিত্র মুখ থুবড়ে পড়ায় বলিউডে অস্তিত্ব¡ সংকটের মুখে পড়েন অভিনেতা। ঠিক তখনই মুক্তি পায় ‘দিওয়ার’। অমিতাভের সেই ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ইমেজে মজেন ভারতীয়রা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বলিউডের আজকের ‘শাহেনশাহ’ এবং মেগাসুপারস্টার বিগ বি’কে। অন্যদিকে নায়িকা হিসেবে জয়ার ক্যারিয়ার শুরু হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘গুড্ডি’ (১৯৭১ সালে) চলচ্চিত্র দিয়ে। অমিতাভের সঙ্গে একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন তিনি, যার মধ্যে অন্যতম ‘জাঞ্জির’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘অভিমান’, ‘মিলি’, ‘শোলে’, ‘সিলসিলা’।
একসময় বলিউডের চলচ্চিত্রশিল্পে অমিতাভ-জয়ার প্রেম ছিল চর্চিত বিষয়। অমিতাভ বচ্চন যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন, ততদিনে জয়া ভাদুড়ি প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। ১৯৭১ সালে যখন ‘গুড্ডি’ মুক্তি পায়, তখন থেকেই অমিতাভের সঙ্গে জয়ার প্রেমের সূত্রপাত। শোনা যায়, ওই চলচ্চিত্রের সেট থেকেই জয়ার প্রতি অনুরাগের শুরু তার। এরপর ‘এক নজর’ চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে জয়াতে নিজেকে হারান অমিতাভ। পরে ‘জঞ্জির’ বক্স অফিসে সাফল্য পেলে লন্ডন বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন এই জুটি। পরিকল্পনা অনুযায়ী লন্ডনের টিকিট কেটে ফেলেন অমিতাভ ও জয়া। কিন্তু তাদের লন্ডন ভ্রমণে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্বয়ং অমিতাভের বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন। ছেলেকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বিয়ে না করে একসঙ্গে বিদেশে বেড়াতে যাওয়া যাবে না কোনোভাবেই।
বাবার নির্দেশ অনুয়ায়ী, পরদিন সকালে পরিবার ও বন্ধুদের খবর দেওয়া হয়। ডেকে আনা হয় পুরোহিতকে। রাতে লন্ডনের বিমানে ওঠার কথা ছিল দুজনের। তাই ওই দিন সকালে একেবারে সাদাসিদেভাবে অমিতাভ-জয়ার বিয়ের আসর বসে। বরের পোশাক পরেই অমিতাভ গাড়ি চালিয়ে গিয়ে মালাবার হিলস থেকে তুলে আনেন জয়াকে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই (১৯৭৩ সালের ৩ জুন ) বিয়ে হয়ে যায় তাদের। বিয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নবদম্পতি রাতে লন্ডনের বিমানে ওঠেন। বিয়ের ১ বছর পর (১৯৭৪ সালে) প্রথম সন্তানের মা হন জয়া বচ্চন। মেয়ের নাম রাখেন শে^তা। এর দুবছর পর জন্ম হয় ছেলে অভিষেকের। বিয়ের পর একেবারে সংসারী হয়ে ওঠেন জয়া। অভিনয় জীবন থেকে লম্বা বিরতি নেন। মন দেন দুই সন্তান শ্বেতা ও অভিষেককে বড় করার দিকে।
অমিতাভ-জয়াকে বলিউডের অন্যতম আদর্শ দম্পতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেখতে দেখতে দাম্পত্যেরও অর্ধশত বছর পার করেছেন তারা। বর্তমানে ৩ নাতি-নাতনি নিয়ে সুখের সংসার তাদের। অভিষেক-ঐশ্বর্যের মেয়ে আরাধ্য। অন্যদিকে শে^তা বচ্চন নন্দার দুই ছেলেমেয়ে অগাস্ত্য ও নভ্যা নভেলি নন্দা। দীর্ঘ এই দাম্পত্য জীবনে বহু চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী থেকেছেন অমিতাভ-জয়া। তারপরও শক্ত করে ধরে রেখেছেন একে অপরের হাত ।
সুপারহিট ‘অভিমান’
বাঙালি পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অভিমান’ নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি। পরিচালক হৃষিকেশ অমিতাভকে তার স্ত্রী জয়ার সঙ্গে জুটি বাঁধিয়েছিলেন, যে জুটি চুটিয়ে প্রেম করছেন তখন । অভিমান মুক্তির এক মাস আগেই বিয়ে করেন তারা। কিন্তু এরই মধ্যে রুপালি পর্দার নবদম্পতির ব্যক্তিত্বের সংঘাত বাস্তব জীবনে সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে জয়া উমা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন।
‘অভিমান’-এর বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা হয়তো পরিচালক হৃষিকেশের মাথায় আগে থেকেই ছিল (বাস্তবের অভিমান সব শ্রেণির দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়)। কিন্তু চলচ্চিত্রটিতে ঠুনকো অহংকার ও ভঙ্গুর মানসিকতার কারণে সৃষ্টি হয় দাম্পত্য কলহ, যার সহজাত কিন্তু গভীর উপলব্ধির পুঙ্খানুপঙ্খ চিত্রায়নের মধ্যেই মূলত লুকিয়ে ছিল এর স্থায়ী আবেদন ।
অভিমানে অমিতাভ ‘সুবির’ নামের এক গায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি পপগানের জন্য সবার কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। স্টেজে তাকে বিখ্যাত গায়ক কিশোর কুমার ও মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে গাওয়া নানা সুপারহিট গান গাইতে দেখা যায়। মাঝরাতে উন্মত্ত নারী অনুরাগীদের টেলিফোন কলের জ¦ালাতন এবং চিত্রার মতো ধনী ও অভিজাত বান্ধবীর তার প্রতি গভীর অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও ওই গানের নিঃসঙ্গতার মতোই সুবীর নিজেকে বড্ড একা অনুভব করে। এমন একসময়েই সুবীর তার প্রিয় মাসি দুর্গা মৌসির (দুর্গা খোটে) দূরের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়। যেখানে ঘটনাচক্রে এক শাস্ত্রীয় সংগীতকারের মেয়ে উমার (জয়া ভাদুরী) সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সুবীর প্রথমে উমার শিববন্দনার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং একসময় সে উমার প্রতিও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
মজার বিয়ষ হলো, এই দম্পতি যে তখন বাস্তব জীবনেও একে অপরের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, পরিচালক হৃষিকেশ সূক্ষ্মভাবে অভিমানের মধ্য দিয়েই ভিন্ন আঙ্গিকে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সুবীরের পরামর্শে উমা মঞ্চে তার সঙ্গে একটি দ্বৈত গান গাইতে রাজি হয়। পরে সে একক গানের প্রস্তাব পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাচক্রে উমা যখন জনপ্রিয়তায় তাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন সুবীর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ও স্ত্রীর প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠে। এই কয়েক দৃশ্যে পরিচালক হৃষিকেশ এই দম্পতির মধ্যকার বৈপরীত্যকে গভীর মমতায় সেলুলয়েডে তুলে আনেন।
চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃশ্যে অন্তজর্¦ালায় জ¦লতে থাকা সুবীরকে (যে কিনা এরই মধ্যে চিত্রার বাড়িতে সময় কাটানো শুরু করেছে) বলতে শোনা যায়, ‘প্রথমেও একাই ছিলাম, আজও একাই আছি।’ তখন চিত্রা উপলব্ধি করে, একাকিত্ব হলো নিজের সৃষ্ট এক ব্যথা, যার জন্ম ছোট ছোট অভিমান আর অহংকার থেকে।
এ সময় উমা স্বেচ্ছায় গান গাওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে সুবীরের ক্ষতবিক্ষত মন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনই এক চরম মুহূর্তে উমাকে সে বলে বসে, তাকে আর তার প্রয়োজন নেই। সুবীরের সন্তানকে গর্ভে নিয়ে উমা তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে। চরম এক বিপর্যয়ের মুহূর্তে উমা তার সন্তানকে হারায়। একপর্যায়ে অনুতপ্ত হয়ে উমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে সুবীর। কিন্তু শোকে কাতর উমা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন উমার নীরবতা ভাঙার জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে সুবীর। শেষ পর্যন্ত স্টেজ শো করে তাদের দুজনের প্রিয় গান গায় (তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না), যা উমাকে স্বামীর ভালোবাসায় ফিরিয়ে আনে আবার। সুবীর উমাকে আবার গান গাইতে অনুরোধ করে।
অমিতাভ-জয়ার দুর্দান্ত অভিনয়ই অভিমানের প্রাণশক্তি। প্রাথমিক অবস্থায় চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয় ‘রাগ রাগিনী’। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিচালক হৃষিকেশ এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘অভিমান’। চলচ্চিত্রটি মুক্তির মাত্র এক মাস আগে অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি বিয়ে করেন। তাই এর প্রথম দিকের দৃশ্যগুলোতে এই দম্পতিকে বিয়ের প্রাথমিক ঘনিষ্ঠতা উপভোগ করতে দেখা যায়, যা ছিল জীবনঘনিষ্ঠ। এর সংগীত পরিচালক ছিলেন এস ডি বর্মণ।
অভিমান-এর পোস্টমর্টেম
১৯৮০-র দশকের শুরুর দিককার কথা। তখন বলিউডে বারবার অ্যাকশন হিরোর চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সফলতা পাওয়ায় ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ইমেজ গড়ে ওঠে অমিতাভের। তখন ‘দিওয়ার’, ‘শোলে’ ও ‘জাঞ্জির’-এর মতো ব্যবসাসফল অ্যাকশন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, সে সময়ের সংগীতের নাটকীয়তাকে ঘিরে এক নবদম্পতির ঈর্ষাপরায়ণতা, ভালোবাসা ও মান-অভিমানের কাহিনি নিয়ে নির্মিত ‘অভিমান’ ছিল অমিতাভ অভিনীত সবচেয়ে ভালো চরিত্রগুলোর মধ্যে একটি।
‘অভিমান’ এবছর অর্ধশত বছর পূর্ণ করেছে। ১৯৭৩ সালে অমিতাভের কমপক্ষে অর্ধ ডজন চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যার মধ্যে ‘অভিমান’ একটি। এই তালিকায় রয়েছে ‘সওদাগর’, যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে সে বছর ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারে যায় এবং আরেকটি ছিল ‘জাঞ্জির’, ব্লকবাস্টার এই চলচ্চিত্রটি অমিতাভকে ভারতের শীর্ষ ‘অ্যাকশন হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। কিন্তু চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক শৈবাল চট্টোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ‘‘অভিমান’ ছিল ওই বছরের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র এবং সে বছরে তার (অমিতাভ) সবচেয়ে বড় হিট চলচ্চিত্রও’’। ‘অভিমান’ দেখতে ভক্তরা দলে দলে ছুটে যান সিনেমা হলগুলোতে। বাবা-মা এবং ছোট বাচ্চাসহ পুরো পরিবারে ভরে যায় থিয়েটারগুলো। সমান তালে ভিড় থাকে ম্যাটিনি ও সান্ধ্য শোতে।
বছরের পর বছর ধরে চলচ্চিত্র শিল্পের ভক্ত, সমালোচক এবং বচ্চন দম্পতির সহকর্মীদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘অভিমান’। অমিতাভ বচ্চন নিজেও সুযোগ পেলেই ‘অভিমান’-এর প্রতি তার ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেন। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘এটি সেই চলচ্চিত্র, যা আমাদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় সৃজনশীল কাজ করাতে জয়া ও আমাকে একত্রিত করেছে এবং এর গানগুলো কোনোভাবেই ভোলার নয়। অনেকের কাছেই এখনো তা স্বপ্নের মতোই।’
লেখক শৈবাল চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘ ‘অভিমান’কে সব সময় বচ্চনের ক্যারিয়ারের ‘একটি শীর্ষ সময়’ হিসেবে আলোচনা করতে হবে। কারণ এটি ছিল এমন একটি চলচ্চিত্র, যেখানে তাকে গতানুগতিক পৌরুষদীপ্ত, তেজী বা রাগী যুবক হিসেবে তুলে ধরা হয়নি। এটি এমন একটি চরিত্র ছিল, যেখানে তার ভিন্ন এক রূপ দেখানো হয়েছে। সেখানে তিনি একজন সত্যিকারের নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, একজন সত্যিকারের মানুষ যিনি নিরাপত্তাহীনতায় ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠেন এবং এখানেই তিনি একজন বহুমুখী অভিনেতার পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হন। প্রমাণ করেন যে, পরিচালক তার জন্য যে চরিত্রই লেখেন না কেন, তিনি তাতে পারদর্শী।’ ”
সময় যত গড়িয়েছে, ‘অভিমান’-এর কাহিনিকে ঘিরে অনুমানের চর্চাও তত বেড়েছে। তখন ধারণা করা হতো যে, চলচ্চিত্রটি তার দুই প্রধান তারকার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হয়েছিল। কেননা অমিতাভ তখন বলিউডে একজন নবাগত হলেও জয়া এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত একজন অভিনেত্রী ছিলেন। আবার কখনো সেতারবাদক রবিশঙ্কর ও তার প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর জীবনের সঙ্গেও এর তুলনা করা হয়েছে, যিনি নিজেও একজন প্রতিভাবান সেতারবাদক ছিলেন। কিন্তু পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় এসব তুলনা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ ছাড়াও ‘অভিমান’কে হলিউডের চলচ্চিত্র ‘এ স্টার ইজ বর্ন’-এর সঙ্গেও তুলনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই একই কাহিনি নিয়ে হলিউডে মোট চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। প্রথমটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে এবং এর সবশেষ সংস্করণটি ২০১৮ সালে নির্মাণ হয়। যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন বিশ্ববিখ্যাত গায়িকা লেডি গাগা ও অভিনেতা ব্রাডলি কুপার। যদিও এই তুলনাকে কখনোই স্বীকার করেননি ‘অভিমান’-র পরিচালক হৃষিকেশ। এর পরিবর্তে তিনি বলেছিলেন, তার চলচ্চিত্রটি বলিউডের কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমার ও তার প্রথম স্ত্রী রুমা দেবীর জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যিনি বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের একজন সফল অভিনেত্রী ও গায়িকা। এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক হৃষিকেশ বলেন, ‘অভিনেত্রী রুমা কম প্রতিভাবান ছিলেন না। যেহেতু কিশোর তার ক্যারিয়ারের শুরুতে কিছুটা সংগ্রাম করছিলেন, তাই অভিনয়শিল্পী হিসেবে রুমার প্রতিভার বিষয়ে সব সময় সতর্ক থাকতেন তিনি।’
তবে আজকাল কিছু নারীবাদী ‘অভিমান’-এ জয়াকে নম্র ও পতিব্রতা স্ত্রী হিসেবে চিত্রিত করার জন্য চলচ্চিত্রটির সমালোচনা করেন। যিনি কখনোই নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করেননি, যার কাছে তার স্বামীই মুখ্য।
রমজানের পঞ্চম দিনেও রাজধানী ছিল তীব্র যানজটের কবলে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। এবার রোজার শুরুতে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে স্বাধীনতা দিবসের ছুটি মিলিয়ে তিন দিন বন্ধ থাকায় রোজার চতুর্থ দিন সোমবার তীব্র যানজটের কবলে পড়েছিল ঢাকা। গতকাল মঙ্গলবার সে তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে সবরাই অভিযোগ, সেবা সংস্থাগুলো তাদের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গার রাস্তা কাটায় যান চলাচাল ব্যাহত হচ্ছে, ভোগান্তি বেড়েছে পথাচারীদের।
গতকাল রাজধানীর সদরঘাট, গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, রামপুরা ও মিরপুরসহ বেশ কটি এলাকা ঘুরে সকাল থেকে তীব্র যানজট দেখা যায়। যানজটে আটকা পড়ে অনেককে হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে আবার বাসে দীর্ঘ সময় বসে থেকে পরে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য হেঁটেই রওনা দিতে দেখা যায়। অনেক জায়গায় শুধু সড়ক নয়, ফ্লাইওভারে দেখা দেয় তীব্র যানজট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর অনেক জায়গায় রাস্তাঘাটের সংস্কারকাজ চলায় বিকল্প পথ ব্যবহারের কারণে যানজটের শিকার বেশি হতে হচ্ছে ওইসব এলাকার যাত্রীদের। বিশেষ করে অফিসের শুরু ও শেষের দিকে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মো. জয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, রাস্তাঘাটের যানজট এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো জায়গায় ঠিকমতো যাওয়া যায় না। তাছাড়া কোনো কিছুরই সঠিক পরিকল্পনা নেই। এক রাস্তা কয়েকবার কাটতে দেখা যায়। আর এজন্যই মূলত এত যানজট।’
যানজটের কারণে যাত্রীদের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ গণপরিবহনের চালক ও কর্মীরাও। দিশারী পরিবহনের চালক মো. সানোয়ার বলেন, ‘সকাল থেকেই রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট ছিল। সোমবারের থেকে আজ (গতকাল) আরও যানজট বেড়েছে। কোনোভাবেই গাড়ি সামনে যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি শহরের জন্য যতটুকু পরিমাণ রাস্তাঘাট দরকার তার কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না এই নগরীতে। আর প্রতিদিন কী পরিমাণ যানবাহন সড়কে চলছে তার সঠিক সংখ্যাও জানা নেই বিআরটিএর। আর গণপরিবহন ব্যবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থায় মানুষের যাতায়াত বাড়ছে। সে জন্য ছোট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। যার জন্য সড়কে যানজট বাড়ছে।
বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার অনুমতি দিয়ে নতুন একটি আইনের পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব সরকার। নতুন এই আইন পাস হলে বিদেশিরা দেশটিতে যেকোনো এলাকায় সম্পত্তি কিনতে পারবেন। অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরমতো বাংলাদেশিরাও এই সুযোগ পাবেন। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার কৌশলের অংশ হিসেবে আবাসন খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতেই এমন পরিকল্পনা বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো।
সৌদি আরবের রিয়েল এস্টেট জেনারেল অথরিটির (আরইজিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুল্লাহ আলহাম্মাদদের বরাতে সৌদি গেজেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশিদের সম্পত্তি কেনা সম্পর্কিত নতুন একটি আইন পর্যালোচনাধীন রয়েছে। এই আইনের আওতায় সৌদি নাগরিক নন, এমন বিদেশিরা মক্কা, মদিনাসহ সৌদি আরবের যেকোনো এলাকায় সম্পত্তি কিনতে পারবেন।
আবদুল্লাহ আলহাম্মাদ বলেন, আইনটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে আইনটির বিষয়ে সবাইকে জানানো হবে।
বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার বিষয়ে ২০২১ সালে একটি নির্দেশনা জারি করেছিল সৌদি আরব। এই নির্দেশনায় সৌদির নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিসহ দেশটিতে থাকা বৈধ বাসিন্দাদের শর্ত সাপেক্ষে একক সম্পত্তি কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
আবদুল্লাহ আলহাম্মাদ বলেন, সৌদিতে রিয়েল এস্টেটের মালিকানার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের চেয়ে নতুন আইনটি আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক হবে। নতুন আইনের অধীন বিদেশিরা সৌদিতে বাণিজ্যিক, আবাসিক, কৃষিসহ যেকোনো ধরনের সম্পত্তি কিনতে পারবেন।
আগের আইনে সৌদির পবিত্র শহরগুলোতে বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ সৌদি আরবের সব জায়গায় বিদেশিরা সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন।
নতুন আইনের মাধ্যমে সৌদি আরব তার আবাসন খাতে একটা রূপান্তর আনতে চাইছে। তারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এ খাতকে আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়। সৌদি কর্র্তৃপক্ষ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান আরও বাড়াতে আগ্রহী।
সৌদির রিয়েল এস্টেট জেনারেল অথরিটি নতুন যে আইনটির কথা বলছে, তা কার্যকর হলে দেশটি প্রবাসী ও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন বিনিয়োগের একটি গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।
সংলাপে নয়, আলোচনার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, ‘মূল জিনিসটা হলো, আমরা কিন্তু সংলাপে আহ্বান করিনি। সংলাপ বিষয়টি আনুষ্ঠানিক। আমরা কোনোভাবেই উনাদের (বিএনপি) সংলাপে ডাকিনি। আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি আনুষ্ঠানিক না হলেও (আনুষ্ঠানিক মানে সংলাপ) অন্তত অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আপনারা আসতে পারেন। অত্যন্ত বিনীতভাবে এ আহ্বানটা করেছি।’
বিএনপিকে চিঠি পাঠানোর পাঁচ দিন পর গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের নিজ কক্ষের সামনে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, “বিএনপিকে চিঠি দেওয়ায় ইসির কোনো ‘কূটকৌশল’ ছিল না, কোনো মহলের ‘চাপও নেই’। অনানুষ্ঠানিকপত্র দিয়েছি বিএনপি মহাসচিবকে। চিঠি বৃহস্পতিবার শেষবেলায় দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় চিঠিটা উনারা পেয়েছেন। আমার কাছে কোনো জবাব আসেনি। ধরে নিচ্ছি উনারা পেয়েছেন। অনেকে বলতে চেয়েছেন এটা সরকারের একটি কূটকৌশল। আমি আপনাদের মাধ্যম পুরো জাতিকে অবহিত করতে চাই, আশ্বস্ত করতে চাই এ পত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সংস্রব নেই, সংশ্লিষ্টতা ছিল না।’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি কেউ এটাকে কূটকৌশল হিসেবে মনে করতে চান তাহলে এটা নির্বাচন কমিশনের কূটকৌশল হতে পারে, সরকারের নয়। আর নির্বাচন কমিশন কখনো কূটকৌশল হিসেবে এ কাজটি করেনি।’
সিইসি বলেন, ‘ইসি একেবারে প্রথম থেকেই অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে আসছে। আমরা ব্যথিত হই যখন বলা হয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করি। আজ্ঞা বহন করিনি। আমরা নির্বাচন নিয়ে আলাপ করি, আমাদের চিন্তার মধ্যে ফুটে উঠেছে বিএনপির মতো দলকে নির্বাচনে আনতে পারলে ভালো হয়।’
বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় এখনো আগ্রহী জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি আপনাদের (বিএনপির) যদি কোনো কৌশল থাকে তার ওপর ইসির কোনো মন্তব্য থাকবে না। তার পরও আমরা আলোচনা করতে চাই আপনাদের সঙ্গে। ফল ইতিবাচক হতেও পারে, নাও হতে পারে। প্রয়াস থাকবে। প্রয়াস গ্রহণ করতে বাধা থাকা উচিত নয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আমরা কোনো চিঠি পাইনি। আমি চিঠি দিয়েছি, যেকোনো রেসপন্স আমাদের চিঠির মাধ্যমে দিতে হবে। আমরা আশা করি, যেহেতু বিএনপি মহাসচিব মহোদয়কে চিঠি দিয়েছি। যেকোনো বক্তব্য আমাদের কাছে পত্রের মাধ্যমে আসে সেটাই কাক্সিক্ষত। এরপর আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব। আগাম কোনো মন্তব্য নেই।’
বিএনপি যদি আসে তাদের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা হবে সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উনারা কী বলবেন, আমরা কী বলব আগাম কোনো বক্তব্য দিতে পারব না। বিএনপি যদি আলোচনার জন্য এজেন্ডা ঠিক করে দেয়, তার পরও বসা বিষয়ে ইতিবাচক’ বলে জানান সিইসি।
কূটনৈতিক মহলে সংলাপ আয়োজনের আলোচনার মধ্যে এমন চিঠি দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এ ধরনের বিষয় আমাদের নলেজে নেই। আমাদের চিন্তা থেকে, উদ্ভূত সিদ্ধান্ত থেকে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। চাপের কথা যেটা বলেছেন এটা সম্পূর্ণ অমূলক ধারণা। কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চাপে বিএনপিকে ডাকা হয়নি।’
বিএনপির জবাব পেতে কত দিন অপেক্ষা করবে কমিশন এমন প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে যান সিইসি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাইবান্ধা ভোট বন্ধের ইস্যুতে ১৩৪ জনের মধ্যে ৪০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবারও পদক্ষেপ নেবে ইসি।
সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে চার নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর, রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
'স্যার নয় আপা ডাকলেই চলবে' রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের এমন বক্তব্যের পর রাত ৯ টার দিকে আন্দোলন সমাপ্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে বুধবার (২২ মার্চ) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একাই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন উমর ফারুক। এর পর তার সাথে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেরোবির একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে উমর ফারুক আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় আমি বাইরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। তখন ওই শিক্ষক আমাকে দেখে আপা বলে ডাক দেন। আমি তাকে স্যার না বলে আপা কেন ডাকছেন জানতে চাই। আমার জায়গায় একজন পুরুষ দায়িত্বে থাকলেও কি তিনি স্যার না বলে ভাই ডাকতেন?
জেলা প্রশাসক জানান, রাতে তিনি ওই শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের স্যার ডাকতে হবে না, আপা ডাকলেই চলবে বলে জানান। এরপর তারা আন্দোলন বন্ধ করে দেন এবং ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে চলে যান।