
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের কূটনীতিকদের বাসা-অফিসে ছোটাছুটি বেড়েছে। শক্তিধর দেশের কূটনীতিকদেরও এ সংক্রান্ত ব্যস্ততা বেড়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদ্যমান অস্থিরতা নিরসনে রাজনৈতিক সংলাপের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী দেশগুলো।
তাদের এ আগ্রহ ও তৎপরতার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকায় নিজের বাসায় মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের। গতকাল বুধবার দুপুরে ওই ভোজ অনুষ্ঠানে যোগ দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধিদল। মধ্যাহ্নভোজের পাশাপাশি চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নির্বাচন নিয়ে পিটার হাসের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। সংলাপ নিয়ে উদ্যোগ ও কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে তাদের মধ্যে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা গত দুটি নির্বাচন ও বিএনপি-জামায়াতের আমলে হওয়া নির্বাচনের অনিয়মের বিষয় পিটার হাসের কাছে তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগ নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরা সম্ভব নয় জানিয়ে সংবিধানের মধ্যে থেকেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেন। সংলাপ প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, শর্তহীন হলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। মধ্যাহ্নভোজে উপস্থিত থাকা আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে এসব তথ্য জানায়।
আওয়ামী লীগের ওই প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান, দলের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত।
আওয়ামী লীগের সূত্রমতে, দলটির নেতারা পিটার হাসকে বলেছেন, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে বিএনপির সঙ্গে তারা সংলাপ করেছিলেন। কিন্তু সংলাপের পর ২০১৪ সালে বিএনপি একতরফা ভোট বর্জন করে অগ্নিসন্ত্রাস চালায়। পরের নির্বাচনে মনোনয়ন বিক্রি করা শুরু করে। টাকা খেয়ে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার কারণে যা হওয়ার তাই হয়েছে। তারা আরও বলেছেন, দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে চায়। শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনায় দক্ষতা দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফল। এ সফলতাকে ভয় করে বিএনপি নির্বাচন নিয়ে রঙ-তামাশা শুরু করেছে।
প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে পিটার হাসকে জানানো হয়েছে, নিঃশর্ত সংলাপ হতে পারে। তবে শর্ত জুড়ে দিয়ে কোনো সংলাপ ও আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে না। কারণ সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন করার ক্ষমতা জনগণ শেখ হাসিনাকে দেয়নি। আইনের মধ্যে, সংবিধানের মধ্যে থাকা সব ধরনের সুযোগ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে নির্বাচনে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, তারা নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারের কাছে চাইলে যেকোনো সহযোগিতা সরকার দেবে। তারা বলেছেন, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অসহযোগিতাই করেনি, নির্বাচন ঠেকানো ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে ষড়যন্ত্র করেছে। এবারও একই ধারাবাহিকতায় হাঁটছে।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎ হয়েছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, বিরোধী দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী সেটা জানতে চান তিনি।
জবাবে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি আওয়ামী লীগেরই আন্দোলনের ফসল। কিন্তু বিএনপি ২০০১ ও ’০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অপব্যবহার করেছে। এর ফলেই এক-এগারোর মতো অনির্বাচিত সরকার এসেছে। এখন পাকিস্তান ছাড়া গণতান্ত্রিক বিশ্বে এ ধরনের সরকারের অস্তিত্ব নেই। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে যাবে না। তারা বলেছেন, বিএনপি যে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানাচ্ছে সে অনির্বাচিত সরকার কতদিন থাকবে সেটার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সূত্র আরও জানায়, দলটির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়েছে, আইনি ও আর্থিকভাবে নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি স্বাধীন। কমিশনকে বর্তমান সরকার শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা করবে। এ ছাড়া অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নির্বাচনে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তা পিটার হাসের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো যে সুষ্ঠু হয়েছে, তাও তুলে ধরা হয়।
সূত্র আরও জানায়, পিটার হাস আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের কাছ থেকেই বেশি শুনতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে।
এর আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাতটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওইদিন ওবায়দুল কাদের বৈঠক শেষে বেরিয়ে বলেছিলেন, তারা চান আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশগ্রহণ করুক। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবেও অনেক কূটনৈতিক সাক্ষাৎ করেছেন। প্রতিনিধিদল নিয়েও বৈঠক করছেন। ভবিষ্যতেও এ ধরনের বৈঠক-সাক্ষাৎ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
বিএনপিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতারা একাধিকবার এসব বৈঠকের সমালোচনা করে ‘বিদেশিদের কাছে বিএনপি ধরনা’ দিচ্ছে বলে সমালোচনা করেন।
এদিকে গতকাল বিকেলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা ভুলে যেতে হবে। আজকে (বুধবার) যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে বলে এসেছি, এ দেশে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘অবৈধ ব্যক্তির হাতে গড়া অবৈধ দল হলো বিএনপি। আর এই অবৈধ দলের অবৈধ মহাসচিব মির্জা ফখরুল। কেন বলছি? বিএনপির একটা গঠনতন্ত্র আছে, সেখানে কোথায় আছে ফখরুল ১২ বছর ধরে মহাসচিব থাকবেন। তাহলে তার বৈধতা হারায় নাই? তিনি যে পদত্যাগ দাবি করেন তার নিজেরই তো পদত্যাগ করা উচিত।’
স্বাধীনতা-পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতিতে বিদেশি কোম্পানির পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নিয়ে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার পথ দেখান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু দেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে তখন আমদানির ঝোঁকের কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে মনে করেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এবারের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, জ্বালানির জন্য নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি উৎস থাকা দরকার। সংকট কাটাতে দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সফলতা এলেও এখন অবহেলার কারণে গভীর সংকটে পড়েছে জ্বালানি খাত।
বর্তমানে সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আমদানির কারণে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। তার পরও শিল্প-কারখানা ও ভোক্তাপর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ পুরোপুরি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। ডলার সংকট ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও কয়লা আমদানি নিয়ে জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বহুজাতিক কোম্পানি শেল ওয়েলের কাছ থেকে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র (তিতাস, হবিগঞ্জ, রসিদপুর, কৈলাশটিলা ও বাখরাবাদ) কিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তার গোড়াপত্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে আরও নতুন ২৩টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ফলে দেশে গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮টি। বর্তমানে দেশীয় গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশই উৎপাদিত হয় ওই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর করা হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম তামিম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০১০ এবং ২০১৬ সালে মহাপরিকল্পনা করার সময় আমি বলেছিলাম, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ৯০ শতাংশ জ্বালানি আমদানি করতে হবে। এজন্য ২০ বিলিয়ন ডলার লাগবে। এখনকার হিসেবে আরও বেশি অর্থের দরকার। তখন বলা হয়েছিল, আমাদের এক্সপোর্ট, রেমিট্যান্স যেভাবে বাড়ছে, তাতে অর্থের কোনো সমস্যা হবে না।’
ম তামিম বলেন, ‘ইকোনমিক গ্রোথ (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বড় ধরনের অনিশ্চয়তাও রয়েছে। নানা কারণে এই গ্রোথ থমকে যেতে পারে। করোনা মহামারী এবং পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেছে। সামনে আরও দুই বছর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স বা অন্য কারণে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’
‘বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে তেল-গ্যাসে ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতে কিছুটা আছে। সেটাও যদি উঠিয়ে দেওয়া হয় তাহলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। তখন অনেকে হয়তো গ্যাস-বিদ্যুৎও ঠিকমতো কিনতে পারবে না। জ্বালানি আমদানি করতে না পারলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট (কেন্দ্র ভাড়া) বেড়ে যাবে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে। অন্যান্য কেন্দ্রের ক্ষেত্রেও এই ব্যয় বাড়বে। বিদ্যুতের পাশাপাশি টার্মিনালের সক্ষমতার চেয়ে কম এলএনজি আমদানির কারণে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভরতা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখান থেকে বের হয়ে দেশীয় জ্বালানির অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, দেশে মজুদ গ্যাসের পরিমাণ ছিল ২৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। সেখান থেকে ১৯ টিসিএফ উত্তোলনের পর এখন মজুদ রয়েছে ৯.০৬ টিসিএফ। প্রতি বছর গড়ে এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার হিসেবে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে এই মজুদ দিয়ে আগামী ৮ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত চলবে।
এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেছেন, গত ১৩ বছরে পাঁচটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ফলে দৈনিক ১০০৮ মিলিয়ন ঘনফুট নতুন গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। পাশাপাশি কিছু পুরনো কূপ সংস্কারের মাধ্যমেও গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সাগরে ও পাহাড়ে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস ও তেল উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে জ্বালানি আমদানির প্রচেষ্টার পাশাপাশি স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
গ্যাসের চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। তখন বলা হয়েছিল, দেশে অনুসন্ধান ও উৎপাদনে যে খরচ পড়ে, তার চেয়ে কম দামে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে এই দাম এখন অনেক বেড়েছে।
২০১৫ সালে গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে এমন দাবি তুলে যখন এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এ ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর না দেওয়ায় গত তিন বছরে দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট কমেছে। বর্তমানে দৈনিক ২৮৯৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২১৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র আসছে। প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত ৫০ বছরে মাত্র ৬৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে পেট্রোবাংলা। অথচ এ সময়ে শুধু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেই ১৬০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে।
২০১৪ সালে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও বঙ্গোপসাগরে এখনো কোনো অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। এমনকি অনুসন্ধানের আগে যে বহুমাত্রিক জরিপের প্রয়োজন সেই কাজই শুরু হয়নি এখন পর্যন্ত। অথচ ভারত ও মিয়ানমার তাদের ব্লক থেকে গ্যাস তুলতে শুরু করেছে।
তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, বর্তমানে চাহিদার ২২ শতাংশ পূরণ হচ্ছে আমদানি করা গ্যাসে। ২০২৫ সালে চাহিদার ৬০ শতাংশ এলএনজি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। এজন্য বর্তমানে দুটি এলএনজি টার্মিনালের পাশাপাশি নতুন আরও টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
গত চার বছরে এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি খোলাবাজার থেকেও আমদানি করা হবে। আগামী কয়েক বছরে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে তার বেশির ভাগই আমদানি করা এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে আমদানিনির্ভরতা অনেকাংশে কমবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাস্তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে যত পরিকল্পনা তার বাস্তবায়ন খুবই কম।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইতিমধ্যে পায়রা ও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। মাতারবাড়ী, মহেশখালীসহ আরও কিছু কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। এগুলো চালাতে যে কয়লা লাগবে তার পুরোটাই আমদানি করতে হবে। এতে ব্যয় অনেক বাড়বে। কারণ কয়লাও এখন উচ্চমূল্যের জ্বালানি। অন্যদিকে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে প্রতি ইউনিটে ব্যয় তিন ডলার। সেখানে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানিতে ব্যয় ১৫-২০ ডলার। এর আগে এই এলএনজি ৩৫ ডলার পর্যন্ত দামে আমদানি করতে হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে ১০ ডলারে আমদানির কথা থাকলেও তা সরবরাহ হচ্ছে অনেক কম। ফলে আমদানিনির্ভরতার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। জ্বালানি আমদানি বাড়লে পরনির্ভরশীলতাও বাড়ে, যা জ্বালানি নিরাপত্তা তথা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
তিনি বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে গ্যাসের সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে। এরপর কমতে থাকে। সরকার দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ফনফুট গ্যাস আবিষ্কারের দাবি করলেও বাস্তবে গ্যাসের উৎপাদন আগের চেয়ে কমেছে। সবাই এগুলো জানার পরও অনুসন্ধানে অবহেলা করা হয়েছে। দেশে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার সময় থেকেও যদি অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরালো হতো তাহলে আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
বদরূল ইমাম বলেন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে ও পেট্রোবাংলার যৌথ জরিপে বাংলাদেশে ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এর এক বছর পর নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আরেক গবেষণায় দেখানো হয়, মজুদ গ্যাসের সম্ভাব্য পরিমাণ ৪২ টিসিএফ। তার মানে দেশের গ্যাস এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এজন্য অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে।
‘পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে তিনটি কূপ খনন করলে একটাতে গ্যাস পাওয়া যায়। কিন্তু সরকার কখনোই জোরালো অনুসন্ধানে যায়নি। ২০১৪ সালে সমুদ্র জয় করলাম। এরপর প্রায় ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কিছুই করিনি। সেখানে অনুসন্ধান করলে অনেক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল,’ যোগ করেন তিনি।
সূত্র মতে, মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১১ সালে সমীক্ষা চালায় ফরাসি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান সøামবার্জার। তখন বলা হয়েছিল, দেশে বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে কিছু সংস্কার ও পরিবর্তন আনলে তিন বছরের মধ্যে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উত্তোলন বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু পরে সেই সংস্কার আর করা হয়নি।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা আর কমিশন বাণিজ্যের কারণে দেশীয় জ্বালানি অনুসন্ধানে অবহেলা করে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানিতে ঝুঁকছে সরকার। পরিকল্পিত আমদানিপ্রীতির কারণে দেশে জ্বালানি সংকট প্রকট হয়েছে। ফলে দফায় দফায় বাড়ছে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম।’ তিনি মনে করেন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
কোনো জেলায় কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন রয়েছে কি না তা জানতে তালিকা তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেক ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমার সরকারের লক্ষ্য হওয়ায় আমি প্রত্যেককে বাড়ি দেব। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ বাড়ি, আশ্রয় এবং জীবিকার সুযোগ পাবে। তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না। আমরা চাই প্রত্যেকে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে।’
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপে বাড়ি হস্তান্তরের সময় এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি সাতটি জেলা ও ১৫৯টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা।
এর আগে তিনি পঞ্চগড় ও মাগুরার সব উপজেলাসহ ৫২টি উপজেলাকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনি গতকাল ৯টি জেলা এবং ২১১টি উপজেলা গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। খবর বাসসের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির পিতা দেশকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে একটি উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন দিতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তার সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না বলে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি বলেন, তার সরকার ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বাড়িঘর ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে বাড়িপ্রাপ্তদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ওপর একটি ভিডিও-প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সরকার প্রধান বলেন, ‘কেউ ঠিকানা ছাড়া থাকবে না। আমরা তাদের শুধু ঘরই দিইনি, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। তাদের জীবিকার জন্য ঋণও দিয়েছি। তারা এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন, একজন ব্যক্তি ১০০ বিঘা জমির অধিকারী হতে পারবে এবং এর অতিরিক্ত পরিমাণ জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র গড়তে রোডম্যাপ জরুরি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভৌগোলিক-কৌশলগত সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। গতকাল ঢাকায় প্রথম অ্যাভিয়েশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে দেওয়া এক ভিডিও ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন সামিট-২০২৩’-এর আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী এই শীর্ষ সম্মেলনকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, দেশটির এই অঞ্চলে একটি বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা রয়েছে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা যাত্রী ও মালামাল উভয়ের জন্যই একটি উন্নত ও টেকসই বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারি সংস্থা, এয়ারলাইনস ও সংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সরকার ই-ভিসা সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ও পর্যটনে আসা যাত্রীদের সুবিধা দেবে ও ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের যুবকদের অবশ্যই পাইলট, বিমান প্রকৌশলী, মেকানিক, ক্রু ও আরও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি দেশের বিমানশিল্পে লোকবলের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই বিমানশিল্প এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী ও ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বক্তব্য দেন।
‘মা, আপনার দয়ায় ঘর পেয়েছি, স্কুল পেয়েছি, মাদ্রাসা পেয়েছি, রাস্তা পেয়েছি। আমার আর কোনো চিন্তা নাই মা। আমি ভিক্ষা আর করব না।’
গতকাল বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চতুর্থ দফায় আরও ৩৯ হাজার ৩৬৫ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ বিনামূল্যে ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানের সময় একথা বলেন সুবিধাভোগী মো. হানিফ। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুরের নয়াপাড়া আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে জমিসহ একটি ঘর পান। একই কেন্দ্রে ঘর পাওয়া দুধজানও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নয়াপাড়া আশ্রয়ণ কেন্দ্র ও বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার বানারীপাড়া পৌরসভার উত্তরপাড় আশ্রয়ণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আনন্দাশ্রু সংবরণ করে মো. হানিফ আরও বলেন, ‘আমি ছোট্ট একটা দোকান করে আপনার দয়ায় দিন কাটায় দিব মা। আপনার জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করা ছাড়া আমার কিছু দেওয়ার নাই। আপনার জন্য দোয়া করি মা। আমি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি, তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।’
একই আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগী দুধজান বেগম বলেন, ‘ভাবসিলাম, আমি মারা গেলে কোনখানে আমারে মাটি দিব! আমার তো জায়গাবাড়ি নাই। বাপের ঘরে হইসিলাম, ভাইয়েরা পরিচয় দেয় না আমি গরিব বইলা। আল্লাহ আমারে অহন দাঁড়ানোর শক্তি দিছে। আফনার জন্য দোয়া করব, আফনি গরিবের পাশে খাঁড়াইছেন।’
চতুর্থ পর্যায়ে ঘর ও জমি হস্তান্তর অনুষ্ঠানের আগে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সব উপজেলা গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার দেশের আরও সাত জেলাকে ভূমিহীন এবং গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, রাজশাহী, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা জেলা। এসব জেলার সব উপজেলাসহ মোট ১৫৯ উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।
ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রাকৃতিক কারণে এসব এলাকায় নতুন করে গৃহহীন হয়ে পড়লে তাদেরও ঘর করে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে যদি ভূমিহীন পাওয়া যায় তাদেরও ঘরের ব্যবস্থা আমরা করে দেব।’
জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, ‘আপনারা আরও যদি কেউ ভূমিহীন, গৃহহীন থেকে থাকে তাদের তালিকা করবেন। আমরা তাদেরও ঘর করে দেব। জাতির পিতার বাংলাদেশে কোনো মানুষ ঠিকানাহীন থাকবে না।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘ছিন্নমূল মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। তাদের মুখে হাসি ফোটানোই বড় পাওয়া।’
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের পরে ভূমিহন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগের কথা স্মরণ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা শুধু স্বাধীনতাই দেননি, এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য তিনি যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন, তা যদি বাস্তবায়ন করে যেতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠত।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের দল। এই দল মানুষের পাশে থাকে, তাদের জন্য কাজ করে। আমাদের একটাই লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর দেশে কেউ ঠিকানাহীন থাকবে না। আমরা চাই, দেশের সবার ঘর-বাড়ি থাকবে।’
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তৎকালীন বিএনপি সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৯১ সালের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কিছু জানতেন না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সবার প্রথমে ছুটে যায়। রাস্তাঘাট বন্ধ ছিল, তারপরও আমরা ছুটে গিয়েছিলাম। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। অনেক মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে কক্সবাজারে বস্তিতে থাকত। আমরা তাদের পুনর্বাসন করেছি।’
সর্বমোট ৯টি জেলা ও ২১১টি উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
গাজীপুরের শ্রীপুরের নয়াপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়ায় জেলার সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং উপকারভোগীরা সকাল থেকে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন।
নয়াপাড়ায় উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সিমিন হোসেন রিমি, ইকবাল হোসেন সবুজ এবং মেহের আফরোজ চুমকি। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান।
শ্রীপুরের গাজীপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়ায় ৮ একর জমিতে ১৪২টি ঘর করা হয়েছে। এখানে স্কুল, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, খেলার মাঠ এবং কবরস্থানও গড়ে তোলা হয়েছে।
এর আগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২ শতক জমির মালিকানাসহ ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬২টি পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট দুই লাখ ১৫ হাজার ৮২৭টি পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে। আরও ২২ হাজার ৬টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে। গুমোট আবহাওয়া কাটিয়ে রোদ ঝলমলে উজ্জ্বল দুপুরে কাল অনুশীলন করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মূল মাঠের এক কোণে তিনটি প্র্যাকটিস উইকেটে টানা অনেকক্ষণ নেট করলেন তামিম ইকবাল। দল পরপর দুটো ম্যাচে তিনশ’র বেশি রান করেছে। দুই ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাট থেকে এসেছে একটি শতরান আর চারটি অর্ধশত রানের ইনিংস। এমন রান স্বর্গেও অধিনায়ক তামিম ইকবাল ৩ এবং ২৩ এর বেশি করতে পারেননি। তাই তো কাল প্রধান কোচ ও ব্যাটিং কোচ মিলে নেটে অনেকটা সময় ব্যাট করালেন তামিমকে। তাসকিন আহমেদ ও মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ দলের প্রধান দুই বোলার একটানা বল করেছেন তামিমকে। নিবিড় মনোযোগে তামিমের ব্যাটিং দেখেছেন ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্স। দিয়েছেন প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। মোস্তাফিজের বল খেলতে তামিম একটু আড়ষ্টই ছিলেন শুরুতে। সিডন্স বার দুয়েক ধরিয়ে দিয়েছেন কোথায় হচ্ছে ভুল। তাসকিনের জোরের ওপর করা ডেলিভারিগুলোকে অবশ্য ভালোভাবেই মাঝব্যাটে খেলছিলেন তামিম। একটা সময় চন্দিকা হাথুরুসিংহে এসেও ডগস্টিক দিয়ে বল থ্রো করেছেন তামিমকে, দিয়েছেন পরামর্শও। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে সরে দাঁড়ানো তামিম আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এই ম্যাচের পরও কিছুদিনের জন্য চলে যাবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে, কারণ এরপরই যে চট্টগ্রামে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। আজকের পর তামিমকে আবারও জাতীয় দলে ব্যাট হাতে দেখা যাবে ৪ এপ্রিল থেকে ঢাকায় শুরু হতে যাওয়া একমাত্র টেস্টে। তবে মিরপুরের উইকেট তো আর সিলেটের মতো ব্যাটিং স্বর্গ নয়। এই মাঠে সবশেষ ৫ ওয়ানডেতেই তিনশ’র বেশি রান করেছে বাংলাদেশ, সবশেষ দুই ওয়ানডেতে হয়েছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দুটো ওয়ানডে ইনিংস। পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ডের ভাষায় এখানকার উইকেট ‘অ্যাবসলিউট বেল্টার’। এমন উইকেটে তামিমের রান না পাওয়াটা দুশ্চিন্তারই। আগের ম্যাচে অবশ্য সাবধানী শুরুর পর অসম্ভব এক রান নিতে গিয়েই রান-আউট হয়ে যান ২৩ রান করা তামিম। চোটের কারণে লম্বা সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে থাকার পর তামিম খেলায় ফিরে এখনো নিজের ছাপটা রাখতে পারেননি। ইংল্যান্ড সিরিজে তিন ইনিংসে করেছেন ২৩, ৩৫ ও ১১ রান। আইরিশদের বিপক্ষে করেছেন যথাক্রমে ৩ ও ২৩ রান। অথচ এই সময়টায় নাজমুল হোসেন শান্তর হাফসেঞ্চুরি ৩টি, সদ্যই অভিষেক হওয়া তাওহিদ হৃদয়ও দুই ম্যাচে করেছেন ৯২ এবং ৪৯ রান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে রান খরায় ভুগতে থাকা লিটন দাসও সবশেষ ম্যাচে তুলে নিয়েছেন হাফসেঞ্চুরি। টি-টোয়েন্টি থেকে সরে দাঁড়ানো আরেক ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমও চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭০ রানের ইনিংস খেলার পর সবশেষ ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৬০ বলে তুলে নিয়েছেন সেঞ্চুরি। তামিমের আশপাশের সবাই রানের দেখা পাচ্ছেন, পাচ্ছেন না কেবল অধিনায়ক নিজেই।
তৃতীয় ওয়ানডের আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে ডোনাল্ড বললেন, ‘সামনে চেমসফোর্ডে আমরা আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে যে রকম উইকেটে খেলব, দ্বিতীয় ওয়ানডের উইকেটটা অনেকটা ওরকমই ছিল। এরপর সামনে আফগানিস্তানের সঙ্গে সিরিজ, পাকিস্তানে এশিয়া কাপ ও ভারতের মাঠে বিশ্বকাপ আছে। ভারত-পাকিস্তানের উইকেটগুলো এরকমই হবে, অনেক রান হবে।’ বড় আসরগুলোর আগে ব্যাটসম্যানরা ঘরের মাঠে রান করবেন, এটাই তো থাকবে টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়া। সেই চাওয়া অবশ্য পূরণ হয়েছে, তবে রানটা আসেনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ হাজারের বেশি রান করা তামিমের ব্যাটে ভর করে।
অনুশীলনে ফুটবল খেলতে গিয়ে বুকে আঘাত পাওয়া মেহেদি হাসান মিরাজকে কাল দেখা গেছে অনুশীলনে। বেশ চনমনে ভঙ্গিতেই বল করছিলেন লিটন দাস ও নাজমুল হোসেন শান্তকে। তবে অনুশীলনে ছিলেন না মুশফিকুর রহিম। পুত্র মায়ানের অসুস্থতার খবর পেয়ে মঙ্গলবার রাতেই ঢাকায় ফিরে গেছেন মুশফিক, কাল রাতেই তার সিলেটে ফেরার কথা। বুধবার অনুশীলনে দেখা যায়নি সাকিব আল হাসানকেও। মোহামেডানের হয়ে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ খেলতেও মাঠে নামেননি সাকিব, ছিলেন না অনুশীলনেও। অবশ্য সাকিব কখন কোথায় থাকেন সেই হদিস রাখাটাও এখন কঠিন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও খুব সম্ভবত হাল ছেড়ে দিয়েছে সাকিবের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে। না হলে ম্যাচের আগে হেলিকপ্টারে মাগুরা চলে যাওয়া, সিরিজের মাঝে সমাবর্তন, বিমানের সঙ্গে চুক্তি সইসহ নানান কাজে সিলেট থেকে ঢাকা চলে আসা...সব কিছুতেই যে নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্ট। কারণ বিতর্কের জন্ম দিয়ে এসে সাকিব যেন আরও ভালো খেলেন!
দেশের মাটিতে গত কয়েক বছরে ইংল্যান্ড বাদে সবার সঙ্গেই ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। আইরিশদের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে জয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে জয় ছিনতাই হয়েছে বৃষ্টিতে। আইরিশদের সামর্থ্য বিচারে এগিয়ে বাংলাদেশই। এখন পর্যন্ত সিরিজের দুটো ওয়ানডেতেই টস জিতেছে আয়ারল্যান্ড। তামিমের আজ টসটাও জেতা দরকার, সেই সঙ্গে ম্যাচও। তবে আরও দরকার ব্যাটে রান, কারণ টি-টোয়েন্টি দলের সাকিবের অধিনায়ক হিসেবে সাফল্য ভিন্নভাবেই ভাবাতে পারে নীতিনির্ধারকদের।
বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদের শুরুতেই শিল্প খাতে গতি আনতে গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্প-সম্পর্কিত ১০টি প্রতিশ্রুতি এবং ৬০টি নির্দেশ নিয়ে প্রথমবারই গ্রহণ করেছেন একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা। তিন মেয়াদ মিলিয়ে গড়ে প্রায় ১৪ বছর পার হলেও এ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতির দুটি বাস্তবায়িত হয়েছে, আটটির কাজ চলছে। ৬০টি নির্দেশের মধ্যে ৩৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে, ২৫টির কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশ গত জানুয়ারি পর্যন্ত কতটা অগ্রগতি হয়েছে তা নিয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদন থেকে প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশ বাস্তবায়নের এ হিসাব পাওয়া গিয়েছে।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শিল্প খাতে গতি আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে অনেক সময় সরকারের সর্বোচ্চপর্যায়ের অনেক নির্দেশও বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম মেয়াদেই ১০ প্রতিশ্রুতি এবং ৬০ নির্দেশ নিয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসব কর্মপরিকল্পনা শিল্প মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বাস্তবায়নে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রয়োজনে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। সরকারের প্রতি মেয়াদেই এসব কর্মপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১১ সালের ৫ মার্চ বন্ধ সরকারি ছয় কারখানা খুলনা নিউজ প্রিন্ট মিলস লিমিটেড (কেএনএম), চিটাগাং কেমিক্যাল কমপেক্স লিমিটেড (সিসিসি), ঢাকা লেদার কোম্পানি লিমিটেড (ডিএলসিএল), বাংলাদেশ ইন্স্যুলেটর স্যানিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বিআইএসএফ), নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস লি (এনবিপিএমএল), দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড চালু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব কারখানা চালুর প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। এ কর্তৃপক্ষ থেকে ওই কর্তৃপক্ষ, ফাইল চালাচালি চলছেই।
প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, কেএনএমের জমির পরিমাণ ৮৭ দশমিক ৬১ একর। অতীতের দায়দেনা পরিশোধ করতে কেএনএমের ৫০ একর জমি নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (নওপাজেকো) কাছে ৫৮৬ দশমিক ৫২ কোটি টাকা মূল্যে বিক্রিতে চুক্তি হয়। নওপাজেকো কেএনএমকে ২৫৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা দিলেও বাকি আছে ৩৩২ দশমিক ১০ কোটি টাকা। কেএনএম থেকে পাওনা পরিশোধে অনুরোধ জানিয়ে নওপাজেকোকে ২৫ বার চিঠি পাঠিয়েছে। অথচ এখনো বাকি টাকা পরিশোধ করেনি। কেএনএমের ৩৭ দশমিক ৬১ একর জমি এবং খুলনা হার্ডবোর্ড মিলস লিমিটেডের ৯ দশমিক ৯৬ জায়গা এক করে ৪৭ দশমিক ৫৭ একর জায়গায় আধুনিক কাগজ কল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রায় ১০ বছর পর ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর ওয়াসো ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্ট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গত ১১ ডিসেম্বর কাজ শুরু করেছে। সরকারের সর্বোচ্চপর্যায়ে নির্দেশে আধুনিক কাগজ কল নির্মাণের অগ্রগতি এটাই।
২০১২ সালের ৩০ জুন টাঙ্গাইল শিল্পপার্ক, ২৫ ফেব্রুয়ারি বাইশদিয়া উপজেলায় জাহাজভাঙা শিল্প ও শিপইয়ার্ড এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দীপ উপজেলায় বিসিক শিল্প নগরী নির্মাণে নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাহাজ নির্মাণশিল্প ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং একই বছরে ৯ এপ্রিল সিরাজগঞ্জে অর্থনৈতিক জোন ও শিল্প নগরী নির্মাণে বলা হয়েছে। ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মুহুরী প্রজেক্টে জেগে ওঠা ১৭ হাজার একর জমিতে শিল্পপার্ক স্থাপনে এবং ২০১৮ সালের ২ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনে নির্দেশ থাকলেও এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে বিসিক থেকে শিল্প প্লট কিনে শিল্প নগরী স্থাপনে এবং একই বছরে ১১ মে মধুপুরে আনারসের জন্য খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনে নির্দেশ দিলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নির্মাণের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন।
নির্দেশে বলা হয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন ও পুরনো প্রতিটি সরকারি কারখানায় বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি নির্মাণ করতে হবে। একইভাবে প্রতিটি বেসরকারি কারখানায়ও ইটিপি বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিল্পপার্কে কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণ করতে হবে। বেসরকারি কারখানার মালিকরা ইটিপি নির্মাণের ব্যয় বহন করতে সক্ষম না হলে প্রয়োজনে সরকারি তহবিল থেকে তাদের ইটিপি নির্মাণ করে দিতে হবে। পরে কারখানার মালিকদের কাছ থেকে নির্মাণব্যয় ও একটি ফি আদায় করতে হবে। ২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও একই নির্দেশ দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ অনুযায়ী এখনো সব সরকারি-বেসরকারি কারখানায় ইটিপি স্থাপনের বিষয় নিশ্চিত করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই শেখ হাসিনা সরকারি চিনিকলগুলো লাভজনক করতে জোর দেন।
প্রসঙ্গত, চিনিকলগুলো আখ স্বল্পতায় বছরের সাত থেকে আট মাস বন্ধ থাকে। চিনিকলগুলোর অনেক পুরনো যন্ত্রপাতিতে উৎপাদন সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে চিনি উৎপাদনের কাঁচামাল আখের পাশাপাশি সুগার বিট চাষ, র-চিনি আমদানি করে সরকারি চিনিকলে পরিশোধন করে চিনি উৎপাদন, চিনিকলের যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন এবং চিনিকলের অব্যবহৃত জায়গায় নতুন শিল্প নির্মাণে নির্দেশ দেন। চিনিকলের বয়লার ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, মোলাসেস থেকে ইথানল, বায়োগ্যাস এবং সার উৎপাদনেও নির্দেশ দেওয়া হয়। সরকারি ১৫ চিনিকলে পর্যায়ক্রমে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে প্রথম ধাপে নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের জন্য ৩২৫ কোটি টাকা এবং ঠাকুরগাঁও চিনিকলের জন্য ৪৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দ করা অর্থে দুই চিনিকলের পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত, নতুন যন্ত্রপাতি কেনা, বিদ্যুৎ কো-জেনারেশ করার কথা আছে। র-চিনি আমদানি করে পরিশোধিত চিনি উৎপাদন, মোলাসেস থেকে ইথানল বানানো, বায়োগ্যাস উৎপাদনের প্রস্তুতি নেওয়ারও কথা আছে। একই সঙ্গে সার বানানোর নির্দেশ আছে। এসব সার আখ এবং সুগার বিট উৎপাদনে ব্যবহার করার কথা। সুগার বিট ‘চিলার স্টোরেজ’ নির্মাণ করে সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এসব উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ পর্যন্ত সরকারের ৯ চিনিকল বন্ধ করা হয়েছে।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ দেশে অনেক ভালো উদ্যোগও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে বছরের পর বছর আটকে থাকে। প্রধানমন্ত্রী গতিশীল অর্থনীতি চান। এজন্য গতিশীল শিল্প খাত প্রয়োজন। অতীতে দেখেছি সরকারের সর্বোচ্চপর্যায়ের অনেক নির্দেশও এ দেশে এই হচ্ছে, এই হচ্ছে করে বছরের পর বছর পড়ে থাকে। এটা কিন্তু নতুন কিছু নয়। এই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর যে দুই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়েছে তা হলো, বরগুনায় এবং রাজশাহীতে বিসিক শিল্প নগরী স্থাপন। জেলাপর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা নির্মাণের উদ্যোগকে উৎসাহিত করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে শিল্পনীতিতে সহায়ক সুযোগ রাখা, অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডে জনবল নিয়োগ, বিএসটিআইয়ের মানের উন্নয়ন, সময়মতো জাতীয় শিল্পনীতি প্রণয়নসহ ৩৫টি নির্দেশ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিল্প মন্ত্রণালয়ে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশ দ্রুত বাস্তবায়নে চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি সবগুলো শেষ হয়ে যাবে। এতে শিল্প খাতে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।