
বাংলাদেশিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে বুধবার রাতে। তার কয়েক ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে এবং মার্কিন নতুন ভিসানীতির খড়গ নিয়ে নির্বাচনে সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক পক্ষ এবং বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জায়েদা খাতুনের বিজয়ী হওয়া ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হেরে যাওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির প্রতিফলন। নির্বাচনের ফলাফলের পর থেকেই রাজনৈতিক ও বিভিন্ন মহলে এটিই এখন আলোচনার বিষয়। কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও স্থানীয় সরকার বিশ্লেষকরাও এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, এর মাধ্যমে সব রাজনৈতিক পক্ষই চাপে পড়বে। এর মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ এ নির্বাচনটি জনগণ তথা ভোটাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে হয়েছে। আর ফলাফলও হয়েছে কাক্সিক্ষত। আবার সরকারকেও তাদের পক্ষ থেকে দেওয়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে হবে। ট্রায়াল রানে আউয়াল কমিশন উতরে গেলেও তাদের এ মান ধরে রাখতে হবে। না হয় নতুন ভিসানীতির আওতায় তারাও পড়ে যাবে। তাই নতুন ভিসানীতির পর গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল ও নির্বাচনের পরিবেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্যই একটা নতুন বার্তা।
তবে কেউ কেউ বলেন, নতুন এ ভিসানীতি অনেক বড় খড়গ। তাই সব পক্ষকেই এ বিষয়টি মাথায় নিতে হবে। ১৭ কোটি জনগণের ওপর এ নীতি ঝুলে আছে। তারা বলেন, নির্বাচনে সংসদের বাইরে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ না নিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লার সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আলোচনায় ছিলেন দলটির সাবেক মেয়র ও দল থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং প্রার্থী মনোনয়ন থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত জাহাঙ্গীর ও মেয়র প্রার্থী তার মা জায়েদা খাতুন সুষ্ঠু নির্বাচন এবং নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন। এ আশঙ্কা কথা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দুদিন আগে জায়েদা খাতুন ঢাকায় কয়েকটি দূতাবাসকেও অবহিত করেন।
সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, কয়েকটি দূতাবাসের মধ্যে জায়েদা খাতুন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসকেও বিষয়টি অবহিত করেন। এর আগে গত ৩ মে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দেশটির নতুন ভিসানীতি ঘোষণার একটি চিঠি পাঠানো হয়। এ চিঠির বিষয়টি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র কেউই প্রকাশ করেনি। কিন্তু গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগেই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ নতুন ভিসানীতির বিষয়টি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। এর কয়েক মিনিট আগে ব্লিঙ্কেন তার টুইট বার্তায়ও বিষয়টি উল্লেখ করেন। এরপর বৃহস্পতিবার একদিকে গাজীপুর নির্বাচন চলে আর অন্যদিকে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নতুন ভিসানীতি নিয়ে দেশের বড় তিন দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে এবং পরে বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নতুন ভিসানীতির ব্যাখ্যা করেন। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টই বার্তা দেয়, তারা অংশগ্রহণমূলক বিষয় নিয়ে মোটেও ভাবছে না। তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমেরিকা বলতে গেলে ভিসার ব্যাপারে সব দলকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। সরকারি এবং বিরোধী দল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। তারা মূলত ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচনের কথা বলছে। এখন বিএনপির যে দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সে ব্যাপারে তারা মনে হয় পরিষ্কার। তবে গাজীপুরের মতো যদি নির্বাচন হয়, যেখানে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়, তাহলে সেটি চলবে বলে তারা মনে করছে। এখন গাজীপুরের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। যার জন্য বিএনপির ওপর এখন অনেকটা চাপ পড়বে। কারণ বিএনপির এখন যে দাবি ছিল সেটা আর থাকল না। তারা যদি অহেতুক নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলে তাদের ওপরও ভিসানীতির প্রয়োগ আসবে। এখন বিএনপির চিন্তা করতে হবে। বিএনপি এখন যদি বয়কট করে আর গাজীপুরের মতো এরকম নির্বাচন হয়, তাহলে তো আমেরিকা মেনে নেবে। আমেরিকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মিত্র এবং পশ্চিমা দেশ তাদের দাবিগুলো মেনে নেবে। সেখান থেকে মনে হলো যে আমেরিকা কিছুটা সরে গেল। এদিকে সব দলের ওপর ভিসা রেসটিকশনের কথা বলল আর এদিকে সরকার প্রথম থেকে বলছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করব এবং গাজীপুরের মাধ্যমে সরকার দেখাতে পারল। এর আগে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনও দেখিয়েছে সরকার। এখন বিএনপির বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন আমাদের দেশে আন্দোলন করা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এখন লাখ লাখ মানুষ যখন রাস্তায় নামে সারা বাংলাদেশে তখন একটা পরিবর্তন হয়। জনগণ যদি সে তাগিদ অনুভব করে তাহলে তারা রাস্তায় নামবে। তবে সেটি তো গাজীপুরে দেখে মনে হলো না। সেখানে সবার ভোট প্রয়োগ হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটি দেখার দরকার। আর সরকারি দলও স্বাভাবিকভাবে সচেতন থাকবে যেন কোনো কিছু তার বিপক্ষে কেউ চলে না যায়। বাংলাদেশের নির্বাচন কাঠামো এবং রাজনীতিক কাঠামো প্রচন্ড বিভাজনের মধ্যে আছে। যে জিতে সে শতভাগ পেয়ে যায় আর যে হারে সে একেবারে শূন্যে নেমে যায়। এমন বাস্তবতায় ভিসার থেকে জেতাটা জরুরি। অনেকে ভাববেন, এখন যদি নাই জিতি তাহলে ভিসা দিয়ে তো আর কিছু হবে না।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেদিন নির্বাচন তার আগের দিন আমেরিকা ভিসার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বড় আকারে। এটি ১৭ কোটির মানুষের ওপর দেওয়া হয়েছে। দেশের ভেতরে যারা বসবাস করে তাদের ওপর এবং যারা বাইরে আছে তাদের ওপরও দেওয়া হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের নির্বাচনে। যেখানে দেখা গেল জাহাঙ্গীরের মায়ের পোলিং এজেন্ট ছিল না, পর্যবেক্ষকরা তাদের সেখানে পায়নি। আমরা যেটা জানি যেখানে পোলিং এজেন্ট থাকে না সেখানে পরাজিত হয় প্রার্থী। সেখানে কিন্তু জাহাঙ্গীরের মা পাস করেছেন। কারণ নিষেধাজ্ঞার পর প্রবল উৎসাহে সবাই ভোটকেন্দ্র গেছে, সবাই ভোট দিয়েছে। এর পাশাপাশি তাদের ওপর হামলে পড়ার যে শঙ্কা ছিল সেটিও সেখানে হয়নি। কারণ কোনো অবস্থায় কেউ মার্কিনিদের তোপের মুখে পড়তে চায়নি। তাই নতুন এ ভিসানীতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সবরকম প্রভাব ফেলেছে বলে আমি মনে করি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ ভোটে দৃশ্যমানভাবে কোনো অশান্তি ঘটেনি। তবে আমি মনে করি মার্কিন নতুন ভিসানীতির প্রভাব পড়েছে এ নির্বাচনে। আমরা দেখছি, যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধের কথা বলেছে, সেটা জন্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের লোকজন, এমনকি নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে বলা হয়েছে। ফলে তারা এখন বিষয়টি মানতে বাধ্য। তবে আমি মনে করি এ নির্বাচনে থেকে কোনোভাবেই বলা যাবে না আগামী জাতীয় নির্বাচনও এমনটা হবে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের অনেক হিসাব-নিকাশ রয়েছে। সেখানে ক্ষমতার রদবদলের বিষয় আছে। আবার এটাকে নির্বাচন কমিশনের ট্রায়াল রান পাস করাও বলা যাবে না।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ওয়ালি উর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান ও এর ফলাফলের সঙ্গে মার্কিন নতুন ভিসানীতির কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ গাজীপুর সিটিতে যিনি জয়ী হয়েছেন, গত কয়েক দিন থেকেই আলোচনায় ছিলেন। তিনি ভোটের মাঠে এগিয়ে ছিলেন। সেই ফলাফলই পেয়েছেন।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় নিয়ে নানা কাটাছেঁড়া হচ্ছে। এই পরাজয় দলের জন্য সতর্কবার্তা কি না, সেই আলোচনাও হচ্ছে। এই কাটাছেঁড়া আর আলোচনার বিষয় আওয়ামী লীগই। কারণ আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়রের মায়ের কাছেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরেছেন। ফল ঘোষণার পর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের ছেলে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘নৌকা জিতেছে, ব্যক্তি হেরেছে।’
যদিও ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমন্ডলীর এক নেতা বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের ভোটে জায়েদা খাতুন জিতেছেন। তবে সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেছেন, আজমত উল্লা খানকে পরাজিত করে জানান দিয়েছে ক্ষমতায় থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘আওয়ামী লীগ’ অনেক শক্তিশালী।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আরেকটি ‘আওয়ামী লীগ’ জন্ম নিয়েছে। প্রথমেই দলে ঢুকে, এরপর নিজেদের ভিত শক্ত করে পদ-পদবি বাগিয়েছে স্বার্থান্বেষী একদল লোক। তারা আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারাই দলের ভেতর দল, ঘরের ভেতর ঘর তৈরি করা শুরু করে এবং এখন তাদের সংখ্যায়ও এখন অনেক বেশি হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের ওই নেতারা দাবি করেন, ২০১২ সালের পরে আওয়ামী লীগের ভেতরে বেড়ে ওঠা এ ‘আওয়ামী লীগ’ নিজেদের শক্তিশালী করার সুযোগ পায়। তখন দল বদল করার হিড়িক পড়ে, আওয়ামী লীগ তাদের নৌকায় তুলে নেয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখন আমি কিছু বলব না।’ তবে খুব শিগগির দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভা হবে, সেখানে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হবে বলে তিনি জানান।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাংশ দাবি করেন, আজমতের মতো পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থীকে হারিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করেছে ক্ষমতায় থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘আওয়ামী লীগ’। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও গাজীপুর সিটির দৃষ্টান্ত টেনে মনোনয়ন বোর্ডকে চাপে ফেলবে এই ‘আওয়ামী লীগ’। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এ নেতারা আরও বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাবশালী একটি অংশ ক্ষমতার সাধ পেয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ হওয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা করে দলে ক্ষমতাশালী হয়েছেন। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে, দলে নিজের ভিত্তি মজবুত করতে ক্ষমতা ও পদ দিয়ে তাদের পুষেছেন অনেকেই।
গাজীপুরের ভোট পর্যালোচনা করে কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, ‘আমাদের প্রার্থী আজমত উল্লা দেখা যায় মাত্র আড়াই শতাংশ ব্যবধানে জিতেছে। এতে বোঝা যায় আওয়ামী লীগের সবাই ভোট দিয়েছে। অপর প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন জিতেছেন বিএনপি-জামায়াতের ভোটে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় ৬ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছে। জাতীয় পার্টির ভোট তাদের প্রার্থী পেয়েছে। ইসলামি আন্দোলনের ভোট তাদের প্রার্থী পেয়েছে। বিএনপি-জামায়াত ঐক্যবদ্ধ হয়ে জায়েদা খাতুনকে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে হারিয়েছে। নৌকাকে হারানোর এটাই ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, দলের ভেতর দল তৈরি করা ‘আওয়ামী লীগ’ সারা দেশেই এখন অনেক শক্তিশালী। গত বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমতউল্লা খানকে পরাজিত করে জানান দিয়েছে ক্ষমতায় থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘আওয়ামী লীগ’ অনেক শক্তিশালী।
গাজীপুর সিটির ভোটের ফলাফলে দলের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের এ প্রতিবেদকের। ভোটে হারার কারণ বলতে গিয়ে ক্ষুব্ধ ওই অংশটি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ক্ষমতায় থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘আওয়ামী লীগ’ই হারিয়েছে আওয়ামী লীগকে। তারা দাবি করেন, দল মনোনীত মেয়র প্রার্থী আজমতউল্লা খানের পরাজয়ের ভেতরের একমাত্র কারণই এটি। তৃণমূল আওয়ামী লীগের সিলেট, টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে গাজীপুর সিটির ভোট নিয়ে পর্যালোচনায় বিষয়গুলো তুলে ধরলেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তাদের অনেকেই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গাজীপুরকে দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ হিসেবে একসময়ে ধরা হতো। সেই অঞ্চলকে নব্য আওয়ামী লীগ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে ২০১৩ সালে গাজীপুরে প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। বলা হয়, তখনো আজমতকে হারানো হয়েছে জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্ব গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ। সেখানে বলা হয়, আওয়ামী লীগের চেয়ে “জাহাঙ্গীর লীগ” শক্তিশালী। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নিজের মা জায়েদা খাতুনকে মেয়র পদে জিতিয়ে এনে ‘জাহাঙ্গীর লীগ’ই গাজীপুরে শেষ কথা, এটা প্রমাণ করেছে।’
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জাহাঙ্গীর আলমকে আজকের এ জায়গায় নিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। ২০১৩ সালেও তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। ২০১৮ সালে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়ে মেয়রও বানিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের ওই অংশটি। এর আগে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ দেওয়া হয় দলীয় সিদ্ধান্ত শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে। গাজীপুরে সিটি ভোটে আওয়ামী লীগের পরাজয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আস্থাশীল আওয়ামী লীগকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্ষমতায় থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘আওয়ামী লীগের’ শক্তির কথা।
আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া ‘আওয়ামী লীগের’ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, আওয়ামী লীগকে ধরাশায়ী করার ক্ষমতা তাদের আছে, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন দলটির বহিষ্কৃত নেতা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ-অধ্যুষিত গাজীপুরে ‘জাহাঙ্গীর লীগ’ বড় ফ্যাক্টর এখন। আজমতের মতো দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের নেতা কেবল নির্বাচনের সময় আলোচনায় আসা একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন, এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
ক্ষোভ প্রকাশ করে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, শুধু গাজীপুরেই নয়, সারা দেশেই আওয়ামী লীগের চেয়ে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে বেড়ে ওঠা ‘আওয়ামী লীগ’ আছে। সময় ও সুযোগ পেলে তারা দলের বিরুদ্ধে যাবে, শৃঙ্খলা নষ্ট করবে কখনো দলের অবস্থান বিরোধী বক্তব্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১৫ বছর সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগ চাপে ফেলে দিয়েছে ত্যাগী আওয়ামী লীগকে। ‘ব্যক্তি লীগ’কে শক্তিশালী করা নেতারা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে যা চেয়েছেন, তা-ই পেয়েছেন। ফলে আদর্শিক নেতারা ঘরে ঢুকে গেছেন, তেমন কর্মীরাও রাজনীতি ছেড়েছেন, মাঠ ছেড়েছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে হারিয়ে নির্বাচিত মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগ ফলাফল মেনে নিয়েছে বলে জানান তিনি। গতকাল শুক্রবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে দলের পক্ষ থেকে এসব কথা বলেন তিনি।
গাজীপুরের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা টিমের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। তাতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। আমরা সেই পরাজয় মেনে নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘খুব শিগগির দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় নির্বাচন নিয়ে পর্যালোচনা হবে। পরে বলব পরাজয়ের কারণ।’
গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমতউল্লা খানকে পরাজিত করেছেন। এই প্রথম নারী মেয়র পেল গাজীপুর সিটি। এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে সেলিনা হায়াত আইভী দেশের প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন।
আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি মো. আমিনুল ইসলাম স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের পরাজয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের জয়ের কারণ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে গতকাল সারা দিনই আলোচনা হয়েছে। তাদের আলোচনা থেকে আওয়ামী প্রার্থীর পরাজয়ের ১০টি কারণ জানা গেছে।
নগরবাসী বলছেন, নৌকা জয়লাভ করবেই এমন অতি আত্মবিশ^াস, প্রতিপক্ষ প্রার্থী ও তার কর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, শঙ্কায় ভোটারদের কম উপস্থিতি, নৌকার নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি, আজমতউল্লা খানের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কম থাকা, মিডিয়ার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা, প্রতিপক্ষের এজেন্ট ও কর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশের হানা দেওয়া, প্রতিপক্ষের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা এবং শ্রমিক, আলেম-ওলামাদের ভোট টানতে না পারাকেই বেশি দায়ী করেছেন তারা।
জয়দেবপুর শহরের বাসিন্দা চাকরিজীবী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘উন্নয়নকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। আর প্রতিপক্ষকে নির্যাতন করে নিজেদের ভোট বাড়ানো যায় না। বলপ্রয়োগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে জনসমর্থন বাড়ে না, বরং কমে। এ নির্বাচনে মানুষ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। দুঃসময়েও নেতাকে কর্মীর পাশে আর কর্মীদেরও নেতার পাশে থাকতে হয়।’
অন্যদিকে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের জয়লাভের জন্য সাত কারণকে চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন। এর মধ্যে রয়েছে জায়েদা খাতুনের ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের জনপ্রিয়তা, তার নামে মামলা ও অপপ্রচার, তিন বছর মেয়র থাকাকালে নগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন, দলে না থেকেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে সব সময় সুসম্পর্ক রাখা, জায়েদা খাতুনের প্রতি নারীদের ভালোবাসা, কৌশলী নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা, প্রতিপক্ষের হামলার ঘটনায় ভোটারদের সহানুভূতি পাওয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম প্রথমবার দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কারণে দলের দুই শতাধিক সিনিয়র নেতাকে শোকজ করা হয়। এরপর দ্বিতীয় দফা বহিষ্কারের পর ফের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বেশ কিছু নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এতে দলের ক্ষুব্ধ একটি অংশ পর্দার আড়ালে জাহাঙ্গীর আলমের মায়ের পক্ষে কাজ করেছেন।’
সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্যাহ মন্ডল সাংবাদিকদের বলেন, ‘দলীয় ফোরামে আলোচনা করে খোঁজখবর নিয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করব।’
বৈশ্বিক কারণে দেশের বাজারে পণ্যের দামের বাড়ন্ত অবস্থা ঠেকাতে আগামী বাজেটে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং সরকারের আয় বাড়াতে ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানতে গিয়ে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে অনেক খাতে খরচ বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে বলে অর্থনীতির বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
নির্বাচনের আগের শেষ বাজেট হওয়ায় ব্যবসায়ীদের খুশি করতেও কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতায় তার সুফল কতটা মিলবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের আয় বাড়েনি বললেই চলে। আগামী বাজেটে আয় বাড়াতে সরকার অনেক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। এতে অনেক খাতে খরচ আরও বাড়বে। নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট হওয়ায় নির্বাচনী চমক হিসেবেও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশি^ক কারণে এসবের সুফল পাওয়া কঠিন। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা একবার দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা শুরু করলে তা আর কমাতে চায় না।’
গত মাস ছয়েক ধরে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৮-৯ শতাংশের ঘরে। সরকার দাম কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও সেসবের সুফল তেমন পাওয়া যায়নি। এক বছর ধরে সব ধরনের চালের দাম বেশি। আটা, ময়দা, চিনি, ভোজ্য তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ। দাম বাড়তি বলে মাছ, মাংস, ডিম, দুধসহ অনেক খাবার সাধারণ আয়ের পরিবারগুলো খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেও আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, ভোজ্য তেল, চিনি, ফল, লবণের দাম কমানোর চেষ্টা করা হয়নি।
আইএমএফের শর্তে রাজস্ব সুবিধা কমানোয় পাউরুটি, বিস্কুট, সাবান, শ্যাম্পু, প্রক্রিয়াজাত খাবারের দাম বাড়বে। ভ্যাটের হার বাড়ানোয় মিষ্টির দামও বাড়বে। দেশে উৎপাদিত জুতা, স্যান্ডেলের দাম কমানো হচ্ছে না। আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়বে। আগামী অর্থবছরেও চেইন শপ থেকে পণ্য কিনতে হলে ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশের সঙ্গে আরও ৫ শতাংশ বাড়তি দিতে হবে ক্রেতাকে। খামারে চাষ করা ৩০ লাখ টাকার বেশি মাছ বিক্রিতে ১৫ শতাংশ রাজস্ব থাকছে। একই সঙ্গে বড় মাছ আমদানিতেও সম্পূরক শুল্ক আসছে। শুল্ক-করের মারপ্যাঁচে আমদানিকৃত ও দেশে চাষ করা বড় মাছের দাম কমানোর সুযোগ থাকছে না। আগামী অর্থবছরের রাজস্ব বাজেট প্রস্তাব ও প্রস্তাবিত অর্থ বিল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী অর্থবছরে মোবাইল ব্যবহারে খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশি কোম্পানির মোবাইলের উৎপাদন পর্যায়ে তিন স্তরে ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। নিজেরা যন্ত্রপাতি বানিয়ে উৎপাদন করলে ৩ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। সংযোজন করলে দুভাবে ভ্যাট আরোপ হবে। কমপক্ষে দুটি যন্ত্রাংশ নিজেরা বানিয়ে মোবাইল উৎপাদন করলে ৫ শতাংশ এবং সব যন্ত্রাংশ আমদানি করে সংযোজন করলে সাড়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশ ভ্যাট বসতে পারে। অন্যদিকে ফ্রিজ তৈরির উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানি এবং স্থানীয় ক্রয়ের ক্ষেত্রে কর ছাড় সুবিধা রয়েছে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এ সুবিধা বাড়ানো না হলে এ পণ্যের দামও বাড়বে। আমদানিকৃত মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও মোটরসাইকেলের দাম কমাতে কিছু থাকছে না। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার প্রভাব এড়াতে বাজেটে কিছু না থাকায় দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত অর্থ বিলে ভ্রমণকর ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সব ধরনের পরিবহনে যাতায়াতে খরচ বাড়ছে। আগামী বাজেটে গাড়ির মালিকদের খরচ অনেকটা বাড়ানো হয়েছে। একাধিক গাড়ি আছে এমন করদাতাদের দ্বিতীয় গাড়ির নিবন্ধন ও নবায়নের সময় ২৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত কার্বন কর দিতে হতে পারে। একই সঙ্গে উচ্চ সিসির অর্র্থাৎ দামি গাড়ির শুল্ক হার বাড়ানো হতে পারে। ২০০১ থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির সম্পূরক শুল্ক ২০০ থেকে বাড়িয়ে ২৫০ শতাংশ ও ৩০০১ থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ শতাংশ করা হতে পারে। বিদ্যমান আইনে অগ্রিম কর ২৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা; এ হিসাব ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে অর্থ বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আবাসন খাতে নিবন্ধন ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে এনবিআর। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের এতে আপত্তি আছে। প্রস্তাব কার্যকর হলে আগামী অর্থবছরে ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম বাড়বে। ধোঁয়া ও ধোঁয়াহীন তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও করা হয়েছে। আমদানিকৃত মদের দাম কমাবে না। বিলাসবহুল অনেক পণ্যের শুল্ক হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
আমদানি শুল্ক বাড়ানোয় বিদেশি খেলনার দাম বাড়বে। দেশি খেলনার দাম কমবে না। বিউটি পার্লারের খরচ, প্রসাধনী ও জুয়েলারির দাম বাড়বে। সোনার দাম কমাতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোতে প্রিন্টিং প্লেট, লিফট, সোলার প্যানেল, মিটার, কম্পিউটার প্রিন্টার, টোনার, বিদেশি চকলেট, বাটার, চিজ, প্রক্রিয়াজাত ও রেডি টু কনজিউম কফির দাম বাড়তি থাকছে। বিদেশি গ্যাস লাইটার ও দেশলাই আমদানি খরচও বাড়তি থাকতে পারে। বোতলজাত পানি ও বাসাবাড়িতে পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ব্যবহৃত ওয়াটার পিউরিফায়ারের দামও বেশি থাকতে পারে।
ক্লাডউ সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস ও ফ্রিল্যান্সিং খাতে রাজস্ব ছাড় না দেওয়ায় খরচ কমছে না।
সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। আগামী বাজেটে কৃষি যন্ত্রপাতিতে রাজস্বের থাবা বসানো হয়নি। তবে বৈশি^ক কারণে দাম বাড়লে তা ঠেকানোর পদক্ষেপ নেই।
আগামী বাজেটে মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের উৎপাদনে আগ্রহী করতে দেশি শিল্পের সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ছাড় দেওয়া হয়েছে। দেশি শিল্পে চাহিদা বেশি এমন অনেক কাঁচামালের আমদানি শুল্কে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, লোহার রড, স্ক্র্যাব, মোটরসাইকেল ও গাড়ির যন্ত্রাংশ, নির্মাণসামগ্রী, টেক্সটাইল, চামড়া খাত, পাটশিল্প, দেশি টেলিভিশন, এসি, মোবাইল, ওষুধ ও অটোমোবাইল শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে ছাড় থাকছে। সম্পূর্ণ আমদানিকৃত মোটরসাইকেলের চেয়ে দেশে সংযোজিত বা উৎপাদিত মোটরসাইকেল শিল্পে বেশি সুবিধা থাকছে। মোটরসাইকেল উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ আমদানিতে নিম্ন হারে শুল্ক হার বহাল থাকছে। জ্বালানি খাতে দফায় দফায় দাম বাড়ানোয় শিল্প খাতে সংকট বেড়েছে। জ্বালানির ১৩ পণ্যে অগ্রিম কর অব্যাহতি দিয়ে দাম বাড়ার ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড এবং সফটওয়্যার উন্নয়নে বিদ্যমান সুবিধ বহাল থাকছে।
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন কাস্টমাইজেশন, এনটিটিএন, ডিজিটাল কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ডিজিটাল অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট সার্ভিস, ওয়েব লিস্টিং, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, ডিজিটাল গ্রাফিকস ডিজাইন, ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি অ্যান্ড প্রসেসিং, ডিজিটাল ডেটা অ্যানালিটিকস, জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস, আইটি সাপোর্ট অ্যান্ড সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, সফটওয়্যার ল্যাব টেস্ট সার্ভিস, কল সেন্টার সার্ভিস, ওভারসিজ মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভারশন, রোবোটিকস প্রসেস আউটসোর্সিং ও সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস খাতে খরচ বাড়ানো হয়নি।
শৈশব থেকে এলাকার মাদক, জলাবদ্ধতা, গ্যাস ও পানির সংকট, বেহাল সড়ক দেখে বড় হয়েছেন। দেখেছেন খেলার মাঠ নেই, টেকসই আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় নগর সংস্থার নিদারুণ অমনোযোগ। নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে এমন অবহেলা, বঞ্চনা কিংবা মাদকের ভয়ংকর বিস্তার ছোটবেলা থেকেই যাকে প্রতিবাদী করে তুলেছিল এবং এখনো যার প্রতিবাদ জারি আছে তিনি হলেন মিজানুর রহমান।
পুরান ঢাকার পূর্ব জুরাইন অবহেলিত এক জনপদ। এখানে সুপেয় পানি ও গ্যাসের সমস্যা প্রকট। জলাবদ্ধতা ও এডিস মশার উপদ্রবেও নাকাল মানুষ। প্রায় ৫০ বছর আগে ওই জনপদে জন্ম নেন মিজানুর রহমান।
কৈশোর থেকে শুরু তার সমাজসেবা ও নাগরিক সেবার আন্দোলন। প্রথমে বন্ধুবান্ধব নিয়ে এলাকায় মাদকবিরোধী প্রচার ও রক্তদান কর্মসূচি শুরু করেন। এরপর ছোট্ট পরিসরে আন্দোলন। ধারাবাহিক নাগরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন তাকে দেশব্যাপী পরিচিত করে তুলেছে। চলার পথে নানা হুমকি, মামলা, পুলিশি হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন; তবুও লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। দেশের মানুষ তাকে চেনেন নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে।
মিজানুর রহমান সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা একজন মানুষ। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। টানাটানির সংসারে লেখাপড়ার ভিত দুর্বল ছিল; শৈশবে বড় ভাইয়ের সঙ্গে অন্যের দোকানে কাজ করেছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করে উচ্চমাধ্যমিকের চৌহদ্দি পার হয়ে স্নাতক (পাস) শ্রেণিতে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তবে শেষ করা হয়নি। মিজানুর পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মৌসুমি বিভিন্ন ফলের ব্যবসা করেন। তিন মেয়ের বাবা মিজানুরের সংসার চলে ব্যবসার পাশাপাশি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দোকান ভাড়া ও স্ত্রীর বাড়ি বাড়ার টাকায়।
আরও জানা যায়, কৈশোরে নাগরিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া মিজানুর ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৮৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় এলাকায় মাদকবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এ কাজে নানা হুমকি পেয়েছেন। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। নাগরিক অধিকার আদায়ে সহায়ক হবে ভেবে রাজনীতিতে যুক্ত হলেও শেষমেশ তার লক্ষ্য পূরণ হয়নি। ১৯৯৮ সালে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত হন।
মিজানুর দেশ রূপান্তরকে বলছিলেন, ‘জনসেবা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার মানসিকতা থেকে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম, মানুষের কথা কেউ বলে না। ব্যক্তিস্বার্থ বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় সেখানে। এ জন্য রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছি। সে সময় কিছু অফারও ছিল; কিন্তু সেসব আমায় টানেনি।’
তিনি বলেন, তার নাগরিক আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট সংগঠন বা প্ল্যাটফর্ম নেই। প্রধানত পূর্ব জুরাইন এলাকার সমস্যা সমাধানে বেশি কাজ করেন। এ ধরনের আন্দোলন পূর্ব জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের ব্যানারে করা হয়। এর বাইরে ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সঙ্গে কাজ করেছেন। ঢাকা থেকে বিবিয়ানা লংমার্চে যোগ দিয়েছেন। তবে এখন পূর্ব জুরাইন এলাকার নাগরিক সমস্যা সমাধানের বিষয়েই বেশি সোচ্চার।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি যে বিষয়গুলো নিয়ে আন্দোলন করছি, এগুলো এলাকার সমস্যা ও নাগরিকদের পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কেননা, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো তার বিনিময়ে মাস শেষে বিল আদায় করছে। আমাদের এলাকায় অনেক শিক্ষিত ও ভালো মানুষ রয়েছে; কিন্তু তারা এসব নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করছেন না। এ জন্য আমি মাঠে নেমেছি। এ কাজগুলো অন্য কেউ করে দিলে আমি এ কাজে মনোযোগী হতাম না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেসব ভালো মানুষ অন্যায় ও অপরাধ দেখেও প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকেন, তাদের আমি ভালো মানুষ বলতে চাই না। কেননা, তারা সোচ্চার হলে খারাপ মানুষগুলো সমাজে এভাবে জেঁকে বসতে পারত না।’
তিনি মনে করেন, ‘সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও অধিকার আদায়ের জন্য কথা বলার লোক থাকতে হবে। যাদের অনুসরণ করে নতুন প্রজন্ম সেই সব কাজে আগ্রহী হবে। এখনকার সময়ে আমরা সমাজে এমন লোক খুঁজে পাচ্ছি না। খারাপগুলো সমাজে প্রভাব বিস্তার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করছে; আর তথাকথিত ভালো লোকগুলো চুপ করে বসে রয়েছে।’
মিজানুরের নাগরিক আন্দোলন : ২০১২ সালে পূর্ব জুরাইনে জলাবদ্ধতা, ঢাকা ওয়াসার দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি ও গ্যাসের নিম্নচাপসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পূর্ব জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের ব্যানারে এ আন্দোলন করেন তারা। ওই সময় তিতাস গ্যাস কোম্পানি ও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে লিখিতভাবে জানান।
২০১২ সালে সড়কে নিম্নমানের কাজের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারের কাজ বন্ধ করে দেন মিজানুরসহ কয়েকজন। ওই ঘটনায় তৎকালীন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের অনেক হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন। একই বছর পূর্ব জুরাইনের ৩০০ মিটার সড়ক তাদের চেষ্টায় জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়েছিল। ওই সড়কটি ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হাঁটুসমান পানির নিচে তলিয়ে থাকত। কাউন্সিলর, সংসদ সদস্যসহ কেউ সমাধানে এগিয়ে আসেননি। ২০১২ সালে মিজানুর ও তার বন্ধুরা মিলে চার দিনে নিজেরা কাজ করে ওই জলাদ্ধতা নিরসন করেন।
দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহের প্রতিবাদে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকা ওয়াসায় গিয়েছিলেন। সংস্থার তৎকালীন এমডিকে ওই দুর্গন্ধযুক্ত পানির শরবত খাওয়াতে চেয়েছিলেন জুরাইন এলাকার লোকজন। ওই আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মিজানুর রহমান। সে সময় ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে পানি সমস্যার সমাধান করে ওই এলাকায় গিয়ে বিশুদ্ধ পানির শরবত খেয়ে আসার প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়েছিল। তিন বছর অতিবাহিত হলেও ওই এলাকার পানির সমস্যার সমাধান হয়নি। শরবত খেতেও যাননি ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তারা। উপরন্তু প্রতিবাদকারীদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। প্রায় এক যুগ ধরে দূষিত পানি ব্যবহার ও পানি কিনে পান করছে ওই এলাকার প্রায় ১০ লাখ মানুষ।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারী রূপ ধারণ করলে প্রতিবাদ করেন মিজান। তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তাকে আটক করান। ঘটনাস্থলে একজন সাংবাদিক উপস্থিত হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই সময় মেয়র ছিলেন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব গ্রহণের পরও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। তখনো আন্দোলন করেন মিজান। ওই সময় মশককর্মীরা তার বাড়িতে গিয়ে মশার ওষুধ ছিটান (ফগিং) যে তার বৃদ্ধ মা ও পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মিজানুর রহমানকে ভালোভাবেই চেনেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও নাগরিক অধিকার কর্মী মারুফ হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০ বছর ধরে পূর্ব জুরাইনের মিজান ভাইকে চিনি। তিনি নাগরিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন; কথা বলছেন। এই জায়গায় এখন কাজ করার লোকের সংখ্যা খুবই কম। আর যারা করছেন, অনেকের দ্বৈত-নীতি লক্ষ করা যায়; কিন্তু মিজান ভাইকে ব্যতিক্রম মানুষ হিসেবে দেখছি।’
নিজের হাতে গড়ে তোলা মেয়েদের হতাশা আর সহ্য করতে পারলেন না গোলাম রব্বানী ছোটন। এর সঙ্গে মেয়েদের ফুটবল এগিয়ে নিতে দীর্ঘ ১৪ বছর যে শ্রম-ঘাম দিয়েছেন, তার মূল্যায়নও হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে ক্লান্তি-হতাশা পেয়ে বসেছিল তাকে। তাই তো হুট করেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ছোটন। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেবেন বাফুফে কার্যালয়ে।
আগামী ১ জুন থেকে তিনি আর থাকছেন না নারী ফুটবলের দায়িত্বে। বিষয়টি গতকাল শুক্রবার নিজেই দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন ছোটন।
মেয়েদের বয়সভিত্তিক থেকে শুরু করে জাতীয় দল সব আন্তর্জাতিক সাফল্যই এসেছে তার কোচিংয়ে। আজকের সাবিনা, সানজিদা, কৃষ্ণা, মারিয়াদের নিজের সন্তানের মতো লালন করে গড়ে তুলে দিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মন্ত্র। অথচ তার কাজের যোগ্য মূল্যায়ন করেনি বাফুফে।
এই তো কিছুদিন আগেও খোদ বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ভিনদেশি টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলির কাজের ফিরিস্তি গাইতে গিয়ে সরাসরি অস্বীকার করেছেন ছোটনের অবদান। নিজেদের মধ্যে আলোচনায় প্রায়ই সালাউদ্দিন বলে থাকেন, মেয়েদের ফুটবলে ছোটনের তেমন কোনো অবদান নেই। সবকিছুই নাকি করেছেন পল স্মলি। পল চলে গেলে নাকি ৯ মাসেই ভেঙে পড়বে মেয়েদের ফুটবলের অবকাঠামো।
এতদিন এসব মুখ বুঝেই সহ্য করেছেন ছোটন। নিজের কাজটুকুতেই দিয়েছেন সব মনোযোগ। তবে সহ্যেরও একটা সীমা থাকে। সেই ২০০৯ সাল থেকে মেয়েদের ফুটবলের দায়িত্বে তিনি। ভোরের সূর্য ওঠার আগে থেকেই শুরু হয় তার ব্যস্ততা। কখনো সিনিয়র জাতীয় দল, কখনোবা বয়সভিত্তিক দল। ক্লান্তিহীন চলে তাদের নিয়ে কাজ। এরপর তো আছে পল স্মলির অযাচিত হস্তক্ষেপ ও খবরদারি।
পদে পদে ছোটনদের পলের কাছে দিতে হয় জবাবদিহিতা। সেটাও মানা যেত, যদি কাজের মূল্যায়ন হতো, মিলত যোগ্য পারিশ্রমিক। সেটাও তো হচ্ছে না। এমনকি বাফুফের সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে সুইপার পর্যন্ত যখন ঈদ বোনাস পান, তখন কোচদের ভাগ্যে জুটে না উৎসব-ভাতা। এভাবে আর কতদিন?
সেপ্টেম্বরে সাফ জয়ের পর থেকেই সাবিনা, কৃষ্ণারা অপেক্ষায় আছেন মাঠে নামার। তবে বাফুফের একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্তে খেলার সুযোগ হারাচ্ছেন মেয়েরা। কোচ হিসেবে তাই প্রতিনিয়ত ছোটনকে ফুটবলারদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এটাও তার দায়িত্ব ছাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ বলে জানান।
চাকরি ছাড়ার কারণ হিসেবে ছোটন অবশ্য বাফুফের বঞ্চনাকে সামনে আনেননি। বরং ক্লান্তিকেই বড় হিসেবে সামনে এনেছেন অভিজ্ঞ এ কোচ, ‘সারা বছর মেয়েদের ক্যাম্প চলে। ভোর ৪টা থেকে শুরু হয়। কাজে কোনো বিশ্রাম নেই। ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু নেই। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ভুলে বছরের পর বছর কাজ করছি। তারপরও দেশের মেয়েদের ফুটবল যতটা মূল্যায়িত হওয়া উচিত ছিল, সেটা হয়নি। এসব দিক চিন্তা করেই চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ৩১ মে পর্যন্ত থাকব। এরপর আর থাকব না।’ সাফ শিরোপা জয়ের পর নভেম্বরেই বাফুফের চাকরি ছাড়তে চেয়েছিলেন ছোটন, পদত্যাগপত্র জমাও দেন কিন্তু পরে মত পরিবর্তন করেন। এবারে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার আগেই সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিয়ে ছোটন বুঝিয়ে দিলেন, ফেরার আর পথ নেই।
বাফুফের চাকরি ছাড়লেও ফুটবল কোচিং ছাড়ার কোনো ইচ্ছে ছোটনের নেই, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরি ছাড়ার পর কিছুদিন শুধু বিশ্রাম নেব। এরপর যদি কোনো ক্লাবে কাজ করার সুযোগ পাই, করব।’
প্রিয় কোচের বিদায়ের খবরে পাথর হয়ে গেছেন জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকা ফুটবলাররা। তাদের জন্য এ খবর যে অনেক বড় ধাক্কা। সালাউদ্দিনদের কাছে ছোটন কিছু না। তবে সাবিনাদের কাছে তো ছোটনই সব। সেই কোচ যখন থাকছেন না, তখন তো হতাশায় ভেঙে পড়া স্বাভাবিকই।
ছোটনের এ সিদ্ধান্তের আগেই অবশ্য ক্যাম্পের একটা রুগ্ণ চিত্র উঠে আসে জাতীয় দলের অন্যতম স্ট্রাইকার সিরাত জাহান স্বপ্নার অসময়ে অবসরের ঘোষণায়। এ কার্যকর স্ট্রাইকার গতকাল ক্যাম্প ছেড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছেন পেশাদার ফুটবল ছাড়ার খবর।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ ও ফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলে ইভিএমের কার্যকারিতার বিষয়টি আবার সামনে এলো। ফল ঘোষণায় বিলম্ব এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর অভিযোগ সব মিলিয়ে এ যন্ত্র ব্যবহারের সফলতা নিয়ে নতুন করে আবার প্রশ্ন উঠল।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ইভিএম কোথাও কোথাও নষ্ট হয়েছে, কোথাও আঙুলের ছাপ মেলেনি। অনেক ভোটার বুঝে উঠতে পারেনি, ঠিক কোথায় ভোট দিতে হবে। এতে করে ভোটের গতি ছিল ধীর। অনেক ভোটার ভোট না দিয়েই চলে গেছেন। ভোটগ্রহণ কম হয়েছে। এসব জটিলতায় নিয়েই পরবর্তী চারটি সিটি করপোরেশনে (সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী) ভোট করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে কার্যকর ফল পাবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজীপুরের ভোটে সারা দিন ভালো ছিল। শেষ মুহূর্তে ফল ঘোষণা করতে গিয়ে সবকিছু গুলিয়ে ফেলেছে ইসি। ইভিএমের ভোট গণনা হওয়ার কথা দ্রুত। সেখানে প্রায় সাড়ে ৯ ঘণ্টা পর ফলাফল ঘোষণায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। ইভিএম বাদ দিয়ে পরবর্তী চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ব্যালটে হলে ইসির জন্য জাতীয় নির্বাচনের ট্রায়াল হতো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
গত বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এ প্রতিবেদক অন্তত ১০টি কেন্দ্রের প্রায় ২৫টি বুথে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে টঙ্গী দারুস সালাম মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে সকাল থেকেই ভোটারদের লম্বা লাইন ছিল। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, কয়েকটা ইভিএম ঠিকমতো কাজ করছিল না। তাই ভোট দিতে দেরি হচ্ছিল। হানিফ সরকার নামে এক ভোটার অভিযোগ করেন, সাতবার আঙুলের ছাপে ভোট দিতে ব্যর্থ হয়ে পরে তিনি স্মার্টকার্ড দিয়ে ভোট দিতে পেরেছেন। এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার জাকির হাসান তালুকদার বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কয়েকটি মেশিনে ভোট দিতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে ভোটারদের। পরে সেগুলো ঠিক করা হয়েছে।’
হরিনাল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটার শফিকুর রহমান জানান, তিনি আগে কখনো ইভিএমে ভোট দেননি। তার ভোট দিতে প্রায় ১০ মিনিট সময় লেগেছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার হাসান ইমাম বলেন, বয়স্কদের ক্ষেত্রে অনেকের আঙুলের ছাপ মিলতে সময় লাগছে। ৭৩ নম্বর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে (৩ নম্বর বুথ) একটি ইভিএম মেশিন বিকল ছিল বেশ কিছুক্ষণ। এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আবদুল মোতালেব বলেন, ৭ নম্বর কক্ষে ইভিএমের একটি ভোটগ্রহণ মেশিনে সমস্যা হয়েছে। গাজীপুর আউচপাড়া নিউ ব্রুন স্কুল কেন্দ্রে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন ভোট দেন। সেখানে ইভিএম কাজ না করার কারণে তিনি বেশ কিছুক্ষণ ভোট দিতে পারেননি। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, মেশিনে বোধহয় একটু সমস্যা ছিল। মেশিনটা স্টার্ট দেওয়ার মুহূর্তে বোধহয় কিছুটা জটিলতা ছিল। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পরেই এটা ঠিক হয়েছে।
কেন্দ্র ঘুরে জানা গেছে, বয়স্ক ও নারী ভোটাররা ইভিএমে ভোট দিতে বেশি সমস্যায় পড়েন। কয়েকবার ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া বোঝানোর পরও অনেকে উল্টাপাল্টা বাটন চেপেছেন। এ কারণেও কোথাও কোথাও ইভিএম নষ্ট হয়েছে। একজনকে বোঝাতে কয়েক মিনিট লেগে যাওয়ায় ভোটগ্রহণ ধীর হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের সমর্থিত পরাজিত প্রার্থী আজমত উল্লা খানও নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ইভিএমে কিছু ত্রুটি ছিল। ইভিএমে অনেকে ভোট দিতে পারেনি।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গাজীপুর নির্বাচনের পরিবেশ সন্তোষজনক হলেও ইভিএমের কারণে ভোটগ্রহণের গতি ধীর ছিল। ইভিএমের বিষয়ে আমরা আগেও বলেছিলাম, এ যন্ত্রে ভোট পুনঃগণনা করলে একই ফল আসবে। কিন্তু এখানে টালি করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি অভিযোগ করে তার ফলাফল ট্যাম্পারিং করা হয়েছে, তাহলে সেটা আপনি টালি করবেন কীভাবে? কারণ, আপনার কাছে কোনো পেপার ট্রায়াল নেই। ইভিএমে পুনঃগণনার যে বিশাল সংকট রয়েছে তা নির্বাচন কমিশনকে ভাবতে হবে। ব্যালট পেপার কেউ নিয়ে গেলেও সেটা ফাইন্ড করা সম্ভব। কিন্তু ইভিএমে সূক্ষ্ম কারচুপি সম্ভব। বাইরে কোনো হইচই নেই, কিছু নেই, ভেতরে কী হচ্ছে? অন্য সিস্টেমে হলে বাইরেও হইহই হবে। সেটা আরও ভালো করে দেখা যাবে। কারণ কেন্দ্র ক্যাপচার করতে তো পাঁচ-ছয়জন লোকবল লাগবে।’
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘ইসি কেন ইভিএম নিয়ে পড়ে আছে সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন। তারা হয়তো মনে করেছে, জনগণের টাকায় কেনা যন্ত্রাংশের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে। কারণ এ যন্ত্র ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। এটা ঠিক তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের ভোট ব্যালটে করলে একটা ট্রায়াল হয়ে যেত। কিন্তু এখন যদি বাকি চারটি সিটি করেপারেশন নির্বাচন ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে করতে চায় তাহলেও সমস্যা তৈরি হতে পারে। কেননা, কেউ যদি রিট করে দেয় তাহলে নির্বাচন আটক যাওয়ার মতো উটকো ঝামেলায় ইসিকে পড়তে হতে পারে।’
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর ইসি কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, এটা ইভিএম আর ব্যালট সবক্ষেত্রেই একই নিয়ম। যে ভোটের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ কেন্দ্রে এলে তাদের ভোট নিতে হবে। আর ইভিএমে অনেকে ভোট দিতে অভ্যস্ত না হওয়ায় কারও কারও হয়তো সময় লেগেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমানে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তা অনেকটা দুর্বল ও নিম্নমানের। এতে ভোট পুনঃগণনার সুযোগ না থাকায় এ ছোট নির্বাচনেই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। বড় ভোটের ক্ষেত্রে আরও জটিলতা হতো। এই ইভিএমে যদি পেপার ট্রায়াল থাকত, তাহলে এসব অভিযোগ ওঠার সুযোগ ছিল না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশন সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দিয়েছে, এখন ব্যালটে বাকি চারটি নির্বাচনে ভোট নেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা সেটি করতে হলে, পুরো প্রক্রিয়া আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে সিমিত চন্দ্র (১২) নামের এক স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (৭ জুন) ভোরে ওই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বেলগাছা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক কিশোরকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সিমিত চন্দ্র বেলগাছা গ্রামের মানিক চন্দ্র ড্রাইভারের ছেলে। অভিযুক্ত কিশোর (১৬) একই গ্রামের প্রদীপ চন্দ্রের (দর্জি) ছেলে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গীতা সংঘ অনুষ্ঠান দেখতে যায় সিমিত ও তার বড় ভাই। সিমিতকে অনুষ্ঠানস্থলে রেখে বাড়িতে ফেরে তার বড় ভাই। পরে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে সিমিতের সঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরের কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় সিমিতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ওই কিশোর। পরে তাদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের গর্তে সিমিতের মরদেহ পুতে রাখে। অনুষ্ঠান শেষে সিমিত বাড়িতে না ফিরলে স্বজনরা তার খোঁজে বের হয়। অভিযুক্ত কিশোরকে সিমিতের বিষয়ে জিজ্ঞাস করলে সে অসংলগ্ন আচরণ করে। পরে তার বাবা প্রদীপ চন্দ্র তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের একটি গর্তে সিমিতের মরদেহ দেখিয়ে দেন। বুধবার ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে।
আটক কিশোরের স্বীকারোক্তিতে সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ বলেন, অভিযুক্ত কিশোরের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। এ নিয়ে সিমিতসহ অনেকেই ওই কিশোরকে খোঁচা দিত। গত রাতে সিমিত ওই কিশোরের সাথে এ নিয়ে আবারও খোঁচা দিলে সে সিমিতের গলা চেপে ধরে। এত শ্বাসরোধ হয়ে শিশুটি মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত কিশোর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনা স্বীকার করেছে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।