
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘ভোট বন্ধে ইসির কোনো ক্ষমতা রহিত হয়নি বরং নির্বাচন কমিশন তার অবস্থান আরও সংহত, দৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য যে সংশোধনগুলো চেয়েছিল সে সংশোধনগুলোতে সরকার সম্মত হয়েছে। এতে আমাদের ক্ষমতা বেড়েছে।’ গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রজ্ঞা অনুযায়ী আইন মন্ত্রণালয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে অনেকে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কেবিনেটে অনুমোদিত হয়। সেখানে সামান্য একটু পরিবর্তন উনারা করেননি, আমাদের মতামত চেয়েছিলেন। সেটা হলো ৯১এ(এ)-তে সামান্য পরিবর্তন ছিল। আমরা বলেছিলাম যেকোনো আসন এলাকায় অনিয়ম হলে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। উনারা বলেছিলেন যে, আমরা শুধু যেখানে যে কেন্দ্রে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। এটা আমাদের কাছে খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছে। এটি কিন্তু সম্পূর্ণ একটি নতুন ধারা ছিল। যেটা ৯১-এর এ ধারা সেখানে কিন্তু আমরা পরিবর্তন করিনি এবং সরকার বা সংসদ থেকেও কোনোরকম পরিবর্তন আনা হয়নি। সেদিক থেকে এ আইনটি বিল আকারে পাস হয়েছিল। গতকাল রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর গেজেট হয়েছে।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, ‘আপনাদের উদ্দেশে বলার কারণ হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে মন্তব্য এসেছে। এতে করে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে যে, এতে করে আমরা মনে করি যেসব ব্যাখ্যা এসেছে তা সব সঠিক নয়। যেমন প্রথম যেটা বলা হয়েছিল, কমিশন বুঝে না বুঝে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে এবং কমিশন গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল এবং ৯১(এ)-তে সংশোধন এসেছে। আসলে তা হয়নি। সেটা হুবহু আগের মতোই আছে। ৯১এ(এ)-তে নতুন একটি ধারা সংযোজিত হয়েছে। সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য আরপিও সংশোধন করেছে এমন মন্তব্যও এসেছে। কিন্তু সরকার আরপিও সংশোধন করেনি। করেছে, তবে আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী। ৯১(এ)-তে যদি সংশোধন হতো তবে আমাদের ক্ষমতা কিছু হেরফের হতো। যেহেতু ওখানে কিছু করা হয়নি, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা, যে পোলিং পিরিয়ডে আমরা যে একটি, দুটি বা সব আসনের নির্বাচন আমরা বাতিল করে দিতে পারি। সেটা হুবহু আগের মতোই আছে।’
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ৯১-এ(এ) সংশোধনের ফলে তফসিল ঘোষণার পর ভোটের দিনের আগে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি সিইসি। তিনি বলেন, ‘আমি এ প্রশ্নের উত্তর দেব না। আপনি বুঝে নিজেই উত্তর দেন।’
ইলেকশনের জায়গায় পোলিং শব্দটা আসার প্রসঙ্গ টেনে কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা যা বোঝেন তা বুঝতে থাকেন। আমরা জানি, আমরা বুঝি। এটা নিয়ে আপনারা যদি চিন্তাভাবনা করেন, চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।’
এ ছাড়া তফসিল ঘোষণার পরদিন যদি মনে হয়, ভোটের পরিবেশ নেই, তাহলে কমিশন ভোট বন্ধ করতে পারবে কি না, এ বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘সেটা হাইপোথেটিক্যাল। আমি রিপ্লাই করতে যাব না। ওই ধরনের পরিবেশ হতে দিন, ওইভাবে পরিবেশ হতে দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
ইলেকশন শব্দটির পরিবর্তে পোলিং শব্দটি কেন আনা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘ইলেকশন শব্দটা হচ্ছে জেনাস। ইলেকশনের আন্ডারে পোলিং। পোলিংয়ের আন্ডারে কখনো ইলেকশন হয় না। তো যেটা হচ্ছে একটা নির্বাচন করে যিনি নির্বাচিত হলেন, উনি পোলড হবেন না, উনি নির্বাচিত হবেন। আর পোলিংটা হবে যেই অংশটাতে ভোটাররা গিয়ে ভোট দেবেন। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াটাকে পোলিং বলা হয়। আমাদের আরপিওতে দেখবেন, ইলেকশন আর পোলিং শব্দটা ডেফিনেশনে আছে। কাজেই এ জিনিসটা বুঝবেন। এটাকে বিশাল করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, যে নির্বাচন কমিশন তার পায়ে কুঠার মেরে ফেলেছে। নির্বাচন কমিশন ভুল করতে পারে কিন্তু কুঠার মারেনি। আমরা বলছি, এটা সুচিন্তিতভাবে এটা কারেকশন করেছি। এখানে আসলে ইলেকশন হবে না, পোলিং হবে।’
আপনারা কি পারবেন ভোট বন্ধ করতে এ প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘সুযোগ নেই কেন। আইনে কোথায় নেই? যদি ওর আগের দিন বিভিন্ন কারণে একটা ইলেকশন...। একটা বেঞ্চমার্ক থাকে যে, এই এই কারণে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবেন। এই এই কারণে বন্ধ করতে পারবেন না। যদি এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তখন অসম্ভব পরিস্থিতি কমিশনের কাছে মনে হলে কমিশন কেন পারবে না। এটা নিয়ে গবেষণাটার প্রয়োজন হলো কেন, আমি বুঝতে পারলাম না।’
‘নতুন আইন মনে করেন হয়নি’ উল্লেখ করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘এখন ভোটের আগে তেমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কমিশন সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।’
আইন না থাকলে কী করে পারবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘৯১এ-তে কোনো ক্ষমতা রহিত হয়নি, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাচ্ছি।’
আইনের বাইরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আছে জানিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘সেটি হলে সেটাকে বলা হয় ইনহেরেন্ট পাওয়ার। আইনে কি লেখা নির্বাচনের আগের ভূমিকম্প হয়ে ৫০ লাখ মারা গেলে ভোট বন্ধ করতে হবে। ওই কথা তো লেখা নেই। তারপর কি আমরা নির্বাচন করব। সেই পরিস্থিতিতে কমিশন বসে আইনকানুন দেখে সিদ্ধান্ত নেবে।’
নির্বাচনের আগে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কমিশন ভোট বন্ধ করতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘কমিশন পারবে না কেন? অনিয়ম যদি হয়, নির্বাচনের আগে, আমাদের বিধান আছে তদন্ত করতে হবে। তদন্ত করে অনিয়ম যিনি করেছেন তার প্রার্থিতা বাতিল করার সুস্পষ্ট একটা বিধান আছে। আমরা যদি দায় নিরূপণ করতে পারি কে অনিয়ম করেছেন, তাহলে তার প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন চালিয়ে নিতে পারব। আর পোলিং বা ইলেকশন শব্দটির কারণে কোনো হেরফের হবে না। এক্সিস্টিং বিধানের কারণে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে।’
সিইসি বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করব যারা বিজ্ঞজন আছেন, আমরা পুরো জাতি প্রত্যাশা করছি একটা সুন্দর নির্বাচন হোক। নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনকে হেয় করা বা খাটো করা যেমন বাঞ্ছনীয় নয়, যেমন নির্বাচন কমিশনকে তারা যদি গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন, আমরা উপকৃত হবো। আমরা যেকোনো গঠনমূলক সাজেশন বিবেচনায় নিতে সদা প্রস্তুত।’
শুধুমাত্রা ৯১(এ) নয়, বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সুসংহত করা হয়েছে বলে মনে করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘যেমন ৮৪এ-তে দেখবেন বেশ কিছু কর্মকে আমরা অপরাধের আওতায় এনেছি। যেমন গণমাধ্যমকর্মী তাদের ইক্যুপমেন্টকে যদি কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত করে, পর্যবেক্ষকদের দেহ এবং তাদের কোনো ইক্যুপমেন্ট যদি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান এনেছি।’
তিনি বলেন, ‘মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় বাধা দেওয়ার অভিযোগ আসে। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য আমরা বাধাদানকারীকে শাস্তির আওতায় এনছি। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে কাউকে চাপ প্রয়োগ করলেও সেটা অপরাধ হবে। তবে এগুলো কমে আসবে। কেননা অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের ব্যবস্থা করছি। ইতিমধ্যে কিছু মনোনয়নপত্র অনলাইনে রিসিভ করতে পেরেছি। এতে শোডাউন এবং অর্থব্যয় কমে যাবে। চট্টগ্রাম-১০ ও ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচনেরও আমরা অনলাইনে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে পেরেছি। ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দিলে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে, এটাও আরপিওতে একটা ইম্প্র“ভমেন্ট।’
আরেকটি বিষয় কেউ প্রশংসাও করেননি, সমালোচনা বা আলোচনাও করেননি মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এতে তিনি যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা না পান তবে ভোট বন্ধ করে সব কাগজপাতি ফেলে বেরিয়ে আসবেন। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব স্পষ্ট করা। এতে তিনি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে সেটা ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘৩১(২)-তে আগে শুধু ছিল থাকবে ব্যালট পেপারে। এখন সেখানে স্বাক্ষরের বিধানও এনেছি। ভোট গণনার সময় ব্যালটে স্বাক্ষর না পেলে সেটা বাতিল করা হবে। আরেকটা বিষয় হলো আবেদনের ভিত্তিতে এজেন্টদের রেজাল্ট দেবেন। কিন্তু এখন বলা হয়েছে আবেদনের ভিত্তিতে নয়, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এমনিতে সেটা দেবেন। কারও প্রার্থিতা আমরা বাতিল করতে পারি। কিন্তু সে আবারও নমিনেশন জমা দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে আমরা বিধান এনেছি কারও যদি অপকর্মের কারণে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়, তাহলে সে পরবর্তীকালে নতুন নমিনেশন দাখিল করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে এটা একটা অগ্রগতি।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রচারটা যদি সঠিক হয়, তথ্যটা যদি সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়, তাহলে আমাদের জনগণের মধ্যে যে বিভ্রান্তি, সেটা নিরসন হবে। বিভ্রান্তি নিয়ে যদি তারা বসবাস করেন তবে তারা অজ্ঞ থেকে যাবেন। আমরা চাই আমাদের জনগণ নির্বাচন বিষয়ে প্রাজ্ঞ হন, প্রাজ্ঞ হয়ে তাদের মতামত যেন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পারবেন।’
ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) থেকে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এই তহবিল থেকে অর্থায়নের সুবিধা পেতে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব করেছে। এতদিন সেটা তেমন আমলে না নিলেও এবার যুক্তরাষ্ট্র ডিএফসি সুবিধা দিতে এগিয়ে এসেছে। আর এ সহায়তা পেতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে পরিবেশ, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আজ মঙ্গলবার ঢাকা সফরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। এ সফরে তারা আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টরে শর্তযুক্ত বিনিয়োগ করার প্রস্তাব করতে পারেন। আর এর মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে দেশের প্রতিষ্ঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে পেতে চায় বিশ্ব মোড়ল এ দেশটি; যা সরকারকে নতুন করে চাপে ফেলতে পারে।
চার দিনের সফরে মার্কিন এই প্রতিনিধিদলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। এ সময় তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা, গণতন্ত্র সুসংহত করা, মানবাধিকার উন্নয়ন এবং শ্রম অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে পারেন বলে জানা গেছে।
সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও বিদেশি সম্পর্কোন্নয়ন নিয়ে কাজ করা আওয়ামী লীগের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন কৌশল নিয়েছে। সেটা হলো, তারা বেসরকারি সেক্টরে শর্তযুক্ত বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে আসবে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে দেশের প্রতিষ্ঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে পেতে চায় তারা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডিএফসি তহবিল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেসরকারি খাতে শর্তযুক্ত ঋণ দিয়ে থাকে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারবিষয়ক ইস্যুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে বেসরকারি সেক্টরের বড় ব্যবসায়ীদের পেতে মূলত শর্তযুক্ত ডিএফসি সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই তহবিল জ¦ালানি, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কম সুদে, দীর্ঘমেয়াদি ও ক্ষেত্রবিশেষে সুদবিহীন বড় অঙ্কের অর্থায়ন করে থাকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বেসরকারি বাণিজ্যিক সেক্টরে। তবে এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশ, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, পরিবেশ ও শ্রম অধিকারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার পরিস্থিতি রুগ্্ণ থাকা কোনো দেশে ডিএফসি তহবিল দেয় না। ডিএফসির মূল লক্ষ্যই হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সরকারপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এখানে আমার কোনো কিছু জানা-বোঝার কথা নয়।’
জানা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের যে চ্যালেঞ্জ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা গ্রহণ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল সে সম্পর্কেও আলোচনা করবে। টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, তার একটি রূপরেখাও ওই প্রতিনিধিদলের হাতে তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা গ্রহণ ও দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পারে সরকার তেমন একটি পরামর্শও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে আসতে পারে। আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান দূর করতে আবারও সংলাপের প্রস্তাব আসবে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র ও সরকারের দুই মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও শ্রম অধিকার বিষয়ে এবং আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে মূলত সফরকারী যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করবে।
সূত্রগুলো জানায়, সরকারও মানবাধিকার, গণতন্ত্র উন্নয়ন ও শ্রম অধিকার আইন নিয়ে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নের পথে, সেগুলো বিস্তর আকারে প্রতিনিধিদলের কাছে তুলে ধরবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল সফরে আসুক, আলোচনা করুক, তারপর কথা বলব।’ তিনি বলেন, সব ঠিক আছে।
কূটনীতিক কৌশল নিয়ে কাজ করেন সরকারি দলের এমন একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, শ্রমিকদের মানোন্নয়ন, অধিকার সুরক্ষায় ইতিমধ্যে শ্রম আইন সংশোধন করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র নিশ্চিতে সরকার কী কী করেছে, তা উদাহরণসহ তুলে ধরা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলকে সন্তুষ্ট করতে ইতিমধ্যে বিস্তারিত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সরকার মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে, সেগুলোও সফররত প্রতিনিধিদলকে অবহিত করা হবে।
ডিএফসির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ডিএফসির বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক উন্নয়নের মঞ্চে একটি শক্তিশালী এবং আরও প্রতিযোগিতামূলক নেতা করে তোলে। রূপান্তরমূলক প্রকল্পগুলোতে মিত্রদের সঙ্গে অংশীদারত্ব করার এবং রাষ্ট্র-নির্দেশিত উদ্যোগ; যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আরও খারাপ করে দিতে পারে, সেগুলোতে আর্থিকভাবে উপযুক্ত বিকল্প প্রদান করে আন্তর্জাতিক এ তহবিল।
ডিএফসির বিনিয়োগ প্রভাবশালী বৈশ্বিক উন্নয়ন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অগ্রগতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের জন্য রিটার্ন তৈরিতে ফোকাস করে। ডিএফসির বিনিয়োগ সীমা ৬০ বিলিয়ন ডলার। ডিএফসি উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের সমাধানে অর্থায়নের জন্য বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারত্ব করে। সংস্থাটি শক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে। ডিএফসি উদীয়মান বাজারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ছোট ব্যবসা এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন করে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি সংস্থা ডিএফসি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চমান মেনে চলে এবং পরিবেশ, মানবাধিকার এবং কর্মীদের অধিকারকে সম্মান করে।
ডিএফসি যে বিনিয়োগগুলো সংহত করে তা বিশ্বের কিছু দরিদ্র দেশ এবং সংঘাত দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চলসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে কাজ করে। এসব বাজারে বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাকে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল বাজারগুলোতে পা রাখতে সাহায্য করে।
দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার না করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করবেন না যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এবং এর চলমান অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে। ক্ষমতায় থাকার কারণে গত ১৪ বছরে গণমাধ্যমকে যতটা স্বাধীনতা আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে, তা আগে কখনো কেউ ভোগ করেনি।’
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের করবী হলে অসুস্থ, অসচ্ছল সাংবাদিক এবং নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের আর্থিক চেক প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। খবর বাসস।
সাংবাদিকদের ‘দেশের ভালোর জন্য’ সামলোচনা করার আহ্বান রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমালোচনা যেন আমাদের দেশের কল্যাণে হয়, দেশের ক্ষতির জন্য না হয়। সমালোচনা থেকে যদি কোনো কিছু সংশোধন করা লাগে আমরা (সরকার) সেটা করে নেব এবং আমরা সেটা করে থাকি। সেখানে আপনাদেরও কিছুটা দায়িত্ব আছে। স্বাধীনতা ভোগ করবেন, সঙ্গে দায়িত্ববোধও থাকতে হবে। দেশ ও জাতির জন্য কর্তব্যবোধ থাকতে হবে।’
সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের জন্য সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা একটা ওয়েজবোর্ড কার্যকর করেছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ডের আওতায় আনা হবে, খুব দ্রুত এটা বাস্তবায়ন করা হবে। গণমাধ্যমকর্মী চাকরি শর্তাবলী আইন, সেটাও আমরা করে দেব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি সেই সমালোচনাটা গঠনমূলক হওয়া উচিত। শুধু বলার জন্য বলা না। বিরোধী দল তো বলবেই, তারা সারা দিন কথা বলে, টক শো করে, টক শোতে ইচ্ছেমতো বলে যাচ্ছে, যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে, কথা বলার পরে বলবে, কথা বলার স্বাধীনতা দেয়নি। স্বাধীনতা ছিল কখন? আইয়ুুব খানের আমলে ছিল? জিয়াউর রহমানের আমলে ছিল? এরশাদের আমলে ছিল?’
বিএনপির শানসামলের উদাহরণ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, ‘২০০১ সালের কথা একবার চিন্তা করেন, খালেদা জিয়া যখন প্রথম সরকারে এলেন, দক্ষিণাঞ্চলে কি কোনো সাংবাদিক যেতে পেরেছিল? কোনো সাংবাদিক যেতে পারেনি। সেখানে এত অত্যাচার করেছিল। সাংবাদিক নিষিদ্ধ ছিল। তাদের অপকর্ম কোনো পত্রিকা লিখতেই পারত না। যে লিখত তাকে খেসারত দিতে হতো। তখন স্বাধীনতাটা ছিল কোথায়?’
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে সংবাদপত্রের ‘ব্যাপক বিকাশ’ ঘটেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা সরকার গঠন করার সময় সংবাদপত্র ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। তখন অবাধে সংবাদ যাতে প্রকাশিত হতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছি।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একসময় সাংবাদিকতা করেছেন জানিয়ে তার মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সেদিক থেকে তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিবারের একজন বলে মনে করেন।
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং বিপদ-আপদে আকস্মিক সহযোগিতার জন্য ভুক্তভোগী সাংবাদিক পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ভাবনা থেকে কল্যাণ ট্রাস্ট আইন গঠন করে দেওয়ার কথাও জানান শেখ হাসিনা।
সাংবাদিকদের আবাসনের বিশেষ প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেককে প্লট দেওয়া হয়েছে, আবার অনেকে বিক্রিও করে দিয়েছে। সরকারিভাবে আমরা ফ্ল্যাট তৈরি করেছি, কিছু টাকা জমা দিয়ে, কোনোটা ১৬ বছর, কোনোটা ২৬ বছর ধীরে ধীরে টাকা জমা দিয়ে ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া যায়। সেভাবে আমরা অনেক ফ্ল্যাট তৈরি করেছি। সাংবাদিকরা চাইলে আমরা সেটা ব্যবস্থা করতে পারি। আমি সাংবাদিকদের বলব, তারা যদি ফ্ল্যাট কিনতে চান, সরকারি প্লট যেগুলো আমরা করেছি, আমরা বিক্রি করব।’
চাকরির অবসরে বেসরকারি চাকরিজীবীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান রাজনীতিবিদের সঙ্গে সাংবাদিকের জীবনের সাদৃশ্যও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক তাদের চাকরির কোনো স্থায়িত্ব থাকে না, বয়স্ক বা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের কোনো সুযোগই থাকে না। সরকারি চাকরিতে অবসর ভাতা পাওয়া যায়। আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য কিছু থাকে না, আবার সাংবাদিকদের জন্য কিছু থাকে না, এটা বাস্তব।’
তিনি বলেন, ‘এখন গণভবনে আছি ভালো কথা, তারপর কোথায় উঠব? আমি নিজের জন্য চিন্তা করি না, সবার জন্যই ভাবি।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের (সাংবাদিক) বলব, আপনারা যদি কেউ ফ্ল্যাট কিনতে চান তাহলে কিস্তিতে দেব, সেভাবে আমরা ফ্ল্যাট তৈরি করে দিচ্ছি। যদি নিজেরাই ঘর করতে চান তাহলে একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেব।’
তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদসহ সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
গ্রামীণ অঞ্চলে থেকে চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর : দেশের চিকিৎসাসেবার আরও উন্নতির জন্য চিকিৎসকদের গবেষণার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের জেলা, উপজেলা পর্যায়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ডা. মিলন অডিটরিয়ামে ৭৮তম ডিএমসি ডে উদযাপন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা মেডিকেল নিয়ে আমাদের নতুন পরিকল্পনা রয়েছে। এটি আরও সুন্দর ও আধুনিক হাসপাতাল হিসেবে গড়ে উঠবে। এর কাজ খুব তাড়াতাড়িই শুরু করতে পারব।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এদের মধ্যে বিদেশিরাও রয়েছে। প্রতিদিন পাঁচ হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়। ২ হাজার ৬০০ বেডের হাসপাতালে ভর্তি থাকে চার হাজার রোগী। এজন্য আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঘাটতি রয়েছে। আমরা তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছি। সব হাসপাতাল আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া, ঢামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শফিকুল আলম চৌধুরী, হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হকসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন ঢামেক অ্যালামনাই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. জুলফিকার রহমান খান।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে থাকা ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’-এর যে ওয়েবসাইট থেকে তথ্য ফাঁস হয়েছে, সেটি ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ফলে এসকিউএল ইনজেকশনের মাধ্যমে ওই সব তথ্য ফাঁস হয়েছে। এ ছাড়া ওয়েবসাইটটির নিরাপত্তায় নিয়মিতভাবে ভিএপিটি (দুর্বলতা মূল্যায়ন এবং অনুপ্রবেশ পরীক্ষা) করেনি কর্র্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় থেকে তাদের চিঠি দেওয়া হলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি। এদিকে ফাঁস হওয়া তথ্য ডার্ক ওয়েবে বিক্রির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে যাদের তথ্য ফাঁস হয়েছে, তারা দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের গঠন করা বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ও পুলিশের সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা প্রকৃত ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু করেছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিটক্র্যাক সাইবার সিকিউরিটির গবেষক ভিক্টর মারকোপাওলোস বাংলাদেশের লাখ লাখ নাগরিকের তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়টি সামনে আনেন। তার তথ্য অনুযায়ী ব্যক্তির নাম, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), মোবাইল ফোন নম্বর, পেশা ও ঠিকানা ফাঁস হয়। এর পরই নড়েচড়ে বসেন সরকারের দায়িত্বশীলরা। আইসিটি বিভাগ একটি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে। সেই বিশেষজ্ঞ দল গত রবিবার সকালে ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’ ওয়েবসাইট থেকে এনআইডির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। তবে বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যদের ধারণা, ওয়েবসাইটটি থেকে এনআইডির তথ্যভান্ডারে ঢুকে তথ্য সংরক্ষণ করেছে অনেকে। কেননা ওই ওয়েবসাইটে ঢুকে পাবলিক সার্চ টুল ব্যবহার করলে সরাসরি এনআইডির তথ্যভান্ডার থেকে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সামনে চলে আসত।
ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’ ওয়েবসাইটটিতে বর্তমানে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সংখ্যা ১৬ কোটি ৮০ লাখ (১০০%) এবং মৃত্যু নিবন্ধনের সংখ্যা ৯২ লাখ ৫৪ হাজার। অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্ম নিবন্ধন ১ কোটি ৩৯ লাখ এবং হার ৮৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর তথ্য থাকা এ ওয়েবসাইটটির তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের গঠন করা বিশেষজ্ঞ দলে থাকা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’ ওয়েবসাইটে দুর্বলতা ছিল, দীর্ঘদিন ধরে এখানে অবহেলা হয়েছে। এখানে একটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, সেই সচেতনতাই তাদের নেই। তারা (কর্র্তৃপক্ষ) কখনো এটা আমলেই নেয়নি যে এর ফলাফল কী হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডেটাবেইসে এসকিউ ইনজেকশন করা যাচ্ছিল। এটা একটি ওয়েবসাইটের দুর্বলতা। সব ওয়েবসাইটের নিরাপত্তায় ভিএপিটি (দুর্বলতা মূল্যায়ন এবং অনুপ্রবেশ পরীক্ষা) করতে হয়, আইটি অডিট করাতে হয়। এগুলো যদি করা হতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না। তারা একটি ওয়েবসাইট করেছে, অথচ সিকিউরিটি (নিরাপত্তা) চেক করেনি।’
তিনি বলেন, ‘ওয়েবসাইটটির দুর্বল পোর্টগুলোকে ঠিক করা হয়েছে, কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। নিরাপত্তার বিষয়ে অতীতে মন্ত্রণালয় থেকে জানতে চেয়ে তাদের অনেকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ সেই চিঠি ফেলে রেখেছে। তারা কোনো অভিযোগ দেয়নি। তাহলে সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?’
ডার্ক ওয়েবে তথ্য বিক্রির আশঙ্কা : ফাঁস হওয়া এসব তথ্য একাধিক ডার্ক ওয়েব বা চোরাগোপ্তা সাইটে বিক্রি করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা। এতে ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাম-পরিচয় ব্যবহার করে তার আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘিœ করার চেষ্টাও চালানো হতে পারে।
ফাঁস হওয়া তথ্যে ঝুঁকি বাড়বে : তথ্য ফাঁসের ফলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়েই নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়েছে। সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের যেসব ব্যক্তির তথ্য ফাঁস হয়েছে, তাদের সহজেই চিহ্নিত করে খুব সহজেই যেকোনো ধরনের ক্ষতি করা সম্ভব। যেমন পেশাভিত্তিক মানুষকে বা টার্গেট গ্রুপকে সিলেক্ট (নির্বাচন) করে তাদের বিভিন্ন ধরনের মেসেজ অথবা তথ্য পাঠিয়ে বিভিন্ন কাজে প্রলুব্ধ করা সম্ভব। ই-মেইল অ্যাড্রেস পাওয়ার ফলে ই-মেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ফিশিং লিংক পাঠিয়ে তাদের ব্যাংকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট খুব সহজেই হ্যাক করা যায়। এ ছাড়া ফাঁস হওয়া তথ্য ব্যবহার করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও গুগলে কোটি কোটি ফেইক আইডি তৈরি করা সম্ভব, যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। যেমন ফাঁস হওয়া তথ্য ব্যবহার করে কাউকে সহজেই জিম্মি করা যাবে। কোনো ব্যক্তির এসব তথ্য জানার পর তার রেফারেন্স ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট বা তার আশপাশের যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে খুব সহজেই প্রতারণা করা সম্ভব।
পুলিশের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্য ফাঁস হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যারা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করেন, তাদের ঝুঁকি বেশি বাড়বে। কেননা হ্যাকাররা পাসওয়ার্ড চুরি করে ওই গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট (হিসাব) থেকে অর্থ চুরি করতে পারে। এ ছাড়া যারা নিয়মিত অনলাইনে কেনাকাটা করেন এবং পণ্যের দাম এমএফএসের মাধ্যমে (মোবাইল ব্যাংকিং) পরিশোধ করেন, তারাও ঝুঁকিতে পড়বেন। কোনো ব্যক্তির ফাঁস হওয়া তথ্য দিয়ে তার নামে ক্রেডিট কার্ড তুলে নিতে পারে হ্যাকাররা। ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করে টাকাও পাচার করে নিতে পারে তারা।
এই পরিস্থিতিতে করণীয় জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মনিরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন প্রধান কাজ হচ্ছে সার্ভার থেকে কাদের তথ্য ফাঁস হয়েছে, তা চিহ্নিত করা। যাদের তথ্য ফাঁস হয়েছে সেই ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা অবগত করা। তাদের জানাতে হবে আপনার এসব তথ্য ফাঁস হয়েছে, এসব তথ্য দিয়ে এ ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম হতে পারে আপনি সতর্ক থাকেন।
তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তথ্য ফাঁস হওয়া নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। এর সঙ্গে কেউ জড়িত আছে কি না, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার ইউনিট ও সিটিটিসির (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) সাইবার উইনিট ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।’
ভূমি মন্ত্রণালয়ের গণবিজ্ঞপ্তি : নাগরিক তথ্য ফাঁস প্রসঙ্গে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত ভূমিসেবাসংক্রান্ত সিস্টেম থেকে নাগরিক তথ্য ফাঁসসংক্রান্ত কোনো তথ্য নির্বাচন কমিশন অথবা আইসিটি বিভাগ থেকে পাওয়া যায়নি বলে দাবি করা হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে। গতকাল সোমবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নাগরিক তথ্য বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ অবস্থায়, ভূমিসেবা গ্রহণে জাতীয় পরিচয়পত্র সিস্টেমের কারিগরি বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে গতকাল বৈঠক করে। এখন পর্যন্ত ভূমিসেবাসংক্রান্ত সিস্টেম থেকে নাগরিকদের তথ্য ফাঁসসংক্রান্ত কোনো তথ্য নির্বাচন কমিশন অথবা আইসিটি বিভাগ থেকে পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ভূমি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করছে যে ভূমিসেবা ডিজিটাইজেশন কার্যক্রমে ডেটা নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা হয় এবং এর পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা শুরু থেকেই বিদ্যমান।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নে বাসিন্দা সাহিনা আক্তার। রাজধানীর মগবাজার এলাকায় দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। সরকারি চাকরিজীবী স্বামী আবদুল ওয়াদুদ ২০২০ সালে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। স্বামীর পেনশন থেকে প্রাপ্ত অর্থসহ সারা জীবন জমানো প্রায় ৩০ লাখ টাকা বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে (এফডিআর) রেখেছিলেন। এফডিআরের লভ্যাংশ আর নিজের টিউশন পড়ানোর টাকায় সংসার চালাতেন তিনি। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সম্প্রতি তিনটি টিউশনের একটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তাকে। এমন পরিস্থিতিতে বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়ায় খরচ আর সংসারের খরচ বৃদ্ধির কারণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি একটি ব্যাংকের এফডিআরের ১০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। সেই টাকা দিয়েই ছোট ছেলের সেমিস্টার ফি আর অন্যান্য খরচ বহন করছেন তিনি।
শুধু সাহিনা আক্তারই নন, রাজধানীতে বসবাস করা আক্তার হোসেন, তারিকুল ইসলামসহ স্বল্প আয়ের অনেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়টাতে সংসার খরচের ব্যয় সামাল দিতে ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকের টাকা চলে যাচ্ছে মানুষের হাতে। আর ব্যাংকে দেখা দিচ্ছে তারল্যের সংকট। এক বছরের ব্যবধানে আমানতের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৮১ শতাংশে নেমে এসেছে।
জানতে চাইলে সাহিনা আক্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যাংকের এফডিআরের লভ্যাংশ আর আমার টিউশন থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই আগে সংসার কোনোরকম চালানো সম্ভব ছিল। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আমার একটা টিউশন বন্ধ হয়ে যায়। আর সব পণ্যের এতটাই বেড়েছে যে, সংসার খরচ ও সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ভাঙতে হয়েছে।’
ধারাবাহিক ঋণ কেলেঙ্কারি, ব্যাংক নিয়ে গুজবসহ নানা কারণে গেল বছরের শেষদিকে অনেকেই ব্যাংক খাত থেকে আমানত তুলে নিয়েছিলেন। এর বাইরে ব্যাংকে আমানতের সুদহার কমে যাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে গ্রাহকদের সঞ্চয়ের টাকা ব্যাংকের পরিবর্তে হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মে মাসে ব্যাংক খাতের বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মে শেষে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ব্যাংক থেকে মানুষের হাতে টাকা চলে গেছে ৩০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অবশ্য সরকারকে ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৮ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছে। এটিও মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দিয়েছে।
তবে ঋণ কেলেঙ্কারি রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি ও হাতে টাকা রাখার ঝুঁকি বিবেচনায় পরবর্তী সময়ে কিছু অর্থ ব্যাংকে ফিরেছে। তবে তা এখনো আগের বছরের তুলনায় কম।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের শেষদিকে ব্যাংক খাতের বেশ কয়েকটি কেলেঙ্কারির বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থার সংকট দেখা দেয়। বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। পাশাপাশি ব্যাংকে টাকা রাখলে পাওয়া যাবে না গুজব ও মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে মানুষ টাকা তুলে নেওয়া শুরু করে। তবে ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে অনেক গ্রাহকের মাঝে ধীরে ধীরে ব্যাংকের প্রতি আস্থা আবারও তৈরি হচ্ছে। তারপরও অনেক গ্রাহকের মনে ‘আস্থার ঘাটতি’ এখনো রয়েই গেছে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে রীতিমতো দোটানায় পড়েছেন। কোনো কোনো গ্রাহক এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর করছেন। বিশেষ করে শরিয়াহ আইনে পরিচালিত ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা তুলে সরকারি কিংবা বিদেশি ব্যাংকে রাখছেন। আর নেহাত যাদের ব্যাংকের ওপর আস্থা কম, তারা টাকা তুলে হাতে রাখছেন। এ কারণেই ব্যাংকের বাইরে টাকা বেড়ে গেছে।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জয়তুন বিজনেস সলিউশনসের চেয়ারম্যান মো. আরফান আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যাংকের বাইরে টাকা চলে যাওয়া ভালো নয়। এটা ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি করতে পারে। এটি হয় দুই কারণে; প্রথমত দেশে যদি দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। তখন মানুষ সংসার চালাতে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখার চেষ্টা করেন। আর দ্বিতীয়ত, যদি ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ মনে না করেন তাহলে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এ ছাড়া আমানতে সুদের হার কম থাকলেও মানুষ টাকা ব্যাংকে না রেখে অন্য খাতে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করেন।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছর এপ্রিল শেষে মানুষের হাতে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। আর মে মাসে এ অর্থ কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মাসের ব্যবধানে মানুষের হাতে রাখা অর্থের পরিমাণ কমেছে ৭ হাজার ৫৪৩ কোটি বা ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত বছর জুনে ব্যাংকিং সিস্টেমের বাইরে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৮ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন আরও বলছে, ২০২১ সালের জুন মাসে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বেড়েছিল ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০২২ সালের জুনে হাতে টাকা রাখার প্রবণতা আরও বেড়েছে। এ সময় হাতে টাকা রাখার পরিমাণ বেড়েছে ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
হু হু করে জনসংখ্যা বাড়ছিল সত্তর ও আশির দশকে। নব্বইতে এসেও তা বহাল ছিল। রাষ্ট্রীয় নীতি বদলাচ্ছিল একের পর এক। ছোট দেশ, মানুষ বেশি হয়ে গেলে মুশকিল! তাই পলিসি মেকাররা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকেই মোক্ষম অস্ত্র মনে করেছিলেন। সেভাবেই দিয়েছিলেন দাওয়াই।
তারই ফলাফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হার পড়তির দিকে। স্থীতিশীল থেকে বৃদ্ধিরেখার এ বাঁকবদলে ভারসাম্যহীনতাও তৈরি হচ্ছে।
বরাবরের মতো উচ্চবিত্তের জনসংখ্যা বাড়ার হার ঋণাত্মক না হলেও সমান সমান। বড় পরিবর্তন এসেছে মধ্যবিত্তে। এককভাবে না হলেও নিম্নবিত্তের সঙ্গে এ শ্রেণিও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে মধ্যবিত্তের অবস্থান বদল হয়েছে। এ শ্রেণির জনসংখ্যা বাড়ার হারও ঋণাত্মক না হলেও সমান সমান অবস্থানে রয়েছে। তবে আগের মতো নিম্নবিত্ত এখনো জনসংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। আর নিম্নবিত্তের এ বৃদ্ধিই সমাজে নতুন করে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা ডেকে আনছে। বৃদ্ধির হার বজায় রেখে তারা সামাজিক ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জগতেও নেতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
পপুলেশন সায়েন্টিস্ট এবং ইকোনমিস্টরা মনে করেন, একটা সময় নীতিনির্ধারকরা জনশক্তিকে হুমকি হিসেবে দেখেছিলেন। সে সময় অনেক অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। বারবার নীতিবদল করে বিষয়টি কার্যকর রাখা হয়েছে। একটি সময় সেøাগান ছিল ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তান যথেষ্ট’। পরে আরও কঠোর নীতি নিতে হয়েছিল সরকারকে। এর পরের সেøাগান ছিল ‘একটি হলে দুটি নয়’। এসব কার্যক্রমেরই ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ। যাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য এত চেষ্টা, সেই জনগণ এখন দেশের জন্য বড় শক্তি। কিন্তু তাদের কাজে লাগানো যায়নি। জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করা যায়নি।
দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে কিন্তু শতকরা বৃদ্ধির হার কমেছে। অর্থাৎ ১৯৮১ সালে যে বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল, ২০২২ সালের সবশেষ শুমারিতে তা কমে অর্ধেকের নিচে নেমেছে। ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখের বেশি। ১৯৮১ সালের শুমারিতে বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ১৯৯১ সালে তা আরও কমে হয়েছে ২ দশমিক ০১। ২০০১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫৮ এবং ২০১১ সালে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ২০২২ সালের জনশুমারিতে জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেমোগ্রাফিক প্যারামিটারে বিবেচনা করলে দেখা যায়, নিম্নবিত্তদের মধ্যে শিক্ষার হার কম। স্বাস্থ্য, মৃত্যু এবং শিক্ষা এ জায়গাগুলোতে নিম্নবিত্তদের মাঝে বেশি। ধনিকশ্রেণির মধ্যে মৃত্যুহার কম, তাদের মধ্যে শিক্ষার হার বেশি। এখন দেখার বিষয় শিক্ষার সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক, পেশার সম্পর্ক বা উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক আছে কি না। জনসংখ্যার উপাদানগত অবস্থান থেকে দেখা যায়, ধনিকশ্রেণি ভালো অবস্থানে আছে। যারা দরিদ্র শ্রেণি তারা খারাপ অবস্থানে আছে। খারাপ অবস্থানে থেকেও মানুষ ভালো করছে, যেমন কৃষিকাজ। কৃষকের মধ্যে চাষ করার প্রাকৃতিক জ্ঞান রয়ে গেছে। কৃষিকাজে তিনি উপার্জন করে অনেকের চেয়ে বেশি আয় করেন। অনেক আছে শিক্ষা নেই কিন্তু আয় কয়েক লাখ টাকা। সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে নিম্নবিত্তদের উত্থানে অনেক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। দেখতে হবে সামাজিকীকরণটা কোথায় হচ্ছে। তবে ডেমোগ্রাফিক জায়গা থেকে দেখতে গেল, সম্পদের বিবেচনায় নিম্নশ্রেণির মানুষদের মধ্যে জন্মহার বেশি। যারা নিম্নবিত্ত আছেন, তাদের জন্মহার যাতে না বাড়ে, সে বিষয়ে কৌশল নিতে হবে।
জনসংখ্যা বাড়ার বিষয়টি নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর। জন্মহার, মৃত্যুহার এবং স্থানান্তর। এ তিন কারণে যেকোনো দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নির্ভর করে। দেখা গেল একটি দেশে অনেক মানুষ জন্ম নিল, কিন্তু কোনো বিপর্যয় বা যুদ্ধে মারাও গেল অনেক মানুষ, তাহলে জনসংখ্যা বাড়বে না। জন্মহার বেশি, মৃত্যুহার কম হলে জনসংখ্যা বাড়ে। এখানে স্থানান্তর হলেও প্রভাব পড়ে। অনেক মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গেল অথবা অনেক মানুষ অন্য দেশ ছেড়ে এ দেশে চলে এলো, এটাও জনসংখ্যা বাড়া বা কমার ওপর প্রভাব ফেলে।
মধ্যবিত্ত সবসময়ই উচ্চবিত্তকে অনুসরণ করেছে। এ শ্রেণি উচ্চবিত্তকে অনুসরণ করতে গিয়ে নিম্নবিত্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আর এ বিচ্ছিন্নতার সুযোগে নিম্নবিত্তের আলাদা সাংস্কৃতিক বলয় জোরালো হয়েছে। রুচির দুর্ভিক্ষ বলে দূরে ঠেলার চেষ্টা করলেও ওই সাংস্কৃতিক বলয় বিস্তৃত হচ্ছে। সাংস্কৃতিক বলয় ছেড়ে তারা রাজনীতিতেও অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছেন।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের নয়নপুর গ্রামের ইরফান আলী ১০ বছর ধরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দুই সন্তানের জনক ইরফান যে বেতন পান, তাতে সংসার চললেও সঞ্চয় নেই। তার প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কাশি হলেও চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখানেই শপিং করেন। তিনি এক সন্তানের জনক।
ইরফানেরই চাচাতো ভাই শফিকুল ইসলাম গ্রামের দিনমজুর। চার সন্তানের জনক। যেদিন শ্রম দিতে পারেন না, সেদিন খাবার জোটানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
ইরফানের সঙ্গে শফিকুলের পৈতৃক জমিজমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। সেগুলো নিয়ে স্বাভাবিক কথাবার্তায়ও শফিক তার সন্তানদের অস্ত্র হিসেবে দাঁড় করায়। ইরফানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। ইরফানও তার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ জায়গা থেকে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা স্পষ্ট হচ্ছে। দেশের মানুষের সংস্কৃতি ও রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। সমাজে মধ্যবিত্তদের প্রভাব কমে যাচ্ছে, নিম্নবিত্তরা সমাজে আলাদাভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছেন। রাজনীতিতেও তাদের দেখা যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের অনীহায় সুযোগ পেয়েছেন তারা। মধ্যবিত্তরা বেশিরভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকেন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে। আর উচ্চবিত্তরা রাজনীতিতে এলেও সেটি নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে তাদের মাধ্যমেই। যেসব উচ্চবিত্ত রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, তাদের অনেকেই জনকল্যাণের চেয়ে জনহুমকির উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন।
ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমছে। দেশগুলোতে এখন আয়ের বড় অংশই ব্যয় করতে হচ্ছে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে। এদিক থেকে বাংলাদেশ এখনো স্বর্ণযুগে অবস্থান করছে। কেননা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে কমলেও গত এক যুগে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়েছে সোয়া দুই কোটি। এমন সুযোগ যেকোনো জাতির ভাগ্যে একবারই আসে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর্মক্ষমতার ইতিমধ্যে ১০ বছর চলে গেছে, সেটিকে বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ কাজে লাগাতে পারিনি। আগের ১০ বছর চলে গেছে। আগামী ১০ বছরেও কতটুকু কাজে লাগাতে পারব সেটি দেখার বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মানসম্মত শিক্ষা। এটাকে পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে নিতে হবে। যারা যুবসমাজকে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারাই শক্তিশালী হয়েছে। এ জনমিতিক লভ্যাংশ পেতে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে শিক্ষার মানের দুর্বলতা বেশি। এর ফলে ডিভিডেন্ড আসা তো দূরের কথা, বরং উল্টো বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।’
দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বাড়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, তার প্রমাণ মেলে পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের জরিপেই। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় ও ব্যয়, সবই কম। তবে শহরে আয় বৈষম্য বেশি, গ্রামের পরিস্থিতি তুলনামূলক কিছুটা হলেও ভালো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত গত ১২ বছরে তিনটি খানা জরিপের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য বেড়েই চলছে। বাংলাদেশ এখন চরম আয় বৈষম্যের দিকে যাচ্ছে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে একদিকে চরম দারিদ্র্যের হার কমেছে, অন্যদিকে আয় বৈষম্যও বেড়েছে। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে মজুরি বাড়ানোর যে সক্ষমতা, সেটি আমরা বাড়াতে পারিনি। আয় বৈষম্য কমানোর দিক হতে পারে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে। সারা বিশে^ আয় বৈষম্য কমানোর একটি বড় উপায় হলো এই ট্যাক্সেশন বিশেষত প্রত্যক্ষ কর। আমাদের দেশে কর আদায় কম, ঋণখেলাপি, টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়া এগুলো আয় বৈষম্য, ভোগ বৈষম্য এবং সম্পদ বৈষম্য বাড়াচ্ছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।