
মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিককে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তার নাম ডা. ইউনুস খান তারিম। গতকাল শুক্রবার সকালে তাকে খুলনা থেকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডা. তারিমের আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন খুলনা সদর থানার ওসি হাসান আল মামুন।
পুলিশ একটি সূত্র জানায়, ডা. ইউনুস খান তারিম মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। তিনি তার মালিকানাধীন থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গত ১৬ বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন।
সূত্র জানায়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে এক প্রতিবেদনে বলেছে, খুলনার এ কোচিং সেন্টার ভর্তিবাণিজ্যের মাধ্যমে ‘মেধাহীন’, ‘অযোগ্য’ ছাত্রছাত্রীদের মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে জনপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা করে নিচ্ছে। এ ভর্তিবাণিজ্যের মাধ্যমে বছরে শতকোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেন হচ্ছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে, উদাহরণ হিসেবে কিছু শিক্ষার্থীর ফলাফল বিবরণীর বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়, যারা থ্রি ডক্টরসে কোচিং করেছেন। তাতে দেখা যায়, তারা কেউ এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পায়নি। তবে ভর্তি পরীক্ষায় ৭৩ করে নম্বর পেয়েছে। একজন ৭৩.২৫ নম্বর পেয়েছে।
একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের পড়াশোনা ও জ্ঞান এত নিম্নমানের যে তারা কীভাবে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন, তা বোধগম্য নয়।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি সিআইডি ওই চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে সাতজনই চিকিৎসক। এসব চিকিৎসকের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি চিকিৎসক রয়েছেন। তদন্তের ধারাবাহিকতায় খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. তারিমকে আটক করা হয়েছে।
অতীতের তুলনায় সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের শোবিজ তারকাদের বিদেশ ঘোরার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। কেউ যাচ্ছেন স্টেজ শো করতে, কেউ বা যাচ্ছেন ব্যক্তিগত কাজ বা নেহাতই ঘুরতে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তারকাদের বিভিন্ন দেশে ঘোরার ছবি সহজেই চোখে পড়ে। তবে কিছু তারকা আছেন যারা আর দেশে ফিরে আসেন না। প্রবাসেই থেকে যান। সেই সংখ্যাও কম নয়। বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই যেন শোবিজ তারকাদের স্থায়ী হওয়ার জন্য প্রথম পছন্দ। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শোবিজ তারকা স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেছেন। তবে কেউই অবৈধভাবে সেখানে থাকছেন বলে শোনা যায়নি। সবাই বৈধভাবেই সেখানে বসবাস করছেন। কেউবা গিয়েছেন স্বামীর কর্মসূত্রে, কেউ আবার বাংলাদেশে ক্যারিয়ার পড়তির দিকে চলে যাওয়ায় উন্নত বিশ্বে থিতু হয়েছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারের একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসত গড়েন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা শাবান। বিউটিকুইনখ্যাত এই নায়িকা দেশের শোবিজ জগতের প্রভাবপত্তি উপেক্ষা করে চলে যান বিদেশে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বামী ওয়াহিদ সাদিককে এমপি বানানোর মিশন নিয়ে দেশে আসেন। মনোনয়ন না পেয়ে আবার ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
আরেক জনপ্রিয় নায়িকা শাবনুর থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। তিনি ক্যারিয়ারের চূড়ায় অবস্থানের সময় পাড়ি জমান ভিনদেশে।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত রয়েছেন নিউ ইয়র্কেই। ছেলে-মেয়েকে উন্নত পড়াশোনার সুবিধা দেওয়ার জন্যই তিনি সেখানে স্থায়ী হয়েছেন। একসময়ের ডাক সাইটে এই অভিনেত্রী এখন অভিনয় থেকে বহুদূরে। তবে তিনি শিল্পচর্চার মধ্যেই আছেন। নিয়মিত ছবি আঁকছেন এবং সেই ছবি নিয়ে জ্যাকসন হাইটসসহ নানা জায়গায় এক্সিবিশন করছেন। সেখান থেকে বেশ ভালো আয়ও করছেন বলে নিউ ইয়র্কে বসবাসরত একাধিক বাঙালি জানিয়েছেন।
বিপাশার স্বামী অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ যাওয়া-আসার মধ্যেই থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খান যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন। তার গ্রিন কার্ড পেতে প্রায় এক বছর লেগেছে। এই সময়ে তিনি সিনেমা থেকে দূরেই ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রেই তাকে অবসর পার করতে হয়েছে। এখন তিনি ঢাকা-নিউ ইয়র্ক আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছেন।
শাকিব খানের মতো এ সময়ের চিত্রনায়িকা পূজা চেরী, অপু বিশ্বাসসহ কম জনপ্রিয় আরও কয়েকজন তারকাও নাকি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডের জন্য চেষ্টা করছেন। শুধু বড় তারকারাই নন, একেবারে তরুণ নৃত্যশিল্পী রাসেল আহমেদ, মেহরাজ হক তুষার কিংবা রণবীর সাহারাও প্রবাসে স্থায়ী হয়েছেন। তাতে বোঝা যায়, শিল্পী তকমা থাকলে বিদেশে স্থায়ী হওয়া সহজ। বিদেশে স্থায়ী হতে যে ধরনের ডকুমেন্ট লাগে, শিল্পী হওয়ার সুবাদে সেগুলো তারা সহজেই দিতে পারেন। ফলে বৈধভাবেই তারা প্রবাসে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।
এ তো গেল সাম্প্রতিক সময়ের কথা। কয়েক বছর ধরে আরও অনেক জনপ্রিয় শোবিজ তারকা প্রবাসে স্থায়ী হয়েছেন। টনি ডায়েস-পিয়া ডায়েস দম্পতি, নওশীন-হিল্লোল দম্পতি, কণ্ঠশিল্পী বেবি নাজনীন, রিজিয়া পারভিন, দিনাত জাহান মুন্নি, বাদশাহ বুলবুল, সায়েরা রেজা, ব্যান্ড তারকা বিপ্লব, চিত্রনায়ক কাজী মারুফ, চিত্রনায়িকা রাত্রি, জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান, রোমানা, শ্রাবন্তী, মোনালিসা, তমালিকা কর্মকার, বন্যা মির্জা, দিলরুবা ইয়াসমিন রুহি, নোভা ফিরোজ, মিলা হোসাইন, পিয়া বিপাশা, আর্শিনা প্রিয়া, আমব্রিন সারজিন, ঈশানা, ইশিকা খান, বেনজির ইসরাত, শিরিন বকুল, রেহানা রাখি, নির্মাতা শামীম শাহেদসহ বেশ কিছু তারকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বাস করছেন।
দেশে এত ভক্ত দর্শকের ভালোবাসা, লাইমলাইট, শিল্পচর্চার মোহ ছেড়ে সাধারণ মানুষের মতো বসবাস করতে তারকারা কেন বিদেশে ছুটছেন? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে। শোবিজের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শোবিজের পেশা কিন্তু আর দশটা পেশার মতো নয় যে আপনি ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ওপরের দিকে উঠতে থাকবেন। আবার সরকারি চাকরির মতো এ ধরনের পেশার স্থায়িত্বের কোনো নিশ্চয়তা নেই। জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে না পারলে এখানে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। তা ছাড়া সিন্ডিকেট, নানা ধরনের পলিটিকসকে টেক্কা দিয়ে কাজ করতে হয়। তাই অনেক তারকা এই পেশার সঙ্গে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে চান না। তারা ভবিষ্যৎকে একটু সুন্দর-সুস্থির করতেই উন্নত বিশে^ পাড়ি জমান। এমন নয় যে তারা সবাই খুব খুশিমনে এই সিদ্ধান্ত নেন। অনেক শিল্পীই আছেন যারা বিদেশে থেকেও দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, নিজের চর্চা, দর্শকের ভালোবাসাকে প্রচ- মিস করেন।
নিউ ইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন এমন একজন শিল্পী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দেশে শিল্পীদের তরুণ বয়সেই যা মূল্যায়ন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তেমন কোনো কাজ তারা পান না। শুধু তা-ই নয়, প্রযোজক-পরিচালকরাও তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করেন না। তাই অনেকে সময় থাকতেই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিদেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন।’
সিনিয়র শিল্পীদের মধ্যে এভাবে দেশ ত্যাগ করে বিদেশে থাকার উদাহরণ তেমন নেই বললেই চলে। এখনকার তারকারা তবে কেন শিল্পচর্চাকে আঁকড়ে ধরে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারছেন না? জানতে চাইলে ওই শিল্পী বলেন, ‘দেখুন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের চারপাশের অনেক পরিবর্তন হয়; যা শিল্পীজীবনেও প্রভাব বিস্তার করে। আগের সময় শিল্পচর্চা বা আমাদের শোবিজের যে অবস্থা, কাজের যে পদ্ধতি ছিল তাতে তারা তুলনামূলক কম্ফোর্টেবল একটা জায়গা পেয়েছেন। এখন আর সিচুয়েশন তেমন নয়। এ জন্যই এখনকার শিল্পীদের মধ্যে অস্থিরতাও বেশি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশে যেসব শিল্পী রয়েছেন, তারা শিল্পচর্চা মিস করলেও আর্থিকভাবে সবাই বেশ ভালো আছেন। অনেকে হয়তো সমাজের চোখে ছোট কাজ যেগুলো, তেমন কাজও করেন, কিন্তু আর্থিক ও জীবনমানের নিশ্চয়তা আছে বলেই খুশিমনে সেটি করছেন। যেমন ব্যান্ড তারকা বিপ্লব ট্যাক্সি চালান। একসময়ের পর্দা ঝলসানো গ্ল্যামারের অধিকারী মোনালিসা এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুপার শপে বিউটি প্রোডাক্টের সেলস গার্ল হিসেবে কাজ করছেন। নন্দিত অভিনেত্রী শ্রাবন্তী সেবিকার কোর্স করেছেন। তিনি এই কর্মক্ষেত্রে চাকরি করেন। অভিনেত্রী নওশীনও মেডিকেল খাতে চাকরি করেন। তার স্বামী অভিনেতা হিল্লোল ইউটিউবে ফুড ব্লগ করেন নিয়মিত। বিমানবন্দরে কাজ করেন লাক্স তারকা নাফিজা জাহান। গ্যারেজের ব্যবসা রয়েছে টনি ডায়েসের। পিয়া ডায়েস নাচের স্কুল চালান। তমালিকা কর্মকারও একটি সাধারণ পেশায় আছেন।
আবার কোনো কোনো তারকা বিদেশে থেকেও ভালো চাকরি করছেন। বন্যা মির্জা বাংলাদেশে থাকতেও অভিনয়ের পাশাপাশি মার্কেটিংয়ে বড় পদে কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েও তিনি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার মার্কেটিং হেড হিসেবেই কাজ করছেন। অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান, রোমানা, চিত্রনায়িকা রাত্রি, সংগীতশিল্পী সায়েরা রেজা নিউ ইয়র্কে রয়েছেন মূলত স্বামীর চাকরিসূত্রে। শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নি বেশ ভালোই আছেন বলে জানালেন বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক কনসার্টে অংশ নিতে যাওয়া শিল্পী স্বপ্নীল সজীব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিউ ইয়র্কে ছিলাম দুদিন। সেখানে কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। কবির বকুল ভাই (গীতিকার) আর তার স্ত্রী মুন্নি ভাবির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ভাবি বাংলাদেশে গান করে যা আয় করতেন, এখন যুক্তরাষ্ট্রে স্টেজ শো করে তার চেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন। এ ছাড়া র্যাম্প মডেল তৃণর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার স্বামী তো একজন কোরিয়ান। তিনি কোরিয়ান অ্যাম্বাসিতে কাজ করেন। তাদের থাকার জায়গা রাজপ্রাসাদের চেয়ে কম নয়। অন্য শিল্পীদের সঙ্গে দেখা হয়নি, তাই জানি না তারা কে কী করেন বা কেমন আছেন?’
নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসেই বেশির ভাগ বাংলাদেশি শিল্পী থাকেন। সেখানে বসবাসরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবাসী বাংলাদেশি বলেন, ‘জ্যাকসন হাইটস হলো প্রান্তিক বাংলাদেশিদের বসবাস। এখানে বেশির ভাগ বাংলাদেশিই ছোটখাটো কাজ করেন। এখানে বাংলাদেশি যেসব তারকা থাকেন, তাদের সবার সঙ্গেই প্রায় দেখা হয়। এর মধ্যে বিপাশা হায়াত, কাজী মারুফ, টনি ডায়েস, শামীম শাহেদ, রিচি সোলায়মান, রোমানা, বন্যা মির্জা, সায়েরা রেজাসহ আরও কয়েকজন শিল্পী বেশ ভালো অবস্থানে আছেন। তবে অল্প কিছু শিল্পী আসলে তেমন কোনো কাজ জোটাতে পারেননি; বিশেষ করে পরিণত বয়সের গানের শিল্পীরা যারা রয়েছেন, তাদের কথা বলছি। তারা আশপাশের অতিসাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে চা-পানি খায়। আড্ডা দেয়। সেসব সাধারণ মানুষের কাছে তো এটা বিশাল ব্যাপার যে একজন তারকা তাদের সঙ্গে এত সময় কাটাচ্ছেন। দিন শেষে দেখা হলো, বাজারের পয়সাটা তাদের কাছ থেকেই নিয়ে নিল। একজন সিনিয়র শিল্পীর কথা শুনলাম, তিনি টানা ছয় মাস একজনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ভাড়া ছিলেন। বাসা ভাড়া চাইতে গেলে তিনি উল্টো মালিককেই পুলিশের ভয় দেখিয়েছেন। কারণ সেখানে গ্রাউন্ড ফ্লোর ভাড়া দেওয়া নিষেধ। এই হলো অবস্থা।’
প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক কাজী হায়াতের ছেলে জনপ্রিয় নায়ক কাজী মারুফ প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছেন, এটা ভাবতে খারাপ লাগলেও ছেলের কাজ নিয়ে ইতিবাচক বাবা। কাজী হায়াৎ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মারুফ বিদেশে গিয়েও বসে নেই। সেখানে সে একটি ছবি বানিয়েছে, নাম “গ্রিন কার্ড”। আমি মনে করি ছবিটি এ দেশের মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে ছবিটি দেখে মনে হয়েছে, সিনেমা হলে “গ্রিন কার্ড” দেখে দর্শকের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যাবে।’ বিদেশে স্থায়ী হওয়া নিয়ে কাজী মারুফ বলেন, ‘বাংলাদেশে সিনেমার তেমন কাজ ছিল না। কিন্তু কিছু তো করে খেতে হবে। তা ছাড়া ২০১৯ সালে আমাদের একটি ছবি মুক্তির কথা ছিল। সেভাবেই টার্গেট করেছিলাম। কিন্তু সিনেমাটি মুক্তি দিতে দেয়নি একটি বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। পরিচালক ছিলেন আমার আব্বা (কাজী হায়াৎ)। তারা আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আমরা রিলিজ করতে না দিলে কীভাবে রিলিজ করবেন। আমার আব্বার মতো মানুষকে এ কথা শুনতে হয়েছিল। সেদিন আব্বা বাসায় এসে বললেন, “আমি এই বয়সে যুদ্ধ করব? আমি চাই না তুমিও যুদ্ধ করো এদের সঙ্গে। চলে যাও আমেরিকা।” এসব কারণেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছি। এখানে নিজের ব্যবসা নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি।’
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান ফুটবলার কে? এ নিয়ে তর্কটা বহুদিনের। তবে ঘুরেফিরে আসে দুটি নাম। একজন বাংলাদেশের প্রথম বিদেশি লিগে খেলা কাজী সালাউদ্দিন। আরেকজন স্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গোলদাতা এনায়েতুর রহমান। ২০২২ সালে ২৮ বছর পর দেশে এসেছিলেন এনায়েত। সেই ১৯৯৪ সালে কানাডা পাড়ি জমিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন পর দেশে এসে অনেকটা সময় কাটিয়ে আবার ফিরে গেছেন। দেশে আসার পর অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে নিয়েছেন অর্থসহায়তা। তারপর আবার ফিরে গেছেন প্রবাসজীবনে।
ফুটবল মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির, কায়সার হামিদরা এ দেশেই থেকে গেছেন। রাষ্ট্র তাদের দিয়েছে যোগ্য সম্মান। সেই সম্মানটা পেতে পারতেন এনায়েতও। তারপরও কেন প্রবাসের কঠিন জীবন বেছে নেওয়া?
শুধু ফুটবলাঙ্গন নয়, তালিকা করলে দেখা যাবে হাজারো ক্রীড়াবিদ পাড়ি জমিয়েছেন নানা উন্নত দেশে। এক মার্কিন মুল্লুকেই মিলবে শত শত খেলোয়াড়। কেউ গিয়েছেন বৈধপথে। কেউবা কোনো ক্রীড়া আসরে অংশ নিতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। এই না ফেরার সলুকসন্ধান করতে গিয়ে বের হয়ে এলো কঠিন বাস্তব চিত্র। মোটা দাগে হতাশা থেকেই দেশ ছেড়ে গেছেন অনেকে। উন্নত ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেকে খেলোয়াড়ি জীবন শেষ হওয়ার আগেই পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।
ফুটবল অঙ্গন থেকে বিদেশে বসত গড়া তারকা সংখ্যা নেহাত কম নয়। দীর্ঘদিন ধরে কানাডায় বসবাস করেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রিজভী করিম রুমি, ফুটবলার মামুন জোয়ার্দার, মিজান। তারকা গোলকিপার ও বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ শাহিদুর রহমান চৌধুরী শান্টু, শামসুল আলম মঞ্জুর বসবাস যুক্তরাষ্ট্রে। কিংবদন্তি অ্যাথলেট সাইদুর রহমান ডন, ১৯৮৫ ঢাকা সাফ গেমসে পাঁচটি স্বর্ণপদকজয়ী সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খানের স্থায়ী নিবাস এখন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফ গেমসে সোনাজয়ী বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জুয়েল রানা একটু দেরিতে হলেও সপরিবারে চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় জাতীয় ফুটবল দলে প্রতিনিধিত্ব করা আবুল, বেলাল, মারুফ, তকলিছ আহমেদ, ওয়াহেদরা সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন প্রবাসে। অতিসম্প্রতি নারী ফুটবল দলের ক্যাম্প ছেড়ে চীন চলে গেছেন ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন। তবে তার দাবি, খেলার লক্ষ্যেই গেছেন।
প্রবাসজীবনকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত যে সবসময় সঠিক হয়, তা কিন্তু নয়। দেশের অন্যতম সেরা গোলকিপার মোহাম্মদ মোহসিনের কথাই ধরুন। দীর্ঘদিন কানাডায় বসবাস করেও ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে না পেরে দেশে ফিরে আসেন অসুস্থ অবস্থায়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে খুইয়েছেন সব সঞ্চয়। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগব্যাধি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নিয়েছে তার চিকিৎসার দায়িত্ব। আবার বিদেশের চাকচিক্যময় জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে নিজেকে সঁপে দেওয়ার উদাহরণও আছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাবেক ফুটবল তারকা আব্দুল গাফফার। তবে দেশের টানে ঠিকই ফিরে এসে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে।
ক্রিকেটাঙ্গনেরও অনেক তারকা বেছে নিয়েছেন প্রবাসজীবন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল এসিসি ও আইসিসির চাকরি সুবাদে অনেক দিন ধরেই আছেন দেশের বাইরে। চাকরিস্থল দুবাই হলেও তিনি সপরিবারে বসবাস করেন অস্ট্রেলিয়ায়। গোলাম নওশের প্রিন্স থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। ওপেনার আল শাহরিয়ার রোকন খেলোয়াড়ি জীবনেই পাড়ি জমান নিউজিল্যান্ডে। হালিম শাহ, তাপস বৈশ্য, মেহরাব জুনিয়র, জাতীয় দলের সাবেক পেসার মোহাম্মদ শরীফ, আবুল হাসান, ওপেনার জুনায়েদ সিদ্দিকীরা আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকে সেখানে নিয়মিত খেলাধুলাও করছেন। একসময়ের ঢাকার মাঠ কাঁপানো হকি খেলোয়াড় আবদুল সাদেক কানাডায় থাকেন অনেক দিন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আসরে খেলতে গিয়ে ফিরে না আসা ক্রীড়াবিদের সংখ্যাও কম নয়। ১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিক খেলতে গিয়ে ফেরেননি এক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব বিমল চন্দ্র তরফদার। কৃতী সাঁতারু কারার মিজানুর রহমানও সেবার থেকে যান যুক্তরাষ্ট্রে। দাবার বোর্ড ছেড়ে ইউরোপে স্থায়ী নিবাস গড়েছেন মহিলা আন্তর্জাতিক মাস্টার লিজা। অলিম্পিকের বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন সাঁতারু আরিফুল ইসলাম। তবে প্রশিক্ষণের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ফ্রান্সে থেকে যান তিনি। ২০০২ সালে ওয়ার্ল্ড কাপ শুটিংয়ে অংশ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরেননি দুই শুটার আফজাল ও রুবেল।
প্রবাসে বসত গড়া খেলোয়াড়দের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দেশ ছাড়ার অন্যতম কারণ দেশের অনিশ্চিত জীবন থেকে নিস্তার পাওয়া। ফুটবলার-ক্রিকেটারদের তারপরও কিছু আয়-রোজগার হয়, যা অন্য খেলায় একেবারেই নেই। তাই তো অন্য খেলার ক্রীড়াবিদ, সংগঠক, কোচদের বিভিন্ন গেমস থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বারবার কলঙ্কিত হয়েছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। পালিয়ে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করলেও নিজেদের ভবিষ্যৎটা তো নিশ্চিত করে ফেলেছেন তারা।
সাবেক তারকা ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম খোঁজার চেষ্টা করেছেন প্রবাসজীবন বেছে নেওয়ার কারণ, ‘হয়তো তারা মনে করেন দেশ সেভাবে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না তাদের। তাছাড়া ফুটবলাঙ্গনের কথা যদি বলি, বর্তমানে কয়জন ফুটবলার ভালো পারিশ্রমিক পাচ্ছে বলেন! সংখ্যাটা একেবারেই নগণ্য। বাকিদের অবস্থা বড্ড নাজুক। ফুটবল খেলে যখন জীবিকা নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়ে, তখন পরিবারের কথা ভেবে হতাশা থেকেই অনেকে একসময় বেছে নেয় প্রবাসজীবন। প্রবাসে সম্মান থাকুক আর না থাকুক, কোনোমতে টিকে তো যাওয়া যায়।’
খেলোয়াড়ি জীবনে আসলাম নিজেও পেয়েছিলেন জার্মানিতে নিবাস গড়ার প্রস্তাব। তবে দেশের মায়া ছাড়তে পারেননি তিনি, ‘আমার নিজেরও জার্মানির হামবুর্গে খেলার আর থাকার প্রস্তাব এসেছিল। তবে সে সময় আমি ছিলাম আবাহনীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। তাছাড়া আমার আম্মাও চাননি আমি বিদেশে চলে যাই। আমার বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই এই দেশটাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছেও জন্মায়নি কখনো।’ ফুটবলের বাইরের অন্য খেলার অনেকে অবৈধভাবে দেশ ছাড়াটা একেবারেই সমর্থন করেন না আসলাম, ‘সুযোগ সন্ধানী কিছু লোক থাকে তারা পালিয়ে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। তাদের বোঝা উচিত দেশের পতাকার প্রতিনিধিত্ব করতেই তারা বিদেশ খেলতে যায়। এভাবে পালিয়ে যাওয়া মোটেই ঠিক নয়।’
খেলাকে পুঁজি করে দেশের সম্মান নষ্ট করে অবৈধপথে প্রবাসজীবন বেছে নেওয়াকে সমর্থন করবেন না অনেকেই। তবে দেশের জন্য ঘাম ঝরানোর প্রতিদান যখন ক্রীড়াবিদরা পান না, তখন দীর্ঘশ্বাস সঙ্গী করে অনেকে বেছে নেন প্রবাসের কঠিন জীবন। যে জীবনে নেই তারকাখ্যাতি। আছে শুধুই কঠিন বাস্তবতা আর সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি।
বাঙলার কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যন্ত্রণাদগ্ধপ্রবাসে বসে লিখেছিলেন হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন/ তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,/ পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি। কবি সাহিত্যিক শিল্পী লেখকরা পারতপক্ষে দেশ ছাড়তে চান না; একেবারে বাধ্য না হলে।
শিক্ষকতা করতে, শিক্ষা গ্রহণ করতে বা প্রশিক্ষণ দিতে কিংবা খণ্ডকালীন চাকরি করতে অনেক লেখক বিদেশে গেছেন, কিন্তু স্থায়ীভাবে প্রবাসজীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন এমন বাংলাদেশি লেখকের সংখ্যাও কম নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শহীদ কাদরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ইকবাল হাসান প্রবাসেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
কবি লেখক সাহিত্যিকদের মধ্যে শামীম আজাদ, লুৎফর রহমান রিটন, আহমাদ মাযহার, খসরু চৌধুরী, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, মুজিব ইরম, মজনু শাহ্, তারেক রহিম, আহমেদুর রশীদ টুটুল, মাহবুব লীলেন, জোবায়েন সন্ধি, ড. সুকুমার বিশ্বাস, রবিশঙ্কর মৈত্রী, সালমা বাণী, মহিবুল আলম, সৈয়দ ইকবাল, শিরীন বকুল, জসীম মল্লিক, প্রবীর বিকাশ সরকার, অজয় দাশগুপ্ত, হরিপদ দত্ত, হাসানাল আবদুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, পারভেজ চৌধুরী, কাজী জহিরুল ইসলাম, হাসান ফেরদৌস, কামাল আহমেদ, দীপেন ভট্টাচার্য, আনোয়ার শাহাদাত, অজয় দাশগুপ্ত, আবেদীন কাদের, শাহাব আহমেদ, তাপস গায়েন, নাহার মনিকা, রাকীব হাসান, সাগুফতা শারমীন তানিয়া, মনজুরুল হক, চৈতী আহমেদ, নাদিয়া ইসলাম, রম্য রহিম চৌধুরী, সুব্রত কুমার দাস, আরিফ আনোয়ার, আদিব খান, ফেরদৌস নাহার, ফারহানা আজিম শিউলী, পারমিতা হিম, সালেহা চৌধুরীসহ অনেক কবি কথাকার লেখক প্রবাসজীবনে আছেন।
দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি বিদেশে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিইনি, আমাকে নেওয়ানো হয়েছে।’
কবি মজনু শাহ ইতালিতে। কেন দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যর্থতা এত বেশি জমেছিল যে তিক্ততা নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে কেবলই মনে হতো, আমার বাবার সামনে থেকে কবে দূরে কোথাও যেতে পারব। অনেক অনেক দূরে। যেখানে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। সেই তীব্র অভিমান একসময় মিলিয়ে গিয়েছিল ঠিকই, শুধু জীবন বয়ে গেল সম্পূর্ণ অচেনা এক দিকে।’
তিনি বলেন, ‘অচেনা মানুষ, অচেনা ভাষা, অচেনা সংস্কৃতির ভেতর ১৫ বছর কেটে গেল। সন্তানদের চিন্তাজগৎ অন্য একটা ভাষা-সংস্কৃতির রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে। আমি প্রবলভাবে দেশে ফিরতে চাইলেও, ওদের পক্ষে সহজ নয়। অনেক কিছুই এখন আমার আয়ত্তের বাইরে।’
কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ার এই তালিকা দীর্ঘ। তবে দেশের প্রতিষ্ঠিত জীবন ছেড়ে যেতেও বাধ্য হয়েছেন কেউ কেউ। দেশে লেখকজীবন রেখে প্রবাসে থিতু হওয়া প্রসঙ্গে কবি প্রাবন্ধিক ও বইয়ের জগৎ সম্পাদক আহমাদ মাযহার বলেন, ‘অনাকাক্সিক্ষত ও আকস্মিক আমার এই অভিবাসিতা এবং ভিন্ন সংস্কৃতিতে অপ্রতিষ্ঠিতের অনুশীলনময় জীবনযাপন। কিন্তু এতে বাংলাদেশের মানুষকে বারবার নবায়িত চোখে দেখার সুযোগ হচ্ছে; এর বিপ্রতীপে বাংলাদেশেরই মানুষকে ব্যাপক অভিবাসিতার মধ্যে পর্যবেক্ষণ করে আরও একটা স্বতন্ত্র জীবনবোধের মুখোমুখিও তো হওয়া যেতে পারে! দেখা যাক না কী হয়, একটা অতি সাধারণ, প্রান্তিক ও ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের অনুশীলময় যাপিত জীবন থেকে!’
প্রতি বছরই বইমেলায় দেশে আসা প্রখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনকে প্রবাসী লেখক বলতেই তিনি খেপে যান। রিটন বলেন, ‘আমি কোনো প্রবাসী লেখক নই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বিদেশে অভিবাসন নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, আমি বাংলা ভাষার একজন লেখক। আমি কোথায় থাকি, সেটি মুখ্য নয়। আমি কোন ভাষায় লিখি, সেটাই মুখ্য। অভিবাসী হওয়ার আগেই আমি লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘২০০১-এর জুন থেকে টোকিও দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। তখন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। ২০০১-এর নভেম্বরে জামায়াত-বিএনপি চারদলীয় জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আমি দেশান্তরি ছিলাম। বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং ঘাতক-রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে লেখালেখির অপরাধে তখন আমার পাসপোর্টটি বাতিল করা হয়েছিল। এরপর সাত-সাতটি বছর আমি ভাসমান উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছি কানাডায় এবং একপর্যায়ে নিয়ম অনুসারে স্থায়ী হয়েছি।’
রিটন আরও বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সবুজ একটি পাসপোর্ট আমার প্রাপ্য ছিল। আবেদনও করেছিলাম যথারীতি, কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসে। ২০০২ থেকে টানা সাত বছর আমি অপেক্ষা করেছি। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমি ছুটে গেছি দূতাবাসে। কিন্তু আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সেই সাতটি বছর দেশে ফেরার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা ছিল আমার! পাসপোর্ট আটকে মূলত আমার কাছ থেকে আমার দেশটি কেড়ে নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আমি দেশে ফিরতে পারিনি। অবশেষে মইন উ-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমি আমার কাক্সিক্ষত সবুজ পাসপোর্টি ফেরত পেয়েছিলাম।’
বাকস্বাধীনতা হারিয়ে কিংবা মৌলবাদীদের আক্রমণে আহত হয়ে দেশ ছেড়েছেন অনেক লেখক। নব্বইয়ের দশকে দাউদ হায়দার নোবেলজয়ী জার্মান লেখক গ্রুন্টার গ্রাসের সহযোগিতায় ভারত থেকে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-UNHCR-এর ট্রাভেল ডকুমেন্টের মাধ্যমে জার্মানি যান। তার আগে প্রায় দুই দশক তিনি ঢাকা-কলকাতায় আত্মগোপনে ছিলেন। জার্মানিতে তিনি দীর্ঘদিন ডয়চে ভেলেতে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন তিনি বার্লিনে বসবাস করছেন। তার কোনো দেশের পাসপোর্ট নেই।
তসলিমা নাসরীন প্রথমে ফ্রান্স, পরে সুইডিশ পেনের স্কলারশিপে দীর্ঘদিন সুইডেনে বাস করেছেন। এরপর তিনি প্রথমে ভারতের কলকাতায় এবং পরে দিল্লিতে বাস করা শুরু করেন। তসলিমা নাসরিনের নির্দিষ্ট কোনো দেশের পাসপোর্ট নেই। তিনিও UNHCR-এর ট্রাভেল ডকুমেন্টের মাধ্যমে ভ্রমণ করেন।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল জঙ্গি হামলায় আহত হওয়ার পর ইন্টারন্যাশনাল সিটিস অব রিফিউজি নেটওয়ার্কের (আইসিওআরএন) আওতায় নরওয়েতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। একই ঘটনায় আহত কবি তারেক রহিম এবং হুমকি পাওয়া কবি ও কথাকার মাহবুব লীলেন ঘটনার পর দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে আলোচিত বই ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ লিখেছিলেন রায়হান আবীর। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে কানাডায় পাড়ি দেন তিনি। এখন কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে সেখানেই বসবাস করছেন।
কবি, গবেষক ও কথাকার মাহবুব লীলেন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে টুটুল কইল, সাবধানে থাইকো আর পারলে বিকল্প দেখো।’
কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমান প্রথম আলোর আলপিন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কার্টুনের কারণে কারাভোগের পর ICORN-এর আওতায় নরওয়েতে আশ্রয় পেয়েছেন। তিনি বর্তমানে নরওয়ের নাগরিক। কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরও প্রবাসী। লেখক ও সম্পাদক জোবায়েন সন্ধি জঙ্গিগোষ্ঠীর ‘৮৪ হিটলিস্টে’ আসার পর ২০১৫ সালে সরকারি চাকরি ও দেশ ছেড়ে প্রথমে ভারত যান। এরপর জার্মান ফেডারেল সরকারের অর্থায়নে জার্মান পেনের Writer-in-Exile স্কলারশিপ নিয়ে ওই দেশে আছেন।
লেখক সংস্কৃতিকর্মী অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ‘প্রবাসীর জীবন উটের কাঁটাগাছ খাওয়ার মতো। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য খেতে হয় কিন্তু ঠোঁট বেয়ে দরদর করে রক্ত ঝরে। দেশের পাখি, বৃক্ষ, চায়ের দোকানের আড্ডা, বইমেলা, রাজনৈতিক কলহ মিস করি।’
কথাসাহিত্যিক শাহাব আহমেদ রাশিয়ায় পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘সেখানে বিয়ে করেছিলাম, বিয়ে করে বিদেশি বউ নিয়ে দেশে আসার আর উপায় ছিল না। একদিকে নিরাপত্তার প্রশ্ন, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা, ভাষা প্রতিবন্ধকতা এসব কারণে আমাকে বিদেশেই থিতু হতে হয়েছে। কিন্তু দেশের জন্য মন পোড়ায় না এমন তো না, মানসিকভাবে আমি তো আমার জন্মভূমিতেই থাকি, আমার লেখালেখির ভিত্তিভূমিও দেশ ও দেশের মানুষই। সুতরাং আমার বিদেশে চলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়, পরিস্থিতির কারণে, অবশ্যই বেটার লাইফের জন্য।’
কী হলে দেশে ফিরবেন প্রশ্নের জবাবে কবি ও লেখক মাহবুব লীলেন বলেন, ‘পড়াশোনার মূল দায় হলো নিজের পাঠের সারসংক্ষেপ আর পাঠপ্রতিক্রিয়া অন্যকে জানানো। অভিজিৎ রায় কিংবা অনন্ত বিজয় যা লিখেছেন, তার সবই তাদের পাঠপ্রতিক্রিয়া ও গবেষণার সারসংক্ষেপ। এর লাইগা তাদের কেন খুন হতে হলো? মতের প্রতিক্রিয়ায় মতামত; লেখার প্রতিক্রিয়ায় সমালোচনা; গবেষণার বিপরীতে গবেষণা এসবই তো হওয়ার কথা। লেখার প্রতিক্রিয়ায় খুন; মতামতের প্রতিক্রিয়ায় গ্রেপ্তার-কারাগার তো হওয়ার কথা না। যদি এগুলো বন্ধ হয়, তবে নিশ্চিত দেশে ফিরব আমি। কারণ বাংলাদেশ ছাড়া বাংলায় হাসা যায় না অন্য কোথাও।’
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে ভারতকে পাশে পাচ্ছেন শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রকে পাঠানো এক কূটনৈতিক বার্তার বরাতে তেমনটাই জানাচ্ছে আনন্দবাজার পত্রিকা ও জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে। সংবাদমাধ্যম দুটির ভাষ্য, নয়াদিল্লি মনে করছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার দুর্বল হলে তা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষেই সুখকর হবে না। ওয়াশিংটনের মতো ভারতও বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চায় জানিয়ে ওই কূটনৈতিক বার্তায় নয়াদিল্লি বলেছে, হাসিনা সরকারকে অস্থির করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক নয়।
আনন্দবাজার বলছে, সেপ্টেম্বরে জি-২০ বৈঠকে নয়াদিল্লিতে এক মঞ্চে বসবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগে ভারতের এ বার্তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। কূটনৈতিক নোটে ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষেই সুখকর হবে না। কারণ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে জামায়াতের মতো সংগঠনের ক্ষমতা বাড়বে বলে মনে করে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু ভারত মনে করে জামায়াত একটি উগ্র মৌলবাদী সংগঠন।
ভারতের বার্তায় সেটি উল্লেখ করে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ স্থলসীমান্ত আছে। বাংলাদেশে জামায়াতের মতো সংগঠন শক্তিশালী হলে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা সমস্যার মুখে পড়বে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ভারতের উত্তরপূর্ব সীমান্ত অঞ্চল বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে। আফগানিস্তানের মতো ভারতের অন্য প্রতিবেশী সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিও নয়াদিল্লির জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘতম স্থলসীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। ফলে সে দেশের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি ভারতেও প্রভাব ফেলে।
ডয়চে ভেলে বলছে, কূটনৈতিক নোটে ভারত এ কথাই বাইডেন প্রশাসনকে জানিয়েছে যে, জামায়াতকে আশকারা দিলে একদিকে যেমন ভারতের আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বাড়তে পারে, তেমনই চীনের প্রভাব বাংলাদেশে অনেকটাই বেড়ে যাবে, যা কাক্সিক্ষত নয় ওয়াশিংটনেরও। এ ছাড়া ওই বার্তায় বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পৃথক ভিসানীতিরও সমালোচনা করা হয়েছে।
একটি সূত্রের বরাতে আনন্দবাজার বলছে, বিষয়টি (ভিসানীতি) যে আদৌ উচিত নয়, সে কথা ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি। ভারত মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতি সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো। ভারত এ নীতিকে ভালো চোখে দেখছে না।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল নয়াদিল্লি গিয়ে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব তথা কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে তারাও বার্তা দিয়েছে, আঞ্চলিক স্থিতি বজায় রাখার প্রশ্নে বিএনপি-জামায়াত জোট বিপজ্জনক। প্রতিনিধিদলের নেতা বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গেও একটি ইতিবাচক বৈঠক করেন।
সার্বিক বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, বাংলাদেশের জন্মের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মসৃণ থেকেছে। যখনই সে দেশে অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় এসেছে, দুই দেশের সম্পর্ক ততটা মসৃণ থাকেনি। তাই ভারত সবসময়ই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকারকে গুরুত্ব দেয়। উৎপল মনে করেন, ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকার দেখতে চায় ভারত। কারণ ভারত মনে করে, আওয়ামী লীগের সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকলে দুই দেশের সীমান্ত আপাতদৃষ্টিতে সুরক্ষিত থাকে।
গোটা দেশ কারাগারে পরিণত হয়েছে এমন মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাদের শত শত নেতাকর্মীকে কারাগারে আটক রেখেছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ যখন ভয় পায়, তখন আটক করে রাখে। ভয়ে এখন মুখ শুকিয়ে গেছে। টেলিভিশনে দেখবেন এখন আগের মতো (আওয়ামী লীগ নেতাদের) হাসি নেই। আর চকচকে কাপড় এখন কম পরে। যারা বিদেশে বাড়িঘর করছিল, ওরা কেমন করে বাঁচবে তার চেষ্টা করছে।’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর দয়াগঞ্জের তিন রাস্তার মোড়ে গণমিছিলের আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি সালাহউদ্দিন আহমেদ, রবিউল ইসলাম রবি, রফিকুল ইসলাম মজনু, মোনায়েম মুন্না, শাহিনসহ আরও অনেকে আটক বলে উল্লেখ করেন। সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে গতকাল ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরে গণমিছিল করে বিএনপি। রাজধানীতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
দয়াগঞ্জ থেকে ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির গণমিছিল শুরু হয়। বেলা ৩টার আগে থেকেই দয়াগঞ্জ ও এর আশপাশের সড়কে দলটির নেতাকর্মীরা জড়ো হন। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে দয়াগঞ্জে তিন রাস্তার মোড় থেকে গণমিছিল বের হয়ে সায়েদাবাদ, মানিকনগর, কমলাপুর স্টেডিয়ামের সামনের সড়ক হয়ে খিলগাঁও চৌরাস্তায় গিয়ে শেষ হয়।
জুমার নামাজের পর থেকেই দলটির নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন। দয়াগঞ্জ তিন রাস্তার মোড়ে পিকআপ ভ্যানে অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। কর্মসূচি কেন্দ্র করে দয়াগঞ্জ ও এর আশপাশে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকতে দেখা যায়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘পুলিশ ভাইয়েরা কথায় কথায় রাতের অন্ধকারে আমাদের ছেলেদের গ্রেপ্তার করেন, আপনাদের ৯ জন বড় বড় অফিসার আমেরিকা যেতে পারেন না। তারা যে সহায়-সম্পদ তৈরি করেছিলেন, বিদেশে সেগুলোর কী হবে তার জন্য রাতে ঘুম হয় না। খুব পরিষ্কার করে বলি, যারা পুলিশের লোক তারা কখনই অন্যায়-চুরি-চামারির সঙ্গে জড়িত না। জড়িত ওই বড়রা। তাদের সম্পূর্ণ বেআইনি নির্দেশে আজকে তারা পুলিশের রাজত্ব করছে। অবস্থা এখন আরও খারাপ। আমেরিকান মানুষরা, বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বলতে শুরু করেছে, বাংলাদেশের ওপর একটা শুনানি হোক। বিরোধী দলগুলোর ওপরে অত্যাচার, নির্যাতন হচ্ছে, গ্রেপ্তার, হত্যা হচ্ছে। তাই এদের আবার নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হোক।’
সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সরকার নির্বাচনী ফান্ড তৈরির ফন্দি এঁটেছে। আওয়ামী লীগ দেশটাকে লুট করে, ফোকলা বানিয়ে আবার নতুন আরেকখান কায়দা বের করেছে। বলে পেনশন দেবে, পেনশন স্কিম। মানুষের টাকা চুরি করার আরেকটা ফন্দি বের করছে। ওই টাকা চুরি করে ওরা নির্বাচন করতে চায়। মানুষ এবার তাদের দেবে না।’
তিনি বলেন, ‘১৮ কোটি মানুষের দাবি, ভালোয় ভালোয় শান্তিপূর্ণভাবে বিদায় হন। অন্যথায় মানুষ জানে স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী ডিক্টেটরকে কীভাবে সরাতে হয়। ’৫২ সালে, ’৬৯ সালে, ’৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে, ’৯০ সালে স্বৈরাচারকে সরিয়েছে, এবার আপনার পালা।’
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণসভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখন তিনি কী নিয়ে এসেছেন? ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর বললে তো লাভ হবে না। উত্তরে উত্তুঙ্গ পর্বতমালা আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। কোনো দিকে যাবে তুমি, কোনো দিকে পালাবার পথ নাই।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। এতে আরও বক্তব্য দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রমুখ।
গণমিছিলে অংশ নেন গয়েশ^র চন্দ্র রায়, ড. আসাদুজ্জামান রিপন, শিরিন সুলতানা, নাসির উদ্দিন অসীম, আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা।
একই সময় মহানগর উত্তরের উদ্যোগে একটি মিছিল রাজধানীর গুলশান ১ থেকে ওয়্যারলেস, তিতুমীর কলেজ সড়ক হয়ে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলের নেতৃত্ব দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে নজরুল ইসলাম খান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, তাবিথ আউয়াল, আামিনুল হক প্রমুখ নেতারা অংশ নেন।
গণমিছিল-পূর্ব সমাবেশে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আজকে শুনলাম পাশের দেশের কিছু কর্মকর্তা নেপালে গেছে পানি পড়া আনতে। এই পানি পড়া দিয়ে কাজ হবে না। এই সরকারকে সরে যেতে হবে। আমাদের গ্রেপ্তার করে, মামলা দিয়ে, হয়রানি করে আন্দোলন থেকে দূরে রাখা যাবে না। আমাদের আর ভয় নেই, দেশের মানুষ গুম-হত্যাকে ভয় পায় না।’
গত ১২ জুলাই এক দফার এ আন্দোলন শুরুর পর ঢাকায় মহাসমাবেশ, ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি এবং গণমিছিল করেছে বিএনপিসহ শরিক জোটগুলো। এবার চতুর্থ এ কর্মসূচিতে ঢাকাসহ বাইরের মহানগরগুলোতে গণমিছিল পালিত হয়।
বিএনপি ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চ জাতীয় প্রেস ক্লাব, ১২ দলীয় জোট ফকিরাপুল পানির ট্যাংক, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিজয় নগরে, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি আরামবাগে, এলডিপির এফডিসির সামনে, লেবার পার্টি পুরানা পল্টনে মসজিদের সামনে, এনডিএম মালিবাগ মোড়, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা সেগুনবাগিচার স্কুলের সামনে, গণ অধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া) রামপুরা ব্রিজ, গণ অধিকার পরিষদ (নূর) ফকিরাপুল কালভার্ট রোডে এবং বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ শাহবাগ মোড় থেকে গণমিছিল বের করে।
এর আগে গতকাল সকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জিয়াউর রহমানের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়। এতে তিন পর্বে ৬৯ জনকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রচনা প্রতিযোগিতা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আ ফ ম ইউসুফ হায়দার। বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলামের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম।
আগামী চেস গিল্ড স্কুল দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আইয়ান রহমান ও মনন রেজা নীড়। একক ইভেন্টের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী ক্যাটাগরিতে আইয়ান ও ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নীড়। ৭ রাউন্ডের খেলায় আইয়ান ও নীড় দুজনই পেয়েছে সাড়ে ছয় পয়েন্ট করে।
বিটজ দলগত বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এলিগেন্ট চেস একাডেমি। এই দলে খেলেছে জারিফ হক আফনান, তাসরিক সায়হান, সিয়াম চৌধুরী ও নীলাভা চৌধুরী। আজ শনিবার দাবা ফেডারেশন কার্যালয়ে শেষ হয়েছে এই প্রতিযোগিতা।
আগামী চেস গিল্ডের আয়োজনে গত ২৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয় ‘আমরা ৯২’ আগামী চেস গিল্ড স্কুল রেটিং টুর্নামেন্ট। সুইস লিগ পদ্ধতিতে হয়েছে খেলা। একক ও দলগত দুই বিভাগে অংশ নেয় ১৪৫ জন দাবাড়ু। টুর্নামেন্টে বিজয়ীরা ট্রফি, মেডেল ও সার্টিফিকেটের পাশাপাশি পেয়েছে ৭০ হাজার টাকা।
টুর্নামেন্ট শেষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার, আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রানী হামিদ। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম।
টানা ৬ ম্যাচ জিতে লা লিগার শীর্ষে উঠে এসেছিল জিরোনা। আগের রাতে সেভিয়াকে হারানো বার্সেলোনা সেই জিরোনাকে পেছনে ফেলে। আর রিয়াল মাদ্রিদ এবার উড়তে থাকা জিরোনাকে হারিয়ে লা লিগার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করেছে।
শনিবার মন্তিলিভি স্টেডিয়ামে জিরোনাকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে কার্লো আনচেলত্তির দল। রিয়ালের হয়ে গোল তিনটি করেছেন জোসেলু, অঁরেলিয়ে চুয়ামেনি ও জুড বেলিংহাম।
আট ম্যাচের সাতটিতে জিতে রিয়ালের পয়েন্ট এখন ২১। সমান ম্যাচে ২০ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে বার্সেলোনা। আর টানা ছয় জয়ের পর রিয়ালের কাছে হেরে যাওয়া জিরোনা ১৯ পয়েন্ট নিয়ে আছে তিনে।
সপ্তাহ খানেক আগেই আতলেতিকো মাদ্রিদে গিয়ে ৩-১ গোলে হেরেছিল রিয়াল। এবার জিরোনায় গিয়ে
প্রথমার্ধেই ২ গোলে এগিয়ে যায় আনচেলোত্তির শিষ্যরা। এর মধ্যে ১৭ মিনিটে বেলিংহামের ক্রস থেকে বল জালে পাঠান জোসেলু। আর ২২ মিনিটে টনি ক্রুসের কর্নার থেকে হেডে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন চুয়ামেনি।
রিয়াল ব্যবধান ৩-০ করে ৭১ মিনিটে। জোসেলুর শট জিরোনা গোলরক্ষক প্রতিহত করলেও বিপদমুক্ত করতে পারেননি। নাগালে বল পেয়ে দারুণভাবে বল জালে পাঠান বেলিংহাম। এটি রিয়ালের হয়ে ৭ ম্যাচে তার অষ্টম গোল।
দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও কুমিল্লার বটগ্রাম মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা নুরুল হক। আলেমদের অবস্থান সুসংহত করাসহ জেলার মাদ্রাসাগুলোকে একতাবদ্ধ রাখা ও শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। সাদাসিধে চলাফেরায় অভ্যস্ত আশি বছর বয়সী এই আলেম বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন ধরে হাদিসের বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বোখারি শরিফের দরস দেন। তার বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে লিখেছেন শামসুদ্দীন সাদী
অলি-আউলিয়ার পুণ্যভূমি বারো আউলিয়ার দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ঊর্বর ভূমিতে জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য বুজুর্গ ও গাউস কুতুব। ভিনদেশ থেকেও আগমন ঘটেছে বহু বুজুর্গের। যাদের পুণ্য পরশে পত্র-পল্লবে সেজে উঠেছে বাংলার মাটি। তাদের উদার মানবতা, চরিত্রের মাধুর্য, মহানুভবতা, মানবপ্রেম ও মহান আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠা ভিন্নধর্মীদের আকৃষ্ট করেছে। ফলে ইসলাম এদেশের মাটির বুকে সুদৃঢ়ভাবে শেকড় গেড়েছে। এখনো সারা দেশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আলেম ও বুজুর্গ। তাদেরই একজন মাওলানা নুরুল হক। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও কুমিল্লার প্রবীণ মুরব্বি। কুমিল্লা জেলার বটগ্রাম মাদ্রাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস।
আশি বছর বয়সী প্রবীণ এই আলেমের জন্ম ব্রিটিশ ভারতে আনুমানিক ১৯৪১ সালে, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সাতবাড়িয়া দাতামা গ্রামে। পিতা সোনা মিয়া ছিলেন অত্যন্ত দীনদার, আমানতদার ও বিশ্বস্ত মানুষ। মাতা জোবায়দা খাতুন ছিলেন দীনদার নামাজি ও পর্দানশিন নারী।
শৈশবে এক বুজুর্গের হাতে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। গ্রামের মসজিদের ইমাম আমির উদ্দীন মাস্টার ছিলেন তার প্রথম শিক্ষক। প্রথাগত আলেম না হলেও আমির উদ্দীন মাস্টার শরিয়ত পালনে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। কোনো ধরনের অনৈসলামিক কার্যকলাপ তিনি সহ্য করতেন না। তার একান্ত চাওয়া ছিল, এলাকার মানুষ দীনের পথে ইসলামের পথে চলুক। সব ধরনের বেদআত ও পাপের কাজ থেকে দূরে থাকুক। এমন মান্যবর বুজুর্গের হাতে তিনি আলিফ বা-তা-সা ও বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন।
মক্তবের বাল্যশিক্ষার পর স্কুলে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। মা-বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না থাকায় দুই বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকে। দুই বছর পর দাতামা পশ্চিম পাড়ার ছেলামত উল্লাহ বেপারির বাড়িতে পড়ালেখার ব্যবস্থা হয়। তিনি, তার জীবনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মাওলানা আবদুল ওয়াহাব (রহ.)-সহ আরও কজন ছিলেন এখানকার সহপাঠী। এখানে তাদের শিক্ষক ছিলেন একজন বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব মাওলানা আব্দুল হাকিম (রহ.)।
আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয় জোলাই ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। তৎকালে অত্র এলাকায় জোলাই মাদ্রাসার পড়াশোনার সুনাম-সুখ্যাতি ছিল। শরহে জামি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ভর্তি হন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায়। দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত হাটহাজারী মাদ্রাসাতেই পড়াশোনা করেন। দাওরায়ে হাদিস শেষ করার পর হাটহাজারী মাদ্রাসাতেই তাফসিরুল কোরআনের ওপর এক বছরের বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন। এ সময় তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসায় জগদ্বিখ্যাত বহু মনীষীর শিষ্যত্ব লাভ করেন।
তার কর্মজীবনের সূচনা হয় গোপালগঞ্জে এক আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। সেখানে পনেরো বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা করেন। পরে সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন নিজ জেলা কুমিল্লায়। কুমিল্লার প্রাচীন মাদ্রাসা বটগ্রাম হামিদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের কয়েক বছর পর সহকারী মুহতামিম, এর কয়েক বছর পর ১৯৯০ সালে মুহতামিম নিযুক্ত হন। তখন থেকে অদ্যাবধি এই গুরুদায়িত্ব পালন করছেন।
আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতার (সুলুক-তাসাউফ) পথে বহু বুজুর্গের সান্নিধ্য পেয়েছেন। অনেকের কাছ থেকে খেলাফতও লাভ করেন। হাটহাজারী মাদ্রাসায় পড়ালেখা কালেই মেখল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হামিউস সুন্নাহ মুফতি ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর কাছে বায়াত (শিষ্যত্ব গ্রহণ) হন। তার ইন্তেকালের পর হাকিমুল উম্মত হজরত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা তওবার রাজনীতির প্রবর্তক মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন। হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) তখন বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী। তাই তারই নির্দেশে শর্শদি মাদ্রাসার আউয়ালের কাছ থেকে সবক গ্রহণ করেন। হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর ফেনী ওলামা বাজার মাদ্রাসার মুহতামিম বরেণ্য বুজুর্গ হজরত মাওলানা আব্দুল হালিম (রহ.)-এর হাতে বায়াত হন এবং তার থেকেই খেলাফত লাভ করেন। এছাড়া হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা পলাশের হুজুরের কাছ থেকেও এজাজত লাভ করেন।
এক সময় কুমিল্লা জেলাজুড়ে ছিল শিরক-বেদআতের গয়রহ দাপট। নানা বেদআতে সয়লাব ছিল কুমিল্লা শহর। কওমি মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসায় পড়–য়া আলেম-উলামাদের নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হতো। মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হতো মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে। কিন্তু সংঘবদ্ধতার অভাবে শিরক-বেদআত দূর করা ও কওমি মাদ্রাসার অবস্থান ও গুরুত্ব তুলে ধরার কোনো সুযোগ ছিল না। এই শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে জেলার চিন্তাশীল আলেমরা মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কুমিল্লা জেলা কওমি মাদ্রাসা সংগঠন।’ জেলার ছোট-বড় প্রায় সব মাদ্রাসা এই সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত। কাসিমুল উলুম মাদ্রাসার মাওলানা আশরাফ আলী (রহ.), বরুড়া মাদ্রাসার মুফতি আব্দুল ওয়াহাব (রহ.), রানীর বাজার মাদ্রাসার মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব (রহ.) এবং বটগ্রাম মাদ্রাসা থেকে মাওলানা নুরুল হক এই সংগঠন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কুমিল্লা জেলায় কওমি আলেমদের সুসংহত অবস্থান তৈরি হয়। কওমি শিক্ষার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা বন্ধ হয়। জেলার প্রাণকেন্দ্রে এর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে থাকে। দেশ-বিদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-উলামারা আমন্ত্রিত হন। জেলার মাদ্রাসাসমূহকে একতাবদ্ধ রাখা ও শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই সংগঠনের অবদান রয়েছে। বর্তমানে তিনি এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এতসব গুরুদায়িত্ব পালন করার পরও সরল জীবনের এক মূর্তপ্রতীক তিনি। বিরোধপূর্ণ বিষয় থেকে সযতেœ নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। তার চলাফেরা একেবারে সাদাসিধে। পোশাক-আশাকে বিলাসিতা নেই। সাধারণ পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ক্ষেতখামারে কাজ করেন। পানি সেচ দেন। ইখলাস (একনিষ্ঠতা) ও লিল্লাহিয়াতের (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব কিছু করা) জীবন্ত নমুনা। কয়েকটি মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন ধরে পড়াচ্ছেন হাদিসের বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বোখারি শরিফ।
মাওলানা নুরুল হকের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দাওয়াত ইলাল্লাহ তথা আল্লাহভোলা মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা। দীনের কথা শোনানো। ইসলামের পথে চলতে উদ্বুব্ধ করা। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে আনাচে-কানাচে তিনি এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ান। দিনরাত ছুটে বেড়ান মাহফিল থেকে মাহফিলে। কিছুটা আঞ্চলিক ভাষায় বয়ান করেন তিনি। যে কারণে সর্বসাধারণ সহজেই তার বয়ানের মর্মবাণী হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। আলেম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই মুগ্ধমনে তার বয়ান শুনেন। তার বয়ানে খোঁজে পান জীবন পথের পাথেয়।
ইসলামের সৌন্দর্য, পারিবারিক জীবন, আখেরাতে ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টির পথ-পদ্ধতি হলো তার বয়ানের বিষয়বস্তু। ইসলাম যে জীবনমুখী ধর্ম, ইসলামে কোনো বৈরাগ্য নেই তার জীবনে ও বয়ানে বারবার বিষয়টি ফুটে ওঠে। দুনিয়ার কাজকর্মও যে দীনের অংশ এবং তাতেও যে অফুরন্ত সওয়াব লুকিয়ে আছে নানা উপমার মাধ্যমে তিনি সেগুলো স্পষ্ট করেন। গতানুগতিক ওয়াজ মাহফিলের বাইরে বিশেষ ইসলাহি মাহফিলও করেন। ভক্ত মুরিদানের আমল আখলাকের খোঁজ-খবর নেন। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মুরিদানের আমলি উন্নয়নের চেষ্টা করেন।
বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি জড়িত। নিজ গ্রামে দাতামা মাদ্রাসা, ধনাইতরী নূরানী মাদ্রাসা, সুলতানপুর কারিয়ানা মাদ্রাসাসহ আরও অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অসংখ্য মাদ্রাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এখনো অনেক মাদ্রাসার নীতিনির্ধারণী কমিটি তথা মজলিসে শুরার সভাপতি ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক মাদ্রাসার সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন।
প্রতিটি কাজে তিনি কোরআন-সুন্নাহর অনুসরণ করেন। নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটেন। নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা কুঁজো হয়ে গেছেন। কথিত আছে, বেপর্দা ও গোনাহ থেকে বাঁচতেই তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটেন। অবসর সময়ে ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করেন। কিতাব অধ্যয়ন করেন। ধ্যানে ডুবে থাকেন। সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সময় দেন। ১০ ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার পরিবার। ছেলেদের অনেকে আলেম হয়েছেন, বাকিরা পড়াশোনা করছেন।
একনিষ্ঠ ও দরদি মানব-দুর্ভিক্ষের এই দুঃসময়ে মাওলানা নুরুল হক আমাদের জন্য এক বটবৃক্ষ। তার ছায়া আমাদের জন্য রহমত। কেবল কুমিল্লার জন্য নয়, সারা দেশের জন্যই তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন বহু বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব সারা দেশে ছড়িয়ে আছেন, যারা আমাদের অগোচরেই হারিয়ে যান। মৃতুর পর হয়তো সংবাদ পাই। জীবিত থাকতে তাদের থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ আমাদের হয় না। এ ধারার পরিবর্তন দরকার। আল্লাহতায়ালা এই মহীরুহ ব্যক্তিত্বসহ অন্যদের ছায়া আমাদের ওপর দীর্ঘায়িত করুন।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
রাজধানীর ঢাকা কলেজের একটি আবাসিক হলে এক সাংবাদিককে আটকে রেখে ১৫ ঘণ্টা ধরে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যান। গত বৃহস্পতিবার রাতে কলেজটির শহীদ ফরহাদ হোসেন হলে নির্যাতনের ওই ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ওবায়দুর সাঈদ।
তিনি একই কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি। কলেজ সাংবাদিক সমিতির দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্বেও আছেন ওবায়দুর। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা কলেজ প্রশাসন।
নির্যাতনের শিকার ওবায়দুর সাঈদ জানান, ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতির সদস্য ফয়সাল আহমেদকে নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবেদন প্রকাশ করায় তাকে রাতভর আটকে রেখে নির্যাতন করে কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সভাপতি রাউফুর রহমান সোহেলের নেতৃত্বে এই নির্যাতন চলে। খবর পেয়ে ১৫ ঘণ্টা পর পরিবারের সদস্যরা গিয়ে ওবায়দুরকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
ওবায়দুর সাইদ জানান, তিনি শহীদ ফরহাদ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পর তার কক্ষে আসে একই হলের ছাত্রলীগ নেতা রাউফুর রহমান সোহেল ও তার কয়েকজন অনুসারী। এ সময় সোহেল ওবায়দুরের বুকে লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। এরপর মুখে ও কানে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ফয়সালকে নির্যাতনের খবর কোন কোন পত্রিকায় পাঠানো হয়েছে। এরপর সোহেল ওবায়দুরের গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে তার মোবাইল ফোনের লক খুলতে বাধ্য করে। পরে ওই মোবাইলের স্ক্রিন থেকে কলেজের সাবেক ও বর্তমান সাংবাদিকদের যোগাযোগের মেসেঞ্জার গ্রুপ ও সাংবাদিক সমিতির গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে হওয়া কথোপকথনের ভিডিওচিত্র ধারণ করে।
এর আগে গত বুধবার গেস্ট রুমে (হলের অতিথি কক্ষে রাজনৈতিক বৈঠক) যেতে দেরি করায় ইংরেজি বিভাগের আবাসিক শিক্ষার্থী এবং ডেইলি বাংলাদেশ ও প্রতিদিনের ক্যাম্পাসের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি ফয়সাল আহমেদকে বেধড়ক পেটায় ছাত্রলীগ নেতারা। এ ঘটনার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় বিভিন্ন সাংবাদিক ও ছাত্রসংগঠন।
প্রত্যক্ষদর্শী এক ছাত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সোহেলের হাত থেকে ওবায়দুরকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সোহেলের হিংস্র আচরণের কাছে আমরা অসহায়। বাধা দিতে গেলে সে আমাদেরও মারতে আসে। পরদিন দুপুরে ওবায়দুর বারবার জুমার নামাজ পড়তে যেতে চেয়েছে, কিন্তু ওকে নামাজও পড়তে দেওয়া হয়নি। রুমে তালা দিয়ে আটকে রাখা হয়। ১৫ ঘণ্টার বেশি সময় নির্যাতনের পর ওকে বের করে নেওয়া হয় প্রিন্সিপালের রুমে।’
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতের পর ওবায়দুরের মোবাইল ফোন এখনো ফেরত দেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ আবু ইউসুফ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামীকাল (আজ রবিবার) রিপোর্ট জমা দেবে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। রাতটা পোহালেই বাংলাদেশ দল উড়াল দেবে ভারতের গোয়াহাটিতে। তবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি দল। বিসিবি জানিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চলমান তৃতীয় ওয়ানডের ম্যাচ শেষেই জানানো হবে বিশ্বকাপের দল।
প্রচুর আলোচনা ও জল্পনা–কল্পনার পর আজ বিশ্বকাপে নিজেদের স্কোয়াড ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির ফেসবুক পেজে আজ দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে দেখা যায় বিসিবির লোগোসংবলিত বক্সে করে গুরুত্বপুর্ণ কিছু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিডিও–র শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে, বলুন তো ভেতরে কি?
বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় সন্ধ্যা পৌণে ৬টায় ঘোষণা করা হবে দল। কিন্তু ৫টা ৪০ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় তৃতীয় ওয়ানডের শেষেই দল ঘোষনা করা হবে।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।