
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের (অ্যানেক্স ভবন) চারতলায় মনিরুজ্জামান মনির (৪৩) নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় গত ৩০ জুলাই দুপুর দেড়টার দিকে। দুর্বল রোগা শরীরের এই ব্যক্তি বিচারপ্রাথী। চোখে-মুখে ক্লান্তি আর হতাশার ছাপ।
জানতে চাইলে দেশ রূপান্তরকে মনির বলেন, পেশায় সামান্য আয়ের টাইলস মিস্ত্রি তিনি। বরিশালের দক্ষিণ সাগরদী এলাকায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে মামলার কাজে প্রায়ই উচ্চ আদালতে আসতে হয় তাকে। প্রতিবেশীর সঙ্গে ৬০ বছরের জমির বিরোধে ৪৬ বছরই কেটে গেছে মামলায়। দাদার সময়ের মামলার জের ধরে তার (মনির) বাবা মামলায় জড়িয়েছেন, তিনি নিজেও এখন মামলা টানছেন। ইতিমধ্যে তার দাদা, বাবা মারা গেলেও মামলা আর নিষ্পত্তি হয়নি। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে সামান্য আয়ের সংসার। অন্যদিকে মামলা চালাতে গিয়ে তিনি নিঃস্ব হচ্ছেন।
জমির বিরোধে দেওয়ানি মামলার জেরে বাদী-বিবাদী হয়ে আদালতে আসা মানুষের ভোগান্তি ও হতাশার নিত্য চিত্র এটি। এক দেওয়ানি মামলা থেকে আরও মামলার উৎপত্তি। অধস্তন আদালত থেকে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগ। আবারও অধস্তন আদালত। দশকের পর দশক এভাবেই চলতে থাকে মামলা। এর মধ্যে মারা যান বাদী-বিবাদী। পক্ষ হয় তার ওয়ারিশরা। কিন্তু মামলা শেষ হয় না। বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে মারামারি, খুনখারাবি হয়। মামলা থেকে মামলা বাড়ে, সমস্যা আরও জটিল হয়। ভুক্তভোগী মনিরের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে অধস্তন ও উচ্চ আদালত মিলিয়ে দেওয়ানি মামলা ৫টি। আর ফৌজদারি মামলা হয়েছে ৫টি।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্যমতে, উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা পৌনে ১৭ লাখের বেশি।
বরিশালের মনিরের মতো গত কয়েক মাসে উচ্চ আদালতে আসা বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। অন্যদিকে নিয়মিত দেওয়ানি মামলা পরিচালনা করেন এমন ছয়জন আইনজীবী তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে অভিন্ন সুরে বলেন, খুন, মারামারি, পারিবারিক বিরোধের সবচেয়ে বড় কারণ জমির মালিকানার বিরোধ। জমির দাগ, খতিয়ানসহ বিভিন্ন জরিপের অস্পষ্টতা ও ধোঁয়াশাও এর কারণ। এই পরিস্থিতির প্রতিকার নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যতই মানুষ বাড়ছে, জমি নিয়ে বিরোধও বাড়ছে। কিন্তু নিষ্পত্তি যত হচ্ছে মামলা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি। মামলাজট কিংবা অনিষ্পন্ন
থাকার বহুবিদ কারণ আছে। অনেক ক্ষেত্রে বিচারক ও আইনজীবীরাও দায়ী। কোনো কোনো পক্ষ তাদের মামলাটা দুর্বল মনে করে যে কোনোভাবে হোক সময়ক্ষেপণ করতে চায়। আবার আইনে অনেক কিছু থাকলেও আইন দেখিয়ে সেখানেও বিলম্ব।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলার জট নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক চিন্তাভাবনা, গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু এগুলোও তো বাস্তবায়ন খুব বেশি হচ্ছে না।’
তিন বছরে দেওয়ানি মামলা বেড়েছে ২ লাখের বেশি সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ (গত মার্চ পর্যন্ত) তথ্য অনুযায়ী, দেশে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪২ লাখ ৮ হাজার ৯৮৭। এর মধ্যে আপিল বিভাগে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলা ১৩ হাজার ৪৪২, হাইকোর্টে ৯১ হাজার ৬৩৮ এবং অধস্তন আদালতে ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ১৬০ বিচারাধীন মামলা। মার্চ পর্যন্ত উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৪০টি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উচ্চ ও অধস্তন আদালতে ১৪ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৭ দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন ছিল। তিন বছর তিন মাস পর উচ্চ ও অধস্তন আদালতে অনিস্পন্ন দেওয়ানি মামলা বেড়েছে ২ লাখ ১০ হাজার ৮১৩ মামলা। এর মধ্যে গত বছরের জুলাই থেকে মাত্র ৯ মাসে (চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত) মামলা বেড়েছে ৩৬ হাজার ৭৭৪টি।
গত দুই বছরে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে ফৌজদারি পুরনো মামলাসহ গুরুতর অপরাধের মামলা নিষ্পত্তিতে আশানুরূপ গতি এসেছে। কিন্তু দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে সেটি আশানুরূপ হচ্ছে না।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা মনে করেন, দেওয়ানি মামলার বাদী ও বিবাদীদের অনেকটা জটিল আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মোটা দাগে এর কারণ ১১৫ বছরের বেশি পুরনো দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার না হওয়া, অধস্তন আদালতে মামলা চালানোর প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণ না হওয়া, ঘন ঘন শুনানির আবেদন ও মুলতবি, অধস্তন আদালতের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়া ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে অমনোযোগিতা।
মনিরদের দুঃখ ঘোচে না
প্রতিবেদনের শুরুতে ভুক্তভোগী মনিরের আইনজীবীদের তথ্যমতে, ১৯৬৩ সালে বরিশাল সদরের সাগরদী মৌজায় ২৬ শতক জমি স্থানীয় আব্দুল লতিফের কাছ থেকে কিনে নেন একই এলাকার আব্দুল গফুর নামে এক ব্যক্তি। তবে জমি কেনাবেচা হয় দলিল ছাড়া, মৌখিকভাবে। ১৯৭২ সালে আব্দুল লতিফ লিখিতভাবে গফুরকে জমি বুঝিয়ে দেন। ইতিমধ্যে গফুর সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। বাদীপক্ষের আইনজীবীদের ভাষ্য, ২৬ শতকের জায়গায় ১৩ শতক জমি বুঝে পান গফুর। লতিফ সেই জমি তার দুই স্ত্রীকে দান করে দেন ১৯৭৭ সালে। এরপর দুই স্ত্রী জিন্নাতুন্নেসা ও জহুরা খাতুন দলিল পেয়ে গফুরের বিরুদ্ধে ওই বছর উচ্ছেদের মামলা করেন। ইতিমধ্যে গফুর মারা যাওয়ায় এ মামলার বিবাদী হন তার ছেলে মজিবুর রহমান। কিন্তু বাদী উচ্ছেদের মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই জমির কিছু অংশ (পাঁচ শতাংশ) আরেক পক্ষের (মো. শামীম ও তার মা রোকেয়া খাতুন) কাছে বিক্রি করেন। পরে মজিবুর রহমান দখলজনিত স্বত্বের মামলা করেন ১৯৮৭ সালে। মামলা চলাকালীন ২০০১ সালের এপ্রিলে মারা যান মজিবুর রহমান। এরপর এই মামলার বাদী হন তার ছেলে মনিরুজ্জামান মনির ও অন্য ওয়ারিশরা। ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর বরিশালের যুগ্ম জেলা জজ আদালত এক রায়ে ১৩ শতক জমির মালিকানা মনিরকে বুঝিয়ে দিতে রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে বরিশাল জেলা জজ আদালতে আপিল করে অপরপক্ষ। অধস্তন আপিল আদালত রায় খারিজ করে মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য পাঠায়। জেলা জজ আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ (মনির) ২০১২ সালের জুলাই মাসে হাইকোর্টে রিভিশন মামলা করে। ইতিমধ্যে এই জমি কেনাবেচা ও মামলায় পক্ষভুক্ত বাদী-বিবাদীপক্ষের অন্তত পাঁচজন মারা গেছেন।
মনিরের আইনজীবী মো. শামীম সরদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, কিছুদিন আগে তিনি মামলাটি পেয়েছেন। এর আগে বেঞ্চ পুনর্নির্ধারণ হওয়া, বিচারক কিংবা এখতিয়ার পরিবর্তনে প্রায় এক যুগেও শুনানি সম্ভব হয়নি। গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে মামলাটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে আংশিক শুনানি শুরু হয়।
তিনি বলেন, ‘মামলাটি নিজ উদ্যোগে নিয়েছিলাম। জমি নিয়ে প্রায় সব দেওয়ানি মামলার পরিস্থিতিই এমন। অন্য মামলার মতো নিকট ভবিষ্যতে এ মামলার নিষ্পত্তি হবে কি না, এ নিয়ে সংশয় আছেই।’
ভুক্তভোগী মনির বলেন, আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধপূর্ণ জমিতেই বসবাস করছেন। জমির বিরোধে তার বাবা ও তার নামে বিভিন্ন সময়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, লুটপাটের অভিযোগে চারটি মামলা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। অন্যদিকে হামলার জেরে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তারাও একটি মামলা করেছেন।
বিবাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী খান বলেন, ‘বিরোধপূর্ণ জমি কিনে বিবাদীরাও ভুগছেন। এখন গুরুতর ফৌজদারি মামলার বড় কারণও এই জমি। দাগ নম্বর খতিয়ানের ঝামেলা তো আছেই। আমার মনে হয়, শুধু দুই পক্ষকে ছাড় দিয়ে নমনীয় হয়ে সমঝোতা বা মধ্যস্থতায় আসতে হবে।’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আইন সাময়িকী ডিএলআরের সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি তাতে মামলা নিষ্পত্তিতে আইনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা থাকতেই হবে। আর যদি মামলার দুই পক্ষ নমনীয় না হয়, শুধু সময় নিতে থাকে, তাহলে সংগত কারণেই মামলায় বিলম্ব হবে। আন্তরিক না হলে আইনটি যথাযথভাবে প্রয়োগ না হলে সমাধান হবে না।’
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নানা উদ্যোগের পরেও দেওয়ানি মামলায় সুফল মিলছে না। বিচারক স্বল্পতা তো আছেই। বিচারঙ্গনে প্রযুক্তির ব্যবহারও আশানুরূপ হয়নি। শুনানিকালে বিচারকদের অনেকে এখনো সাক্ষীদের (জেরা) বক্তব্য হাতে লেখেন। এতেই দিনের একটা সময় চলে যায়।’
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি যা, তাতে দেওয়ানি মামলায় সুফল পেতে অবশ্যই মেডিয়েশনের (দুই পক্ষের মধ্যস্থতা) ব্যবহার বাড়াতে হবে। পুরো বিচার বিভাগকে প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে পুরনো আইনের সংস্কারও হতে পারে।’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দুই দশক হতে চলল। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় ওই হামলার ঘটনায় ২৪ জন নিহত হন। আহত অনেকে পরে মারা যান। অনেক কষ্ট নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন অনেকে। ২১ আগস্ট এলেই ভয়াল স্মৃতি জাপটে ধরে তাদের। আবেগাপ্লুত হন স্বজনহারানো পরিবারের সদস্যরা। আজ সেই দিন। আজ ওই ঘটনার ১৯তম বার্ষিকী।
ভয়ংকর ও ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেছিল ২১ আগস্ট, ২০০৪ সালে। বিএনপি-জামায়াত জোট তখন ক্ষমতাসীন ছিল। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চে দলটির সন্ত্রাসবিরোধী জনসভা চলছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
সভার একপর্যায়ে প্রধান অতিথি মঞ্চে উঠলেন, বক্তৃতাও করলেন। বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই বিকেল ৫টা ১৮ মিনিটে (মামলার নথি অনুযায়ী) ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয় সেখানে। সভামঞ্চের আশপাশে উপর্যুপরি আর্জেস গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সন্ত্রাসবিরোধী জনসভা পরিণত হয় মৃত্যুকূপে।
২৪ জন নেতাকর্মীর জীবন ও শত শত নেতাকর্মীর আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেদিন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। রক্তস্নাত হয়েছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক, ঢাকার কালো রাজপথ। আজ সেই বীভৎস ও নারকীয় ঘটনার দিন। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই চালানো হয়েছিল বর্বরোচিত, ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলা। গুলিও চালানো হয়েছিল সেদিন। মঞ্চে থাকা নেতারা মানবঢাল হয়ে রক্ষা করেছিলেন শেখ হাসিনাকে। ডজনখানেক গুলি ছোড়া হয়েছিল। গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ সভাপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ।
সেদিনের সেই মানবঢাল রাজনীতির ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। থাকবে তা অনন্তকাল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গৌরবান্বিত এক মানবঢাল, যা রক্ষা করেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জীবন। সেদিন মঞ্চে থাকা নেতাদের উদ্যোগকে বিস্ময়কর অভিহিত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘বিস্ময়কর বলছি এ কারণে যে, তারা নিজের জীবনের কথা না ভেবে নেতাকে বাঁচাতে হবে- এ কথা আগে ভেবেছিলেন। এমন সিদ্ধান্ত সত্যিই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা, স্মরণীয় ঘটনা। তারা নিশ্চয়ই জানতেন না যে, নেতাকে বাঁচালে অনেক কিছু পাবেন। এ কারণে ঝুঁকি নেননি তারা। তারা দেখতে পাচ্ছিলেন, তাদের সামনে বিকল্প কিছুই নেই তাদের নেতা শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য।’
শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘নেতাকর্মীদের মধ্যে আবেগের বন্ধন ছিল। রাজনৈতিক দলে এটা থাকা উচিতও। আওয়ামী লীগে নেতাকর্মীর এ বন্ধন নিঃস্বার্থ বন্ধনের দৃষ্টান্ত; পদ-পদবির ঊর্ধ্বে এ বন্ধন। সেদিনের ঘটনা তারই প্রমাণ।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তি মিছিলের আয়োজন করে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। শান্তি মিছিলের উদ্বোধক ছিলেন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। কর্মসূচি কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার প্রাণনাশের নীলনকশা আঁকে ষড়যন্ত্রীরা। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার্য আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। শান্তি সমাবেশের শেষদিকে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান শেষ হওয়ার আগেই ছোড়া হয় সে গ্রেনেড। গ্রেনেড হামলায় আক্রান্ত হন শেখ হাসিনা। শান্তি মিছিল শেষে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সভামঞ্চে দলের সব কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। তারাও আক্রান্ত হন। নেতারা নিজেদের জীবনের চিন্তা না করে শেখ হাসিনার জীবনরক্ষায় রচনা করেন মানবঢাল।
সেদিন মঞ্চে উপস্থিত সব নেতা গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিজের শরীরে ধারণ করে অক্ষত রাখেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। বাঁচিয়ে রাখেন তাদের আশা-ভরসার প্রতীক শেখ হাসিনাকে। যদিও হামলার শিকার আওয়ামী লীগ সভাপতির শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। সেদিন জীবন নিয়েছেন দলের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী। কেন্দ্রীয় একাধিক নেতাসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন, পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
শেখ হাসিনার শরীরের ওপর নিজের শরীর বিছিয়ে দিয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ অসংখ্য স্প্লিন্টার নিজের শরীরে বিঁধিয়েছেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ হয়ে রাজনীতির মাঠ আর ফিরে আসা হয়নি তার।
মানবঢাল রচনা করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীসহ অন্য নেতারা স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে জীবন পার করছেন। মানবঢাল একটি গৌরবের নাম। মানবঢাল এখন সম্মানের, নেতৃত্বের প্রতি আস্থা-বিশ্বাসের প্রতীক। পৃথিবীতে নেতাকে রক্ষার জন্য মানবঢাল রচনার দ্বিতীয় নজির কেউ স্মরণ করতে পারে না।
এ ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার দলে কতটা জনপ্রিয়, কতটা আস্থার আর বিশ্বাসের। দলের শীর্ষসারির নেতাদের প্রাণপণ চেষ্টায় নির্মিত মানবঢালে রক্ষা পেয়েছে শেখ হাসিনার জীবন। কীভাবে নিজের জীবনের কথা না ভেবে, পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততির পরোয়া না করে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে নেত্রীর জীবনরক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠেন নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রক্ষায় মানবঢাল করে মঞ্চেই থাকেন কিছুক্ষণ। পরে পরিস্থিতি বুঝে তাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে তার বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। ওই গাড়ি লক্ষ্য করেও গুলি ছুড়েছিল হামলাকারীরা।
মানবঢাল রচনাকারী নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে গ্রেনেড হামলা থেকে নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) রক্ষা করেন। আমরা যখন নেত্রীর জীবনরক্ষায় মরিয়া তখন অন্যরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন তিনি। বললেন, আমি সুধা সদন যাব না, সবাইকে দেখে তারপর যাব। ধানমণ্ডির সুধা সদনে পৌঁছানো পর্যন্ত পথে বারবার তিনি বলছিলেন, “গাড়ি থামাও, আমি যাব না, সবাইকে দেখে তারপর যাব”।’ রাস্তায় আবারও হামলা হয় কি না, সে আশঙ্কাও তাড়া করছিল বলে জানান মায়া।
আওয়ামী লীগের ডেটাবেজ টিমের এবং সংস্কৃতিবিষয়ক উপকমিটির সদস্য নুরুল আলম পাঠান মিলন বলেন, ‘রাজনীতিতে, কী তত্ত্বে কী প্রয়োগে, ব্যক্তি ম্যাটার করে। রাজনীতিতে নেতার প্রতি, নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য কর্মীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ দীক্ষাই একজন কর্মীকে উদ্বুদ্ধ করে নেতাকে নিরাপদ রাখতে এবং নেতার বিপন্ন জীবনকে সুরক্ষা দিতে। ২১ আগস্ট মানবঢাল তৈরি করে আমাদের বাতিঘর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জীবনরক্ষার মাধ্যমে আমরা গৌরবের অধিকারী হয়েছি। এমন গৌরবের ভাগীদার হওয়া সৌভাগ্যের বিষয়।’
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, শেখ হাসিনার তখনকার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বর্তমান সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মেজর সোয়েব, মামুন ও জাহাঙ্গীর শেখ হাসিনাকে সেদিন সুধা সদনে রেখে আসেন। ২১ আগস্ট মানবঢাল রচনা বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য এক ঘটনা। সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসেও।
হঠাৎ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধড়পাকড়, হামলা ও মামলায় নতুন করে চাপে পড়েছে দলটি। সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। কারণ ছাত্রদলের ছয় নেতাকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়ে পুলিশ দাবি করেছে, নির্বাচনের সময় সহিংসতার জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শে তারা অস্ত্র সংগ্রহ করছিল।
এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনকে যেভাবে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তাতে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, রাজপথের কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী তরুণ নেতাদের ওপর সরকারের আক্রমণ বাড়তে পারে। তাদের দাবি, ছাত্রদল নেতাদের তুলে নেওয়ার পর অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার দেখানো আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার দাবিতে বিএনপি শনিবার সারা দেশে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ ঘটনায়ও মামলার মুখোমুখি হচ্ছেন নেতাকর্মীরা। এর আগে শুক্রবার ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরে গণমিছিল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। দলটির নেতারা দাবি করেন, ওই দিন রাতে সকালে ছাত্রদলের নিখোঁজ এক নেতাকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে সংগঠনের আরও পাঁচ নেতাকে। শনিবার সকালে এ বিষয়ে দলটি বিবৃতি দেয়। এরপর রাতেই এই ছয়জনকে অস্ত্রসহ আটকের কথা জানায় পুলিশ। গতকাল তাদের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।
এ ছাড়া শনিবার রাতে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের নিচ থেকে রবিনসহ আরও ১২ জনকে আটকের তথ্য জানায় পুলিশ।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হঠাৎ করে ধরপাকড় বৃদ্ধি হয়েছে বলতে চাই না। মূলত ধরপাকড় শুরু হয়েছে গত ২৮ জুলাইয়ের পর থেকে। এরপর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে গত শনিবার হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও নারায়ণগঞ্জে দলের ঘোষিত পদযাত্রা কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অতীতের মতো যৌথভাবে হামলা, মামলা শুরু করেছে।’
তবে এ ঘটনা নিয়ে তারা চিন্তিত নন জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আন্দোলনের মাত্রা যতই বাড়বে, সরকারের নির্যাতন, হামলা, মামলা ততই বাড়বে। আমরা বিষয়টি আগেই আঁচ করতে পেরেছি। সেভাবেই আগামীর পরিকল্পনা করছি। কর্মসূচিতে সাধারণ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।’
গতকাল বিকেলে গুলশানে দলটির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের ছয় নেতাকে তুলে নেওয়া এবং অস্ত্র মামলার প্রসঙ্গে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে তারা নিজেরাই কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। পুরনো কায়দায় তার দায় বিএনপির ওপর চাপাবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, সন্ত্রাস হবে, আরেকজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি বলেছেন যে সন্ত্রাস করতে দেব না। সন্ত্রাসটা হলো কোথায়? আমরা কোথায় করলাম। যা কিছু সন্ত্রাস তো করছ তোমরা। বন্দুক তোমাদের হাতে, পিস্তল তোমাদের হাতে, আইন তোমাদের হাতে। রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সন্ত্রাস করছ। এটা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস করছে।’
ফখরুল অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকারপ্রধানের নির্দেশে কিছুসংখ্যক অতিউৎসাহী দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তা এহেন বেআইনি কর্মকান্ড চালানোর জন্য মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে গায়েবি মামলায় বিএনপিসহ বিরোধী মতের নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে সাজা দিচ্ছে। উচ্চতর আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর নিম্ন আদালতে হাজির হলে জামিন নামঞ্জুর করে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হচ্ছে। আবার জামিন লাভের পর নতুন আসামি বানিয়ে জেলগেটেই অনেককে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আটক রাখা হচ্ছে, যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম বলেন, ‘হঠাৎ করে পুলিশের ধরপাকড়, হামলা ও মামলা দেওয়ার ঘটনায় নেতাকর্মীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কাকে কখন কোথা থেকে তুলে নিয়ে যাবে, সে বিষয়ে চিন্তিত নেতাকর্মীরা।’
তবে বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সম্প্রতি নেতাকর্মীরা যেভাবে সাহসী ভূমিকা নিয়ে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত রয়েছেন, তা থামানো যাবে না বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
সালাম বলেন, ‘আরেকটি বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তিত সেটা হচ্ছে ছাত্রদলের নেতাদের খালি হাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিদেশি অস্ত্র দিয়ে গ্রেপ্তারের ঘটনা সামনের দিনগুলোতে বাড়তে পারে। কারণ সরকার অতীতের মতো সামনের দিনগুলোতে আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে অপচেষ্টা চালিয়ে যাবে। আমাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের পাশাপাশি সারা দেশের তৃণমূলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। নতুন করে আরও মামলা হবে। এসব নিয়ে চিন্তা থাকলেও উদ্বিগ্ন নই আমরা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের পুরনো মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার পাশাপাশি রাজপথে সক্রিয় তরুণ নেতাকর্মীদের কারারুদ্ধ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনকে গ্রেপ্তার করেছে সাদাপোশাকের পুলিশ। এর আগে দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এগুলো সরকারের পুরনো কৌশল।’
এর বিপরীতে বিএনপিরও কৌশল রয়েছে জানিয়ে ওই নেতা বলেন, ‘সম্প্রতি কয়েকজন তরুণ নেতাকে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যৌথ হামলা, মামলা, নির্যাতন সহ্য করে টিকে আছি। এগুলো এখন আর ভয় পাই না। আমাদের নেতাকর্মীরাও ভয় পায় না।’
আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আওয়ামী লীগ প্যাকেজ কৌশল গ্রহণ করেছে। এসব কৌশলে চমকও থাকতে পারে বলে ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের প্যাকেজ কৌশলের মধ্যে রয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপিকে প্রতিদিন কর্মসূচি পালন করতে না দেওয়া, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রাখা, বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি সৃষ্টি করা। শীর্ষ নেতৃত্বে সংশয় সৃষ্টি করা। সেই সঙ্গে যেকোনো মূল্যে মাঠ নিয়ন্ত্রণে বিএনপির সব চেষ্টা সামাল দেওয়া।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে প্রতিরোধের মুখে বিএনপির অনেকটাই উত্তাপহীন হয়ে পড়ে। তাদের সেদিনের শক্তি দেখে মূলত আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কৌশল থেকে সরে এসেছে। বিএনপির কর্মসূচির পরে আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি পালন থেকে বিরত থাকে প্রায় তিন সপ্তাহ।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এক দিনও বিএনপিকে কর্মসূচির বাইরে রাখা গেলে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রাখা গেলে সেটাও এক ধরনের উপকারে আসবে। তিনি বলেন, নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এবারের লক্ষ্য বিএনপির ভেতরের নেতাকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি সৃষ্টি করা। শীর্ষ নেতৃত্বে সংশয় সৃষ্টি করা। সেই সঙ্গে মাঠ নিয়ন্ত্রণে বিএনপির সব চেষ্টা নস্যাৎ করে দেওয়া।
ক্ষমতাসীন দলটির নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি বাধার মুখে পড়ার পরে দলটির পরবর্তী কর্মসূচি অনেকটা গতিহীন হয়ে গেছে। আর এটা সক্ষম হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কর্মকৌশলের কারণে। ফলে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কৌশল থেকে বিরতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আবার শোকের মাসও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে থাকতে না চাওয়ার কারণ ছিল। শোকের মাস উপলক্ষে কিছু কর্মসূচি থাকলেও সেগুলোতে তেমন ‘অ্যাকশনমুডে’ থাকছে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আসছে সেপ্টেম্বর মাস থেকে আবারও পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে থাকার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। তারা বলেন, এটা মূলত আওয়ামী লীগের ওই নীতিরই অংশ ‘প্রয়োজনে কঠোর, প্রয়োজনে ছাড়’।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ মাঠে নামছে। ওই দিন প্রায় পাঁচ লাখ লোকের জনসমাবেশ ঘটাতে চায় তারা। এর মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে জানান দিতে চায় আওয়ামী লীগ সরকারের যেমন শক্ত অবস্থান রয়েছে, তেমনি মাঠে ও জনগণের ভেতরেও জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছে ক্ষমতাসীনরা।
শোকের মাসের শেষদিনে ছাত্রলীগের আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে মাসব্যাপী শোক দিবসের কর্মসূচির ইতি টানা হয়। কিন্তু এবারই প্রথম তার ব্যত্যয় ঘটছে। ছাত্রলীগের এ অনুষ্ঠান এর আগে কখনো সেপ্টেম্বর মাসে আয়োজন করা হয়নি। বরাবরই শোকের মাসের শেষদিন এ কর্মসূচি পালন করে আসছিল ছাত্রলীগ। কারণ, দেখিয়েছে শুক্রবার হওয়ায় কর্মসূচির তারিখ পাল্টেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা কখনোই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির গ্রহণ করি না। আওয়ামী লীগ মনেও করে না এগুলো পাল্টাপাল্টি কিছু একটা।’
সভাপতিমন্ডলীর অন্য সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আবারও বলছি, বিএনপির কর্মসূচির দিন এ দেশের মানুষ ভয়ে থাকে কখন কী ঘটে? নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। আমরা সরকারে আছি। জনগণের সেই ভয় কাটিয়ে জনগণকে ভয়হীন করা, নিরাপদে রাখতে শান্তি সমাবেশ করি।’
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপিকে ভয়ডরহীনভাবে মাঠে থাকতে দেওয়া যাবে না। তাতে দলটির নেতাকর্মীরা প্রচুর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। ফলে নির্বাচন পর্যন্ত মাঠ ফাঁকা রাখা হবে না। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বিএনপির কর্মসূচিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
মাঠপর্যায়ের কর্মসূচিতে সব সময়ই থাকেন এমন একজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপি প্রতিরোধের মুখে পড়েছে বলেই সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন অল্প কিছুদিনের জন্য গতিহারা হয়। কর্মসূচি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যায় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। এটা আওয়ামী লীগের জন্য সুফল বয়ে এনেছে।
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরপরই দেশের বাজারে পণ্যটির দাম বাড়তে শুরু করেছে। এক রাতের ব্যবধানে বাজারে কেজিপ্রতি অন্তত ২০ টাকা বেড়ে গেছে। কিন্তু শুল্কযুক্ত পেঁয়াজ এখনো আমদানি হয়নি। এর জন্য বাজার সিন্ডিকেটের প্রভাবকে দায়ী করেছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
খবর নিয়ে জানা যায়, এতদিন ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে কোনো শুল্ক দিতে হতো না বাংলাদেশকে। গতকাল হঠাৎ পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয় দেশটি। ফলে এক রাতের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেড়ে গেছে। সব থেকে বেশি দাম বেড়েছে ভারতীয় পেঁয়াজের। বাজারে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। যা একদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকায়। দেশি পেঁয়াজের মধ্যে ফরিদপুরের পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায় ও পাবনার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকায়।
এদিকে আমদানিকারকরা জানান, গতকাল রবিবার পর্যন্ত শুল্কযুক্ত পেঁয়াজ দেশের বাজারে প্রবেশ করেনি। তবে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণায় পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
জানতে চাইলে হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক মোবারক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ ভাগ শুল্ক আরোপের নতুন সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়েছে। এর ফলে কেজিপ্রতি কত টাকা করে শুল্ক পড়ছে সেটি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। পেঁয়াজের কেজিপ্রতি শুল্ক কাস্টমস ৫ টাকা নেবে নাকি ৬ টাকা নেবে নাকি ৯ টাকা নেবে এ বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় কাস্টমসের সঙ্গে রপ্তানিকারকদের দেনদরবার চলছে। তবে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য ভারতের কাস্টমসে আসেনি। এ সংক্রান্ত চিঠি আসার কথা। এটি আসার পরই বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ রপ্তানি শুরু হবে। বিকেল ৪টা নাগাদ যদি এ সংক্রান্ত মেসেজ ভারতীয় কাস্টমসে আসে তবেই বিকেল থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি শুরু হতে পারে। আর যদি এর মধ্যে না আসে আরও দেরি হয় তাহলে রপ্তানি শুরু হতে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তে এখনো পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়নি।
শুল্ক আরোপের খবরে দেশের বাজারে পেঁয়াজের অস্বাভবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে শ্যামবাজার পেঁয়াজ আমদানিকারক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. হাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে অনেক। সেই অনুযায়ী দেশটিতে পেঁয়াজের দাম বাড়লে আমাদের দেশের বাজারে এর একটা প্রভাব পড়ে। তবে গতকাল দেশটির ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবরে দেশের বাজারে হুট করে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। প্রতি মণ পেঁয়াজে ৬শ টাকা বেড়েছে। গতকাল পর্যন্ত একমণ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৪শ টাকায়। তবে এটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না। আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে এটি সমন্বয় হয়ে আসবে।
পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সরবরাহ কম থাকায় বাড়তি দামে বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। মূলত শনিবার রাত থেকে এই পণ্যটির দাম বেড়েছে। পাল্লাপ্রতি ২০-৩০ টাকা ও কেজি প্রতি ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে দেশি পেঁয়াজের পাল্লা ২০ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজের পাল্লায় ৪০ টাকা বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারের নূর মোহাম্মদ নামের এক পাইকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতিদিন ১০০ কেজির বেশি পেঁয়াজের দরকার হয়। তার জোগান আসে শ্যামবাজার থেকে। বর্তমানে বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হয় বলে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। গতকাল মণপ্রতি ৬০০ টাকা বাড়তি দামে পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। যা এর আগের দিনেও প্রতি মণ পেঁয়াজ কিনেছি ২ হাজার ৪শ টাকায়।
একই কারণে চট্টগ্রামের বাজারেও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। শনিবার যেখানে প্রতি কেজি ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, একদিনের ব্যবধানে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। আর তা খুচরা ব্যবসায়ীরা ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি করছে।
কেবল শুল্ক আরোপের খবরে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম নিয়ে অরাজকতার বিষয় কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের স্বভাব এমনই। তাদের অতিমুনফা লোভের জন্য দেশের মানুষের কষ্ট হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার খবরে তাদের স্টকের ভোগ্যপণ্যের সংকট দেখা দিতে শুরু করে। অথচ, যখন পণ্যের দাম কমে তখন দাম কমানো বিষয় তাদের খবর থাকে না। তাদের সে সময়কার অজুহাত থাকে, বাড়তি দামে পণ্য কেনায় কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের হটাতে দেশের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করার সরকারের দায়িত্ব থাকলেও তারা তা করছে না। এর জন্য জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের বাজারে যেসব পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে তা ব্যবহার কমিয়ে আনলে অসাধু ব্যবসায়ীদের থামানো সম্ভব বলে ভোক্তাদের এই নেতা মনে করেন।
যাতায়াত সুবিধা ভালো থাকায় মসলাসহ কয়েক ধরনের কাঁচা সবজি ভারত থেকে আমদানি করে থাকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। আমদানি করা পণ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম পেঁয়াজ। ফলে প্রতি বছরই আমদানি করা পেঁয়াজের সিংহভাগ ভারত থেকে আসে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ৭ লাখ ৪৩ হাজার টন পেঁয়াজ। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয় ৬ লাখ ৬৫ হাজার টন। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫৩ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৭১ হাজার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ লাখ ৭ হাজার ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ৮ লাখ ৬৩ হাজার টন পেঁয়াজ।
বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৮-৩০ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করা হয়। এতে উৎপাদন হয় ৩৪ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ। তবে সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে বিভিন্ন ধাপে পণ্যটির ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। যার প্রভাবে দেশের বাজারে প্রায় তিনগুণ হারে পণ্যটির দাম বাড়ে। বাজার স্থিতিশীল করতে তাই গত ৫ জুন থেকে কৃষি মন্ত্রণালয় আবার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস দেশ রূপান্তরকে বলেন, চাহিদার থেকে আমাদের উৎপাদন অনেক বেশি হচ্ছে। তবে প্রাকৃতিক দিক থেকে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই আমাদের দেশের পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। যেহেতু ছোট দেশ, সামান্য ক্ষতি হলে অনেক বেশি সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের। কমবেশি এই সমস্যা আমাদের থাকবেই।
পেঁয়াজ আমদানির বিষয়ে কোনো বাধা নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যেহেতু ভারতের বাজারে এখন পেঁয়াজের দাম বেশি। তার প্রভাবে আমাদের দেশেও এই পণ্যটির দাম বেড়েছে। সেই ক্ষেত্রে যে কেউ চাইলে অন্য যেকোনো দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিতে পারবেন। সেই ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।
অন্তঃসত্ত্বা ও চার বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের কল্যাণের জন্য ১৩৯ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে মা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মা ও শিশুর কল্যাণের জন্য নেওয়া হলেও লাভের ষোলআনা কিন্তু কর্মকর্তাদেরই। প্রকল্পে মা তো দূরে থাক, শিশুদের জন্যও ব্যয়ের খাত প্রায় শূন্য! এমন লোভনীয় প্রকল্পের ৯৩ কোটি টাকা ঋণ আসবে বিশ^ব্যাংকের আইডিএ প্রকল্প থেকে।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে ‘সাপোর্টিং ইমপ্লিমেনটেশন অব মাদার অ্যান্ড চাইল্ড বেনিফিট প্রোগ্রাম’ শীর্ষক একটি প্রকল্প পাঠিয়েছে মা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি প্রকল্পটির বিশেষ মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্পটির ২৯ শতাংশের বেশি ব্যয় হবে কর্মকর্তাদের ঘোরাঘুরিতে অর্থাৎ ভ্রমণ খাতে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্পের পুরো নকশায় কোথায় কীভাবে ভ্রমণ করা হবে বা কী জন্য ভ্রমণ করা হবে, তার ব্যাখ্যা নেই।
ব্যয়ের তথ্যে আরও দেখা যায়, প্রকল্পটির পরামর্শক খাতের ব্যয় অস্বাভাবিক। পরামর্শক খাতকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শক খাত, আরেকটি ব্যক্তি পরামর্শক খাত। প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৪৮ লাখের বেশি। চারটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেবে মন্ত্রণালয়টি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পেছনে খরচ হবে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বেশি। মোট প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ৪ শতাংশ খরচ হবে এ খাতে।
এই তো গেল প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শক খাত। ব্যক্তি পরামর্শক খাতের ব্যয় সবচেয়ে বেশি। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ ব্যয় হবে ১০ জন পরামর্শকের জন্য। ১০ জন পরামর্শকের জন্য ব্যয় হবে ১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি পরামর্শকের জন্য ব্যয় হবে ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বা প্রায় ২ কোটি টাকা।
প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ব্যয় হবে কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের জন্য। মোট ব্যয়ের ৩২ শতাংশ। ৩ হাজার ৯১৩টি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয়ের কারণ জানার জন্য মা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রওশন আরা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে। তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, ‘আমাদের যেকোনো বিষয়ে মন্তব্য করবেন এ মন্ত্রণালয়ের সচিব।’
পরে সচিব নাজমা মোবারকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির যাচাই-বাছাই করে আর্থসামাজিক অনুবিভাগ। প্রকল্পটির বিভিন্ন অসংগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে আর্থসামাজিক বিভাগের সদস্য (সচিব) নাসিমা বেগম বলেন, ‘যারা প্রকল্প পাঠিয়েছে তাদের জিজ্ঞাসা করাই ভালো হবে। এ ব্যাপারে আমি কথা বলতে পারব না।’
পরিকল্পনা কমিশন বিশেষ মূল্যায়ন কমিটির সভায় জানতে চেয়েছে, গত জুনে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ যাচাই কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ৩৫৯ কোটি টাকা। কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৯ কোটি টাকারও বেশি। বিষয়টি স্পষ্ট করতে বলেছে কমিশন।
এ ব্যাখ্যায় মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের এ প্রোগ্রামের আওতায় ২০ কোটি ৭৭ লাখ ডলার ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১০৭ টাকা ধরে তা ২২৩ কোটি টাকার বেশি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৯৩ কোটি টাকা আর বাকি টাকা ট্রেজারিতে জমা করা হবে।
মা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রকল্পটির মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা ও চার বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের উপকৃত করা হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মগুলোকে শক্তিশালী করা হবে। কিন্তু স্থানীয় ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মগুলোর কীভাবে উন্নয়ন করা হবে তার কোনো ব্যাখ্যা প্রকল্প প্রস্তাবে দেওয়া হয়নি।
বলা হয়েছে, প্রকল্পের একটি খাতের মাধ্যমে শিশুদের সঠিক পুষ্টি, সামাজিক দক্ষতা ও তাদের বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা পেতে সাহায্য করা হবে। ঠিক কোন উপায়ে বা কোন খাতের ব্যয় থেকে শিশুরা উপকৃত হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
প্রকল্পে অনুদান হিসেবে দেওয়া হবে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। আবার গবেষণার জন্য অনুদান রাখা হয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের জন্য প্রচার ও বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ শুধু প্রচার ও বিজ্ঞাপনেই খরচ হবে মোট ব্যয়ের ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ ব্যয়ের পর আবার সেমিনার ও কনফারেন্সের জন্য থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ খাতের ব্যয় হবে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তবে কোথায়, কীভাবে বা কতটি কনফারেন্সে এসব ব্যয় করা হবে তার স্পষ্ট ধারণা দেয়নি মন্ত্রণালয়।
কেন্দ্রীয় খেলাঘরের সভাপতি ডা. আবু সাঈদের মতে, ‘বাচ্চাদের প্রকল্পে তাদের মতো দেওয়ার সুযোগ রাখা হয় সারা বিশ্বেই। এখানে তেমন সুযোগ দেখছি না।’
দেশ রূপান্তরকে এ শিশু সংগঠক বলেন, ‘এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরো হত্যা করা হয়েছে। এ প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয় এটিই প্রমাণ করে। ঋণদাতা সংস্থা এ প্রকল্পে হয়তো ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় কি না, বা সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।