
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত মাঠের বিরোধী দল বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস। জবাবে আওয়ামী লীগ তাকে জানিয়েছে, দলটি আশাবাদী যে, নির্বাচনে আসবে আন্দোলনরত বিএনপি।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইসের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের। সেই বৈঠকে এই আলোচনা হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৪টায় গুলশান-২ নম্বরে গোয়েন লুইসের বাসভবনে হওয়া বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। অন্য সদস্যরা হলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান, আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ এবং কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
বৈঠক শেষ হয় বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশে একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় বলে জানিয়েছেন গোয়েন লুইস। এ বিষয়ে তারাও একমত বলে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না গোয়েন লুইসের এই প্রশ্নে বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেছেন, ‘আমরা আশাবাদী বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে।’
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়েছে, সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো সাহায্য চাইলে তারা সেটা দিতে পারে। একই সঙ্গে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগ্রহের কথাও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ জানায়, দলটি বলেছে বাংলাদেশ পরিপক্ব গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে নির্বাচন নিয়ে অনেকগুলো শক্তিশালী আইন রয়েছে। সাংবিধানিক ভিত্তি রয়েছে। তাই এখানে নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না আওয়ামী লীগ। এটা দলটির অবস্থান। আর সরকার তো এ ধরনের সহযোগিতা কখনো তাদের (জাতিসংঘ) কাছ থেকে চায়নি। বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে বলা হয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে পারলে তারা খুশি হবে। সরকার চাইলে তারা যেকোনো ধরনের সহযোগিতা দিতে রাজি আছে। তবে সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কিছুই তারা করবে না বলে জানিয়েছে।’
বৈঠকে উপস্থিত থাকা ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতা জানান, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। নির্বাচন নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে তারা বলেছেন, বিএনপি আলোচনায় আগ্রহী নয়। তাদের ২০১৪ সালে সংলাপের জন্য ডাকা হয়েছিল, কিন্তু সেটা তারা নাকচ করেছিল। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দুবার সংলাপ করা হলেও ভোটের দিন দুপুর ১২টায় তারা ভোট বর্জন করে।
বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের অন্য এক নেতা বলেন, জাতিসংঘ প্রতিনিধির সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়ও আলোচনায় উঠে এসেছে। সেখানে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস ছাড়াও আরও দুজন উপস্থিত ছিলেন।
অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চায় জাতিসংঘ : কাদের বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায় বলে আওয়ামী লীগকে জানিয়েছেন গোয়েন লুইস। একটা নির্বাচন বাংলাদেশে হোক এটাই তারা (জাতিসংঘ) চায়। বিরোধীরা যে শর্তগুলোর কথা বলছে তা নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। তারা (জাতিসংঘ) বলেছে এটা তোমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এটা নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, তারা (জাতিসংঘ) বলেছে, বাংলাদেশে একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখলে তাদের ভালো লাগবে। মূলত তারা এ বিষয়টিই বলেছে।
বিরোধী দল (বিএনপি) প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদের বিলুপ্তি, তত্ত্বাবধায়কের যে দাবিতে জোর দিচ্ছে সেসব বিষয়ে জাতিসংঘের কোনো বক্তব্য ও মাথাব্যথা নেই বলে দাবি করেছেন ওবায়দুল কাদের।
কাদের বলেন, ‘আমরা আমাদের সেই ইচ্ছেটা বলেছি যে, আমরা একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করতে চাই। যেটা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হবে। বিএনপির মতো বড় দল নির্বাচনে আসুক সেটাও চায় আওয়ামী লীগ।’
তিনি বলেন, ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আমরা জোরাজুরি করতে পারি না। নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের (বিএনপি) অধিকার। এটা কোনো দলের জন্য সুযোগ নয়। এটা কারও দয়ার দান নয়। তারা বাংলাদেশের বড় দল হিসেবে এটা তাদের নৈতিক অধিকার। সেটা তারা প্রয়োগ করবে। এটা আমরা আশা করি।’
পাঁচ দেশের জোট ব্রিকসের এবারের শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিনে ছয়টি দেশকে সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ নেই। ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় ছিল। প্রভাবশালী দেশ চীনেরও জোরালো সমর্থন ছিল। নির্বাচনের আগে পশ্চিমা চাপের মধ্যে ব্রিকসের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ ও প্রত্যাশা ছিল। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্রিকসের সদস্য হতে পারলে তাতে নতুন মাত্রা যোগ হতো। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় কেউ কেউ মনে করছেন, কূটনৈতিকভাবে হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ।
তবে কারও কারও মত হলো, বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে আবেদন করেছে। তাছাড়া এমন একটি ফোরামে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের কূটনৈতিক প্রয়াস চালাতে হয়, সেটা করেনি। হতে পারে, এবার বাংলাদেশ সদস্যপদ পাবে ভাবেনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে তিন দিনের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়। ১৫তম শীর্ষ সম্মেলনে এ জোটে ছয় দেশকে সদস্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ ছয়টি দেশ হলো সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইথিওপিয়া ও আর্জেন্টিনা। আগামী বছর ১ জানুয়ারি থেকে তাদের সদস্যপদ কার্যকর হবে। অর্থাৎ পাঁচ দেশ থেকে এগারো দেশের জোটে পরিণত হবে ব্রিকস।
৪০টিরও বেশি দেশ এবার ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এর মধ্যে ২২টি দেশ এ জোটে যোগ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ব্রিকসে সম্প্রসারণ বিষয়ে ঘোষণা এলেও নীতিমালা, মানদ- ও প্রক্রিয়া নিয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দ্বিমত ছিল। শেষ পর্যন্ত গতকাল এসব বিষয়ে সবাই একমত হওয়ার পর ছয়টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
গত জুনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠক হয়। এরপর ব্রিকসে যোগ দেওয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ আগস্টে ব্রিকসের সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে পারে। তবে ওই বৈঠকের পর, অর্থাৎ ১৪ জুনের পরই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের সদস্যপদের জন্য আবেদন করে। বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশ আবেদন করেছে চলতি বছর।
বাংলাদেশকে সদস্য করার ক্ষেত্রে জোটের অন্যতম শক্তিশালী দেশ চীনের জোরালো সমর্থনের বিষয়টি গত দুই মাস ধরেই আলোচনায় ছিল। এমনকি সম্মেলনের সাইড লাইনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ব্রিকসের সদস্য হতে চীন বাংলাদেশকে সমর্থন দেবে।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের বেশি আগ্রহের ফলেই হয়তো শেষ পর্যন্ত সমর্থন পায়নি বাংলাদেশ। কারণ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সাপে-নেউলে অবস্থায় যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক চরম খারাপ। আবার ব্রিকসের পাঁচ দেশের মধ্যে ভারত এবং ব্রাজিলের সঙ্গে পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাও শুরুতে বাংলাদেশকে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি। ব্রিকস জোটের বর্তমান সদস্যরাও চাইছিল নিজেদের জোটে আবার নতুন কেউ যেন প্রভাবশালী হয়ে না ওঠে। সে বিষয়ে সম্মেলনের আগে থেকেই সতর্ক ছিল দেশগুলো। ফলে ধারণা করা হচ্ছে ভারত ও ব্রাজিলের সমর্থন পায়নি বাংলাদেশ। আর দক্ষিণ আফ্রিকাও ছিল নীরব।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা চাপে রয়েছে সরকারপক্ষ। ব্রিকসের সদস্যপদকে পশ্চিমা চাপের বিপরীতে একটি শক্তি হিসেবে দেখেছিল সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তাই হয়তো চলতি বছরের জুনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এ জোটে সদস্য হওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। জুনেই বাংলাদেশ সদস্যপদের জন্য আবেদন করে।
তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাধারণত এ ধরনের কোনো ফোরামে যোগ দিতে শুধু আবেদন করে বসে থাকলেই হয় না। কারণ সদস্য দেশগুলোর নতুন কোনো দেশকে যুক্ত করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হয়। ফলে ওইসব দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানোর পাশাপাশি সেসব দেশে বিশেষ দূত পাঠানোর মতো প্রয়াস চালাতে হয়। কিন্তু আবেদন করা ছাড়া সদস্য দেশগুলোর প্রধানদের সঙ্গে কোনো ধরনের সুপারিশ বা তদবির করেনি বাংলাদেশ।
সূত্রের দাবি, ব্রিকসে যুক্ত হতে বাংলাদেশের যতটা না আগ্রহ ছিল, তার থেকে বেশি আগ্রহ চীনের। পশ্চিমা আধিপত্য খর্ব করতে চীন ও রাশিয়া এ জোটের সম্প্রসারণ চেয়েছে। বাংলাদেশ সদস্যপদ না পেলেও যে ছয়টি দেশ সদস্যপদ লাভ করেছে, তাতেও চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে ভূরাজনৈতিক মেরূকরণ ক্রমেই বাড়বে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এবার না পেলেও পরেরবার বাংলাদেশ ব্রিকস জোটের সদস্যপদ পাবে। তবে সে ক্ষেত্রে ভারতের সমর্থন জরুরি। তারা বলেন, ভারত আঞ্চলিক ভারসাম্যের কথা ভেবেই এবার বাংলাদেশের পক্ষে হয়তো জোরালো সমর্থন দেয়নি। কারণ ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের থেকে এখন বেশি বৈরী। তাই তারা ব্রিকসে চীনের সমর্থনে বাংলাদেশকে চায় না। একই সঙ্গে ভারতের অন্যতম মিত্র যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশ চীনের বলয়ে ঢুকে পড়–ক। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক মিত্র ব্রাজিলের নজরেও বিষয়টি এসেছে। তবে এখানে বড় সমীকরণটি হতে পারে, এশিয়া অঞ্চলে চীনের আধিপত্য নিয়ে ভারতের আপত্তি। কারণ নতুন যে ছয়টি দেশকে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে তিনটিই চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, জোটের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিছু মানদণ্ড প্রস্তাব করেন। শেষ মুহূর্তে গতকাল জোটের সদস্য বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এবারের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের শুরু থেকেই মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে জোটের সম্প্রসারণ।
গত বুধবার দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি প্যানডর তাদের রাষ্ট্রীয় রেডিও স্টেশনকে বলেছিলেন, ‘আমরা এই জোট সম্প্রসারণের বিষয়ে একমত হয়েছি। আমাদের কাছে একটি নথি রয়েছে, যা আমরা গ্রহণ করেছি। এতে ব্রিকসের সদস্য হতে চায়, এমন দেশগুলোকে বিবেচনায় নেওয়ার জন্য নির্দেশিকা, নীতিমালা ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা আছে। ...বিষয়টি খুবই ইতিবাচক।’
জোটের ভারসাম্য নিয়ে ভারতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক হর্ষ পন্ত সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, চীন সমমনা দেশগুলোকে ব্রিকসে স্বাগত জানানোর কথা বললেও ভারতের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে সতর্ক।
এ বিষয়ে ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্রিকসের পরিধি বাড়ানোর প্রশ্নে জোটের অন্যতম সদস্য ভারতের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য হলো জোটে নিশ্চয়ই নতুন নতুন দেশকে স্বাগত জানানো দরকার। কিন্তু জোটের ভেতরে ‘আঞ্চলিক ভারসাম্য’ যাতে রক্ষিত হয় সেটাও দেখাটা খুব জরুরি। ব্রিকসে যাতে চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা বেশি বেশি দেশ ঢুকে গিয়ে জোটের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যটা নষ্ট না হয়ে যায়, ভারত সেদিকেও সতর্ক।
ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী একাধিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, চীন বা রাশিয়া উভয়ই চেয়েছে তাদের ঘনিষ্ঠ দেশগুলো ব্রিকসে আসুক। কারণ তাতে জোটের ভেতরে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের পাল্লা শক্ত হবে। আবার ভারত নিশ্চিত হতে চেয়েছে ব্রিকস যাতে আরও বেশি চীনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে। সেজন্য চীনের অনুমোদন নিয়ে যেসব দেশ ব্রিকসের সদস্য হতে চেয়েছে ভারত তাদের ব্যাপারে সাবধানী মনোভাব নিয়েছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ যদিও পুরোপুরি এর মধ্যে পড়ে না। বাংলাদেশ সরাসরি ব্রিকসেও আসুক, এটা কিন্তু কখনো ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সদস্যপদ চাওয়া অবশ্যই ইতিবাচক হয়েছে। সদস্যপদ না পাওয়াকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলা যাবে না।’
তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত সপ্তাহে বলেছিলেন, এবার সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অবশ্য তিনি বলেছিলেন, ব্রিকস জোট সম্প্রসারণ নাও হতে পারে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যাশাও ছিল না।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালি উর রহমান বলেন, ‘সদস্যপদ পেলে বেশি ভালো হতো। তবে আমি যতদূর জানি সদস্যপদ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তেমন কোনো তাড়া নেই বা ছিল না।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ব্রিকস জোটে নতুন যেসব দেশকে সদস্য করা হয়েছে তার মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সবকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে অগ্রসরমাণ। কাজেই এবার সদস্য না হওয়ার বিষয়টি কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলা যাবে না। কারণ বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশের কাতারেই আছে। আর ব্রিকসে যারা আছে তারা আরও ওপরে।’ তিনি বলেন, ‘বিকল্প একটা অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করার মতো সক্ষমতা রাখে এমন দেশকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো সেই ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না, তাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।’
নতুন সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন ব্রিকসের বর্তমান চেয়ারম্যান দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ ঘোষণার সময় রামাফোসার পাশে ছিলেন। ইউক্রেন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন সম্মেলনে অংশ নেননি। তার প্রতিনিধিত্ব করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।
পাঁচ সদস্য ছাড়াও এ জোটে যুক্ত হতে আগ্রহী দেশগুলোর প্রতিনিধিরাসহ বিশ্বের ৫০টি দেশ যোগ দিয়েছে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে।
ব্রিকস হলো উন্নয়নশীল অর্থনীতির পাঁচটি দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও সাউথ আফ্রিকার জোট। জোটের নামকরণ হয়েছে সদস্য দেশগুলোর নামের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে। সর্বশেষ ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে এই জোট ‘ব্রিক’ নামে পরিচিত ছিল।
২০২১ সালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে পরিচিত ব্রিকসের ব্যাংকে যুক্ত হয় বাংলাদেশ।
এবারের ব্রিকস সম্মেলনে পাঁচ দেশের এই জোটের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত ছিল বাংলাদেশ। ব্রিকস সভাপতি সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ জোটে এবারই ঢুকবে বাংলাদেশ সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে যোগ দিতে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে সদস্যপদের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সদস্যপদ না পাওয়ার খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। তবে সরাসরি বা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য কেউ দেয়নি। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা মনে করছেন, জোটে আধিপত্যের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে প্রতিবেশী ভারতের অনীহা থাকতে পারে। যে কারণে বাংলাদেশকে সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আবার আফ্রিকায় নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ থাকার কারণেও হতে পারে।
ব্রিকসে বাংলাদেশের সদস্যপদ না পাওয়া নিয়ে আলোচনায় ভূ-রাজনৈতিক উপাদানও যোগ হয়েছে। ‘বাংলাদেশ চীনের পেটে ঢুকে গেছে’ যুক্তরাষ্ট্রের মতোই কি অন্যতম মিত্র ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত মনে করে? চীন বলয়ের ভেবেই কি ব্রিকসে বাংলাদেশকে নিয়ে আপত্তি তুলেছে ভারত, এমন সব আলোচনা রয়েছে। এমন আলোচনায় আগ্রহী যারা তারা বলছে, ভারতের বিরোধিতার কারণ বাংলাদেশ যুক্ত হলে ব্রিকসে চীন শক্তিশালী হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে কিছুটা বাঁকা চোখেই দেখছে। তবে বাংলাদেশ অবশ্য এই জোটে ঢুকবে, দুদিন আগে আর পরে, জোটে থাকা দেশগুলোই বাংলাদেশকে টানবে এমন প্রত্যাশা করছেন রাজনীতিকরা। এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষমতাসীন দলের ও জোটের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থাকলে চীন সুবিধা পাবে, এতে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে আশঙ্কা করে প্রতিবেশী দেশটি।
ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা বলেন, ইথিওপিয়া দিয়ে আফ্রিকায় ঢোকার পথ সৃষ্টি করতে চায় ভারত। ফলে আপত্তি তোলেনি দেশটি। এ নেতারা বলেন, যে দেশগুলোই ব্রিকসে যুক্ত হয়েছে কোনো না কোনো স্বার্থের কারণে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগদান করতে না পারার কারণ আমার কাছেও মনে হয় ভারত। ব্রিকসে এবারই সদস্যপদ পাবে সেটা প্রায় নিশ্চিতই ছিল বলা যায়। জোটের সভাপতি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বাংলাদেশকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। তবে ভারত এখনই চায়নি বলে সুযোগ বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ।’
তিবি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারত বড় ভূমিকা রেখেছে, বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছে। তবে এই মুহূর্তে প্রতিবেশী দেশটি চায় না স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিনিধিত্ব করুক। তবে কখনো না কখনো বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হবে এ জোটে। এই জোটে থাকা দেশগুলোই টেনে নেবে বাংলাদেশকে।’
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান বলেন, ‘ব্রিকস উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা জন্য জোট। এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হলে সব কিছু অর্জন হবে, অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি বলে সব শেষ হয়ে যাবে ব্যাপারটা এ রকম নয়। বিষয়টি মিডিয়ায় পুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তো বলেছি, ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ পেলে আমরা যাব। তাই হয়েছে। সরকার বলেনি যে, আমরা ব্রিকসে যোগ দেব।’
ফারুক খান মনে করেন, ‘এখন হয়নি তো কী হয়েছে? আগামীতে হবে। বিষয়টি রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে করি না।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে ফিরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবেন বলে জানান ফারুক খান।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত না হলেও সুবিধা পাবে। ব্রিকস সম্প্রসারণ হবে এ নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুতরাং কখনো না কখনো অন্তর্ভুক্ত হবে কোনো সন্দেহ নেই।’
ব্রিকস বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারসাম্য সৃষ্টি করবে জানিয়ে ইনু বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ঋণ সুবিধা গ্রহণে দর কষাকষির সুযোগ সৃষ্টি করবে ব্রিকস। এখনই অন্তর্ভুক্ত হতে না পারা কোনো রকম পিছিয়ে পড়া বলে মনে করেন না জাসদ সভাপতি।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে এর সদস্য বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ব্রিকস যুক্তরাষ্ট্র ও ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭ বা শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির জোট জি-২০-এর বিরোধী কোনো শিবির নয়। এর লক্ষ্য, কথিত তৃতীয় বিশ্ব, ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর উন্নয়ন। ব্রিকসে যোগ দিতে ৪০টি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করলেও মাত্র ৬টি দেশ এ সুযোগ পেয়েছে।
দেশের জন্য অস্ত্র ধরেছিলেন নুর ইসলাম। দেশ স্বাধীন করেছেন। তবে এ গৌরব নিয়ে বসে থাকেননি তিনি। মন দিয়েছিলেন সামাজিক, সাংগঠনিক নানা কাজে। অকস্মাৎ তার কর্মযজ্ঞে ভাটা পড়ে। এক সকালে ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার পথে এক দানবীয় বাহন রক্তাক্ত করে তাকে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার ওপর রুক্ষতা এঁটে দিয়েছে দেশের বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা। হয়তো অনেক অভিযোগ নিয়ে অনন্তযাত্রা হয়েছে এ মুক্তিযোদ্ধার।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবারের সদস্যরা দেশ রূপান্তরকে জানান, নুর ইসলাম (৭০) গত ৭ আগস্ট ফজরের নামাজ শেষে ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। ঘটনাস্থলে থাকা কয়েকজন যুবক মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে নিয়ে যান স্থানীয় স্পেশালাইজড মেডিকেল কেয়ার হাসপাতালে। সেখানে তাকে ৪০ মিনিটের বেশি সময় রাখা হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। পরে এক আত্মীয় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পথেই তার মৃত্যু হয়।
মুক্তিযোদ্ধা নুর ইসলামের মতো সারা দেশে অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিভছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দায়িত্বহীন কান্ডে। ‘পুলিশ কেস’, ‘আইনি ঝামেলা আছে’ প্রভৃতি কথা বলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে মুমূর্ষু রোগীদের। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পরও বদলায়নি তারা। নানা অজুহাতে দুর্ঘটনায় আহত বা অপরাধীদের আক্রমণে মারাত্মক আহত রোগীদেরও ফিরিয়ে দিচ্ছে তারা দ্বিধা ছাড়াই।
মুক্তিযোদ্ধা নুর ইসলামের চিকিৎসাবিষয়ক কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি স্পেশালাইজড মেডিকেল কেয়ার হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। তবে একাধিকবার চেষ্টার পর কথা হয় মার্কেটিং ম্যানেজার মো. শরীফের সঙ্গে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা তাকে ফিরিয়ে দিইনি। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরিবারের ইচ্ছায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।’
ওই হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনায় আহত রোগীরা এখানেই চিকিৎসার জন্য আসেন। কম আহত রোগীদের এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গুরুতর আহত রোগীকে দেওয়া হয় না, বরং তাকে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’ ওই ঘটনায় হাসপাতালটির বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে নুর ইসলামের পরিবার।
বেসরকারি সব হাসপাতালের এক চিত্র আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেসরকারি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়টি যাচাই করা হয়। দেখা যায়, প্রায় সব হাসপাতালেই রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ৫২০টি বৈধ জেনারেল হাসপাতাল আছে। সবটিতেই আহত রোগীকে চিকিৎসা করার প্রাথমিক সক্ষমতা আছে। কিন্তু চিকিৎসা পায় না গুরুতর আহতরা।
রাজধানীর হাতিরঝিলে গত ১৩ জুলাই ভিক্টর পরিবহনের বাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন কলেজ শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান (২৪)। তাকে নেওয়া হয় পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে। তাকে চিকিৎসা না দিয়ে ঢামেক হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। ততক্ষণে তিনি মারা যান। জাহিদ চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং দ্বিতীয় বর্ষে অনলাইনে ক্লাস করতেন। ২৫ আগস্টের আগেই চীনে যাওয়ার কথা ছিল তার। তাকে এবং দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা না দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জেনারেল ম্যানেজার নুরুল ইসলাম তুহিন। তিনি বলেন, ‘প্রচুর ডেঙ্গু রোগী আসছে। আমরা অন্যদের জায়গা দিতে পারছি না। সমস্যায় না পড়লে আমরা সাধারণত রোগী ফিরিয়ে দিই না।’
১৭ জুলাই রাতে খিলক্ষেত ৩০০ ফিট এলাকায় মোটরসাইকেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আহত হয় দুই কিশোর। দুজনের একজন গুরুতর আহত হয়। পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আরও একটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে তাদের যেতে হয় ঢামেক হাসপাতালে। তবে যথাসময়ে চিকিৎসার অভাবে সেখানে যাওয়ার আগেই মারা যায় রাতুল কাজী।
হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনায় আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি তারা বিবেচনা করেন। গুরুতর আহতদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হয় তাদের। গুরুতর আহত রোগী মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে ভুল বুঝে হাসপাতাল ভাঙচুর করে। টাকা পরিশোধ করতে চায় না। এসব ঘটনায় মামলা হলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কখনো চিকিৎসা দিতে পুলিশের অনুমতি নিতে হয়। ফলে জটিলতা এড়াতে চিকিৎসাদানে মালিকপক্ষ কড়াকড়ি আরোপ করে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গুরুতর আহত রোগীদের পাঠানো হয় ঢামেক হাসপাতালে। যানজটের কারণে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই অসংখ্য প্রাণ নিভছে। ঢামেক হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, আহত রোগীদের অধিকাংশই স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে যায়নি চিকিৎসা পাবে না বলে। যারা গিয়েছে তাদের বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে ভালো হয়। তাদের কাছে আহত রোগীর চিকিৎসা নেই।
ঢামেকে রাজধানী ও আশপাশের জেলা ছাড়াও দূরবর্তী জেলার রোগীরা রয়েছে। ওইসব এলাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোও তাদের একই কথা বলেছে। গত সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া এলাকায় ছিনতাইকারীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন স্থানীয় ব্যবসায়ী দিল মোহাম্মদ। ওই এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে পুলিশ কেস বলে ঢামেকে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তিনি ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চিকিৎসা দিতে সমস্যা কোথায়?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রথমত পুলিশে কেস হতে পারে বা পুলিশ কেস হয় সেসব রোগীর বিষয় সাধারণত দীর্ঘকাল ধরে চলে। বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যারা কর্মরত থাকেন তাদের এতবার নানা জায়গায় হাজিরা দিতে হয়, যা তাদের জন্য ঝামেলাপূর্ণ। দেখা যায়, কোনো মামলা ১৫ বছরেও গড়িয়েছে; ডাক্তার এ সময়ে অন্য কোনো বা দূরের কোনো হাসপাতালে যোগ দিয়েছে। কোর্টে হাজিরা দেওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। আবার হাজিরার খরচও তাকে দেওয়া হয় না। এ কারণে তারা আহত রোগীর চিকিৎসায় আগ্রহী হয় না। দ্বিতীয়ত যাদের দ্বারা দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যদি তারা রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে বা পেশিশক্তিতে বলীয়ান থাকে তাহলে নানা চাপ তৈরি হয়। এসব কারণে বেসরকারি হাসপাতালে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। তবে মুমূর্ষু কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়; তার চিকিৎসা করা দরকার। চিকিৎসকরা হয়রানির মুখোমুখি না হলে এ প্রবণতা কমে যাবে।’
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনা, অপরাধীর আক্রমণ বা সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা বা জিডিতে বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য গ্রহণ করে না পুলিশ। ফলে বাধ্য হয়ে সরকারি হাসপাতালে যেতে হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনায় শিকার কেউ অভিযোগ করতে চাইলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার তথ্য দিতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী আমরা সরকারি হাসপাতালের তথ্য চেয়ে থাকি।’
আইনও নেই আহতের পাশে
সারা দেশে আগের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে বেপরোয়া পরিবহন, যান্ত্রিক ত্রুটি প্রভৃতি কারণে। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে দ্রুত কাছের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে বলা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে হাসপাতালের প্রতি কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এর আগে একই বছর দুর্ঘটনায় আহতের চিকিৎসার নীতিমালার গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। তবে এখনো কার্যকরী হয়নি সে নির্দেশ।
দুর্ঘটনাস্থলের কাছের থানা এবং ক্ষেত্রমত ফায়ার সার্ভিস, চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতালকে জানাতে বলা হয়েছে ওই আইনে। আহতের চিকিৎসা না করালে তা আইনের লঙ্ঘন হবে এবং এজন্য অনধিক এক মাসের কারাদ- বা অনধিক ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- হবে এবং চালকের ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
২০১৬ সালে গুরুতর আহত ব্যক্তির জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালকে নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের আগস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও সহায়তাকারীর সুরক্ষায় প্রণীত নীতিমালার দুটি অংশে আদালতের পর্যবেক্ষণ যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করতে বলে হাইকোর্ট। নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত এটাই আইন গণ্য হবে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার আয়েশা আক্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে নীতিমালাটা যথাযথভাবে এসেছে। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিবকে গেজেট প্রকাশ করতে বলা হয়। এটার গুরুত্ব চিকিৎসকরাও বুঝতে পারবে যখন তাদের গাইডলাইনে এটা যুক্ত হবে। সরকার যখন এটাকে গেজেট আকারে প্রকাশ করবে তখন তারা বুঝতে পারবে যে এটা করতে হবে। গেজেট না হওয়ায় নীতিমালার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না।’
সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করা হলেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম মহানগরীর জাকির হোসেন রোডের উভয় পাশেই পাহাড় ছিল। নব্বইয়ের দশকে দিনের বেলায়ও এ রোড দিয়ে চলতে ভয় পেত মানুষ। সরকারি মহিলা কলেজের উল্টো পাশে নাসিরাবাদ প্রপার্টিজ নামে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠলেও আগে পুরোটা পাহাড়ি এলাকা ছিল। দক্ষিণ খুলশী, পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ভিআইপি আবাসিক এলাকা সব হয়েছে পাহাড়-জঙ্গল কেটে। পুকুর-দীঘি-জলাশয়, খেলার মাঠ, কৃষিজমি ভরাট করেও উঠেছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক জি এন তানজিনা হাসনাত ও একই বিভাগের মোহাম্মদ আলী বাবু ‘আরবান ল্যান্ডস্কেপ চেঞ্জ ডিটেকশন ইউজিং জিআইএস অ্যান্ড আর এস’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ২০২২ সালে। তাতে বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়-জঙ্গলের সবুজ কমেছে ২১ দশমিক ৮২ শতাংশ আর পুকুর-জলাশয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ১৯৯০ সালে নগরীর মাত্র ১৯ শতাংশ এলাকায় বসতি থাকলেও এখন ৪৫ শতাংশ এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।
সারা দেশের ভৌগোলিক পরিবর্তনের বিভিন্ন মানচিত্রের গবেষণা করে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো)। এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নূর হোসাইন শরীফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উন্নয়ন ও সবুজায়ন সাংঘর্ষিক। তার পরও উন্নয়ন চালিয়ে যেতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের কারণেই সবুজ কমছে। এ চিত্র সারা বিশে^ই; কোথাও কম, কোথাও বেশি। এতে বাড়ছে উষ্ণতা।’
আবাসনে বিলীন পাহাড় গাছ পানি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে স্থাপনার (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) সংখ্যা বাড়ছে। পতিত জমি, সবুজাচ্ছাদিত ভূমি ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে। একদিকে বাড়ছে আবাসন, অন্যদিকে কমছে সবুজ।’
নিজেদের গবেষণার একটি মানচিত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘স্যাটেলাইটের উপাত্তে দেখা যায়, নগরীর যেসব এলাকায় আগে পাহাড় ছিল, সেখানে এখন বসতি। আগে যেখানে পুকুর বা জলাশয় ছিল, এখন সেগুলো ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে স্থাপনা।’
অধ্যাপক জি এন তানজিনা হাসনাত বলেন, ‘শহরমুখো মানুষের আবাসনের চাহিদা মেটাতে বিলীন হচ্ছে চট্টগ্রামের পাহাড়, জলাশয় ও খোলামাঠ। নগরীর প্রান্তীয় এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।’
৪০ বছরে সাবাড় ১২০ পাহাড়
গত বছরের ৩০ মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক খালেদ মিসবাহ উজ্জামান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার এক সেমিনারে ‘হিল কাটিং ইন চিটাগাং সিটি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ৪০ বছরে হারিয়ে গেছে ১২০টি পাহাড়। একটি মাত্র সড়ক নির্মাণেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কেটে ফেলেছে ১৬টি পাহাড়। সবচেয়ে বেশি পাহাড় বিনষ্ট হয়েছে আবাসিক এলাকা নির্মাণে। এক-দুই বছরে নয়, অনেক বছরে পর্যায়ক্রমে। অবশিষ্টগুলোও সাবাড় হওয়ার পথে। সম্প্রতি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার ফখরুজ্জামান বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় চট্টগ্রামের পাহাড় সাবাড় হচ্ছে।’
পশ্চিম খুলশীর জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটির উত্তরে কৃষ্ণচূড়া আবাসিক এলাকার পরের জায়গাটি সমতল হয়ে গেছে। সেখানে প্লট বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ বছর আগেও এখানে পাহাড় ছিল। ২০১৮ সালেও এখানে পাহাড়ের ঢালে ছড়া প্রবাহিত ছিল। এখন সেখানে কংক্রিটের রাস্তা। পাহাড়ের দিকে আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় যাওয়া যায় সে রাস্তা ধরে। উভয় পাশের পাহাড়গুলো আগের অবস্থায় নেই। স্থানীয় এক দোকানি বলেন, ‘এলাকাটি প্রধান সড়ক থেকে তিন-চার কিলোমিটার ভেতরে। তাই প্রশাসনের কেউ আসে না। মোড়ে মোড়ে পাহারাদার বসিয়ে ভেতরে চলে পাহাড় কাটা।’
জাকির হোসেন রোডে খুলশী থানার বিপরীতে জাকির হোসেনের বাংলোর চারপাশে পাহাড় ছিল। এখন সেখানে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে জাকির হোসেন সোসাইটি। সোসাইটির পশ্চিম পাশে নিউ ঝাউতলা রেলওয়ে কলোনি ও ডিজেল কলোনি। নিউ ঝাউতলার ২৩ নম্বর ভবনে ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বসবাস করেছেন আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘যখন এ কলোনিতে বাসা বরাদ্দ পাই, তখন জানালা দিয়ে জাকির হোসেনের পাহাড় ও গাছ-গাছালি দেখা যেত। চোখের সামনে সেখানে একের পর এক ভবন উঠতে দেখলাম।’
জাকির হোসেন রোডের হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের (বর্তমানে বন্ধ) পাশ দিয়ে দক্ষিণে হাতের বাম পাশে পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা। সেখানকার পাহাড়ে এখন সুউচ্চ ভবনের ভিড়। আরও একটু দক্ষিণে বাম পাশের সড়ক দিয়ে দক্ষিণ খুলশী যাওয়া যায়। সড়কে ওঠার পথে বাম পাশে একটি উঁচু এবং অনেকগুলো মাঝারি পাহাড় ছিল। অনেক দূর থেকে বড় পাহাড়টি দেখা যেত। এর পাশেই একটি ভবনে ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছেন ব্যবসায়ী ফরিদ আহমেদ। তার মুখেও শোনা গেল এলাকাটির একসময়কার পাহাড়ি চিত্রের বর্ণনা।
একসময় সর্দার বাহাদুরনগর থেকে লালখান বাজারের বাঘঘোনায় আসার জন্য পাহাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটাপথ ছিল। পথের উভয় দিকেই ছিল পাহাড়। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তার পাশে পাহাড়ের ঢাল থাকলেও ভেতরে কোনো পাহাড় নেই। সমান করে গড়ে তোলা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভিআইপি আবাসিক এলাকা।
জাকির হোসেন রোডে সরকারি মহিলা কলেজের বিপরীত দিকে নব্বইয়ের দশকেও পাহাড় ছিল। ২০১০ সালের পর এ এলাকায় পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ শুরু হয়। এখনো চলছে। সিডিএ এ এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন না দিলেও ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পর পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়ে।
এ ছাড়া, চট্টগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্রের উল্টো পাশে রোজভ্যালি আবাসিক এলাকা, লেকভ্যালি আবাসিক এলাকা, ফয়’স লেকে চিড়িয়াখানার আগে আবদুল হামিদ সড়কের আবাসিক এলাকা, কৈবল্যধামের বিশ্বকলোনি, নন্দন হাউজিং, সিটি করপোরেশনের লেকসিটি আবাসিক এলাকা, বায়েজীদ চন্দ্রনগরসহ অনেক এলাকার পাহাড় কেটে আবাসন বিস্তৃত হয়েছে।
১৫ বছরে ভরাট ৩ হাজার পুকুর-জলাশয়
সিডিএর হিসাব মতেই, চট্টগ্রামে গত ১৫ বছরে হারিয়ে গেছে তিন হাজার পুকুর ও জলাশয়। ২০০৮ সালের ডিটেইলড এরিয়াপ্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী চট্টগ্রামে ৫ হাজার ৩১টি পুকুর ও জলাশয় ছিল। এখন নেমেছে প্রায় দুই হাজারে। সিডিএর উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক আবু ঈসা আনসারী দেশ রূপান্তরকে এমন তথ্য দেন।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কোনো নগরীর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ জায়গায় খেলার মাঠ, পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, পুকুর, দীঘি ও জলাশয় থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের শহরগুলোতে এর অর্ধেকও নেই। ফলে নগরীতে বসবাসের পরিবেশ যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন ঝুঁকি বাড়ছে।’
একসময় বন্দরনগরীর পরীর পাহাড়ের নিচে বিশাল জলাধার ছিল। সেখানে গড়ে উঠেছে আজকের জহুর হকার্স মার্কেট। চকবাজার অলি খাঁ মসজিদের পাশে কমলদহ নামে যে বিশাল দীঘি ছিল সেটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে কিশলয় কমিউনিটি সেন্টার। বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল নির্মাণের সময় ভরাট করা হয়েছে মাইল্যার দীঘি। আন্দরকিল্লায় রাজাপুকুর লেইন আছে; কুসুমবাগে আছে দেওয়ানজী পুকুর লেইন, কিন্তু পুকুর দুটি আর নেই। কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ের পেছনে বিশাল কাট্টলী দীঘির ওপর গড়ে উঠেছে প্রশান্তি আবাসিক এলাকা।
নগরীতে আগে এলাকাভিত্তিক ছোট অনেক পুকুর ছিল, এখন ভরাট। পাহাড়তলী, হালিশহর, রামপুরা, পতেঙ্গা, চান্দগাঁও প্রভৃতি এলাকার প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে পুুকুর ছিল, এখন নেই।
উধাও হচ্ছে খোলামাঠ
নগরীর খোলামাঠগুলোও ফুরানোর পথে। আউটার স্টেডিয়ামে মাঠের অর্ধেক দখল করে গড়ে উঠেছে স্থাপনা। ষোলশহরে বিপ্লব উদ্যান বিপন্ন করে গড়ে তোলা হয়েছে খাবারের দোকান। আগ্রাবাদে জাম্বুরি মাঠের অর্ধেক দখল করে হয়েছে শিশুপার্ক। আগ্রাবাদ সরকারি কলোনিতে একাধিক খেলার মাঠ ছিল, সেগুলোতে এখন গড়ে উঠছে বহুতল ভবন।
জলাধার, কৃষিজমিতেও আবাসন
বন্দরনগরীর প্রাকৃতিক জলাধার বাকলিয়া বগার বিল ভরাট করে বহুতল ভবন গড়ে তোলার হিড়িক পড়েছে। সিডিএ বাকলিয়ায় কর্ণফুলী নদীর তীরের কৃষিজমিতে কল্পলোক আবাসিক এলাকা প্রথম পর্যায় ও দ্বিতীয় পর্যায় নামে দুটো প্রকল্প নিয়েছে। অক্সিজেন-কুয়াইশ রোডে কৃষিজমি ভরাট করে অনন্যা আবাসিক এলাকা প্রকল্প নেয় সিডিএ। বর্ষাকালে এলাকাটি ছিল চান্দগাঁও, অক্সিজেন, কুয়াইশ, কালুরঘাট এলাকার প্রাকৃতিক জলাধার। বিবিরহাট সুন্নীয় মাদ্রাসার পেছনের এলাকায় এখন আবাসন গড়ে উঠছে। হালিশহরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জায়গাটি ছিল কৃষিজমি এবং বর্ষায় প্রাকৃতিক জলাধার। হালিশহর থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সাগর পাড়ে একসময় প্রচুর কৃষিজমি ছিল। এখন গড়ে উঠছে আবাসন ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা।
পাহাড়-জঙ্গল-বনানী, পুকুর-দীঘি-জলাশয়, কৃষিভূমি-খোলা মাঠ কেন হারিয়ে গেল? জানতে চাইলে সিডিএর সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘এসব রক্ষার দায়িত্ব অবশ্যই আমাদের ছিল। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় তা বিলীন হয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যান ১৯৯৯ সালে অনুমোদনের পর এক আদেশে অর্ধকাটা পাহাড়গুলোতে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০০১ সালের দিকে। সে সিদ্ধান্তে নগরীতে পাহাড় কাটার ধুম পড়ে যায়। ২০০৮ সালের ডিটেইলড এরিয়াপ্ল্যান প্রণয়ন এবং ২০০৮ সালের নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আগ পর্যন্ত সাবাড় হয় অধিকাংশ পাহাড়।’
দেশে ডেঙ্গুতে আরও একজন চিকিৎসক মারা গেছেন। ডা. বায়েজিদ আহমেদ নামে এই চিকিৎসক গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি এই কলেজের পঞ্চম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
হাসপাতাল পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান দেশ রূপান্তরকে জানান, ডা. বায়েজিদ আহমেদ রাজধানীর জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থা সংকটাপন্ন হলে তাকে সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল। পরে সেখান থেকে গত মঙ্গলবার রাতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের আইসিইউতে আনা হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। তিনি ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
এ নিয়ে এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে পাঁচ চিকিৎসক ও একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী মারা গেলেন। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া পাঁচ চিকিৎসক হলেন ডা. এম আরিফুর রহমান, ডা. শরীফা বিনতে আজিজ, ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু, ডা. ফাতেমা-তুজ-জোহরা রওনক ও ডা. বায়েজিদ আহমেদ এবং একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী হলেন সৈয়দা সাদিয়া ইয়াসমিন রাইসা।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ২ হাজার ২০১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১ লাখ ৮ হাজার ৬৩০ জনে। এ সময় ডেঙ্গুতে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর মারা গেল ৫১৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, নতুন রোগীদের মধ্যে ৯২৬ জন ঢাকায় এবং ১ হাজার ২৭৫ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭ হাজার ৯৪২ রোগী ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩ হাজার ৭৬৩ জন ও ৪১৭৯ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার।
মারা গেলেন পাঁচ চিকিৎসক, এক মেডিকেল শিক্ষার্থী : ডা. বায়েজিদ আহমেদকে নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন পাঁচ চিকিৎসক। তাদের মধ্যে মাত্র ২৭ বছর বয়সী ডা. শরীফা বিনতে আজিজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১১ আগস্ট ভোর ৫টার দিকে মারা যান। তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন এবং মৃত্যুর সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে এফসিপিএস পার্ট-২ করছিলেন। ডা. শরীফা দোহার উপজেলার লটাখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল আজিজের একমাত্র মেয়ে। এক ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়।
এর ঠিক তিন দিন আগে গত ৭ আগস্ট রাত ১টা ১৫ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু। তিনি সর্বশেষ বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইসিএমএইচ) গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগে রেসিডেন্ট (৩৯ ব্যাচ) হিসেবে অধ্যয়নরত ছিলেন।
এই চিকিৎসকের মৃত্যুর ব্যাপারে আইসিএমএইচের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ মান্নান জানান, ডা. মিশু সেখানে এমএস কোর্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। আসছে জানুয়ারিতে তার চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। জুনের পর থেকে বিএসএমএমইউতে পড়ালেখা করছিলেন তিনি, সেখানে তার প্লেসমেন্ট ছিল। গত ২৪ জুলাই তার জ্বর আসে, ডেঙ্গু ধরা পড়লে প্রথমে বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। অবস্থা খারাপ হলে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে এভারকেয়ার থেকে তার পরিবারকে জানানো হয় তিনি অলরেডি ব্রেইন ডেড। চিকিৎসা চালিয়ে যেতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসেন তার পরিবারের সদস্যরা। রাতে সেখানেই মারা যান।
১৫ মাসের সন্তান রেখে মারা গেছেন ডা. ফাতেমা-তুজ-জোহরা। গত ২২ জুলাই সন্ধ্যার দিকে সাভারের সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই চিকিৎসক রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ডা. রওনক ছিলেন সমাজভিত্তিক মেডিকেলের এমবিবিএস ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৩২ বছর। তিনি ১৫ মাস বয়সী একটি শিশু ছেলে রেখে গেছেন।
গত ২২ জুন ভোর সাড়ে ৫টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ডা. এম আরিফুর রহমান। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) কর্মরত ছিলেন। ডা. এম আরিফুর রহমান বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৩৯তম ব্যাচের কর্মকর্তা জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক মেডিকেল অফিসার ছিলেন। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন ডা. আরিফুর রহমান। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনে এমডি ফেইজ-এ-তে অধ্যয়নরত ছিলেন।
ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী মারা গেছেন। রাজধানীর ধানম-িতে অবস্থিত আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজের অষ্টম ব্যাচের শিক্ষার্থী সৈয়দা সাদিয়া ইয়াসমিন রাইসা গত ২৫ জুলাই সকালে আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি এমবিবিএস শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে একটি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশ বলছে। চক্রটির নেতা ফাওয়াদ মুখতারের বিরুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি চুরি করে বের করে ধনী গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিউজ।
বিবিসি জানায়, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তান পুলিশ। ফাওয়াদ এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগীর কিডনি চুরি করেছেন।
এমনকি অস্ত্রোপচারকালে কিডনি চুরির সময় তার হাতে অন্তত তিনজন রোগী মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফাওয়াদ এর আগে পাঁচবার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবারই জামিন নিয়ে মুক্তি পেয়ে যান। রোববার (১ অক্টোবর) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পাকিস্তান পুলিশ। চক্রটি পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের পাশাপাশি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে কাজ করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহসিন নকভি রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, “কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনকে ক্লিনিক আকারে সাজিয়ে সেখানে রোগীদের অস্ত্রোপচার করার সময় রোগীদের অজান্তেই কিডনি সরিয়ে নেয়া হত।“
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাওয়াদ মুখতার জানিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন চক্র এখন পর্যন্ত মোট ৩২৮ রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি করেছে। প্রতিটি কিডনি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি রুপি করে।
২০১০ সালে মানবদেহের প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।