
জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভারের অবস্থা এই আছে, এই নেই। এতে জন্মনিবন্ধন সনদ ব্যবহার করে ১৭ ধরনের সেবা পেতে সারা দেশের মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। পাশাপাশি মৃত্যুনিবন্ধন করতে না পারায় মৃত ব্যক্তি উত্তরাধিকারদের সম্পত্তি বণ্টন, পারিবারিক পেনশন প্রাপ্তিতেও হয়রানিতে পড়ছে তারা। আর মৃত্যুনিবন্ধন না করলে প্রকৃত জনসংখ্যাও নির্ণয় করতে পারে না সরকার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এক মাসের বেশি সময় ধরে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভারে আবেদন করতে পারছেন না গ্রাহকরা। সরকারের সেন্ট্রাল সার্ভার হ্যাকড হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে। যদিও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয় তা স্বীকার করছে না; তারা বলছে, সার্ভার আপডেট কাজ চলছে। তবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের যাদের আইডি নম্বর রয়েছে, তারা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করতে পারছেন। এসব আইডি থেকে দৈনিক ১৫ থেকে ১৮ হাজার জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন হচ্ছে। যদিও ঢাকার দুই সিটির বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করতে পারছেন না।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন সার্ভারে উন্মুক্ত থাকায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গ্রাহকদের আবেদন করে দেওয়া হতো না। একান্ত যারা ওই কর্মকর্তাদের দিয়ে এসব আবেদন করাতেন, তাদের নিবন্ধন ফির বাইরে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে করানো হতো। নইলে তারা কাউকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতেন না। এখন বাইরে থেকে আবেদন বন্ধ হওয়ায় ওইসব আইডি নম্বরধারীরা অসাধু চক্রের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করে দিচ্ছেন।
মহাখালী রাসেল কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী মো. রাসেল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, কয়েক বছর ধরে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অনলাইন আবেদনের কাজ করছি। অন্য দপ্তরের সার্ভারে সহজে কাজ করা যায়। কিন্তু জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভারের কাজ করতে ভোগান্তির শেষ নেই।
তিনি বলেন, ‘এক মাসের বেশি হবে অনলাইনে বাইরে থেকে কোনো আবেদন করা যাচ্ছে না। এজন্য গ্রাহকরা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করতে না পেরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তবে খবর পাচ্ছি, সিটি করপোরেশনের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শাখার কর্মীরা সার্ভারে ঢুকতে পারছেন। তারা সব গ্রাহককে এই সেবা দিচ্ছে না; যারা উৎকোচ দিচ্ছেন তারা শুধু জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করতে পারছেন।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, গত জুন মাস থেকে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের ফি সরকারি কোষাগারে জমা করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে ওই ফি দাবি করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় জুন থেকে জন্ম-মৃত্যু সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বন্দ্বে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সেবা বন্ধ থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন দক্ষিণ ঢাকার বাসিন্দারা। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
ঢাকা দক্ষিণের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শাখার এক কর্মী বলেন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শাখা খামখেয়ালিপনা করে। সিটি করপোরেশনে প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অথচ জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিসিকে, যিনি একজন উপসচিব। এ সিদ্ধান্তের কারণে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করতে রাজধানীর সব এলাকা থেকে নগরবাসীকে ডিসি অফিসে যেতে হচ্ছে। যানজটের এ শহরে নগরবাসীকে একটি ভুলের জন্য ডিসি অফিসে দৌড়াতে দৌড়াতে নাকাল হতে হচ্ছে। এসব ভাববার বা দেখার কেউ নেই। সচিবালয়ে বসে কর্মকর্তারা যখন যা খুশি, সেই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন। আমরা যারা সরাসরি জনগণের সেবা দিচ্ছি; আমরা বুঝতে পারছি মানুষের কত কষ্ট হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১১ সালে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য অনলাইন সার্ভার ব্যবহার শুরু করা হয়। কিছুদিন ভালো চলার পর সার্ভারের সমস্যার কারণে নগরবাসীর বকাবকি শুনতে শুনতে আমরা অতিষ্ঠ। সার্ভার কিছু সময় থাকে, আবার চলে যায়। নগরবাসীর সেবা দিতে আমাদের কর্মীরা গভীর রাতে এসব কাজ করে বাসায় ফিরত। সময়মতো নিবন্ধন দিতে না পারলে নানা কথা শুনতে হয়েছে।
তারা আরও বলেন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শাখাকে বিদ্যমান সমস্যার কথা বলতে গেলে তারা শুনতে চায় না। মানুষ সার্ভারে ঢুকতে পারছে না। আর জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয় বলছে, সার্ভার ঠিক আছে। আজগুবি সব কা-। উত্তর ও দক্ষিণের মেয়রদ্বয় স্থানীয় সরকার মহোদয়কে একটি সেমিনারে বিদ্যমান সমস্যার সুরাহা করতে বললেও তারা সেটা করছেন না। এ ছাড়া আগে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের সংশোধন সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে করা হতো। ওই কার্যালয় থেকে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, এখন ছোটখাটো ভুলের জন্য ডিসি অফিসে দৌড়াতে হচ্ছে। মানুষ আমাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কিন্তু তারা ভাব নিয়ে বসে আছেন, বলছেন এসব সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের কিছু করার নেই। মানুষের দুর্ভোগ হয় এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা কী মজা পাচ্ছেন আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা দিদারুল আলম। মেয়ের জন্ম নিবন্ধনের আবেদনে মায়ের নামের বানান ভুল হয়েছে। সংশোধনের জন্য ছুটে গেলেন সিটি করপোরেশনের স্থানীয় অফিসে। আবেদন করতে বলা হলো, তিনি আবেদন করলেন। এরপর একটি সিøপ দিয়ে বলা হলো ডিসি অফিসে চলে যান। কর্মীদের অনেক অনুরোধ করলেন, কিন্তু তারা তাকে বুঝিয়ে বললেন, তাদের কিছু করার নেই। প্রায় এক মাসে তিন থেকে চারবার ডিসি অফিসে ছোটাছুটি করে সংশোধন করেছেন তার মেয়ের জন্ম নিবন্ধন।
কুড়িলের বাসিন্দা সিমু আক্তারের মা মারা গেছেন ২০১০ সালে। তার মায়ের জন্ম নিবন্ধন, স্কুল সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র বা বয়স প্রমাণের কোনো প্রমাণপত্র নেই। কয়েক বছর ধরে সরকারের দপ্তরগুলোতে ঘুরে ঘুরে কোনো কূল-কিনারা করতে পারছেন না। ভুক্তভোগী এ নগরবাসী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এটা কেমন নিয়ম ভাই। আমার মায়ের বয়স প্রমাণপত্র থাকবে না বলে আমরা কোনো সমাধান পাব না। এ ধরনের ক্ষেত্রে আগের মতো জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যয়নকে গ্রহণ করলে তো হয়। হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত দিলে আমরা কোথায় যাব, কীভাবে আমাদের সমস্যার সমাধান করব।’
১৭ কাজে জন্মসনদ : জন্মসনদে পাওয়া যায় ১৭ ধরনের সেবা। সেগুলো হলো পাসপোর্ট, বিবাহ নিবন্ধন, বিদ্যালয়ে ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জমি-ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংকে হিসাব খোলা, আমদানি-রপ্তানির লাইসেন্স প্রাপ্তি, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস ও টেলিফোন সংযোগ প্রাপ্তি, ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) প্রাপ্তি, ঠিকাদারের লাইসেন্স প্রাপ্তি, ভবনের নকশা অনুমোদন, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়প্রাপ্তি এবং বয়স প্রমাণ করতে।
৩ কাজে মৃত্যু নিবন্ধন : তিন ধরনের কাজে মৃত্যু নিবন্ধন প্রয়োজন। সেগুলো হলো মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন, পারিবারিক পেনশন প্রাপ্তি এবং দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের অতিরিক্ত সচিব এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধক মো. রাশেদুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ের কারিগরি জনবল সংকট রয়েছে। এজন্য নতুন সাংগাঠনিক কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুমোদন প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় জটিলতাগুলো কার্যকর সমাধান করা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিগত সিদ্ধান্তের আলোকে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। এখানে ভালো-মন্দ বিভিন্ন দিক রয়েছে। সেসব পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কোনো কিছু স্থায়ী নয়; সরকার প্রয়োজন মনে করলে সেসব সংশোধন করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন অনলাইন সার্ভারের কিছু ত্রুটি দেখা দেওয়ায় সংস্কারকাজ চলছে। এজন্য সাধারণ মানুষের আবেদনের সুযোগ আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে এটিও চালু করা হবে। জরুরি হলে সেবাপ্রত্যাশী সংশ্লিষ্ট এলাকার সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদে গেলে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সেবা নিতে পারবেন। জরুরি প্রয়োজনে প্রতিদিন সারা দেশের ১৫ থেকে ১৮ হাজার জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন হচ্ছে।
২০০৪ সালে সরকার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন পাস করে। আর ২০০৬ সাল থেকে নিবন্ধন সনদ দেওয়া শুরু করে। প্রথমে অফলাইন সার্ভারের মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হতো। এরপর ২০১০ সালে সরকার অনলাইন সার্ভার চালু করে। তখন আগে ইস্যু করা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদগুলো সেখানে পাওয়া যায়নি। এজন্য আগে যারা জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন করেছেন, তারা আবার সেসব সনদ ইস্যু করেছেন। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদের গলদের কোনো শেষ নেই; দেশে ১৬ কোটি ৯৭ লাখ জনসংখ্যা হলেও জন্মসনদ ইস্যু করা হয়েছে ১৯ কোটি ৩৫ লাখ।
ভোগান্তির আরেক নাম হয়ে উঠেছে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ভুল সংশোধন প্রক্রিয়ার। এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে অনেককে। নির্বাচন কমিশনের এনআইডি অনুবিভাগ নতুন এনআইডি তৈরি ও ভুল হলে তা সংশোধন করে। সংশোধনের ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা একের পর এক নানারকম কাগজ চেয়ে থাকেন। সঠিক কাগজ উপস্থাপনের পরও সংশোধন করতে হয়রানি হতে হয় নাগরিকদের।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন অফিসের ইলেকটোরাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ইটিআই) ভবনের নিচে প্রতিদিনই থাকে মানুষের জটলা। তথ্যকেন্দ্রের সামনে থাকে লম্বা সারি। সরেজমিনে এনআইডি সংশোধন, হারিয়ে যাওয়ার পর নতুন করে তুলতে আসা লোকজনের ভিড় লেগে থাকতে দেখা যায়। সপ্তাহখানেক আগে এনআইডি ট্রান্সফার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আগারগাঁওয়ে আসেন নুরুল ইসলাম গাজী। এ সময় তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, তার বড় ভাই আগে ধানম-ির ভোটার ছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে বেশ অসুস্থ। তাই তিনি গ্রামে চলে যাবেন। তার এনআইডি ঢাকা থেকে চাঁদপুরের কচুয়াতে গ্রামের ঠিকানায় ট্রান্সফার করতে এসেছিলেন। তাকে বলা হয়, উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে। সেখানে যাওয়ার পর কিছু কাগজপত্র দিতে বলা হয়। যেমন জন্ম নিবন্ধন, বিদ্যুৎ বিলের কাগজ, প্রত্যয়নপত্র। ইউনিয়ন পরিষদে গেলে বলা হয় জন্ম নিবন্ধন অনলাইন করা নেই। এটা অনলাইন করতে হবে। তারা নানা অজুহাতে ঘুরাতে থাকে। বেশ কয়েক দিন পর জন্ম নিবন্ধন ও প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। তার জন্য বাড়তি টাকাও দিতে হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী সব কাগজ জমা দিয়েছেন। এখন অপেক্ষা করছেন, কবে ট্রান্সফার হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের প্রায় সবারই এনআইডিতে সমস্যা রয়েছে। এর আগে আমার আইডি কার্ডে মায়ের নামের বানান ভুল ছিল। বানান ঠিক করতে আবেদন করার পর তারা বলেছিল ১৫ দিন সময় লাগবে। কিন্তু সংশোধিত এনআইডি ছয় মাস সময় লেগেছে। আমাকে পাঁচ থেকে সাতবার নির্বাচন কমিশনে যেতে হয়েছে। পরিবারের আরও কয়েকজনের একই অবস্থা। মনে হয় জীবনের বাকি সময় এই ভুল সংশোধন করতে কেটে যাবে।’
জন্মতারিখ সংশোধন করতে এক বছর ধরে নির্বাচন কমিশনের বারান্দায় ঘুরছিলেন নোয়াখালীর আশ্রাফ উদ্দিন। জন্ম নিবন্ধন সনদ অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৮২ সালে কিন্তু এনআইডি কার্ডে ১৯৭৭ সাল। স্থানীয় নির্বাচন অফিসে গেলে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। সেখানে যাওয়ার পর তারা আবার নিজ জেলায় যোগাযোগ করতে বলে।
আশ্রাফ উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এক বছর আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। অনেক কর্মকর্তার হাতে-পায়েও ধরতে হয়েছে। নানা জায়গায় হয়রানি ও টাকা খরচ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংশোধন হয়েছে।’
জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত (সংশোধন, যাচাই ও সরবরাহ) প্রবিধানমালা ২০১৪-এর প্রবিধি ২(৫) অনুযায়ী, এনআইডি সংশোধন আবেদনের ক্ষেত্রে ৪টি শ্রেণি (ক্যাটাগরি) করা হয়েছে। ক ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তির জন্য উপজেলা-থানা নির্বাচন কর্মকর্তা, খ ক্যাটাগরির আবেদনের জন্য জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, গ ক্যাটাগরির আবেদনের জন্য আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং ঘ ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তির জন্য এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে ক, খ, গ ক্যাটাগরিতে এবং সব থেকে বেশি গ ও ঘ ক্যাটাগরিতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। মাসের পর মাস আবেদন জমা থাকছে। আবেদন প্রক্রিয়া ডিজিটাল হলেও নাগরিকরা এর সুফল ঠিকমতো পাচ্ছে না।
আগারগাঁওয়ে এনআইডি অফিসে আসা একজন ভুক্তভোগী শাহে আলম বলেন, ‘আমার ভোটার আইডি (এনআইডি) কার্ডে নামের বানান ভুল ছিল। তারা যেসব কাগজপত্র চেয়েছে সবই জমা দিয়েছি। এখন শুনানির জন্য ডেকেছে। গত সপ্তাহে আসার পর তারা বলেছে এ সপ্তাহে আসতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিরিয়াল পাইনি।’
নামের বানান ভুল নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জাকিয়া ইসলামকে। তার জন্মস্থান সিলেট। জাকিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই দেশে এসেছি নবায়ন করে ই-পাসপোর্ট করতে। সবকিছু ঠিকঠাক করে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য জমা দিলে সেখান থেকে বলা হয় আমার এনআইডি ভুল। জন্মতারিখ মিলছে না। স্থানীয়ভাবে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করা হলেও তারা কিছুই করতে পারবে না বলে জানায়। তাদের পরামর্শে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে এসে কয়েক দিন ঘুরেছি, কাগজপত্র সবই জমা দিয়েছি। এখন অপেক্ষায় আছি কবে নাগাদ ঠিক হয়।’
রাজধানীর বসিলা থেকে আসা মজিবুর হক নামে এক ভুক্তভোগী জানান, তারা জন্মতারিখ এবং নামের বানানে ভুল রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে এলে জন্ম নিবন্ধন ও এসএসসির সার্টিফিকেট আনতে বলা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। আমার তো ম্যাট্রিক পাসের সার্টিফিকেট নেই। আমি এই সার্টিফিকেট কোথায় পাব।’
দেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ৪৪০। এর মধ্যে অনেকেরই এনআইডিতে কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধান করতে এসে যাতে নাগরিকের ভোগান্তি না হয়, সেজন্য ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির সেবা কার্যক্রম। এনআইডি সংশোধন, হারানো কার্ড উত্তোলন এবং নতুন কার্ড মুদ্রণে উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি) কার কী ক্ষমতা তা-ও নির্ধারিত হয় প্রজ্ঞাপনে। এসএসসি সনদধারীরা কিছুটা সেবা পেলেও, যাদের কোনো সনদ নেই তাদের বেশি বেগ পেতে হয়।
আহসান বারী পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তিনি নতুন করে পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য নিয়ম অনুযায়ী ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন। পরে ছবি তোলার নির্ধারিত সময় গত ৩০ এপ্রিল আগের পাসপোর্ট (এমআরপি) নিয়ে উপস্থিত হন যাত্রাবাড়ী (বর্তমানে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত) পাসপোর্ট অফিসে। কিন্তু তার তথ্য যাচাই করতে গিয়ে অবাক হয়ে যান সেখানকার দায়িত্বরত ব্যক্তি। তিনি জানতে পারেন তার পাসপোর্ট অন্য কারও পরিচয়ে করা হয়েছে।
আহসান বারী বলেন, ‘অপারেটরের কাছে আমার কাগজপত্র দিয়ে ছবি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন তিনি বলছেন জন্মনিবন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট করেছেন কেন। আর এটা কার জন্মনিবন্ধন। আমি তার কথায় বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্ক্রিনে দেখাচ্ছে মফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তির তথ্য আসছে আমার পাসপোর্টে। এমন ভুলের বিষয়টি আমি আগে জানতে পারিনি। জানার পর বিষয়টি সমাধানের কোনো উপায়ও পাচ্ছিলাম না, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও জানাতে পারছিলেন না কী করতে হবে। এরপর প্রায় এক মাস আগারগাঁও ও যাত্রাবাড়ী পাসপোর্ট অফিসে বারবার গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তি পেতে হয়েছে।’
তবে এমন ভুলের কথা অস্বীকার করেন উপপরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এটা কখনো হবে না। এখানে আমাদের কোনো ভুল করার কারণ নেই। আবেদনকারী ফরম যেটা পূরণ করবে সেটা আর এনআইডি থেকে ডেটা আসবে সেটাই আমরা ব্যবহার করি। তিনি (আহসান বারী) নিজে এমআরপি ফরম পূরণ করে আমাদের দিয়েছেন। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে পাসপোর্ট পেয়েছেন। তাহলে এ সময়ের মধ্যে তিনি জানলেন না কেন? অন্যের তথ্য দিয়ে এটা সে উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেছেন।’
পাসপোর্টে আবেদনের ক্ষেত্রে অনেকেই ভুলে করে থাকেন। কিন্তু আবেদনে সঠিক তথ্য দিয়েও ভুল পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য মানুষের। তারা আহসান বারীর মতো কর্র্তৃপক্ষের করা বিভিন্ন ধরনের ভুলের ভোগান্তিতে পড়ছে। তাদের অধিকাংশই জানিয়েছে নাম ও পিতা-মাতার নামের বানানে ভুলের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কমল কান্তি মন্ডল কর্র্তৃপক্ষের এমন ভুলের অভিযোগ করেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি ২০১৭ সালের দিকে আগারগাঁও অফিসে পাসপোর্ট করি (এমআরপি)। তখন পাসপোর্টের আবেদনে নামসহ অন্যসব তথ্য সঠিকভাবে দিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে দেখি আমার নামে ভুল এসেছে। ইংরেজিতে কমল কান্তির শেষের ‘আই’ বাদ পড়েছে।’
কমল আরও বলেন, ‘এই পাসপোর্ট নিয়ে আমি ভারতে ঘুরে এসেছি। সংশোধন করতে গিয়ে আমি ভোগান্তিতে পড়িনি। ওই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত বছর নতুন ই-পাসপোর্ট নিয়েছি। সেখানে নামের বানান সঠিক পেয়েছি।’
এদিকে পাসপোর্ট আইনে বা অধ্যাদেশের কোথাও কর্র্তৃপক্ষের ভুলে গ্রাহক হয়রানির জন্য আইনি কোনো ব্যাখ্যা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মনজিলা সুলতানা ঝুমা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কর্র্তৃপক্ষের ভুলে অথবা অবহেলার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির ব্যাপারটা সবসময় ভুল হবে তা কিন্তু নয়। দেখা যায় একটা ভুলের কারণে নতুন করে আবার তথ্য দেওয়া প্রয়োজন হয়। অনেকেই এ ঝামেলায় যেতে চায় না, অফিসে কোনো কর্মচারী তখন বলে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে যান আমি ঠিকঠাক করে দেব। এটা মূলত একটা সিন্ডিকেট। হলফনামা থেকে শুরু করে পরবর্তী সব ডকুমেন্টস ঠিকঠাক হবে শুধু কিছু টাকার বিনিময়ে।’
ঢাকা ও খাগড়াছড়ির জেলা এবং দায়রা জজ আদালতের এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘কারও কাছে যদি প্রমাণাদি থাকে তিনি সঠিক তথ্য দেওয়ার পরও ভুল আসছে, তখন তিনি পাসপোর্ট অফিসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করতে পারেন। জবাবদিহিতা না থাকার কারণে পাসপোর্ট অফিসে কর্মচারী অথবা কর্র্তৃপক্ষের অবহেলায় সাধারণ পাসপোর্ট প্রার্থীর হয়রানি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
এদিকে কর্র্তৃপক্ষের ভুল সংশোধনে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে বাড়তি জটিলতার কথা জানাচ্ছেন অনেক ভুক্তভোগী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বাসিন্দা মো. আল-আমিন। এজন্য তিনি পাসপোর্ট নিয়েছেন। তবে সঠিক তথ্য দেওয়ার পরও তার পাসপোর্টে জন্ম তারিখ ১৯৯৬ ভুল হয়ে ১৯৮৬ এসেছে।
আল-আমিনের ভাই ওমানপ্রবাসী মোহাম্মদ ইয়ামিন মিয়া বলেন, ‘পাসপোর্টের এ ভুলের কারণে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় আছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাসপোর্ট অফিস গিয়ে এ সমস্যা নিয়ে কথা বলারই সুযোগ নেই। একমাত্র দালালের মাধ্যমে কাজ করা যায়। জন্মতারিখ সংশোধন নিয়ে আমরা দালালদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলছেন, জন্মতারিখ সংশোধন করতে ৫০ হাজার টাকা লাগবে।’
রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দালালচক্রের এমন কার্যক্রমের তথ্য পাওয়া যায়। গত মাসে সরেজমিনে পাসপোর্ট অফিসের সামনে গিয়ে এমন অসংখ্য অসাধু ব্যক্তির দেখা মেলে। তাদের একজন নুরুজ্জামান জানান, পাসপোর্টের সব সমস্যার সমাধান তার মাধ্যমে করা যায়। তার বিভিন্ন মাধ্যম টাকার বিনিময়ে এসব কাজ করে দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আল-আমিনের মতো ভুল হওয়া জন্মতারিখ সংশোধন করা যাবে কি না, জানতে চাইলে নুরুজ্জামান বলেন, ‘এ ভুল সংশোধন করতে ৪০ হাজার টাকা লাগবে।’
এসব বিষয়ে জানতে গত ১১ আগস্ট (শুক্রবার) ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নূরুল আনোয়ারকে ফোন ও মেসেজ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
জামিল আহমেদের বাবার নাম মিজানুর রহমান। কিন্তু সার্টিফিকেটে (সনদ) লেখা হয়েছে নিজাবুর রহমান। এই ভুল সংশোধনের জন্য তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ঘোরাঘুরি করছেন দুই মাস ধরে। কিন্তু সমাধান হয়নি।
সুনামগঞ্জের বাসিন্দা জামিল লক্ষ্মীপুর তাওয়াক্কোলিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে পাস করেছেন। বর্তমানে একটি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। তার সার্টিফিকেটে বাবার নামে ভুল থাকায় তা দিয়ে কোনো কাজই করতে পারছেন না।
জামিল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি তো এই ভুল করিনি। ভুল করেছে কর্তৃপক্ষ। অনাইলনে সার্টিফিকেট সংশোধনের জন্য আবেদন করেছি অনেক আগেই। কিন্তু এখনো সংশোধন হয়নি। দুই মাসের বেশি সময় ধরে বোর্ডে ঘোরাঘুরি করছি।’ তিনি জানালেন, ভবিষ্যতে দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। সার্টিফিকেটে বাবার নামে ভুল থাকায় পাসপোর্ট করতে পারছেন না। এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন এই শিক্ষার্থী।
শুধু জামিল একা নন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের ভুলের জন্য এ রকম অনেক শিক্ষার্থী ভোগান্তিতে পড়েছেন। মাসের পর মাস বোর্ডে এসেও সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন না এসব শিক্ষার্থী।
বকশীবাজারে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সার্টিফিকেট সংশোধনের জন্য শিক্ষার্থীরা আসছেন। অনলাইনে আবেদন করা গেলেও মাসের পর মাস সমাধান না পেয়ে সবাই বোর্ডে ভিড় জমাচ্ছেন। বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বেশিরভাগকেই ঠিকমতো না পাওয়ায় ভুল আর সংশোধন হচ্ছে না।
সার্টিফিকেটে নিজ নামে ভুল থাকায় চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না সাইফুল ইসলাম নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে আমাকে। তাদের (মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড) জন্য চাকরিতে আবেদন করতে পারছি না। নামে বড় রকম ভুল থাকায় এই সার্টিফিকেট দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। তিন মাসের বেশি সময় হয়ে যাচ্ছে এখনো সমাধানের কোনো খবর নেই। আর কবে নাগাদ এই সমস্যার সমাধান হবে, সেটিও বোর্ডের কেউ বলতে পারছে না।’
দশবারের বেশি বোর্ডে আসা-যাওয়া করছেন ডেমরার আবদুল মতিন। এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, সরকার সবকিছুই এখন ডিজিটাল করেছে। কিন্তু ছোট একটা সমস্যা সমাধান করতে মাসের পর মাস লেগে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার সার্টিফিকেটে বাবার নাম সংশোধনের জন্য চার মাস আগেই অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করেছিলাম। কর্মকর্তাদের নানা অজুহাতে বিভিন্ন কর্মকর্তার রুমে রুমে ঘুরলেও কেউ সমাধান দিতে পারছেন না।’ তার দাবি, বোর্ডের কর্মকর্তারা দায়সারাভাবে কাজ করেন। যার ফলে ছোট সমস্যাও সমাধান করতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটারিং করা।
ফৌজদারি মামলার বিচারে ভোগান্তি ও হয়রানি জানা কথা। শুরুটা হয় মামলার প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নথি তোলার মধ্য দিয়ে। মামলার এজাহার, প্রাথমিক তথ্যবিবরণী, জামিন কিংবা জামিন নামঞ্জুরের আদেশ, অভিযোগপত্র, রায়সহ বিভিন্ন সময়ের আদেশের অনুলিপির প্রয়োজন হয় বিচারপ্রত্যাশী ও আইনজীবীদের। কিন্তু বিচারের আগে কিংবা বিচার চলাকালে নথি পেতেও ভোগান্তির শেষ নেই।
ছয় মাসের বেশি সময় আগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন অধস্তন আদালত থেকে কোনো মামলার নথির ফটোকপি দেওয়া বন্ধ রয়েছে। মামলার প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আদালতের নকল শাখা থেকে সার্টিফায়েড কপি (সই মহুরি নকল) তুলতে হয়। কিন্তু অধস্তন আদালতে কিছু অসাধু কর্মচারী বিচারপ্রত্যাশীর ভোগান্তি বাড়াচ্ছেন। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় মামলার ফটোকপি দেওয়া বন্ধ থাকলেও নিয়মের বাইরে বিকল্প উপায়ে অনেকে আদালতের কর্মচারীদের দিয়ে তা সংগ্রহ করেন।
ঢাকার আদালতে মামলা পরিচালনাকারী বেশ কয়েকজন আইনজবীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো মামলার নথি পেতে নীল রঙের একটি আবেদনপত্র ৬০ টাকা দিয়ে কিনে তা পূরণ করে ২৫ টাকা কোর্ট ফি (স্ট্যাম্প) দিয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের নকল শাখায় জমা দিতে হয়। সেখান থেকে আবেদন যায় আদালতে। তবে, সে জন্য নিয়মের বাইরে আদালতের কর্মচারীদের দিতে হয় মামলার গুরুত্ব অনুযায়ী কমপক্ষে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। আদালতের অনুমোদনের পর নকল শাখার নকলনবিশদের কাউকে ধরতে হয় নথির জন্য। এ জন্য নিয়মের বাইরে টাকা দিতে হয় তাদের। এই প্রক্রিয়ায় কয়েক দিন পার হয়।
আইনজীবীরা বলেন, সার্টিফায়েড কপির (বাদামি রঙের কাগজে ছাপা লেখা) জন্য নির্ধারিত কোনো মূল্যের বিষয়ে তারা অবগত নন। এক পাতা নথির অনুলিপির জন্য ২০০ থেকে শুরু করে কয়েক শ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। আর নথির পাতার সংখ্যা বাড়লে প্রতি পাতা নেওয়া হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকা। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সার্টিফায়েড কপির এক পাতার জন্য ৫০০ টাকা নেওয়ার ঘটনা অহরহ। পাতা যত বাড়ে, টাকার অঙ্কও তত বাড়ে। এমন পরিস্থিতিতে দরিদ্র ও অসহায় বিচারপ্রত্যাশীরা বিপাকে পড়েন।
২০২১ সালে ঢাকার এক পারিবারিক আদালতে ভরণপোষণসংক্রান্ত একটি মামলায় বাদীর অনুপস্থিতিতে মামলা খারিজের আদেশ হয় গত ৮ জুন। আদেশের অনুলিপি (সার্টিফায়েড কপি) পেতে আইনজীবী আবেদন করেন ১৩ জুন। এক মাসের বেশি সময় পর অনুলিপি হাতে পান গত ১৯ জুলাই। দুই পাতার আদেশের অনুলিপির জন্য বিচারপ্রত্যাশীকে প্রতি পাতায় গুনতে হয়েছে ১ হাজার টাকা। এ মামলায় বাদীকে আইনি সহায়তা দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী (ঢাকা বারের সদস্য) খাদেমুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কোনো মামলার নথি পেতে তদবির (একধরনের তাগিদ) না করলে আবেদনসংশ্লিষ্ট আদালতগুলোতে পড়ে থাকে। মাস পার হলেও রেকর্ডরুমে নথি যায় না। বাধ্য হয়ে অনেকেই বাড়তি টাকা দেন।’
ঢাকা বারের আইনজীবী আজাদ রহমান বলেন, ‘এক পাতা নথির জন্য কমপক্ষে ২০০ টাকা দিতে হয়। কেন কী কারণে এত বেশি টাকা দিয়ে নথি নিতে হবে, এর কোনো কারণ কেউ বলেন না।’
অন্যদিকে দরিদ্র বিচারপ্রত্যাশীদের অনেকেই নিয়মের বাইরে টাকা দিতে না পারায় আদেশের অনুলিপি না পাওয়ার ঘটনাও অহরহ। গত বছরের ৩০ আগস্ট ২৫০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধারের একটি মামলায় কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ ধর্মগুরু গ্রাম থেকে মহিদুল (৪৩) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় গত ১৯ মার্চ খালাস পান তিনি। কিন্তু অটোরিকশাচালক এই ব্যক্তি অর্থের অভাবে এখনো আদেশের অনুলিপি নিতে আসেননি। নাম না প্রকাশের শর্তে মহিদুলের আইনজীবী বলেন, ভবিষ্যতে হয়রানি থেকে রক্ষায় যেকোনো আদেশের অনুলিপি তুলে রাখতে হয়। কিন্তু তার অনুলিপি তুলতে কয়েক হাজার টাকা খরচের আশঙ্কায় তিনি আর আদলতমুখো হচ্ছেন না।
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আব্দুল্লাহ আবু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও নথি টেম্পারিং রোধ করতেই মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। এখন কেউ যদি এ সিদ্ধান্তের বরখেলাপ করে বিচারপ্রত্যাশীর কাছে টাকা নেয়, তাহলে অবশ্যই এ বিষয়টি আদালতের দৃষ্টিগোচর করা হবে।’
মো. মাইনুদ্দীন কেরানীগঞ্জ এলাকার একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ের কাজে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাকে মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে হয়। কেরানীগঞ্জে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ইকুরিয়া কার্যালয়ে তিন বছর ধরে ঘুরেও পাচ্ছেন না ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড।
মাইনুদ্দীন জানালেন, এই তিন বছরে কতবার যে তিনি ইকুরিয়া কার্যালয়ে যাওয়া-আসা করেছেন গুনে বলা যাবে না। যখনই আসেন, তখন নতুন তারিখ দেওয়া হয়। সব রকম পরীক্ষা ও টাকা দেওয়ার পরেও ড্রাইভিং লাইসেন্সের সেই কাক্সিক্ষত স্মার্ট কার্ড পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, লাইসেন্স না থাকায় রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ অনেক সমস্যা করে। অনুমতির যে কাগজ দেওয়া হয়েছে, সেটাও পুরনো হয়ে গেছে, নষ্ট হওয়ার পথে। ঠিক একই সমস্যা নিয়ে এই সার্কেল অফিসে এসেছিলেন যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা মো. রাকিব। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় চলার সময় নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয় ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য। আর যে কাগজ দেওয়া হয়েছে, সেটা অনেক দিন ভাঁজে থাকায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা এখন। সরকার কত কিছু ডিজিটাল সেবা করল। কিন্তু আমরা এখনো সেভাবে তার সুফল পাচ্ছি না।’
শুধু ইকুরিয়া কার্যালয় নয়, দেশে বিআরটিএর বেশিরভাগ সার্কেল অফিসে সেবা নিতে এসে নানান হয়রানির শিকার হতে হয় সেবাপ্রার্থীদের। জানা যায়, প্রায় ৩০ হাজার আবেদনকারীর প্রয়োজনীয় তথ্য বিআরটিএর কাছে নেই। আবার অনেক সময় সার্ভার সমস্যায় নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। কর্তৃপক্ষের গাফলতির কারণেও দুর্ভোগ বাড়ে সেবাগ্রহীতাদের।
বিআরটিএর ঢাকা মেট্রো ৩ সার্কেল উত্তরা কার্যালয়ে গাড়ির মালিকানার সমস্যা নিয়ে তিন বছর ধরে ঘোরাঘুরি করেও সমাধান পাচ্ছেন না উওরার বাসিন্দা মো. শিহাব উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘পুরনো একটি মোটরসাইকেল নিয়েছিলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে। কিন্তু নানা জটিলতার জন্য নাকি এখনো মালিকানা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তারা (কর্তৃপক্ষ) বলছেন, অনেকগুলো ফাইল জমা আছে। যার জন্য কাজ শেষ হতে সময় লাগছে। কিন্তু কবে এই সমাধান হবে, সেটা কেউ বলতে পারছেন না।’
এই সার্কেলে আরেক ভুক্তভোগী মো. জামান বলেন, ‘চার বছর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স করা হয়েছিল। কিন্তু স্মার্ট কার্ড এখনো পাওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষের জন্য আমাদের এই ভোগান্তি হচ্ছে।’ এগুলো দেখার কেউ নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিআরটিএর অনেক কাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা করে থাকে। তাদের এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির জন্য অনেকে ঠিকমতো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন না। আর বিআরটিএর সার্ভারেও অনেক সময় সমস্যা দেখা যায়। শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্স নয়, মালিকানা বদল করার ক্ষেত্রেও নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হয় সেবাগ্রহীতাদের।
তিনি আরও বলেন, বিআরটিএর ইমার্জেন্সি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অনেকের লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অনেকের ভিসা পেয়েও এই ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বিদেশে যেতে পারছেন না। তাই বিআরটিএর মতো সেবাদান প্রতিষ্ঠানের আরও বেশি সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। তা না হলে বছরের পর বছর ভোগান্তিতে পড়তে হবে সেবাগ্রহীতাদের।
বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই রাব্বানী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের যে সমস্যাগুলো আছে, সেটি সমস্যা সমাধানে কাজ করা হচ্ছে। আর মালিকানায় অনেক ক্ষেত্রে যার নামে প্রথম মোটরসাইকেলের মালিকানা থাকে সেই ব্যক্তিকে পাওয়া যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্বাক্ষর সমস্যার জটিলতায় দেরি হয় মালিকানা বদলানোর ক্ষেত্রে। যার জন্য অনেক সময় লেগে যায়। তবে সবার সব ধরনের সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করেন তারা।
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।