
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ ৪৬ বছরে পা দিচ্ছে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। দলটি এমন একসময়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে যখন সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। ক্ষমতাসীন অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পাশাপাশি জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকারসহ সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। জনগণ এখন এ সরকারের হাত থেকে মুক্তি চায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণ প্রত্যাশা করছে বিএনপি তাদের মুক্তি দেবে।’
তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সফলতা পেতে ৯ বছর লাগলেও এবার ইতিমধ্যে ১৪ বছর চলে গেছে। বর্তমানে সরকার পতনের যে আন্দোলন চলছে, এবার সে আন্দোলনে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ছিটকে পড়তে হবে। আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই চলমান আন্দোলন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপি নেতারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চলমান এক দফার আন্দোলন সফল করতে নেতাকর্মীরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন। আগামী সপ্তাহে রাজপথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক দলগুলোর পাশাপাশি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরাসহ দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আমাদের হাতে সময় খুবই কম।’
বিএনপির একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের আগে এক দফার দাবিতে রাজপথে দুই-একটি কর্মসূচি থাকবে। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি থাকবে। কর্মসূচি চূড়ান্ত করার আগে শরিক দলগুলোর লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে।
যুবদলের এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কর্মসূচিতে যারা পরিশ্রম বেশি করে তাদেরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতটা না টার্গেট করে, তার চেয়ে বেশি টার্গেট করে দলের কিছু নেতা। কোনো কর্মসূচি সফল করলে তাদের গা জ¦লে। আতঙ্কে থাকে এই বুঝি তার রাজনীতি শেষ হয়ে গেল। এভাবে রেষারেষি চলতে থাকলে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তিনি বলেন, ‘দলের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতা চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে। তারা নিজেরা কোনো কর্মসূচিতে সেভাবে থাকেন না। অন্য যারা থাকে তাদের বিরুদ্ধে দলের হাইকমান্ডের কাছে বিষোদ্গার করেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ওয়ান-ইলেভেনের সংকটসহ বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করেছে। তারপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ১৪ বছর কেটে গেছে। এর আগে দুটি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে। এবার চলছে তৃতীয় দফার চূড়ান্ত আন্দোলন।’
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে গত মাসে রাজধানী ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ফ্লপ হয়। হতাশ হন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ক্ষুব্ধ তারেক রহমান ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে অব্যাহতি দেন, যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমিটি ভেঙে দেন। অবস্থান কর্মসূচিতে তৃণমূল নেতারা উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় রাজপথে যেভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেভাবে স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যসহ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতা উপস্থিত ছিলেন না। যদিও রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশের পরদিন রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
রাজপথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের এক শীর্ষ নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার পতনের আন্দোলনে নানা চড়াই-উতরাই, বাঁক থাকবে। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সবসময় একরকম থাকবে না। তাছাড়া নানা ইস্যুতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকে। বর্তমানে যে আন্দোলন চলছে তাতেও একই অবস্থা বিরাজমান। আগামী সপ্তাহে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক রয়েছে। তার আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হবে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিরিজ বৈঠক করবেন। আলোচনার মাধ্যমে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে। ১৫ সেপ্টেম্বরের আগে দুই-একটি কর্মসূচি থাকবে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ধারাবাহিক কর্মসূচি চলতে থাকবে।’
তিনি বলেন, বিএনপির যেমন তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি রয়েছে তেমনি গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দলগুলোর নিজস্ব রাজনীতি আছে। এর অংশ হিসেবে ৩ সেপ্টেম্বর সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে, চলমান আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় কর্মসূচি রয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে বিবৃতি দিচ্ছে, কর্মসূচি দিচ্ছে।
গত বছর জুলাই থেকে রাজপথের আন্দোলনে নামে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বরে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে ৯ ডিসেম্বর অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয় ২০ দলীয় জোট। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে গড়ে তোলা হয় রাজনৈতিক জোট। শুরুতে ৩৬টি দল সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও সময়ের ব্যবধানে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, জাতীয় পার্টি (মঞ্জুর)সহ আরও অনেকে যুক্ত হয়েছে চলমান এক দফার আন্দোলনে। ইতিমধ্যে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, পদযাত্রা, গণমিছিলের মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে।
চলতি সপ্তাহ জুড়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালনের পর এক দফার পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। কর্মসূচির ধরন নিয়ে দলের হাইকমান্ড স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মতামত নেবেন। পাশাপাশি সমমনা যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছেন তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা বসবেন। সবার মতামত পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচি : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলিস্তান মহানগর নাট্যমঞ্চে বিএনপির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া আজ সকালে নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের কার্যালয়গুলোতে দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে কর্মসূচি। বেলা ১১টায় শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিকেল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র্যালি বের করবে দলটি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির বাইরে সব জেলা ইউনিট ও অঙ্গসংগঠনগুলো কর্মসূচি পালন করবে নিজেদের মতো করে।
এক যৌথসভার পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে নিয়ে বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছে, চক্রান্ত হয়েছে এই দলটিকে ভেঙে ফেলার, ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু কখনোই বিএনপিকে ধ্বংস করতে পারেনি। বিএনপি একটা প্রবাহমান স্রোতঃস্বিনী নদী, সে বয়ে চলেছে। এখানে কেউ এসেছে, কেউ গেছে কখনো। কিন্তু বিএনপির গতিকে কেউ রুদ্ধ করতে পারেনি।’
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনকে বিএনপির দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ দাবি করে তিনি বলেন, ‘আজকে বিএনপি বড় রকমের দায়িত্ব নিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ জাতির দ্বিতীয় একটা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছে। সেই মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের এই ৫২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্ত এখন। যারা জোর করে বিনা নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতা দখল করে বসে আছে, তারা সর্বশক্তি দিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাটা ধবংস করে দিয়েছে। আজকে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে জনগণের আকাক্সক্ষাগুলোকে ধবংস করছে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হন। ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন; ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭-এর ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়, জিয়া তখন ওই দায়িত্বও নেন। সে সময় জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টায় একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়, যাতে ৯৮.৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে।
সামরিক আইন প্রশাসক থাকাবস্থায় জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি ডানপন্থি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। তবে সে দল তখন দেশের রাজনীতিতে নাড়া দিতে পারেনি। ওই বছর ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধানের পদে থেকে পুরাদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে যান জিয়া। ৩ জুন নির্বাচন দিয়ে ওই ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি ‘নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপতি হন। নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।
একসময় ঢাকায় সন্ধ্যা নামলেই শহর ঘুমিয়ে যেত। একবার বাসায় ঢুকলে বাসা থেকে অভিভাবকরা আর বের হতে দিতেন না। সেই সময় রাতে চলাচল করা ছিল একরকম আতঙ্ক। কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই শহর। দিনের মতো রাতের বেলায়ও জমজমাট। সন্ধ্যার সেই ঘুমন্ত শহর এখন ক্রমেই ২৪ ঘণ্টার নগরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
রাত যত বাড়ে, শহরের ব্যস্ততা ঠিক ততই বাড়তে থাকে। রাস্তায় থাকে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও ব্যাটারিচালিত যানের দাপট। এরই মধ্যে শহরে গড়ে ওঠা রাতের বাজারগুলো ও আশপাশে কর্মব্যস্ত হাজারো লোকের হাঁকডাক শোনা যায়। ভবন বা যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ ঘিরে ব্যস্ত থাকে আরও অনেক লোকজন। যদিও রাত ১টার পর খুব একটা গণপরিবহনের দেখা মেলে না। তবে বিকল্প বাহন ও অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবায় ভরসা করা যায় রাতের যাত্রায়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত, ঠাটারীবাজার, সোয়ারীঘাট মাছের বাজার, কারওয়ান বাজার, বাদামতলী ফলের বাজারে রাতভর ব্যস্ত থাকে। মূলত এ বাজারগুলো কেন্দ্র করে প্রতিরাতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। এ বাজারগুলো কেন্দ্র করে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ব্যবসায়িক কর্মকা- হয়। আর যার প্রভাব রাজধানী জুড়ে দেখা যায়। আর বসুন্ধরা কুড়িল এলাকায় রাতভর খোলা থাকে দোকানপাট। বসুন্ধরার ভেতরে আবাসিক এলাকায় দোকানপাট না থাকায় রাতে জরুরি জিনিসপত্রের চাহিদা মেটানোর জন্য মূলত এ দোকানগুলো খোলা থাকে। তবে অনেক তরুণও রাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে বড় রকমের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করে। সেখান থেকে বড় রকমের মুনাফা আসে দেশে ফ্রিল্যান্স কাজের মাধ্যমে।
সরেজমিন গত সপ্তাহের মঙ্গল ও বুধবার রাতে গুলিস্তান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কিছু কিছু জায়গায় তীব্র যানজট। সড়কের পাশে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ওঠানামার কাজ করছেন শ্রমিকরা। আর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়কে ব্যস্ত আগের চেয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য আসে রাতভর, দূরপাল্লার বাসগুলো শহর থেকে যাওয়া-আসা করছে বিভিন্ন গন্তব্যে। মালিবাগ আবুল হোটেলের সামনেও অনেক গার্মেন্ট রাতভর খোলা থাকে।
গুলশানেও অনেক রেস্তোরাঁ খোলা থাকতে দেখা যায়। মহাখালী এলাকায়ও গাড়ির চাপ থাকে চোখের পড়ার মতো। এর মধ্যে মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসসহ শহরের উন্নয়নকাজ চলতে দেখা যায় রাতের বেলায়। আর উত্তরবঙ্গের যাত্রার প্রবেশপথ গাবতলী এলাকায় গাড়ির চাপ দেখা যায়। শহর পরিষ্কার করতে দেখা যায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। এ ছাড়া রাতে আগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বেশি দেখা যায়। রাজধানীর প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে জোরালো তৎপর দেখা যায় পুলিশের।
গত বুধবার রাত ১২টার পর পান্থপথ এলাকায় কথা হয় এক চা দোকানের মালিকের সঙ্গে। ‘স্মার্ট চা বিক্রেতা’ নামে বেশ পরিচিত মো. হান্নান নামে এ ব্যক্তির। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই এলাকায় রাত যত বাড়ে, আমার বেচাবিক্রি তত বাড়তে থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এ দোকানে আসে চা খেতে। অনেকে চলার পথে একটু বিরতি নেয় এ দোকানের সামনে। তাছাড়া রাতে বেচাকেনা করতে বেশ ভালো লাগে।’
কারওয়ান বাজারের ডিম ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমাদের এ আড়তে ডিমের চালান আসে। প্রতিরাতেই আমাদের ব্যস্ততা থাকে। রাজধানীর খুচরা দোকানদার বা যারা দোকানে দোকানে সরবরাহ করে, তারা আমাদের কাছ থেকে ডিম নিয়ে যায়। রাতভরই বেচাকেনা হয়।’
একইদিন রাতে কথা হয় মো. জামান নামে এক উবার চালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা মুগদা এলাকায়। নিজের ব্যক্তিগত একটি প্রাইভেট কার আছে। দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে অনেক যানজট থাকে। তাই রাত ১২টার পর গাড়ি নিয়ে বের হই। এ সময় গাড়ি চালাতে বেশ ভালো লাগে। তাছাড়া রাতের বেশিরভাগ যাত্রী উবার সেবায় ভরসা করে।’ সব খরচ বাদ দিয়ে ২ হাজার মতো টাকা থাকে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর কুড়িল এলাকায় রংপুর থেকে আসা দুলাল মিয়া নামে এক ট্রাকচালক বলেন, ‘রাত ১২টার আগে শহরে প্রবেশ করা যায় না। তাই রংপুর থেকে এসে অপেক্ষা করছি। রাত ১২টার পর শহরে প্রবেশ করব। তবে রাতে কিছু জায়গায় ট্রাক থামিয়ে কেউ কেউ চাঁদা তোলে। এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। গাড়ির গতি স্বাভাবিকই থাকে।’
রাতের সড়কে কিছু জায়গায় আবাসিক এলাকার স্থানীয় লোকজন ভেতরের প্রবেশ গেট বন্ধ করায় কিছুটা বেগ পেতে হয় বলে জানান রাজধানীর মহানগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. রায়হান। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়িক কাজে অনেক সময় রাত করে বাসায় ফিরতে হয়। তাছাড়া আমাদের শহর আর আগের মতো নেই। এখন দিনে-রাতে সবসময় ব্যস্ত থাকে শহর। সে হিসাবে এভাবে বন্ধ করার কোনো মানে হয় না।’ প্রয়োজনে এলাকায়গুলোতে সিকিউরিটি বাড়িয়ে গেট খুলে রাখার দাবি জানান তিনি।
রাত যত বাড়ে পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে ভোজনরসিকদের আড্ডা বাড়তে দেখা যায়। ‘হানিফ বিরিয়ানি’র বিক্রেতা মো. শাকিল জানান, এই এলাকায় রাত ১২টার পর লোকজন আসে। দিনের বেলা থেকেও বেশি। শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন আসে। যে কারণে নাজিরাবাজার দিনে-রাতে সবসময় ব্যস্ত থাকে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ইকার সঙ্গে কথা হয় নাজিরাবাজারে। তিনি বলেন, ‘এখন রাতে ঘুরতে বেশ ভালো লাগে। একটা সময় ছিল রাতে বের হওয়া যেত না। নীরব থাকত চারপাশ। কিন্তু সেই ঢাকা আর আজকের ঢাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখন ঢাকা ক্যাপিটাল সিটিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। যার ফলে দিনের বেলার মতো রাতে পুরো শহর ঘোরা যায়। আর এতে করে আমাদের সিটি অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি সমৃদ্ধ হচ্ছে।’ নাজিরাবাজার সবসময় জেগে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসলাম খাবারের খোঁজে।’
রাত ১টার পর গণপরিবহন খুব একটা দেখা যায় না। ফলে রাতে চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত পরিহনের পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত যানের দাপট থাকে। মো. রাজু নামে এক চালক বলেন, ‘দিনের বেলায় রোদে গাড়ি চালাতে ভালো লাগে না। তাই রাত ১২টার পর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বের হই। ছয় ঘণ্টা চালালে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় হয়। দিনের বেলায় এত আয় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
রাত ২টার পর গুলশান গুদারাঘাট এলাকায় মাহাবুব ও আকাশ নামে দুজন পথচারীর সঙ্গে দেখা হয়। তারা বলেন, সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। একটা সময় ছিল রাতে এভাবে রাস্তায় হাঁটা যেত না। এখন আর আগের মতো নেই শহর। রাতের বেলায়ও চারপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকেন। তাই গ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে গভীর রাত হলেও সমস্যা নেই।
গত ১২ আগস্ট গুলিস্তান মাজারের সামনে পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাবেয়াকে (৪০) কাজ করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, দিনের আলো ফোটার আগেই শহর পরিষ্কারের কাজ শেষ হয়ে যায়। একটা সময় সকাল বেলায় এ কাজ করলেও এখন রাত ১২টায় শুরু হয়ে যায়। তাই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাতে অনেক ব্যস্ততা থাকেন। আর রাতের এ সময়টায় কাজ করতে ভালো লাগে বলে জানান তিনি।
পূর্বাচলে ভূঁইয়া হোটেলের ম্যানেজার সজীব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের হোটেল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বেশি চলে। কারণ শহরে প্রবেশের আগে এই এলাকায় ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ট্রাকচালক ও তাদের সহকারীরা এ হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেন। তাছাড়া অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে রাতের বেলায় এ হোটেলে খেতে আসেন।’ তিনি জানান, রাতের বেলা ব্যবসা ভালোই চলে।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল করীম বলেন, ‘আমাদের ঢাকা সিটি এখন ২৪ ঘণ্টার নগরীতে রূপান্তর হয়েছে। যার সুফল ভোগ করছি আমাদের বাদামতলী এলাকার ব্যবসায়ীরা। রাতভর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফলের গাড়ি আসে। সেগুলো কেন্দ্র করে রাতভর ব্যস্ত থাকেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। সমিতির পক্ষ থেকে দিনের বেলার মতো রাতের বেলায়ও ভালোভাবে মনিটরিং করার জন্য লোকজন রাখা হয়েছে।’
দিনভর ব্যস্ত ঢাকা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই এ শহরের কিছু এলাকা জেগে ওঠে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর বেড়িবাঁধসংলগ্ন পাইকারি কাঁচাবাজার, গাবতলী, পুরনো ঢাকার বাবুবাজার, নাজিরাবাজার, সদরঘাট, সায়েদাবাদ, মহাখালীসহ বেশ কিছু এলাকায় রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়। ঢাকার রাতের অর্থনীতি মূলত এসব এলাকা কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়।
কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন মেগাসিটির রাত্রিকালীন অর্থনীতির যে চিত্র তা থেকে অনেক দূরে রয়েছে ঢাকা। আর এ দূরত্ব যে শুধু উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে হয়েছে তা নয়, এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি, সরকারি নীতি, লিকার নীতি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে একটি শহরের রাত্রিকালীন অর্থনীতি। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসবই শহুরে রাত্রিকালীন অর্থনীতির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার পর রাজধানী ঢাকায় প্রায় সব দোকানপাট রাত ৮টার পর বন্ধ করে দিতে হয়। রাত ১২টার পর কোনো নাগরিক রাস্তায় বের হলে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হয়। সুযোগ-সুবিধা ও নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণে রাজধানী ঢাকার রাত্রিকালীন অর্থনীতি শুধু পণ্যের পাইকারি বাজারকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকো, বার্লিন, আমস্টারডাম, প্যারিস, মাদ্রিদ, সিডনিসহ বিশ্বের যেসব শহর ২৪ ঘণ্টা সচল থাকে, সেসব শহরে রাতের অর্থনীতির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নাইট ক্লাব, ক্যাফে, বার, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, পেশাদার পরিষেবা খাত, যা মূলত সেবা খাত হিসেবে চিহ্নিত। এগুলোই মেগাসিটিগুলোর রাতের অর্থনীতির প্রাণ।
বিশ্বব্যাপী শুধু ক্যাফে, বার এবং নাইট ক্লাব নয়, যা রাতের অর্থনীতি তৈরি করে। একটি সক্রিয় নাইটলাইফের শহরে পাব ও রেস্তোরাঁয় যাওয়া ছাড়াও, আতিথেয়তা খাতকে পরিপূরক করার জন্য বিস্তৃত কার্যক্রম বিদ্যমান। এর প্রভাবে রাজস্ব বাড়ে এবং কর্মসংস্থান তৈরি হয়। লন্ডনের মেয়রের অফিসের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সালে শহরে কর্মরতদের এক-তৃতীয়াংশ বা প্রায় প্রায় ১৬ লাখ মানুষ রাতে কাজ করেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৯১ হাজার স্বাস্থ্যে, ১ লাখ ৭৮ হাজার পেশাদার পরিষেবাগুলোতে এবং আতিথেয়তা খাতে ১ লাখ ৬৮ হাজার জন নিযুক্ত ছিল। এ ছাড়া পরিবহন, অটোমেটিভ, তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট লোকজনও রাতে কাজ করে। যুক্তরাজ্যের নাইট টাইম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের একটি সমীক্ষা অনুসারে, করোনা মহামারী শুরুর আগে যুক্তরাজ্যের মোট রাত্রিকালীন অর্থনীতির আকার ছিল ১১২ বিলিয়ন পাউন্ড, যা দেশটির জিডিপির প্রায় ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
আমস্টারডামের সাবেক নাইট মেয়র মিরিক মিলান একবার বলেছিলেন, রাতের সংস্কৃতি একটি শহরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের রাতের সংস্কৃতি একটু আলাদা। অর্থনীতির যে অংশগুলো রাতে কাজ করতে পারে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে যথেষ্ট মূল্য যোগ করতে পারে, তা না হওয়ার কারণ দেশের মেগাসিটির লোকেরা রাতে ঘুমাতে চলে যায়। তবে দেশে এমন কিছু পকেট রয়েছে, যেখানে রাতের অর্থনীতি একটি বিকশিত ঘটনা।
সেই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের অর্থনীতিও লাভবান হবে যদি দেশের শহরগুলোতে একটি কাঠামোগত রাত্রিকালীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি শপিং সেক্টরের জন্য একটি রাত্রিকালীন নীতি করা যায়, তাহলে রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা এবং ব্যবস্থাপক পদে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ কাজের সুযোগ বাড়তে পারে। এতে করে সংশ্লিষ্ট খাতে একই হারে রাজস্ব বাড়বে।
তবে রাজধানী ঢাকার রাত্রিকালীন অর্থনীতি কারওয়ান বাজার, সায়েদাবাদ, গাবতলীসহ পুরনো ঢাকার কিছু এলাকা ও বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঘিরে পরিচালিত হচ্ছে। ১৮০০ শতাব্দীর শেষের দিকে যাত্রা শুরু হওয়া কারওয়ান বাজার এলাকায় রাত ১০ থেকে ১২টার পর থেকেই বড় বড় ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে প্রায় সবরকমের শাকসবজি ও পেঁয়াজ-রসুনের মতো নিত্যপণ্য আসতে শুরু করে। এ বাজার কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে। তবে এখানে আয়-রোজগারের সঙ্গে সঙ্গে নানারকম দুর্ভোগও রয়েছে। নামে-বেনামে চাঁদার কারণে এ বাজারের পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর।
কারওয়ান বাজারকে কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। রাজধানীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাইকারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি খুচরা ব্যবসায়ীদের রুটি-রুজির ভরসা এই বাজার। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, লাউশাক, পুঁইশাক, লাউ, করলা, গাজর, টমেটো, কলাসহ সব ধরনের সবজির পাইকারির বড় বাজার কারওয়ান বাজার।
জানতে চাইলে কারওয়ান বাজার কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের (আড়ত ভবন নিচতলা) সাধারণ সম্পাদক সুজন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে কারওয়ান বাজার। শুধু প্রতিবছর আড়ত ভবন নিচতলার কাঁচাবাজারে হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়। এ ছাড়া এখানে আরও দুটি কাঁচাবাজার মার্কেট, ফুটপাত ও অস্থায়ী আড়ত ব্যবসা রয়েছে। সেগুলোর বিষয় সঠিকভাবে বলা না গেলে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়। এ বাজারের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কৃষক, মিনতি, লেবার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ীসহ আরও কয়েক শ্রেণি-পেশার মানুষ।’
শুধু কারওয়ান বাজার নয়, পুরনো ঢাকার বাবুবাজার, শ্যামবাজার, বাদামতলীসহ রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে দিনের ২৪ ঘণ্টা জুড়ে। এসব ব্যবসায়িক কেন্দ্র শুধু ঢাকাবাসীর চাহিদাই মেটাচ্ছে না বরং রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোর মানুষও অনেকাংশে নির্ভরশীল। মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরের খুচরা ব্যবসায়ীরা এসব ব্যবসা কেন্দ্র থেকে পণ্য কিনে স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছেন।
মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা পাইকারি ক্রেতা ইদ্রিস মোল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে ধরনের পণ্য পাইকারি ক্রেতাদের চাহিদা থাকে, তা পাওয়ার অন্যতম ভরসার জায়গা কারওয়ান বাজার। মৌসুম অনুসারে অনেক কিছুই অনেক জায়গায় পাওয়া যায় না। তবে কারওয়ান বাজার থেকে যত দামে পণ্য কিনতে পারি, বাজার থেকে বের হতেই বাড়তি আরও দেড় হাজার টাকা এখানে-ওখানে বিভিন্ন নামের চাঁদা দিতে হয়।’
রাজধানীর গাবতলীতে ২৪ ঘণ্টা সচল থাকে মূলত নির্মাণসামগ্রীর উপকরণ কেনাবেচায়। তবে অর্থের লেনদেন দিনের বেলায় হলেও পণ্য পরিবহন হয় রাতে। পুরো রাতের বেলায় এখান থেকে পাথর, ইট, বালু রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
গাবতলীর পাথর ব্যবসায়ী জিহান আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা কেন্দ্র করে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ব্যবসায়িক এ হাবটি ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকলেও বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে পণ্য পরিবহনের কাজটি শুধু রাতে করতে হয়।’
রাজধানীর রাতে অর্থনীতিতে আরও একটি বড় হাব রয়েছে। সেটি হলো রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ঘিরে। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার, চানখাঁরপুলসহ বেশ কিছু এলাকায় প্রায় সারা রাত খাবারের দোকানগুলো খোলা থাকে। নাজিরাবাজারে বিখ্যাত খাবার হলো হাজীর বিরিয়ানি। এ ছাড়া আছে হানিফ বিরিয়ানি, মামুন বিরিয়ানি, ভাই ভাই বিরিয়ানি হাউস, মদিনা বিরিয়ানি হাউস, বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর, মক্কা বিরিয়ানি হাউস, বোখারী কড়াই রেস্তোরাঁ। আগুনপান পাওয়া যায় নাজিরাবাজারে।
চানখাঁরপুল এলাকায় প্রায় সারা রাত খাবার দোকানগুলো জমজমাট থাকে। এখানকার নান্নার শাহি মোরগ পোলাও, মামুন বিরিয়ানি হাউস, নীরব হোটেলের মতো বিখ্যাত দোকানগুলো থাকে জমজমাট। তবে অভিযোগ আছে, রাত বাড়লেই পুলিশের হয়রানির শিকার হন এসব এলাকায় ঘুরতে আসা গ্রাহকরা।
পুরান ঢাকাসহ বেশ কিছু এলাকার বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে রাতের ব্যস্ততা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে মূল রাজধানীকে কেন্দ্র করে এ ব্যস্ততা এখন অনেক বেশি। নানা প্রয়োজন কিংবা বিনোদনেও এখন রাতে বের হতে আগ্রহী নগরবাসী। ব্যবসায়িক প্রয়োজন ছাড়াও সারা দিনের যানজটে পূর্ণ কর্মব্যস্ত নগরীতে একটু স্বস্তির প্রত্যাশায় অনেকেই বের হন রাতে। তবে ব্যবসা কিংবা অন্য প্রয়োজনে রাতের ঢাকায় চলাচলে সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার অস্বস্তি কিন্তু থাকছে। এসব মিটিয়ে ঢাকাকে নিরাপদভাবে ২৪ ঘণ্টার নগরীতে রূপ দিলে ত্বরান্বিত হবে ঢাকার নানা কর্মযজ্ঞ। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় বেশি জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ে রাজধানীতে প্রবেশের পরও পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়। চাঁদা না দিলে নানাভাবে তাদের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের অবগত করা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, এ বিষয়ে তারা সক্রিয় রয়েছে। চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে তারা আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সরকারের অন্য সংস্থার মদদে যদি কেউ তাদের হয়রানি করা হয় তাহলে সে দায় পুলিশের নয়। আর যদি কেউ সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে, তাহলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে নানা প্রয়োজনে রাতে বের হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে নগরবাসীর। তবে বাইরে বের হতেই পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে পড়ে হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য পুলিশে বলছে, নিরাপত্তার প্রয়োজনে সন্দেহজনক মনে হলে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে। পুলিশের কোনো সদস্য যদি এ অজুহাতে কাউকে হয়রানি করে, তাহলে অভিযোগ জানালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে ঢাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় রাতে চলাচল অনেকটা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। ভোরে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার পেছনে পুলিশের টহল দলের সক্রিয় না থাকার অভিযোগ রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহর ২৪ ঘণ্টা কর্মব্যস্ত থাকে। দিনের বেলায় যেমন অফিসে সবাই ব্যস্ত থাকে, রাতের ঢাকায় ব্যাপক হারে ট্রাক ঢোকে। কাঁচা বাজারে বিভিন্ন পণ্য যারা বিক্রি করেন, সেখানে বাজার খুবই সক্রিয় থাকে। যারা রাতের বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে বাইরে থেকে আসেন, তারা যখন গভীর রাতে চলাচল করেন তখন অপরাধীদের ফাঁদে পড়েন। এসব বিষয় বিবেচনায় বিট পুলিশ ও থানা পুলিশকে রাজধানীর অপরাধ দমনে সবসময় নির্দেশনা দেওয়া হয়। দিনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকে। তবে অপরাধীরা স্বভাবতই রাতে বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। সেই বিবেচনায় রাতের নিরাপত্তায় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়। বর্তমানে টহল, ফুট প্যাট্রলিং ও সাদা পোশাকে সদস্যদের বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়া গুরুত্ব বিবেচনায় বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে গোয়েন্দা কার্যক্রমও।
এ ছাড়া রাতের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পণ্যবাহী ও দূরপাল্লার পরিবহনের জট লেগে থাকতে দেখা যায়। নিয়ম না মেনেই রাত ১০টার আগেই বহু মালবাহী পরিবহন ঢাকায় প্রবেশ করে। এসব পরিবহন চলাচল আগের তুলনায় বেড়েছে। রাজধানীর গুলিস্তানসহ বিভিন্ন এলাকায় গভীর রাতেও জট লেগে থাকতে দেখা যায়। মূলত ওই সময়ে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের সক্রিয় থাকতে দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় পরিবহন ও সড়ক বেড়ে যাওয়ার পরও সে তুলনায় জনবল না বাড়ানোয় এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে এটি নিয়ন্ত্রণে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতা জাহাঙ্গীর আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রতিদিন রাতে নামে-বেনামে চাঁদা নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে সিদ্দিকবাজার, গুলিস্তান, জয়কালী মন্দির, যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ, দোলাইরপাড় এবং ধোলাইখালসহ বিভিন্ন স্থান। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী মোড়ে ফ্লাইওভারের নিচে টোলের নামে টাকা নেওয়া হয়। চাঁদা দিতে না চাইলে গাড়ির চালক ও শ্রমিকদের শারীরিকভাবে নির্যাতন এবং গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।’
মালিক সমিতির এ নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘এ পয়েন্টগুলো ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হয়রানির শিকার হতে হয়। আমাদের মালবাহী গাড়িগুলো বিভিন্ন এলাকায় মাল নামাতে গেলে টহল পুলিশ এসে টাকা চায়। না দিলে নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা করে। এ ছাড়া সকালে বিভিন্ন এলাকায় গাড়ির কাগজ দেখার কথা বলে আটকে রেখে সময়ক্ষেপণ করে, পরে নির্ধারিত সময় পার হলে জরিমানা গুনতে হয় আমাদের। এসব বিষয়ে পুলিশকে আমরা জানানোর পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। রাতে আমাদের এ পরিবহন সেবা অব্যাহত রাখতে পুলিশের সহযোগিতা ও সমন্বয় প্রয়োজন।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মো. জাফর হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবহন মালিকরা আমাদের তাদের সমস্যার কথা জানালে আমরা সে অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করব। এ ছাড়া পরিবহনে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে আমরা অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করি। কিছুদিন আগেও আমরা এমন অভিযোগে চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তার করেছি। আর পুলিশের কোনো সদস্য যদি হয়রানি করে কিংবা টাকা নেয়, তাহলে আমাদের কাছে এসে সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ জানাতে হবে। তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারব।’
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকায় আগের তুলনায় পরিবহন বেড়েছে, সে অনুযায়ী আমাদের সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। তারা বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে কাজ করছে। রাতে বিভিন্ন এলাকায় যানজটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা রাতে পৃথকভাবে আমাদের সদস্যদের ওইসব এলাকার দায়িত্ব দিয়ে থাকি।’
চলতি বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা নতুন বছরের মধ্য জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এক দফা ঘোষণা করায় এক ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান সম্মতভাবেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির এক দফা দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। সরকারি ও বিরোধী দলের এ চাওয়া নিয়ে ভোটের আগে সেপ্টেম্বর মাসকে গুরুত্বপূর্ণ ধরে নিয়েই এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ মাস থেকে মাঠের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা এবং আরও সোচ্চার থাকার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের একটুও ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
এ ছাড়া এই মাসে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে দেশের বাইরে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এগুলো নিয়ে জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হবে রাজনীতির মাঠে। তাই এ মাসটি গুরুত্ব পাচ্ছে আওয়ামী লীগের কাছে। মাঠে সজাগ ও সতর্ক থাকতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি, বিএনপি-জামায়াত যৌথভাবে এখন আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাবে। সেটা করতে দেওয়া যাবে না বলেই এখন আর কোনো ছাড় দেবে আওয়ামী লীগ।
ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকায় সেপ্টেম্বরের প্রথম দুদিন দুটি বড় সমাবেশ করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। এর আগে গত জুলাই বিরোধীদের আন্দোলনের জবাবে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে ছিল আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীনদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের আয়োজনে ছাত্রসমাবেশ ও ২ সেপ্টেম্বর পুরনো বাণিজ্য মেলা মাঠে সুধী সমাবেশ। একইদিন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ উদ্বোধন করা হবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, মাসের শুরুতে বড় শোডাউন দিয়ে সরকারবিরোধী পক্ষকে হুঁশিয়ার করতে চায় আওয়ামী লীগ। মাসের দ্বিতীয় দিনও ঢাকায় বড় কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলটি জানান দিতে চেষ্টা করবে মাঠের শক্তিতে অপরাজেয় আওয়ামী লীগ। এ দুটি কর্মসূচিতে বক্তব্য দেবেন টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বিএনপিসহ আন্দোলনরত সব দলের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দেওয়া হবে ষড়যন্ত্র, জ্বালাও-পোড়াও বাংলাদেশে হবে না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির কর্মসূচি দেখে দেশের সাধারণ মানুষ ভীত থাকে। কখন কী হয় সেই আতঙ্ক দেখা দেয় শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন পর্যন্ত কোনো ধরনের অস্থিরতা, অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা আর দেখতে চায় না।’
দলের আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকার পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কারণ একটাই, মানুষকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখা।’
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা নানান চাপ সৃষ্টি করছে। এরই মধ্যে বিএনপিসহ বিরোধীরাও ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে। সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে বিএনপি লাগাতার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা আগেই দিয়েছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি যাতে মাঠ নিয়ন্ত্রণ বা জনসম্পৃক্ততা তৈরি করতে না পারে, সেজন্য মাসের প্রথম দুদিন ঢাকায় বৃহৎ জমায়েত করে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করবে জনগণ তাদের সঙ্গেই আছে, থাকবে। এতে করে সারা দেশের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হবেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজনৈতিক মহড়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতি জনগণ যে আস্থাশীল, সেই বার্তা দেশি-বিদেশি মহলে জানিয়ে দিতে চাই আমরা। মানুষ শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে চায় তার প্রমাণই দেখাতে চাই আগামীকাল (শনিবার) সুধী সমাবেশের মধ্য দিয়ে।’
১ সেপ্টেম্বর (আজ) ছাত্রলীগ যে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে, সেটি মূলত ৩১ আগস্টই হতো সবসময়ই। কিন্তু এবারই তা এক দিন পিছিয়ে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করা হচ্ছে। অবশ্য ছাত্রলীগ কারণ দেখিয়েছে, ৩১ আগস্ট বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত খোলা হওয়ায় তারা কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে শুক্রবার ছুটির দিনে করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেপ্টেম্বরে শক্তভাবে মাঠে নামার পরিকল্পনারই অংশ আজকের ছাত্র সমাবেশ। ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। একইদিন বিএনপিও ঢাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। ফলে উত্তাপ থাকবে আজও।
আজ বিকেল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র সমাবেশ সফল করার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং তাদের অধীনে থাকা বিভিন্ন ইউনিট দফায় দফায় বৈঠক করেছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সমাবেশে পাঁচ লাখের বেশি ছাত্র জমায়েত হবে। অন্যদিকে সাংগঠনিক ইউনিটগুলো থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
এ কর্মসূচি ঘিরে ছাত্রসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থীর বাইরেও যারা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতাকে ভালোবেসে এবং শেখ হাসিনার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দেওয়ার জন্য অনেকেই ছুটে আসবে।’
আগামীকাল শনিবার বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ওইদিন বিকেল ৩টায় পুরনো বাণিজ্য মেলা মাঠে সুধী সমাবেশ হবে। প্রথমদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের তত্ত্বাবধানে এ সুধী সমাবেশ করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা থেকে সরে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এ সমাবেশের আয়োজক হয়েছে। নির্বাচন এবং বিরোধীদের আন্দোলন কর্মসূচিকে মাথায় রেখে সুধী সমাবেশ ব্যাপক পরিসরে করতে চায় আওয়ামী লীগ। সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করে মাঠ দখলে রাখার তৃপ্তি পেতে চান নেতাকর্মীরা। এ সমাবেশে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে বলে জানা গেছে।
সুধী সমাবেশ সফল করতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ছাড়া ও দলটির সহযোগী সংগঠনগুলো আলাদা বর্ধিত সভা করছে। এরই মধ্যে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ আশপাশের জেলার নেতা ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে তৃণমূলের নিজ নিজ ইউনিট থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতাকর্মী আনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএ মান্নান কচি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস উন্নয়নের নতুন দিগন্তের উদ্বোধনে অনেকেই সাক্ষী হওয়ার জন্যই যাবেন। যেমন মেট্রোরেলের উদ্বোধনের দিনও গিয়েছিলেন। এ কারণে আলাদা উৎসাহ-উদ্দীপনাও আছে।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) সরকারের সঙ্গে না থাকার আভাস পাওয়া গেছে। চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলটি বিএনপির দিকে ঝুঁকছে। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত তারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যেতে পারে এবং পরিস্থিতি বুঝে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। জাতীয় পার্টির কয়েকজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত হয়নি।
জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এতদিন এই বিষয়টি দলের ভেতর চেয়ারম্যান জিএম কাদেরপন্থি কয়েকজন শীর্ষ নেতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু জিএম কাদের নিজে গত ৫ জুন ঢাকার নবাবগঞ্জে ঢাকা জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলনে প্রথম প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থাকার ঘোষণা দেন। সেখানে তিনি এমনও বলেন, দলীয় প্রতীক লাঙ্গল না থাকলেও তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরবেন না।
এরপর গত তিন মাসে জাতীয় পার্টির নির্বাচনী রাজনৈতিক কৌশল আরও কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে। তারা বুঝতে পারছেন, এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ সরকারের সঙ্গে জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব। তিনি কিছুতেই এবার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে চাচ্ছেন না। সে কারণেই বিএনপির দিকে ঝুঁকছে দলটি বলে ওই নেতারা জানান। গত এক সপ্তাহে বিএনপির দিকে জাতীয় পার্টির ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে বেশ গুঞ্জন ও আলোচনাও সামনে চলে আসে। বিষয়টি প্রথমে সামনে আনেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। গত ১৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, জিএম কাদের যেভাবে কথাবার্তা শুরু করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে তিনি বিএনপির সঙ্গে জোট করবেন। পরে গত রবিবার সিঙ্গাপুরে বিএনপির কিছু নেতার সঙ্গে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বৈঠকের গুঞ্জন শোনা যায়। পরে অবশ্য জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ ধরনের বৈঠকের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, চুন্নু সিঙ্গাপুরে যাননি। তিনি থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। এমনকি কাদেরপন্থি নেতাদের মধ্যেও এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন কয়েক নেতা।
এছাড়া জিএম কাদের ভারত থেকে ঘুরে আসার পর তার সফর ঘিরে এক ধরনের কৌতূহল আছে। এর মধ্যে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে চুন্নুর বৈঠকের গুঞ্জন। এ ছাড়া জিএম কাদের বনানীর কার্যালয়ে যাচ্ছেন। আর সম্মেলন করার জন্য রওশনপন্থিদের তৎপরতা চলছে আলাদাভাবে।
জানতে চাইলে দলটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রেসিডিয়াম সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জিএম কাদের বিএনপির দিকে ঝুঁকছেন, এটার সত্যতা ৭৫ শতাংশ। কারণ আওয়ামী লীগ কখনোই জাতীয় পার্টিকে ভালোভাবে মূল্যায়ন করেনি। ২০১৪ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে জিএম কাদের হতাশ ছিলেন। তিনি তার ঘনিষ্ঠদের বলতেন, দল সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে।
বিএনপির দিকে ঝোঁকার কারণ হিসেবে আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে রওশন এরশাদ উভয়পক্ষ দলকে কুক্ষিগত করতে চাইছে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে পরিচালনা করবে, পার্টির নিজস্ব অস্তিত্ব থাকবে না, এটা জিএম কাদের কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। অবশ্য রওশনপন্থিরা জিএম কাদেরের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন। তারা চাচ্ছেন, এবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করুক জাপা। এতে তাদের নির্বাচনে জিতে আসা সহজ হবে।
কিন্তু সরকার জিএম কাদেরকে ছাড়তে নারাজ বলে জানিয়েছেন রওশনপন্থি নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রওশনপন্থি এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশন এরশাদের একান্তে ১০ মিনিট কথা হয়েছে। ওই সাক্ষাতের বরাত দিয়ে রওশনপন্থি নেতারা জানান, জাপার ভবিষ্যৎ কমিটিতে সরকার জিএম কাদেরকে দেখতে চায়। এমনকি ইতিমধ্যেই আগামী নির্বাচনের জন্য রওশন প্রাথমিকভাবে ৪২টি আসনের তালিকা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে উপস্থাপন করেছেন। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে পরে আলোচনা করার কথা বলা হয়েছে। রওশন এরশাদকে এমনও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, আগামী নির্বাচন কঠিন হবে এবং নিজ যোগ্যতা বলে বিজয়ী হয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে বিজয়ী হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে কাজ করতে হবে।
অন্যদিকে, ভারতও রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ চায় না বলে দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন। তারা জানান, ভারত সফরকালে জিএম কাদেরকে দুটি বার্তা দেওয়া হয়েছে প্রথমত, রওশন এরশাদের সঙ্গে বিভক্তি তৈরি করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, মূল জায়গায় থেকে সরা যাবে না। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে।
তবে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি বিএনপির দিকে ঝুঁকেছে, এমন কিছু জানা নেই। আওয়ামী লীগের দিকেও ঝোঁকেনি। যে সব কথা শোনা যাচ্ছে, সেগুলো সব গুঞ্জন। তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে সিঙ্গাপুরে বৈঠক হয়েছে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ দলের কে কোথায় থাকেন, সেটা রেকর্ড থাকে। ফখরুল ইমাম দেশেই ছিলেন। মহাসচিব ব্যাংকক গেছেন। এটা নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না।’
এই প্রেসিডিয়াম সদস্য আরও বলেন, ‘বিভিন্ন টকশো, দূতাবাসের দাওয়াতে বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়। এর বাইরে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কারোর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নির্বাচন বা এ সংক্রান্ত কোনো মিটিং-সিটিং এখন পর্যন্ত হয়নি। এখনো আমরা ৩০০ আসনে নির্বাচনের ব্যাপারেই কথা বলছি। নির্বাচনে কার সঙ্গে জোট করব কি করব না, সেটা আমরা সেপ্টেম্বরের পরে ঘোষণা দেব। সর্বশেষ আমাদের প্রেসিডিয়াম বৈঠকে এটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন বলেন, ‘যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, সেসবের কিছু তো সত্যতা রয়েছেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন মানে জনগণের ভোট দিতে পারা। তার মানে এবারও একতরফা নির্বাচনের দিকেই যাচ্ছে সরকার। কতটুকু সফল হতে পারবে, সেটা তারা জানেন। জাতীয় পার্টির ভূমিকা এখন নীরব।’
বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টির নির্বাচনী কৌশল কেমন হবে জানতে চাইলে দলটির দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, প্রথমে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যাবে। পরবর্তী সময়ে জোটের দিকে যাবে। কিন্তু একেবারে যে বিএনপির কাছে সমর্পিত হবে, তেমন না। আওয়ামী লীগকে যেভাবে সব দিয়ে দিয়েছে, সে রকম না। পার্টির অস্তিত্ব ঠিক রাখবে। সেক্ষেত্রে রওশনের সঙ্গে সুবিধাবাদী অংশ যাবে। যারা শুধু সংসদ সদস্য হতে চান। আর কাদেরের সঙ্গে তৃণমূল থেকে উচ্চ পর্যায়ের সবাই থাকবেন।
তারা বলেন, সেক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচন কমিশন লাঙ্গল প্রতীক রওশন এরশাদকে দিয়ে দিতে পারে। জিএম কাদের সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন ৫ জুন নবাবগঞ্জের সম্মেলনে। তিনি বলেছেন, ‘যদি লাঙ্গল চলেও যায়, তারপরও আমরা সরকারের সঙ্গে থাকব না। সুবিধাবাদীদের কারণে দলকে গোছাতে পারিনি। তারা যদি চলে যায়, আমি একা হলেও লড়ব’।
জাতীয় পার্টির নেতাদের দাবি, নিজেদের সঙ্গে রাখার জন্য সরকার দলটিকে চাপের মধ্যে রেখেছে। রওশনকে দিয়ে ট্রাম্পকার্ড খেলছে। কারণ সরকার জানে জিএম কাদের তাদের নিয়ন্ত্রণ মানতে রাজি নন। এমনকি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে কয়েকজন নেতাকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন দলটির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের উদ্যোগে আজ রাজধানীর উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতে দুটি শান্তি সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটায় সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে যাত্রাবাড়ী মোড়সংলগ্ন শহীদ ফারুক সড়কে শান্তি সমাবেশ শুরু হবে।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুরুল আমিন রুহুল এমপির সভাপতিত্বে সমাবেশে কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা উপস্থিত থাকবেন।
বিকেল ৩টায় উত্তরা আজমপুর আমির কমপ্লেক্সের সামনে শুরু হবে আরেকটি শান্তি সমাবেশ। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের এ সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন।
এতে সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। সঞ্চালনা করবেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি।
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে চলতি বছর মে মাসে। গত শুক্রবার ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে দেশটি। নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করার ঘোষণার তিন দিন পার হলেও কারও নাম প্রকাশ হয়নি। তবে বিভিন্ন মহলে নানা দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের নামে আলোচনা এখন সর্বত্র।
কারা যুক্তরাষ্ট্রের এ ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন বা পড়তে যাচ্ছেন তা নিয়ে রাজনৈতিক, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, যেহেতু নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে এর লক্ষ্য নির্বাচনী ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারাই। তারাই ভিসানীতির আওতায় পড়বেন, এটাই স্পষ্ট।
তারা আরও বলেন, ভিসানীতি প্রয়োগের কথা জানালেও যুক্তরাষ্ট্র কারও নাম প্রকাশ করেনি। তবুও বলা যেতে পারে, কাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করবে পশ্চিমা এ প্রভাবশালী দেশটি।
এ ব্যক্তিরা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই একটা তালিকার বেশিরভাগ নামই চূড়ান্ত করে ফেলেছে। অল্পসংখ্যক বাকি থাকতে পারে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সেগুলোরও চূড়ান্ত করা হবে। যেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত প্রতিষ্ঠান, দপ্তর, অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা থাকতে পারেন।
বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে ধারণা পাওয়া গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির উদ্দেশ্যই যেহেতু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে, ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা যারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবেন তারাই ভিসানীতির আওতায় আসবেন। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও থাকতে পারেন। থাকতে পারেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, তারা যেকোনো দলের হতে পারেন। অল্পসংখ্যক ব্যবসায়ীও থাকতে পারেন।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন,‘ভিসানীতির বিষয়টি আমেরিকা প্রশাসন পরিষ্কার করে ঘোষণা না করলেও বুঝিয়ে দিয়েছে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারেন, এমন যে কেউ এ ভিসানীতির আওতায় পড়তে পারেন। যেমন রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাহী প্রশাসন, জুডিশিয়ারি অর্থাৎ যারাই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট থাকবেন, অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যাহত করবেন তারাই এর আওতায় আসবেন।’ তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের এর আওতায় পড়ার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, নির্বাচন ব্যাহত করার ছোট্ট সুযোগ তাদের হাতেও থাকে, তারা যদি জড়িত হন, ভিসানীতির আওতায় পড়বেন।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ভিসানীতির চেয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে নেগোশিয়েশন জরুরি। কে ভিসানীতির আওতায় পড়ল, কে পড়ল না এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঐক্য।’ তিনি বলেন, ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়ায় কারা রয়েছেন সেটা আমেরিকা প্রশাসন ঘোষণা না করলেও বোঝা খুব জটিল কিছু নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আমেরিকা যেহেতু ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে তাদের ভিসানীতি, ফলে পরিষ্কার হয়ে গেছে কারা পড়তে পারেন এর আওতায়। যারা নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, নিশ্চয়ই তারাই এর আওতায়।’
বিভিন্ন পর্যায়ের ও পেশার নিয়োজিত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক নেতারা ভিসানীতিকে তেমন আমলে না নিলেও বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভেতরে আমেরিকার ভিসানীতি ভীষণ ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে এর নানা কারণ জানা গেছে। এর মধ্যে বিদেশে টাকা পাচার, ব্যবসাবাণিজ্য, পরিবারের সদস্যদের বিদেশে থাকা এসব কারণে বেশি ভীতিতে ফেলেছে তাদের। আবার একটা অংশ বিদেশে কিছু না থাকলেও ভিসানীতির আওতায় পড়লে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার ভয় পাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করায় যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারেন এমন দুুশ্চিন্তা যেমন কারও কারও মনে ভর করেছে, তেমনি ভিসানীতিতে পড়ার সুযোগ নেই তারাও দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। কারণ এই শ্রেণির লোকজন মনে করছেন, কখনো যদি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান, তখন যদি ভিসা না হয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন এমন নামের তালিকাও চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। আরও অগ্রসর হয়ে কোনো কোনো মহল লম্বা তালিকা হাতে নিয়ে ঘুরছে। তবে এসব নামের তালিকার উৎস বা সূত্র নিশ্চিত নয় বলে কেউ কেউ বিষয়টি গুজব মনে করছেন। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের বাইরে প্রায় সবাই ভিসানীতি আতঙ্কে ভুগছেন।
একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিসানীতিকে জয়-পরাজয় হিসেবে প্রচার করে এলেও ভেতরে ভীতি সবারই রয়েছে। কারণ পশ্চিমা দেশে তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। ফলে রাজনীতির বাইরেও ব্যক্তিজীবনের প্রয়োজনে ভিসানীতি তাদের ওপর যদি প্রভাব ফেলে, সে আশঙ্কা তো আছেই।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব বিষয়ে আমি কথা বলি না। আমি একটাই কথা বলব, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ সে কাজই করছে।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘ভিসানীতি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি বলেন, গণতন্ত্রের বিষয়ে বলতে হলে আরও অনেক বিষয় রয়েছে। এ ভিসানীতি কারা লক্ষ্যবস্তু জানতে চাইলে ইনু বলেন, ‘এটি নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমাদের। তারাই বলতে পারবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারও পরামর্শে সরকার কোনো প্রতিষ্ঠান অদলবদল করবে না, পরিবর্তনও আনবে না।’
সৌরজগতের সবচেয়ে ভয়ংকর গ্রহাণু হিসেবে পরিচিত বেন্নু। প্রতি ছয় বছরে একবার করে এটি ঢুকে পড়ে পৃথিবীর কক্ষপথে। কখনো কখনো পৃথিবীর বিপজ্জনক দূরত্বেও চলে আসে। গবেষকদের আশঙ্কা, আগামী ২০০ বছরের মধ্যে সেটি আছড়ে পড়তে পারে পৃথিবীতে। তাই এই গ্রহাণু ঘিরে বিজ্ঞানীদের আগ্রহও ছিল তুমুল। গ্রহাণুটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তাই ২০১৬ সালে সেখানে পাঠানো হয়েছিল নাসার মহাকাশযান ওসিরিস রেক্সকে। সাত বছর পর গ্রহাণুর নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে গতকাল পৃথিবীতে ফিরেছে ওসিরিস রেক্স।
বিবিসি জানাচ্ছে, গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৫২ মিনিটে দেশটির উতাহ মরুভূমিতে সফলভাবে অবতরণ করে ওসিরিস রেক্স থেকে ছেড়ে দেওয়া ক্যাপসুলটি। অবতরণের সময় রাইফেলের বুলেটের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি গতিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে সেটি। প্রচণ্ড এই গতির কারণে শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বেন্নুর বুক থেকে তুলে আনা নমুনা নিয়ে নিরাপদেই সেটি পৃথিবীর মাটি ছুঁয়েছে।
বিবিসি বলছে, পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণের উৎস কী, বিজ্ঞানীদের সেই গভীরতম প্রশ্নের জবাব মিলতে পারে ওই নমুনা থেকে। অভিযানের সঙ্গে যুক্ত দান্তে লরেত্তা বলেন, ‘উপাদানগুলো পৃথিবী তৈরির আগের। তার মধ্যে কিছু নমুনা থাকতে পারে, যা এমনকি আমাদের সৌরজগতেরও আগের। পৃথিবী কীভাবে গঠিত হলো, কেন এটি প্রাণের বসবাসযোগ্য, আবহমণ্ডলের বায়ু বা মহাসাগরের পানি কোথা থেকে এলো এবং সর্বোপরি পৃথিবীর সব প্রাণ গঠনে প্রয়োজনীয় জৈব অণুর উৎস কী এসব জটিল প্রশ্নের জবাব খোঁজা হবে ওই নমুনা থেকে।
বিজ্ঞানীদের বিদ্যমান ধারণা হলো, প্রাণের জন্য সহায়ক উপাদানগুলোর অনেকই পৃথিবীর আদিকালের দিকে মহাকাশ থেকে ছুটে এসে আছড়ে পড়া গ্রহাণু থেকে পাওয়া। তার মধ্যে অনেকই হয়তো বেন্নুর মতো।
নাসা বেন্নু থেকে নমুনা সংগ্রহের অভিযান শুরু করে ২০১৬ সালে। ৫০০ মিটার চওড়া কাঠামোতে পৌঁছাতে ওসিরিসের লাগে দুই বছর। আরও দুই বছর লাগে নমুনা সংগ্রহের সঠিক স্থান বাছাই করতে। সাত বছরে যেতে-আসতে অনুসন্ধানযানটি ভ্রমণ করেছে ৭০০ কোটি কিলোমিটার পথ।
নাসার বরাতে বিবিসি জানাচ্ছে, নমুনা সংগ্রহের মুহূর্তটি ছিল চমকে দেওয়ার মতো। তিন মিটার দীর্ঘ হাতটি ওসিরিসের মাটিতে রাখতেই সেখানকার উপাদান তরল পদার্থের মতো ভাগ হয়ে যায়। কারণ বেন্নুতে সম্ভবত প্রচুর পানি রয়েছে। তা আছে এর খনিজ উপাদানের মধ্যে। এর পরিমাণ হতে পারে গ্রহাণুটির ওজনের ১০ শতাংশ।
এখন বিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখবেন এর বিভিন্ন ধরনের হাইড্রোজেন অণুর অনুপাত পৃথিবীর সাগরের পানির মতোই কি না। পৃথিবীর শুরুর দিকের অতি তাপের জন্য বেশির ভাগ পানিই শুকিয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এখন যদি দেখা যায়, বেন্নু ও পৃথিবীর পানির ধরন এক, তাহলে এ ধারণাটা জোরদার হবে যে পরবর্তীকালে এসে আছড়ে পড়া গ্রহাণুই পৃথিবীর পানির উৎস।
নাসার তথ্য বলছে, বেন্নুতে সম্ভবত এর ওজনের ৫ থেকে ১০ শতাংশ কার্বনও আছে। আর এ বিষয়টিও খুব কৌতূহলকর। জানা মতে, পৃথিবীর প্রাণ জৈব রাসায়নিক উপাদানে তৈরি। তাহলে কি নবীন পৃথিবীতে জীবনের জাগরণের জন্য পানির পাশাপাশি জটিল অণুও মহাকাশ থেকে আসতে হয়েছিল? বেন্নু হয়তো এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে অনেকটাই সাহায্য করবে।
মানুষ একসময় বেঁচে থাকার জন্য পশুপাখি শিকার করত। বহু পথ পাড়ি দিয়ে সেই শিকার মধ্যযুগে সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। বিশে্বর নামকরা শিকারিরা কেবল পশু শিকারই করেননি, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পক্ষেও কথা বলেন। লিখেছেন তৃষা বড়ুয়া
শিকারি এবং সংরক্ষণবাদী শব্দ দুটি একেবারেই বিপরীত। প্রথমটি বন্যপ্রাণী শিকার যারা করে, তাদের বলা হয় আর বন্যপ্রাণী থেকে শুরু করে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষাকারীরা সংরক্ষণবাদী। প্রথম দল প্রাণ সংহার করে আর পরের দল প্রাণরক্ষার কথা বলে। মজার বিষয় হলো, গত শতাব্দীতে প্রথম বিশে^র পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরা বিশ্বাস করা শুরু করেন, ন্যাচারাল ইকোসিস্টেম বা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে শিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিকার ও শিকারির অনুপাত নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে এমনটা সম্ভব। শিকার বা শিকারির প্রসঙ্গ এলে অবধারিতভাবে জিম করবেটের নাম আসবেই। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এই শিকারি ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের ঘন জঙ্গলে কয়েক ডজন মানুষখেকো বাঘ ও চিতাবাঘ শিকার করেছিলেন। তবে একই সঙ্গে এটাও মাথায় রাখা জরুরি, করবেট সংরক্ষণবাদীও ছিলেন। তার বন্দুক থেকে ছোড়া গুলি যেমন একদিকে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও তাদের আবাসস্থল ফুঁড়ে বের হতো, তেমনি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পক্ষেও তাকে কথা বলতে দেখা যায়। জিম করবেটের ক্ষেত্রে শিকারি ও সংরক্ষণবাদী শব্দ দুটি ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে না। তিনি এমন বেশ কয়েকটি বাঘ মেরেছিলেন, যেগুলো স্থানীয় গ্রামবাসীদের জখম করেছিল। বাঘের আক্রমণে কয়েকজনের প্রাণও যায়।
শিকারের গুরুত্ব
ইতিহাসবিদরা দীর্ঘদিন মনে করতেন, আমাদের আদি পূর্বপুরুষরা মৃত বা আহত প্রাণীর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতেন। পরে এই ধারণায় পরিবর্তন আসে। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হেনরি বান বলেন, ‘কমপক্ষে ২০ লাখ বছর ধরে মানুষ বড় প্রাণী শিকার করে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা শিকারের পদ্ধতি পরিবর্তন করে, যা জটিল থেকে জটিলতর হয়।’ প্রাচীন যুগের প্রাণীদের জীবাশ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অধ্যাপক বান আবিষ্কার করেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা বন্যপ্রাণী শিকার করতেন, সেগুলো কবে মারা যাবে বা অসুস্থ হবে, তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন না। শিকারের জন্য তারা সাধারণত বয়স্ক প্রাণী বাছাই করতেন। গাছে বসে প্রাণীদের একত্র হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন তারা। এরপর সেগুলোকে বর্শা দিয়ে আঘাত করা হতো। অধ্যাপক বানের আবিষ্কার মানবদেহের বিকাশ বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশেষ করে যুগের পর যুগ ধরে মানব মস্তিষ্ক যেভাবে বিবর্তিত হয়, তার সঙ্গে শিকারের সম্পর্ক নিরূপণ করা সহজ হয়। বান মনে করেন, মানুষ যখন শিকারের অস্ত্র বানানো শিখল, তখন সে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার তথা শক্তির সন্ধানও পেয়ে গেল। এর আগে মানুষ শক্তির জন্য শাকসবজি ও ফলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। দেহে প্রোটিন প্রবেশ করার পর মানুষের মস্তিষ্কের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে। অন্য জীবের চেয়ে মানব মস্তিষ্কের আকার বড় হতে থাকে। মার্কিন বিজ্ঞানলেখক রবার্ট আরড্রের মতে, আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাণী শিকারের তাড়না বর্শা ও কুড়ালের মতো অস্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে।
মানুষের শিকারের ধরনে পরিবর্তন বিশে^র নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাণীদের মধ্যেও প্রভাব ফেলে। ইসরায়েলের ইতিহাসবিদ ইয়ুভাল নোয়াহ হারারির মতে, মানবজাতির উৎপত্তি আফ্রিকা মহাদেশে। সেখানে তাদের একার বিবর্তন হয়, তা নয়। তাদের আশপাশের প্রাণীরাও একই সময়ে বিবর্তিত হয়। মানুষ যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ শিকারি হয়ে ওঠে, তেমনি শিকারির হাত থেকে বাঁচতে জীবজন্তুও নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করা শুরু করে। এসব কৌশলের একটি ছিল দৌড়ের গতিবৃদ্ধি। এ কারণে আফ্রিকার বড় প্রাণীরা আমাদের পূর্বপুরুষদের হাত থেকে কখনো কখনো পালিয়ে বাঁচতে পারলেও পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের প্রাণীদের দৌড়ানোর গতি বেশি না হওয়ায় শিকারির হাতে তাদের ধরা পড়তে বেশি সময় লাগত না।
প্রাণঘাতী অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা মানুষকে পাকা শিকারিতে পরিণত করে। প্রাচীন যুগে কেবল মানুষের কাছেই অস্ত্র থাকত, অন্য কোনো প্রাণী অস্ত্র তৈরি করতে পারত না এমনটা দীর্ঘদিন বিজ্ঞানীরা মনে করলেও সাম্প্রতিক সময়ে গবেষকরা এ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। ২০০৭ সালে গবেষকরা জানান, পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিরা লাঠি থেকে বর্শা বানাতে শিখেছিল। সেসব বর্শা দিয়ে তারা ছোট প্রাণী শিকার করত। মানুষের বাইরে অন্য প্রাণীও যে অস্ত্রের সাহায্যে শিকার করতে পারত, তা ওই প্রথম জানা যায়। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জিল প্রুয়েৎজ বলেন, ‘পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিরা হাত ও দাঁত দিয়ে গাছের ডাল ছিঁড়ত। এরপর তারা ডালগুলোর একদিক ধারালো করত। সেসব ডাল দিয়ে তারা দিনের বেলা গাছের গর্তে ঘুমিয়ে থাকা ছোট নিশাচর প্রাণীদের আঘাত করত।’
শুরু যেভাবে
বিশে্বর অনেক জায়গায় শিকারকে ধর্মীয় আচারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হয়। একটা সময়ে মনে করা হতো, শিকারে সফল হলে স্রষ্টার কৃপা পাওয়া সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন মিসরের কথা বলা যায়। প্রাচীন মিসরের চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্যে শিকার বারবার উঠে আসে, কারণ মিসরীয়রা মনে করত, এর মধ্য দিয়ে দেবতাদের সন্তুষ্ট করা যাবে। সামাজিক মর্যাদা ও কর্র্তৃত্বের সঙ্গে শিকারের সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। শিকারের ক্ষমতাকে বরাবরই সাহসিকতা, শক্তি ও দক্ষতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে শিকার ছিল বিশেষ অধিকার। ইউরোপে মধ্যযুগে অভিজাত শ্রেণির মানুষ শিকার করা উপভোগ করতেন। এটি ছিল তাদের কাছে অর্থ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম। শিকারে তারা একা যেতেন না। সঙ্গে থাকত ডজনখানেক কুকুর, ঘোড়া ও বাজপাখি। ১৫২০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ও ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের শিকারের কাহিনি হয়তো অনেকে জানেন। ইতিহাসের পাতায় ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা আছে। ওই সময় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ। দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৫২০ সালে ফ্রান্সের কেলে শহরের কাছে এক তৃণভূমিতে হেনরি ও ফ্রান্সিস শিকার অভিযানের পরিকল্পনা করেন। দুই রাজার সঙ্গে ছিলেন তাদের অমাত্যরা। তারাও রাজাদের সঙ্গে শিকার, তীর-ধনুক ছোড়া ও ঘোড়ার পিঠে চড়ে দৌড়ানোর প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। শিকারের সময় ফ্রান্সিস ও হেনরির মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করত। কে কয়টা প্রাণী শিকার করতে পারলেন, এ নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলত তাদের মধ্যে। শত্রুতা থাকলেও শিকার অভিযানের সময় দুজনের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা একসঙ্গে নৈশভোজ করতেন, নিজেদের তাঁবুতে আড্ডা দিতেন, যা শিকারের আগে কেউ কল্পনাই করতে পারতেন না। ফ্রান্সিস ও হেনরির শিকার অভিযান ইউরোপের অন্য দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশ্বের কূটনৈতিক ইতিহাসে ঘটনাটিকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ সেটি মধ্যযুগে ইউরোপের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল।
শিকারের উপনিবেশায়ন
সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিকারকে ব্যবহার করার রীতি সম্ভবত ঔপনিবেশিক ভারতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ২০১৮ সালে ইম্পেরিয়াল কালচার অ্যান্ড হান্টিং ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া বইয়ে লেখক বিজয়া রামাদাস মান্ডালা এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তার মতে, শিকার ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অপরিহার্য অংশ। ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণি এটিকে বিনোদন হিসেবে দেখত। এর মধ্য দিয়ে তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব বিস্তার করত। এ ছাড়া ভারতীয় রাজারা ব্রিটিশ প্রভুদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের লক্ষ্যে মাঝেমধ্যেই শিকারের আয়োজন করতেন। ঔপনিবেশিক আমলে বন্যপ্রাণী শিকার এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু বাঘই মেরেছিল ১ হাজার ৫৭৯টি। এক সময় মানুষ বেঁচে থাকার জন্য পশু শিকার করতে বাধ্য হতো। সেই শিকারই কালের বিবর্তনে মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীতে অবশ্য বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ শিকারকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
পরিবেশগত প্রভাব
যেসব দেশ শিকারকে অনুমোদন দিয়েছে, তাদের এই পদক্ষেপের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র থেকে সমস্যাবহুল প্রজাতিকে সরিয়ে ফেলা। উদাহরণ হিসেবে ১৯৩২ সালে অস্ট্রেলিয়ার কথা বলা যায়। ত্রিশের দশকে দেশটিতে ইমুর সংখ্যা হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। তারা দেদার কৃষকদের ফসল নষ্ট করা শুরু করলে অস্ট্রেলিয়া সরকার তাদের সংখ্যা হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেয়। ইমুদের আবাসস্থলে পাঠানো হয় একদল সেনা, যাদের কাজ মেশিনগানের সাহায্যে পাখিগুলোকে হত্যা করা। কাজে নেমে অল্প সময়ের মধ্যে সেনারা বুঝতে পারলেন, কাজটা যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল, ততটা সহজ নয়। ইমু বেশ চালাক ও দ্রুত গতিসম্পন্ন প্রাণী। তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া কঠিন। ওই অভিযান অচিরেই ব্যর্থ হয়। অভিযানের কমান্ডার মেজর গুইনিড মেরেডিথ বলেন, ‘আমাদের যদি এমন কোনো সৈন্যদল থাকত, যেখানে তাদের সহায়তায় নিয়োজিত রাখা হতো অনেক ইমু এবং সেগুলোর শরীরে বাঁধা থাকত বুলেট, তাহলে পৃথিবীর যেকোনো সেনাবাহিনীকে আমাদের ওই সৈন্যদল পরাজিত করতে পারত।’ অস্ট্রেলিয়া সরকার আজও তাদের নাজুক বাস্তুতন্ত্র থেকে ইমুদের নির্মূল করতে পারছে না এবং ক্ষেতে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সহ্য করে যাচ্ছে।
বন্যপ্রাণীর উৎপাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা ছাড়াও শিকারের আরও ইতিবাচক দিক আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিহাসবিদ জন মেকেঞ্জি ১৯৯৭ সালে তার দ্য এম্পায়ার অব নেচার বইয়ে লেখেন, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ‘মহান শ্বেতাঙ্গ শিকারির’ ধারণা রূপান্তরিত হয়ে ‘মহান শ্বেতাঙ্গ আলোকচিত্রীতে’ পরিণত হয়। জিম করবেটের মতো বিখ্যাত শিকারিদের ওই সময় পরিবেশ রক্ষার অগ্রদূত হিসেবে দেখা হতো। তারা জাতীয় পার্ক ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
বিশ্বের অনেক দেশে লাইসেন্স বিক্রির মাধ্যমে শিকারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। লাইসেন্স বিক্রির অর্থ প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণ ও গবেষণার কাজে ব্যয় করা হয়। যেমন জিম্বাবুয়ে। দেশটি শিকারের লাইসেন্স বিক্রি করে সেই অর্থ অবৈধ শিকার বন্ধের প্রচারণা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগে খরচ করে। এ ছাড়া কয়েকটি দেশে ট্রফি শিকারের (এক ধরনের শিকার যেখানে শিকার করা বন্যপ্রাণীদের ট্রফি হিসেবে প্রদর্শন করা হয়) চল আছে। এটিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার সফল কৌশল হিসেবে দেখা হয় কারণ দেশগুলো ট্রফি শিকারকে সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করে। এমনকি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডও এ ধরনের শিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ট্রফি শিকার সেসব দেশের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর, যেখানে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত প্রণোদনা বা আয় নেই।
১৯৯০ সালে নামিবিয়া সরকার স্থানীয় সম্প্রদায়ের হাতে নির্দিষ্ট বনাঞ্চলের মালিকানা ছেড়ে দেওয়ার আইন করে। এই আইন করার উদ্দেশ্য স্থানীয়রা বনাঞ্চলের মালিক হলে সেক্ষেত্রে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী শিকারের সময় তাদের মনে হতে পারে, তারা প্রতিবেশীর সম্পদে হাত দিচ্ছে। ওই আইনের ফলে নামিবিয়ায় অবৈধ শিকার কমে যায়। দেশটির ২০ শতাংশের বেশি বনাঞ্চল এখন স্থানীয়রা সংরক্ষণ করছে। এ ছাড়া ৪৪ শতাংশ বনাঞ্চল কোনো না কোনোভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের হাত থেকে রেহাই পায়। ১৯৯০ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের স্বার্থে ওই আইন প্রণয়নের পর নামিবিয়ায় বন্যপ্রাণীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’