
ব্যাটিং নিয়ে আশঙ্কাটাই সত্যি হলো। তামিম ইকবালের পর এশিয়া কাপ থেকে লিটন কুমার দাসকে ছিটকে দিয়েছিল অসুস্থতা। দুই নিয়মিত ওপেনারের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের গভীরতা নিয়ে শঙ্কাটা আসর শুরুর আগেই তৈরি হয়েছিল। নাঈম শেখ ও অভিষিক্ত তানজিদ হাসান তামিম গোড়াপত্তনের গুরু দায়িত্ব ঠিকঠাক পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। সাকিব, মুশফিকের মতো অভিজ্ঞরাও পারেননি হাল ধরতে। লেট অর্ডারে মিরাজ, মেহেদির ব্যাটও হাসেনি। তাই নাজমুল হোসেন শান্তর একার লড়াইয়ে দলের সংগ্রহ দেড়শ পেরোলেও বোলারদের জন্য যা যথেষ্ট ছিল না। ১৬৪ পুঁজি করে বাংলাদেশের বোলাররা ভালো বোলিংয়ে শুধু স্বাগতিকদের জয়টাই বিলম্বিত করেছে। তাসকিন, শরিফুল, সাকিবরা ৫ উইকেট তুলে নিলেও ৬৬ বল হাতে রেখেই ঠিকই জয়ের স্বস্তি পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। তাতে বাংলাদেশের তৈরি হয়েছে টানা দ্বিতীয়বার সুপার ফোরের আগে এশিয়া কাপ থেকে বিদায়ের আশঙ্কা। ৩ সেপ্টেম্বর লাহোরে আফগানিস্তানকে হারাতে না পারলে আরেকবার গ্রুপ পর্বে থামবে তাদের অভিযান।
অথচ স্বল্প পুঁজি নিয়েই বাংলাদেশের বোলাররা শুরুতে দেখিয়েছিল ম্যাচ বাঁচানোর স্বপ্ন। দিমুথ করুনারতেœকে বোল্ড করে বুনো উল্লাসে মেতেছিলেন তাসকিন আহমেদ। খানিক পর বাংলাদেশের সমর্থকদেরও ফের আনন্দের উপলক্ষ এনে দেন আরেক পেসার শরিফুল ইসলাম। তিনি ফেরান আরেক ওপেনার পাথুম নিশানকাকে। ১৫ রানে প্রতিপক্ষের যখন ২ উইকেট নেই, তখন সমর্থকদের মনে বড় আশার সঞ্চার হওয়া দোষের কী! এর মধ্যে সাকিব আল হাসান দারুণ এক ডেলিভারিতে উপড়ে ফেলেন অভিজ্ঞ কুশল মেন্ডিসের উইকেট। ৪৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা তখন অনেকটাই কোণঠাসা। তবে পুঁজি যখন মাত্র ১৬৪ রান, তখন এ নিয়ে আর কতক্ষণইবা লড়াই করা যায়? শুরুর এ চাপটা ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশের বোলাররা। তৃতীয় উইকেটে সাদিরা সামারাবিক্রমা ও চারিথ আসালাঙ্কা ৭৮ রানের জুটি গড়ে স্বাগতিকদের ভালোভাবেই ফিরিয়ে আনেন। এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে শ্রীলঙ্কা আরও দুই উইকেট হারালেও ৬২ রানে অপরাজিত থেকে তাদের স্বস্তির জয় এনে দেন আসালাঙ্কা।
অতীতে পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামের এ উইকেটে প্রথম ইনিংসে ৩০০ ছাড়ানো দলীয় সংগ্রহ আছে এক ডজন। এখানেই ২০১৮ সালে স্বাগতিকদের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা তুলেছিল ৩৬৩ রান। এই হিসাব বাদ দিন। এ মাঠে ওয়ানডেতে প্রথম ইনিংসে গড় দলীয় সংগ্রহ ২৪৮ রান। কাল বাংলাদেশ ওই রানটাও যদি তুলতে পারত তবে বোলাররা পেতেন চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো পুঁজি। হয়তো পাল্লেকেলে থেকে অনুপ্রেরণার এক জয় নিয়ে আজ পাকিস্তানের বিমানে চড়তে পারত বাংলাদেশ। সেটা হয়নি ব্যাটিং নিয়ে আগের শঙ্কাটা সত্যি হওয়ায়। টস জিতে ব্যাটিংয়ের শুরুটাই হয় নড়বড়ে। তামিম-লিটনের অনুপস্থিতিতে অভিষেকটা রাঙানো দূরে থাক, জুনিয়র তামিমের শুরুটা হয় রানের খাতা না খুলেই। বারবার পাওয়া সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার ধারাটা এ ম্যাচেও অব্যাহত রাখলেন অন্য ওপেনার নাঈম শেখ (২৩ বলে ১৬)। সাকিবও পারেননি শুরুর ধাক্কা সামলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে। ৫ রানে বাংলাদেশ অধিনায়ককে সাজঘরে ফিরিয়ে প্রতিপক্ষ শিবিরে বড় আঘাতটা হানেন তরুণ পেসার মাথিশা পাথিরানা। ৩৬ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর তাওহীদ হৃদয়কে নিয়ে অবশ্য নাজমুল হোসেন শান্ত শুরু করেছিলেন ইনিংস মেরামতের। তিনে নেমে এ বাঁহাতি ১২২ বলে ৭ চারে খেলেন ৮৯ রানের ইনিংস। তবে কিছুক্ষণ শান্তকে সঙ্গ দিয়ে হৃদয়ও ফিরেন ৪১ বলে ২০ রান করে। চতুর্থ উইকেটে তাদের দুজনের ৮০ বলে ৫৯ রানের জুটি অবশ্য বাংলাদেশের ইনিংস দেড়শ ছাড়াতে সহায়তা করে। এমন বিপর্যয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে অনেক ম্যাচেই নায়ক হয়েছেন অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম। তবে কাল তিনিও ব্যর্থ; ২২ বলে ১৩ রান করে হন পাথিরানার শিকার। লোয়ার অর্ডারে মেহেদী হাসান মিরাজ (৫) ও শেখ মেহেদি হাসানও (৬) পারেননি শান্তকে সঙ্গ দিতে। সতীর্থদের একের পর এক ফিরতে দেখে একটা সময় মনঃসংযোগ হারানো শান্তও ফিরেছেন দ্বিতীয় সেঞ্চুরির খুব কাছে পৌঁছে। অথচ এই শ্রীলঙ্কার বোলিং বিভাগ রীতিমতো কাঁপছিল চোটের হানায়। ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গাসহ শ্রীলঙ্কার প্রথম সারির বোলাররা ছিলেন না এ ম্যাচে। তাদের না থাকাটা অবশ্য বুঝতে দেননি তরুণ পাথিরানা। তার ৩২ রানে ৪ উইকেট শিকারে বাংলাদেশের ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৬৪ রানে, ৪২.৪ ওভারে।
গত কয়েক বছরে যে ফরম্যাটে বাংলাদেশ ভালো দল হিসেবে নাম কামিয়েছে, সেই ওয়ানডেতেই সুরটা যেন কেটে গেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত এ ফরম্যাটে বাংলাদেশের ইনিংস ২০০-এর নিচে শেষ হয়েছে ছয়বার। ২০২৩ সালেই হয়েছে চারবার। যার সর্বনিম্নটার সঙ্গে দেখা হলো গতকাল। শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় সারির বোলিংয়ের কাছেই এভাবে ধরাশায়ী হতে দেখে ৩ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের শক্তিশালী বোলিং সামলানো নিয়ে দুশ্চিন্তাটা বাড়তে শুরু করেছে।
ম্যাচ শেষে সাকিব অবশ্য দাবি করেছেন, এ উইকেট ৩০০ তোলার মতো নয়। এখানে আর ৫০ রান বেশি করলে তার বিশ্বাস জেতা সম্ভব ছিল। তিনি এককথায় মেনেই নিলেন, ১৬৪ করে কোনোভাবেই ম্যাচ জেতা যায় না, ‘এটা ৩০০ রানের উইকেট নয়। ২২০-২৩০ রান আমাদের জয়ের সুযোগ অনেকটা বাড়িয়ে দিত। দল হিসেবে ব্যাটিংটা আমাদের ভালো হয়নি। আমাদের পেসার ও স্পিনাররা অনেক দিন ধরেই নিজেদের কাজ ঠিকঠাক করছে। কিন্তু বোর্ডে যথেষ্ট রান নেই...।’ আফগান পরীক্ষার আগে মিলবে না খুব বেশি সময়। এর মধ্যেই নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
সেই গুছিয়ে ওঠার কাজটা গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ৩ সেপ্টেম্বর আফগানদের বিপক্ষে ঠিকঠাক না করতে পারলে বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের মনোবলটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা আগেভাগেই অনুমান করা যায়।
একসময় ঢাকায় সন্ধ্যা নামলেই শহর ঘুমিয়ে যেত। একবার বাসায় ঢুকলে বাসা থেকে অভিভাবকরা আর বের হতে দিতেন না। সেই সময় রাতে চলাচল করা ছিল একরকম আতঙ্ক। কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই শহর। দিনের মতো রাতের বেলায়ও জমজমাট। সন্ধ্যার সেই ঘুমন্ত শহর এখন ক্রমেই ২৪ ঘণ্টার নগরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
রাত যত বাড়ে, শহরের ব্যস্ততা ঠিক ততই বাড়তে থাকে। রাস্তায় থাকে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও ব্যাটারিচালিত যানের দাপট। এরই মধ্যে শহরে গড়ে ওঠা রাতের বাজারগুলো ও আশপাশে কর্মব্যস্ত হাজারো লোকের হাঁকডাক শোনা যায়। ভবন বা যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ ঘিরে ব্যস্ত থাকে আরও অনেক লোকজন। যদিও রাত ১টার পর খুব একটা গণপরিবহনের দেখা মেলে না। তবে বিকল্প বাহন ও অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবায় ভরসা করা যায় রাতের যাত্রায়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত, ঠাটারীবাজার, সোয়ারীঘাট মাছের বাজার, কারওয়ান বাজার, বাদামতলী ফলের বাজারে রাতভর ব্যস্ত থাকে। মূলত এ বাজারগুলো কেন্দ্র করে প্রতিরাতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। এ বাজারগুলো কেন্দ্র করে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ব্যবসায়িক কর্মকা- হয়। আর যার প্রভাব রাজধানী জুড়ে দেখা যায়। আর বসুন্ধরা কুড়িল এলাকায় রাতভর খোলা থাকে দোকানপাট। বসুন্ধরার ভেতরে আবাসিক এলাকায় দোকানপাট না থাকায় রাতে জরুরি জিনিসপত্রের চাহিদা মেটানোর জন্য মূলত এ দোকানগুলো খোলা থাকে। তবে অনেক তরুণও রাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে বড় রকমের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করে। সেখান থেকে বড় রকমের মুনাফা আসে দেশে ফ্রিল্যান্স কাজের মাধ্যমে।
সরেজমিন গত সপ্তাহের মঙ্গল ও বুধবার রাতে গুলিস্তান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কিছু কিছু জায়গায় তীব্র যানজট। সড়কের পাশে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ওঠানামার কাজ করছেন শ্রমিকরা। আর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়কে ব্যস্ত আগের চেয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য আসে রাতভর, দূরপাল্লার বাসগুলো শহর থেকে যাওয়া-আসা করছে বিভিন্ন গন্তব্যে। মালিবাগ আবুল হোটেলের সামনেও অনেক গার্মেন্ট রাতভর খোলা থাকে।
গুলশানেও অনেক রেস্তোরাঁ খোলা থাকতে দেখা যায়। মহাখালী এলাকায়ও গাড়ির চাপ থাকে চোখের পড়ার মতো। এর মধ্যে মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসসহ শহরের উন্নয়নকাজ চলতে দেখা যায় রাতের বেলায়। আর উত্তরবঙ্গের যাত্রার প্রবেশপথ গাবতলী এলাকায় গাড়ির চাপ দেখা যায়। শহর পরিষ্কার করতে দেখা যায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। এ ছাড়া রাতে আগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বেশি দেখা যায়। রাজধানীর প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে জোরালো তৎপর দেখা যায় পুলিশের।
গত বুধবার রাত ১২টার পর পান্থপথ এলাকায় কথা হয় এক চা দোকানের মালিকের সঙ্গে। ‘স্মার্ট চা বিক্রেতা’ নামে বেশ পরিচিত মো. হান্নান নামে এ ব্যক্তির। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই এলাকায় রাত যত বাড়ে, আমার বেচাবিক্রি তত বাড়তে থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এ দোকানে আসে চা খেতে। অনেকে চলার পথে একটু বিরতি নেয় এ দোকানের সামনে। তাছাড়া রাতে বেচাকেনা করতে বেশ ভালো লাগে।’
কারওয়ান বাজারের ডিম ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমাদের এ আড়তে ডিমের চালান আসে। প্রতিরাতেই আমাদের ব্যস্ততা থাকে। রাজধানীর খুচরা দোকানদার বা যারা দোকানে দোকানে সরবরাহ করে, তারা আমাদের কাছ থেকে ডিম নিয়ে যায়। রাতভরই বেচাকেনা হয়।’
একইদিন রাতে কথা হয় মো. জামান নামে এক উবার চালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা মুগদা এলাকায়। নিজের ব্যক্তিগত একটি প্রাইভেট কার আছে। দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে অনেক যানজট থাকে। তাই রাত ১২টার পর গাড়ি নিয়ে বের হই। এ সময় গাড়ি চালাতে বেশ ভালো লাগে। তাছাড়া রাতের বেশিরভাগ যাত্রী উবার সেবায় ভরসা করে।’ সব খরচ বাদ দিয়ে ২ হাজার মতো টাকা থাকে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর কুড়িল এলাকায় রংপুর থেকে আসা দুলাল মিয়া নামে এক ট্রাকচালক বলেন, ‘রাত ১২টার আগে শহরে প্রবেশ করা যায় না। তাই রংপুর থেকে এসে অপেক্ষা করছি। রাত ১২টার পর শহরে প্রবেশ করব। তবে রাতে কিছু জায়গায় ট্রাক থামিয়ে কেউ কেউ চাঁদা তোলে। এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। গাড়ির গতি স্বাভাবিকই থাকে।’
রাতের সড়কে কিছু জায়গায় আবাসিক এলাকার স্থানীয় লোকজন ভেতরের প্রবেশ গেট বন্ধ করায় কিছুটা বেগ পেতে হয় বলে জানান রাজধানীর মহানগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. রায়হান। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়িক কাজে অনেক সময় রাত করে বাসায় ফিরতে হয়। তাছাড়া আমাদের শহর আর আগের মতো নেই। এখন দিনে-রাতে সবসময় ব্যস্ত থাকে শহর। সে হিসাবে এভাবে বন্ধ করার কোনো মানে হয় না।’ প্রয়োজনে এলাকায়গুলোতে সিকিউরিটি বাড়িয়ে গেট খুলে রাখার দাবি জানান তিনি।
রাত যত বাড়ে পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে ভোজনরসিকদের আড্ডা বাড়তে দেখা যায়। ‘হানিফ বিরিয়ানি’র বিক্রেতা মো. শাকিল জানান, এই এলাকায় রাত ১২টার পর লোকজন আসে। দিনের বেলা থেকেও বেশি। শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন আসে। যে কারণে নাজিরাবাজার দিনে-রাতে সবসময় ব্যস্ত থাকে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ইকার সঙ্গে কথা হয় নাজিরাবাজারে। তিনি বলেন, ‘এখন রাতে ঘুরতে বেশ ভালো লাগে। একটা সময় ছিল রাতে বের হওয়া যেত না। নীরব থাকত চারপাশ। কিন্তু সেই ঢাকা আর আজকের ঢাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখন ঢাকা ক্যাপিটাল সিটিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। যার ফলে দিনের বেলার মতো রাতে পুরো শহর ঘোরা যায়। আর এতে করে আমাদের সিটি অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি সমৃদ্ধ হচ্ছে।’ নাজিরাবাজার সবসময় জেগে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসলাম খাবারের খোঁজে।’
রাত ১টার পর গণপরিবহন খুব একটা দেখা যায় না। ফলে রাতে চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত পরিহনের পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত যানের দাপট থাকে। মো. রাজু নামে এক চালক বলেন, ‘দিনের বেলায় রোদে গাড়ি চালাতে ভালো লাগে না। তাই রাত ১২টার পর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বের হই। ছয় ঘণ্টা চালালে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় হয়। দিনের বেলায় এত আয় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
রাত ২টার পর গুলশান গুদারাঘাট এলাকায় মাহাবুব ও আকাশ নামে দুজন পথচারীর সঙ্গে দেখা হয়। তারা বলেন, সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। একটা সময় ছিল রাতে এভাবে রাস্তায় হাঁটা যেত না। এখন আর আগের মতো নেই শহর। রাতের বেলায়ও চারপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকেন। তাই গ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে গভীর রাত হলেও সমস্যা নেই।
গত ১২ আগস্ট গুলিস্তান মাজারের সামনে পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাবেয়াকে (৪০) কাজ করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, দিনের আলো ফোটার আগেই শহর পরিষ্কারের কাজ শেষ হয়ে যায়। একটা সময় সকাল বেলায় এ কাজ করলেও এখন রাত ১২টায় শুরু হয়ে যায়। তাই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাতে অনেক ব্যস্ততা থাকেন। আর রাতের এ সময়টায় কাজ করতে ভালো লাগে বলে জানান তিনি।
পূর্বাচলে ভূঁইয়া হোটেলের ম্যানেজার সজীব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের হোটেল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বেশি চলে। কারণ শহরে প্রবেশের আগে এই এলাকায় ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ট্রাকচালক ও তাদের সহকারীরা এ হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেন। তাছাড়া অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে রাতের বেলায় এ হোটেলে খেতে আসেন।’ তিনি জানান, রাতের বেলা ব্যবসা ভালোই চলে।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল করীম বলেন, ‘আমাদের ঢাকা সিটি এখন ২৪ ঘণ্টার নগরীতে রূপান্তর হয়েছে। যার সুফল ভোগ করছি আমাদের বাদামতলী এলাকার ব্যবসায়ীরা। রাতভর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফলের গাড়ি আসে। সেগুলো কেন্দ্র করে রাতভর ব্যস্ত থাকেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। সমিতির পক্ষ থেকে দিনের বেলার মতো রাতের বেলায়ও ভালোভাবে মনিটরিং করার জন্য লোকজন রাখা হয়েছে।’
দিনভর ব্যস্ত ঢাকা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই এ শহরের কিছু এলাকা জেগে ওঠে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর বেড়িবাঁধসংলগ্ন পাইকারি কাঁচাবাজার, গাবতলী, পুরনো ঢাকার বাবুবাজার, নাজিরাবাজার, সদরঘাট, সায়েদাবাদ, মহাখালীসহ বেশ কিছু এলাকায় রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়। ঢাকার রাতের অর্থনীতি মূলত এসব এলাকা কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়।
কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন মেগাসিটির রাত্রিকালীন অর্থনীতির যে চিত্র তা থেকে অনেক দূরে রয়েছে ঢাকা। আর এ দূরত্ব যে শুধু উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে হয়েছে তা নয়, এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি, সরকারি নীতি, লিকার নীতি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে একটি শহরের রাত্রিকালীন অর্থনীতি। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসবই শহুরে রাত্রিকালীন অর্থনীতির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার পর রাজধানী ঢাকায় প্রায় সব দোকানপাট রাত ৮টার পর বন্ধ করে দিতে হয়। রাত ১২টার পর কোনো নাগরিক রাস্তায় বের হলে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হয়। সুযোগ-সুবিধা ও নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণে রাজধানী ঢাকার রাত্রিকালীন অর্থনীতি শুধু পণ্যের পাইকারি বাজারকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকো, বার্লিন, আমস্টারডাম, প্যারিস, মাদ্রিদ, সিডনিসহ বিশ্বের যেসব শহর ২৪ ঘণ্টা সচল থাকে, সেসব শহরে রাতের অর্থনীতির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নাইট ক্লাব, ক্যাফে, বার, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, পেশাদার পরিষেবা খাত, যা মূলত সেবা খাত হিসেবে চিহ্নিত। এগুলোই মেগাসিটিগুলোর রাতের অর্থনীতির প্রাণ।
বিশ্বব্যাপী শুধু ক্যাফে, বার এবং নাইট ক্লাব নয়, যা রাতের অর্থনীতি তৈরি করে। একটি সক্রিয় নাইটলাইফের শহরে পাব ও রেস্তোরাঁয় যাওয়া ছাড়াও, আতিথেয়তা খাতকে পরিপূরক করার জন্য বিস্তৃত কার্যক্রম বিদ্যমান। এর প্রভাবে রাজস্ব বাড়ে এবং কর্মসংস্থান তৈরি হয়। লন্ডনের মেয়রের অফিসের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সালে শহরে কর্মরতদের এক-তৃতীয়াংশ বা প্রায় প্রায় ১৬ লাখ মানুষ রাতে কাজ করেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৯১ হাজার স্বাস্থ্যে, ১ লাখ ৭৮ হাজার পেশাদার পরিষেবাগুলোতে এবং আতিথেয়তা খাতে ১ লাখ ৬৮ হাজার জন নিযুক্ত ছিল। এ ছাড়া পরিবহন, অটোমেটিভ, তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট লোকজনও রাতে কাজ করে। যুক্তরাজ্যের নাইট টাইম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের একটি সমীক্ষা অনুসারে, করোনা মহামারী শুরুর আগে যুক্তরাজ্যের মোট রাত্রিকালীন অর্থনীতির আকার ছিল ১১২ বিলিয়ন পাউন্ড, যা দেশটির জিডিপির প্রায় ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
আমস্টারডামের সাবেক নাইট মেয়র মিরিক মিলান একবার বলেছিলেন, রাতের সংস্কৃতি একটি শহরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের রাতের সংস্কৃতি একটু আলাদা। অর্থনীতির যে অংশগুলো রাতে কাজ করতে পারে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে যথেষ্ট মূল্য যোগ করতে পারে, তা না হওয়ার কারণ দেশের মেগাসিটির লোকেরা রাতে ঘুমাতে চলে যায়। তবে দেশে এমন কিছু পকেট রয়েছে, যেখানে রাতের অর্থনীতি একটি বিকশিত ঘটনা।
সেই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের অর্থনীতিও লাভবান হবে যদি দেশের শহরগুলোতে একটি কাঠামোগত রাত্রিকালীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি শপিং সেক্টরের জন্য একটি রাত্রিকালীন নীতি করা যায়, তাহলে রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা এবং ব্যবস্থাপক পদে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ কাজের সুযোগ বাড়তে পারে। এতে করে সংশ্লিষ্ট খাতে একই হারে রাজস্ব বাড়বে।
তবে রাজধানী ঢাকার রাত্রিকালীন অর্থনীতি কারওয়ান বাজার, সায়েদাবাদ, গাবতলীসহ পুরনো ঢাকার কিছু এলাকা ও বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঘিরে পরিচালিত হচ্ছে। ১৮০০ শতাব্দীর শেষের দিকে যাত্রা শুরু হওয়া কারওয়ান বাজার এলাকায় রাত ১০ থেকে ১২টার পর থেকেই বড় বড় ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে প্রায় সবরকমের শাকসবজি ও পেঁয়াজ-রসুনের মতো নিত্যপণ্য আসতে শুরু করে। এ বাজার কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে। তবে এখানে আয়-রোজগারের সঙ্গে সঙ্গে নানারকম দুর্ভোগও রয়েছে। নামে-বেনামে চাঁদার কারণে এ বাজারের পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর।
কারওয়ান বাজারকে কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। রাজধানীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাইকারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি খুচরা ব্যবসায়ীদের রুটি-রুজির ভরসা এই বাজার। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, লাউশাক, পুঁইশাক, লাউ, করলা, গাজর, টমেটো, কলাসহ সব ধরনের সবজির পাইকারির বড় বাজার কারওয়ান বাজার।
জানতে চাইলে কারওয়ান বাজার কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের (আড়ত ভবন নিচতলা) সাধারণ সম্পাদক সুজন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে কারওয়ান বাজার। শুধু প্রতিবছর আড়ত ভবন নিচতলার কাঁচাবাজারে হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়। এ ছাড়া এখানে আরও দুটি কাঁচাবাজার মার্কেট, ফুটপাত ও অস্থায়ী আড়ত ব্যবসা রয়েছে। সেগুলোর বিষয় সঠিকভাবে বলা না গেলে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়। এ বাজারের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কৃষক, মিনতি, লেবার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ীসহ আরও কয়েক শ্রেণি-পেশার মানুষ।’
শুধু কারওয়ান বাজার নয়, পুরনো ঢাকার বাবুবাজার, শ্যামবাজার, বাদামতলীসহ রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে দিনের ২৪ ঘণ্টা জুড়ে। এসব ব্যবসায়িক কেন্দ্র শুধু ঢাকাবাসীর চাহিদাই মেটাচ্ছে না বরং রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোর মানুষও অনেকাংশে নির্ভরশীল। মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরের খুচরা ব্যবসায়ীরা এসব ব্যবসা কেন্দ্র থেকে পণ্য কিনে স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছেন।
মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা পাইকারি ক্রেতা ইদ্রিস মোল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে ধরনের পণ্য পাইকারি ক্রেতাদের চাহিদা থাকে, তা পাওয়ার অন্যতম ভরসার জায়গা কারওয়ান বাজার। মৌসুম অনুসারে অনেক কিছুই অনেক জায়গায় পাওয়া যায় না। তবে কারওয়ান বাজার থেকে যত দামে পণ্য কিনতে পারি, বাজার থেকে বের হতেই বাড়তি আরও দেড় হাজার টাকা এখানে-ওখানে বিভিন্ন নামের চাঁদা দিতে হয়।’
রাজধানীর গাবতলীতে ২৪ ঘণ্টা সচল থাকে মূলত নির্মাণসামগ্রীর উপকরণ কেনাবেচায়। তবে অর্থের লেনদেন দিনের বেলায় হলেও পণ্য পরিবহন হয় রাতে। পুরো রাতের বেলায় এখান থেকে পাথর, ইট, বালু রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
গাবতলীর পাথর ব্যবসায়ী জিহান আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা কেন্দ্র করে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ব্যবসায়িক এ হাবটি ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকলেও বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে পণ্য পরিবহনের কাজটি শুধু রাতে করতে হয়।’
রাজধানীর রাতে অর্থনীতিতে আরও একটি বড় হাব রয়েছে। সেটি হলো রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ঘিরে। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার, চানখাঁরপুলসহ বেশ কিছু এলাকায় প্রায় সারা রাত খাবারের দোকানগুলো খোলা থাকে। নাজিরাবাজারে বিখ্যাত খাবার হলো হাজীর বিরিয়ানি। এ ছাড়া আছে হানিফ বিরিয়ানি, মামুন বিরিয়ানি, ভাই ভাই বিরিয়ানি হাউস, মদিনা বিরিয়ানি হাউস, বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর, মক্কা বিরিয়ানি হাউস, বোখারী কড়াই রেস্তোরাঁ। আগুনপান পাওয়া যায় নাজিরাবাজারে।
চানখাঁরপুল এলাকায় প্রায় সারা রাত খাবার দোকানগুলো জমজমাট থাকে। এখানকার নান্নার শাহি মোরগ পোলাও, মামুন বিরিয়ানি হাউস, নীরব হোটেলের মতো বিখ্যাত দোকানগুলো থাকে জমজমাট। তবে অভিযোগ আছে, রাত বাড়লেই পুলিশের হয়রানির শিকার হন এসব এলাকায় ঘুরতে আসা গ্রাহকরা।
পুরান ঢাকাসহ বেশ কিছু এলাকার বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে রাতের ব্যস্ততা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে মূল রাজধানীকে কেন্দ্র করে এ ব্যস্ততা এখন অনেক বেশি। নানা প্রয়োজন কিংবা বিনোদনেও এখন রাতে বের হতে আগ্রহী নগরবাসী। ব্যবসায়িক প্রয়োজন ছাড়াও সারা দিনের যানজটে পূর্ণ কর্মব্যস্ত নগরীতে একটু স্বস্তির প্রত্যাশায় অনেকেই বের হন রাতে। তবে ব্যবসা কিংবা অন্য প্রয়োজনে রাতের ঢাকায় চলাচলে সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার অস্বস্তি কিন্তু থাকছে। এসব মিটিয়ে ঢাকাকে নিরাপদভাবে ২৪ ঘণ্টার নগরীতে রূপ দিলে ত্বরান্বিত হবে ঢাকার নানা কর্মযজ্ঞ। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় বেশি জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ে রাজধানীতে প্রবেশের পরও পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়। চাঁদা না দিলে নানাভাবে তাদের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের অবগত করা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, এ বিষয়ে তারা সক্রিয় রয়েছে। চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে তারা আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সরকারের অন্য সংস্থার মদদে যদি কেউ তাদের হয়রানি করা হয় তাহলে সে দায় পুলিশের নয়। আর যদি কেউ সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে, তাহলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে নানা প্রয়োজনে রাতে বের হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে নগরবাসীর। তবে বাইরে বের হতেই পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে পড়ে হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য পুলিশে বলছে, নিরাপত্তার প্রয়োজনে সন্দেহজনক মনে হলে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে। পুলিশের কোনো সদস্য যদি এ অজুহাতে কাউকে হয়রানি করে, তাহলে অভিযোগ জানালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে ঢাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় রাতে চলাচল অনেকটা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। ভোরে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার পেছনে পুলিশের টহল দলের সক্রিয় না থাকার অভিযোগ রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহর ২৪ ঘণ্টা কর্মব্যস্ত থাকে। দিনের বেলায় যেমন অফিসে সবাই ব্যস্ত থাকে, রাতের ঢাকায় ব্যাপক হারে ট্রাক ঢোকে। কাঁচা বাজারে বিভিন্ন পণ্য যারা বিক্রি করেন, সেখানে বাজার খুবই সক্রিয় থাকে। যারা রাতের বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে বাইরে থেকে আসেন, তারা যখন গভীর রাতে চলাচল করেন তখন অপরাধীদের ফাঁদে পড়েন। এসব বিষয় বিবেচনায় বিট পুলিশ ও থানা পুলিশকে রাজধানীর অপরাধ দমনে সবসময় নির্দেশনা দেওয়া হয়। দিনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকে। তবে অপরাধীরা স্বভাবতই রাতে বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। সেই বিবেচনায় রাতের নিরাপত্তায় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়। বর্তমানে টহল, ফুট প্যাট্রলিং ও সাদা পোশাকে সদস্যদের বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়া গুরুত্ব বিবেচনায় বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে গোয়েন্দা কার্যক্রমও।
এ ছাড়া রাতের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পণ্যবাহী ও দূরপাল্লার পরিবহনের জট লেগে থাকতে দেখা যায়। নিয়ম না মেনেই রাত ১০টার আগেই বহু মালবাহী পরিবহন ঢাকায় প্রবেশ করে। এসব পরিবহন চলাচল আগের তুলনায় বেড়েছে। রাজধানীর গুলিস্তানসহ বিভিন্ন এলাকায় গভীর রাতেও জট লেগে থাকতে দেখা যায়। মূলত ওই সময়ে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের সক্রিয় থাকতে দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় পরিবহন ও সড়ক বেড়ে যাওয়ার পরও সে তুলনায় জনবল না বাড়ানোয় এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে এটি নিয়ন্ত্রণে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতা জাহাঙ্গীর আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রতিদিন রাতে নামে-বেনামে চাঁদা নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে সিদ্দিকবাজার, গুলিস্তান, জয়কালী মন্দির, যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ, দোলাইরপাড় এবং ধোলাইখালসহ বিভিন্ন স্থান। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী মোড়ে ফ্লাইওভারের নিচে টোলের নামে টাকা নেওয়া হয়। চাঁদা দিতে না চাইলে গাড়ির চালক ও শ্রমিকদের শারীরিকভাবে নির্যাতন এবং গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।’
মালিক সমিতির এ নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘এ পয়েন্টগুলো ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হয়রানির শিকার হতে হয়। আমাদের মালবাহী গাড়িগুলো বিভিন্ন এলাকায় মাল নামাতে গেলে টহল পুলিশ এসে টাকা চায়। না দিলে নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা করে। এ ছাড়া সকালে বিভিন্ন এলাকায় গাড়ির কাগজ দেখার কথা বলে আটকে রেখে সময়ক্ষেপণ করে, পরে নির্ধারিত সময় পার হলে জরিমানা গুনতে হয় আমাদের। এসব বিষয়ে পুলিশকে আমরা জানানোর পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। রাতে আমাদের এ পরিবহন সেবা অব্যাহত রাখতে পুলিশের সহযোগিতা ও সমন্বয় প্রয়োজন।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মো. জাফর হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবহন মালিকরা আমাদের তাদের সমস্যার কথা জানালে আমরা সে অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করব। এ ছাড়া পরিবহনে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে আমরা অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করি। কিছুদিন আগেও আমরা এমন অভিযোগে চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তার করেছি। আর পুলিশের কোনো সদস্য যদি হয়রানি করে কিংবা টাকা নেয়, তাহলে আমাদের কাছে এসে সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ জানাতে হবে। তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারব।’
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকায় আগের তুলনায় পরিবহন বেড়েছে, সে অনুযায়ী আমাদের সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। তারা বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে কাজ করছে। রাতে বিভিন্ন এলাকায় যানজটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা রাতে পৃথকভাবে আমাদের সদস্যদের ওইসব এলাকার দায়িত্ব দিয়ে থাকি।’
চলতি বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা নতুন বছরের মধ্য জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এক দফা ঘোষণা করায় এক ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান সম্মতভাবেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির এক দফা দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। সরকারি ও বিরোধী দলের এ চাওয়া নিয়ে ভোটের আগে সেপ্টেম্বর মাসকে গুরুত্বপূর্ণ ধরে নিয়েই এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ মাস থেকে মাঠের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা এবং আরও সোচ্চার থাকার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের একটুও ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
এ ছাড়া এই মাসে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে দেশের বাইরে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এগুলো নিয়ে জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হবে রাজনীতির মাঠে। তাই এ মাসটি গুরুত্ব পাচ্ছে আওয়ামী লীগের কাছে। মাঠে সজাগ ও সতর্ক থাকতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি, বিএনপি-জামায়াত যৌথভাবে এখন আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাবে। সেটা করতে দেওয়া যাবে না বলেই এখন আর কোনো ছাড় দেবে আওয়ামী লীগ।
ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকায় সেপ্টেম্বরের প্রথম দুদিন দুটি বড় সমাবেশ করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। এর আগে গত জুলাই বিরোধীদের আন্দোলনের জবাবে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে ছিল আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীনদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের আয়োজনে ছাত্রসমাবেশ ও ২ সেপ্টেম্বর পুরনো বাণিজ্য মেলা মাঠে সুধী সমাবেশ। একইদিন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ উদ্বোধন করা হবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, মাসের শুরুতে বড় শোডাউন দিয়ে সরকারবিরোধী পক্ষকে হুঁশিয়ার করতে চায় আওয়ামী লীগ। মাসের দ্বিতীয় দিনও ঢাকায় বড় কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলটি জানান দিতে চেষ্টা করবে মাঠের শক্তিতে অপরাজেয় আওয়ামী লীগ। এ দুটি কর্মসূচিতে বক্তব্য দেবেন টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বিএনপিসহ আন্দোলনরত সব দলের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দেওয়া হবে ষড়যন্ত্র, জ্বালাও-পোড়াও বাংলাদেশে হবে না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির কর্মসূচি দেখে দেশের সাধারণ মানুষ ভীত থাকে। কখন কী হয় সেই আতঙ্ক দেখা দেয় শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন পর্যন্ত কোনো ধরনের অস্থিরতা, অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা আর দেখতে চায় না।’
দলের আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকার পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কারণ একটাই, মানুষকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখা।’
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা নানান চাপ সৃষ্টি করছে। এরই মধ্যে বিএনপিসহ বিরোধীরাও ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে। সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে বিএনপি লাগাতার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা আগেই দিয়েছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি যাতে মাঠ নিয়ন্ত্রণ বা জনসম্পৃক্ততা তৈরি করতে না পারে, সেজন্য মাসের প্রথম দুদিন ঢাকায় বৃহৎ জমায়েত করে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করবে জনগণ তাদের সঙ্গেই আছে, থাকবে। এতে করে সারা দেশের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হবেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজনৈতিক মহড়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতি জনগণ যে আস্থাশীল, সেই বার্তা দেশি-বিদেশি মহলে জানিয়ে দিতে চাই আমরা। মানুষ শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে চায় তার প্রমাণই দেখাতে চাই আগামীকাল (শনিবার) সুধী সমাবেশের মধ্য দিয়ে।’
১ সেপ্টেম্বর (আজ) ছাত্রলীগ যে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে, সেটি মূলত ৩১ আগস্টই হতো সবসময়ই। কিন্তু এবারই তা এক দিন পিছিয়ে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করা হচ্ছে। অবশ্য ছাত্রলীগ কারণ দেখিয়েছে, ৩১ আগস্ট বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত খোলা হওয়ায় তারা কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে শুক্রবার ছুটির দিনে করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেপ্টেম্বরে শক্তভাবে মাঠে নামার পরিকল্পনারই অংশ আজকের ছাত্র সমাবেশ। ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। একইদিন বিএনপিও ঢাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। ফলে উত্তাপ থাকবে আজও।
আজ বিকেল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র সমাবেশ সফল করার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং তাদের অধীনে থাকা বিভিন্ন ইউনিট দফায় দফায় বৈঠক করেছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সমাবেশে পাঁচ লাখের বেশি ছাত্র জমায়েত হবে। অন্যদিকে সাংগঠনিক ইউনিটগুলো থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
এ কর্মসূচি ঘিরে ছাত্রসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থীর বাইরেও যারা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতাকে ভালোবেসে এবং শেখ হাসিনার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দেওয়ার জন্য অনেকেই ছুটে আসবে।’
আগামীকাল শনিবার বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ওইদিন বিকেল ৩টায় পুরনো বাণিজ্য মেলা মাঠে সুধী সমাবেশ হবে। প্রথমদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের তত্ত্বাবধানে এ সুধী সমাবেশ করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা থেকে সরে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এ সমাবেশের আয়োজক হয়েছে। নির্বাচন এবং বিরোধীদের আন্দোলন কর্মসূচিকে মাথায় রেখে সুধী সমাবেশ ব্যাপক পরিসরে করতে চায় আওয়ামী লীগ। সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করে মাঠ দখলে রাখার তৃপ্তি পেতে চান নেতাকর্মীরা। এ সমাবেশে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে বলে জানা গেছে।
সুধী সমাবেশ সফল করতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ছাড়া ও দলটির সহযোগী সংগঠনগুলো আলাদা বর্ধিত সভা করছে। এরই মধ্যে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ আশপাশের জেলার নেতা ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে তৃণমূলের নিজ নিজ ইউনিট থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতাকর্মী আনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএ মান্নান কচি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস উন্নয়নের নতুন দিগন্তের উদ্বোধনে অনেকেই সাক্ষী হওয়ার জন্যই যাবেন। যেমন মেট্রোরেলের উদ্বোধনের দিনও গিয়েছিলেন। এ কারণে আলাদা উৎসাহ-উদ্দীপনাও আছে।’
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ ৪৬ বছরে পা দিচ্ছে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। দলটি এমন একসময়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে যখন সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। ক্ষমতাসীন অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পাশাপাশি জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকারসহ সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। জনগণ এখন এ সরকারের হাত থেকে মুক্তি চায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণ প্রত্যাশা করছে বিএনপি তাদের মুক্তি দেবে।’
তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সফলতা পেতে ৯ বছর লাগলেও এবার ইতিমধ্যে ১৪ বছর চলে গেছে। বর্তমানে সরকার পতনের যে আন্দোলন চলছে, এবার সে আন্দোলনে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ছিটকে পড়তে হবে। আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই চলমান আন্দোলন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপি নেতারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চলমান এক দফার আন্দোলন সফল করতে নেতাকর্মীরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন। আগামী সপ্তাহে রাজপথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক দলগুলোর পাশাপাশি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরাসহ দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আমাদের হাতে সময় খুবই কম।’
বিএনপির একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের আগে এক দফার দাবিতে রাজপথে দুই-একটি কর্মসূচি থাকবে। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি থাকবে। কর্মসূচি চূড়ান্ত করার আগে শরিক দলগুলোর লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে।
যুবদলের এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কর্মসূচিতে যারা পরিশ্রম বেশি করে তাদেরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতটা না টার্গেট করে, তার চেয়ে বেশি টার্গেট করে দলের কিছু নেতা। কোনো কর্মসূচি সফল করলে তাদের গা জ¦লে। আতঙ্কে থাকে এই বুঝি তার রাজনীতি শেষ হয়ে গেল। এভাবে রেষারেষি চলতে থাকলে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তিনি বলেন, ‘দলের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতা চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে। তারা নিজেরা কোনো কর্মসূচিতে সেভাবে থাকেন না। অন্য যারা থাকে তাদের বিরুদ্ধে দলের হাইকমান্ডের কাছে বিষোদ্গার করেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ওয়ান-ইলেভেনের সংকটসহ বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করেছে। তারপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ১৪ বছর কেটে গেছে। এর আগে দুটি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে। এবার চলছে তৃতীয় দফার চূড়ান্ত আন্দোলন।’
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে গত মাসে রাজধানী ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ফ্লপ হয়। হতাশ হন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ক্ষুব্ধ তারেক রহমান ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে অব্যাহতি দেন, যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমিটি ভেঙে দেন। অবস্থান কর্মসূচিতে তৃণমূল নেতারা উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় রাজপথে যেভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেভাবে স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যসহ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতা উপস্থিত ছিলেন না। যদিও রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশের পরদিন রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
রাজপথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের এক শীর্ষ নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার পতনের আন্দোলনে নানা চড়াই-উতরাই, বাঁক থাকবে। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সবসময় একরকম থাকবে না। তাছাড়া নানা ইস্যুতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকে। বর্তমানে যে আন্দোলন চলছে তাতেও একই অবস্থা বিরাজমান। আগামী সপ্তাহে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক রয়েছে। তার আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হবে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিরিজ বৈঠক করবেন। আলোচনার মাধ্যমে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে। ১৫ সেপ্টেম্বরের আগে দুই-একটি কর্মসূচি থাকবে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ধারাবাহিক কর্মসূচি চলতে থাকবে।’
তিনি বলেন, বিএনপির যেমন তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি রয়েছে তেমনি গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দলগুলোর নিজস্ব রাজনীতি আছে। এর অংশ হিসেবে ৩ সেপ্টেম্বর সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে, চলমান আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় কর্মসূচি রয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে বিবৃতি দিচ্ছে, কর্মসূচি দিচ্ছে।
গত বছর জুলাই থেকে রাজপথের আন্দোলনে নামে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বরে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে ৯ ডিসেম্বর অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয় ২০ দলীয় জোট। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে গড়ে তোলা হয় রাজনৈতিক জোট। শুরুতে ৩৬টি দল সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও সময়ের ব্যবধানে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, জাতীয় পার্টি (মঞ্জুর)সহ আরও অনেকে যুক্ত হয়েছে চলমান এক দফার আন্দোলনে। ইতিমধ্যে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, পদযাত্রা, গণমিছিলের মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে।
চলতি সপ্তাহ জুড়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালনের পর এক দফার পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। কর্মসূচির ধরন নিয়ে দলের হাইকমান্ড স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মতামত নেবেন। পাশাপাশি সমমনা যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছেন তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা বসবেন। সবার মতামত পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচি : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলিস্তান মহানগর নাট্যমঞ্চে বিএনপির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া আজ সকালে নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের কার্যালয়গুলোতে দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে কর্মসূচি। বেলা ১১টায় শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিকেল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র্যালি বের করবে দলটি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির বাইরে সব জেলা ইউনিট ও অঙ্গসংগঠনগুলো কর্মসূচি পালন করবে নিজেদের মতো করে।
এক যৌথসভার পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে নিয়ে বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছে, চক্রান্ত হয়েছে এই দলটিকে ভেঙে ফেলার, ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু কখনোই বিএনপিকে ধ্বংস করতে পারেনি। বিএনপি একটা প্রবাহমান স্রোতঃস্বিনী নদী, সে বয়ে চলেছে। এখানে কেউ এসেছে, কেউ গেছে কখনো। কিন্তু বিএনপির গতিকে কেউ রুদ্ধ করতে পারেনি।’
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনকে বিএনপির দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ দাবি করে তিনি বলেন, ‘আজকে বিএনপি বড় রকমের দায়িত্ব নিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ জাতির দ্বিতীয় একটা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছে। সেই মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের এই ৫২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্ত এখন। যারা জোর করে বিনা নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতা দখল করে বসে আছে, তারা সর্বশক্তি দিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাটা ধবংস করে দিয়েছে। আজকে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে জনগণের আকাক্সক্ষাগুলোকে ধবংস করছে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হন। ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন; ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭-এর ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়, জিয়া তখন ওই দায়িত্বও নেন। সে সময় জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টায় একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়, যাতে ৯৮.৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে।
সামরিক আইন প্রশাসক থাকাবস্থায় জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি ডানপন্থি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। তবে সে দল তখন দেশের রাজনীতিতে নাড়া দিতে পারেনি। ওই বছর ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধানের পদে থেকে পুরাদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে যান জিয়া। ৩ জুন নির্বাচন দিয়ে ওই ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি ‘নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপতি হন। নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।
তামিম ইকবাল দলে না থাকাতে যেন অনেকেরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে! আবার বিশ্বকাপের দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অন্তর্ভুক্তিতেও অনেকের চোখ কপালে! দল ঘোষণার পর যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকরা এলেন সংবাদ সম্মেলনে, তখন আলোচনায় শুধু ছিলেন এই দুজনেই। তাদের এই বিরহ বেদনায় চাপা পড়ে যায় অনেক প্রশ্ন। লিটন দাসকে বাদ দিয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত কেন সহ-অধিনায়ক! বাড়তি কোনো ওপেনার ছাড়া কিংবা পাঁচ পেসারকে নিয়ে কেন দল গড়া?
প্রায় মিনিট পনেরোর সংবাদ সম্মেলনে ঘুরে ফিরে এসেছে একই প্রশ্ন। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও ঘুরেফিরে বন্দী ছিলেন একই কথার বৃত্তে। প্রশ্নোত্তর শেষে বেরিয়ে যান তিন নির্বাচক। যেতে যেতে কথা হয় তাদেরই একজন হাবিবুল বাশারের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল চাপা পড়া সেইসব প্রশ্নের উত্তর।
শুরুতেই জানতে চাওয়া হয় লিটনকে বাদ দিয়ে শান্তকে কেন সহ-অধিনায়ক করা হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যৎ একটা কারণ। আর লিটনের অনাগ্রহও তাকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর একটি কারণ। লিটন নিজেও চায় না নেতৃত্বের চাপ নিতে। সে একটু ব্যাটিংয়ে বেশি মনোযোগ দিতে চায়।’
বিশ্বকাপ দলে বিকল্প ওপেনার না থাকার কারণও জানা গেল এই নির্বাচকের কথায়। তিনি জানালেন, ‘আমরা ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে মিরাজকে ভাবছি।’
বিকল্প ওপেনার হিসেবে বিশেষজ্ঞ কাউকে না নেওয়ায় একজন বাড়তি বোলার দলে রাখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে শেখ মেহেদি হাসান সুযোগ পেয়েছেন সে কারণে। পাশাপাশি জায়গা হয়েছে পাঁচ পেসারেরও। এর পেছনে বাশার ভারতের কন্ডিশনের কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভারতে এখন আর্লি সিজন। উইকেট সতেজ থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই পাঁচজন পেসার দরকার হবে।’
যেতে যেতে আরও বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক মুখোমুখি হলেন, এই দলটা বিশ্বকাপে কেমন করবে? এই প্রশ্নটা শুনেই ঘুরে দাঁড়ালেন হাবিবুল। উত্তরে মজা করে বললেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হবে এই দল।’ এরপর একটু গাম্ভীর্য ফিরিয়ে এনে যোগ করলেন, ‘আমি এদের অনেক দিন ধরে দেখছি। ওরা কয়টা ম্যাচ জিতবে জানি না। তবে বিশ্বকাপে প্রতিটি দলকে ভোগাবে, এটা জানি।’
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনে রদবদলের সুযোগ নেই সরকারের। তাই এর আগেই নির্বাচনী প্রশাসনে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রশাসনে চলছে পদোন্নতি ও রদবদল। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রশাসন সাজাতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বদলি-পদায়ন হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে বড় পদোন্নতি হয়েছে। নির্বাচনের আগে অবসরে যাওয়া কয়েকজন সচিবেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২০ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৮ জন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিসিএসের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৫ সালে, ২৫তম ব্যাচ ২০০৬ সালে এবং ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৮ সালে।
জানা যায়, নির্বাচনের সময় ডিসিরা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন। তাদের যে কোনো কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিলের ক্ষমতাও থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসির অধীনে। নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকায়ও থাকেন ডিসিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন তাদের দুটি ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে। আর সে সময় বিসিএস নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। বিসিএসে ছিল নানা ধরনের তদবির। ২৪ ও ২৫তম ব্যাচ দুটি বিএনপির সময়ে নিয়োগ পেলেও ২৭তম ব্যাচ নিয়োগ পেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। কারণ বিএনপির শেষ সময়ে ২৭তম ব্যাচের নিয়োগে বড় ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় তা বাতিল হয়। পরে ফের পরীক্ষা নিয়ে ২০০৮ সালে এ ব্যাচের নিয়োগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ২৪তম ব্যাচের নিয়োগ নিয়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২৪তম ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডিসির পদ থেকে তুলে আনা হতে পারে। নির্বাচনের সময় যারা ডিসির দায়িত্বে থাকবেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের সবার ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পরিবার ও নিকট আত্মীয়স্বজনদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো যাচাই করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে আর ডিসির পদে রাখা হবে না।
এ ছাড়া নির্বাচনে অন্যতম ভূমিকা পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। বর্তমানে ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন ইউএনও পদে, যারা আসন্ন নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। এখন ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইউএনওর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে; এ ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারের ২৯১ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইকরাম আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষা হয় যোগ্যতা, মেধা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে। সেখানে ছাত্রজীবনে কে কোন পার্টি করেছিলেন, কোন দল ক্ষমতায় আছে তা বিবেচনা করা হয় না। বিসিএস কর্মকর্তাদের যে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয়, তাতে তাকে একজন অফিসার হিসেবেই গড়ে তোলা হয়। এরপর এসিআর, সুপিরিয়রের মতামত, সুনাম, দক্ষতা, যোগ্যতার ভিত্তিতেই একজন কর্মকর্তাকে উচ্চতর পদে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তবে সরকার যে দল পরিচালনা করে তাদের কিছু নীতিমালা ও উদ্দেশ্য থাকে। কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া বৈধ ও জনকল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা। তিনি প্রলুব্ধ হবেন না, নিরপেক্ষ থেকে তার দায়িত্ব পালন করবেন। যদি কোনো নির্বাচনী দায়িত্বও দেওয়া হয়, সেটাও নিরপেক্ষভাবে তিনি পালন করবেন।’
গত মে মাসে অতিরিক্ত সচিব পদে ১১৪ জনের পদোন্নতি হয়। জুলাই মাসে পাঁচ বিভাগে নতুন বিভাগীয় কমিশনার দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসেই বদলি ও নতুন মিলিয়ে ৩০টি জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। উপসচিব পদমর্যাদার এই ডিসি পদে এবারও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আটজন পিএসকে পদায়ন দেওয়া হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২১ কর্মকর্তা। এ পদোন্নতিতে মূল বিবেচনায় এসেছে ২২তম ব্যাচ। বর্তমানে যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদ ৫০২টি। এর বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়ার পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা হলো ৯৪৬ জন। এর আগে সর্বশেষ গত বছর ২ নভেম্বর ১৭৫ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। আর গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২৭০ জন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
জানা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই অন্তত ১০ জন সচিবের স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কথা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন আগামী ১৩ অক্টোবর অবসরে যেতে পারেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান ১৪ সেপ্টেম্বর, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আবদুস সালামের ২৬ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে আবদুস সালামের চাকরি এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ৯ অক্টোবর, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক ৩০ অক্টোবর, ইআরডি সচিব শরিফা খান ২৪ নভেম্বর, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসানে এলাহী ২৫ নভেম্বর এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সিনিয়র সচিব কামাল হোসেন ২৯ নভেম্বর অবসরে যাবেন। ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম এবং ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলাম। এ ১০ জনের মধ্যে কয়েকজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।
গত কয়েক বছরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং মুখ্য সচিব পদে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক অবসরের মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। সর্বশেষ সাবেক চার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মধ্যে একমাত্র কবির বিন আনোয়ার ছাড়া বাকি তিনজনই স্বাভাবিক মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা হলেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, মোহাম্মদ শফিউল আলম ও খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।