
দেশের অর্থনীতি বর্তমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। চারটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংকট দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রিজার্ভ সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণপ্রাপ্তি কমে যাওয়া এবং ঋণ পরিশোধের চাপের কারণে অর্থনীতি এমন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে আরও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে সরকার দেশি-বিদেশি নানা চাপের মুখে রয়েছে। এর মধ্যে অর্থনীতির সংকট সরকারের জন্য আরও মারাত্মক চ্যালেঞ্জ বয়ে আনতে পারে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুই বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৫৫ শতাংশ। প্রতি মাসে প্রায় এক বিলিয়ন করে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।
১৪ সেপ্টেম্বর দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ২১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (আইএমএফের হিসেবে)। তারও কয়েক দিন আগে এই রিজার্ভ নেমে এসেছিল ২১ দশমিক ৪৮ বিলিয়নে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ছিল ৩৯ বিলিয়ন। বর্তমানে যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো কষ্টকর হবে। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো দেশের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট (আর্থিক হিসাব) ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, সামনের দিনগুলোতে এক বিলিয়ন ডলারের ডেফার্ড এলসির (বিলম্বিত ঋণপত্র) দায় পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। তবে এই অর্থের চেয়ে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি ঋণ পরিশোধের চাপ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার ও সরকারি গ্যারান্টিতে পাওয়া বিদেশি ঋণের মধ্যে ৩১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে, যার মধ্যে ২৪৩ কোটি ডলার আসল ও সুদ বাবদ ৭৬ কোটি ডলার। অবশিষ্ট প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে হবে বেসরকারি খাতকে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধ করতে হবে ১৬২ কোটি ডলার।
বিদেশি মুদ্রার, বিশেষ করে ডলার সংকট সামাল দিতে আমদানিতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ডলার সংকটে টাকার দাম ধরে রাখতে মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে অভিযান চলছে। ফলে মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। খোলাবাজারের পরিবর্তে ডলার এখন কেনাবেচা হচ্ছে কালোবাজারে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকেও তুলনামূলক কম ঋণ পাচ্ছে সরকার। শুধু বিদেশি ঋণই নয়, টাকায় ধার করাও সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। তারল্য সংকটে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ধার দিতে না পারায় নতুন টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; অর্থাৎ ডলার সংকটের কারণে টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া ও আমদানি বিধিনিষেধ আরোপ করায় রেকর্ড মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েছে দেশ।
সর্বশেষ গত আগস্টে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ শতাংশে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা গত এক দশকে সর্বোচ্চ। দেশের রিজার্ভ যদি আরও কমে যায়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে গাণিতিক হারে বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি, যেমনটা ঘটেছে শ্রীলঙ্কার বেলায়।
একদিকে বিপুল ঋণ পরিশোধের চাপ, অন্যদিকে ডলার সংকট। পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকলে জরুরি খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, এলএনজি কিংবা কয়লার মতো গুরুত্বপূর্ণ আমদানির জন্য অর্থ সরবরাহ বা বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে সরকার। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন এলসির দায় পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে এমন পরিস্থিতিতে চাইলেও যেকোনো ঋণ পরিশোধের সময় বাড়াতে ঋণদাতারা রাজি হয় না। এর আগে বেসরকারি পর্যায়ের স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হলেও এখন অনেক আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান মেয়াদ বাড়াতে রাজি হচ্ছে না।
অবশ্য বিদেশি মুদ্রার এমন সংকটে শুধু বাংলাদেশই নেই, আরও অন্তত ৪০টি উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যাদের রিজার্ভ ২৪ থেকে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ হারানোর তালিকায় রয়েছে বলিভিয়া। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটি ৮৮ শতাংশ রিজার্ভ হারিয়েছে। ওই সময়ে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ কমেছিল প্রায় ৭৮ শতাংশ।
এসব দেশের এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা হচ্ছে। দেশটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে নিয়মিতভাবে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। এতে এক দিকে যেমন ডলার শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে বিশে^র প্রায় সব মুদ্রার পতন হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে। তবে ডলারের সংকট সরকারের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে। শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল্য নির্ধারণ করলেও এখন এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডকে (এবিবি), যারা ঘাটতির কারণে নিয়মিতভবে ডলারের দাম বাড়িয়ে চলেছে। আবার সংগঠন দুটি ডলারের যে দর নির্ধারণ করছে, তাদের সদস্য ব্যাংকগুলোই তা মানছে না। বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে বেশি মূল্যে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় দেশে আনছে, আবার তার চেয়েও বেশি দরে আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবেই প্রায় দেড় বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩১ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অব্যাহত অবমূল্যায়নে আমদানি করা সব পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়। বাংলাদেশ ঠিক এমন পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও রিজার্ভের অব্যাহত পতন ঠেকাতে আমদানিতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। রপ্তানি আয় দ্রুত নগদায়নের পাশাপাশি এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর বন্ধ করা হয়েছে।
প্রবাসী আয়ের পতনে বিদেশি মুদ্রা, বিশেষ করে ডলারের চাহিদা আরও তীব্র করে তুলেছে। গত বছরের আগস্টের চেয়ে চলতি বছর একই সময়ে প্রবাসী আয় ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ কমে গেছে। গত বছর আগস্টে ছিল ২০৪ কোটি ডলার। চলতি বছর আগস্টে কমে দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি ডলার।
এদিকে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নে বিদেশি বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে পুঁজিবাজারের বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকির মুখে থাকেন। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিজের দেশে ফিরিয়ে নেন। এটিকে ক্যাপিটাল ফ্লাইট বলা হয়। ক্যাপিটাল ফ্লাইট হলো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা পুঁজি নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতো ঘটনার কারণে একটি দেশ থেকে আর্থিক সম্পদ এবং মূলধনের একটি বড় আকারের বহির্গমন। বাংলাদেশে টাকার অবমূল্যায়নের শঙ্কায় ২০১৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পুঁজিবাজার থেকে বিদেশিরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। এর পরিমাণ এক বছরে কিছুটা কমেছে। কারণ হলো পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করায় মৌলভিত্তির প্রায় সব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশিরা চাইলেও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। তবে পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ আটকানো গেলেও বিদ্যমান পরিস্থিতি নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে।
ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে ব্যবসা করা অনেক বিদেশি কোম্পানি তাদের মুনাফা বিদেশে অবস্থিত মূল কোম্পানিতে পাঠাতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর অনুমোদন দিচ্ছে না। এটিও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টের ক্ষেত্রে বাধা।
অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে সুদের হার বাড়ানো, যেটির সফলতা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই পথে হাঁটেনি। আইএমএফের চাপে পড়ে সুদহার বাজারব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার নামে যে পদ্ধতিটি চালু করেছে, তার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে সুদহার কার্যত তেমন একটা বাড়েনি। ফলে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিতে পারছে না। আর টাকার সরবরাহ বাড়ায় মূল্যস্ফীতিও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে শ্রীলঙ্কা। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের চরম সংকটে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মাত্র আড়াই মাসে শ্রীলঙ্কার মুদ্রা ডলারের বিপরীতে প্রায় ৭৯ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়। এ সময়ে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি সামলাতে কয়েক মাসের ব্যবধানে নীতি সুদহার তিন গুণ বাড়িয়ে দেয় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত সুদহার বাড়িয়েই মূল্যস্ফীতি সামাল দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এ সময়টাতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করেছে পর্যটক ও প্রবাসী আয়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালের এপ্রিলে আমানতের সুদহার এক ধাপে সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাজনীতি ও অর্থনীতির চরম দুরবস্থার মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামলাতে চলতি বছরের মার্চে আমানতের নীতি সুদহার ফের বাড়িয়ে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সর্বোচ্চ সুদহারের রেকর্ড। তবে পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সুদহারও কমিয়ে আনে শ্রীলঙ্কা। চলতি বছরের মে থেকে দেশটির মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করে। মাত্র তিন মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতি আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে। গত আগস্টে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। অন্যদিকে আমানতের সুদহার কমালেও তা ১১ শতাংশের নিচে নামেনি।
বিশ^ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছরের প্রথম দিকে আমরা যেভাবে সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি, এবার আমাদের সেই সক্ষমতা নেই। একই সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অবস্থাও অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখনো সমস্যার মূলে হাত না দিয়ে আমরা লোক দেখানোর জন্য দুই-একটা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা এখনো বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। ডলার বাজারে বিভিন্নভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে। দাম নির্ধারণ করে সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এটা ব্যবসায়ীদের কালোবাজারিতে উসকে দেবে।’
ড. জাহিদ মনে করেন, মূল্য নির্ধারণ না করে সরকারের উচিত ছিল যারা কালোবাজারিতে যুক্ত, তাদের আইনের আওতায় আনা। এখন খুচরা ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রিতে তাদের লাভ না দেখলে বেচাকেনা বন্ধ করে দিতে পারেন। এতে সমস্যা আরও জটিল হতে পারে।
ঘুষের বিনিময়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দেওয়াসহ নানা রকম আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহর বিরুদ্ধে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে তিতাস এমডি এই দুর্নীতি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে পেট্রোবাংলাকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গাজীপুরের পিরুজালী এলাকায় অবস্থিত মেসার্স সিলভার নিট কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের কারখানায় বয়লার ও গ্যাসচালিত জেনারেটরের জন্য নতুন গ্যাস সংযোগের আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ওই আবেদনের ওপর নির্দেশনা দিয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিখেছেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত। আলাপ করবেন।’
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নির্দেশনা-সংবলিত আবেদনটি তিতাসের গাজীপুরের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসানকে পাঠানো হয়। বিষয়টি জানতে সাইদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। গ্যাস সংযোগের জন্য ওই আবেদনপত্রটি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হলেও সেখানে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো সিল, স্বাক্ষর কিংবা নির্দেশনা নেই। ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দপ্তর থেকেও কোনো ধরনের চিঠি কিংবা নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এরপরও তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবেদনপত্রে মন্ত্রীর (প্রধানমন্ত্রীর) দপ্তরের কথা উল্লেখ করেছেন।
বিষয়টি নজরে আসার পর গত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি বিভাগের সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়। রূপালী মণ্ডল (পরিচালক-১১) স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে, বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণ করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে পরীক্ষা করে বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চিঠি পেয়ে বিষয়টি এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
গত ১২ সেপ্টেম্বর জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশিদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়।
চিঠি পাঠানোর বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব বরাবর পাঠানো এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) কিংবা প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও উৎকোচ গ্রহণ করে সিলভার নিট কম্পোজিটের সঙ্গে এসএম এক্সেসরিজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সংযোগের ছয় মাসের পুরনো আবেদনটি দ্রুত পাস করিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।
লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিতাসের সিস্টেম লস ছিল ৫ থেকে ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শুধু বেসরকারি দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে তিতাসের বকেয়া রয়েছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই বকেয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রিভিউ মামলায় তিতাসের পক্ষে রায় গেলেও এই অর্থ আদায়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
ওই অভিযোগপত্রে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিতাসের এমডির অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঘুষের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিমানা মওকুফ, বিল বকেয়া থাকা সত্ত্বেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা, সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার করাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত তিতাস এমডি। জিসান নামে একজন ঠিকাদার তার এসব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
গ্যাস সংকটের কারণে ২০১০ সাল থেকে দেশে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে নানা রকম যাচাই-বাছাই ও বিবেচনা করে সীমিত পরিসরে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। শিল্পে গ্যাস সংযোগের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কয়েকশ আবেদন জমা রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও প্রতিবারই সেটি ব্যস্ত পাওয়া গেছে। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে রিং হয়। কিন্তু তিনি তা ধরেননি। সর্বশেষ বিষয়বস্তু লিখে তাকে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।
২০২১ সালে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান হারুনুর রশিদ। পরে দ্বিতীয় দফায় আরও এক বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। সম্প্রতি আবারও তার মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
প্রায় তিন মাস আগে অতিরিক্ত আইজিপি থেকে পুলিশ সুপার পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। কিন্তু এই সময়েও পদোন্নতির বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। উল্টো পুলিশের দেওয়া তালিকা কাটছাঁট করা হচ্ছে। এইড নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে পুলিশে।
পুলিশের অভিযোগ, অন্য ক্যাডারদের দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের বেলায় নানা অজুহাত দেখানো হচ্ছে। এ কারণে আগামী অক্টোবরের মধ্যে তালিকা অনুযায়ী পদোন্নতির বিষয়টি সুরাহা চাচ্ছে পুলিশ।
জানা গেছে, ইতিমধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। সর্বশেষ গত বুধবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এবং সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছেন অন্তত ২৬ জন ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) এই পদোন্নতিতে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পরে গত ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভাও হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদ ২১২টি। কিন্তু এই পদমর্যাদায় কর্মরত কর্মকর্তার সংখ্যা ৪২৬। পদ না থাকলেও ধাপে ধাপে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে সবাইকে। গত মে মাসে একসঙ্গে ১৪৪ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। যুগ্ম সচিব পদের সংখ্যা ৫০২। কিন্তু কর্মরত আছেন ৯৩৬ জন। অতিরিক্ত সচিবের মতো যুগ্ম সচিব পদেও পদ ছাড়াই পদোন্নতি দেওয়া হয় অনেক কর্মকর্তাকে। ৪ সেপ্টেম্বর ২১১ এবং গত বছরের নভেম্বরে ১৭৫ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতিপ্রাপ্ত অনেককেই সুপারনিউমারারি পদায়ন দেওয়া হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি ও অতিরিক্ত আইজিপি পদে ৭২০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পুলিশ সদর দপ্তর।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, ৭২০ জনের প্রস্তুাবটি ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। জুন মাসে তালিকাটি সংশোধন করে ৫২৯ জনের চূড়ান্ত তালিকা করে স্বরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ২০ জুলাই পদোন্নতি দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয় ফাইলটি। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৩৪২ জনের বিষয়ে ছাড়পত্র দেয়। বাকিদের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জানা গেছে, অতিরিক্ত আইজিপি পদে ২, ডিআইজি পদে ৫০, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) ৩৪, উপমহাপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ১৪০, অতিরিক্ত উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) ১৫০ ও পুলিশ সুপার ১৯০ পদের পদোন্নতির সুপারিশ।
পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন পুলিশের নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়।
পদোন্নতি পাওয়ার পর ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ রেঞ্জে নিয়োগ দেওয়া হবে। তা ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর মহানগর পুলিশ, পুলিশ সদর দপ্তর, এসবি, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা, পুলিশ স্টাফ কলেজ, রেলওয়ে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, এপিবিএন, এন্টি টেররিজম ইউনিট, পিবিআই, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশ, মেট্রোরেল পুলিশ ইউনিট ও পিটিসি ইউনিটে (টাঙ্গাইল, নোয়াখালী, রংপুর ও খুলনা) সুপারনিউমারারি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি না পাওয়ার হতাশা থেকে বের করে আনতেই এই পরিকল্পনা করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। কিন্তু যেভাবে কাটছাঁট করা হচ্ছে তাতে সবাই পদোন্নতি পান কি না, সন্দেহ করছেন। এ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পদোন্নতি হওয়ার পর কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাবে তা সত্য। অন্য ক্যাডাররা পেলে আমরা কী দোষ করছি? আমরা তো রাষ্ট্রের জন্যই কাজ করি। কিন্তু মন্ত্রণালয় যেভাবে কাটছাঁট করে পদ চূড়ান্ত করছে তা কিছুতেই মানতে পারছি না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পদোন্নতির সংখ্যা কমানো হয়েছে। তারপরও তালিকা ছোট করছে মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতনরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আবার কথা বলবেন আমরা জানতে পেরেছি। আশা করি সরকারপ্রধান আমাদের পদোন্নতির বিষয়টি সুরাহা করবেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সুপারনিউমারারির মাধ্যমে পদোন্নতির বিষয়টি সমাধান করা হবে দ্রুত সময়ে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
গণমাধ্যমে তথ্য সরবরাহের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছিল সরকারি কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক এসএম আরিফুজ্জামানের নামে। তার বিরুদ্ধে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন বা এসিআর ঘষামাজার অভিযোগও আনা হয়েছিল।
পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, এ দুই বিভাগীয় মামলার চাপ সইতে না পেরে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মারা যান আরিফুজ্জামান। জীবিত অবস্থায় তিনিও এসব বিভাগীয় মামলাকে ভুয়া বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন।
আরিফুজ্জামান মারা যাওয়ার পর তাকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয় এবং প্রাপ্য পেনশন দাবি করা হয়।
কেউ মারা গেলে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া চিরায়ত রেওয়াজ। তা ভুলে গিয়ে মামলা দীর্ঘায়িত করার মতলবে মতামতের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠায় শ্রম মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ২২ আগস্ট সাফ জানিয়ে দেয়, কেউ মারা গেলে তাকে আসামি রাখার আর কোনো সুযোগ নেই।
শুধু আরিফুজ্জামান নয়, বিভাগীয় মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ নতুন নয়।
বিভাগীয় মামলায় পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে। এখানে অভিযোগকারী তদন্তকারী আর বিচারকারী সবই একজন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংস্থাপ্রধান অভিযোগ আনেন। তিনিই তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। সংস্থাপ্রধানই বিচার করেন। দপ্তরের প্রধান ব্যক্তি এসবের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় তার কাছের কর্মকর্তা-কর্মচারী এর সুবিধা নেন। আর যারা কাছে না ভিড়ে একটু দূরে থাকেন, তারা বিভাগীয় মামলাচক্রের ভুক্তভোগী হন।
অধিদপ্তরের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের কর্তৃপক্ষ প্রধান হন মন্ত্রণালয়ের সচিব। সচিব হলেও বিভাগীয় মামলার বিষয়টি নিজেদের মধ্যেই থাকে। যুগ যুগ ধরে এ প্রথা চলে আসছে। এ থেকে বের হওয়ার জন্য নানা সময় উদ্যোগ নিলেও কারও অদৃশ্য বাধায় তা আটকে যায়। বিভাগীয় মামলার চক্করে পড়ে অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিষ্ঠুরতায় কেউ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আর বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত হওয়ার কাহিনি তো খুবই সাধারণ ঘটনা।
বিভাগীয় মামলার অপব্যবহার বন্ধ করতে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলেছিলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সচিব সভায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। পরে সচিব সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব। বিভাগীয় মামলার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাদের কাছে স্পষ্ট মতামত চাইলেও কেউ মতামত দেননি।
লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক ডিজি একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিভাগীয় মামলা নিয়ে নানা হয়রানি রয়েছে। একটি বিভাগীয় মামলা শেষ হতে ২৫ বছরও লেগেছে। বিভাগীয় মামলা নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে শেষ না করলে সরকারের ক্ষতি, দপ্তরের ক্ষতি ও ব্যক্তির ক্ষতি। বিভাগীয় মামলার আইনি কোনো দুর্বলতা নেই। চমৎকার কাঠামো। কখন কী করতে হবে সব বলা আছে। কিন্তু কেতাবে লেখা থাকলে কী হবে, যদি না মানি। তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের মানার মন নেই। প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং তার অধীনÑ কেউ মানে না। তাই বিভাগীয় মামলার অপপ্রয়োগ হচ্ছে।’
যাদের ক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলা সবচেয়ে বাজেভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাবেক অতিরিক্ত সচিব শেখ আবদুর রশিদ। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি তাকে জানানো হয় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চার বছর পর। ততদিনে তিনি পিআরএলে (অবসর-পরবর্তী ছুটি) চলে গেছেন।
আবদুর রশিদ ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মসূচিতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল করিমের। তিনি না গিয়ে সেই অনুষ্ঠানে পাঠান আবদুর রশিদকে। শেষ পর্যন্ত ওই অনুষ্ঠানের একটি বিষয়কে সামনে এনে তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য প্রমাণ হয়নি। ২০১২ সালে এ রিপোর্ট জমা হলেও তাকে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয় ২০১৬ সালে। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের মেধা তালিকায় প্রথম হওয়া কর্মকর্তা তিনি। ক্যাডারভিত্তিক মেধা তালিকা, জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করলে এ কর্মকর্তার মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাকে বিদায় নিতে হয়েছে অতিরিক্ত সচিবের পদ থেকে।
বিভাগীয় মামলা তদন্তে দীর্ঘ সময় ব্যয় করা হয়। এ সময়ে সংশ্লিষ্ট বিবাদী আর্থিক সংকটে পড়েন। মামলা চলাকালে বিবাদীর অর্ধেক বেতন পাওয়ার অধিকার থাকলেও অনেক সময় তা উপেক্ষা করা হয়। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণ হলেও এটা বিবাদীকে জানিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে কর্মকর্তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।
বিভাগীয় মামলায় আরেক ভুক্তভোগীর নাম বাদিউল কবীর। সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও তাকে প্রায় ছয় বছর চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হয়। বিভাগীয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও সরকার পক্ষে নথি উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন না করে মাসের পর মাস সময়ক্ষেপণ করেন। এতে মামলার তদন্ত শেষ হতেই তিন বছর পার হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ার পরও ফাইলটি নিষ্পত্তি না করে দায়িত্বশীল পদস্থ কর্মকর্তারা আরও এক বছরের বেশি সময় ফেলে রাখেন। এমনকি একপর্যায়ে তার অর্ধেক বেতনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চরম মানবেতর অবস্থায় পড়েছিলেন বাদিউল কবীর।
বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি না হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি ঝুলে থাকে। ব্যাচমেটরা পদোন্নতি পেয়ে ওপরের পদে চলে যাচ্ছেন আর বিভাগীয় মামলার আসামি হয়ে অভিযুক্ত একই পদে বসে থাকেন বছরের পর বছর।
বিভাগীয় মামলায় শাস্তি নির্ধারিত। কিছু মামলায় গুরুদন্ড হয়। আবার কিছু মামলায় লঘুদন্ড। কখনো কখনো গুরুদন্ড দেওয়া হলেও আপিলে লঘুদন্ড হয়। লঘুদন্ডের মধ্যে সতর্কীকরণের মতো নামমাত্র শাস্তিও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এ শাস্তিও মাফ করে দেন রাষ্ট্রপতি।
এসিআর ঘষামাজার অভিযোগে ১৪ জন শ্রম পরিদর্শককে অভিযুক্ত করে বিভাগীয় মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। তাদের মধ্যে সাতজন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের (আইজি) কাছে কারণ দর্শানো নোটিসের জবাব দেন। বাকি সাতজন মহাপরিদর্শকের কাছে জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান। নিরপেক্ষ না থাকার অভিযোগে তারা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে নোটিসের জবাব দেন। এসএম আরিফুজ্জামান আইজির কাছে জবাব দিয়েছিলেন। তার সঙ্গী ছয়জনকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও আরিফুজ্জামানকে দেওয়া হয়নি। তার মৃত্যুও তাকে বিভাগীয় মামলা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আরিফুজ্জামানের বিষয়ে জনপ্রশাসনের মতামতের জন্য অপেক্ষা করা ঠিক হয়নি। কারণ সারা পৃথিবীতেই যেকোনো মামলা থেকে মৃত ব্যক্তিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক বিভাগীয় মামলায় পর্যবেক্ষণ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। বিভাগের পাঠানো কাগজপত্র ও মামলার প্রসিডিংস পর্যালোচনা করে পিএসসি মামলা দায়ের, পরিচালন ও তদন্তে দুর্বলতা পেয়েছে। এমনকি তদন্তকারীর তদন্ত করার মতো দক্ষতা ছিল না। এতে পক্ষপাতিত্ব এবং ন্যায্যতা নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে কমিশন পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা পিএসসির এ পর্যবেক্ষণের কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন।
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন তার ফেসবুক পেজের ইন্ট্রোতে লিখে রেখেছেন ‘৪টি শাস্তিপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা’। পুরো কর্মজীবনেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। যে বিভাগে কাজ করেছেন সেখানেই প্রচলিত পদ্ধতি বদল করে জনসেবা উন্নত করতে চেয়েছেন। সর্বশেষ রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। রেলপথে সাধারণ যাত্রীদের সেবা সহজ করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অনিয়ম কমাতে তিনি যাত্রীদের এনআইডির ভিত্তিতে টিকিট কাটার প্রস্তাব করেছিলেন। সেই সময় মাহবুব কবীর মিলনের প্রস্তাব মানা হয়নি। অথচ এখন সেই এনআইডির ভিত্তিতেই টিকিট বিক্রি করা হয়। তাহলে কী সমস্যা ছিল মাহবুব কবীর মিলনের প্রশ্ন তুলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, মিলন রেল থেকে দুর্নীতি সরাতে চেয়েছিলেন। এটা পছন্দ হয়নি কিছু কর্মকর্তার। তারা রেলের কালো বিড়াল লালন-পালন করতে চান। এ কারণে মিলনের নামে বিভাগীয় মামলা দেওয়া হয়। মাহবুব কবীর মিলন দুর্নীতি দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে ১০ জন কর্মকর্তার একটি উইং চেয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বিভাগীয় মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হবেন। আগামী মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের উচ্চ-পর্যারের প্রথম দিনের বিতর্কে যোগ দেবেন তিনি। শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জাতিসংষের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য খাতে সাফল্যসহ বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন তুলে ধরবেন। এর পাশাপাশি বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা, নিরাপদ অভিবাসন, রোহিঙ্গা সংকট ও জলবায়ু ন্যায্যতাও তার ভাষণে স্থান পাবে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে সংস্থার সদর দপ্তরে জমায়েত হচ্ছেন বিশ্ব নেতারা। এবারের অধিবেশনের প্রতিপাদ্য হলো, ‘বিশ্বাস পুনর্গঠন এবং বৈশ্বিক সংহতি পুনর্নির্মাণ : সবার জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও স্থায়িত্ব অর্জনের উদ্দেশ্যে ২০৩০ এজেন্ডা এবং এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসংক্রান্ত ত্বরান্বিত কর্মপন্থা’।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এবং বর্তমান সংসদের সময়ের মধ্যে এটিই হবে শেখ হাসিনার শেষ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়া।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক অধিবেশনের ফাঁকে বেশ কয়েকটি উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠক ও বিতর্কে অংশ নেবেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর বাইরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করতে প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ডেনমার্ক ও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে যোগ দিতে পারেন।
মোমেন জানান, সফরকালে বাংলাদেশ এবং হাঙ্গেরি, কাজাখস্তানের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সব দিক থেকেই প্রধানমন্ত্রীর এবারের নিউ ইয়র্ক সফর গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, অধিবেশনে এবং অধিবেশনের সাইড লাইনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে পশ্চিমাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন প্রধানমন্ত্রী। তারা বলছেন, সরকারপ্রধান অবশ্যই এই বিষয়ে নিজের তথা নিজের সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছেন।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইট আজ সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যাবে। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে চার ঘণ্টা যাত্রা বিরতির পর ফ্লাইটটি নিউ ইয়র্ক সময় রাত ১০টা ৫০ মিনিটে জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কাল সোমবার নিউ ইয়র্কের রকফেলার সেন্টারে জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা-ইউএনআইডিও এবং বাণিজ্য পরামর্শদাতা সংস্থা ডেলয়েট আয়োজিত ‘খাদ্যের জন্য চিন্তা খাদ্য সরবরাহ চেইন উদ্ভাবনের জন্য এসডিজিকে ত্বরান্বিত করার জন্য সহযোগিতা’ শীর্ষক একটি উচ্চ-পর্যায়ের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মূল বক্তব্য দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। একই দিনে তিনি ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল চেম্বারে ‘এসডিজি সামিট-লিডার্স’ ডায়ালগ-৪ (এসডিজি অর্জনের জন্য সমন্বিত নীতি ও পাবলিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা) শীর্ষক আরেকটি সম্মেলনেও ভাষণ দেবেন। ওইদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈশ্বিক শিক্ষা বিষয়ক বিশেষ দূত ও বিশ্ব স্বাস্থ্য অর্থায়নের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রাষ্ট্রদূত গর্ডন ব্রাউন ও নিউ ইয়র্কের লেক্সিংটন ভেন্যুতে গ্লোবাল বিজনেস কোয়ালিশন ফর এডুকেশনের এক্সিকিউটিভ চেয়ার সারাহ ব্রাউন আয়োজিত জাতিসংঘের ২০২৩ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) শীর্ষক সম্মেলন উপলক্ষে একটি উচ্চ-পর্যায়ের ব্যক্তিগত নৈশভোজে যোগ দিতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ প্রধানের আমন্ত্রণে ‘ক্লাইমেট অ্যাম্বিশন সামিট’ শীর্ষক একটি উচ্চ-পর্যায়ের আলোচনা এবং ‘হাই-লেভেল ব্রেকফাস্ট সামিট অন ক্লাইমেট মবিলিটি’সহ কয়েকটি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি দূর করতে বিশ্ব নেতাদের কাছে তার পরামর্শ তুলে ধরবেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার সরকারের পদক্ষেপও তুলে ধরবেন। কানাডা, গাম্বিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে আয়োজিত সাইড ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ‘কমিউনিটি ক্লিনিকে শেখ হাসিনার উদ্যোগ : মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রতিবন্ধীসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জনে উদ্ভাবনী পদ্ধতি’, ‘মহামারী প্রতিরোধ, প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া’, সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এসব বৈঠকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং বাংলাদেশে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার সরকারের ব্যাপক সাফল্য তুলে ধরবেন।
মোমেন বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী সফরকালে জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার, জাতিসংঘ মহাসচিবের গণহত্যা বিষয়ক উপদেষ্টা, নবনির্বাচিত ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) মহাপরিচালক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
দাম নির্ধারণের দুদিন পরও কাক্সিক্ষত দামে ডিম, আলু ও পেঁয়াজ কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। উল্টো বাজারে এসে দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন তারা। বাজারে স্বস্তি ফেরাতে দফায় দফায় অভিযান পরিচালনা করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানের খবরে দোকানিরা নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করলেও ভোক্তা অধিকার চলে যাওয়ার পরই আগের দামেই বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
গত বৃহস্পতিবার খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ডিম ১৪৪, আলুর কেজি ৩৫-৩৬ এবং ৬৪-৬৫ টাকায় পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয় সরকার। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সরকারের সিদ্ধান্ত না মেনে প্রতি কেজি আলু ৫০, পেঁয়াজ ৯০ এবং ডিম ১৫০ থেকে ১৫৮ এবং ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে আলু, পেঁয়াজ ও ডিম বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে ভোক্তাদের মধ্যে। তারা বলছেন, সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকায় ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া। খোলাবাজারের লুটপাটের প্রবণতা মজুদকারী থেকে সব শ্রেণির ব্যবসায়ীর মধ্যে রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, আমরা কম দামে পণ্য কিনতে পারলেই ক্রেতার কাছে কমে বিক্রি করতে পারব। তাদের দাবিÑ খুচরা দোকানে অভিযান না চালিয়ে আড়তগুলো তদারকির আওতায় আনা গেলে বাজারে সুফল মিলবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর নিউ মার্কেট, বাড্ডা ও রাজাবাজারের ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব কথা জানা গেছে।
বাড্ডা বাজারে আলু কিনতে এসে সানাউল্লাহ নামে এক ক্রেতাকে বাগবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে তিনি দেশ রূপান্তরকে জানান, সরকার আলুর দাম বেঁধে দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা এখনো ৫০ টাকার নিচে আলু বিক্রি করছেন না। উল্টো তারা দাবি করেন, বেশি দামে কেনা আলু হওয়ায় কম দামে বিক্রি সম্ভব নয়। আলু বিক্রেতা শাহিন বলেন, সকালে ৪২-৪৩ টাকা কেজি দরে আলু পাইকারি বাজার থেকে কিনে এনেছি। এখন তা ৩৫-৩৬ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব নয়। সরকার যেমন ইচ্ছা তেমন বললেই তা মানা যায় না। তাদের বলুন আগে বড় মাফিয়া ব্যবসায়ীদের ধরতে। তাহলেই দাম কমে যাবে।
ডিমের ক্ষেত্রেও বাজারে একই দৃশ্য দেখা গেছে। প্রতি ডজন ডিম ১৫০-১৫৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি না করার কারণ জানতে চাইলে নিউ মার্কেটের ডিম ব্যবসায়ী কাইয়ুম দেশ রূপান্তরকে বলেন, পাইকারি বাজারে গত দুদিনে দাম এক টাকাও কমেনি। ১০০ ডিম দোকানে আনতে খরচ হয় ১ হাজার ২২০ টাকা। তার মানে একেকটা ডিমের দাম পড়ে ১২ টাকা ২০ পয়সা। তাহলে কীভাবে ১২ টাকায় ডিম বিক্রি করব? লোকসান দিয়ে বিক্রি করলে সংসার কি সরকার চালাবে?
এদিকে বাজারের লাগাম টেনে ধরতে একযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় সরকার নির্ধারিত মূল্যের থেকে বেশি দামে পণ্য বিক্রি ও বিক্রয় মূল্য তালিকা না থাকায় ব্যবসায়ীদের জরিমানাসহ সতর্ক করেন ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তারা।
একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে : জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে। এ বছর যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে, তাতে দেশে আলুর কোনো ঘাটতি নেই। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।
গতকাল শনিবার দুপুরে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর ফেরিঘাট এলাকার রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজ পরিদর্শন শেষে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আলু বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার পাকা রসিদ ব্যবহার করতে হবে। পাকা রসিদ না থাকলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজে পাকা রসিদ ছাড়া আলু বিক্রির অপরাধে এক ব্যবসায়ীকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ব্যবসায়ীর নাম রসরাজ বাবু (৬০)। তিনি ওই হিমাগারে ১০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছেন। সেখানে পাকা রসিদ ছাড়া মোবাইল ফোনে দাম নির্ধারণ করে আলু বিক্রি করছিলেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিদর্শনকালে ব্যবসায়ী রসরাজ বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদে তার কথায় অসংগতি পাওয়া যায়। পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পরে গতকাল বিকেলে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তা, কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মহাপরিচালক বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আলুর বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এ সময় তিনি সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, হিমাগারের মজুদদারদের জন্যই আলুর বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হবে।
মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপনের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ আসলাম খান, জেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল আজিজ, মুন্সীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদ-ই-হাসান তুহিন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুস সালাম ও জেলা হিমাগার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত কুমার মণ্ডল। এ ছাড়া জেলার ছয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, সরকার গত বৃহস্পতিবার আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৩৫-৩৬ টাকা ও হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭ বেঁধে দিয়েছে। তবে এ নিয়ম মানছেন না ব্যবসায়ীরা। গতকাল মুন্সীগঞ্জ শহর বাজার ঘুরে দেখা যায় খুচরা বাজারে ৪৪-৪৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। গ্রামের বাজার ও দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে।
সরকারের দাম বেঁধে দেওয়ার আগের দিন বুধবার মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে ৩৮ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হয়েছে। অথচ দুদিন ধরে হিমাগারে কোনো পাইকারি ক্রেতা আসছেন না। ব্যবসায়ীরাও আড়তে আলু পাঠাচ্ছেন না। গতকাল সকালে মুন্সীরহাট এলাকার সুলতান কোল্ড স্টোরেজ, মুক্তারপুর এলাকার রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজ, পঞ্চসার কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। হিমঘর থেকে আলু বের করে রাখলেও কোনো ক্রেতা ছিল না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতে আমরা যে আলু রাখি, সেগুলো প্রতি বছর মে মাসের পর হিমাগার থেকে বের করি। এবার আলুর সংকট থাকায়, এপ্রিল মাস থেকেই বের করা শুরু হয়েছে। এজন্য হিমাগারে আলুর সংকট রয়েছে। মজুদ রাখা আলু ২৫ থেকে ২৬ টাকা দরে বিক্রি করেছি। আমাদের মজুদকৃত আলু শেষ হয়ে যাওয়ার পর কৃষকদের কাছ থেকে চড়া দরে আলু কিনে রেখেছি। সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে গেলে কেজিতে ৮ থেকে ৯ টাকা করে লোকসান গুনতে হবে। এজন্য আমরা আলু বিক্রি করছি না। সরকারি লোকজন বেশি চাপাচাপি করলে এক সপ্তাহ আমরা আলু বিক্রি বন্ধ করে দেব।
জেলা প্রশাসক আবুজাফর রিপন বলেন, আলু বিক্রি বন্ধ রাখা এটি নীতিনৈতিকতার ব্যাপার। সবাই হয়তো এই কাজটি করবেন না। যারা করবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ভোক্তাদের আলুর চাহিদা রয়েছে ৯৫ হাজার ৮৮ টন। সেখানে উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৩ টন। জেলার ১৬০টি হিমাগারে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মজুদ ছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ১৮২ টন আলু।
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে আন্তঃসরকার সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করে। এতে শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষকতা পেশার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ছিল। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশ্বের ১০০টি দেশে শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে থাকে। অনেক দেশে দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালিত হয়। যেমন, ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। অস্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর মাসের শেষ শুক্রবার। শেষ শুক্রবার যদি ৩১ অক্টোবর হয়, তা হলে ৭ নভেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ভুটান শিক্ষক দিবস পালন করে ২ মে, ইন্দোনেশিয়া ২৫ নভেম্বর, মালয়েশিয়া ১৬ মে, ইরান ২ মে, ইরাক ১ মার্চ, আর্জেন্টিনা ১১ সেপ্টেম্বর, ব্রাজিল ১৫ অক্টোবর, চীন ১০ সেপ্টেম্বর, তাইওয়ান ২৮ সেপ্টেম্বর, থাইল্যান্ড ১৬ জানুয়ারি, সিঙ্গাপুর সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার দিবসটি পালন করে। ইউনেস্কো কর্র্তৃক নির্ধারিত এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘ÔThe teachers we need for the education we want : The global imperative to reverse the teacher shortage’। অর্থাৎ, ‘কাক্সিক্ষত শিক্ষা পেতে যেমন শিক্ষক চাই : শিক্ষক সংকট ঠেকাতে বৈশি^ক উদ্যোগ।’ প্রতিপাদ্যটি বেশ চমৎকার ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা যে ধরনের শিক্ষা চাই আমাদের সে ধরনের শিক্ষকই দরকার। তাই প্রথমত বুঝতে হবে যে আমরা আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিতে চাই। শিক্ষার যথাযথ বিকাশের কাজটি শিক্ষকদেরই। আর এর জন্য শিক্ষকদের হতে হবে দক্ষ ও যোগ্য। পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের যে ঘাটতি সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড ধরা হয়, তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। কিন্তু শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। শিক্ষকরা সমস্যায় থাকলে শিক্ষার গুণগত মান এবং কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাবনা করা যেতে পারে। প্রথমত শিক্ষকতা পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা না থাকার ফলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অনেকে আসতে চায় না এবং এভাবে চলতে থাকলে আগামীতেও আসতে চাইবে না। আমাদের এখনই সময় এসেছে, এই পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিক্ষকরা আগামীতেও যাতে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন বীমা, বিশেষ ঋণ সহায়তা দিয়ে পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন সুনির্দিষ্ট করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষকরা যেন বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন তা ভাবতে হবে। সময়ের সঙ্গে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের বেতনের মানদণ্ড মানসম্মত করতে হবে। দেখা যায়, শিক্ষকতা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পেশা হলেও দেশের মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না অন্য পেশার মতো এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নেই বলে। অথচ মেধাবীদেরই এ পেশায় বেশি বেশি আসার কথা ছিল। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হতো। শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা হলেও কার্যত এ পেশা অনেকটা অবহেলিত। অন্য পেশার মতো এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নেই। এ কারণে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না। তাই এ পেশার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষা খাত সময়ের সেরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ভারতের নোবেল বিজয়ী শিক্ষাবিদ কৈলাশ সত্যার্থী বলছেন, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুণ রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পেশায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা শিক্ষার উন্নয়নে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শিক্ষকদেরও বদলাতে হবে প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকরা কতটা পিছিয়ে সেটা দেশে মহামারী করোনা আসার পর আমরা লক্ষ করেছি। একজন শিক্ষক আজই আগামী দশকের সুযোগ ও সমস্যা মোকাবিলার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করছেন। ফলে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের আত্মোন্নয়নের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।
শিক্ষক সংকট ও শিক্ষকদের প্রমোশনজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেখা যায়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর শিক্ষক সংকট। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রমোশন যেন সোনার হরিণ। শত শত প্রধান শিক্ষকের পদ খালি পড়ে আছে। কিন্তু প্রমোশন নেই। সহকারী প্রধান শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রমোশন হলে সিনিয়র শিক্ষকদের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে প্রমোশন পাওয়ার সুযোগ হবে। প্রমোশন হলে কাজে গতি বাড়বে। তাছাড়া সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল, যথাসময়ে পদোন্নতি ইত্যাদির জটিলতা নিরসনেও কাজ করতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হলো শিক্ষার্থীদের জীবনের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি। এ স্তরে শিক্ষকরা যদি যোগ্য ও যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন হন, তাহলে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি মজবুত হবে। জ্ঞানে-মানে একটি শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে উঠবে। এজন্য প্রাথমিক স্তরে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আর শিক্ষার মান উন্নয়নে এখন এটা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। শিক্ষকতায় স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। সুতরাং, শিক্ষকদের প্রতিটি কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ইদানীং অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। যেমন: বছর শেষে ‘সেরা শিক্ষক’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই বছর সরকারের এটুআই ও গ্রামীণফোনের উদ্যোগে ‘সংকটে নেতৃত্বে’ শিরোনামে শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করেছে। শিক্ষকদের ক্লাসের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের থেকে মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষককে স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান সবাই সফলকাম হবে।
দাবি ছিল শিক্ষক দিবসটিকে সরকারিভাবে পালন করা। অবশেষে গত বছর প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে দিবসটি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। এর আগে এত দিন ধরে এ দিবসটি সরকারিভাবে পালিত হতো না। এখন থেকে পালিত হবে। এ বছর জাতীয় শিক্ষক দিবসের পরিবর্তে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনেরও উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই দিবসটি এখন সরকারিভাবে পালিত হলে শিক্ষকরা অবশ্যই নিজেদের সম্মানিত বোধ করবেন, যা তাদের জন্য বড় ধরনের একটা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষকতা একটি মহান ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। জাতি গঠনে শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের ওপর হামলা ও অপমানের ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে। পাশাপাশি বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নৈতিক ও আদর্শিক বিচ্যুতিও আমাদের সমানভাবে ব্যথিত করে। কারণ, শিক্ষকরাই জাতি গড়ার কারিগর। তারা যদি এমন হন তাহলে আমাদের কেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে, সে প্রশ্ন না উঠে পারে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষকতা পেশার যথাযথ মূল্যায়ন ও শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
লেখক : লেখক
ছুটির দিন নয়, এমনি একটা দিনে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হলাম সকাল ১০টার দিকে। ধারণা করলাম টাঙ্গাইল যেতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। কারণ ঢাকা-টাঙ্গাইলের পথে পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। শুধু পাঁচ ঘণ্টা নয়, আট ঘণ্টার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু যে জায়গাটা খুবই জটিলতাপূর্ণ সেই গাবতলী গিয়ে দেখলাম রাস্তা ফাঁকা আর কয়েকটি সাইনবোর্ড যেখানে লেখা ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’। খুবই নির্বিঘ্নে আমিন বাজার সেতু পার হয়ে গেলাম। ভাবলাম এর পরের জায়গাটা হচ্ছে সাভার বাসস্ট্যান্ড। ওখানে ঘণ্টাখানেক লাগবেই। কিন্তু রহস্যজনকভাবে দেখলাম সেখানেও একই সাইনবোর্ড ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’ এবং রাস্তা ফাঁকা। গেলাম নবীনগর সেখানেও একই অবস্থা, রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি চলছে কোথাও কোনো বাধা নেই। তিন ঘণ্টার মাথায় আমি টাঙ্গাইলের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। কী করে সম্ভব হলো! হঠাৎ মনে পড়ল এ হচ্ছে সদ্য নির্বাচিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র বন্ধুবর আনিসুল হক এবং প্রিয়ভাজন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের পদক্ষেপ।
এরপর ঈদের ছুটিতে টাঙ্গাইল যেতে খুব কষ্টভোগ করেছি। কিন্তু একবার ড্রাইভার জানাল, স্যার কালকে টাঙ্গাইল যেতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোনো ম্যাজিক হচ্ছে কি? ড্রাইভার বলল, হ্যাঁ, হচ্ছে। কালকে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বসবেন এবং তিনি সারা দেশের ট্রাফিক সিস্টেমের পরিস্থিতি দেখবেন। সত্যিকারের ম্যাজিক ঘটে গেল। ঈদের আগের দিন আড়াই ঘণ্টার মধ্যে মায়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। এই ঘটনাগুলোতে কি মনে হয়? আমরা পারি। শুধু প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটু হাল ধরা। কখনো হাল ধরেন মেয়র আনিসুল হক, কখনো জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান। কখনো বড় ধরনের সংকটে হাল ধরেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যথায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কিন্তু সমগ্র ব্যবস্থাটাকে একটা নিয়ন্ত্রণে আনা কি সম্ভব নয়? প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নতির ফলে এটা তো কোনো বিষয়ই নয়। কেমন করে বিষয় নয় তাও জানি।
প্রাচ্যদেশীয় লোকগুলো বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষ আইন মানতে চায় না। আইনের ব্যাপারে তাদের এক ধরনের ক্ষোভ আছে। কেন আইন মানব? এই জন্যই লাখ লাখ মামলার স্তূপ জমে ওঠে আদালতগুলোতে। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে জেলা শহরগুলোতে আদালতের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। এখন সেখানে ছয়তলা থেকে আটতলা পর্যন্ত ভবনে বিভিন্ন আদালত গড়ে তোলা হয়েছে। একটি জেলা শহরেও অনেক বিচারক রাখতে হচ্ছে এবং ছয় সাত এমনকি আটতলা ভবন নির্মাণ করতে হচ্ছে শুধু আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। দেশের স্বাধীনতা কি শুধু আদালত নির্মাণের কাজ করবে না কি মানুষে মানুষে সংঘাত কমিয়ে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনকারীর সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসবে?
আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখতাম একটা লোক ছোট্ট একটা গাড়ি চালিয়ে চলাচল করত। পাঁচ-ছয় গজ দূরের একটা জায়গায় যেতেন। একটু বড় হয়ে জেনেছি তিনি জেলার মুন্সেফ। বাসা থেকে আদালতে যান। তার চেহারা কখনো দেখিনি। কিন্তু একটা ছোট্ট এলাকায় তিনি এসব আইন আদালতের বিচার করেন। আর বাকিটা করেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেটাও খুব বড় কিছু নয়।
সম্প্রতি ব্যাংকের একজন ডিজিএমের স্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের একজন অফিসারের দ্বন্দ্ব হয়েছে। কারণ উনি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে গাড়ি পার্ক করেছিলেন। কিন্তু ডিজিএমের স্ত্রী বলছেন তিনি আইন ভঙ্গ করেননি। তার নামতে যতটুকু সময় লেগেছে ততটুকু সময়ই তিনি নিয়েছেন। এসব ব্যাপারে অনেক বাহাস হতে পারে, কে ভুল আর কে ঠিক? কিন্তু ট্রাফিক আইন তো মানতে হবে। যেখানে ট্রাফিক আইন সম্পূর্ণভাবে যন্ত্র বিবর্জিত আধুনিককালে সমস্ত ব্যবস্থা উপেক্ষিত, যে শহরে সবুজ, হলুদ এবং লালবাতির সংকেত জ¦লে না সেই শহরে ট্রাফিক আইন কী করে বাস্তবায়ন করা যায়? অধিকাংশ সময়ে হস্ত নির্দেশিত ট্রাফিক সিগন্যাল দেখা যায় অথবা নির্দেশকারী একেবারেই তার অভিজ্ঞতাপ্রসূত ট্রাফিক সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছেন। তখন তা মেনে চলাও কি নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকাবাসী এই যে আদিম অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে তার জন্য তাদের কোনো আক্ষেপ নেই?
স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যেটা ছিল আমাদের একটা আদর্শ ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থাকে কেমন করে ধ্বংস করা হলো তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। স্কুলের ওই শিশুরা মন্ত্রীদের, পুলিশ অফিসারদের হাঁটতে বাধ্য করেছিল। তারা ওই ব্যবস্থাকে কিন্তু মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের রাজনীতিবিদদের কি করে বোঝাব সব কিছু রাজনৈতিক করবেন না! সব কিছুকে রাজনৈতিক করতে গেলে অনেক বড় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। দয়া করে শিক্ষাকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। দুর্নীতিকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। শিক্ষাকে রাজনীতি করতে গেলে কীভাবে দুর্নীতি এসে যায় সেটা আপনারা জানেন। তদবিরে নিয়োগ বাণিজ্যের লাখ লাখ টাকায় শুধু কিছু অশিক্ষিত লোকরা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়ে তারা শিশুদের মননকে যে কীভাবে ধ্বংস করে দেয় তা রাজনীতিকরা একটিবারও ভাবেন না।
ঢাকা শহরের নাগরিকরা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে তেমন কিছু বলেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও কিছু বলেন না। প্রথমটায় বলেন না তার কারণ রিকশায় চড়তে তারা খুবই আনন্দ পান এবং অনেক শিক্ষিত লোককে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে রিকশায় করে রাস্তার রংসাইড দিয়ে ঢুকে পড়েন তারা রিকশাচালককে মানা তো করেনই না, অনেক সময় উৎসাহ এমনকি রংসাইডে ঢুকে পড়ার পরামর্শও দেন। আমি এই প্রসঙ্গে তেমন বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ শহরগুলোতে গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক দূর হেঁটে এসে তারা যে গণপরিবহনে চড়ার একটা সুবন্দোবস্ত পাবেন, সেই ব্যবস্থা আমরা রাখতে পারিনি। পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় শহরে নাগরিকদের অনেক পথ হাঁটতে হয়। কারণ তারা গণপরিবহনে উঠবেন হেঁটেই, কাজেই তাদের স্বাস্থ্যও অত্যন্ত ভালো থাকে। এ দেশেও হয়তো রিকশা বন্ধ করে দিলে মধ্যবিত্তদের একটা আন্দোলনও শুরু হয়ে যাবে। যার নাম হবে অলস বাঙালিদের আন্দোলন।
কিন্তু আবার এও দেখেছি, উত্তরা বা মিরপুরের নাগরিকরা খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্রেনে উঠছেন। কিন্তু ধানম-িবাসীর কী হবে? এখানে তো গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই, একমাত্র বাসই ভরসা। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একই ব্যবস্থা। তাদের জন্যও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব সমস্যা মিলে রাষ্ট্রের বায়ান্ন বছর হয়ে গেল, কোনো সুশৃঙ্খল আধুনিক গণপরিবহনের ব্যবস্থা হলো না। অতএব যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে আমাদের নগরগুলোতে সামান্য বৃষ্টি হলে ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় পানি জমে যায়। সেখানে তখন মানুষ মারা পড়বে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এটার কোনো দায়দায়িত্বও নেবে না? দুটি সিটি করপোরেশন নিবিড় ঘুমে রাত্রিযাপন করবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে একটি মন্ত্রণালয় আছে। তারা বৃষ্টিতে ঘুম উপভোগ করবে আর মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বিপদসঙ্কুল সময় অতিক্রম করবে। এসব সমস্যা দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু এর যে সমাধান সম্ভব তা কিন্তু অনেকেই জানেন না। আনিসুল হক জানতেন। ঢাকার বর্তমান মেট্রোপলিটন কমিশনার হাবিবুর রহমান জানেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জানেন। জানেন অনেক নাগরিক। কিন্তু সমস্যা সমাধানের সুযোগ অত্যন্ত কম। তাদের ক্ষমতা যদি বাড়ানো যায় তাহলে অনেক কিছু ঘটানো সম্ভব। সেই দিকটায় আমরা কি যেতে পারি? লেখক: নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট
‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০২০ সালে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা (এমপি)। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় তালিকা অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাদের চাহিদার পরিবর্তন আনেন। তারা ইউনিয়ন পর্যায়ে রাস্তা না করে সেতু তৈরির ওপর জোর দেন। কিছু ক্ষেত্রে খাতভিত্তিক ব্যয় না চেয়ে থোক বরাদ্দও চাওয়া হয়েছিল। চাহিদার জটিলতায় ধীরগতিতে চলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। ঠিক সময়ে প্রকল্পটি শেষ করতে না পারার শঙ্কায় ফের সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
যদিও একই রকম আরেকটি প্রকল্পের কাজ তখনো চলমান ছিল। চলমান একটি প্রকল্প শেষ না হতেই সংসদ সদস্যদের জন্য আরেকটি প্রকল্প নিয়ে তখন বেশ আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছিল।
প্রকল্প-৩-এর মেয়াদ আছে আর এক বছর। অথচ কাজ চলছে ঢিমেতালে। নির্বাচনের আগে তাদের চাহিদার পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের পর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। এর বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৪১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে প্রত্যেক সংসদ সদস্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে বছরে পাঁচ কোটি টাকা করে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়।
প্রতি বছর পাঁচ কোটি করে চার বছরে এ অর্থে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা তাদের। সিটি করপোরেশন এলাকার ২০ সংসদ সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যরা এ বরাদ্দের বাইরে রয়েছেন।
নিজ এলাকার উন্নয়নে এমন সুযোগ পেলেও সংসদ সদস্যরা কাজে লাগাতে পারেননি। প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়ন অর্ধেকেরও কম হয়েছে। অধিকাংশ সংসদ সদস্যই তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিন্তু তারা বলছেন, যে চাহিদা তারা দিয়েছিলেন তার অধিকাংশ পেয়েছেন।
জানতে চাইলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার আসনে যেসব চাহিদা দিয়েছিলাম সবগুলোই পেয়েছি। কিন্তু এ মুহূর্তে এসে বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৪১ শতাংশ বলা হচ্ছে, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরিকল্পনা কমিশনে কীসের ভিত্তিতে এই সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা জানি না।’
সংসদ সদস্যরা যে চাহিদা পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন সে বিষয়ে ইনু বলেন, ‘কোনো এমপি চাহিদা পরিবর্তন করার কথা নয়। আমার এলাকায় যা চেয়েছি তাই তো পুরোটা তারা দিতে পারেননি। প্রতি বছর পাঁচ কোটির বরাদ্দ, তার বাইরে তো তারা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।’ পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। পিইসি সভায় প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন খানের কাছে সংশোধনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। সেখানে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে বেশ কিছু সড়ক ও সেতু-কালভার্ট নতুনভাবে নির্মাণের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত স্কিমগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। স্কিমগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রয়োজন।
পিইসি সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, এ বিষয়ে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. ছায়েদুজ্জামান বলেন, যেসব স্কিম অতীব জনগুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর যৌক্তিকতাসহ সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে, নতুনভাবে গৃহীত স্কিমগুলো বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকার কম করতে হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তৃতীয় দফার এ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে উপজেলা সড়ক নির্মাণ করা হবে ৩০৫ দশমিক ২১ কিলোমিটার। ইউনিয়ন সড়ক নির্মাণ করা হবে ৬৬০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার। গ্রাম সড়ক উন্নয়ন হবে ৫ হাজার ৭৫ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ হবে ১ হাজার ৯০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়কে ১০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যরে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ৭ হাজার ৯৯২ দশমিক ২২ মিটার।
এসব প্রস্তাব সংসদ সদস্যদের চাহিদার ভিত্তিতেই করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় ফের বাদ সাধেন তারাই। পরে মূল প্রকল্প প্রস্তাব থেকে প্রস্তাবিত প্রথম সংশোধনে ১৯৩ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক, ৮৩ দশমিক ৯১ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক, ৫০৫ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার গ্রাম সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম বাদ দেওয়ার আবদার করেছেন তারা। এর বিপরীতে ৩৯২ দশমিক শূন্য ১ কিলোমিটার গ্রাম সড়ক ও ২ হাজার ৬৭৪ দশমিক ৫১ মিটার সেতু-কালভার্টের প্রস্তাব এসেছে তাদের কাছ থেকে। সে অনুযায়ী সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা চিন্তা করেছি এ রাস্তাটি আজকে করব, কিন্তু দেখা গেল অন্য কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে এ রাস্তাটি হয়ে গেছে। এমপিরা যেভাবে ডিও দেন প্রকল্পটি সেভাবে চলে, আমাদের ফ্রেমওয়ার্কটিই সেভাবে তৈরি করা।’
এ মুহূর্তে প্রকল্পটি সংশোধনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে পরিবেশের জন্য ড্রেনেজ সুবিধা রাখতে হবে। একটি রাস্তা করতে গিয়ে দেখা গেল, একটি কালভার্ট বা সেতুর প্রয়োজন হয়েছে। এটি এখন প্রথম প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার)। এটি প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন হিসেবে কাজ করছে।’
বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণ হিসেবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘যখন প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছিল তখন করোনা মহামারী ছিল। করোনার কারণে প্রকল্পটির কাজ দেরিতে শুরু হয়েছিল, যার ফলে এ মুহূর্তে বাস্তবায়ন অগ্রগতি এ পর্যায়ে এসেছে।
পিইসি সভায় সংশোধনের কারণ জানতে চাওয়া হলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ১১তম জাতীয় সংসদ সদস্যদের প্রাথমিক চাহিদাপত্র (ডিও) গ্রহণ করে স্কিমের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিশেষ পরিস্থিতি ও অগ্রাধিকার ক্রমপরিবর্তনের ফলে আরডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত স্কিম তালিকা পরিবর্তন করে ডিওর মাধ্যমে সংশোধিত নতুন স্কিম তালিকা করা হয়েছে। পরিবর্তিত স্কিম তালিকা অনুযায়ী গ্রাম সড়ক ও সেতু-কালভার্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উপজেলা-ইউনিয়ন সড়কের পরিমাণ কমেছে।
এ প্রকল্পের তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা যায়, এতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৭৫ কিলোমিটারের গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নের জন্য। এতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা। ৬৬০ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২৮ কোটি টাকা, ৩০৫ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক উন্নয়নের জন্য ২৯০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। তা ছাড়া ১ হাজার ৯০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক সংরক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৮১ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠনের পর প্রত্যেক সংসদ সদস্য নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকা করে পেয়েছিলেন। সে সময় প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৮৯২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এটি ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১৬ সালের জুনে শেষ হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্যদের ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যায়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ৭৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়ন হয়েছে। এ প্রকল্পটি শেষ না করেই তৃতীয় মেয়াদে আবার ২০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়। এই উদ্যোগের কারণে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় প্রশ্নের মুখে পড়ে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রকল্পের আওতায় সংসদ সদস্যরা সরাসরি টাকা পাবেন না। তারা শুধু তাদের নির্বাচনী আসনে পছন্দ মোতাবেক প্রকল্পের নাম দেবেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আবার সরকারকে বলব, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি ভালো হয় না। যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিন। নাগরিক হিসেবে তাকে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া হোক। তা না হলে একজন গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় প্রবীণ নাগরিকের প্রতি বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণের জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।’
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন।
ফখরুল বলেন, ‘সুচিকিৎসা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বেগম জিয়া দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন। সংবিধান তার বেঁচে থাকার জন্য চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করেছে। যে রোগের চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়, সামর্থ্য অনুযায়ী দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া সংবিধানকে অবজ্ঞা করা। দেশনেত্রীকে চিকিৎসা-সুরক্ষার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যা অন্যায়। এটা অমানবিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আইনের দোহাই দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত রাখার সুযোগ নেই। সরকার হীন উদ্দেশ্যে আইনের দোহাই দিয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
চেয়ারপারসনের চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনার (খালেদা জিয়া) যারা চিকিৎসা করছেন এটা তাদের বিষয়। চিকিৎসকরা তার বেস্ট ট্রিটমেন্ট করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। আমরা তো জোর করে তাকে নিয়ে যেতে পারব না বিদেশে। আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। আমরা যা আছে সে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করে যাব। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হবে এবং খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে।’
ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খন্ডন করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সত্য হলো, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দন্ডপ্রাপ্ত আসামি তৎকালীন জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে ১/১১’র সরকার ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও আছে। শেখ হাসিনাও এমন সুযোগ (বিদেশে চিকিৎসা) নিয়েছেন ২০০৮ সালে। জরুরি আইনের সরকারের সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি চাঁদাবাজির মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। ওই অবস্থায় নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হলে তিনি দুই/তিনদিনের মধ্যে বিদেশে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। তিনি বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছিলেন একজন ওয়ারেন্টি আসামি হিসেবে; প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়েছিলেন। সুতরাং আইনের দোহাই দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই।’
আপনারা এ অবস্থায় কি গণতান্ত্রিক পথে হাঁটবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রের বাইরে যেতে পারি না। এরপরও যদি কেউ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা দেয় সে বাধাও আমরা গণতান্ত্রিকভাবে অতিক্রম করব। তার (শেখ হাসিনা) বক্তব্য তো আপনারা শুনেছেন। উনি তো বিদেশে যেতে দেবেন না বলেছেন। তারপরও আমরা আপিল করছি শুভবুদ্ধির কাছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তার (খালেদা জিয়ার) পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শর্তসাপেক্ষে উনি বিদেশে যাবেন না।’
খালেদা জিয়াকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে নির্বাচনে যাবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। বেগম জিয়াকে এ অবস্থায় রেখে, হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আমাদের পরিষ্কার কথা।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু উপস্থিত ছিলেন।
দুর্গাপূজার আগে পরে সরকারকে আলটিমেটাম দেবে বিএনপি : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একদফার আন্দোলনের শেষ ধাপে সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা দল বিএনপি। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজার আগে বা পরে এই আলটিমেটাম ঘোষণার সিদ্ধান্ত থাকলেও পূজার কয়েকদিন কর্মসূচি রাখবে না দলটি। এর আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বিএনপির রোডমার্চ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে বিএনপি। সেটি না হলে প্রথম ধাপের কর্মসূচি শেষে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে আলটিমেটাম দেওয়ার আগে চূড়ান্ত ধাপের আংশিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এর আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে যুগপতের শরিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করা হবে। তাদের দেওয়া বিভিন্ন প্রস্তাবনা সমন্বয় করে আন্দোলন পরিকল্পনা প্রণয়ন চূড়ান্ত হবে। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে ওই সভায় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা অংশ নেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা একদফার আন্দোলনে রয়েছি। প্রতিদিনই আমাদের কর্মসূচি থাকছে। নতুন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা সরকারকে আর সময় দিতে চাই না। এবারের কর্মসূচি হবে রাজধানীকেন্দ্রিক। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়েই সরকার পতন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে।’
বৈঠক সূত্রগুলো বলছে, প্রথম ধাপের কর্মসূচি শেষে ৭ অক্টোবর থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি শুরু হতে পারে। এর এক পর্যায়ে ১৮ অক্টোবরের দিকে সরকারকে পদত্যাগে আলটিমেটাম ঘোষণা করা হতে পারে। এর আগ পর্যন্ত রাজধানীর পাশাপাশি বাইরেও কিছু কর্মসূচি হবে। তবে আলটিমেটামের পর সব কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক। তখন সারা দেশের নেতাকর্মীদের রাজধানীর কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার নির্দেশনা দেবে বিএনপি।
জানা গেছে, চলতি অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একদফার যুগপৎ আন্দোলন বেগবান করার আগে যুব ও ছাত্র কনভেনশন করবে বিএনপি। ছাত্র কনভেনশনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের বটতলায় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এজন্য গত ২৯ সেপ্টেম্বর ১৫টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য’র আত্মপ্রকাশ হয়েছে। একদফার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পৃক্ত করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দলটির নেতারা মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে পারলে চূড়ান্ত সফলতা আরও সহজ হবে। এছাড়াও যুব কনভেনশন সফল করতে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের সমন্বয়ে শিগগির ‘যুব ঐক্যজোট’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, ১৮ অক্টোবরের আগেই পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এবং প্রধান নির্বাচন কমিশন (সিইসি) বরাবর স্মারকলিপি দিতে পারে বিএনপি। স্মারকলিপিতে পুলিশকে চলমান হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার বন্ধ এবং ইসিকে সম্ভাব্য একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ না নেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা করতে পারেন, সেজন্য আগামী ২০ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত পূজা চলাকালীন বড় কোনো কর্মসূচি রাখবে না যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো।
সূত্রগুলো বলছে, সরকার আলটিমেটাম মেনে পদত্যাগ না করলে, দুর্গাপূজার পরে ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে আলটিমেটামের কর্মসূচি শুরু হবে। এই আন্দোলনের শুরুতেই সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরপর পর্যায়ক্রমে গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাওসহ টানা অবস্থান কর্মসূচিতে যেতে পারে তারা। পাশাপাশি রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। একেবারে বাধ্য না হলে হরতালের মতো কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি।
থাইগ্লাস আর লাল ইটে চকচক করছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতাল ভবন। কার্যক্রম পরিচালনায় রুটিন করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের। অথচ ভবনটির ভেতরে চিকিৎসা-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির অস্তিত্ব নেই। নেই চেয়ার-টেবিল ও অন্যান্য আসবাব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালে ৫ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করে একটি ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালের অনুমোদন দেওয়া হয়। ঢাকাবাসীর গৃহপালিত বিভিন্ন পশুপাখির চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে হাতে-কলমে এ বিষয়ে ধারণা পান, সে উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়।
নানা জটিলতা পেরিয়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আর ২০২৩ সালের মে মাসে ঘটা করে উদ্বোধন করা হয় হাসপাতালটির। এতে দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হলো বলে দাবি করা হয়। উদ্বোধনের পর প্রায় ৫ মাস পার হয়ে গেছে; হাসপাতালে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি নেই।
সরজমিনে দেখা গেছে, তিনতলাবিশিষ্ট ভবনের কোনো রুমেই চিকিৎসার যন্ত্রপাতি বলতে গেলে নেই; চেয়ার-টেবিল বা অন্যান্য আসবাবও নেই। নিচতলায় গেটের সামনে প্যাকেট করা কিছু চেয়ারের পাশে বসে আছেন গার্ড। প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো স্যার (ডাক্তার) বসেন না। কেউ সেবা নিতে এলে স্যারদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করিয়ে দিই। স্যারেরা তাদের শেখ কামাল ভবনে নিয়ে সেবা দেন।’
হাসপাতালে সেবার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীরা যেমন ব্যবহারিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসীও। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, তাহলে কী কাজে লাগছে ৫ কোটি টাকার এ ভবন?
সংশ্লিষ্ট অনুষদের একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০১২ সাল থেকে অ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে একটি প্রাণী হাসপাতালের দাবি করা হচ্ছে। বরাদ্দ হলেও অজানা কারণে এগোয় না কাজ। এক যুগের বেশি সময় পর স্থাপনা হলেও কোনো সরঞ্জাম সেখানে নেই। এভাবেই চলবে; এই হাসপাতাল কখনো কর্মচঞ্চল হবে না। কারণ এই অনুষদের বেশিরভাগ শিক্ষক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো বেসরকারি পশুক্লিনিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তারা চান না হাসপাতালটি জনপ্রিয় হোক।
হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. কে বি এম সাইফুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগের যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যাওয়ায় আমাদের এ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নেই। বিভাগের যন্ত্রপাতি দিয়ে কোনোমতে কাজ চালাচ্ছি। নতুন যন্ত্রপাতি, আসবাব আর লোকবল পেলে হাসপাতাল পুরোদমে চালু হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কোনো ক্লিনিকে কাজ করা বাধা হবে না।’
যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. মোমেনুল আহসানের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে আন্তঃসরকার সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করে। এতে শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষকতা পেশার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ছিল। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশ্বের ১০০টি দেশে শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে থাকে। অনেক দেশে দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালিত হয়। যেমন, ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। অস্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর মাসের শেষ শুক্রবার। শেষ শুক্রবার যদি ৩১ অক্টোবর হয়, তা হলে ৭ নভেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ভুটান শিক্ষক দিবস পালন করে ২ মে, ইন্দোনেশিয়া ২৫ নভেম্বর, মালয়েশিয়া ১৬ মে, ইরান ২ মে, ইরাক ১ মার্চ, আর্জেন্টিনা ১১ সেপ্টেম্বর, ব্রাজিল ১৫ অক্টোবর, চীন ১০ সেপ্টেম্বর, তাইওয়ান ২৮ সেপ্টেম্বর, থাইল্যান্ড ১৬ জানুয়ারি, সিঙ্গাপুর সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার দিবসটি পালন করে। ইউনেস্কো কর্র্তৃক নির্ধারিত এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘ÔThe teachers we need for the education we want : The global imperative to reverse the teacher shortage’। অর্থাৎ, ‘কাক্সিক্ষত শিক্ষা পেতে যেমন শিক্ষক চাই : শিক্ষক সংকট ঠেকাতে বৈশি^ক উদ্যোগ।’ প্রতিপাদ্যটি বেশ চমৎকার ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা যে ধরনের শিক্ষা চাই আমাদের সে ধরনের শিক্ষকই দরকার। তাই প্রথমত বুঝতে হবে যে আমরা আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিতে চাই। শিক্ষার যথাযথ বিকাশের কাজটি শিক্ষকদেরই। আর এর জন্য শিক্ষকদের হতে হবে দক্ষ ও যোগ্য। পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের যে ঘাটতি সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড ধরা হয়, তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। কিন্তু শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। শিক্ষকরা সমস্যায় থাকলে শিক্ষার গুণগত মান এবং কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাবনা করা যেতে পারে। প্রথমত শিক্ষকতা পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা না থাকার ফলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অনেকে আসতে চায় না এবং এভাবে চলতে থাকলে আগামীতেও আসতে চাইবে না। আমাদের এখনই সময় এসেছে, এই পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিক্ষকরা আগামীতেও যাতে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন বীমা, বিশেষ ঋণ সহায়তা দিয়ে পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন সুনির্দিষ্ট করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষকরা যেন বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন তা ভাবতে হবে। সময়ের সঙ্গে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের বেতনের মানদণ্ড মানসম্মত করতে হবে। দেখা যায়, শিক্ষকতা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পেশা হলেও দেশের মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না অন্য পেশার মতো এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নেই বলে। অথচ মেধাবীদেরই এ পেশায় বেশি বেশি আসার কথা ছিল। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হতো। শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা হলেও কার্যত এ পেশা অনেকটা অবহেলিত। অন্য পেশার মতো এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নেই। এ কারণে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না। তাই এ পেশার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষা খাত সময়ের সেরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ভারতের নোবেল বিজয়ী শিক্ষাবিদ কৈলাশ সত্যার্থী বলছেন, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুণ রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পেশায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা শিক্ষার উন্নয়নে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শিক্ষকদেরও বদলাতে হবে প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকরা কতটা পিছিয়ে সেটা দেশে মহামারী করোনা আসার পর আমরা লক্ষ করেছি। একজন শিক্ষক আজই আগামী দশকের সুযোগ ও সমস্যা মোকাবিলার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করছেন। ফলে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের আত্মোন্নয়নের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।
শিক্ষক সংকট ও শিক্ষকদের প্রমোশনজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেখা যায়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর শিক্ষক সংকট। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রমোশন যেন সোনার হরিণ। শত শত প্রধান শিক্ষকের পদ খালি পড়ে আছে। কিন্তু প্রমোশন নেই। সহকারী প্রধান শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রমোশন হলে সিনিয়র শিক্ষকদের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে প্রমোশন পাওয়ার সুযোগ হবে। প্রমোশন হলে কাজে গতি বাড়বে। তাছাড়া সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল, যথাসময়ে পদোন্নতি ইত্যাদির জটিলতা নিরসনেও কাজ করতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হলো শিক্ষার্থীদের জীবনের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি। এ স্তরে শিক্ষকরা যদি যোগ্য ও যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন হন, তাহলে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি মজবুত হবে। জ্ঞানে-মানে একটি শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে উঠবে। এজন্য প্রাথমিক স্তরে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আর শিক্ষার মান উন্নয়নে এখন এটা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। শিক্ষকতায় স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। সুতরাং, শিক্ষকদের প্রতিটি কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ইদানীং অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। যেমন: বছর শেষে ‘সেরা শিক্ষক’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই বছর সরকারের এটুআই ও গ্রামীণফোনের উদ্যোগে ‘সংকটে নেতৃত্বে’ শিরোনামে শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করেছে। শিক্ষকদের ক্লাসের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের থেকে মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষককে স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান সবাই সফলকাম হবে।
দাবি ছিল শিক্ষক দিবসটিকে সরকারিভাবে পালন করা। অবশেষে গত বছর প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে দিবসটি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। এর আগে এত দিন ধরে এ দিবসটি সরকারিভাবে পালিত হতো না। এখন থেকে পালিত হবে। এ বছর জাতীয় শিক্ষক দিবসের পরিবর্তে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনেরও উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই দিবসটি এখন সরকারিভাবে পালিত হলে শিক্ষকরা অবশ্যই নিজেদের সম্মানিত বোধ করবেন, যা তাদের জন্য বড় ধরনের একটা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষকতা একটি মহান ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। জাতি গঠনে শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের ওপর হামলা ও অপমানের ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে। পাশাপাশি বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নৈতিক ও আদর্শিক বিচ্যুতিও আমাদের সমানভাবে ব্যথিত করে। কারণ, শিক্ষকরাই জাতি গড়ার কারিগর। তারা যদি এমন হন তাহলে আমাদের কেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে, সে প্রশ্ন না উঠে পারে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষকতা পেশার যথাযথ মূল্যায়ন ও শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
লেখক : লেখক
ছুটির দিন নয়, এমনি একটা দিনে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হলাম সকাল ১০টার দিকে। ধারণা করলাম টাঙ্গাইল যেতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। কারণ ঢাকা-টাঙ্গাইলের পথে পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। শুধু পাঁচ ঘণ্টা নয়, আট ঘণ্টার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু যে জায়গাটা খুবই জটিলতাপূর্ণ সেই গাবতলী গিয়ে দেখলাম রাস্তা ফাঁকা আর কয়েকটি সাইনবোর্ড যেখানে লেখা ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’। খুবই নির্বিঘ্নে আমিন বাজার সেতু পার হয়ে গেলাম। ভাবলাম এর পরের জায়গাটা হচ্ছে সাভার বাসস্ট্যান্ড। ওখানে ঘণ্টাখানেক লাগবেই। কিন্তু রহস্যজনকভাবে দেখলাম সেখানেও একই সাইনবোর্ড ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’ এবং রাস্তা ফাঁকা। গেলাম নবীনগর সেখানেও একই অবস্থা, রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি চলছে কোথাও কোনো বাধা নেই। তিন ঘণ্টার মাথায় আমি টাঙ্গাইলের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। কী করে সম্ভব হলো! হঠাৎ মনে পড়ল এ হচ্ছে সদ্য নির্বাচিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র বন্ধুবর আনিসুল হক এবং প্রিয়ভাজন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের পদক্ষেপ।
এরপর ঈদের ছুটিতে টাঙ্গাইল যেতে খুব কষ্টভোগ করেছি। কিন্তু একবার ড্রাইভার জানাল, স্যার কালকে টাঙ্গাইল যেতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোনো ম্যাজিক হচ্ছে কি? ড্রাইভার বলল, হ্যাঁ, হচ্ছে। কালকে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বসবেন এবং তিনি সারা দেশের ট্রাফিক সিস্টেমের পরিস্থিতি দেখবেন। সত্যিকারের ম্যাজিক ঘটে গেল। ঈদের আগের দিন আড়াই ঘণ্টার মধ্যে মায়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। এই ঘটনাগুলোতে কি মনে হয়? আমরা পারি। শুধু প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটু হাল ধরা। কখনো হাল ধরেন মেয়র আনিসুল হক, কখনো জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান। কখনো বড় ধরনের সংকটে হাল ধরেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যথায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কিন্তু সমগ্র ব্যবস্থাটাকে একটা নিয়ন্ত্রণে আনা কি সম্ভব নয়? প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নতির ফলে এটা তো কোনো বিষয়ই নয়। কেমন করে বিষয় নয় তাও জানি।
প্রাচ্যদেশীয় লোকগুলো বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষ আইন মানতে চায় না। আইনের ব্যাপারে তাদের এক ধরনের ক্ষোভ আছে। কেন আইন মানব? এই জন্যই লাখ লাখ মামলার স্তূপ জমে ওঠে আদালতগুলোতে। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে জেলা শহরগুলোতে আদালতের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। এখন সেখানে ছয়তলা থেকে আটতলা পর্যন্ত ভবনে বিভিন্ন আদালত গড়ে তোলা হয়েছে। একটি জেলা শহরেও অনেক বিচারক রাখতে হচ্ছে এবং ছয় সাত এমনকি আটতলা ভবন নির্মাণ করতে হচ্ছে শুধু আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। দেশের স্বাধীনতা কি শুধু আদালত নির্মাণের কাজ করবে না কি মানুষে মানুষে সংঘাত কমিয়ে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনকারীর সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসবে?
আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখতাম একটা লোক ছোট্ট একটা গাড়ি চালিয়ে চলাচল করত। পাঁচ-ছয় গজ দূরের একটা জায়গায় যেতেন। একটু বড় হয়ে জেনেছি তিনি জেলার মুন্সেফ। বাসা থেকে আদালতে যান। তার চেহারা কখনো দেখিনি। কিন্তু একটা ছোট্ট এলাকায় তিনি এসব আইন আদালতের বিচার করেন। আর বাকিটা করেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেটাও খুব বড় কিছু নয়।
সম্প্রতি ব্যাংকের একজন ডিজিএমের স্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের একজন অফিসারের দ্বন্দ্ব হয়েছে। কারণ উনি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে গাড়ি পার্ক করেছিলেন। কিন্তু ডিজিএমের স্ত্রী বলছেন তিনি আইন ভঙ্গ করেননি। তার নামতে যতটুকু সময় লেগেছে ততটুকু সময়ই তিনি নিয়েছেন। এসব ব্যাপারে অনেক বাহাস হতে পারে, কে ভুল আর কে ঠিক? কিন্তু ট্রাফিক আইন তো মানতে হবে। যেখানে ট্রাফিক আইন সম্পূর্ণভাবে যন্ত্র বিবর্জিত আধুনিককালে সমস্ত ব্যবস্থা উপেক্ষিত, যে শহরে সবুজ, হলুদ এবং লালবাতির সংকেত জ¦লে না সেই শহরে ট্রাফিক আইন কী করে বাস্তবায়ন করা যায়? অধিকাংশ সময়ে হস্ত নির্দেশিত ট্রাফিক সিগন্যাল দেখা যায় অথবা নির্দেশকারী একেবারেই তার অভিজ্ঞতাপ্রসূত ট্রাফিক সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছেন। তখন তা মেনে চলাও কি নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকাবাসী এই যে আদিম অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে তার জন্য তাদের কোনো আক্ষেপ নেই?
স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যেটা ছিল আমাদের একটা আদর্শ ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থাকে কেমন করে ধ্বংস করা হলো তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। স্কুলের ওই শিশুরা মন্ত্রীদের, পুলিশ অফিসারদের হাঁটতে বাধ্য করেছিল। তারা ওই ব্যবস্থাকে কিন্তু মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের রাজনীতিবিদদের কি করে বোঝাব সব কিছু রাজনৈতিক করবেন না! সব কিছুকে রাজনৈতিক করতে গেলে অনেক বড় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। দয়া করে শিক্ষাকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। দুর্নীতিকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। শিক্ষাকে রাজনীতি করতে গেলে কীভাবে দুর্নীতি এসে যায় সেটা আপনারা জানেন। তদবিরে নিয়োগ বাণিজ্যের লাখ লাখ টাকায় শুধু কিছু অশিক্ষিত লোকরা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়ে তারা শিশুদের মননকে যে কীভাবে ধ্বংস করে দেয় তা রাজনীতিকরা একটিবারও ভাবেন না।
ঢাকা শহরের নাগরিকরা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে তেমন কিছু বলেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও কিছু বলেন না। প্রথমটায় বলেন না তার কারণ রিকশায় চড়তে তারা খুবই আনন্দ পান এবং অনেক শিক্ষিত লোককে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে রিকশায় করে রাস্তার রংসাইড দিয়ে ঢুকে পড়েন তারা রিকশাচালককে মানা তো করেনই না, অনেক সময় উৎসাহ এমনকি রংসাইডে ঢুকে পড়ার পরামর্শও দেন। আমি এই প্রসঙ্গে তেমন বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ শহরগুলোতে গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক দূর হেঁটে এসে তারা যে গণপরিবহনে চড়ার একটা সুবন্দোবস্ত পাবেন, সেই ব্যবস্থা আমরা রাখতে পারিনি। পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় শহরে নাগরিকদের অনেক পথ হাঁটতে হয়। কারণ তারা গণপরিবহনে উঠবেন হেঁটেই, কাজেই তাদের স্বাস্থ্যও অত্যন্ত ভালো থাকে। এ দেশেও হয়তো রিকশা বন্ধ করে দিলে মধ্যবিত্তদের একটা আন্দোলনও শুরু হয়ে যাবে। যার নাম হবে অলস বাঙালিদের আন্দোলন।
কিন্তু আবার এও দেখেছি, উত্তরা বা মিরপুরের নাগরিকরা খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্রেনে উঠছেন। কিন্তু ধানম-িবাসীর কী হবে? এখানে তো গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই, একমাত্র বাসই ভরসা। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একই ব্যবস্থা। তাদের জন্যও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব সমস্যা মিলে রাষ্ট্রের বায়ান্ন বছর হয়ে গেল, কোনো সুশৃঙ্খল আধুনিক গণপরিবহনের ব্যবস্থা হলো না। অতএব যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে আমাদের নগরগুলোতে সামান্য বৃষ্টি হলে ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় পানি জমে যায়। সেখানে তখন মানুষ মারা পড়বে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এটার কোনো দায়দায়িত্বও নেবে না? দুটি সিটি করপোরেশন নিবিড় ঘুমে রাত্রিযাপন করবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে একটি মন্ত্রণালয় আছে। তারা বৃষ্টিতে ঘুম উপভোগ করবে আর মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বিপদসঙ্কুল সময় অতিক্রম করবে। এসব সমস্যা দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু এর যে সমাধান সম্ভব তা কিন্তু অনেকেই জানেন না। আনিসুল হক জানতেন। ঢাকার বর্তমান মেট্রোপলিটন কমিশনার হাবিবুর রহমান জানেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জানেন। জানেন অনেক নাগরিক। কিন্তু সমস্যা সমাধানের সুযোগ অত্যন্ত কম। তাদের ক্ষমতা যদি বাড়ানো যায় তাহলে অনেক কিছু ঘটানো সম্ভব। সেই দিকটায় আমরা কি যেতে পারি? লেখক: নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।