
প্রায় তিন মাস আগে অতিরিক্ত আইজিপি থেকে পুলিশ সুপার পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। কিন্তু এই সময়েও পদোন্নতির বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। উল্টো পুলিশের দেওয়া তালিকা কাটছাঁট করা হচ্ছে। এইড নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে পুলিশে।
পুলিশের অভিযোগ, অন্য ক্যাডারদের দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের বেলায় নানা অজুহাত দেখানো হচ্ছে। এ কারণে আগামী অক্টোবরের মধ্যে তালিকা অনুযায়ী পদোন্নতির বিষয়টি সুরাহা চাচ্ছে পুলিশ।
জানা গেছে, ইতিমধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। সর্বশেষ গত বুধবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এবং সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছেন অন্তত ২৬ জন ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) এই পদোন্নতিতে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পরে গত ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভাও হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদ ২১২টি। কিন্তু এই পদমর্যাদায় কর্মরত কর্মকর্তার সংখ্যা ৪২৬। পদ না থাকলেও ধাপে ধাপে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে সবাইকে। গত মে মাসে একসঙ্গে ১৪৪ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। যুগ্ম সচিব পদের সংখ্যা ৫০২। কিন্তু কর্মরত আছেন ৯৩৬ জন। অতিরিক্ত সচিবের মতো যুগ্ম সচিব পদেও পদ ছাড়াই পদোন্নতি দেওয়া হয় অনেক কর্মকর্তাকে। ৪ সেপ্টেম্বর ২১১ এবং গত বছরের নভেম্বরে ১৭৫ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতিপ্রাপ্ত অনেককেই সুপারনিউমারারি পদায়ন দেওয়া হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি ও অতিরিক্ত আইজিপি পদে ৭২০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পুলিশ সদর দপ্তর।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, ৭২০ জনের প্রস্তুাবটি ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। জুন মাসে তালিকাটি সংশোধন করে ৫২৯ জনের চূড়ান্ত তালিকা করে স্বরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ২০ জুলাই পদোন্নতি দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয় ফাইলটি। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৩৪২ জনের বিষয়ে ছাড়পত্র দেয়। বাকিদের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জানা গেছে, অতিরিক্ত আইজিপি পদে ২, ডিআইজি পদে ৫০, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) ৩৪, উপমহাপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ১৪০, অতিরিক্ত উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) ১৫০ ও পুলিশ সুপার ১৯০ পদের পদোন্নতির সুপারিশ।
পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন পুলিশের নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়।
পদোন্নতি পাওয়ার পর ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ রেঞ্জে নিয়োগ দেওয়া হবে। তা ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর মহানগর পুলিশ, পুলিশ সদর দপ্তর, এসবি, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা, পুলিশ স্টাফ কলেজ, রেলওয়ে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, এপিবিএন, এন্টি টেররিজম ইউনিট, পিবিআই, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশ, মেট্রোরেল পুলিশ ইউনিট ও পিটিসি ইউনিটে (টাঙ্গাইল, নোয়াখালী, রংপুর ও খুলনা) সুপারনিউমারারি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি না পাওয়ার হতাশা থেকে বের করে আনতেই এই পরিকল্পনা করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। কিন্তু যেভাবে কাটছাঁট করা হচ্ছে তাতে সবাই পদোন্নতি পান কি না, সন্দেহ করছেন। এ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পদোন্নতি হওয়ার পর কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাবে তা সত্য। অন্য ক্যাডাররা পেলে আমরা কী দোষ করছি? আমরা তো রাষ্ট্রের জন্যই কাজ করি। কিন্তু মন্ত্রণালয় যেভাবে কাটছাঁট করে পদ চূড়ান্ত করছে তা কিছুতেই মানতে পারছি না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পদোন্নতির সংখ্যা কমানো হয়েছে। তারপরও তালিকা ছোট করছে মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতনরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আবার কথা বলবেন আমরা জানতে পেরেছি। আশা করি সরকারপ্রধান আমাদের পদোন্নতির বিষয়টি সুরাহা করবেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সুপারনিউমারারির মাধ্যমে পদোন্নতির বিষয়টি সমাধান করা হবে দ্রুত সময়ে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
দেশের অর্থনীতি বর্তমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। চারটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংকট দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রিজার্ভ সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণপ্রাপ্তি কমে যাওয়া এবং ঋণ পরিশোধের চাপের কারণে অর্থনীতি এমন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে আরও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে সরকার দেশি-বিদেশি নানা চাপের মুখে রয়েছে। এর মধ্যে অর্থনীতির সংকট সরকারের জন্য আরও মারাত্মক চ্যালেঞ্জ বয়ে আনতে পারে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুই বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৫৫ শতাংশ। প্রতি মাসে প্রায় এক বিলিয়ন করে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।
১৪ সেপ্টেম্বর দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ২১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (আইএমএফের হিসেবে)। তারও কয়েক দিন আগে এই রিজার্ভ নেমে এসেছিল ২১ দশমিক ৪৮ বিলিয়নে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ছিল ৩৯ বিলিয়ন। বর্তমানে যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো কষ্টকর হবে। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো দেশের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট (আর্থিক হিসাব) ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, সামনের দিনগুলোতে এক বিলিয়ন ডলারের ডেফার্ড এলসির (বিলম্বিত ঋণপত্র) দায় পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। তবে এই অর্থের চেয়ে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি ঋণ পরিশোধের চাপ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার ও সরকারি গ্যারান্টিতে পাওয়া বিদেশি ঋণের মধ্যে ৩১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে, যার মধ্যে ২৪৩ কোটি ডলার আসল ও সুদ বাবদ ৭৬ কোটি ডলার। অবশিষ্ট প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে হবে বেসরকারি খাতকে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধ করতে হবে ১৬২ কোটি ডলার।
বিদেশি মুদ্রার, বিশেষ করে ডলার সংকট সামাল দিতে আমদানিতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ডলার সংকটে টাকার দাম ধরে রাখতে মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে অভিযান চলছে। ফলে মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। খোলাবাজারের পরিবর্তে ডলার এখন কেনাবেচা হচ্ছে কালোবাজারে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকেও তুলনামূলক কম ঋণ পাচ্ছে সরকার। শুধু বিদেশি ঋণই নয়, টাকায় ধার করাও সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। তারল্য সংকটে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ধার দিতে না পারায় নতুন টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; অর্থাৎ ডলার সংকটের কারণে টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া ও আমদানি বিধিনিষেধ আরোপ করায় রেকর্ড মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েছে দেশ।
সর্বশেষ গত আগস্টে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ শতাংশে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা গত এক দশকে সর্বোচ্চ। দেশের রিজার্ভ যদি আরও কমে যায়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে গাণিতিক হারে বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি, যেমনটা ঘটেছে শ্রীলঙ্কার বেলায়।
একদিকে বিপুল ঋণ পরিশোধের চাপ, অন্যদিকে ডলার সংকট। পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকলে জরুরি খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, এলএনজি কিংবা কয়লার মতো গুরুত্বপূর্ণ আমদানির জন্য অর্থ সরবরাহ বা বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে সরকার। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন এলসির দায় পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে এমন পরিস্থিতিতে চাইলেও যেকোনো ঋণ পরিশোধের সময় বাড়াতে ঋণদাতারা রাজি হয় না। এর আগে বেসরকারি পর্যায়ের স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হলেও এখন অনেক আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান মেয়াদ বাড়াতে রাজি হচ্ছে না।
অবশ্য বিদেশি মুদ্রার এমন সংকটে শুধু বাংলাদেশই নেই, আরও অন্তত ৪০টি উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যাদের রিজার্ভ ২৪ থেকে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ হারানোর তালিকায় রয়েছে বলিভিয়া। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটি ৮৮ শতাংশ রিজার্ভ হারিয়েছে। ওই সময়ে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ কমেছিল প্রায় ৭৮ শতাংশ।
এসব দেশের এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা হচ্ছে। দেশটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে নিয়মিতভাবে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। এতে এক দিকে যেমন ডলার শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে বিশে^র প্রায় সব মুদ্রার পতন হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে। তবে ডলারের সংকট সরকারের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে। শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল্য নির্ধারণ করলেও এখন এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডকে (এবিবি), যারা ঘাটতির কারণে নিয়মিতভবে ডলারের দাম বাড়িয়ে চলেছে। আবার সংগঠন দুটি ডলারের যে দর নির্ধারণ করছে, তাদের সদস্য ব্যাংকগুলোই তা মানছে না। বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে বেশি মূল্যে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় দেশে আনছে, আবার তার চেয়েও বেশি দরে আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবেই প্রায় দেড় বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩১ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অব্যাহত অবমূল্যায়নে আমদানি করা সব পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়। বাংলাদেশ ঠিক এমন পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও রিজার্ভের অব্যাহত পতন ঠেকাতে আমদানিতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। রপ্তানি আয় দ্রুত নগদায়নের পাশাপাশি এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর বন্ধ করা হয়েছে।
প্রবাসী আয়ের পতনে বিদেশি মুদ্রা, বিশেষ করে ডলারের চাহিদা আরও তীব্র করে তুলেছে। গত বছরের আগস্টের চেয়ে চলতি বছর একই সময়ে প্রবাসী আয় ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ কমে গেছে। গত বছর আগস্টে ছিল ২০৪ কোটি ডলার। চলতি বছর আগস্টে কমে দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি ডলার।
এদিকে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নে বিদেশি বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে পুঁজিবাজারের বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকির মুখে থাকেন। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিজের দেশে ফিরিয়ে নেন। এটিকে ক্যাপিটাল ফ্লাইট বলা হয়। ক্যাপিটাল ফ্লাইট হলো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা পুঁজি নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতো ঘটনার কারণে একটি দেশ থেকে আর্থিক সম্পদ এবং মূলধনের একটি বড় আকারের বহির্গমন। বাংলাদেশে টাকার অবমূল্যায়নের শঙ্কায় ২০১৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পুঁজিবাজার থেকে বিদেশিরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। এর পরিমাণ এক বছরে কিছুটা কমেছে। কারণ হলো পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করায় মৌলভিত্তির প্রায় সব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশিরা চাইলেও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। তবে পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ আটকানো গেলেও বিদ্যমান পরিস্থিতি নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে।
ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে ব্যবসা করা অনেক বিদেশি কোম্পানি তাদের মুনাফা বিদেশে অবস্থিত মূল কোম্পানিতে পাঠাতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর অনুমোদন দিচ্ছে না। এটিও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টের ক্ষেত্রে বাধা।
অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে সুদের হার বাড়ানো, যেটির সফলতা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই পথে হাঁটেনি। আইএমএফের চাপে পড়ে সুদহার বাজারব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার নামে যে পদ্ধতিটি চালু করেছে, তার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে সুদহার কার্যত তেমন একটা বাড়েনি। ফলে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিতে পারছে না। আর টাকার সরবরাহ বাড়ায় মূল্যস্ফীতিও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে শ্রীলঙ্কা। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের চরম সংকটে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মাত্র আড়াই মাসে শ্রীলঙ্কার মুদ্রা ডলারের বিপরীতে প্রায় ৭৯ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়। এ সময়ে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি সামলাতে কয়েক মাসের ব্যবধানে নীতি সুদহার তিন গুণ বাড়িয়ে দেয় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত সুদহার বাড়িয়েই মূল্যস্ফীতি সামাল দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এ সময়টাতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করেছে পর্যটক ও প্রবাসী আয়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালের এপ্রিলে আমানতের সুদহার এক ধাপে সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাজনীতি ও অর্থনীতির চরম দুরবস্থার মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামলাতে চলতি বছরের মার্চে আমানতের নীতি সুদহার ফের বাড়িয়ে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সর্বোচ্চ সুদহারের রেকর্ড। তবে পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সুদহারও কমিয়ে আনে শ্রীলঙ্কা। চলতি বছরের মে থেকে দেশটির মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করে। মাত্র তিন মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতি আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে। গত আগস্টে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। অন্যদিকে আমানতের সুদহার কমালেও তা ১১ শতাংশের নিচে নামেনি।
বিশ^ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছরের প্রথম দিকে আমরা যেভাবে সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি, এবার আমাদের সেই সক্ষমতা নেই। একই সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অবস্থাও অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখনো সমস্যার মূলে হাত না দিয়ে আমরা লোক দেখানোর জন্য দুই-একটা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা এখনো বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। ডলার বাজারে বিভিন্নভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে। দাম নির্ধারণ করে সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এটা ব্যবসায়ীদের কালোবাজারিতে উসকে দেবে।’
ড. জাহিদ মনে করেন, মূল্য নির্ধারণ না করে সরকারের উচিত ছিল যারা কালোবাজারিতে যুক্ত, তাদের আইনের আওতায় আনা। এখন খুচরা ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রিতে তাদের লাভ না দেখলে বেচাকেনা বন্ধ করে দিতে পারেন। এতে সমস্যা আরও জটিল হতে পারে।
ঘুষের বিনিময়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দেওয়াসহ নানা রকম আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহর বিরুদ্ধে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে তিতাস এমডি এই দুর্নীতি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে পেট্রোবাংলাকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গাজীপুরের পিরুজালী এলাকায় অবস্থিত মেসার্স সিলভার নিট কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের কারখানায় বয়লার ও গ্যাসচালিত জেনারেটরের জন্য নতুন গ্যাস সংযোগের আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ওই আবেদনের ওপর নির্দেশনা দিয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিখেছেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত। আলাপ করবেন।’
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নির্দেশনা-সংবলিত আবেদনটি তিতাসের গাজীপুরের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসানকে পাঠানো হয়। বিষয়টি জানতে সাইদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। গ্যাস সংযোগের জন্য ওই আবেদনপত্রটি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হলেও সেখানে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো সিল, স্বাক্ষর কিংবা নির্দেশনা নেই। ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দপ্তর থেকেও কোনো ধরনের চিঠি কিংবা নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এরপরও তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবেদনপত্রে মন্ত্রীর (প্রধানমন্ত্রীর) দপ্তরের কথা উল্লেখ করেছেন।
বিষয়টি নজরে আসার পর গত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি বিভাগের সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়। রূপালী মণ্ডল (পরিচালক-১১) স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে, বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণ করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে পরীক্ষা করে বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চিঠি পেয়ে বিষয়টি এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
গত ১২ সেপ্টেম্বর জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশিদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়।
চিঠি পাঠানোর বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব বরাবর পাঠানো এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) কিংবা প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও উৎকোচ গ্রহণ করে সিলভার নিট কম্পোজিটের সঙ্গে এসএম এক্সেসরিজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সংযোগের ছয় মাসের পুরনো আবেদনটি দ্রুত পাস করিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।
লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিতাসের সিস্টেম লস ছিল ৫ থেকে ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শুধু বেসরকারি দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে তিতাসের বকেয়া রয়েছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই বকেয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রিভিউ মামলায় তিতাসের পক্ষে রায় গেলেও এই অর্থ আদায়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
ওই অভিযোগপত্রে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিতাসের এমডির অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঘুষের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিমানা মওকুফ, বিল বকেয়া থাকা সত্ত্বেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা, সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার করাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত তিতাস এমডি। জিসান নামে একজন ঠিকাদার তার এসব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
গ্যাস সংকটের কারণে ২০১০ সাল থেকে দেশে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে নানা রকম যাচাই-বাছাই ও বিবেচনা করে সীমিত পরিসরে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। শিল্পে গ্যাস সংযোগের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কয়েকশ আবেদন জমা রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও প্রতিবারই সেটি ব্যস্ত পাওয়া গেছে। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে রিং হয়। কিন্তু তিনি তা ধরেননি। সর্বশেষ বিষয়বস্তু লিখে তাকে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।
২০২১ সালে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান হারুনুর রশিদ। পরে দ্বিতীয় দফায় আরও এক বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। সম্প্রতি আবারও তার মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
গণমাধ্যমে তথ্য সরবরাহের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছিল সরকারি কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক এসএম আরিফুজ্জামানের নামে। তার বিরুদ্ধে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন বা এসিআর ঘষামাজার অভিযোগও আনা হয়েছিল।
পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, এ দুই বিভাগীয় মামলার চাপ সইতে না পেরে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মারা যান আরিফুজ্জামান। জীবিত অবস্থায় তিনিও এসব বিভাগীয় মামলাকে ভুয়া বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন।
আরিফুজ্জামান মারা যাওয়ার পর তাকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয় এবং প্রাপ্য পেনশন দাবি করা হয়।
কেউ মারা গেলে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া চিরায়ত রেওয়াজ। তা ভুলে গিয়ে মামলা দীর্ঘায়িত করার মতলবে মতামতের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠায় শ্রম মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ২২ আগস্ট সাফ জানিয়ে দেয়, কেউ মারা গেলে তাকে আসামি রাখার আর কোনো সুযোগ নেই।
শুধু আরিফুজ্জামান নয়, বিভাগীয় মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ নতুন নয়।
বিভাগীয় মামলায় পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে। এখানে অভিযোগকারী তদন্তকারী আর বিচারকারী সবই একজন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংস্থাপ্রধান অভিযোগ আনেন। তিনিই তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। সংস্থাপ্রধানই বিচার করেন। দপ্তরের প্রধান ব্যক্তি এসবের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় তার কাছের কর্মকর্তা-কর্মচারী এর সুবিধা নেন। আর যারা কাছে না ভিড়ে একটু দূরে থাকেন, তারা বিভাগীয় মামলাচক্রের ভুক্তভোগী হন।
অধিদপ্তরের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের কর্তৃপক্ষ প্রধান হন মন্ত্রণালয়ের সচিব। সচিব হলেও বিভাগীয় মামলার বিষয়টি নিজেদের মধ্যেই থাকে। যুগ যুগ ধরে এ প্রথা চলে আসছে। এ থেকে বের হওয়ার জন্য নানা সময় উদ্যোগ নিলেও কারও অদৃশ্য বাধায় তা আটকে যায়। বিভাগীয় মামলার চক্করে পড়ে অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিষ্ঠুরতায় কেউ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আর বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত হওয়ার কাহিনি তো খুবই সাধারণ ঘটনা।
বিভাগীয় মামলার অপব্যবহার বন্ধ করতে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলেছিলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সচিব সভায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। পরে সচিব সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব। বিভাগীয় মামলার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাদের কাছে স্পষ্ট মতামত চাইলেও কেউ মতামত দেননি।
লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক ডিজি একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিভাগীয় মামলা নিয়ে নানা হয়রানি রয়েছে। একটি বিভাগীয় মামলা শেষ হতে ২৫ বছরও লেগেছে। বিভাগীয় মামলা নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে শেষ না করলে সরকারের ক্ষতি, দপ্তরের ক্ষতি ও ব্যক্তির ক্ষতি। বিভাগীয় মামলার আইনি কোনো দুর্বলতা নেই। চমৎকার কাঠামো। কখন কী করতে হবে সব বলা আছে। কিন্তু কেতাবে লেখা থাকলে কী হবে, যদি না মানি। তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের মানার মন নেই। প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং তার অধীনÑ কেউ মানে না। তাই বিভাগীয় মামলার অপপ্রয়োগ হচ্ছে।’
যাদের ক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলা সবচেয়ে বাজেভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাবেক অতিরিক্ত সচিব শেখ আবদুর রশিদ। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি তাকে জানানো হয় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চার বছর পর। ততদিনে তিনি পিআরএলে (অবসর-পরবর্তী ছুটি) চলে গেছেন।
আবদুর রশিদ ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মসূচিতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল করিমের। তিনি না গিয়ে সেই অনুষ্ঠানে পাঠান আবদুর রশিদকে। শেষ পর্যন্ত ওই অনুষ্ঠানের একটি বিষয়কে সামনে এনে তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য প্রমাণ হয়নি। ২০১২ সালে এ রিপোর্ট জমা হলেও তাকে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয় ২০১৬ সালে। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের মেধা তালিকায় প্রথম হওয়া কর্মকর্তা তিনি। ক্যাডারভিত্তিক মেধা তালিকা, জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করলে এ কর্মকর্তার মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাকে বিদায় নিতে হয়েছে অতিরিক্ত সচিবের পদ থেকে।
বিভাগীয় মামলা তদন্তে দীর্ঘ সময় ব্যয় করা হয়। এ সময়ে সংশ্লিষ্ট বিবাদী আর্থিক সংকটে পড়েন। মামলা চলাকালে বিবাদীর অর্ধেক বেতন পাওয়ার অধিকার থাকলেও অনেক সময় তা উপেক্ষা করা হয়। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণ হলেও এটা বিবাদীকে জানিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে কর্মকর্তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।
বিভাগীয় মামলায় আরেক ভুক্তভোগীর নাম বাদিউল কবীর। সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও তাকে প্রায় ছয় বছর চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হয়। বিভাগীয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও সরকার পক্ষে নথি উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন না করে মাসের পর মাস সময়ক্ষেপণ করেন। এতে মামলার তদন্ত শেষ হতেই তিন বছর পার হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ার পরও ফাইলটি নিষ্পত্তি না করে দায়িত্বশীল পদস্থ কর্মকর্তারা আরও এক বছরের বেশি সময় ফেলে রাখেন। এমনকি একপর্যায়ে তার অর্ধেক বেতনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চরম মানবেতর অবস্থায় পড়েছিলেন বাদিউল কবীর।
বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি না হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি ঝুলে থাকে। ব্যাচমেটরা পদোন্নতি পেয়ে ওপরের পদে চলে যাচ্ছেন আর বিভাগীয় মামলার আসামি হয়ে অভিযুক্ত একই পদে বসে থাকেন বছরের পর বছর।
বিভাগীয় মামলায় শাস্তি নির্ধারিত। কিছু মামলায় গুরুদন্ড হয়। আবার কিছু মামলায় লঘুদন্ড। কখনো কখনো গুরুদন্ড দেওয়া হলেও আপিলে লঘুদন্ড হয়। লঘুদন্ডের মধ্যে সতর্কীকরণের মতো নামমাত্র শাস্তিও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এ শাস্তিও মাফ করে দেন রাষ্ট্রপতি।
এসিআর ঘষামাজার অভিযোগে ১৪ জন শ্রম পরিদর্শককে অভিযুক্ত করে বিভাগীয় মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। তাদের মধ্যে সাতজন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের (আইজি) কাছে কারণ দর্শানো নোটিসের জবাব দেন। বাকি সাতজন মহাপরিদর্শকের কাছে জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান। নিরপেক্ষ না থাকার অভিযোগে তারা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে নোটিসের জবাব দেন। এসএম আরিফুজ্জামান আইজির কাছে জবাব দিয়েছিলেন। তার সঙ্গী ছয়জনকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও আরিফুজ্জামানকে দেওয়া হয়নি। তার মৃত্যুও তাকে বিভাগীয় মামলা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আরিফুজ্জামানের বিষয়ে জনপ্রশাসনের মতামতের জন্য অপেক্ষা করা ঠিক হয়নি। কারণ সারা পৃথিবীতেই যেকোনো মামলা থেকে মৃত ব্যক্তিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক বিভাগীয় মামলায় পর্যবেক্ষণ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। বিভাগের পাঠানো কাগজপত্র ও মামলার প্রসিডিংস পর্যালোচনা করে পিএসসি মামলা দায়ের, পরিচালন ও তদন্তে দুর্বলতা পেয়েছে। এমনকি তদন্তকারীর তদন্ত করার মতো দক্ষতা ছিল না। এতে পক্ষপাতিত্ব এবং ন্যায্যতা নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে কমিশন পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা পিএসসির এ পর্যবেক্ষণের কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন।
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন তার ফেসবুক পেজের ইন্ট্রোতে লিখে রেখেছেন ‘৪টি শাস্তিপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা’। পুরো কর্মজীবনেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। যে বিভাগে কাজ করেছেন সেখানেই প্রচলিত পদ্ধতি বদল করে জনসেবা উন্নত করতে চেয়েছেন। সর্বশেষ রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। রেলপথে সাধারণ যাত্রীদের সেবা সহজ করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অনিয়ম কমাতে তিনি যাত্রীদের এনআইডির ভিত্তিতে টিকিট কাটার প্রস্তাব করেছিলেন। সেই সময় মাহবুব কবীর মিলনের প্রস্তাব মানা হয়নি। অথচ এখন সেই এনআইডির ভিত্তিতেই টিকিট বিক্রি করা হয়। তাহলে কী সমস্যা ছিল মাহবুব কবীর মিলনের প্রশ্ন তুলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, মিলন রেল থেকে দুর্নীতি সরাতে চেয়েছিলেন। এটা পছন্দ হয়নি কিছু কর্মকর্তার। তারা রেলের কালো বিড়াল লালন-পালন করতে চান। এ কারণে মিলনের নামে বিভাগীয় মামলা দেওয়া হয়। মাহবুব কবীর মিলন দুর্নীতি দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে ১০ জন কর্মকর্তার একটি উইং চেয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বিভাগীয় মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হবেন। আগামী মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের উচ্চ-পর্যারের প্রথম দিনের বিতর্কে যোগ দেবেন তিনি। শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জাতিসংষের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য খাতে সাফল্যসহ বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন তুলে ধরবেন। এর পাশাপাশি বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা, নিরাপদ অভিবাসন, রোহিঙ্গা সংকট ও জলবায়ু ন্যায্যতাও তার ভাষণে স্থান পাবে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে সংস্থার সদর দপ্তরে জমায়েত হচ্ছেন বিশ্ব নেতারা। এবারের অধিবেশনের প্রতিপাদ্য হলো, ‘বিশ্বাস পুনর্গঠন এবং বৈশ্বিক সংহতি পুনর্নির্মাণ : সবার জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও স্থায়িত্ব অর্জনের উদ্দেশ্যে ২০৩০ এজেন্ডা এবং এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসংক্রান্ত ত্বরান্বিত কর্মপন্থা’।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এবং বর্তমান সংসদের সময়ের মধ্যে এটিই হবে শেখ হাসিনার শেষ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়া।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক অধিবেশনের ফাঁকে বেশ কয়েকটি উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠক ও বিতর্কে অংশ নেবেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর বাইরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করতে প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ডেনমার্ক ও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে যোগ দিতে পারেন।
মোমেন জানান, সফরকালে বাংলাদেশ এবং হাঙ্গেরি, কাজাখস্তানের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সব দিক থেকেই প্রধানমন্ত্রীর এবারের নিউ ইয়র্ক সফর গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, অধিবেশনে এবং অধিবেশনের সাইড লাইনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে পশ্চিমাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন প্রধানমন্ত্রী। তারা বলছেন, সরকারপ্রধান অবশ্যই এই বিষয়ে নিজের তথা নিজের সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছেন।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইট আজ সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যাবে। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে চার ঘণ্টা যাত্রা বিরতির পর ফ্লাইটটি নিউ ইয়র্ক সময় রাত ১০টা ৫০ মিনিটে জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কাল সোমবার নিউ ইয়র্কের রকফেলার সেন্টারে জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা-ইউএনআইডিও এবং বাণিজ্য পরামর্শদাতা সংস্থা ডেলয়েট আয়োজিত ‘খাদ্যের জন্য চিন্তা খাদ্য সরবরাহ চেইন উদ্ভাবনের জন্য এসডিজিকে ত্বরান্বিত করার জন্য সহযোগিতা’ শীর্ষক একটি উচ্চ-পর্যায়ের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মূল বক্তব্য দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। একই দিনে তিনি ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল চেম্বারে ‘এসডিজি সামিট-লিডার্স’ ডায়ালগ-৪ (এসডিজি অর্জনের জন্য সমন্বিত নীতি ও পাবলিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা) শীর্ষক আরেকটি সম্মেলনেও ভাষণ দেবেন। ওইদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈশ্বিক শিক্ষা বিষয়ক বিশেষ দূত ও বিশ্ব স্বাস্থ্য অর্থায়নের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রাষ্ট্রদূত গর্ডন ব্রাউন ও নিউ ইয়র্কের লেক্সিংটন ভেন্যুতে গ্লোবাল বিজনেস কোয়ালিশন ফর এডুকেশনের এক্সিকিউটিভ চেয়ার সারাহ ব্রাউন আয়োজিত জাতিসংঘের ২০২৩ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) শীর্ষক সম্মেলন উপলক্ষে একটি উচ্চ-পর্যায়ের ব্যক্তিগত নৈশভোজে যোগ দিতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ প্রধানের আমন্ত্রণে ‘ক্লাইমেট অ্যাম্বিশন সামিট’ শীর্ষক একটি উচ্চ-পর্যায়ের আলোচনা এবং ‘হাই-লেভেল ব্রেকফাস্ট সামিট অন ক্লাইমেট মবিলিটি’সহ কয়েকটি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি দূর করতে বিশ্ব নেতাদের কাছে তার পরামর্শ তুলে ধরবেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার সরকারের পদক্ষেপও তুলে ধরবেন। কানাডা, গাম্বিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে আয়োজিত সাইড ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ‘কমিউনিটি ক্লিনিকে শেখ হাসিনার উদ্যোগ : মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রতিবন্ধীসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জনে উদ্ভাবনী পদ্ধতি’, ‘মহামারী প্রতিরোধ, প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া’, সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এসব বৈঠকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং বাংলাদেশে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার সরকারের ব্যাপক সাফল্য তুলে ধরবেন।
মোমেন বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী সফরকালে জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার, জাতিসংঘ মহাসচিবের গণহত্যা বিষয়ক উপদেষ্টা, নবনির্বাচিত ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) মহাপরিচালক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
দাম নির্ধারণের দুদিন পরও কাক্সিক্ষত দামে ডিম, আলু ও পেঁয়াজ কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। উল্টো বাজারে এসে দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন তারা। বাজারে স্বস্তি ফেরাতে দফায় দফায় অভিযান পরিচালনা করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানের খবরে দোকানিরা নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করলেও ভোক্তা অধিকার চলে যাওয়ার পরই আগের দামেই বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
গত বৃহস্পতিবার খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ডিম ১৪৪, আলুর কেজি ৩৫-৩৬ এবং ৬৪-৬৫ টাকায় পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয় সরকার। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সরকারের সিদ্ধান্ত না মেনে প্রতি কেজি আলু ৫০, পেঁয়াজ ৯০ এবং ডিম ১৫০ থেকে ১৫৮ এবং ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে আলু, পেঁয়াজ ও ডিম বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে ভোক্তাদের মধ্যে। তারা বলছেন, সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকায় ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া। খোলাবাজারের লুটপাটের প্রবণতা মজুদকারী থেকে সব শ্রেণির ব্যবসায়ীর মধ্যে রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, আমরা কম দামে পণ্য কিনতে পারলেই ক্রেতার কাছে কমে বিক্রি করতে পারব। তাদের দাবিÑ খুচরা দোকানে অভিযান না চালিয়ে আড়তগুলো তদারকির আওতায় আনা গেলে বাজারে সুফল মিলবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর নিউ মার্কেট, বাড্ডা ও রাজাবাজারের ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব কথা জানা গেছে।
বাড্ডা বাজারে আলু কিনতে এসে সানাউল্লাহ নামে এক ক্রেতাকে বাগবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে তিনি দেশ রূপান্তরকে জানান, সরকার আলুর দাম বেঁধে দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা এখনো ৫০ টাকার নিচে আলু বিক্রি করছেন না। উল্টো তারা দাবি করেন, বেশি দামে কেনা আলু হওয়ায় কম দামে বিক্রি সম্ভব নয়। আলু বিক্রেতা শাহিন বলেন, সকালে ৪২-৪৩ টাকা কেজি দরে আলু পাইকারি বাজার থেকে কিনে এনেছি। এখন তা ৩৫-৩৬ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব নয়। সরকার যেমন ইচ্ছা তেমন বললেই তা মানা যায় না। তাদের বলুন আগে বড় মাফিয়া ব্যবসায়ীদের ধরতে। তাহলেই দাম কমে যাবে।
ডিমের ক্ষেত্রেও বাজারে একই দৃশ্য দেখা গেছে। প্রতি ডজন ডিম ১৫০-১৫৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি না করার কারণ জানতে চাইলে নিউ মার্কেটের ডিম ব্যবসায়ী কাইয়ুম দেশ রূপান্তরকে বলেন, পাইকারি বাজারে গত দুদিনে দাম এক টাকাও কমেনি। ১০০ ডিম দোকানে আনতে খরচ হয় ১ হাজার ২২০ টাকা। তার মানে একেকটা ডিমের দাম পড়ে ১২ টাকা ২০ পয়সা। তাহলে কীভাবে ১২ টাকায় ডিম বিক্রি করব? লোকসান দিয়ে বিক্রি করলে সংসার কি সরকার চালাবে?
এদিকে বাজারের লাগাম টেনে ধরতে একযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় সরকার নির্ধারিত মূল্যের থেকে বেশি দামে পণ্য বিক্রি ও বিক্রয় মূল্য তালিকা না থাকায় ব্যবসায়ীদের জরিমানাসহ সতর্ক করেন ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তারা।
একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে : জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজারকে অস্থির করেছে। এ বছর যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে, তাতে দেশে আলুর কোনো ঘাটতি নেই। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।
গতকাল শনিবার দুপুরে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর ফেরিঘাট এলাকার রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজ পরিদর্শন শেষে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আলু বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার পাকা রসিদ ব্যবহার করতে হবে। পাকা রসিদ না থাকলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজে পাকা রসিদ ছাড়া আলু বিক্রির অপরাধে এক ব্যবসায়ীকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ব্যবসায়ীর নাম রসরাজ বাবু (৬০)। তিনি ওই হিমাগারে ১০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছেন। সেখানে পাকা রসিদ ছাড়া মোবাইল ফোনে দাম নির্ধারণ করে আলু বিক্রি করছিলেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিদর্শনকালে ব্যবসায়ী রসরাজ বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদে তার কথায় অসংগতি পাওয়া যায়। পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পরে গতকাল বিকেলে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তা, কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মহাপরিচালক বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আলুর বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এ সময় তিনি সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, হিমাগারের মজুদদারদের জন্যই আলুর বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হবে।
মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপনের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ আসলাম খান, জেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল আজিজ, মুন্সীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদ-ই-হাসান তুহিন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুস সালাম ও জেলা হিমাগার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত কুমার মণ্ডল। এ ছাড়া জেলার ছয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, সরকার গত বৃহস্পতিবার আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৩৫-৩৬ টাকা ও হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭ বেঁধে দিয়েছে। তবে এ নিয়ম মানছেন না ব্যবসায়ীরা। গতকাল মুন্সীগঞ্জ শহর বাজার ঘুরে দেখা যায় খুচরা বাজারে ৪৪-৪৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। গ্রামের বাজার ও দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে।
সরকারের দাম বেঁধে দেওয়ার আগের দিন বুধবার মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে ৩৮ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হয়েছে। অথচ দুদিন ধরে হিমাগারে কোনো পাইকারি ক্রেতা আসছেন না। ব্যবসায়ীরাও আড়তে আলু পাঠাচ্ছেন না। গতকাল সকালে মুন্সীরহাট এলাকার সুলতান কোল্ড স্টোরেজ, মুক্তারপুর এলাকার রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজ, পঞ্চসার কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। হিমঘর থেকে আলু বের করে রাখলেও কোনো ক্রেতা ছিল না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতে আমরা যে আলু রাখি, সেগুলো প্রতি বছর মে মাসের পর হিমাগার থেকে বের করি। এবার আলুর সংকট থাকায়, এপ্রিল মাস থেকেই বের করা শুরু হয়েছে। এজন্য হিমাগারে আলুর সংকট রয়েছে। মজুদ রাখা আলু ২৫ থেকে ২৬ টাকা দরে বিক্রি করেছি। আমাদের মজুদকৃত আলু শেষ হয়ে যাওয়ার পর কৃষকদের কাছ থেকে চড়া দরে আলু কিনে রেখেছি। সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে গেলে কেজিতে ৮ থেকে ৯ টাকা করে লোকসান গুনতে হবে। এজন্য আমরা আলু বিক্রি করছি না। সরকারি লোকজন বেশি চাপাচাপি করলে এক সপ্তাহ আমরা আলু বিক্রি বন্ধ করে দেব।
জেলা প্রশাসক আবুজাফর রিপন বলেন, আলু বিক্রি বন্ধ রাখা এটি নীতিনৈতিকতার ব্যাপার। সবাই হয়তো এই কাজটি করবেন না। যারা করবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ভোক্তাদের আলুর চাহিদা রয়েছে ৯৫ হাজার ৮৮ টন। সেখানে উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৩ টন। জেলার ১৬০টি হিমাগারে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মজুদ ছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ১৮২ টন আলু।
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।