
পরিকল্পনাবিদ ছাড়াই ১২টি উপজেলা শহরের (নন-মিউনিসিপ্যাল) মহাপরিকল্পনার দরপত্র মূল্যায়ন করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এ ছাড়া পছন্দের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে যোগসাজশে দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে। এসব অনিয়মের বিনিময়ে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৩ জুলাই সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) পরিচালক বরাবর কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ জমা পড়েছে। লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অস্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। এখানে সরকারের ক্রয়নীতি পিপিআর-২০০৬ ও ২০০৮ যথাযথভাবে অনুসরণ না করে শেলটেক কনসালট্যান্টস প্রাইভেট লিমিটেডকে ৫টি প্যাকেজের সব কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মহাপরিকল্পনা প্রণয়নকাজের জন্য বাছাই করা প্রতিষ্ঠান শেলটেকের কারিগরি প্রস্তাবের পরামর্শকের সিভিতে প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী (পে-রোল) জনবল হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করেন। আবার অনেকে দেশে সরকারি চাকরিও করছেন। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সংক্ষুব্ধ পরামর্শ প্রতিষ্ঠানগুলো সিপিটিইউর পাশাপাশি স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী, এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বরাবরও তাদের অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ন্যাচারাল রিসোর্সেস প্ল্যানার্স লিমিটেড (এনআরপি), বাংলাদেশ, আইসিএসবি কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস এলএলপি, ভারত, গ্লোবাল সার্ভে কনসালট্যান্টস (জেএসসি), বাংলাদেশ, সার্কেল টেকনোলজি লিমিটেড, বাংলাদেশ। এসব মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে ন্যাচারাল রিসোর্সেস প্ল্যানার্স লিমিটেড (এনআরপি), বাংলাদেশের পরিচালক শফিকুল ইসলাম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলজিইডির দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি শতভাগ অনিয়ম করে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫টি প্যাকেজের কাজ দিয়েছে। টার্মস অব রেফারেন্সে (টিওআর) মূল্যায়ন কমিটিতে পরিকল্পনাবিদ রাখার কথা থাকলেও তা রাখা হয়নি। এ ছাড়া শুরু থেকে মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া পর্যন্ত সরকারি ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে শেলটেককে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। তিনি বলেন, ‘এনআরপি কনসোর্টিয়াম করে মাত্র ৬৪ পয়েন্ট দিয়ে নন-রেসপনসিভ করা হয়েছে। অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এক পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে, যেটা পাওয়ার কথা ১০ পয়েন্ট। কর্মপদ্ধতি, ওয়ার্ক প্ল্যান, সংগঠনে পয়েন্ট পাওয়ার কথা ৩৫ এবং অভিজ্ঞ পরামর্শকের জন্য পাওয়ার কথা ৫০। এই হিসাবে আমাদের পয়েন্ট আসার কথা ৯৫। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের কম পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাইলেও এলজিইডি সঠিক জবাব দেয়নি। এক প্রশ্নের আরেক জবাব দিয়েছে তারা।’
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এলজিইডির পাঁচ প্যাকেজে ১২টি উপজেলা শহরের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নকাজের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দরপত্র আহ্বান করে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে; আর দরপত্র মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে গত জুন মাসে। এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়নকাজটি ৫টি প্যাকেজে করা হচ্ছে। ৩টি নতুন উপজেলায় নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দুটি উপজেলায় মহাপরিকল্পনা রিভিউ করা হবে। এখানে ৩৩টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। এলজিইডি থেকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয়েছিল, একটি প্রতিষ্ঠানকে সব প্যাকেজের কাজ দেওয়া হবে না। ভাগ ভাগ করে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার ব্যাপারে কাজ দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও রয়েছে। এলজিইডির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সেটা অনুসরণ করার কথা বললেও বাস্তবে তা করেননি।
এলজিইডির মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘টার্মস অব রেফারেন্সে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত মূল্যায়ন কমিটিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ (নগর-পরিকল্পনাবিদ) রাখতে হবে। তাহলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের কাজটি সঠিক উপায়ে করা সম্ভব হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এলজিইডি তা করেনি। অসৎ উদ্দেশ্য থেকে এলজিইডি এটা করে থাকতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মহাপরিকল্পনা নেওয়ার সময় যাচাই-বাছাই কমিটি করে তা গ্রহণ করতে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। শুরুর তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে, তারা হয়তো এসবের তোয়াক্কা করবেন না।’
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, এলজিইডির মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তদের স্বচ্ছতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এলজিইডির প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন শেলটেকের গাজী শাহিনুর রহমান। এর আগে দীর্ঘদিন শেলটেকের পরিকল্পনাবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। নেপথ্যে তিনি শেলটেককে সব কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। আর এ কাজে শেলটেকেরে পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. সাইফুদ্দিনের ব্যাপারেও।
অভিযোগ প্রসঙ্গে এলজিইডির কনসালট্যান্ট গাজী শাহিনুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এর আগে আমি শেলটেকে কাজ করেছি, তা সঠিক। তবে ১২ উপজেলার মহাপরিকল্পনার কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে শেলটেককে অনৈতিক কোনো সহযোগিতা করিনি।’ জানতে চাইলে এলজিইডির উপজেলা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সাইফুদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১২ উপজেলার মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়।’ সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরলে বলেন, ‘আপনি অফিসে আসেন সরাসরি কথা বলব।’ পরে তার সাক্ষাৎ পেতে তিন দিন একাধিকবার ফোন করলেও ফোন রিসিভ করেননি।
শেলটেক কনসালট্যান্টস প্রাইভেট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শেলটেক পরিকল্পনা প্রণয়নে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান। এলজিইডিতে যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিদ্বন্দিতা করেছে। এ ক্ষেত্রে শেলটেক কোনো অসুদপায় অবলম্বন করেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে পরিকল্পনাবিদ রাখা না রাখা এলজিইডির বিষয়। এ ক্ষেত্রে সেটা ছিল কি না, তা আমার জানা নেই।’
ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উপজেলা মহাপরিকল্পা প্রণয়ন পরিকল্পনা পেশাজীবীদের মুখ্য কাজ। টার্মস অব রেফারেন্সে পরিকল্পনাবিদ রাখার প্রস্তাব যৌক্তিক ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা না মানা এলজিইডির সঠিক হয়নি।’
প্রকল্পের আওতাভুক্ত উপজেলা : এলজিইডির মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত প্রকল্পের আওতাভুক্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন; নেত্রকোনার আটপারা; কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ ও লালমাই; সিলেটের গোয়াইনঘাট; সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ; বাগের হাটের ফকির হাট এবং পটুয়াখালীর দুমকি। রিভিউ করা হবে ঢাকার নবাবগঞ্জ, রাজশাহীর বাগমারা, কক্সবাজারের রামু এবং গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মহাপরিকল্পনা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে বিএনপির নতুন কর্মসূচির ঘোষণা আসছে। বগুড়া থেকে রাজশাহী পর্যন্ত তারুণ্যের রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ করে আজ সোমবার এই ঘোষণা দেওয়া হবে। নতুন কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ১১টি সমাবেশ ও পাঁচ বিভাগে পাঁচ রোর্ড মার্চ থাকতে পারে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে ১২ দিনের এই কর্মসূচি শুরু হবে। চলবে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত। এরপরও যদি দাবি মেনে না নেয় তাহলে ঘেরাও, অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। অক্টোবর জুড়েই এই কর্মসূচি থাকবে।
দলটির নেতারা বলছেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে যা যা করেছে সব কিছুই বিএনপি করবে ধারাবাহিকভাবে। তাদের কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। তবে সরকার বাধা দিলেও তারা মাঠ ছাড়বেন না।
নির্বাচন কমিশন আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আভাস দিয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদের সমাপনী অধিবেশনের ভাষণে বলেছেন, অক্টোবরে সংসদ অধিবেশন শেষ হবে। তারপর নির্বাচন।
বিএনপি চায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই এক দফা দাবির আন্দোলন শেষ করতে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।
এক দফা দাবি আদায়ে সেপ্টেম্বরে লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দিলেও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি বিএনপি। কিংবা জোরালো কোনো কর্মসূচিও দিতে পারেনি এ পর্যন্ত। সে কারণে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ১২ দিনের নতুন কর্মসূচির কঠোর আন্দোলনে নামবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, তারুণ্যের রোডমার্চের পর আজ সোমবার নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে। এর মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, আমিনবাজার ও রাজধানীতে ১১টি সমাবেশ করা হবে। এর মধ্যে নারী, শ্রমিক ও পেশাজীবীদের সমাবেশ হবে। এ ছাড়া খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগে পাঁচটি রোডমার্চ কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। শ্রমিক সমাবেশের পর পুরো অক্টোবরজুড়ে লাগাতার কর্মসূচি থাকবে। তবে দলীয় একটি সূত্র বলছে, আগামী মঙ্গলবার থেকে যে কর্মসূচি শুরু হবে তা শেষ হবে ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের মধ্য দিয়ে।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব কর্মসূচির পর পুরো অক্টোবরজুড়ে কর্মসূচি থাকবে। এই কর্মসূচির মধ্যে রোর্ডমার্চ, লংমার্চ থাকবে। এসব কর্মসূচিতে কাজ না হলে ঘেরাও, অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি আসতে পারে।
এক দফা দাবি আদায়ের চূড়ান্ত আন্দোলনের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছিল। তখন বিএনপি বাধ্য হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। আজ বিএনপি একই পথে হাঁটবে।’
তিনি বলেন, প্রাথমিক চিন্তা হিসেবে কোনো ধরনের আক্রমণাত্মক পথে না গিয়ে একের পর এক কর্মসূচির মাধ্যমে তারাও একই পরিস্থিতি তৈরি করবেন দাবি আদায়ের জন্য, যাতে করে তার ভাষায় সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রশ্নে সমঝোতায় বাধ্য হয়। তবে বাধ্য করলে কোনো ছাড় নয়। বাধ্য করতে যা লাগে তাই করবে বিএনপি।
ওই নেতা আরও বলেন, ‘বিএনপি এক দফার দাবি আদায়ে পুরো অক্টোবরজুড়ে বিরতিহীন কর্মসূচিতে যাবে। কর্মসূচির শুরু হতে পারে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে সমাবেশ দিয়ে। এরপর রাজধানী ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় রোডমার্চ, লংমার্চের কর্মসূচি আসবে। সারা দেশে তৃণমূল নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে ঢাকায় আসবে কর্মসূচি। এসব কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচিতে সরকারের টনক না নড়লে পুরো অক্টোবরজুড়ে দেশব্যাপী লাগাতার ঘেরাও, অবরোধের মতো কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। তাতেও কাজ না হলে সরকার বাধ্য করলে সর্বশেষ হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার প্রবেশপথে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে পুরো ঢাকা শহর অচল করে দেওয়া হতে পারে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী তিন মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজপথে আমরা নেমে এসেছি বিজয় অর্জন না করে আমরা ঘরে ফিরে যাব না। আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নতুন বাংলাদেশ তাদের উপহার হিসেবে দিয়ে যেতে চাই।’
বিএনপি সূত্রগুলো বলছে, সরকারের ওপর বিদেশিদের চাপের কারণে সরকার এখন নমনীয়। কিন্তু কঠোর আন্দোলন শুরু হলে সে-রকম নাও থাকতে পারে। বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে সহিংসতা হলে সরকারের ওপর বিদেশিদের চাপ বাড়বে। অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে আসবেন বলে তারা মনে করেন।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।
নতুন কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১২ জুলাই সরকার পতনের এক দফা ঘোষণার পর থেকে ধাপে ধাপে কর্মসূচি পালন করে আসছি আমরা। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি সব সময় একরকম থাকে না। সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে কী ধরনের কর্মসূচির ঘোষণা আসবে।’
তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আমাদের করতে হচ্ছে তা স্বাধীনতার গত ৫০ বছরের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলকে করতে হয়নি। কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং সর্বশেষ বিচার বিভাগকে পুরোপুরি দলীয়করণ করেছে। এখন এক ব্যক্তির ইচ্ছা ও নির্দেশে দেশ চলছে। এই রেজিমের পরিবর্তন করতে হলে ভেবেচিন্তে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সে প্রক্রিয়া চলছে।’
ফখরুল বলেন, ‘সরকারকে সরে যেতে হবে কারণ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। হামলা হলে আন্দোলনের গতিপথ পাল্টে যাবে। কঠোর কর্মসূচির দিকে যাব আমরা।’
গত শুক্রবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে দুদিনের ‘তারুণ্যের রোডমার্চ’ শেষে সোমবার নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে। এক দফার দাবি আদায়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, এই আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ।’
দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, ‘নতুন কর্মসূচির মধ্যে ঢাকার জেলার কেরানীগঞ্জে দলীয় কার্যালয়ের সামনে, গাজীপুর মহানগর ছাড়াও গাবতলীর আমিনবাজার, ঢাকা মহানগর উত্তর উত্তরায় একটি সমাবেশের আয়োজন করবে। এছাড়া শ্রমিক দলের কর্মসূচি রয়েছে ৩০ সেপ্টেম্বর।’
শ্রমিক দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এবারের আন্দোলনেও শ্রমিকরা রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকবেন।’ তারা জানান, কর্মসূচি সফল করতে ফরিদপুর ছাড়া ঢাকা বিভাগের সব জেলা নেতাদের নিয়ে গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রস্তুতি সভা করেছেন। সরকার পতন আন্দোলনে সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষকে সম্পৃক্ত করতে এ কর্মসূচি।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপি রাজধানীর গোলাপবাগে সরকার পতনে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে। এরপর সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ৩০ ডিসেম্বর থেকে রাজপথে আন্দোলন শুরু করে। সর্বশেষ গত ১২ জুলাই নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশ থেকে সরকার পতনের এক দফার কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের শঙ্কা ও বিভিন্ন বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিগত কয়েকটি আন্দোলন পর্যালোচনা করে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে তা বিশ্লেষণ করে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। ইতিমধ্যে সাবেক প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের (সাবেক আমলা) ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের একটা অংশ যারা বিএনপিতে যোগদান করেছেন তারাসহ অন্য যারা আছেন তাদের সবাইকে সক্রিয় করা হচ্ছে।’
বগুড়া থেকে রাজশাহী অভিমুখে তারুণ্যের রোডমার্চের উদ্বোধনকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে তারা মানুষের আস্থা হারিয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে লুটপাটে ব্যস্ত। চোর চোর এত বড় চোর যে চুরি করে তারা দেশকে ফোকলা করে দিয়েছে।
গতকাল রবিবার বেলা সোয়া ১১টায় বগুড়া সদরের এরুলিয়ায় এক দফা দাবিতে তারুণ্যের রোডমার্চ বগুড়া টু রাজশাহীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দেশের টাকা চুরি করে বিদেশে পাঠায়, বিদেশে বাড়িঘর করেছে। তাদের ব্যক্তিগত সব কর্মকান্ড বিদেশে। সবচেয়ে বড় অধিকার চুরি করেছে, আমাদের ভোটের অধিকার। ২০১৪ সালে চুরি করেছে, ২০১৮ সালে চুরি করেছে, আবারও তারা ২০২৪ সালে চুরি করে পার পেতে চায়। কিন্তু এ দেশের মানুষ এবার আর ভোট চুরি করতে দেবে না। এর আগে আমরা বলেছি, তা মানুষ বিশ্বাস করেনি, এখন সারা পৃথিবীর মানুষ তা বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের বিগত দুটি নির্বাচন হয়নি। যদি ঠিকঠাক মতো জনগণ ভোট দিতে না পারে, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।’
তিনি বলেন, ‘বিরোধী দল যাতে ভোটে আসতে না পারে, সে জন্য মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার হয়রানি করা আগেই শুরু করেছে। আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী, গণতন্ত্রের জন্য যিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন, সেই নেত্রীকে আজ মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দি করে তাকে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়ার কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে না। ডাক্তাররা বলেছেন তাকে বাঁচাতে হলে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। আর সেই চিকিৎসা আমাদের দেশে নেই। বিদেশে নিয়ে যেতে হবে। আমরা বারবার বলেছি, কিন্তু এই সরকার রাজি নয়। আপনারা দেখেছেন কীভাবে সাঈদী সাহেবকে কারাগারে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল আমাদের রোডমার্চ শুরু হয়েছে রংপুর থেকে। আমি বগুড়ার যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এই তরুণরা আসল কাজ শুরু করেছে। তারা ঘুরে ঘুরে সারা বাংলাদেশের মানুষকে জানান দিচ্ছে। তারা মানুষকে জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘কেউ আমাদের অধিকার দিয়ে যাবে না, আমাদের অধিকার নিয়ে নিতে হবে। তাই এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদের। পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানের সবখানে তাদের পরাজিত করতে হবে। আমরা এই রোডমার্চ শুরু করেছি। আমাদের দাবি একটাই আমাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দাও আর ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করো। তা ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না, সংসদ বিলুপ্ত করো। আর নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করো। শেয়ালের কাছে মুরগি দিলে কী অবস্থা হয় তা জানেন না, তা আবার হবে। আমাদের কথা পরিষ্কার, এক দফা এক দাবি, শেখ হাসিনা কবে যাবি।’
গতকাল দুপুরে তারুণ্যের রোডমার্চ কর্মসূচি বগুড়া থেকে রাজশাহী যাওয়ার পথে আদমদীঘি উপজেলায় পথসভা করে। সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সারা দেশের তরুণ সমাজ এবার জেগে উঠেছে। তাই এ সরকারের পতন ছাড়া আমরা আর ঘরে ফিরব না।’ তিনি বলেন, ‘বারবার শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরেছি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নির্বাচন হলে জনগণ ভোট দিতে পারে না, ভোট চুরি হয়ে যায়, ডাকাতি হয়ে যায়। সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যায় না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন না করলে এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না আমরা।’ বাংলার মাটিতে আর কোনো পাতানো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।
গতকাল রাত পৌনে ৮টার দিকে রাজশাহী ঈদগাহ মাঠের সামনের রাস্তায় পৌঁছায় রোডমার্চটি। এ সময় সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকার আবারও নির্বাচন নিয়ে পাতানো খেলায় মেতে উঠেছে। আজকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে কি না, তার প্রশ্ন। আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারব কি না, সেই প্রশ্ন আজকে জাতির সামনে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই সরকার আমাদের সব অর্জন ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা রাষ্ট্রের যে স্তম্ভগুলো আছে আদালত, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পার্লামেন্ট সবকিছু তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। এই দেশকে তারা সুপরিকল্পিতভাবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, রাজশাহীর চারঘাটের ওসির বক্তব্য ভাইরাল প্রসঙ্গে এই প্রশাসনকে সরকার যে তার নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে তার একটি নমুনা রাজশাহীর চারঘাটের ওসির বক্তব্য। ওসি নিজের মুখে বলেছেন, তাকে ভোট করার জন্য এখানে আনা হয়েছে। এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, এটি তার একটি নমুনা।
সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিএরপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ ছাড়া বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা প্রমুখ। গতকাল তারুণ্যের রোডমার্চ কর্মসূচির সবশেষ সমাবেশ ছিল রাজশাহীতে।
বিএনপির ‘তারুণ্যের রোডমার্চে’ অংশ নিতে বগুড়ায় যাওয়ার পথে নাটোরে একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ডালসড়ক এলাকায় আগুন দেওয়ার এ ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের একটি দল সেখানে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ছাড়া গতকাল সকালে নাটোর শহর ও সদর থানার বিভিন্ন স্থানে হামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের কমপক্ষে ৩০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন দলটির নেতারা।
নাটোর জেলা বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ডালসড়ক এলাকায় মাইক্রোবাসে আগুন দেওয়ার সময় গাড়িতে থাকা নেতাকর্মীদের ধারালো বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে কোপানোর পাশাপাশি মারধর করা হয়। খবর পেয়ে নাটোর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে গাড়ির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে সদর থানার তেবাড়িয়া হাট এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের বহনকারী আরেকটি গাড়িতে হামলা চালিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নাটোর-ঢাকা মহাসড়কে সদর থানার সৈয়দ মোড় এলাকায় প্রায় একই সময়ে হামলা চালানো হয়। আহত হন লালপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মজিদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আনোয়ারুল ইসলাম, কাবিল উদ্দিন ও যুবদল নেতা মজনু পাটোয়ারী।
নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম বাচ্চু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বগুড়ায় তারুণ্যের রোডমার্চে অংশগ্রহণের জন্য নাটোর সদরসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। পথে আওয়ামী লীগের লোকজন পথরোধ করে গাড়িতে আগুন জ¦ালিয়ে দেয় এবং তাদের মারধর করে।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালকুদার দুলু অভিযোগ করে বলেন, ‘কোনো কারণ ছাড়াই ভোর থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের ওপরে হামলা করা হয়েছে। হামলায় দলের ৩০-৩৫ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এসব হামলা করেছে।’
তবে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, তাদের নেতাকর্মীরা কারও ওপরে কোনো হামলা বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়নি।
নাটোর সদর থানার ওসি নাছিম আহম্মেদ বলেন, ‘গাড়িতে আগুন লেগেছে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। গাড়ির আগুন নেভানো হয়েছে। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
এদিকে পুড়িয়ে দেওয়া মাইক্রোবাসের মালিক রফিকুল ইসলামের দাবি, নওগাঁয় বিয়ের জন্য কনে দেখতে যাওয়ার কথা বলে মাইক্রোবাসটি ভাড়া করা হয়েছিল। সকালে বগুড়া হয়ে নওগাঁয় যাওয়ার সময় তার গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে গাড়িটি পুরোপুরি পুড়ে গেছে।
প্রায় তিন বছর করোনার প্রাদুর্ভাবের পর বিশ্ব যখন ঘুরে দাঁড়াতে ব্যস্ত, তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর ফলে বৈশি^ক অর্থনীতি সংকটে পড়ে। অনেক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাই শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। উন্নত দেশগুলোও সংকটে পড়ে। অনেক দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইতিমধ্যে অনেক দেশই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে; ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। এ অবস্থায় আজ সোমবার বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশন।
সাধারণ পরিষদের এ বছরের অধিবেশন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ করোনার মধ্যে দুটি অধিবেশন হয়েছে ভার্চুয়ালি। গত বছর সরাসরি অধিবেশন হলেও তাতে উপস্থিতি ছিল সীমিত। এ বছর বিশ্বনেতারা প্রায় সবাই অধিবেশনে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘আস্থা পুনর্গঠন ও বিশ্ব সংহতির পুনরুদ্ধার : সবার জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও স্থায়িত্ব ত্বরান্বিত করতে ২০৩০ এজেন্ডা এবং এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ।’
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এ অধিবেশনে চোখ এখন বিশ^বাসীর। খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা কাটাতে ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এবারের অধিবেশনে যুদ্ধের বদলে সংহতি-সমঝোতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। শিক্ষা, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়ন, বাণিজ্য, লিঙ্গ, মানব উন্নয়ন, বিশ্বায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন প্রভৃতি ইস্যু এ অধিবেশনের আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। বিশ্বনেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে মানব উন্নয়নের জন্য গৃহীত সূচকগুলোর অগ্রগতি নিয়েও পর্যালোচনা করবেন। বিশ্ব জুড়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্য প্রভৃতি নিরসনের উপায় খুঁজবেন।
অধিবেশনের প্রাক্কালে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘বিশ্বনেতাদের কাছে আমার আবেদন স্পষ্ট। এখন ভান করার বা অনড় থাকার সময় নয়; সিদ্ধান্তহীনতার বা উদাসীন থাকার সময় নয়। বাস্তব সমাধানের লক্ষ্যে এখন সময় একত্রিত হওয়ার। সুন্দর আগামীর জন্য এখন সমঝোতার সময়।’ তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি মানেই সমঝোতা, কূটনীতি মানেও সমঝোতা এবং কার্যকর নেতৃত্বও সমঝোতা।’
গুতেরেস বলেন, বিশ্বনেতারা এমন এক সময়ে একত্রিত হতে যাচ্ছেন যখন মানবসভ্যতা গুরুতর জলবায়ু পরিস্থিতি থেকে শুরু করে ক্রমবর্ধমান সংঘাত, ব্যয়-সংকট, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও নাটকীয় প্রযুক্তিগত বাধার সম্মুখীন। তিনি বলেন, ‘মানুষ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হ্রাস করছে।’
গুতেরেস বলেন, ‘বিভাজন, স্বার্থের ভিন্নতা, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও ভিন্ন সংস্কৃতি সত্ত্বেও বিশ্বের প্রয়োজন সমঝোতা। আমরা সমতা ও সংহতির ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ চাইলে আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যৎ ও ভালোর জন্য নেতাদেরও বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।’
জাতিসংঘের ২০১৫ সালের অধিবেশনে পরিবর্তনশীল বিশ্বের সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ‘রূপান্তরিত আমাদের পৃথিবী : ২০৩০ সালের জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’ শিরোনামে ১৭টি ক্ষেত্রে উন্নয়নের কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। যেমন চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করা, সুপেয় পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, লিঙ্গবৈষম্য দূর করা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রভৃতি। এসডিজির লক্ষ্যপূরণে সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০৩০ সাল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।
বিশ্ব জুড়ে নানাবিধ সংকটের কারণে এসডিজির লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গত জুলাইয়ে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বিপদের মধ্যে রয়েছে। ৭৮তম অধিবেশনে তাই এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে করণীয় নির্ধারণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের মূল বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আর্থিক অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকর বৈশ্বিক উদ্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান প্রভৃতি প্রসঙ্গ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে এ অধিবেশন সহায়ক হতে পারে।
জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে গতকাল রবিবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। তিনি ১৭ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে অবস্থান করবেন। ১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সাধারণ পরিষদ হলে ৭৮তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের প্রথম দিনের উচ্চপর্যায়ের সাধারণ আলোচনায় যোগ দেবেন। ২২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। প্রধানমন্ত্রী ১৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নৈশভোজেও যোগ দেবেন।
অধিবেশনে যোগদানের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও অর্থসহ বেশ কয়েকটি উচ্চপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় ও সৌজন্যমূলক বৈঠকে অংশ নেবেন।
১৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের রকফেলার সেন্টারে ইউএনআইডিও ও ডেলয়েট আয়োজিত ‘খাদ্য ভাবনা-খাদ্য সরবরাহ চেইন উদ্ভাবনে এসডিজিকে ত্বরান্বিত করার সহযোগিতা’ শীর্ষক সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী ১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সিআর-১৬-এ স্পেনের প্রধানমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সভাপতির ‘টুওয়ার্ডস এ ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকেও ভাষণ দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী ২০ সেপ্টেম্বর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে ‘টেকসই উন্নয়নে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য আন্তর্জাতিক গণ-অর্থায়ন বৃদ্ধি এবং দক্ষতা নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক উন্নয়ন অর্থায়ন (এফএফডি) বিষয়ে ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল চেম্বারে আলোচনায় প্রধান বক্তার ভাষণ দেবেন।
তিনি ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে একটি সাইড ইভেন্টের পাশাপাশি ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলা’ শীর্ষক ব্রেকফাস্ট সামিট ও ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ-বিষয়ক সভায় যোগ দেবেন।
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে আন্তঃসরকার সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করে। এতে শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষকতা পেশার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ছিল। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশ্বের ১০০টি দেশে শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে থাকে। অনেক দেশে দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালিত হয়। যেমন, ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। অস্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর মাসের শেষ শুক্রবার। শেষ শুক্রবার যদি ৩১ অক্টোবর হয়, তা হলে ৭ নভেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ভুটান শিক্ষক দিবস পালন করে ২ মে, ইন্দোনেশিয়া ২৫ নভেম্বর, মালয়েশিয়া ১৬ মে, ইরান ২ মে, ইরাক ১ মার্চ, আর্জেন্টিনা ১১ সেপ্টেম্বর, ব্রাজিল ১৫ অক্টোবর, চীন ১০ সেপ্টেম্বর, তাইওয়ান ২৮ সেপ্টেম্বর, থাইল্যান্ড ১৬ জানুয়ারি, সিঙ্গাপুর সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার দিবসটি পালন করে। ইউনেস্কো কর্র্তৃক নির্ধারিত এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘ÔThe teachers we need for the education we want : The global imperative to reverse the teacher shortage’। অর্থাৎ, ‘কাক্সিক্ষত শিক্ষা পেতে যেমন শিক্ষক চাই : শিক্ষক সংকট ঠেকাতে বৈশি^ক উদ্যোগ।’ প্রতিপাদ্যটি বেশ চমৎকার ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা যে ধরনের শিক্ষা চাই আমাদের সে ধরনের শিক্ষকই দরকার। তাই প্রথমত বুঝতে হবে যে আমরা আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিতে চাই। শিক্ষার যথাযথ বিকাশের কাজটি শিক্ষকদেরই। আর এর জন্য শিক্ষকদের হতে হবে দক্ষ ও যোগ্য। পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের যে ঘাটতি সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড ধরা হয়, তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। কিন্তু শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। শিক্ষকরা সমস্যায় থাকলে শিক্ষার গুণগত মান এবং কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাবনা করা যেতে পারে। প্রথমত শিক্ষকতা পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা না থাকার ফলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অনেকে আসতে চায় না এবং এভাবে চলতে থাকলে আগামীতেও আসতে চাইবে না। আমাদের এখনই সময় এসেছে, এই পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিক্ষকরা আগামীতেও যাতে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন বীমা, বিশেষ ঋণ সহায়তা দিয়ে পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন সুনির্দিষ্ট করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষকরা যেন বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন তা ভাবতে হবে। সময়ের সঙ্গে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের বেতনের মানদণ্ড মানসম্মত করতে হবে। দেখা যায়, শিক্ষকতা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পেশা হলেও দেশের মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না অন্য পেশার মতো এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নেই বলে। অথচ মেধাবীদেরই এ পেশায় বেশি বেশি আসার কথা ছিল। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হতো। শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা হলেও কার্যত এ পেশা অনেকটা অবহেলিত। অন্য পেশার মতো এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নেই। এ কারণে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না। তাই এ পেশার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষা খাত সময়ের সেরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ভারতের নোবেল বিজয়ী শিক্ষাবিদ কৈলাশ সত্যার্থী বলছেন, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুণ রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পেশায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা শিক্ষার উন্নয়নে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শিক্ষকদেরও বদলাতে হবে প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকরা কতটা পিছিয়ে সেটা দেশে মহামারী করোনা আসার পর আমরা লক্ষ করেছি। একজন শিক্ষক আজই আগামী দশকের সুযোগ ও সমস্যা মোকাবিলার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করছেন। ফলে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের আত্মোন্নয়নের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।
শিক্ষক সংকট ও শিক্ষকদের প্রমোশনজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেখা যায়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর শিক্ষক সংকট। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রমোশন যেন সোনার হরিণ। শত শত প্রধান শিক্ষকের পদ খালি পড়ে আছে। কিন্তু প্রমোশন নেই। সহকারী প্রধান শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রমোশন হলে সিনিয়র শিক্ষকদের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে প্রমোশন পাওয়ার সুযোগ হবে। প্রমোশন হলে কাজে গতি বাড়বে। তাছাড়া সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল, যথাসময়ে পদোন্নতি ইত্যাদির জটিলতা নিরসনেও কাজ করতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হলো শিক্ষার্থীদের জীবনের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি। এ স্তরে শিক্ষকরা যদি যোগ্য ও যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন হন, তাহলে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি মজবুত হবে। জ্ঞানে-মানে একটি শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে উঠবে। এজন্য প্রাথমিক স্তরে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আর শিক্ষার মান উন্নয়নে এখন এটা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। শিক্ষকতায় স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। সুতরাং, শিক্ষকদের প্রতিটি কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ইদানীং অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। যেমন: বছর শেষে ‘সেরা শিক্ষক’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই বছর সরকারের এটুআই ও গ্রামীণফোনের উদ্যোগে ‘সংকটে নেতৃত্বে’ শিরোনামে শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করেছে। শিক্ষকদের ক্লাসের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের থেকে মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষককে স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান সবাই সফলকাম হবে।
দাবি ছিল শিক্ষক দিবসটিকে সরকারিভাবে পালন করা। অবশেষে গত বছর প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে দিবসটি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। এর আগে এত দিন ধরে এ দিবসটি সরকারিভাবে পালিত হতো না। এখন থেকে পালিত হবে। এ বছর জাতীয় শিক্ষক দিবসের পরিবর্তে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনেরও উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই দিবসটি এখন সরকারিভাবে পালিত হলে শিক্ষকরা অবশ্যই নিজেদের সম্মানিত বোধ করবেন, যা তাদের জন্য বড় ধরনের একটা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষকতা একটি মহান ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। জাতি গঠনে শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের ওপর হামলা ও অপমানের ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে। পাশাপাশি বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নৈতিক ও আদর্শিক বিচ্যুতিও আমাদের সমানভাবে ব্যথিত করে। কারণ, শিক্ষকরাই জাতি গড়ার কারিগর। তারা যদি এমন হন তাহলে আমাদের কেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে, সে প্রশ্ন না উঠে পারে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষকতা পেশার যথাযথ মূল্যায়ন ও শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
লেখক : লেখক
ছুটির দিন নয়, এমনি একটা দিনে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হলাম সকাল ১০টার দিকে। ধারণা করলাম টাঙ্গাইল যেতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। কারণ ঢাকা-টাঙ্গাইলের পথে পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। শুধু পাঁচ ঘণ্টা নয়, আট ঘণ্টার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু যে জায়গাটা খুবই জটিলতাপূর্ণ সেই গাবতলী গিয়ে দেখলাম রাস্তা ফাঁকা আর কয়েকটি সাইনবোর্ড যেখানে লেখা ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’। খুবই নির্বিঘ্নে আমিন বাজার সেতু পার হয়ে গেলাম। ভাবলাম এর পরের জায়গাটা হচ্ছে সাভার বাসস্ট্যান্ড। ওখানে ঘণ্টাখানেক লাগবেই। কিন্তু রহস্যজনকভাবে দেখলাম সেখানেও একই সাইনবোর্ড ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’ এবং রাস্তা ফাঁকা। গেলাম নবীনগর সেখানেও একই অবস্থা, রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি চলছে কোথাও কোনো বাধা নেই। তিন ঘণ্টার মাথায় আমি টাঙ্গাইলের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। কী করে সম্ভব হলো! হঠাৎ মনে পড়ল এ হচ্ছে সদ্য নির্বাচিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র বন্ধুবর আনিসুল হক এবং প্রিয়ভাজন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের পদক্ষেপ।
এরপর ঈদের ছুটিতে টাঙ্গাইল যেতে খুব কষ্টভোগ করেছি। কিন্তু একবার ড্রাইভার জানাল, স্যার কালকে টাঙ্গাইল যেতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোনো ম্যাজিক হচ্ছে কি? ড্রাইভার বলল, হ্যাঁ, হচ্ছে। কালকে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বসবেন এবং তিনি সারা দেশের ট্রাফিক সিস্টেমের পরিস্থিতি দেখবেন। সত্যিকারের ম্যাজিক ঘটে গেল। ঈদের আগের দিন আড়াই ঘণ্টার মধ্যে মায়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। এই ঘটনাগুলোতে কি মনে হয়? আমরা পারি। শুধু প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটু হাল ধরা। কখনো হাল ধরেন মেয়র আনিসুল হক, কখনো জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান। কখনো বড় ধরনের সংকটে হাল ধরেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যথায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কিন্তু সমগ্র ব্যবস্থাটাকে একটা নিয়ন্ত্রণে আনা কি সম্ভব নয়? প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নতির ফলে এটা তো কোনো বিষয়ই নয়। কেমন করে বিষয় নয় তাও জানি।
প্রাচ্যদেশীয় লোকগুলো বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষ আইন মানতে চায় না। আইনের ব্যাপারে তাদের এক ধরনের ক্ষোভ আছে। কেন আইন মানব? এই জন্যই লাখ লাখ মামলার স্তূপ জমে ওঠে আদালতগুলোতে। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে জেলা শহরগুলোতে আদালতের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। এখন সেখানে ছয়তলা থেকে আটতলা পর্যন্ত ভবনে বিভিন্ন আদালত গড়ে তোলা হয়েছে। একটি জেলা শহরেও অনেক বিচারক রাখতে হচ্ছে এবং ছয় সাত এমনকি আটতলা ভবন নির্মাণ করতে হচ্ছে শুধু আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। দেশের স্বাধীনতা কি শুধু আদালত নির্মাণের কাজ করবে না কি মানুষে মানুষে সংঘাত কমিয়ে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনকারীর সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসবে?
আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখতাম একটা লোক ছোট্ট একটা গাড়ি চালিয়ে চলাচল করত। পাঁচ-ছয় গজ দূরের একটা জায়গায় যেতেন। একটু বড় হয়ে জেনেছি তিনি জেলার মুন্সেফ। বাসা থেকে আদালতে যান। তার চেহারা কখনো দেখিনি। কিন্তু একটা ছোট্ট এলাকায় তিনি এসব আইন আদালতের বিচার করেন। আর বাকিটা করেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেটাও খুব বড় কিছু নয়।
সম্প্রতি ব্যাংকের একজন ডিজিএমের স্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের একজন অফিসারের দ্বন্দ্ব হয়েছে। কারণ উনি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে গাড়ি পার্ক করেছিলেন। কিন্তু ডিজিএমের স্ত্রী বলছেন তিনি আইন ভঙ্গ করেননি। তার নামতে যতটুকু সময় লেগেছে ততটুকু সময়ই তিনি নিয়েছেন। এসব ব্যাপারে অনেক বাহাস হতে পারে, কে ভুল আর কে ঠিক? কিন্তু ট্রাফিক আইন তো মানতে হবে। যেখানে ট্রাফিক আইন সম্পূর্ণভাবে যন্ত্র বিবর্জিত আধুনিককালে সমস্ত ব্যবস্থা উপেক্ষিত, যে শহরে সবুজ, হলুদ এবং লালবাতির সংকেত জ¦লে না সেই শহরে ট্রাফিক আইন কী করে বাস্তবায়ন করা যায়? অধিকাংশ সময়ে হস্ত নির্দেশিত ট্রাফিক সিগন্যাল দেখা যায় অথবা নির্দেশকারী একেবারেই তার অভিজ্ঞতাপ্রসূত ট্রাফিক সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছেন। তখন তা মেনে চলাও কি নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকাবাসী এই যে আদিম অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে তার জন্য তাদের কোনো আক্ষেপ নেই?
স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যেটা ছিল আমাদের একটা আদর্শ ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থাকে কেমন করে ধ্বংস করা হলো তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। স্কুলের ওই শিশুরা মন্ত্রীদের, পুলিশ অফিসারদের হাঁটতে বাধ্য করেছিল। তারা ওই ব্যবস্থাকে কিন্তু মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের রাজনীতিবিদদের কি করে বোঝাব সব কিছু রাজনৈতিক করবেন না! সব কিছুকে রাজনৈতিক করতে গেলে অনেক বড় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। দয়া করে শিক্ষাকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। দুর্নীতিকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। শিক্ষাকে রাজনীতি করতে গেলে কীভাবে দুর্নীতি এসে যায় সেটা আপনারা জানেন। তদবিরে নিয়োগ বাণিজ্যের লাখ লাখ টাকায় শুধু কিছু অশিক্ষিত লোকরা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়ে তারা শিশুদের মননকে যে কীভাবে ধ্বংস করে দেয় তা রাজনীতিকরা একটিবারও ভাবেন না।
ঢাকা শহরের নাগরিকরা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে তেমন কিছু বলেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও কিছু বলেন না। প্রথমটায় বলেন না তার কারণ রিকশায় চড়তে তারা খুবই আনন্দ পান এবং অনেক শিক্ষিত লোককে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে রিকশায় করে রাস্তার রংসাইড দিয়ে ঢুকে পড়েন তারা রিকশাচালককে মানা তো করেনই না, অনেক সময় উৎসাহ এমনকি রংসাইডে ঢুকে পড়ার পরামর্শও দেন। আমি এই প্রসঙ্গে তেমন বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ শহরগুলোতে গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক দূর হেঁটে এসে তারা যে গণপরিবহনে চড়ার একটা সুবন্দোবস্ত পাবেন, সেই ব্যবস্থা আমরা রাখতে পারিনি। পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় শহরে নাগরিকদের অনেক পথ হাঁটতে হয়। কারণ তারা গণপরিবহনে উঠবেন হেঁটেই, কাজেই তাদের স্বাস্থ্যও অত্যন্ত ভালো থাকে। এ দেশেও হয়তো রিকশা বন্ধ করে দিলে মধ্যবিত্তদের একটা আন্দোলনও শুরু হয়ে যাবে। যার নাম হবে অলস বাঙালিদের আন্দোলন।
কিন্তু আবার এও দেখেছি, উত্তরা বা মিরপুরের নাগরিকরা খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্রেনে উঠছেন। কিন্তু ধানম-িবাসীর কী হবে? এখানে তো গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই, একমাত্র বাসই ভরসা। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একই ব্যবস্থা। তাদের জন্যও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব সমস্যা মিলে রাষ্ট্রের বায়ান্ন বছর হয়ে গেল, কোনো সুশৃঙ্খল আধুনিক গণপরিবহনের ব্যবস্থা হলো না। অতএব যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে আমাদের নগরগুলোতে সামান্য বৃষ্টি হলে ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় পানি জমে যায়। সেখানে তখন মানুষ মারা পড়বে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এটার কোনো দায়দায়িত্বও নেবে না? দুটি সিটি করপোরেশন নিবিড় ঘুমে রাত্রিযাপন করবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে একটি মন্ত্রণালয় আছে। তারা বৃষ্টিতে ঘুম উপভোগ করবে আর মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বিপদসঙ্কুল সময় অতিক্রম করবে। এসব সমস্যা দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু এর যে সমাধান সম্ভব তা কিন্তু অনেকেই জানেন না। আনিসুল হক জানতেন। ঢাকার বর্তমান মেট্রোপলিটন কমিশনার হাবিবুর রহমান জানেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জানেন। জানেন অনেক নাগরিক। কিন্তু সমস্যা সমাধানের সুযোগ অত্যন্ত কম। তাদের ক্ষমতা যদি বাড়ানো যায় তাহলে অনেক কিছু ঘটানো সম্ভব। সেই দিকটায় আমরা কি যেতে পারি? লেখক: নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট
‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০২০ সালে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা (এমপি)। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় তালিকা অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাদের চাহিদার পরিবর্তন আনেন। তারা ইউনিয়ন পর্যায়ে রাস্তা না করে সেতু তৈরির ওপর জোর দেন। কিছু ক্ষেত্রে খাতভিত্তিক ব্যয় না চেয়ে থোক বরাদ্দও চাওয়া হয়েছিল। চাহিদার জটিলতায় ধীরগতিতে চলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। ঠিক সময়ে প্রকল্পটি শেষ করতে না পারার শঙ্কায় ফের সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
যদিও একই রকম আরেকটি প্রকল্পের কাজ তখনো চলমান ছিল। চলমান একটি প্রকল্প শেষ না হতেই সংসদ সদস্যদের জন্য আরেকটি প্রকল্প নিয়ে তখন বেশ আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছিল।
প্রকল্প-৩-এর মেয়াদ আছে আর এক বছর। অথচ কাজ চলছে ঢিমেতালে। নির্বাচনের আগে তাদের চাহিদার পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের পর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। এর বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৪১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে প্রত্যেক সংসদ সদস্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে বছরে পাঁচ কোটি টাকা করে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়।
প্রতি বছর পাঁচ কোটি করে চার বছরে এ অর্থে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা তাদের। সিটি করপোরেশন এলাকার ২০ সংসদ সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যরা এ বরাদ্দের বাইরে রয়েছেন।
নিজ এলাকার উন্নয়নে এমন সুযোগ পেলেও সংসদ সদস্যরা কাজে লাগাতে পারেননি। প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়ন অর্ধেকেরও কম হয়েছে। অধিকাংশ সংসদ সদস্যই তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিন্তু তারা বলছেন, যে চাহিদা তারা দিয়েছিলেন তার অধিকাংশ পেয়েছেন।
জানতে চাইলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার আসনে যেসব চাহিদা দিয়েছিলাম সবগুলোই পেয়েছি। কিন্তু এ মুহূর্তে এসে বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৪১ শতাংশ বলা হচ্ছে, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরিকল্পনা কমিশনে কীসের ভিত্তিতে এই সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা জানি না।’
সংসদ সদস্যরা যে চাহিদা পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন সে বিষয়ে ইনু বলেন, ‘কোনো এমপি চাহিদা পরিবর্তন করার কথা নয়। আমার এলাকায় যা চেয়েছি তাই তো পুরোটা তারা দিতে পারেননি। প্রতি বছর পাঁচ কোটির বরাদ্দ, তার বাইরে তো তারা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।’ পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। পিইসি সভায় প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন খানের কাছে সংশোধনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। সেখানে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে বেশ কিছু সড়ক ও সেতু-কালভার্ট নতুনভাবে নির্মাণের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত স্কিমগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। স্কিমগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রয়োজন।
পিইসি সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, এ বিষয়ে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. ছায়েদুজ্জামান বলেন, যেসব স্কিম অতীব জনগুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর যৌক্তিকতাসহ সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে, নতুনভাবে গৃহীত স্কিমগুলো বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকার কম করতে হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তৃতীয় দফার এ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে উপজেলা সড়ক নির্মাণ করা হবে ৩০৫ দশমিক ২১ কিলোমিটার। ইউনিয়ন সড়ক নির্মাণ করা হবে ৬৬০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার। গ্রাম সড়ক উন্নয়ন হবে ৫ হাজার ৭৫ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ হবে ১ হাজার ৯০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়কে ১০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যরে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ৭ হাজার ৯৯২ দশমিক ২২ মিটার।
এসব প্রস্তাব সংসদ সদস্যদের চাহিদার ভিত্তিতেই করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় ফের বাদ সাধেন তারাই। পরে মূল প্রকল্প প্রস্তাব থেকে প্রস্তাবিত প্রথম সংশোধনে ১৯৩ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক, ৮৩ দশমিক ৯১ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক, ৫০৫ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার গ্রাম সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম বাদ দেওয়ার আবদার করেছেন তারা। এর বিপরীতে ৩৯২ দশমিক শূন্য ১ কিলোমিটার গ্রাম সড়ক ও ২ হাজার ৬৭৪ দশমিক ৫১ মিটার সেতু-কালভার্টের প্রস্তাব এসেছে তাদের কাছ থেকে। সে অনুযায়ী সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা চিন্তা করেছি এ রাস্তাটি আজকে করব, কিন্তু দেখা গেল অন্য কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে এ রাস্তাটি হয়ে গেছে। এমপিরা যেভাবে ডিও দেন প্রকল্পটি সেভাবে চলে, আমাদের ফ্রেমওয়ার্কটিই সেভাবে তৈরি করা।’
এ মুহূর্তে প্রকল্পটি সংশোধনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে পরিবেশের জন্য ড্রেনেজ সুবিধা রাখতে হবে। একটি রাস্তা করতে গিয়ে দেখা গেল, একটি কালভার্ট বা সেতুর প্রয়োজন হয়েছে। এটি এখন প্রথম প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার)। এটি প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন হিসেবে কাজ করছে।’
বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণ হিসেবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘যখন প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছিল তখন করোনা মহামারী ছিল। করোনার কারণে প্রকল্পটির কাজ দেরিতে শুরু হয়েছিল, যার ফলে এ মুহূর্তে বাস্তবায়ন অগ্রগতি এ পর্যায়ে এসেছে।
পিইসি সভায় সংশোধনের কারণ জানতে চাওয়া হলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ১১তম জাতীয় সংসদ সদস্যদের প্রাথমিক চাহিদাপত্র (ডিও) গ্রহণ করে স্কিমের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিশেষ পরিস্থিতি ও অগ্রাধিকার ক্রমপরিবর্তনের ফলে আরডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত স্কিম তালিকা পরিবর্তন করে ডিওর মাধ্যমে সংশোধিত নতুন স্কিম তালিকা করা হয়েছে। পরিবর্তিত স্কিম তালিকা অনুযায়ী গ্রাম সড়ক ও সেতু-কালভার্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উপজেলা-ইউনিয়ন সড়কের পরিমাণ কমেছে।
এ প্রকল্পের তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা যায়, এতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৭৫ কিলোমিটারের গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নের জন্য। এতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা। ৬৬০ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২৮ কোটি টাকা, ৩০৫ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক উন্নয়নের জন্য ২৯০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। তা ছাড়া ১ হাজার ৯০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক সংরক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৮১ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠনের পর প্রত্যেক সংসদ সদস্য নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকা করে পেয়েছিলেন। সে সময় প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৮৯২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এটি ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১৬ সালের জুনে শেষ হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্যদের ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যায়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ৭৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়ন হয়েছে। এ প্রকল্পটি শেষ না করেই তৃতীয় মেয়াদে আবার ২০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়। এই উদ্যোগের কারণে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় প্রশ্নের মুখে পড়ে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রকল্পের আওতায় সংসদ সদস্যরা সরাসরি টাকা পাবেন না। তারা শুধু তাদের নির্বাচনী আসনে পছন্দ মোতাবেক প্রকল্পের নাম দেবেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আবার সরকারকে বলব, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি ভালো হয় না। যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিন। নাগরিক হিসেবে তাকে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া হোক। তা না হলে একজন গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় প্রবীণ নাগরিকের প্রতি বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণের জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।’
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন।
ফখরুল বলেন, ‘সুচিকিৎসা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বেগম জিয়া দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন। সংবিধান তার বেঁচে থাকার জন্য চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করেছে। যে রোগের চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়, সামর্থ্য অনুযায়ী দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া সংবিধানকে অবজ্ঞা করা। দেশনেত্রীকে চিকিৎসা-সুরক্ষার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যা অন্যায়। এটা অমানবিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আইনের দোহাই দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত রাখার সুযোগ নেই। সরকার হীন উদ্দেশ্যে আইনের দোহাই দিয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
চেয়ারপারসনের চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনার (খালেদা জিয়া) যারা চিকিৎসা করছেন এটা তাদের বিষয়। চিকিৎসকরা তার বেস্ট ট্রিটমেন্ট করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। আমরা তো জোর করে তাকে নিয়ে যেতে পারব না বিদেশে। আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। আমরা যা আছে সে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করে যাব। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হবে এবং খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে।’
ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খন্ডন করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সত্য হলো, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দন্ডপ্রাপ্ত আসামি তৎকালীন জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে ১/১১’র সরকার ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও আছে। শেখ হাসিনাও এমন সুযোগ (বিদেশে চিকিৎসা) নিয়েছেন ২০০৮ সালে। জরুরি আইনের সরকারের সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি চাঁদাবাজির মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। ওই অবস্থায় নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হলে তিনি দুই/তিনদিনের মধ্যে বিদেশে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। তিনি বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছিলেন একজন ওয়ারেন্টি আসামি হিসেবে; প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়েছিলেন। সুতরাং আইনের দোহাই দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই।’
আপনারা এ অবস্থায় কি গণতান্ত্রিক পথে হাঁটবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রের বাইরে যেতে পারি না। এরপরও যদি কেউ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা দেয় সে বাধাও আমরা গণতান্ত্রিকভাবে অতিক্রম করব। তার (শেখ হাসিনা) বক্তব্য তো আপনারা শুনেছেন। উনি তো বিদেশে যেতে দেবেন না বলেছেন। তারপরও আমরা আপিল করছি শুভবুদ্ধির কাছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তার (খালেদা জিয়ার) পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শর্তসাপেক্ষে উনি বিদেশে যাবেন না।’
খালেদা জিয়াকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে নির্বাচনে যাবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। বেগম জিয়াকে এ অবস্থায় রেখে, হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আমাদের পরিষ্কার কথা।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু উপস্থিত ছিলেন।
দুর্গাপূজার আগে পরে সরকারকে আলটিমেটাম দেবে বিএনপি : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একদফার আন্দোলনের শেষ ধাপে সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা দল বিএনপি। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজার আগে বা পরে এই আলটিমেটাম ঘোষণার সিদ্ধান্ত থাকলেও পূজার কয়েকদিন কর্মসূচি রাখবে না দলটি। এর আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বিএনপির রোডমার্চ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে বিএনপি। সেটি না হলে প্রথম ধাপের কর্মসূচি শেষে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে আলটিমেটাম দেওয়ার আগে চূড়ান্ত ধাপের আংশিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এর আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে যুগপতের শরিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করা হবে। তাদের দেওয়া বিভিন্ন প্রস্তাবনা সমন্বয় করে আন্দোলন পরিকল্পনা প্রণয়ন চূড়ান্ত হবে। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে ওই সভায় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা অংশ নেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা একদফার আন্দোলনে রয়েছি। প্রতিদিনই আমাদের কর্মসূচি থাকছে। নতুন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা সরকারকে আর সময় দিতে চাই না। এবারের কর্মসূচি হবে রাজধানীকেন্দ্রিক। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়েই সরকার পতন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে।’
বৈঠক সূত্রগুলো বলছে, প্রথম ধাপের কর্মসূচি শেষে ৭ অক্টোবর থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি শুরু হতে পারে। এর এক পর্যায়ে ১৮ অক্টোবরের দিকে সরকারকে পদত্যাগে আলটিমেটাম ঘোষণা করা হতে পারে। এর আগ পর্যন্ত রাজধানীর পাশাপাশি বাইরেও কিছু কর্মসূচি হবে। তবে আলটিমেটামের পর সব কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক। তখন সারা দেশের নেতাকর্মীদের রাজধানীর কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার নির্দেশনা দেবে বিএনপি।
জানা গেছে, চলতি অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একদফার যুগপৎ আন্দোলন বেগবান করার আগে যুব ও ছাত্র কনভেনশন করবে বিএনপি। ছাত্র কনভেনশনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের বটতলায় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এজন্য গত ২৯ সেপ্টেম্বর ১৫টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য’র আত্মপ্রকাশ হয়েছে। একদফার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পৃক্ত করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দলটির নেতারা মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে পারলে চূড়ান্ত সফলতা আরও সহজ হবে। এছাড়াও যুব কনভেনশন সফল করতে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের সমন্বয়ে শিগগির ‘যুব ঐক্যজোট’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, ১৮ অক্টোবরের আগেই পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এবং প্রধান নির্বাচন কমিশন (সিইসি) বরাবর স্মারকলিপি দিতে পারে বিএনপি। স্মারকলিপিতে পুলিশকে চলমান হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার বন্ধ এবং ইসিকে সম্ভাব্য একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ না নেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা করতে পারেন, সেজন্য আগামী ২০ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত পূজা চলাকালীন বড় কোনো কর্মসূচি রাখবে না যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো।
সূত্রগুলো বলছে, সরকার আলটিমেটাম মেনে পদত্যাগ না করলে, দুর্গাপূজার পরে ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে আলটিমেটামের কর্মসূচি শুরু হবে। এই আন্দোলনের শুরুতেই সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরপর পর্যায়ক্রমে গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাওসহ টানা অবস্থান কর্মসূচিতে যেতে পারে তারা। পাশাপাশি রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। একেবারে বাধ্য না হলে হরতালের মতো কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি।
থাইগ্লাস আর লাল ইটে চকচক করছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতাল ভবন। কার্যক্রম পরিচালনায় রুটিন করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের। অথচ ভবনটির ভেতরে চিকিৎসা-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির অস্তিত্ব নেই। নেই চেয়ার-টেবিল ও অন্যান্য আসবাব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালে ৫ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করে একটি ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালের অনুমোদন দেওয়া হয়। ঢাকাবাসীর গৃহপালিত বিভিন্ন পশুপাখির চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে হাতে-কলমে এ বিষয়ে ধারণা পান, সে উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়।
নানা জটিলতা পেরিয়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আর ২০২৩ সালের মে মাসে ঘটা করে উদ্বোধন করা হয় হাসপাতালটির। এতে দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হলো বলে দাবি করা হয়। উদ্বোধনের পর প্রায় ৫ মাস পার হয়ে গেছে; হাসপাতালে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি নেই।
সরজমিনে দেখা গেছে, তিনতলাবিশিষ্ট ভবনের কোনো রুমেই চিকিৎসার যন্ত্রপাতি বলতে গেলে নেই; চেয়ার-টেবিল বা অন্যান্য আসবাবও নেই। নিচতলায় গেটের সামনে প্যাকেট করা কিছু চেয়ারের পাশে বসে আছেন গার্ড। প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো স্যার (ডাক্তার) বসেন না। কেউ সেবা নিতে এলে স্যারদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করিয়ে দিই। স্যারেরা তাদের শেখ কামাল ভবনে নিয়ে সেবা দেন।’
হাসপাতালে সেবার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীরা যেমন ব্যবহারিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসীও। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, তাহলে কী কাজে লাগছে ৫ কোটি টাকার এ ভবন?
সংশ্লিষ্ট অনুষদের একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০১২ সাল থেকে অ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে একটি প্রাণী হাসপাতালের দাবি করা হচ্ছে। বরাদ্দ হলেও অজানা কারণে এগোয় না কাজ। এক যুগের বেশি সময় পর স্থাপনা হলেও কোনো সরঞ্জাম সেখানে নেই। এভাবেই চলবে; এই হাসপাতাল কখনো কর্মচঞ্চল হবে না। কারণ এই অনুষদের বেশিরভাগ শিক্ষক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো বেসরকারি পশুক্লিনিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তারা চান না হাসপাতালটি জনপ্রিয় হোক।
হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. কে বি এম সাইফুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগের যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যাওয়ায় আমাদের এ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নেই। বিভাগের যন্ত্রপাতি দিয়ে কোনোমতে কাজ চালাচ্ছি। নতুন যন্ত্রপাতি, আসবাব আর লোকবল পেলে হাসপাতাল পুরোদমে চালু হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কোনো ক্লিনিকে কাজ করা বাধা হবে না।’
যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. মোমেনুল আহসানের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে আন্তঃসরকার সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করে। এতে শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষকতা পেশার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ছিল। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশ্বের ১০০টি দেশে শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে থাকে। অনেক দেশে দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালিত হয়। যেমন, ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। অস্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর মাসের শেষ শুক্রবার। শেষ শুক্রবার যদি ৩১ অক্টোবর হয়, তা হলে ৭ নভেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ভুটান শিক্ষক দিবস পালন করে ২ মে, ইন্দোনেশিয়া ২৫ নভেম্বর, মালয়েশিয়া ১৬ মে, ইরান ২ মে, ইরাক ১ মার্চ, আর্জেন্টিনা ১১ সেপ্টেম্বর, ব্রাজিল ১৫ অক্টোবর, চীন ১০ সেপ্টেম্বর, তাইওয়ান ২৮ সেপ্টেম্বর, থাইল্যান্ড ১৬ জানুয়ারি, সিঙ্গাপুর সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার দিবসটি পালন করে। ইউনেস্কো কর্র্তৃক নির্ধারিত এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘ÔThe teachers we need for the education we want : The global imperative to reverse the teacher shortage’। অর্থাৎ, ‘কাক্সিক্ষত শিক্ষা পেতে যেমন শিক্ষক চাই : শিক্ষক সংকট ঠেকাতে বৈশি^ক উদ্যোগ।’ প্রতিপাদ্যটি বেশ চমৎকার ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা যে ধরনের শিক্ষা চাই আমাদের সে ধরনের শিক্ষকই দরকার। তাই প্রথমত বুঝতে হবে যে আমরা আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিতে চাই। শিক্ষার যথাযথ বিকাশের কাজটি শিক্ষকদেরই। আর এর জন্য শিক্ষকদের হতে হবে দক্ষ ও যোগ্য। পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের যে ঘাটতি সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড ধরা হয়, তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। কিন্তু শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। শিক্ষকরা সমস্যায় থাকলে শিক্ষার গুণগত মান এবং কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাবনা করা যেতে পারে। প্রথমত শিক্ষকতা পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা না থাকার ফলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অনেকে আসতে চায় না এবং এভাবে চলতে থাকলে আগামীতেও আসতে চাইবে না। আমাদের এখনই সময় এসেছে, এই পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিক্ষকরা আগামীতেও যাতে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন বীমা, বিশেষ ঋণ সহায়তা দিয়ে পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন সুনির্দিষ্ট করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষকরা যেন বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন তা ভাবতে হবে। সময়ের সঙ্গে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের বেতনের মানদণ্ড মানসম্মত করতে হবে। দেখা যায়, শিক্ষকতা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পেশা হলেও দেশের মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না অন্য পেশার মতো এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নেই বলে। অথচ মেধাবীদেরই এ পেশায় বেশি বেশি আসার কথা ছিল। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হতো। শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা হলেও কার্যত এ পেশা অনেকটা অবহেলিত। অন্য পেশার মতো এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নেই। এ কারণে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না। তাই এ পেশার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষা খাত সময়ের সেরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ভারতের নোবেল বিজয়ী শিক্ষাবিদ কৈলাশ সত্যার্থী বলছেন, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুণ রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পেশায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা শিক্ষার উন্নয়নে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শিক্ষকদেরও বদলাতে হবে প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকরা কতটা পিছিয়ে সেটা দেশে মহামারী করোনা আসার পর আমরা লক্ষ করেছি। একজন শিক্ষক আজই আগামী দশকের সুযোগ ও সমস্যা মোকাবিলার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করছেন। ফলে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের আত্মোন্নয়নের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।
শিক্ষক সংকট ও শিক্ষকদের প্রমোশনজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেখা যায়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর শিক্ষক সংকট। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রমোশন যেন সোনার হরিণ। শত শত প্রধান শিক্ষকের পদ খালি পড়ে আছে। কিন্তু প্রমোশন নেই। সহকারী প্রধান শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রমোশন হলে সিনিয়র শিক্ষকদের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে প্রমোশন পাওয়ার সুযোগ হবে। প্রমোশন হলে কাজে গতি বাড়বে। তাছাড়া সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল, যথাসময়ে পদোন্নতি ইত্যাদির জটিলতা নিরসনেও কাজ করতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হলো শিক্ষার্থীদের জীবনের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি। এ স্তরে শিক্ষকরা যদি যোগ্য ও যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন হন, তাহলে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি মজবুত হবে। জ্ঞানে-মানে একটি শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে উঠবে। এজন্য প্রাথমিক স্তরে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আর শিক্ষার মান উন্নয়নে এখন এটা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। শিক্ষকতায় স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। সুতরাং, শিক্ষকদের প্রতিটি কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ইদানীং অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। যেমন: বছর শেষে ‘সেরা শিক্ষক’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই বছর সরকারের এটুআই ও গ্রামীণফোনের উদ্যোগে ‘সংকটে নেতৃত্বে’ শিরোনামে শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করেছে। শিক্ষকদের ক্লাসের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের থেকে মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষককে স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান সবাই সফলকাম হবে।
দাবি ছিল শিক্ষক দিবসটিকে সরকারিভাবে পালন করা। অবশেষে গত বছর প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে দিবসটি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। এর আগে এত দিন ধরে এ দিবসটি সরকারিভাবে পালিত হতো না। এখন থেকে পালিত হবে। এ বছর জাতীয় শিক্ষক দিবসের পরিবর্তে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনেরও উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই দিবসটি এখন সরকারিভাবে পালিত হলে শিক্ষকরা অবশ্যই নিজেদের সম্মানিত বোধ করবেন, যা তাদের জন্য বড় ধরনের একটা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষকতা একটি মহান ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। জাতি গঠনে শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের ওপর হামলা ও অপমানের ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে। পাশাপাশি বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নৈতিক ও আদর্শিক বিচ্যুতিও আমাদের সমানভাবে ব্যথিত করে। কারণ, শিক্ষকরাই জাতি গড়ার কারিগর। তারা যদি এমন হন তাহলে আমাদের কেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে, সে প্রশ্ন না উঠে পারে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষকতা পেশার যথাযথ মূল্যায়ন ও শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
লেখক : লেখক
ছুটির দিন নয়, এমনি একটা দিনে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হলাম সকাল ১০টার দিকে। ধারণা করলাম টাঙ্গাইল যেতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। কারণ ঢাকা-টাঙ্গাইলের পথে পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। শুধু পাঁচ ঘণ্টা নয়, আট ঘণ্টার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু যে জায়গাটা খুবই জটিলতাপূর্ণ সেই গাবতলী গিয়ে দেখলাম রাস্তা ফাঁকা আর কয়েকটি সাইনবোর্ড যেখানে লেখা ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’। খুবই নির্বিঘ্নে আমিন বাজার সেতু পার হয়ে গেলাম। ভাবলাম এর পরের জায়গাটা হচ্ছে সাভার বাসস্ট্যান্ড। ওখানে ঘণ্টাখানেক লাগবেই। কিন্তু রহস্যজনকভাবে দেখলাম সেখানেও একই সাইনবোর্ড ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’ এবং রাস্তা ফাঁকা। গেলাম নবীনগর সেখানেও একই অবস্থা, রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি চলছে কোথাও কোনো বাধা নেই। তিন ঘণ্টার মাথায় আমি টাঙ্গাইলের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। কী করে সম্ভব হলো! হঠাৎ মনে পড়ল এ হচ্ছে সদ্য নির্বাচিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র বন্ধুবর আনিসুল হক এবং প্রিয়ভাজন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের পদক্ষেপ।
এরপর ঈদের ছুটিতে টাঙ্গাইল যেতে খুব কষ্টভোগ করেছি। কিন্তু একবার ড্রাইভার জানাল, স্যার কালকে টাঙ্গাইল যেতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোনো ম্যাজিক হচ্ছে কি? ড্রাইভার বলল, হ্যাঁ, হচ্ছে। কালকে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বসবেন এবং তিনি সারা দেশের ট্রাফিক সিস্টেমের পরিস্থিতি দেখবেন। সত্যিকারের ম্যাজিক ঘটে গেল। ঈদের আগের দিন আড়াই ঘণ্টার মধ্যে মায়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। এই ঘটনাগুলোতে কি মনে হয়? আমরা পারি। শুধু প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটু হাল ধরা। কখনো হাল ধরেন মেয়র আনিসুল হক, কখনো জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান। কখনো বড় ধরনের সংকটে হাল ধরেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যথায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কিন্তু সমগ্র ব্যবস্থাটাকে একটা নিয়ন্ত্রণে আনা কি সম্ভব নয়? প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নতির ফলে এটা তো কোনো বিষয়ই নয়। কেমন করে বিষয় নয় তাও জানি।
প্রাচ্যদেশীয় লোকগুলো বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষ আইন মানতে চায় না। আইনের ব্যাপারে তাদের এক ধরনের ক্ষোভ আছে। কেন আইন মানব? এই জন্যই লাখ লাখ মামলার স্তূপ জমে ওঠে আদালতগুলোতে। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে জেলা শহরগুলোতে আদালতের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। এখন সেখানে ছয়তলা থেকে আটতলা পর্যন্ত ভবনে বিভিন্ন আদালত গড়ে তোলা হয়েছে। একটি জেলা শহরেও অনেক বিচারক রাখতে হচ্ছে এবং ছয় সাত এমনকি আটতলা ভবন নির্মাণ করতে হচ্ছে শুধু আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। দেশের স্বাধীনতা কি শুধু আদালত নির্মাণের কাজ করবে না কি মানুষে মানুষে সংঘাত কমিয়ে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনকারীর সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসবে?
আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখতাম একটা লোক ছোট্ট একটা গাড়ি চালিয়ে চলাচল করত। পাঁচ-ছয় গজ দূরের একটা জায়গায় যেতেন। একটু বড় হয়ে জেনেছি তিনি জেলার মুন্সেফ। বাসা থেকে আদালতে যান। তার চেহারা কখনো দেখিনি। কিন্তু একটা ছোট্ট এলাকায় তিনি এসব আইন আদালতের বিচার করেন। আর বাকিটা করেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেটাও খুব বড় কিছু নয়।
সম্প্রতি ব্যাংকের একজন ডিজিএমের স্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের একজন অফিসারের দ্বন্দ্ব হয়েছে। কারণ উনি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে গাড়ি পার্ক করেছিলেন। কিন্তু ডিজিএমের স্ত্রী বলছেন তিনি আইন ভঙ্গ করেননি। তার নামতে যতটুকু সময় লেগেছে ততটুকু সময়ই তিনি নিয়েছেন। এসব ব্যাপারে অনেক বাহাস হতে পারে, কে ভুল আর কে ঠিক? কিন্তু ট্রাফিক আইন তো মানতে হবে। যেখানে ট্রাফিক আইন সম্পূর্ণভাবে যন্ত্র বিবর্জিত আধুনিককালে সমস্ত ব্যবস্থা উপেক্ষিত, যে শহরে সবুজ, হলুদ এবং লালবাতির সংকেত জ¦লে না সেই শহরে ট্রাফিক আইন কী করে বাস্তবায়ন করা যায়? অধিকাংশ সময়ে হস্ত নির্দেশিত ট্রাফিক সিগন্যাল দেখা যায় অথবা নির্দেশকারী একেবারেই তার অভিজ্ঞতাপ্রসূত ট্রাফিক সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছেন। তখন তা মেনে চলাও কি নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকাবাসী এই যে আদিম অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে তার জন্য তাদের কোনো আক্ষেপ নেই?
স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যেটা ছিল আমাদের একটা আদর্শ ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থাকে কেমন করে ধ্বংস করা হলো তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। স্কুলের ওই শিশুরা মন্ত্রীদের, পুলিশ অফিসারদের হাঁটতে বাধ্য করেছিল। তারা ওই ব্যবস্থাকে কিন্তু মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের রাজনীতিবিদদের কি করে বোঝাব সব কিছু রাজনৈতিক করবেন না! সব কিছুকে রাজনৈতিক করতে গেলে অনেক বড় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। দয়া করে শিক্ষাকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। দুর্নীতিকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। শিক্ষাকে রাজনীতি করতে গেলে কীভাবে দুর্নীতি এসে যায় সেটা আপনারা জানেন। তদবিরে নিয়োগ বাণিজ্যের লাখ লাখ টাকায় শুধু কিছু অশিক্ষিত লোকরা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়ে তারা শিশুদের মননকে যে কীভাবে ধ্বংস করে দেয় তা রাজনীতিকরা একটিবারও ভাবেন না।
ঢাকা শহরের নাগরিকরা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে তেমন কিছু বলেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও কিছু বলেন না। প্রথমটায় বলেন না তার কারণ রিকশায় চড়তে তারা খুবই আনন্দ পান এবং অনেক শিক্ষিত লোককে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে রিকশায় করে রাস্তার রংসাইড দিয়ে ঢুকে পড়েন তারা রিকশাচালককে মানা তো করেনই না, অনেক সময় উৎসাহ এমনকি রংসাইডে ঢুকে পড়ার পরামর্শও দেন। আমি এই প্রসঙ্গে তেমন বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ শহরগুলোতে গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক দূর হেঁটে এসে তারা যে গণপরিবহনে চড়ার একটা সুবন্দোবস্ত পাবেন, সেই ব্যবস্থা আমরা রাখতে পারিনি। পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় শহরে নাগরিকদের অনেক পথ হাঁটতে হয়। কারণ তারা গণপরিবহনে উঠবেন হেঁটেই, কাজেই তাদের স্বাস্থ্যও অত্যন্ত ভালো থাকে। এ দেশেও হয়তো রিকশা বন্ধ করে দিলে মধ্যবিত্তদের একটা আন্দোলনও শুরু হয়ে যাবে। যার নাম হবে অলস বাঙালিদের আন্দোলন।
কিন্তু আবার এও দেখেছি, উত্তরা বা মিরপুরের নাগরিকরা খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্রেনে উঠছেন। কিন্তু ধানম-িবাসীর কী হবে? এখানে তো গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই, একমাত্র বাসই ভরসা। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একই ব্যবস্থা। তাদের জন্যও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব সমস্যা মিলে রাষ্ট্রের বায়ান্ন বছর হয়ে গেল, কোনো সুশৃঙ্খল আধুনিক গণপরিবহনের ব্যবস্থা হলো না। অতএব যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে আমাদের নগরগুলোতে সামান্য বৃষ্টি হলে ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় পানি জমে যায়। সেখানে তখন মানুষ মারা পড়বে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এটার কোনো দায়দায়িত্বও নেবে না? দুটি সিটি করপোরেশন নিবিড় ঘুমে রাত্রিযাপন করবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে একটি মন্ত্রণালয় আছে। তারা বৃষ্টিতে ঘুম উপভোগ করবে আর মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বিপদসঙ্কুল সময় অতিক্রম করবে। এসব সমস্যা দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু এর যে সমাধান সম্ভব তা কিন্তু অনেকেই জানেন না। আনিসুল হক জানতেন। ঢাকার বর্তমান মেট্রোপলিটন কমিশনার হাবিবুর রহমান জানেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জানেন। জানেন অনেক নাগরিক। কিন্তু সমস্যা সমাধানের সুযোগ অত্যন্ত কম। তাদের ক্ষমতা যদি বাড়ানো যায় তাহলে অনেক কিছু ঘটানো সম্ভব। সেই দিকটায় আমরা কি যেতে পারি? লেখক: নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।