
শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের ভূখণ্ডের মানুষের দীর্ঘদিনের। পরাধীনতার সুদীর্ঘ বছরগুলোতে ১৯০ বছর ব্রিটিশ, পরে ২৩ বছর পাকিস্তানিদের আমরা দেখেছিলাম কীভাবে তারা আমাদের শোষণ করেছে। শোষণের প্রয়োজনেই শাসন করা ছিল তাদের কাজ। আমাদের তারা যে পরিমাণ শোষণ করেছে তাদের সমৃদ্ধি ততই বেড়েছে। জনগণ এটা মেনে নিতে চায়নি, তাই ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তেভেজা এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছে। কিন্তু যেকোনো সংগ্রামের একটা সূচনাবিন্দু থাকে, স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াইয়েরও তেমনি শুরু খুঁজতে হলে প্রথমেই আসে ৫২ সালের কথা। ৭১-এ অর্জিত এই স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি যে বেদনা এবং যে চেতনা জাগিয়ে দিয়েছিল তা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বৈষম্য বেদনা জাগিয়েছিল বলেই মুক্তি-চেতনার জন্ম হয়েছিল। এই বৈষম্য থেকে মুক্তি আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা জোগায়।
কেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যেই মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমির আন্দোলনে নিম্নবিত্ত দরিদ্র মুসলমান দলে দলে যুক্ত হয়েছিলেন এই প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আশা জাগিয়ে তোলা হয়েছিল যে মুসলমানদের আলাদা দেশ পাকিস্তান গঠিত হলে সেখানে কোনো শোষণ থাকবে না। কারণ মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। ভাই কি ভাইকে শোষণ করতে পারে? আর উচ্চবিত্ত ধনী উচ্চশিক্ষিত মুসলমান যুক্ত হয়েছিলেন এই আশায় যে রাষ্ট্রটা হাতে পেলে ক্ষমতার দুধ-মধু সবই তারা খেতে পারবেন। ফলে এই দুই শ্রেণির ছিল দুই আশা কিন্তু লক্ষ্য ছিল এক, সেটা হলো পাকিস্তান সৃষ্টি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম যে প্রশ্ন এলো এই রাষ্ট্রের সংবিধান কেমন হবে। শুধু মুসলমানদের জন্য কেন, কোনো ধর্মের ভিত্তিতেই কি কোনো দেশ হতে পারে? যদি তাই হতো তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের অধিবাসীই তো মুসলমান, তাহলে তারা সবাই মিলে একটা দেশ হতে পারে না কেন? আবার এক দেশে বহু ধর্মের মানুষ থাকলে তাদের পরিচয় কী হবে? আবার ভারতে যে মুসলমানরা থেকে গেলেন তাদের পরিচয় কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা গেলেও আশ্বস্ত করা হয়েছিল এই বলে যে, এক দিন হিন্দু আর হিন্দু হিসেবে নয়, মুসলমান আর মুসলমান হিসেবে নয় তারা সবাই বিবেচিত হবেন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয় আর নাগরিক পরিচয় এক হবে না। একেবারে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিপরীতমুখী যাত্রা! তাহলে এত সাম্প্রদায়িক কারণে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু কীসের জন্য? এই টানাপড়েনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে তাই দীর্ঘ সময় লেগে গেল। ১৯৪৭ সালে জন্ম নিল পাকিস্তান আর তার ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে প্রণীত হলো সংবিধান। এ সময়টায় সংবিধান না থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্রিটিশ প্রবর্তিত বিধান তো ছিল, তা দিয়েই চলছিল সব। রাষ্ট্রের ধর্ম নিয়ে সমাধানে আসতে না আসতেই প্রশ্ন এলো রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে? এক ধর্ম, এক দেশ, এক ভাষা এ ধরনের চিন্তা থেকেই মুসলমান, পাকিস্তান এবং উর্দু ভাষাকে সমার্থক করার আয়োজন চলছিল সর্বত্র। অন্যদিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনে ঢাকা তখন উত্তাল। এ সময় ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত গণসংবর্ধনায় তিনি বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। ভাষা আন্দোলনকে তিনি মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যের প্রতিবাদ হয় সমাবেশের মধ্যেই। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে স্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি বাতিল করে দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি অবশ্যই উর্দু। কারণ উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে। ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়। ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ভাষার দাবিকে তাচ্ছিল্য করে ২৮ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন জিন্নাহ।
জিন্নাহ চলে গেছেন কিন্তু উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে পারেননি। প্রশ্ন ছিল, উর্দু কি পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা? সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ প্রত্যেকেরই তো আলাদা ভাষা। ভাষা দিয়ে কি ধর্মের পরিচয় তুলে ধরা যায়? আরবি ভাষায় কি মুসলমান ছাড়া কেউ কথা বলে না? আরবের খ্রিস্টান, ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষরাও তো আরবি ভাষায় কথা বলে। এ কথা তো সত্য যে, মানুষ যত দ্রুত ধর্মান্তরিত হতে পারে তত সহজে ভাষান্তরিত হতে পারে না। আরবের মুসলমান আর ইন্দোনেশিয়ার মুসলমান ধর্মে এক হলেও ভাষা এবং সংস্কৃতিতে এক নয়। আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথাও যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে যে ভাষায় ৫৪ শতাংশ মানুষ কথা বলে তাদের দাবি কি অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হবে না?
ভাষা আন্দোলনের মূল সুর ছিল গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক। রাষ্ট্র তার নাগরিককে ধর্মের ভিত্তিতে বিবেচনা করবে না। এই ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া ও বসবাস করা মানুষরা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের নাগরিক। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্তি হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল শহীদ মিনার। তারা জীবন দিয়েছিলেন এই ভূখণ্ডের সব মানুষের মুখের ভাষার জন্য। তাই সব ধর্মের মানুষ যেন শ্রদ্ধা জানাতে পারে সে উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল শহীদ মিনার।
একুশ শিখিয়েছিল আত্মসমর্পণ নয়, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে। একুশ মানে মাথানত না করা। এটা আমাদের কাছে এখনো একটি প্রেরণাদায়ক কথা। প্রবল শক্তির কাছে বা যুক্তিহীনতার কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু সম্মানের সঙ্গে বাঁচা যায় না। অন্ধত্ব বা অন্ধকার যত প্রবলই হোক না কেন যুক্তি অস্ত্রে তাকে পরাভূত করা সম্ভব যদি ব্যাপক মানুষের মধ্যে সেই যুক্তির আলো পৌঁছে দেওয়া যায়। যুক্তির আলো পথ দেখিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার। স্বাধীনতার সঙ্গে মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ তা অর্জন করতে হলেও যুক্তিই হবে অন্যতম হাতিয়ার। ভাষার দাবিতে লড়াই পথ দেখিয়েছে, নাগরিক অধিকার অর্জন করতে হলে ভোটের অধিকার দরকার। বৈষম্য দূর করার প্রথম পদক্ষেপ হলো সবার ভাতের অধিকার। সে কারণেই স্লোগান উঠেছিল কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না। আর এসব দাবিকে একসঙ্গে যুক্ত করেছিল এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন করতে হবে। তাই দেখা যায়, ভাষা-ভাত-ভোট-ভূখণ্ড এই চারটি শব্দ, যা ‘ভ’ দিয়েই শুরু তা আমাদের জীবন ও রাজনীতিকে তখন কতটা প্রভাবিত করেছে এবং এখনো করছে।
আন্দোলন থামে না তার পরিণতিতে না যাওয়া পর্যন্ত। তাই ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করে স্বাধীন হলাম কিন্তু বন্দি হয়ে গেলাম পুঁজির কাছে। মুখের ভাষায় পড়তে হলে যে শিক্ষা লাগে তা তো আমরা জানি। সেই শিক্ষা ক্রমাগত ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হচ্ছে, ফলে তা চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। শিক্ষার ওপর আক্রমণের পাশাপাশি আক্রমণ আসছে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর। ছাত্রদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতীতের সংগ্রামের ইতিহাসকে। যেমন : গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং একটি গণতান্ত্রিক, বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার একই পদ্ধতির শিক্ষানীতির দাবিতে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের জীবন দিতে হয়েছিল তা প্রায় ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।
ভাষা চিন্তার বাহন। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জীবন দিলেও সে ভাষায় কথা বলতে গেলে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ লাগে, দেশে কি এখন সে অবস্থায় আছে? এই প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উত্তর নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর ভোটের অধিকারের জন্য লড়তে হচ্ছে এখনো। নানা ধরনের কালাকানুন আর সাম্প্রদায়িক বাতাবরণে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। মাথানত না করার সাহস দিয়েছে একুশ, আর মাথানত করে রাখার পরিবেশ তৈরি করেছে রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্র জনগণের ট্যাক্সে চলে সেই রাষ্ট্র জনগণকে দেখায় ভয়। ফলে দেশ, অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে বন্ধু-স্বজনরাও পরামর্শ দেয় এবং বলে, বাদ দাও তো এসব, কী দরকার রাজনীতির বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে! এই ভয় আর ভরসাহীনতার রাষ্ট্র তো আমরা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম রাষ্ট্রটা হবে জনগণের এবং জনগণকে ভরসা দেবে।
একুশ যে চেতনা জাগিয়েছিল তার মর্মে ছিল মুক্তির আকুতি। শোষণ থেকে মুক্তি, বৈষম্য থেকে মুক্তি আর মুক্তি অপমান থেকে। এই চেতনা ছড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনায়। কোনো মানুষ যেন তার মাতৃভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন সেই লড়াইকে এগিয়ে নিতে একুশ যেন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে আরও বহুদিন।
লেখক : রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
[email protected]
দেশভাগের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় মাতৃভাষার জন্য বাঙালিকে রাজপথে নামতে হয়। সাত মাসের মধ্যে ঘটে রক্তপাতের ঘটনা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম রক্তাক্ত হয় পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ। ওই দিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় পালিত হয় প্রথম ধর্মঘট। পুলিশের বর্বর হামলা ও গুলিবর্ষণে সচিবালয়ের সামনের রাস্তা রক্তে ভিজে যায়। কারাগার ভরে যায় তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সংগ্রামী ছাত্রদের গ্রেপ্তারে। সেদিন প্রতিবাদের যে ভিত রচিত হয় তারই পথ ধরে আসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তঝরা দিন এবং এর আগের-পরের সময়গুলো ক্যামেরায় ধারণ করেন চল্লিশের দশকের শক্তিমান আলোকচিত্রী শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব। তার তোলা ভাষা আন্দোলনের এই দলিলচিত্রগুলো হয়ে ওঠে পাকিস্তানি স্বৈর-সিদ্ধান্তের বিপরীতে প্রতিবাদের হাতিয়ার।
দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তথ্য অধিদপ্তরের [পিআইডি] কার্যালয় খোলা হয়, ইয়াকুব ছিলেন এর প্রথম দিককার ফটোগ্রাফার। সরকারি চাকুরে হয়েও বাঙালির পক্ষে তার এই অবস্থান ছিল শাসকচক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আটচল্লিশের অগ্নিঝরা সময় যার ক্যামেরায় মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল, তার অসীম সাহসিকতার গল্প কোথাও উল্লেখ নেই। ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্রী হিসেবেও তার নামটি এখন পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি কোনো মহলে। ফলে বাংলা ভাষার জন্য তার যে বিশাল অবদান কিংবা ত্যাগের মহিমা, সাধারণ মানুষের কাছে তা অজানা থেকে গেছে।
দৈনিক বাংলার পাতায়
আটচল্লিশের রক্তাক্ত অধ্যায় যে শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের ফ্রেমে ধরা তার খোঁজ মেলে পুরনো পত্রিকার ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে। তার তোলা তিনটি দুর্লভ ছবি ১৯৭৪ সালের ৭ জুন দৈনিক বাংলার শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। ছবিগুলোর ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয় শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের নাম। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল আগে পত্রিকায় ছাপা হওয়া এই ছবিগুলো যেন বাঙালির গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের একঝলক। প্রকাশিত একটি ছবি হলো ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র-সমাবেশের। ভাষা আন্দোলনের পাটাতন তৈরির সময়ের ছবি বলে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। আরেকটি ছবি ১১ মার্চ সচিবালয়ের ১ নম্বর গেটে আহত মোহাম্মদ বায়তুল্লাহকে [যিনি ছিলেন শ্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডেপুটি স্পিকার] ঘিরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রনেতাদের। এই দুটি ছবি বর্তমান প্রজন্মের একেবারেই অদেখা। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা শওকত আলীর পাশে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি ১১ মার্চ তোলা বলে বিভিন্ন প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ওই দিন শওকত আলী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। আর শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করা হয়। ১৫ মার্চ শেখ মুজিব মুক্তি পান। পরদিন সুস্থতার ছাড়পত্র পান শওকত আলী। ফলে এ ছবিটি ১৬ মার্চ হাসপাতাল গেটে তোলা বলে গবেষকরা মনে করেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও এর সত্যতা মেলে। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজে অবস্থিত ভাষা আন্দোলন জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় এই ঐতিহাসিক ছবির একটি খন্ডিত অংশ সংরক্ষিত আছে। কিন্তু প্রদর্শিত ছবিতে আলোকচিত্রীর নাম উল্লেখ নেই। ফলে দৈনিক বাংলায় ছবিগুলো ছাপা না হলে এই কৃতী আলোকচিত্রকরের নাম জানা সম্ভব হতো না।
এত দিন সবাই জানতেন, আটচল্লিশে আ জা ম তকীয়ুল্লাহ এবং বায়ান্নতে আমানুল হক, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, জমিল চৌধুরী আর ডা. আবদুল হাফিজ ছবি তুলেছিলেন। জীবদ্দশায় তকীয়ুল্লাহ, আমানুল হক ও রফিকুল ইসলাম ভাষাসংগ্রাম নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন এবং তাদের তোলা ছবিগুলো চিহ্নিত করে গেছেন। ফলে আটচল্লিশের বাকি যেসব ছবি বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বেনামে ঘুরে বেড়ায়, সেগুলো কার তোলাÑএই প্রশ্নের উত্তর ছিল অমীমাংসিত। ইয়াকুবের ছবিগুলোর সন্ধান পাওয়ায় অমীমাংসিত বিষয়টির সমাধানের পথ তৈরি হলো। আটচল্লিশের ভাষাসংগ্রামের যে বিস্তৃতি তাতে এই তিনটি ছবি ছাড়াও তার তোলা আরও অনেক ছবি থাকার কথা। সেগুলোর মূল নেগেটিভ এখন কোথায় কিংবা কী অবস্থায় আছে, তা অজানা। নেগেটিভগুলো উদ্ধার করা গেলে ভাষা আন্দোলনের আরও অজানা ইতিহাস প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হতো।
বিশিষ্টজনের মন্তব্য
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, এখন পর্যন্ত ভাষাসংগ্রামের যে লিখিত ইতিহাস, তাতে শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের কথা উল্লেখ নেই। কিন্তু চুয়াত্তরের পত্রিকায় যেহেতু ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাই তাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, আমাদের মনোযোগ বায়ান্নর দিকে। কিন্তু আটচল্লিশ আর বায়ান্ন একই সূত্রে গাথা। আটচল্লিশ ছাড়া বায়ান্নকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। আটচল্লিশের ১১ মার্চ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কারাবরণের কারণে শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন, যা ইয়াকুবের ক্যামেরায় বন্দি। বায়তুল্লাহর ছবিটি প্রমাণ করে ওই দিনের বিক্ষোভ সমাবেশে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ইয়াকুব শুধু আটচল্লিশেই নয়, ছেচল্লিশের দাঙ্গার ছবি তুলেও দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। ছাত্রজীবনেই বন্ধু হিসেবে শেখ মুজিবের সান্নিধ্য পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠার পেছনে যে কয়েকজন মানুষের নেপথ্য সমর্থন ছিল, ইয়াকুব তাদের অন্যতম। ফলে এই মানুষটি সম্পর্কে আরও বেশি জানা দরকার। এ বিষয়ে যত তথ্য, বিবরণ ও ভাষ্য উঠে আসবে, আমাদের ইতিহাস ততই সমৃদ্ধ হবে।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, আগে ফটোগ্রাফারদের ক্রেডিট দেওয়া হতো না বলে তাদের কথা মানুষ জানত না। অনেক দেরিতে হলেও শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ভাষাসংগ্রামীকে আবিষ্কার করতে পারা এক বিশাল ঘটনা। তার তোলা আমতলার সমাবেশ আর আহত বায়তুল্লাহ্র ছবিটি ইতিহাসের এক নব সংযোজন। ফলে তার ছবির কারণে আমাদের ভাষা আন্দোলনের পরিধিটাও আরও বিস্তৃত হলো। এখন থেকে ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে তার নাম ব্যবহার করা কর্তব্য বলে মনে করি।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে
নিভৃতচারী হওয়ার কারণে একসময়ের শক্তিমান আলোকচিত্রকার শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব কালের আবিলতার আড়ালে চাপা পড়ে যান। সে আবিলতা ঝেড়ে সবার আগে তাকে উজ্জ্বল আলোয় আপন সৌকর্যে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব আর ইয়াকুব ছিলেন ঘনিষ্ঠ সহপাঠী। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে তাদের বন্ধুত্ব। একই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন বলে বিভিন্ন মিছিল-মিটিং, আন্দোলন-সংগ্রামে ক্যামেরা কাঁধে বন্ধুর পাশে ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছেন ইয়াকুব। ছেচল্লিশের দাঙ্গা নিরসনে তার তোলা মর্মস্পর্শী ছবিগুলো অবিভক্ত বাংলায় কী প্রভাব ফেলেছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ৮১ ও ৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি আর ইয়াকুব নামে আমার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু পরামর্শ করলাম, আজ [১৯ আগস্ট, ১৯৪৬] মহাত্মাজীকে একটা উপহার দিব। ইয়াকুব বলল, তোমার মনে আছে আমি আর তুমি বিহার থেকে দাঙ্গার ফটো তুলেছিলাম? আমি বললাম, হ্যাঁ মনে আছে। ইয়াকুব বলল, সমস্ত কলকাতা ঘুরে আমি ফটো তুলেছি। তুমি জান না তার কপিও করেছি। সেই ছবিগুলি থেকে কিছু ছবি বেছে একটা প্যাকেট করে মহাত্মাজীকে উপহার দিলে কেমন হয়। আমি বললাম, চমৎকার হবে। চল যাই, প্যাকেট করে ফেলি। যেমন কথা তেমন কাজ। দুইজন বসে পড়লাম। তারপর প্যাকেটটা এমনভাবে বাঁধা হল যে, কমপক্ষে দশ মিনিট লাগবে খুলতে। আমরা তাকে উপহার দিয়েই ভাগব। এই ফটোর মধ্যে ছিল মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, শুধু শরীরটা আছে, বস্তি, মসজিদে আগুন জ¦লছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, এমনই আরও অনেক কিছু! মহাত্মাজী দেখুক, কিভাবে তার লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে। আমরা নারকেলডাঙ্গায় মহাত্মাজীর ওখানে পৌঁছালাম। তার সাথে ঈদের মোলাকাত করব বললাম। আমাদের তখনই তার কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। মহাত্মাজী আমাদের কয়েকটা আপেল দিলেন। আমরা মহাত্মাজীকে প্যাকেটটা উপহার দিলাম। তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করলেন। আমরা যে অপরিচিত, সেদিকে তার ভ্রƒক্ষেপ নাই। তবে বুঝতে পারলাম, তার নাতনী মনু গান্ধী আমার চেহারা দেখেছে ব্যারাকপুর সভায়, কারণ আমি শহীদ সাহেবের [হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী] কাছে প্ল্যাটফর্মে বসেছিলাম। আমরা উপহার দিয়ে চলে এলাম তাড়াতাড়ি হেঁটে।...। বন্ধু ইয়াকুবের এই ফটোগুলি যে মহাত্মা গান্ধীর মনে বিরাট দাগ কেটেছিল, তাতে সন্দেহ নাই।’
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিককার ছবিগুলো শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের তোলা বলে ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে। কলকাতার ব্যারাকপুরের জনসভায় মহাত্মা গান্ধীর পাশে ২৭ বছরের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি যে ইয়াকুবের তোলা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
ব্যক্তিজীবন
শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের জন্ম ১৯১৭ সালে, অবিভক্ত বাংলার কলকাতায়। কলেজে পড়ার সময় এক খ্রিস্টান যুবকের কাছ থেকে বিশ টাকা দিয়ে কোডাকের বি-টু সাইজের ফোল্ডিং ক্যামেরা কিনে ফটোগ্রাফি শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ছবি তুলে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ওই সব ছবি দেখে তৎকালীন তথ্য সচিব তাকে কেন্দ্রীয় তথ্য দপ্তরে ফটোগ্রাফার হিসেবে যোগ দিতে বলেন। দেশভাগের সময় তিনি স্থায়ীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসে পিআইডিতে যোগদান করেন। তখন মুক্তাঙ্গনের পাশে ছিল পিআইডির কার্যালয়। পিআইডির নিজস্ব ডার্করুম না থাকায় তিনি পুরান ঢাকার ‘স্টুডিও এইচ’ থেকে ছবি প্রিন্ট করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অকৃতদার ছিলেন। মাকে নিয়ে পল্টনের একটি ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। এ দেশে তার আপন কেউ ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধুকেই তিনি অভিভাবক মনে করতেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হওয়ার পর তিনি সত্যিকার অর্থেই অভিভাবকহীন হলেন। আর পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে অবসর গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যে মায়ের মৃত্যুতে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি।
জীবনসায়াহ্নে
ইয়াকুবের শেষ জীবনটা ছিল ভীষণ কষ্টের। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, অর্থের অভাবে সেটিও একসময় ছেড়ে দিতে হয়। ফলে রাতের বেলায় প্রেস ক্লাবের অভ্যর্থনা কক্ষের মেঝেতে কিংবা ফুটপাতে ঘুমাতেন। দিনের বেলায় ঘুরে বেড়াতেন প্রেস ক্লাবের আঙিনায়। ক্যানটিনের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতেন। অনুজ ফটোসাংবাদিক খালেদ হায়দার আর বুলবুল আহমেদকে কাছে পেলে পুরনো দিনের গল্প বলতেন। জীবনের শেষদিকে শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কেউ কেউ তাকে বোঝাও মনে করতেন। বেশির ভাগ সময় তাকে না খেয়ে থাকতে হতো। বড় অবহেলায় নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত।
কবে মারা গেলেন শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব, জানতে প্রেস ক্লাবে গেলাম। কয়েকজন প্রবীণ আলোকচিত্রী তার কথা শুনে স্মৃতিকাতর হলেন। কিন্তু দিনক্ষণ বলতে পারলেন না! প্রেস ক্লাবের রেজিস্ট্রি খাতায়ও তার মৃত্যুর তারিখটি পাওয়া গেল না! কম্পিউটারে সংরক্ষিত তালিকা দেখে একজন বললেন, ‘এই নামে কোনো ফটোসাংবাদিক ছিল বলে জানা নেই!’ পরে বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে পুরনো পত্রিকার ফাইল ঘেঁটে জানা গেল শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের চলে যাওয়ার দিনটি ছিল বুধবার, ৭ জুন, ১৯৯৫। সেই সময়ের জাতীয় কয়েকটি দৈনিকে কী নিদারুণ দায়সারাভাবে তার মৃত্যুর খবর ছাপে, তা দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হলো।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
ভাষাশহীদ আবুল বরকত ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরের বছর তৎকালীন পূর্ববাংলায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করে এমএ শেষ পর্বের ছাত্র ছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে তার জন্ম, ডাকনাম আবাই। শহীদ বরকত সম্পর্কে খুব কমই জানি। আমরা দুজন ২০১৮ সালে ভাষাশহীদ আবুল বরকত সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তার জন্মস্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ভাষার মাসকেই বেছে নিই। ২ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় বিমানে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে কলকাতায় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দরে পৌঁছাই দুপুর ১২টায়। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে কলকাতার চিতপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাই দেড়টা নাগাদ। আমাদের গন্তব্য মুর্শিদাবাদের বহরমপুর। কলকাতা থেকে বহরমপুরের দূরত্ব ২০০ কিমি। সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ। ট্রেনের নাম ‘ধনধান্যে’। বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ট্রেন ও স্টেশনের পর স্টেশন অতিক্রম করে এগোতে লাগল। মাঝেমধ্যে পরিচিত জায়গার নাম চোখে পড়ায় যেন শব্দদূষণের যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হলো। যেমন বারাসাত, রানাঘাট, পলাশী, হুগলী, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি। রাত ৯টা বাজার কয়েক মিনিট আগে আমরা বহরমপুর স্টেশনে নামলাম। ‘সোনার বাংলা’ হোটেলে উঠলাম।
৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার ২০১৮। সকাল ৮টায় ভাষাশহীদ বরকতের নিজগ্রাম বাবলার উদ্দেশে ট্যাক্সিতে রওনা হলাম। শীতের সকাল। শহরের গন্ডি পেরোতেই চারদিকে ঘনকুয়াশা, ডানে-বামে কিছু দেখা যায় না। শহরের বাইরে রঞ্জিত সার্ভিস পেট্রলপাম্প স্টেশন পার হয়ে সামনের মোড় থেকে বামদিকে বাদশাহী রোড ধরে সালার থানা। সালারের বাসিন্দা বরকতের চাচাতো ভাই মানিক মিয়ার ছেলের ঘরের নাতি দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া সামিন। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে সালার ডিগ্রি কলেজের সামনের মোড়ে অবস্থান করছে। সামিন শহীদ বরকতের তৃতীয় প্রজন্মের সর্বকনিষ্ঠ বংশধর। সামিনদের বাসায় আমাদের প্রথম বিরতি। ঘরে ঢুকতেই দেখা হলো কোটপরা ছয় ফুটের বেশি লম্বা সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের সঙ্গে। চেয়ারে বসা। বুঝতে বাকি রইল না, উনিই বরকতের চাচাতো ভাই ‘মানিক মিয়া’। বরকতকে স্বচক্ষে দেখা একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। তার কিছু ছবি তোলা ও বক্তব্য রেকর্ড করার কাজটি দ্রুত সেরে নেওয়া হলো। দুপুর ১২টা বেজে গেছে প্রায়। আমরা দ্রুত সামিন ও মানিক মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বরকতের জন্মভূমি বাবলা গ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে মানিক মিয়ার সঙ্গে অনেক কথা হলো বরকত সম্পর্কে। বয়সের ভারে তিনি অনেকটাই ন্যুব্জ, অসুস্থও। বরকতের সঙ্গে তার সর্বশেষ দেখা হয় তার ৯ বছর বয়সে। এর বেশি স্মৃতি তার মনে নেই।
গ্রামের অপ্রশস্ত পথ ধরে এগোলাম। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা চলার পর বাবলা গ্রামে ‘বরকত ভবন’-এর সামনে গাড়ি থামল। আমরা দুজনই খুব পুলকিত। শহীদ বরকতের অনাবিষ্কৃত ইতিহাসের দোরগোড়ায় আমরা এসে গেছি। গাড়ি থেকে নেমে তাকিয়ে দেখি রাস্তার পূর্ব পাশে ‘বরকত ভবন’ নামাঙ্কিত ডুপ্লেক্স ভবন। ভবনের গায়ে লেখা ‘শহীদ আবুল বরকত কেন্দ্র’, স্থাপিত ২০০৫-০৬, বাবলা, রেজি. নং ঝ/১খ/১৭২০৩.১। ঠিক সামনেই রাস্তার দক্ষিণ পাশে ‘শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি সংঘ’, স্থাপিত-১৯৯৬, রেজি. নং-ঝ/১খ/১৪১৫০ বাবলা (বরকত নগর); পো. তালিবপুর, জেলা-মুর্শিদাবাদ। ছোট একতলা ভবন। ভবনটির সামনেই একটি ছোট্ট স্ট্যান্ডের ওপর শহীদ বরকতের সোনালি রঙের আবক্ষ মূর্তি। নিচে নেমপ্লেটে লেখা আছে ‘ভাষাশহীদ, শহীদ আবুল বরকত, আবির্ভাব : ১৬ই জুন ১৯২৭, শহীদ : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, উদ্বোধক মাননীয় সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, শ্রী অধীর রঞ্জন চৌধুরী, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।’
আশপাশের বাড়ির লোকজন আমাদের আগমন টের পেয়ে কাছে আসতে শুরু করেছে। অনুরোধ করতেই বরকত ভবনটি খুলে দেওয়া হলো। ডুপ্লেক্স ভবন। ভেতরে একাধিক কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের সামনে ভাষাশহীদদের নামফলক লাগানো। (১) ভাষাশহীদ সালাম কক্ষ; (২) ভাষাশহীদ রফিক কক্ষ; (৩) ভাষাশহীদ বরকত লাইব্রেরি কক্ষ। ভবনে একটি বড় হলরুম আছে। জানা গেল এখানে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ বরকতের সম্মানে অনুষ্ঠান হয়। রাস্তার উত্তর পাশে বরকত ভবনের ঠিক উল্টো পাশে শহীদ বরকতদের বসতঘর। বাড়িটি অন্য লোকের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। তিনি সেখানে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কিন্তু বরকতদের ইটের একতলা ঘরটি, যার দক্ষিণ পাশে দুটি জানালা আছে, স্মৃতি হিসেবে আগের আকৃতিতে রেখে দিয়েছেন। রাস্তার দক্ষিণ পাশে একটি বড় দীঘি আছে। এলাকার লোকজনের ভাষ্য, এ দীঘিটি বরকতের পরিবারের। শহীদ বরকতের বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ গজ পূর্বদিকে রাস্তা ঘেঁষে রয়েছে ‘শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
শহীদ আবুল বরকত এ বিদ্যালয়েই প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন। তখন নাম ছিল বাবলা বহড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয় ভবনটি দোতলা। ভবনের মাঝখানে অপ্রশস্ত সিঁড়ি, এর দুদিকে ছোট ছোট ক্লাসরুম। কোনো শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের বসার কোনো বেঞ্চের অস্তিত্ব পেলাম না। শিক্ষার্থীরা মেঝেতে বসেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম সারছে। বিদ্যালয়ের সামনের দেয়ালে শিক্ষার্থীদের সাপ্তাহিক খাবারের মেন্যু টানানো আছে। জানা গেল, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় দুপুরের খাবার স্কুলেই মেন্যু অনুযায়ী রান্না হয় এবং শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়। বাবলা গ্রামের এই বিদ্যালয়টির দৈন্যদশা আমাদের ব্যথিত করেছে।
আমরা আবার বরকতের বাড়ির আঙিনায় ফিরে এলাম। কথা হয় বরকতের পড়শি, সম্পর্কে ভাইপো মো. আবদুল্লাহর সঙ্গে। তার বয়স পঞ্চাশের বেশি। তার ভাষ্য, বরকতের সম্পত্তি বাড়িঘর ও ধানিজমি মিলে প্রায় ৪০ বিঘা। সবটাই ওয়াকফ করা আছে আবুল বরকত স্মৃতি সংঘের নামে। এ সম্পত্তির আয় থেকেই প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালন, বরকতের নামে অনুষ্ঠান করা এবং বরকতসংক্রান্ত কাজে ব্যয় করার কথা। কিন্তু বরকতের আত্মীয়স্বজনরা খোঁজখবর নেয় না। তাই প্রায় সব সম্পত্তিই দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এরপর মিনিট দশেক খোঁজার পর শহীদ আবুল বরকত নামে একটি স্কুল ভবন পাওয়া গেল। বিদ্যালয়টির নাম ‘শহীদ আবু বরকত শিশু শিক্ষা’, স্থাপিত : ২০০৩, গ্রাম : বাবলা, পো. : তালিবপুর, জেলা : মুর্শিদাবাদ, সৌজন্যে : ভরতপুর ১নং পঞ্চায়েত সমিতি। আমরা বাংলাদেশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি শুনে প্রধান শিক্ষক খুব খুশি হলেন। তার অনুমতি নিয়ে ক্লাস পরিদর্শনে গেলাম। এখানেও ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের বসার কোনো বেঞ্চ নেই। সবাই মাটিতে বসেই শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাবলা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম তালিবপুর হাই স্কুলের উদ্দেশ্যে। বাবলা থেকে তালিবপুর গাড়িতে প্রায় ২০ মিনিট। তালিবপুর হাই স্কুলে পৌঁছে টের পেলাম সেদিন শনিবার তাই স্কুল বন্ধ। কিছু ছবি তোলা ছাড়া আর কিছু করতে পারলাম না। এ নিয়ে যখন আলোচনা করছি তখন সামিন জানাল, সালার থানার পাশে শহীদ আবুল বরকতের স্মরণে একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে।
ফুলের টব ও উন্মুক্ত চত্বরে সাজানো পার্ক। আমরা কয়েকটি ছবি তুললাম। পার্কে ঢুকতেই গেটের সামনে ডানপাশে শহীদ বরকতের আবক্ষ মূর্তি। মূর্তির নিচে লেখা : ভাষা আন্দোলনের শহীদ, আবুল বরকত সাহেব, জন্ম ১৬ জুন ১৯২৭, মৃত্যু ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।’ বেদির পাশেই ডানদিকে শ্বেতপাথরের ওপর খোদাই করে লেখা : ‘বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবুল বরকত সাহেবের স্মৃতি উদ্দেশ্য সালার শিশু উদ্যান-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিলেন ড. রাজেশ কুমার আইপিএস মাননীয় পুলিশ সুপার মুর্শিদাবাদ ৮ই জুলাই ২০০০।’ সালার থানায় এবং অন্যান্য স্থানেও মানিক মিয়ার বেশ কদর। বরকতের ভাই হিসেবে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ২টা ছুঁই ছুঁই। এখনো আমাদের অনেক অনুসন্ধান বাকি। বরকতের আদি বাড়ি ও বহরমপুরে তার কলেজে যেতে হবে। চা-নাশতা সেরে আমরা মানিক মিয়াকে নিয়ে তার আদি বাড়ি ভরতপুর থানার কিসাতপুর গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। গাড়িতে মানিক মিয়ার সঙ্গে অনেক কথাই হলো। জানা গেল, বরকতের আদি গ্রাম কিসাতপুর। বাবলা তার মামার বাড়ি। তার বাবা শামসুজ্জামান ভোলা মিয়া বিয়ের পর বাবলায় চলে যায়। পরে কিসাতপুরের জায়গা-জমি বিক্রি করে বাবলায় জমি কিনে বাস শুরু করেন। পরে বরকত পড়ালেখার জন্য ঢাকায় তার মামার কাছে চলে যান। এখন বাবলা গ্রামে বরকতের পরিবারের কেউ থাকে না।
সামিন সালারে থেকে যায়। শুধু মানিক মিয়াকে নিয়ে আমরা চলে এসেছিলাম। অনেকটা পথ পেরিয়ে প্রায় দুপুর ৩টা নাগাদ আমরা কিসাতপুর হাজির হয়েছি। এ বাড়িতে মানিক মিয়া তার দুই ছেলে ও নাতি-নাতনিসহ থাকেন। মাটির দোতলা ঘর। বোঝা যাচ্ছে অসচ্ছল পরিবার। আমাদের যে ঘরে বসতে দিল তাতে একটা চৌকি, কাঠের আলনা ও ভাঙাচোরা একটা শোকেস। এখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বহরমপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ। হোটেলে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। কাল সকালে অর্থাৎ ৪ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনাথ কলেজে বরকতের স্মৃতিসন্ধান করব।
পরদিন সকাল ৮টার মধ্যে ড. দেবরাজ চক্রবর্তীসহ হাজির হলাম কৃষ্ণনাথ কলেজে। ভাগ্য খারাপ, রোববার থাকায় কলেজ ছুটি। গার্ডের তত্ত্বাবধানে কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘুরে দেখলাম। মেইন গেটের পর বামদিকে খোলা আকাশের নিচে বরকতের ছোট আবক্ষ মূর্তি। সেখানে লেখা ‘বরকত আমাদের ছাত্র, আমাদের গর্ব আবুল বরকতের স্মরণে
মাতৃভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের সকলের প্রতি উৎসর্গ করা হল। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০১১।’ বরকত এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সিকিউরিটি গার্ড আমাদের একটা কক্ষ তালা খুলে দেখাল। কক্ষটি বরকতের নামে উৎসর্গ করা। ওই ভবনের নিচে একটা মাঝারি সাইজের অডিটরিয়াম। দরজার ওপরে ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ‘শহীদ বরকত কক্ষ’। এরপর আমরা মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিলাম। একসময়ের সুবে বাংলার রাজধানী। পেছনে রেখে এলাম বরকতের সব স্মৃতি।
আমাদের মন খারাপ। বুকভরা আশা নিয়ে পরিবার-পরিজন, জন্মভূমি ছেড়ে বরকত ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ উৎসর্গ করলেন। তার আত্মত্যাগে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বরকতের নামে বাংলাদেশেও রয়েছে বিভিন্ন স্মারক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাশহীদ আবুল বরকত জাদুঘর ও সংগ্রহশালা ২০১২ সালে স্থাপিত হয়েছে। গাজীপুরে বরকত ভবন নামে একটি বাড়ি আছে। গাজীপুরে রয়েছে শহীদ আবুল বরকত স্টেডিয়াম। ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ আবুল বরকতকে ২০০০ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে বাঙালির হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন।
লেখক : আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, সভাপতি, ইতিহাস বিভাগ ও পরিচালক, ভাষাশহীদ আবুল বরকত জাদুঘর ও সংগ্রহশালা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বোরহান উদ্দিন ভূঁইয়া, উপাধ্যক্ষ, ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ, খিলগাঁও
১৯৫২ সালে আমার বড় খালা রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্যতম ‘সিলেটি ছাত্রী’ হিসেবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সংগত কারণে নিজেকে একজন ভাষাসৈনিক পরিবারের সদস্য হিসেবে গৌরবান্বিত মনে করতাম। কিন্তু জানতাম না, আমার ছোটখালা হোসনে আরা বেগম এবং আম্মা ছালেহা বেগমও যে সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। জানতাম না, আম্মা ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালে সেখানে ভাষা আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সার দেশে শোক প্রকাশ হিসেবে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলনের জন্য জেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে চরম শাস্তি দিয়েছিল। সেই শাস্তি ছিল, তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা। আম্মাকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ফলে তিনি তার শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়েছিলেন।
বহিষ্কৃত হওয়ার পর আম্মা ময়মনসিংহ শহর ত্যাগ করেন এবং ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় অবদানের কথা কাউকে না বলে সারা জীবন অপরাধী হিসেবে কাটিয়েছেন। তাকে পারিবারিকভাবে কোরআন শপথের মাধ্যমে বড় বোন ওই শাস্তির কথা কাউকে ঘুণাক্ষরেও যাতে না বলেন, সেই ওয়াদা করিয়েছিলেন। তিনি লজ্জায় ওই শাস্তির কথা জীবদ্দশায় কাউকে বলেননি। তাকে পারিবারিকভাবে অন্য বোনদের আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ওইটুকু পড়াশোনা নিয়েই তিনি স্বামীর কর্মস্থল কুষ্টিয়ার চাঁদ সুলতানা গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ছিলেন কুলাউড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সহকারী শিক্ষিক। পরে তিনি নিজ উদ্যোগে কিশোরগঞ্জে বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০০৪ সালে ১৯ আগস্ট ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৯৫২ সালের তার সেই অনবদ্য সংগ্রামী অভিজ্ঞতা, যা আমাদের পরিবারের সবারই অজানা ছিল।
২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর আমার বড় খালা রওশন আরা বাচ্চুর জীবনাবসান হয়। এরপর ১৭ ডিসেম্বর তার জন্মদিন উপলক্ষে খালাতো বোনের মিরপুরের বাসায় স্মরণসভার আয়োজন ছিল। ওই সভায় খালাতো বোন তার বক্তব্যে আমন্ত্রিত অতিথি ও সাংবাদিক ভাইদের বলছিলেন, আমার মা-খালা তিন বোনই ভাষাসৈনিক। আমি তখন পাশে বসা ছিলাম, কিছুই বলিনি। অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার মুহূর্তে খালাতো বোন তানভীর ওয়াহেদ তুনা কয়েকটি পেজের ফটোকপি ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও, এগুলো রাখো, এগুলো ডকুমেন্ট, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’
ফেরার সময় ওই কয়েকটি পাতার লেখা পড়ার পর আম্মার অবদানের কথা স্মরণ করে ছোট বোন সৈয়দা ফরিদা আক্তার সাকীসহ দুই ভাইবোন অটোরিকশায় বসে সারা পথ শুধু কেঁদেছি। বোনের অনুরোধেই পরে আম্মার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহে ছোটাছুটি করতে থাকি এবং একের পর এক তথ্য পেতে থাকি।
খালাতো বোনের দেওয়া সেদিনের ওই কয়েকটি পাতা পড়ে জানলাম, আম্মার কথা। সেই পাতাগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদের লেখা ‘সংগ্রামী সাত নারী’ বইয়ের। বইটিতে রওশন আরা বাচ্চুকে নিয়ে লেখা অংশে তার পরিবারের ও অন্য ভাইবোনদের উদ্ধৃতি ছিল, যেখানে বারবার উল্লেখ করা আছে আমার আম্মা ছালেহা বেগমের কথা। কৃতজ্ঞতা জানাই তাজুল মোহাম্মদ ভাইকে, তার ওই লেখার সূত্র ধরেই আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু। শুরু করলাম তথ্য খোঁজা, গুগল, উইকিপিডিয়া, সিলেটপিডিয়া, পুরনো লেখক, গবেষকদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা, বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি, আত্মীয়স্বজনদের কাছে দৌড়ানো ইত্যাদি। সব জায়গাতেই আম্মার ১৯৫২ সালের ওই ঘটনার সত্যতা পাই। একপর্যায়ে ছোট বোনকে নিয়ে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গেলাম ময়মনসিংহে। সহযোগিতা পেলাম হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার এবং সাংবাদিক আবু সাইদের ছোট ভাই জনি ও বিপ্লব বর্মণের, ভাতিঝি ডালিসহ অন্য অনেক শুভাকাক্সক্ষীর। তাদের মাধ্যমে পরিচিত হলাম বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আনন্দ মোহন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রনেতা কাজী আজাদ শামীমের সঙ্গে। এগিয়ে এলেন তিনি, তাকে নিয়ে গেলাম মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে। আমরা ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের সন্তানেরা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় তার বহিষ্কারাদেশ বাতিল (মরণোত্তর) চেয়ে স্কুলের অধ্যক্ষ এবং স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে স্মারকলিপি দিলাম। সেদিন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন আমাদের দাবি গ্রহণ করলেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। জানালেন, তিনিও শুনেছেন ছালেহা বেগম ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তবে ব্যাপারটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, এ ব্যাপারে এর আগে কেন কেউ কোনো কথা বলেননি বা তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেননি। এ বিষয়টি তিনি আরও অনুসন্ধান করবেন এবং স্কুল কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকার কাছে উত্থাপন করবেন। প্রধান শিক্ষক আরও জানালেন, যেহেতু ছালেহা বেগম জেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, অতএব যদি তাদের কাছ থেকে কোনো রকম লিখিত নির্দেশ আসে তাহলে তাদের স্কুল কমিটির পক্ষে ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা সহজ হবে।
পরদিন কাজী শামীম ভাইয়ের সহযোগিতায় আমরা স্মারকলিপি নিয়ে জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন লেখকের বইপত্র, পেপার কাটিং ইত্যাদি প্রমাণসহ জমা দিই এবং সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাদের যেহেতু স্কুলে কোনো রেকর্ড নেই এবং আমরাও সেই আদেশের কোনো কপি দেখাতে পারছি না, তাই ভাষা আন্দোলনের সময়ের কোনো জীবিত লোক বা চাক্ষুস সাক্ষী খুঁজে বের করতে বললেন, যা তার জন্য সহায়ক হবে। তিনিও তার কার্যালয়ের নথি তালাশ করবেন বলে জানান এবং এ ব্যাপারে ওপরমহলের নির্দেশের কথা জানালেন। পরে আমরা আমাদের এক মামা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন, তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি আম্মাকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন এবং ভাষার জন্য আম্মার শিক্ষাজীবনের শাহাদাতবরণের বিষয়টি জানতেন। মামা ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান সাহেবকে বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ করলেন। পরদিন আমরা গেলাম ময়মনসিংহে। ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে ‘ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগম স্মৃতি পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন ও ময়মনসিংহের স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, লেখক, সাংবাদিক, গবেষকসহ এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে বহু মানুষ সোচ্চার হন। তাদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আমরা ভাইবোন মিলে করোনাকালের দুর্যোগ উপেক্ষা করে স্মারকলিপি নিয়ে গেলাম বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসানের কাছে। তিনিও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিলের বিষয়টি আমলে নিলেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেন। অল্প কিছুদিন পরেই আমরা ডাকযোগে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনারের কাছ থেকে একটি চিঠির অনুলিপি পাই। সহকারী কমিশনার রূপম দাস স্বাক্ষরিত চিঠিতে মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সদস্য সচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী ছালেহা বেগমের স্কুল থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও আইনানুগ নিষ্পত্তির জন্য। এই চিঠির অনুলিপি পেয়ে আমরা যাই স্কুলে এবং দেখা করি প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তিনিও চিঠিটি পেয়েছেন। তার স্কুল কমিটি সভা করে যে সিদ্ধান্ত নেবে, তিনি সেই সিদ্ধান্ত প্রশাসনকে জানিয়ে দেবেন এবং এও জানালেন যে তাদের পুরনো রেকর্ড ১৯৮৪ সালে উইপোকা খেয়ে ফেলেছে। নষ্ট প্রায় কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সেদিন অল্প বয়স্ক এক তরুণ ইংরেজির শিক্ষক জানালেন, তিনি ’৪৭ সাল থেকে অদ্যাবধি স্কুল কমিটির যে বৈঠক হয়েছিল সব খুঁজে দেখেছেন; ছালেহা বেগমের নামে কোথাও কোনো সিদ্ধান্তের কপি পাওয়া যায়নি। তবে আরও কিছু পুরনো কাগজপত্র একটি আলমারিতে রাখা আছে, যা খুঁজে দেখা হয়নি। তিনি খুঁজে দেখে ব্যবস্থা নেবেন এবং বিষয়টি তাদের সময়ে নিষ্পত্তি করতে পারলে তা তাদের জন্য এবং স্কুলের জন্য গৌরবের হবে।
ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক, প্রতিভা মুৎসুদ্দি ও রাজিয়া হোসেইন, অধ্যাপক ড. মন্জুরুল ইসলাম, ড. আতিয়ার রহমান, ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, ড. এম ইলিয়াস, ড. শাহ এমরান, বুলবুল খান মাহবুব, ফরিদ আহম্মেদ দুলাল, হামিদুল আলম সখা, ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম, কাইয়ুম রেজা চৌধুরী, দীনা হক, চৌধুরী নুরুল হুদা, সৌরভ জাহাংগীর, লতিফুল বারী হামীম, ডা. লিমন প্রমুখ।
ভাড়া করা বিমানে উড়িয়ে নিয়েও মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রথম ম্যাচে একাদশে রাখল না দিল্লি ক্যাপিটালস। আসরে তাদের শুরুটাও ভালো হলো না। লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে হারল মোস্তাফিজবিহীন দিল্লি।
ঘরের মাঠে ৫০ রানের জয়ে আসর শুরু করল লক্ষ্ণৌ। ১৯৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দিল্লি থামে ৯ উইকেটে ১৪৩ রানে। ৪ ওভারে মাত্র ১৪ রান খরচায় ৫ উইকেট নিয়ে লক্ষ্ণৌয়ের জয়ের নায়ক মার্ক উড।
এদিন দিল্লির ব্যাটিং ছিল পুরো ফ্লপ। দলের অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার ৪৮ বলে ৫৬ রান করেছেন। পাশাপাশি রাইলি রোশো ২০ বলে ৩০ রানের ইনিংস খেলেন। কিন্তু বাকিরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফলে যা হরার তাই হলো ম্যাচের ফল।
এর আগে স্বাগতিক দলের হয়ে ঝড় তোলেন কাইল মেয়ার্স। এই ক্যারিবীয়ান ৩৮ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলেন। ২টি চারের সঙ্গে হাঁকান ৭টি ছক্কা। এ ছাড়া নিকোলস পুরান ২১ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলেন। সুবাদে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৬ উইকেটে ১৯৩ রানের পুঁজি গড়ে লক্ষ্ণৌ।
গত অক্টোবরের পর আর্সেনালের জার্সিতে প্রথম গোলের দেখা পেলেন গাব্রিয়েল জেসুস। তার আবার জোড়া গোল। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের জ্বলে ওঠার দিনে লিডস ইউনাইটেডকে উড়িয়ে ম্যানচেস্টার সিটির চেয়ে ফের আট পয়েন্টে এগিয়ে গেল আর্সেনাল।
ঘরের মাঠে শনিবার প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচটি ৪-১ গোলে জিতে আর্সেনাল। স্পট কিকে দলকে প্রথম এগিয়ে দেন জেসুস। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বেন হোয়াইট ব্যবধান দ্বিগুণ করেন। এর খানিক পরই জোড়া গোল পূর্ণ করেন জেসুস।
এরপর লিডস একটি গোল শোধ করলেও গ্রানিত জাকার গোলে বড় জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে স্বাগতিকরা।
আন্তর্জাতিক বিরতি থেকে ফেরার পর এটিই প্রথম ম্যাচ ছিল আর্সেনালের। বিরতিতে যাওয়ার আগে নিজেদের মাঠে একই ব্যবধানে তারা হারিয়েছিল ক্রিস্টাল প্যালেসকে।
এই জয়ে ২৯ ম্যাচে ৭২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষস্থান আরও মজবুত করল গানাররা। ২০০৩-০৪ মৌসুমের পর প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্সেনাল। তাদের সঙ্গে গত লিগের চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটির পয়েন্ট ব্যবধান ৮।
গানারদের চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে ৬৪ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে সিটি। একই দিন তারাও নিজেদের মাঠে লিভারপুলকে উড়িয়ে দিয়েছে ৪-১ গোলে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সময়ের আলোচিত চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়া। একাধারে উপস্থাপিকা, নায়িকা এবং সংগীতশিল্পীও। সিনেমার বাইরে তিনটি গান প্রকাশ পেয়েছে তার। সে ধারাবাহিকতায় এবারের ঈদে নতুন গান নিয়ে আসছেন তিনি।
গানের শিরোনাম ‘বুঝি না তো তাই’। বাঁধনের লেখা এ গানটির সংগীতায়োজন করেছেন বলিউড র্যাপার মুমজি স্ট্রেঞ্জার। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ফারিয়া। বাবা যাদবের কোরিওগ্রাফিতে ভিডিওতে অংশ নিয়েছেন ফারিয়া ও মুমজি। আসছে ঈদে উন্মুক্ত হবে গানটি। গানটি প্রকাশ করবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে গানটির টিজার, যা দর্শকমহলে প্রশংসা কুড়াচ্ছে। এরমধ্যে সোমবার বিকেলে নিজের ফেসবুকে গান ভিডিওর দৃশ্যের একটি ছবি পোস্ট করেন এ গায়িকা। সেখানে ক্যাপশনে লিখেন, মাই হাইট ইজ ৫' ৩'' বাট অ্যাটিচিউড ৬' ১''।
গানটি প্রসঙ্গে নুসরাত ফারিয়া জানিয়েছিলেন, ‘নতুন এ গানটি বেশ আনন্দের সঙ্গে করেছি। আমার আগের তিনটি গানের মতো এটিও বেশ মজার। আমার বিশ্বাস এটি সবার পছন্দ হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে ‘পটাকা’ গানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ঘরানার গানে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন নুসরাত ফারিয়া। এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রকাশ পায় ‘আমি চাই থাকতে’ ও ‘হাবিবি’। আসছে ঈদুল ফিতরে এ অভিনেত্রী গায়িকা হিসাবে চতুর্থবার হাজির হচ্ছেন দর্শক শ্রোতাদের সামনে।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।