
শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের ভূখণ্ডের মানুষের দীর্ঘদিনের। পরাধীনতার সুদীর্ঘ বছরগুলোতে ১৯০ বছর ব্রিটিশ, পরে ২৩ বছর পাকিস্তানিদের আমরা দেখেছিলাম কীভাবে তারা আমাদের শোষণ করেছে। শোষণের প্রয়োজনেই শাসন করা ছিল তাদের কাজ। আমাদের তারা যে পরিমাণ শোষণ করেছে তাদের সমৃদ্ধি ততই বেড়েছে। জনগণ এটা মেনে নিতে চায়নি, তাই ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তেভেজা এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছে। কিন্তু যেকোনো সংগ্রামের একটা সূচনাবিন্দু থাকে, স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াইয়েরও তেমনি শুরু খুঁজতে হলে প্রথমেই আসে ৫২ সালের কথা। ৭১-এ অর্জিত এই স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি যে বেদনা এবং যে চেতনা জাগিয়ে দিয়েছিল তা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বৈষম্য বেদনা জাগিয়েছিল বলেই মুক্তি-চেতনার জন্ম হয়েছিল। এই বৈষম্য থেকে মুক্তি আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা জোগায়।
কেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যেই মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমির আন্দোলনে নিম্নবিত্ত দরিদ্র মুসলমান দলে দলে যুক্ত হয়েছিলেন এই প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আশা জাগিয়ে তোলা হয়েছিল যে মুসলমানদের আলাদা দেশ পাকিস্তান গঠিত হলে সেখানে কোনো শোষণ থাকবে না। কারণ মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। ভাই কি ভাইকে শোষণ করতে পারে? আর উচ্চবিত্ত ধনী উচ্চশিক্ষিত মুসলমান যুক্ত হয়েছিলেন এই আশায় যে রাষ্ট্রটা হাতে পেলে ক্ষমতার দুধ-মধু সবই তারা খেতে পারবেন। ফলে এই দুই শ্রেণির ছিল দুই আশা কিন্তু লক্ষ্য ছিল এক, সেটা হলো পাকিস্তান সৃষ্টি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম যে প্রশ্ন এলো এই রাষ্ট্রের সংবিধান কেমন হবে। শুধু মুসলমানদের জন্য কেন, কোনো ধর্মের ভিত্তিতেই কি কোনো দেশ হতে পারে? যদি তাই হতো তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের অধিবাসীই তো মুসলমান, তাহলে তারা সবাই মিলে একটা দেশ হতে পারে না কেন? আবার এক দেশে বহু ধর্মের মানুষ থাকলে তাদের পরিচয় কী হবে? আবার ভারতে যে মুসলমানরা থেকে গেলেন তাদের পরিচয় কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা গেলেও আশ্বস্ত করা হয়েছিল এই বলে যে, এক দিন হিন্দু আর হিন্দু হিসেবে নয়, মুসলমান আর মুসলমান হিসেবে নয় তারা সবাই বিবেচিত হবেন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয় আর নাগরিক পরিচয় এক হবে না। একেবারে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিপরীতমুখী যাত্রা! তাহলে এত সাম্প্রদায়িক কারণে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু কীসের জন্য? এই টানাপড়েনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে তাই দীর্ঘ সময় লেগে গেল। ১৯৪৭ সালে জন্ম নিল পাকিস্তান আর তার ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে প্রণীত হলো সংবিধান। এ সময়টায় সংবিধান না থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্রিটিশ প্রবর্তিত বিধান তো ছিল, তা দিয়েই চলছিল সব। রাষ্ট্রের ধর্ম নিয়ে সমাধানে আসতে না আসতেই প্রশ্ন এলো রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে? এক ধর্ম, এক দেশ, এক ভাষা এ ধরনের চিন্তা থেকেই মুসলমান, পাকিস্তান এবং উর্দু ভাষাকে সমার্থক করার আয়োজন চলছিল সর্বত্র। অন্যদিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনে ঢাকা তখন উত্তাল। এ সময় ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত গণসংবর্ধনায় তিনি বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। ভাষা আন্দোলনকে তিনি মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যের প্রতিবাদ হয় সমাবেশের মধ্যেই। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে স্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি বাতিল করে দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি অবশ্যই উর্দু। কারণ উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে। ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়। ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ভাষার দাবিকে তাচ্ছিল্য করে ২৮ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন জিন্নাহ।
জিন্নাহ চলে গেছেন কিন্তু উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে পারেননি। প্রশ্ন ছিল, উর্দু কি পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা? সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ প্রত্যেকেরই তো আলাদা ভাষা। ভাষা দিয়ে কি ধর্মের পরিচয় তুলে ধরা যায়? আরবি ভাষায় কি মুসলমান ছাড়া কেউ কথা বলে না? আরবের খ্রিস্টান, ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষরাও তো আরবি ভাষায় কথা বলে। এ কথা তো সত্য যে, মানুষ যত দ্রুত ধর্মান্তরিত হতে পারে তত সহজে ভাষান্তরিত হতে পারে না। আরবের মুসলমান আর ইন্দোনেশিয়ার মুসলমান ধর্মে এক হলেও ভাষা এবং সংস্কৃতিতে এক নয়। আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথাও যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে যে ভাষায় ৫৪ শতাংশ মানুষ কথা বলে তাদের দাবি কি অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হবে না?
ভাষা আন্দোলনের মূল সুর ছিল গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক। রাষ্ট্র তার নাগরিককে ধর্মের ভিত্তিতে বিবেচনা করবে না। এই ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া ও বসবাস করা মানুষরা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের নাগরিক। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্তি হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল শহীদ মিনার। তারা জীবন দিয়েছিলেন এই ভূখণ্ডের সব মানুষের মুখের ভাষার জন্য। তাই সব ধর্মের মানুষ যেন শ্রদ্ধা জানাতে পারে সে উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল শহীদ মিনার।
একুশ শিখিয়েছিল আত্মসমর্পণ নয়, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে। একুশ মানে মাথানত না করা। এটা আমাদের কাছে এখনো একটি প্রেরণাদায়ক কথা। প্রবল শক্তির কাছে বা যুক্তিহীনতার কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু সম্মানের সঙ্গে বাঁচা যায় না। অন্ধত্ব বা অন্ধকার যত প্রবলই হোক না কেন যুক্তি অস্ত্রে তাকে পরাভূত করা সম্ভব যদি ব্যাপক মানুষের মধ্যে সেই যুক্তির আলো পৌঁছে দেওয়া যায়। যুক্তির আলো পথ দেখিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার। স্বাধীনতার সঙ্গে মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ তা অর্জন করতে হলেও যুক্তিই হবে অন্যতম হাতিয়ার। ভাষার দাবিতে লড়াই পথ দেখিয়েছে, নাগরিক অধিকার অর্জন করতে হলে ভোটের অধিকার দরকার। বৈষম্য দূর করার প্রথম পদক্ষেপ হলো সবার ভাতের অধিকার। সে কারণেই স্লোগান উঠেছিল কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না। আর এসব দাবিকে একসঙ্গে যুক্ত করেছিল এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন করতে হবে। তাই দেখা যায়, ভাষা-ভাত-ভোট-ভূখণ্ড এই চারটি শব্দ, যা ‘ভ’ দিয়েই শুরু তা আমাদের জীবন ও রাজনীতিকে তখন কতটা প্রভাবিত করেছে এবং এখনো করছে।
আন্দোলন থামে না তার পরিণতিতে না যাওয়া পর্যন্ত। তাই ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করে স্বাধীন হলাম কিন্তু বন্দি হয়ে গেলাম পুঁজির কাছে। মুখের ভাষায় পড়তে হলে যে শিক্ষা লাগে তা তো আমরা জানি। সেই শিক্ষা ক্রমাগত ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হচ্ছে, ফলে তা চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। শিক্ষার ওপর আক্রমণের পাশাপাশি আক্রমণ আসছে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর। ছাত্রদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতীতের সংগ্রামের ইতিহাসকে। যেমন : গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং একটি গণতান্ত্রিক, বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার একই পদ্ধতির শিক্ষানীতির দাবিতে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের জীবন দিতে হয়েছিল তা প্রায় ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।
ভাষা চিন্তার বাহন। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জীবন দিলেও সে ভাষায় কথা বলতে গেলে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ লাগে, দেশে কি এখন সে অবস্থায় আছে? এই প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উত্তর নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর ভোটের অধিকারের জন্য লড়তে হচ্ছে এখনো। নানা ধরনের কালাকানুন আর সাম্প্রদায়িক বাতাবরণে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। মাথানত না করার সাহস দিয়েছে একুশ, আর মাথানত করে রাখার পরিবেশ তৈরি করেছে রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্র জনগণের ট্যাক্সে চলে সেই রাষ্ট্র জনগণকে দেখায় ভয়। ফলে দেশ, অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে বন্ধু-স্বজনরাও পরামর্শ দেয় এবং বলে, বাদ দাও তো এসব, কী দরকার রাজনীতির বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে! এই ভয় আর ভরসাহীনতার রাষ্ট্র তো আমরা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম রাষ্ট্রটা হবে জনগণের এবং জনগণকে ভরসা দেবে।
একুশ যে চেতনা জাগিয়েছিল তার মর্মে ছিল মুক্তির আকুতি। শোষণ থেকে মুক্তি, বৈষম্য থেকে মুক্তি আর মুক্তি অপমান থেকে। এই চেতনা ছড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনায়। কোনো মানুষ যেন তার মাতৃভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন সেই লড়াইকে এগিয়ে নিতে একুশ যেন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে আরও বহুদিন।
লেখক : রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
[email protected]
দেশভাগের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় মাতৃভাষার জন্য বাঙালিকে রাজপথে নামতে হয়। সাত মাসের মধ্যে ঘটে রক্তপাতের ঘটনা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম রক্তাক্ত হয় পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ। ওই দিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় পালিত হয় প্রথম ধর্মঘট। পুলিশের বর্বর হামলা ও গুলিবর্ষণে সচিবালয়ের সামনের রাস্তা রক্তে ভিজে যায়। কারাগার ভরে যায় তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সংগ্রামী ছাত্রদের গ্রেপ্তারে। সেদিন প্রতিবাদের যে ভিত রচিত হয় তারই পথ ধরে আসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তঝরা দিন এবং এর আগের-পরের সময়গুলো ক্যামেরায় ধারণ করেন চল্লিশের দশকের শক্তিমান আলোকচিত্রী শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব। তার তোলা ভাষা আন্দোলনের এই দলিলচিত্রগুলো হয়ে ওঠে পাকিস্তানি স্বৈর-সিদ্ধান্তের বিপরীতে প্রতিবাদের হাতিয়ার।
দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তথ্য অধিদপ্তরের [পিআইডি] কার্যালয় খোলা হয়, ইয়াকুব ছিলেন এর প্রথম দিককার ফটোগ্রাফার। সরকারি চাকুরে হয়েও বাঙালির পক্ষে তার এই অবস্থান ছিল শাসকচক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আটচল্লিশের অগ্নিঝরা সময় যার ক্যামেরায় মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল, তার অসীম সাহসিকতার গল্প কোথাও উল্লেখ নেই। ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্রী হিসেবেও তার নামটি এখন পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি কোনো মহলে। ফলে বাংলা ভাষার জন্য তার যে বিশাল অবদান কিংবা ত্যাগের মহিমা, সাধারণ মানুষের কাছে তা অজানা থেকে গেছে।
দৈনিক বাংলার পাতায়
আটচল্লিশের রক্তাক্ত অধ্যায় যে শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের ফ্রেমে ধরা তার খোঁজ মেলে পুরনো পত্রিকার ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে। তার তোলা তিনটি দুর্লভ ছবি ১৯৭৪ সালের ৭ জুন দৈনিক বাংলার শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। ছবিগুলোর ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয় শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের নাম। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল আগে পত্রিকায় ছাপা হওয়া এই ছবিগুলো যেন বাঙালির গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের একঝলক। প্রকাশিত একটি ছবি হলো ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র-সমাবেশের। ভাষা আন্দোলনের পাটাতন তৈরির সময়ের ছবি বলে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। আরেকটি ছবি ১১ মার্চ সচিবালয়ের ১ নম্বর গেটে আহত মোহাম্মদ বায়তুল্লাহকে [যিনি ছিলেন শ্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডেপুটি স্পিকার] ঘিরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রনেতাদের। এই দুটি ছবি বর্তমান প্রজন্মের একেবারেই অদেখা। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা শওকত আলীর পাশে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি ১১ মার্চ তোলা বলে বিভিন্ন প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ওই দিন শওকত আলী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। আর শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করা হয়। ১৫ মার্চ শেখ মুজিব মুক্তি পান। পরদিন সুস্থতার ছাড়পত্র পান শওকত আলী। ফলে এ ছবিটি ১৬ মার্চ হাসপাতাল গেটে তোলা বলে গবেষকরা মনে করেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও এর সত্যতা মেলে। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজে অবস্থিত ভাষা আন্দোলন জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় এই ঐতিহাসিক ছবির একটি খন্ডিত অংশ সংরক্ষিত আছে। কিন্তু প্রদর্শিত ছবিতে আলোকচিত্রীর নাম উল্লেখ নেই। ফলে দৈনিক বাংলায় ছবিগুলো ছাপা না হলে এই কৃতী আলোকচিত্রকরের নাম জানা সম্ভব হতো না।
এত দিন সবাই জানতেন, আটচল্লিশে আ জা ম তকীয়ুল্লাহ এবং বায়ান্নতে আমানুল হক, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, জমিল চৌধুরী আর ডা. আবদুল হাফিজ ছবি তুলেছিলেন। জীবদ্দশায় তকীয়ুল্লাহ, আমানুল হক ও রফিকুল ইসলাম ভাষাসংগ্রাম নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন এবং তাদের তোলা ছবিগুলো চিহ্নিত করে গেছেন। ফলে আটচল্লিশের বাকি যেসব ছবি বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বেনামে ঘুরে বেড়ায়, সেগুলো কার তোলাÑএই প্রশ্নের উত্তর ছিল অমীমাংসিত। ইয়াকুবের ছবিগুলোর সন্ধান পাওয়ায় অমীমাংসিত বিষয়টির সমাধানের পথ তৈরি হলো। আটচল্লিশের ভাষাসংগ্রামের যে বিস্তৃতি তাতে এই তিনটি ছবি ছাড়াও তার তোলা আরও অনেক ছবি থাকার কথা। সেগুলোর মূল নেগেটিভ এখন কোথায় কিংবা কী অবস্থায় আছে, তা অজানা। নেগেটিভগুলো উদ্ধার করা গেলে ভাষা আন্দোলনের আরও অজানা ইতিহাস প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হতো।
বিশিষ্টজনের মন্তব্য
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, এখন পর্যন্ত ভাষাসংগ্রামের যে লিখিত ইতিহাস, তাতে শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের কথা উল্লেখ নেই। কিন্তু চুয়াত্তরের পত্রিকায় যেহেতু ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাই তাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, আমাদের মনোযোগ বায়ান্নর দিকে। কিন্তু আটচল্লিশ আর বায়ান্ন একই সূত্রে গাথা। আটচল্লিশ ছাড়া বায়ান্নকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। আটচল্লিশের ১১ মার্চ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কারাবরণের কারণে শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন, যা ইয়াকুবের ক্যামেরায় বন্দি। বায়তুল্লাহর ছবিটি প্রমাণ করে ওই দিনের বিক্ষোভ সমাবেশে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ইয়াকুব শুধু আটচল্লিশেই নয়, ছেচল্লিশের দাঙ্গার ছবি তুলেও দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। ছাত্রজীবনেই বন্ধু হিসেবে শেখ মুজিবের সান্নিধ্য পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠার পেছনে যে কয়েকজন মানুষের নেপথ্য সমর্থন ছিল, ইয়াকুব তাদের অন্যতম। ফলে এই মানুষটি সম্পর্কে আরও বেশি জানা দরকার। এ বিষয়ে যত তথ্য, বিবরণ ও ভাষ্য উঠে আসবে, আমাদের ইতিহাস ততই সমৃদ্ধ হবে।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, আগে ফটোগ্রাফারদের ক্রেডিট দেওয়া হতো না বলে তাদের কথা মানুষ জানত না। অনেক দেরিতে হলেও শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ভাষাসংগ্রামীকে আবিষ্কার করতে পারা এক বিশাল ঘটনা। তার তোলা আমতলার সমাবেশ আর আহত বায়তুল্লাহ্র ছবিটি ইতিহাসের এক নব সংযোজন। ফলে তার ছবির কারণে আমাদের ভাষা আন্দোলনের পরিধিটাও আরও বিস্তৃত হলো। এখন থেকে ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে তার নাম ব্যবহার করা কর্তব্য বলে মনে করি।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে
নিভৃতচারী হওয়ার কারণে একসময়ের শক্তিমান আলোকচিত্রকার শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব কালের আবিলতার আড়ালে চাপা পড়ে যান। সে আবিলতা ঝেড়ে সবার আগে তাকে উজ্জ্বল আলোয় আপন সৌকর্যে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব আর ইয়াকুব ছিলেন ঘনিষ্ঠ সহপাঠী। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে তাদের বন্ধুত্ব। একই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন বলে বিভিন্ন মিছিল-মিটিং, আন্দোলন-সংগ্রামে ক্যামেরা কাঁধে বন্ধুর পাশে ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছেন ইয়াকুব। ছেচল্লিশের দাঙ্গা নিরসনে তার তোলা মর্মস্পর্শী ছবিগুলো অবিভক্ত বাংলায় কী প্রভাব ফেলেছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ৮১ ও ৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি আর ইয়াকুব নামে আমার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু পরামর্শ করলাম, আজ [১৯ আগস্ট, ১৯৪৬] মহাত্মাজীকে একটা উপহার দিব। ইয়াকুব বলল, তোমার মনে আছে আমি আর তুমি বিহার থেকে দাঙ্গার ফটো তুলেছিলাম? আমি বললাম, হ্যাঁ মনে আছে। ইয়াকুব বলল, সমস্ত কলকাতা ঘুরে আমি ফটো তুলেছি। তুমি জান না তার কপিও করেছি। সেই ছবিগুলি থেকে কিছু ছবি বেছে একটা প্যাকেট করে মহাত্মাজীকে উপহার দিলে কেমন হয়। আমি বললাম, চমৎকার হবে। চল যাই, প্যাকেট করে ফেলি। যেমন কথা তেমন কাজ। দুইজন বসে পড়লাম। তারপর প্যাকেটটা এমনভাবে বাঁধা হল যে, কমপক্ষে দশ মিনিট লাগবে খুলতে। আমরা তাকে উপহার দিয়েই ভাগব। এই ফটোর মধ্যে ছিল মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, শুধু শরীরটা আছে, বস্তি, মসজিদে আগুন জ¦লছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, এমনই আরও অনেক কিছু! মহাত্মাজী দেখুক, কিভাবে তার লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে। আমরা নারকেলডাঙ্গায় মহাত্মাজীর ওখানে পৌঁছালাম। তার সাথে ঈদের মোলাকাত করব বললাম। আমাদের তখনই তার কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। মহাত্মাজী আমাদের কয়েকটা আপেল দিলেন। আমরা মহাত্মাজীকে প্যাকেটটা উপহার দিলাম। তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করলেন। আমরা যে অপরিচিত, সেদিকে তার ভ্রƒক্ষেপ নাই। তবে বুঝতে পারলাম, তার নাতনী মনু গান্ধী আমার চেহারা দেখেছে ব্যারাকপুর সভায়, কারণ আমি শহীদ সাহেবের [হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী] কাছে প্ল্যাটফর্মে বসেছিলাম। আমরা উপহার দিয়ে চলে এলাম তাড়াতাড়ি হেঁটে।...। বন্ধু ইয়াকুবের এই ফটোগুলি যে মহাত্মা গান্ধীর মনে বিরাট দাগ কেটেছিল, তাতে সন্দেহ নাই।’
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিককার ছবিগুলো শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের তোলা বলে ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে। কলকাতার ব্যারাকপুরের জনসভায় মহাত্মা গান্ধীর পাশে ২৭ বছরের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি যে ইয়াকুবের তোলা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
ব্যক্তিজীবন
শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের জন্ম ১৯১৭ সালে, অবিভক্ত বাংলার কলকাতায়। কলেজে পড়ার সময় এক খ্রিস্টান যুবকের কাছ থেকে বিশ টাকা দিয়ে কোডাকের বি-টু সাইজের ফোল্ডিং ক্যামেরা কিনে ফটোগ্রাফি শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ছবি তুলে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ওই সব ছবি দেখে তৎকালীন তথ্য সচিব তাকে কেন্দ্রীয় তথ্য দপ্তরে ফটোগ্রাফার হিসেবে যোগ দিতে বলেন। দেশভাগের সময় তিনি স্থায়ীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসে পিআইডিতে যোগদান করেন। তখন মুক্তাঙ্গনের পাশে ছিল পিআইডির কার্যালয়। পিআইডির নিজস্ব ডার্করুম না থাকায় তিনি পুরান ঢাকার ‘স্টুডিও এইচ’ থেকে ছবি প্রিন্ট করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অকৃতদার ছিলেন। মাকে নিয়ে পল্টনের একটি ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। এ দেশে তার আপন কেউ ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধুকেই তিনি অভিভাবক মনে করতেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হওয়ার পর তিনি সত্যিকার অর্থেই অভিভাবকহীন হলেন। আর পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে অবসর গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যে মায়ের মৃত্যুতে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি।
জীবনসায়াহ্নে
ইয়াকুবের শেষ জীবনটা ছিল ভীষণ কষ্টের। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, অর্থের অভাবে সেটিও একসময় ছেড়ে দিতে হয়। ফলে রাতের বেলায় প্রেস ক্লাবের অভ্যর্থনা কক্ষের মেঝেতে কিংবা ফুটপাতে ঘুমাতেন। দিনের বেলায় ঘুরে বেড়াতেন প্রেস ক্লাবের আঙিনায়। ক্যানটিনের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতেন। অনুজ ফটোসাংবাদিক খালেদ হায়দার আর বুলবুল আহমেদকে কাছে পেলে পুরনো দিনের গল্প বলতেন। জীবনের শেষদিকে শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কেউ কেউ তাকে বোঝাও মনে করতেন। বেশির ভাগ সময় তাকে না খেয়ে থাকতে হতো। বড় অবহেলায় নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত।
কবে মারা গেলেন শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব, জানতে প্রেস ক্লাবে গেলাম। কয়েকজন প্রবীণ আলোকচিত্রী তার কথা শুনে স্মৃতিকাতর হলেন। কিন্তু দিনক্ষণ বলতে পারলেন না! প্রেস ক্লাবের রেজিস্ট্রি খাতায়ও তার মৃত্যুর তারিখটি পাওয়া গেল না! কম্পিউটারে সংরক্ষিত তালিকা দেখে একজন বললেন, ‘এই নামে কোনো ফটোসাংবাদিক ছিল বলে জানা নেই!’ পরে বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে পুরনো পত্রিকার ফাইল ঘেঁটে জানা গেল শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের চলে যাওয়ার দিনটি ছিল বুধবার, ৭ জুন, ১৯৯৫। সেই সময়ের জাতীয় কয়েকটি দৈনিকে কী নিদারুণ দায়সারাভাবে তার মৃত্যুর খবর ছাপে, তা দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হলো।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
ভাষাশহীদ আবুল বরকত ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরের বছর তৎকালীন পূর্ববাংলায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করে এমএ শেষ পর্বের ছাত্র ছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে তার জন্ম, ডাকনাম আবাই। শহীদ বরকত সম্পর্কে খুব কমই জানি। আমরা দুজন ২০১৮ সালে ভাষাশহীদ আবুল বরকত সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তার জন্মস্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ভাষার মাসকেই বেছে নিই। ২ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় বিমানে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে কলকাতায় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দরে পৌঁছাই দুপুর ১২টায়। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে কলকাতার চিতপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাই দেড়টা নাগাদ। আমাদের গন্তব্য মুর্শিদাবাদের বহরমপুর। কলকাতা থেকে বহরমপুরের দূরত্ব ২০০ কিমি। সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ। ট্রেনের নাম ‘ধনধান্যে’। বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ট্রেন ও স্টেশনের পর স্টেশন অতিক্রম করে এগোতে লাগল। মাঝেমধ্যে পরিচিত জায়গার নাম চোখে পড়ায় যেন শব্দদূষণের যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হলো। যেমন বারাসাত, রানাঘাট, পলাশী, হুগলী, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি। রাত ৯টা বাজার কয়েক মিনিট আগে আমরা বহরমপুর স্টেশনে নামলাম। ‘সোনার বাংলা’ হোটেলে উঠলাম।
৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার ২০১৮। সকাল ৮টায় ভাষাশহীদ বরকতের নিজগ্রাম বাবলার উদ্দেশে ট্যাক্সিতে রওনা হলাম। শীতের সকাল। শহরের গন্ডি পেরোতেই চারদিকে ঘনকুয়াশা, ডানে-বামে কিছু দেখা যায় না। শহরের বাইরে রঞ্জিত সার্ভিস পেট্রলপাম্প স্টেশন পার হয়ে সামনের মোড় থেকে বামদিকে বাদশাহী রোড ধরে সালার থানা। সালারের বাসিন্দা বরকতের চাচাতো ভাই মানিক মিয়ার ছেলের ঘরের নাতি দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া সামিন। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে সালার ডিগ্রি কলেজের সামনের মোড়ে অবস্থান করছে। সামিন শহীদ বরকতের তৃতীয় প্রজন্মের সর্বকনিষ্ঠ বংশধর। সামিনদের বাসায় আমাদের প্রথম বিরতি। ঘরে ঢুকতেই দেখা হলো কোটপরা ছয় ফুটের বেশি লম্বা সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের সঙ্গে। চেয়ারে বসা। বুঝতে বাকি রইল না, উনিই বরকতের চাচাতো ভাই ‘মানিক মিয়া’। বরকতকে স্বচক্ষে দেখা একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। তার কিছু ছবি তোলা ও বক্তব্য রেকর্ড করার কাজটি দ্রুত সেরে নেওয়া হলো। দুপুর ১২টা বেজে গেছে প্রায়। আমরা দ্রুত সামিন ও মানিক মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বরকতের জন্মভূমি বাবলা গ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে মানিক মিয়ার সঙ্গে অনেক কথা হলো বরকত সম্পর্কে। বয়সের ভারে তিনি অনেকটাই ন্যুব্জ, অসুস্থও। বরকতের সঙ্গে তার সর্বশেষ দেখা হয় তার ৯ বছর বয়সে। এর বেশি স্মৃতি তার মনে নেই।
গ্রামের অপ্রশস্ত পথ ধরে এগোলাম। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা চলার পর বাবলা গ্রামে ‘বরকত ভবন’-এর সামনে গাড়ি থামল। আমরা দুজনই খুব পুলকিত। শহীদ বরকতের অনাবিষ্কৃত ইতিহাসের দোরগোড়ায় আমরা এসে গেছি। গাড়ি থেকে নেমে তাকিয়ে দেখি রাস্তার পূর্ব পাশে ‘বরকত ভবন’ নামাঙ্কিত ডুপ্লেক্স ভবন। ভবনের গায়ে লেখা ‘শহীদ আবুল বরকত কেন্দ্র’, স্থাপিত ২০০৫-০৬, বাবলা, রেজি. নং ঝ/১খ/১৭২০৩.১। ঠিক সামনেই রাস্তার দক্ষিণ পাশে ‘শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি সংঘ’, স্থাপিত-১৯৯৬, রেজি. নং-ঝ/১খ/১৪১৫০ বাবলা (বরকত নগর); পো. তালিবপুর, জেলা-মুর্শিদাবাদ। ছোট একতলা ভবন। ভবনটির সামনেই একটি ছোট্ট স্ট্যান্ডের ওপর শহীদ বরকতের সোনালি রঙের আবক্ষ মূর্তি। নিচে নেমপ্লেটে লেখা আছে ‘ভাষাশহীদ, শহীদ আবুল বরকত, আবির্ভাব : ১৬ই জুন ১৯২৭, শহীদ : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, উদ্বোধক মাননীয় সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, শ্রী অধীর রঞ্জন চৌধুরী, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।’
আশপাশের বাড়ির লোকজন আমাদের আগমন টের পেয়ে কাছে আসতে শুরু করেছে। অনুরোধ করতেই বরকত ভবনটি খুলে দেওয়া হলো। ডুপ্লেক্স ভবন। ভেতরে একাধিক কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের সামনে ভাষাশহীদদের নামফলক লাগানো। (১) ভাষাশহীদ সালাম কক্ষ; (২) ভাষাশহীদ রফিক কক্ষ; (৩) ভাষাশহীদ বরকত লাইব্রেরি কক্ষ। ভবনে একটি বড় হলরুম আছে। জানা গেল এখানে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ বরকতের সম্মানে অনুষ্ঠান হয়। রাস্তার উত্তর পাশে বরকত ভবনের ঠিক উল্টো পাশে শহীদ বরকতদের বসতঘর। বাড়িটি অন্য লোকের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। তিনি সেখানে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কিন্তু বরকতদের ইটের একতলা ঘরটি, যার দক্ষিণ পাশে দুটি জানালা আছে, স্মৃতি হিসেবে আগের আকৃতিতে রেখে দিয়েছেন। রাস্তার দক্ষিণ পাশে একটি বড় দীঘি আছে। এলাকার লোকজনের ভাষ্য, এ দীঘিটি বরকতের পরিবারের। শহীদ বরকতের বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ গজ পূর্বদিকে রাস্তা ঘেঁষে রয়েছে ‘শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
শহীদ আবুল বরকত এ বিদ্যালয়েই প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন। তখন নাম ছিল বাবলা বহড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয় ভবনটি দোতলা। ভবনের মাঝখানে অপ্রশস্ত সিঁড়ি, এর দুদিকে ছোট ছোট ক্লাসরুম। কোনো শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের বসার কোনো বেঞ্চের অস্তিত্ব পেলাম না। শিক্ষার্থীরা মেঝেতে বসেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম সারছে। বিদ্যালয়ের সামনের দেয়ালে শিক্ষার্থীদের সাপ্তাহিক খাবারের মেন্যু টানানো আছে। জানা গেল, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় দুপুরের খাবার স্কুলেই মেন্যু অনুযায়ী রান্না হয় এবং শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়। বাবলা গ্রামের এই বিদ্যালয়টির দৈন্যদশা আমাদের ব্যথিত করেছে।
আমরা আবার বরকতের বাড়ির আঙিনায় ফিরে এলাম। কথা হয় বরকতের পড়শি, সম্পর্কে ভাইপো মো. আবদুল্লাহর সঙ্গে। তার বয়স পঞ্চাশের বেশি। তার ভাষ্য, বরকতের সম্পত্তি বাড়িঘর ও ধানিজমি মিলে প্রায় ৪০ বিঘা। সবটাই ওয়াকফ করা আছে আবুল বরকত স্মৃতি সংঘের নামে। এ সম্পত্তির আয় থেকেই প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালন, বরকতের নামে অনুষ্ঠান করা এবং বরকতসংক্রান্ত কাজে ব্যয় করার কথা। কিন্তু বরকতের আত্মীয়স্বজনরা খোঁজখবর নেয় না। তাই প্রায় সব সম্পত্তিই দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এরপর মিনিট দশেক খোঁজার পর শহীদ আবুল বরকত নামে একটি স্কুল ভবন পাওয়া গেল। বিদ্যালয়টির নাম ‘শহীদ আবু বরকত শিশু শিক্ষা’, স্থাপিত : ২০০৩, গ্রাম : বাবলা, পো. : তালিবপুর, জেলা : মুর্শিদাবাদ, সৌজন্যে : ভরতপুর ১নং পঞ্চায়েত সমিতি। আমরা বাংলাদেশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি শুনে প্রধান শিক্ষক খুব খুশি হলেন। তার অনুমতি নিয়ে ক্লাস পরিদর্শনে গেলাম। এখানেও ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের বসার কোনো বেঞ্চ নেই। সবাই মাটিতে বসেই শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাবলা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম তালিবপুর হাই স্কুলের উদ্দেশ্যে। বাবলা থেকে তালিবপুর গাড়িতে প্রায় ২০ মিনিট। তালিবপুর হাই স্কুলে পৌঁছে টের পেলাম সেদিন শনিবার তাই স্কুল বন্ধ। কিছু ছবি তোলা ছাড়া আর কিছু করতে পারলাম না। এ নিয়ে যখন আলোচনা করছি তখন সামিন জানাল, সালার থানার পাশে শহীদ আবুল বরকতের স্মরণে একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে।
ফুলের টব ও উন্মুক্ত চত্বরে সাজানো পার্ক। আমরা কয়েকটি ছবি তুললাম। পার্কে ঢুকতেই গেটের সামনে ডানপাশে শহীদ বরকতের আবক্ষ মূর্তি। মূর্তির নিচে লেখা : ভাষা আন্দোলনের শহীদ, আবুল বরকত সাহেব, জন্ম ১৬ জুন ১৯২৭, মৃত্যু ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।’ বেদির পাশেই ডানদিকে শ্বেতপাথরের ওপর খোদাই করে লেখা : ‘বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবুল বরকত সাহেবের স্মৃতি উদ্দেশ্য সালার শিশু উদ্যান-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিলেন ড. রাজেশ কুমার আইপিএস মাননীয় পুলিশ সুপার মুর্শিদাবাদ ৮ই জুলাই ২০০০।’ সালার থানায় এবং অন্যান্য স্থানেও মানিক মিয়ার বেশ কদর। বরকতের ভাই হিসেবে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ২টা ছুঁই ছুঁই। এখনো আমাদের অনেক অনুসন্ধান বাকি। বরকতের আদি বাড়ি ও বহরমপুরে তার কলেজে যেতে হবে। চা-নাশতা সেরে আমরা মানিক মিয়াকে নিয়ে তার আদি বাড়ি ভরতপুর থানার কিসাতপুর গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। গাড়িতে মানিক মিয়ার সঙ্গে অনেক কথাই হলো। জানা গেল, বরকতের আদি গ্রাম কিসাতপুর। বাবলা তার মামার বাড়ি। তার বাবা শামসুজ্জামান ভোলা মিয়া বিয়ের পর বাবলায় চলে যায়। পরে কিসাতপুরের জায়গা-জমি বিক্রি করে বাবলায় জমি কিনে বাস শুরু করেন। পরে বরকত পড়ালেখার জন্য ঢাকায় তার মামার কাছে চলে যান। এখন বাবলা গ্রামে বরকতের পরিবারের কেউ থাকে না।
সামিন সালারে থেকে যায়। শুধু মানিক মিয়াকে নিয়ে আমরা চলে এসেছিলাম। অনেকটা পথ পেরিয়ে প্রায় দুপুর ৩টা নাগাদ আমরা কিসাতপুর হাজির হয়েছি। এ বাড়িতে মানিক মিয়া তার দুই ছেলে ও নাতি-নাতনিসহ থাকেন। মাটির দোতলা ঘর। বোঝা যাচ্ছে অসচ্ছল পরিবার। আমাদের যে ঘরে বসতে দিল তাতে একটা চৌকি, কাঠের আলনা ও ভাঙাচোরা একটা শোকেস। এখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বহরমপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ। হোটেলে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। কাল সকালে অর্থাৎ ৪ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনাথ কলেজে বরকতের স্মৃতিসন্ধান করব।
পরদিন সকাল ৮টার মধ্যে ড. দেবরাজ চক্রবর্তীসহ হাজির হলাম কৃষ্ণনাথ কলেজে। ভাগ্য খারাপ, রোববার থাকায় কলেজ ছুটি। গার্ডের তত্ত্বাবধানে কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘুরে দেখলাম। মেইন গেটের পর বামদিকে খোলা আকাশের নিচে বরকতের ছোট আবক্ষ মূর্তি। সেখানে লেখা ‘বরকত আমাদের ছাত্র, আমাদের গর্ব আবুল বরকতের স্মরণে
মাতৃভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের সকলের প্রতি উৎসর্গ করা হল। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০১১।’ বরকত এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সিকিউরিটি গার্ড আমাদের একটা কক্ষ তালা খুলে দেখাল। কক্ষটি বরকতের নামে উৎসর্গ করা। ওই ভবনের নিচে একটা মাঝারি সাইজের অডিটরিয়াম। দরজার ওপরে ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ‘শহীদ বরকত কক্ষ’। এরপর আমরা মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিলাম। একসময়ের সুবে বাংলার রাজধানী। পেছনে রেখে এলাম বরকতের সব স্মৃতি।
আমাদের মন খারাপ। বুকভরা আশা নিয়ে পরিবার-পরিজন, জন্মভূমি ছেড়ে বরকত ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ উৎসর্গ করলেন। তার আত্মত্যাগে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বরকতের নামে বাংলাদেশেও রয়েছে বিভিন্ন স্মারক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাশহীদ আবুল বরকত জাদুঘর ও সংগ্রহশালা ২০১২ সালে স্থাপিত হয়েছে। গাজীপুরে বরকত ভবন নামে একটি বাড়ি আছে। গাজীপুরে রয়েছে শহীদ আবুল বরকত স্টেডিয়াম। ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ আবুল বরকতকে ২০০০ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে বাঙালির হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন।
লেখক : আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, সভাপতি, ইতিহাস বিভাগ ও পরিচালক, ভাষাশহীদ আবুল বরকত জাদুঘর ও সংগ্রহশালা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বোরহান উদ্দিন ভূঁইয়া, উপাধ্যক্ষ, ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ, খিলগাঁও
১৯৫২ সালে আমার বড় খালা রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্যতম ‘সিলেটি ছাত্রী’ হিসেবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সংগত কারণে নিজেকে একজন ভাষাসৈনিক পরিবারের সদস্য হিসেবে গৌরবান্বিত মনে করতাম। কিন্তু জানতাম না, আমার ছোটখালা হোসনে আরা বেগম এবং আম্মা ছালেহা বেগমও যে সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। জানতাম না, আম্মা ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালে সেখানে ভাষা আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সার দেশে শোক প্রকাশ হিসেবে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলনের জন্য জেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে চরম শাস্তি দিয়েছিল। সেই শাস্তি ছিল, তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা। আম্মাকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ফলে তিনি তার শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়েছিলেন।
বহিষ্কৃত হওয়ার পর আম্মা ময়মনসিংহ শহর ত্যাগ করেন এবং ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় অবদানের কথা কাউকে না বলে সারা জীবন অপরাধী হিসেবে কাটিয়েছেন। তাকে পারিবারিকভাবে কোরআন শপথের মাধ্যমে বড় বোন ওই শাস্তির কথা কাউকে ঘুণাক্ষরেও যাতে না বলেন, সেই ওয়াদা করিয়েছিলেন। তিনি লজ্জায় ওই শাস্তির কথা জীবদ্দশায় কাউকে বলেননি। তাকে পারিবারিকভাবে অন্য বোনদের আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ওইটুকু পড়াশোনা নিয়েই তিনি স্বামীর কর্মস্থল কুষ্টিয়ার চাঁদ সুলতানা গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ছিলেন কুলাউড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সহকারী শিক্ষিক। পরে তিনি নিজ উদ্যোগে কিশোরগঞ্জে বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০০৪ সালে ১৯ আগস্ট ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৯৫২ সালের তার সেই অনবদ্য সংগ্রামী অভিজ্ঞতা, যা আমাদের পরিবারের সবারই অজানা ছিল।
২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর আমার বড় খালা রওশন আরা বাচ্চুর জীবনাবসান হয়। এরপর ১৭ ডিসেম্বর তার জন্মদিন উপলক্ষে খালাতো বোনের মিরপুরের বাসায় স্মরণসভার আয়োজন ছিল। ওই সভায় খালাতো বোন তার বক্তব্যে আমন্ত্রিত অতিথি ও সাংবাদিক ভাইদের বলছিলেন, আমার মা-খালা তিন বোনই ভাষাসৈনিক। আমি তখন পাশে বসা ছিলাম, কিছুই বলিনি। অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার মুহূর্তে খালাতো বোন তানভীর ওয়াহেদ তুনা কয়েকটি পেজের ফটোকপি ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও, এগুলো রাখো, এগুলো ডকুমেন্ট, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’
ফেরার সময় ওই কয়েকটি পাতার লেখা পড়ার পর আম্মার অবদানের কথা স্মরণ করে ছোট বোন সৈয়দা ফরিদা আক্তার সাকীসহ দুই ভাইবোন অটোরিকশায় বসে সারা পথ শুধু কেঁদেছি। বোনের অনুরোধেই পরে আম্মার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহে ছোটাছুটি করতে থাকি এবং একের পর এক তথ্য পেতে থাকি।
খালাতো বোনের দেওয়া সেদিনের ওই কয়েকটি পাতা পড়ে জানলাম, আম্মার কথা। সেই পাতাগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদের লেখা ‘সংগ্রামী সাত নারী’ বইয়ের। বইটিতে রওশন আরা বাচ্চুকে নিয়ে লেখা অংশে তার পরিবারের ও অন্য ভাইবোনদের উদ্ধৃতি ছিল, যেখানে বারবার উল্লেখ করা আছে আমার আম্মা ছালেহা বেগমের কথা। কৃতজ্ঞতা জানাই তাজুল মোহাম্মদ ভাইকে, তার ওই লেখার সূত্র ধরেই আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু। শুরু করলাম তথ্য খোঁজা, গুগল, উইকিপিডিয়া, সিলেটপিডিয়া, পুরনো লেখক, গবেষকদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা, বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি, আত্মীয়স্বজনদের কাছে দৌড়ানো ইত্যাদি। সব জায়গাতেই আম্মার ১৯৫২ সালের ওই ঘটনার সত্যতা পাই। একপর্যায়ে ছোট বোনকে নিয়ে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গেলাম ময়মনসিংহে। সহযোগিতা পেলাম হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার এবং সাংবাদিক আবু সাইদের ছোট ভাই জনি ও বিপ্লব বর্মণের, ভাতিঝি ডালিসহ অন্য অনেক শুভাকাক্সক্ষীর। তাদের মাধ্যমে পরিচিত হলাম বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আনন্দ মোহন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রনেতা কাজী আজাদ শামীমের সঙ্গে। এগিয়ে এলেন তিনি, তাকে নিয়ে গেলাম মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে। আমরা ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের সন্তানেরা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় তার বহিষ্কারাদেশ বাতিল (মরণোত্তর) চেয়ে স্কুলের অধ্যক্ষ এবং স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে স্মারকলিপি দিলাম। সেদিন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন আমাদের দাবি গ্রহণ করলেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। জানালেন, তিনিও শুনেছেন ছালেহা বেগম ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তবে ব্যাপারটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, এ ব্যাপারে এর আগে কেন কেউ কোনো কথা বলেননি বা তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেননি। এ বিষয়টি তিনি আরও অনুসন্ধান করবেন এবং স্কুল কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকার কাছে উত্থাপন করবেন। প্রধান শিক্ষক আরও জানালেন, যেহেতু ছালেহা বেগম জেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, অতএব যদি তাদের কাছ থেকে কোনো রকম লিখিত নির্দেশ আসে তাহলে তাদের স্কুল কমিটির পক্ষে ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা সহজ হবে।
পরদিন কাজী শামীম ভাইয়ের সহযোগিতায় আমরা স্মারকলিপি নিয়ে জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন লেখকের বইপত্র, পেপার কাটিং ইত্যাদি প্রমাণসহ জমা দিই এবং সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাদের যেহেতু স্কুলে কোনো রেকর্ড নেই এবং আমরাও সেই আদেশের কোনো কপি দেখাতে পারছি না, তাই ভাষা আন্দোলনের সময়ের কোনো জীবিত লোক বা চাক্ষুস সাক্ষী খুঁজে বের করতে বললেন, যা তার জন্য সহায়ক হবে। তিনিও তার কার্যালয়ের নথি তালাশ করবেন বলে জানান এবং এ ব্যাপারে ওপরমহলের নির্দেশের কথা জানালেন। পরে আমরা আমাদের এক মামা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন, তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি আম্মাকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন এবং ভাষার জন্য আম্মার শিক্ষাজীবনের শাহাদাতবরণের বিষয়টি জানতেন। মামা ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান সাহেবকে বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ করলেন। পরদিন আমরা গেলাম ময়মনসিংহে। ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে ‘ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগম স্মৃতি পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন ও ময়মনসিংহের স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, লেখক, সাংবাদিক, গবেষকসহ এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে বহু মানুষ সোচ্চার হন। তাদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আমরা ভাইবোন মিলে করোনাকালের দুর্যোগ উপেক্ষা করে স্মারকলিপি নিয়ে গেলাম বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসানের কাছে। তিনিও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিলের বিষয়টি আমলে নিলেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেন। অল্প কিছুদিন পরেই আমরা ডাকযোগে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনারের কাছ থেকে একটি চিঠির অনুলিপি পাই। সহকারী কমিশনার রূপম দাস স্বাক্ষরিত চিঠিতে মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সদস্য সচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী ছালেহা বেগমের স্কুল থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও আইনানুগ নিষ্পত্তির জন্য। এই চিঠির অনুলিপি পেয়ে আমরা যাই স্কুলে এবং দেখা করি প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তিনিও চিঠিটি পেয়েছেন। তার স্কুল কমিটি সভা করে যে সিদ্ধান্ত নেবে, তিনি সেই সিদ্ধান্ত প্রশাসনকে জানিয়ে দেবেন এবং এও জানালেন যে তাদের পুরনো রেকর্ড ১৯৮৪ সালে উইপোকা খেয়ে ফেলেছে। নষ্ট প্রায় কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সেদিন অল্প বয়স্ক এক তরুণ ইংরেজির শিক্ষক জানালেন, তিনি ’৪৭ সাল থেকে অদ্যাবধি স্কুল কমিটির যে বৈঠক হয়েছিল সব খুঁজে দেখেছেন; ছালেহা বেগমের নামে কোথাও কোনো সিদ্ধান্তের কপি পাওয়া যায়নি। তবে আরও কিছু পুরনো কাগজপত্র একটি আলমারিতে রাখা আছে, যা খুঁজে দেখা হয়নি। তিনি খুঁজে দেখে ব্যবস্থা নেবেন এবং বিষয়টি তাদের সময়ে নিষ্পত্তি করতে পারলে তা তাদের জন্য এবং স্কুলের জন্য গৌরবের হবে।
ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক, প্রতিভা মুৎসুদ্দি ও রাজিয়া হোসেইন, অধ্যাপক ড. মন্জুরুল ইসলাম, ড. আতিয়ার রহমান, ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, ড. এম ইলিয়াস, ড. শাহ এমরান, বুলবুল খান মাহবুব, ফরিদ আহম্মেদ দুলাল, হামিদুল আলম সখা, ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম, কাইয়ুম রেজা চৌধুরী, দীনা হক, চৌধুরী নুরুল হুদা, সৌরভ জাহাংগীর, লতিফুল বারী হামীম, ডা. লিমন প্রমুখ।
রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলের আলো ঝলমলে অডিটোরিয়ামে দেশি-বিদেশী মডেল ভাড়া করে এনে সাড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নারী ফুটবল আসর ওমেন্স সুপার লিগের। সিনে জগতের তারকাদের সঙ্গে মঞ্চে র্যাম্প করতে করতে প্রত্যাশার ঘুড়িটা দূর আকাশে উড়িয়েছিলেন সাবিনা-সানজিদারা। দেশের ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন এখন তারা। ফুটবলপ্রেমীদের তাদের নিয়ে অসীম আগ্রহকে পুঁজি করে কে-স্পোর্টস আর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন চেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট করে ফায়দা লুটতে। তবে দিন যত গড়িয়েছে, মেয়েদের স্বপ্ন ধূসর হয়েছে। এখন তো তা মিলিয়ে গেছে বহুদূরে।
কে-স্পোর্টস-বাফুফের কর্তারা বুঝেছেন, তাদের লেখা চিত্রনাট্য আর বাস্তবতায় বড্ড ফাঁরাক। তাই তারা বারবার টুর্নামেন্ট শুরুর তারিখ দিয়েও আলোচিত টুর্নামেন্টকে মাঠে নিয়ে যেতে পারেননি। সর্বশেষ ১০ জুন আসর শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সেটাও মিথ্যে হয়ে গেছে। তাই হতাশা ছাঁপিয়ে নারী ফুটবলারদের মনে ভর করেছে রাজ্যের ক্ষোভ।
কে-স্পোর্টস আর বাফুফের কর্তারা ভেবেছিলেন এমন একটা টুর্নামেন্টের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে হামলে পড়বে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছর নেপালে সাফ শিরোপা জয়ের পর মেয়েদের নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই আসলে স্বপ্নবাজ করে তোলে সালাউদ্দিন-মাহফুজা আক্তার-ফাহাদ করিমদের। তবে হয়েছে উল্টো। সেটাই যে হওয়ার কথা! কে-স্পোর্টস কিংবা বাফুফে, দুটি প্রতিষ্ঠানই যে এখন ভীষণভাবে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে। এর মাঝে অগোচরে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, যেটা কখনই প্রত্যাশিত ছিল না। কে-স্পোর্টস আর বাফুফের দেখানো স্বপ্নে বুদ হয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলাররা। এমন একটা টুর্নামেন্টে খেলতে মুখিয়ে ছিলেন তারা। এমনিতে ঘরোয়া ফুটবল খেলে সেভাবে পারিশ্রমিক জুটে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে হলে একটা আকর্ষণীয় পারিশ্রমিকের হাতছানি ছিল। তারচেয়েও বেশি ছিল নানা দেশের নামী-দামী ফুটবলারদের সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করার সুবর্ণ সুযোগ। দারুণ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুখ বুজে মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন দিনের পর দিন। এর মাঝেই তারা দেখেছেন বাবার মতো কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের বিদায়। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ন্যায্য দাবী পুরোপুরি পূরণ না হওয়ার পরও তারা বাফুফের কঠোর অনুশাসন মেনে দুঃসহ গরমে সকাল-বিকাল ঘাম ঝড়িয়েছেন। এরপর যখন দেখলেন এই স্বপ্ন বারবার হোচট খাচ্ছে কে-স্পোর্টসের ব্যর্থতা আর বাফুফের অদূরদর্শীতায়, তখন আর মুখ বুজে থাকতে পারলেন না। হতাশার কথা জানাতে গিয়ে অগোচরে তাদের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এসেছে ক্ষোভের আগুন।
অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি বৃহস্পতিবার ক্যাম্প বন্ধ ঘোষণা করে বাফুফে। সিনিয়র খেলোয়াড়দের দেওয়া হয় পাঁচ দিনের ছুটি। বৃহস্পতিবার রাতে বাসে করে সাতক্ষীরাগামী সাফজয়ের অগ্রনায়ক সাবিনা খাতুন দেশ রূপান্তরকে মুঠোফোনে বলছিলেন, 'ওমেন্স সুপার লিগ স্রেফ আমাদের আবেগ নিয়ে খেললো।' একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, 'প্রথমত সাফের পর কোন খেলা নেই। তারপর এই লিগ মেয়েদের নিয়ে দুই দফা এত কিছু করলো, এত আশা দিলো, মেয়েরা খেলার জন্য মুখিয়ে ছিল। আর সব থেকে বড় ব্যাপার বিদেশী খেলোয়াড় যারা দক্ষিণ এশিয়ার, তাদের নিয়ে আমি নিজেও কাজ করছিলাম। তাদের কাছে এখন আমার সম্মান কই থাকলো! বারবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। মেয়েরা অনেক আশায় ছিল। কিন্তু... । এটা নিয়ে অবশ্য মেয়েরা অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আমিও কোন আশা দেখছি না।'
সতীর্থদের সংগে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে বাড়ির যেতে যেতে জাতীয় দলের রাইট উইঙ্গার সানজিদা বলছিলেন, 'আসলে কিছু বলার ভাষাই হারায় ফেলেছি। একটা টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমরা কঠোর অনুশীলণ করছিলাম। আশা ছিল খেলবো। এখন সেটা হচ্ছে না বলে খুব কষ্ট লাগছে। যখন শুনলাম লিগটা হবে না, তখন মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, বুঝতেই পারছেন।'
সাফের পর কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি সিনিয়র ফুটবলাররা। এ নিয়ে ভীষণ হতাশ সানজিদা বলেন, 'নয়টা মাস ধরে অপেক্ষায় আছি খেলার। প্রীতি ম্যাচ বলেন কিংবা কোন টুর্নামেন্ট, একটা ম্যাচও আমরা খেলতে পারিনি সাফের পর। অথচ আমাদের সঙ্গে যারা সাফে খেলেছে, তারা প্রায় সবাই পাঁচটা-ছয়টা করে প্রীতি ম্যাচ খেলে ফেলেছে এর মধ্যে।' মেয়েদের সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল, মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলার কথা ছিল। অথচ বাফুফে অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে তাদের খেলতে পাঠায়নি। সানজিদা বললেন, 'আমরা আসলে হতাশ হতেও ভুলে গেছি। বারবার টুর্নামেন্টে খেলার কথা বলা হয়, আবার সেটা বাতিল হয়। এরকমটা হতে হতে আসলে আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছি।'
হতাশা, বঞ্চনায় বাফুফের চাকুরি থেকে পদত্যাগ করেছেন নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। প্রিয় কোচের জন্য কষ্ট পান সানজিদা, 'ছোটন স্যারের হাত ধরেই আমার এখানে আসা। তার কাছেই আমার ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠা। তিনি চলে গেছেন। এতে খুব কষ্ট পাই। তিনি আমাদের অনেক আদর-যত্ন করতেন। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক যেমন হয়, ঠিক তেমন সম্পর্ক ছিল।'
১৩ জুন সাবিনা-সানজিদাদের ক্যাম্পে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে বাফুফে। বিকল্প নেই বলে তারা হয়তো ফিরবেন। তবে ফেরার সময় তাদের চোখে থাকবে না বড় কোন স্বপ্ন। সেটা দেখাই বারণ। কে-স্পোর্টস আর বাফুফে মিলে যে মেয়েদের সব স্বপ্ন গলা টিপে মেরে ফেলেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর মেয়ের জামাতাকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার, কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য প্রটোকল দেওয়ার একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
অনেকেই চিঠিটি শেয়ার করে সমালোচনা করছেন। কেউ বলছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই বলে কথা! কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই প্রটোকল কোন হিসেবে পান? আবার কেউবা বলছেন, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে!
জানা যায়, গত ৬ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। পরে ৭ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালককে চিঠিটি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে চিঠিটির সত্যতাও পাওয়া যায়।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার উপসচিব ড. অমিতাভ চক্রবর্ত্তী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের মেয়ের জামাতা মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ৯ জুন শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ইকে ৫৮৬ যোগে দুবাই থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। তাকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতিসহ মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার মশিউর রহমানকে কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশন এবং বিমানবন্দরের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য বোর্ডিং ব্রিজ পাস দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিমানবন্দর পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য পৃথক লাউঞ্জ রয়েছে। যেটাকে ভিআইপি লাউঞ্জ বলা হয়। ভিআইপি লাউঞ্জ কারা ব্যবহার করতে পারবেন এমন একটি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।
লাউঞ্জ রজনীগন্ধা, বকুল, দোলনচাঁপা ও চামেলি নামে বিমানবন্দরে ৪টি ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। রজনীগন্ধা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ভিআইপিরা ব্যবহার করেন। বকুল ব্যবহার করেন অতিরিক্ত সচিব বা তার পদমযার্দার ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা। দোলনচাঁপা ব্যবহার করেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর চামেলি দিয়ে একুশে পদক পাওয়া ব্যক্তি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রবেশ ও বের হতে পারেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।