
ভাষাশহীদ আবুল বরকত ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরের বছর তৎকালীন পূর্ববাংলায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করে এমএ শেষ পর্বের ছাত্র ছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে তার জন্ম, ডাকনাম আবাই। শহীদ বরকত সম্পর্কে খুব কমই জানি। আমরা দুজন ২০১৮ সালে ভাষাশহীদ আবুল বরকত সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তার জন্মস্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ভাষার মাসকেই বেছে নিই। ২ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় বিমানে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে কলকাতায় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দরে পৌঁছাই দুপুর ১২টায়। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে কলকাতার চিতপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাই দেড়টা নাগাদ। আমাদের গন্তব্য মুর্শিদাবাদের বহরমপুর। কলকাতা থেকে বহরমপুরের দূরত্ব ২০০ কিমি। সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ। ট্রেনের নাম ‘ধনধান্যে’। বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ট্রেন ও স্টেশনের পর স্টেশন অতিক্রম করে এগোতে লাগল। মাঝেমধ্যে পরিচিত জায়গার নাম চোখে পড়ায় যেন শব্দদূষণের যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হলো। যেমন বারাসাত, রানাঘাট, পলাশী, হুগলী, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি। রাত ৯টা বাজার কয়েক মিনিট আগে আমরা বহরমপুর স্টেশনে নামলাম। ‘সোনার বাংলা’ হোটেলে উঠলাম।
৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার ২০১৮। সকাল ৮টায় ভাষাশহীদ বরকতের নিজগ্রাম বাবলার উদ্দেশে ট্যাক্সিতে রওনা হলাম। শীতের সকাল। শহরের গন্ডি পেরোতেই চারদিকে ঘনকুয়াশা, ডানে-বামে কিছু দেখা যায় না। শহরের বাইরে রঞ্জিত সার্ভিস পেট্রলপাম্প স্টেশন পার হয়ে সামনের মোড় থেকে বামদিকে বাদশাহী রোড ধরে সালার থানা। সালারের বাসিন্দা বরকতের চাচাতো ভাই মানিক মিয়ার ছেলের ঘরের নাতি দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া সামিন। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে সালার ডিগ্রি কলেজের সামনের মোড়ে অবস্থান করছে। সামিন শহীদ বরকতের তৃতীয় প্রজন্মের সর্বকনিষ্ঠ বংশধর। সামিনদের বাসায় আমাদের প্রথম বিরতি। ঘরে ঢুকতেই দেখা হলো কোটপরা ছয় ফুটের বেশি লম্বা সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের সঙ্গে। চেয়ারে বসা। বুঝতে বাকি রইল না, উনিই বরকতের চাচাতো ভাই ‘মানিক মিয়া’। বরকতকে স্বচক্ষে দেখা একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। তার কিছু ছবি তোলা ও বক্তব্য রেকর্ড করার কাজটি দ্রুত সেরে নেওয়া হলো। দুপুর ১২টা বেজে গেছে প্রায়। আমরা দ্রুত সামিন ও মানিক মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বরকতের জন্মভূমি বাবলা গ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে মানিক মিয়ার সঙ্গে অনেক কথা হলো বরকত সম্পর্কে। বয়সের ভারে তিনি অনেকটাই ন্যুব্জ, অসুস্থও। বরকতের সঙ্গে তার সর্বশেষ দেখা হয় তার ৯ বছর বয়সে। এর বেশি স্মৃতি তার মনে নেই।
গ্রামের অপ্রশস্ত পথ ধরে এগোলাম। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা চলার পর বাবলা গ্রামে ‘বরকত ভবন’-এর সামনে গাড়ি থামল। আমরা দুজনই খুব পুলকিত। শহীদ বরকতের অনাবিষ্কৃত ইতিহাসের দোরগোড়ায় আমরা এসে গেছি। গাড়ি থেকে নেমে তাকিয়ে দেখি রাস্তার পূর্ব পাশে ‘বরকত ভবন’ নামাঙ্কিত ডুপ্লেক্স ভবন। ভবনের গায়ে লেখা ‘শহীদ আবুল বরকত কেন্দ্র’, স্থাপিত ২০০৫-০৬, বাবলা, রেজি. নং ঝ/১খ/১৭২০৩.১। ঠিক সামনেই রাস্তার দক্ষিণ পাশে ‘শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি সংঘ’, স্থাপিত-১৯৯৬, রেজি. নং-ঝ/১খ/১৪১৫০ বাবলা (বরকত নগর); পো. তালিবপুর, জেলা-মুর্শিদাবাদ। ছোট একতলা ভবন। ভবনটির সামনেই একটি ছোট্ট স্ট্যান্ডের ওপর শহীদ বরকতের সোনালি রঙের আবক্ষ মূর্তি। নিচে নেমপ্লেটে লেখা আছে ‘ভাষাশহীদ, শহীদ আবুল বরকত, আবির্ভাব : ১৬ই জুন ১৯২৭, শহীদ : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, উদ্বোধক মাননীয় সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, শ্রী অধীর রঞ্জন চৌধুরী, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।’
আশপাশের বাড়ির লোকজন আমাদের আগমন টের পেয়ে কাছে আসতে শুরু করেছে। অনুরোধ করতেই বরকত ভবনটি খুলে দেওয়া হলো। ডুপ্লেক্স ভবন। ভেতরে একাধিক কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের সামনে ভাষাশহীদদের নামফলক লাগানো। (১) ভাষাশহীদ সালাম কক্ষ; (২) ভাষাশহীদ রফিক কক্ষ; (৩) ভাষাশহীদ বরকত লাইব্রেরি কক্ষ। ভবনে একটি বড় হলরুম আছে। জানা গেল এখানে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ বরকতের সম্মানে অনুষ্ঠান হয়। রাস্তার উত্তর পাশে বরকত ভবনের ঠিক উল্টো পাশে শহীদ বরকতদের বসতঘর। বাড়িটি অন্য লোকের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। তিনি সেখানে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কিন্তু বরকতদের ইটের একতলা ঘরটি, যার দক্ষিণ পাশে দুটি জানালা আছে, স্মৃতি হিসেবে আগের আকৃতিতে রেখে দিয়েছেন। রাস্তার দক্ষিণ পাশে একটি বড় দীঘি আছে। এলাকার লোকজনের ভাষ্য, এ দীঘিটি বরকতের পরিবারের। শহীদ বরকতের বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ গজ পূর্বদিকে রাস্তা ঘেঁষে রয়েছে ‘শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
শহীদ আবুল বরকত এ বিদ্যালয়েই প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন। তখন নাম ছিল বাবলা বহড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয় ভবনটি দোতলা। ভবনের মাঝখানে অপ্রশস্ত সিঁড়ি, এর দুদিকে ছোট ছোট ক্লাসরুম। কোনো শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের বসার কোনো বেঞ্চের অস্তিত্ব পেলাম না। শিক্ষার্থীরা মেঝেতে বসেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম সারছে। বিদ্যালয়ের সামনের দেয়ালে শিক্ষার্থীদের সাপ্তাহিক খাবারের মেন্যু টানানো আছে। জানা গেল, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় দুপুরের খাবার স্কুলেই মেন্যু অনুযায়ী রান্না হয় এবং শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়। বাবলা গ্রামের এই বিদ্যালয়টির দৈন্যদশা আমাদের ব্যথিত করেছে।
আমরা আবার বরকতের বাড়ির আঙিনায় ফিরে এলাম। কথা হয় বরকতের পড়শি, সম্পর্কে ভাইপো মো. আবদুল্লাহর সঙ্গে। তার বয়স পঞ্চাশের বেশি। তার ভাষ্য, বরকতের সম্পত্তি বাড়িঘর ও ধানিজমি মিলে প্রায় ৪০ বিঘা। সবটাই ওয়াকফ করা আছে আবুল বরকত স্মৃতি সংঘের নামে। এ সম্পত্তির আয় থেকেই প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালন, বরকতের নামে অনুষ্ঠান করা এবং বরকতসংক্রান্ত কাজে ব্যয় করার কথা। কিন্তু বরকতের আত্মীয়স্বজনরা খোঁজখবর নেয় না। তাই প্রায় সব সম্পত্তিই দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এরপর মিনিট দশেক খোঁজার পর শহীদ আবুল বরকত নামে একটি স্কুল ভবন পাওয়া গেল। বিদ্যালয়টির নাম ‘শহীদ আবু বরকত শিশু শিক্ষা’, স্থাপিত : ২০০৩, গ্রাম : বাবলা, পো. : তালিবপুর, জেলা : মুর্শিদাবাদ, সৌজন্যে : ভরতপুর ১নং পঞ্চায়েত সমিতি। আমরা বাংলাদেশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি শুনে প্রধান শিক্ষক খুব খুশি হলেন। তার অনুমতি নিয়ে ক্লাস পরিদর্শনে গেলাম। এখানেও ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের বসার কোনো বেঞ্চ নেই। সবাই মাটিতে বসেই শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাবলা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম তালিবপুর হাই স্কুলের উদ্দেশ্যে। বাবলা থেকে তালিবপুর গাড়িতে প্রায় ২০ মিনিট। তালিবপুর হাই স্কুলে পৌঁছে টের পেলাম সেদিন শনিবার তাই স্কুল বন্ধ। কিছু ছবি তোলা ছাড়া আর কিছু করতে পারলাম না। এ নিয়ে যখন আলোচনা করছি তখন সামিন জানাল, সালার থানার পাশে শহীদ আবুল বরকতের স্মরণে একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে।
ফুলের টব ও উন্মুক্ত চত্বরে সাজানো পার্ক। আমরা কয়েকটি ছবি তুললাম। পার্কে ঢুকতেই গেটের সামনে ডানপাশে শহীদ বরকতের আবক্ষ মূর্তি। মূর্তির নিচে লেখা : ভাষা আন্দোলনের শহীদ, আবুল বরকত সাহেব, জন্ম ১৬ জুন ১৯২৭, মৃত্যু ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।’ বেদির পাশেই ডানদিকে শ্বেতপাথরের ওপর খোদাই করে লেখা : ‘বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবুল বরকত সাহেবের স্মৃতি উদ্দেশ্য সালার শিশু উদ্যান-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিলেন ড. রাজেশ কুমার আইপিএস মাননীয় পুলিশ সুপার মুর্শিদাবাদ ৮ই জুলাই ২০০০।’ সালার থানায় এবং অন্যান্য স্থানেও মানিক মিয়ার বেশ কদর। বরকতের ভাই হিসেবে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ২টা ছুঁই ছুঁই। এখনো আমাদের অনেক অনুসন্ধান বাকি। বরকতের আদি বাড়ি ও বহরমপুরে তার কলেজে যেতে হবে। চা-নাশতা সেরে আমরা মানিক মিয়াকে নিয়ে তার আদি বাড়ি ভরতপুর থানার কিসাতপুর গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। গাড়িতে মানিক মিয়ার সঙ্গে অনেক কথাই হলো। জানা গেল, বরকতের আদি গ্রাম কিসাতপুর। বাবলা তার মামার বাড়ি। তার বাবা শামসুজ্জামান ভোলা মিয়া বিয়ের পর বাবলায় চলে যায়। পরে কিসাতপুরের জায়গা-জমি বিক্রি করে বাবলায় জমি কিনে বাস শুরু করেন। পরে বরকত পড়ালেখার জন্য ঢাকায় তার মামার কাছে চলে যান। এখন বাবলা গ্রামে বরকতের পরিবারের কেউ থাকে না।
সামিন সালারে থেকে যায়। শুধু মানিক মিয়াকে নিয়ে আমরা চলে এসেছিলাম। অনেকটা পথ পেরিয়ে প্রায় দুপুর ৩টা নাগাদ আমরা কিসাতপুর হাজির হয়েছি। এ বাড়িতে মানিক মিয়া তার দুই ছেলে ও নাতি-নাতনিসহ থাকেন। মাটির দোতলা ঘর। বোঝা যাচ্ছে অসচ্ছল পরিবার। আমাদের যে ঘরে বসতে দিল তাতে একটা চৌকি, কাঠের আলনা ও ভাঙাচোরা একটা শোকেস। এখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বহরমপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ। হোটেলে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। কাল সকালে অর্থাৎ ৪ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনাথ কলেজে বরকতের স্মৃতিসন্ধান করব।
পরদিন সকাল ৮টার মধ্যে ড. দেবরাজ চক্রবর্তীসহ হাজির হলাম কৃষ্ণনাথ কলেজে। ভাগ্য খারাপ, রোববার থাকায় কলেজ ছুটি। গার্ডের তত্ত্বাবধানে কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘুরে দেখলাম। মেইন গেটের পর বামদিকে খোলা আকাশের নিচে বরকতের ছোট আবক্ষ মূর্তি। সেখানে লেখা ‘বরকত আমাদের ছাত্র, আমাদের গর্ব আবুল বরকতের স্মরণে
মাতৃভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের সকলের প্রতি উৎসর্গ করা হল। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০১১।’ বরকত এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সিকিউরিটি গার্ড আমাদের একটা কক্ষ তালা খুলে দেখাল। কক্ষটি বরকতের নামে উৎসর্গ করা। ওই ভবনের নিচে একটা মাঝারি সাইজের অডিটরিয়াম। দরজার ওপরে ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ‘শহীদ বরকত কক্ষ’। এরপর আমরা মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিলাম। একসময়ের সুবে বাংলার রাজধানী। পেছনে রেখে এলাম বরকতের সব স্মৃতি।
আমাদের মন খারাপ। বুকভরা আশা নিয়ে পরিবার-পরিজন, জন্মভূমি ছেড়ে বরকত ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ উৎসর্গ করলেন। তার আত্মত্যাগে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বরকতের নামে বাংলাদেশেও রয়েছে বিভিন্ন স্মারক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাশহীদ আবুল বরকত জাদুঘর ও সংগ্রহশালা ২০১২ সালে স্থাপিত হয়েছে। গাজীপুরে বরকত ভবন নামে একটি বাড়ি আছে। গাজীপুরে রয়েছে শহীদ আবুল বরকত স্টেডিয়াম। ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ আবুল বরকতকে ২০০০ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে বাঙালির হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন।
লেখক : আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, সভাপতি, ইতিহাস বিভাগ ও পরিচালক, ভাষাশহীদ আবুল বরকত জাদুঘর ও সংগ্রহশালা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বোরহান উদ্দিন ভূঁইয়া, উপাধ্যক্ষ, ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ, খিলগাঁও
দেশভাগের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় মাতৃভাষার জন্য বাঙালিকে রাজপথে নামতে হয়। সাত মাসের মধ্যে ঘটে রক্তপাতের ঘটনা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম রক্তাক্ত হয় পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ। ওই দিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় পালিত হয় প্রথম ধর্মঘট। পুলিশের বর্বর হামলা ও গুলিবর্ষণে সচিবালয়ের সামনের রাস্তা রক্তে ভিজে যায়। কারাগার ভরে যায় তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সংগ্রামী ছাত্রদের গ্রেপ্তারে। সেদিন প্রতিবাদের যে ভিত রচিত হয় তারই পথ ধরে আসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তঝরা দিন এবং এর আগের-পরের সময়গুলো ক্যামেরায় ধারণ করেন চল্লিশের দশকের শক্তিমান আলোকচিত্রী শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব। তার তোলা ভাষা আন্দোলনের এই দলিলচিত্রগুলো হয়ে ওঠে পাকিস্তানি স্বৈর-সিদ্ধান্তের বিপরীতে প্রতিবাদের হাতিয়ার।
দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তথ্য অধিদপ্তরের [পিআইডি] কার্যালয় খোলা হয়, ইয়াকুব ছিলেন এর প্রথম দিককার ফটোগ্রাফার। সরকারি চাকুরে হয়েও বাঙালির পক্ষে তার এই অবস্থান ছিল শাসকচক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আটচল্লিশের অগ্নিঝরা সময় যার ক্যামেরায় মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল, তার অসীম সাহসিকতার গল্প কোথাও উল্লেখ নেই। ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্রী হিসেবেও তার নামটি এখন পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি কোনো মহলে। ফলে বাংলা ভাষার জন্য তার যে বিশাল অবদান কিংবা ত্যাগের মহিমা, সাধারণ মানুষের কাছে তা অজানা থেকে গেছে।
দৈনিক বাংলার পাতায়
আটচল্লিশের রক্তাক্ত অধ্যায় যে শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের ফ্রেমে ধরা তার খোঁজ মেলে পুরনো পত্রিকার ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে। তার তোলা তিনটি দুর্লভ ছবি ১৯৭৪ সালের ৭ জুন দৈনিক বাংলার শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। ছবিগুলোর ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয় শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের নাম। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল আগে পত্রিকায় ছাপা হওয়া এই ছবিগুলো যেন বাঙালির গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের একঝলক। প্রকাশিত একটি ছবি হলো ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র-সমাবেশের। ভাষা আন্দোলনের পাটাতন তৈরির সময়ের ছবি বলে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। আরেকটি ছবি ১১ মার্চ সচিবালয়ের ১ নম্বর গেটে আহত মোহাম্মদ বায়তুল্লাহকে [যিনি ছিলেন শ্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডেপুটি স্পিকার] ঘিরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রনেতাদের। এই দুটি ছবি বর্তমান প্রজন্মের একেবারেই অদেখা। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা শওকত আলীর পাশে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি ১১ মার্চ তোলা বলে বিভিন্ন প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ওই দিন শওকত আলী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। আর শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করা হয়। ১৫ মার্চ শেখ মুজিব মুক্তি পান। পরদিন সুস্থতার ছাড়পত্র পান শওকত আলী। ফলে এ ছবিটি ১৬ মার্চ হাসপাতাল গেটে তোলা বলে গবেষকরা মনে করেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও এর সত্যতা মেলে। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজে অবস্থিত ভাষা আন্দোলন জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় এই ঐতিহাসিক ছবির একটি খন্ডিত অংশ সংরক্ষিত আছে। কিন্তু প্রদর্শিত ছবিতে আলোকচিত্রীর নাম উল্লেখ নেই। ফলে দৈনিক বাংলায় ছবিগুলো ছাপা না হলে এই কৃতী আলোকচিত্রকরের নাম জানা সম্ভব হতো না।
এত দিন সবাই জানতেন, আটচল্লিশে আ জা ম তকীয়ুল্লাহ এবং বায়ান্নতে আমানুল হক, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, জমিল চৌধুরী আর ডা. আবদুল হাফিজ ছবি তুলেছিলেন। জীবদ্দশায় তকীয়ুল্লাহ, আমানুল হক ও রফিকুল ইসলাম ভাষাসংগ্রাম নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন এবং তাদের তোলা ছবিগুলো চিহ্নিত করে গেছেন। ফলে আটচল্লিশের বাকি যেসব ছবি বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বেনামে ঘুরে বেড়ায়, সেগুলো কার তোলাÑএই প্রশ্নের উত্তর ছিল অমীমাংসিত। ইয়াকুবের ছবিগুলোর সন্ধান পাওয়ায় অমীমাংসিত বিষয়টির সমাধানের পথ তৈরি হলো। আটচল্লিশের ভাষাসংগ্রামের যে বিস্তৃতি তাতে এই তিনটি ছবি ছাড়াও তার তোলা আরও অনেক ছবি থাকার কথা। সেগুলোর মূল নেগেটিভ এখন কোথায় কিংবা কী অবস্থায় আছে, তা অজানা। নেগেটিভগুলো উদ্ধার করা গেলে ভাষা আন্দোলনের আরও অজানা ইতিহাস প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হতো।
বিশিষ্টজনের মন্তব্য
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, এখন পর্যন্ত ভাষাসংগ্রামের যে লিখিত ইতিহাস, তাতে শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের কথা উল্লেখ নেই। কিন্তু চুয়াত্তরের পত্রিকায় যেহেতু ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাই তাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, আমাদের মনোযোগ বায়ান্নর দিকে। কিন্তু আটচল্লিশ আর বায়ান্ন একই সূত্রে গাথা। আটচল্লিশ ছাড়া বায়ান্নকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। আটচল্লিশের ১১ মার্চ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কারাবরণের কারণে শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন, যা ইয়াকুবের ক্যামেরায় বন্দি। বায়তুল্লাহর ছবিটি প্রমাণ করে ওই দিনের বিক্ষোভ সমাবেশে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ইয়াকুব শুধু আটচল্লিশেই নয়, ছেচল্লিশের দাঙ্গার ছবি তুলেও দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। ছাত্রজীবনেই বন্ধু হিসেবে শেখ মুজিবের সান্নিধ্য পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠার পেছনে যে কয়েকজন মানুষের নেপথ্য সমর্থন ছিল, ইয়াকুব তাদের অন্যতম। ফলে এই মানুষটি সম্পর্কে আরও বেশি জানা দরকার। এ বিষয়ে যত তথ্য, বিবরণ ও ভাষ্য উঠে আসবে, আমাদের ইতিহাস ততই সমৃদ্ধ হবে।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, আগে ফটোগ্রাফারদের ক্রেডিট দেওয়া হতো না বলে তাদের কথা মানুষ জানত না। অনেক দেরিতে হলেও শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ভাষাসংগ্রামীকে আবিষ্কার করতে পারা এক বিশাল ঘটনা। তার তোলা আমতলার সমাবেশ আর আহত বায়তুল্লাহ্র ছবিটি ইতিহাসের এক নব সংযোজন। ফলে তার ছবির কারণে আমাদের ভাষা আন্দোলনের পরিধিটাও আরও বিস্তৃত হলো। এখন থেকে ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে তার নাম ব্যবহার করা কর্তব্য বলে মনে করি।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে
নিভৃতচারী হওয়ার কারণে একসময়ের শক্তিমান আলোকচিত্রকার শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব কালের আবিলতার আড়ালে চাপা পড়ে যান। সে আবিলতা ঝেড়ে সবার আগে তাকে উজ্জ্বল আলোয় আপন সৌকর্যে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব আর ইয়াকুব ছিলেন ঘনিষ্ঠ সহপাঠী। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে তাদের বন্ধুত্ব। একই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন বলে বিভিন্ন মিছিল-মিটিং, আন্দোলন-সংগ্রামে ক্যামেরা কাঁধে বন্ধুর পাশে ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছেন ইয়াকুব। ছেচল্লিশের দাঙ্গা নিরসনে তার তোলা মর্মস্পর্শী ছবিগুলো অবিভক্ত বাংলায় কী প্রভাব ফেলেছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ৮১ ও ৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি আর ইয়াকুব নামে আমার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু পরামর্শ করলাম, আজ [১৯ আগস্ট, ১৯৪৬] মহাত্মাজীকে একটা উপহার দিব। ইয়াকুব বলল, তোমার মনে আছে আমি আর তুমি বিহার থেকে দাঙ্গার ফটো তুলেছিলাম? আমি বললাম, হ্যাঁ মনে আছে। ইয়াকুব বলল, সমস্ত কলকাতা ঘুরে আমি ফটো তুলেছি। তুমি জান না তার কপিও করেছি। সেই ছবিগুলি থেকে কিছু ছবি বেছে একটা প্যাকেট করে মহাত্মাজীকে উপহার দিলে কেমন হয়। আমি বললাম, চমৎকার হবে। চল যাই, প্যাকেট করে ফেলি। যেমন কথা তেমন কাজ। দুইজন বসে পড়লাম। তারপর প্যাকেটটা এমনভাবে বাঁধা হল যে, কমপক্ষে দশ মিনিট লাগবে খুলতে। আমরা তাকে উপহার দিয়েই ভাগব। এই ফটোর মধ্যে ছিল মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, শুধু শরীরটা আছে, বস্তি, মসজিদে আগুন জ¦লছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, এমনই আরও অনেক কিছু! মহাত্মাজী দেখুক, কিভাবে তার লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে। আমরা নারকেলডাঙ্গায় মহাত্মাজীর ওখানে পৌঁছালাম। তার সাথে ঈদের মোলাকাত করব বললাম। আমাদের তখনই তার কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। মহাত্মাজী আমাদের কয়েকটা আপেল দিলেন। আমরা মহাত্মাজীকে প্যাকেটটা উপহার দিলাম। তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করলেন। আমরা যে অপরিচিত, সেদিকে তার ভ্রƒক্ষেপ নাই। তবে বুঝতে পারলাম, তার নাতনী মনু গান্ধী আমার চেহারা দেখেছে ব্যারাকপুর সভায়, কারণ আমি শহীদ সাহেবের [হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী] কাছে প্ল্যাটফর্মে বসেছিলাম। আমরা উপহার দিয়ে চলে এলাম তাড়াতাড়ি হেঁটে।...। বন্ধু ইয়াকুবের এই ফটোগুলি যে মহাত্মা গান্ধীর মনে বিরাট দাগ কেটেছিল, তাতে সন্দেহ নাই।’
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিককার ছবিগুলো শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের তোলা বলে ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে। কলকাতার ব্যারাকপুরের জনসভায় মহাত্মা গান্ধীর পাশে ২৭ বছরের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি যে ইয়াকুবের তোলা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
ব্যক্তিজীবন
শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের জন্ম ১৯১৭ সালে, অবিভক্ত বাংলার কলকাতায়। কলেজে পড়ার সময় এক খ্রিস্টান যুবকের কাছ থেকে বিশ টাকা দিয়ে কোডাকের বি-টু সাইজের ফোল্ডিং ক্যামেরা কিনে ফটোগ্রাফি শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ছবি তুলে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ওই সব ছবি দেখে তৎকালীন তথ্য সচিব তাকে কেন্দ্রীয় তথ্য দপ্তরে ফটোগ্রাফার হিসেবে যোগ দিতে বলেন। দেশভাগের সময় তিনি স্থায়ীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসে পিআইডিতে যোগদান করেন। তখন মুক্তাঙ্গনের পাশে ছিল পিআইডির কার্যালয়। পিআইডির নিজস্ব ডার্করুম না থাকায় তিনি পুরান ঢাকার ‘স্টুডিও এইচ’ থেকে ছবি প্রিন্ট করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অকৃতদার ছিলেন। মাকে নিয়ে পল্টনের একটি ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। এ দেশে তার আপন কেউ ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধুকেই তিনি অভিভাবক মনে করতেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হওয়ার পর তিনি সত্যিকার অর্থেই অভিভাবকহীন হলেন। আর পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে অবসর গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যে মায়ের মৃত্যুতে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি।
জীবনসায়াহ্নে
ইয়াকুবের শেষ জীবনটা ছিল ভীষণ কষ্টের। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, অর্থের অভাবে সেটিও একসময় ছেড়ে দিতে হয়। ফলে রাতের বেলায় প্রেস ক্লাবের অভ্যর্থনা কক্ষের মেঝেতে কিংবা ফুটপাতে ঘুমাতেন। দিনের বেলায় ঘুরে বেড়াতেন প্রেস ক্লাবের আঙিনায়। ক্যানটিনের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতেন। অনুজ ফটোসাংবাদিক খালেদ হায়দার আর বুলবুল আহমেদকে কাছে পেলে পুরনো দিনের গল্প বলতেন। জীবনের শেষদিকে শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কেউ কেউ তাকে বোঝাও মনে করতেন। বেশির ভাগ সময় তাকে না খেয়ে থাকতে হতো। বড় অবহেলায় নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত।
কবে মারা গেলেন শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুব, জানতে প্রেস ক্লাবে গেলাম। কয়েকজন প্রবীণ আলোকচিত্রী তার কথা শুনে স্মৃতিকাতর হলেন। কিন্তু দিনক্ষণ বলতে পারলেন না! প্রেস ক্লাবের রেজিস্ট্রি খাতায়ও তার মৃত্যুর তারিখটি পাওয়া গেল না! কম্পিউটারে সংরক্ষিত তালিকা দেখে একজন বললেন, ‘এই নামে কোনো ফটোসাংবাদিক ছিল বলে জানা নেই!’ পরে বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে পুরনো পত্রিকার ফাইল ঘেঁটে জানা গেল শেখ মোহাম্মদ ইয়াকুবের চলে যাওয়ার দিনটি ছিল বুধবার, ৭ জুন, ১৯৯৫। সেই সময়ের জাতীয় কয়েকটি দৈনিকে কী নিদারুণ দায়সারাভাবে তার মৃত্যুর খবর ছাপে, তা দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হলো।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের ভূখণ্ডের মানুষের দীর্ঘদিনের। পরাধীনতার সুদীর্ঘ বছরগুলোতে ১৯০ বছর ব্রিটিশ, পরে ২৩ বছর পাকিস্তানিদের আমরা দেখেছিলাম কীভাবে তারা আমাদের শোষণ করেছে। শোষণের প্রয়োজনেই শাসন করা ছিল তাদের কাজ। আমাদের তারা যে পরিমাণ শোষণ করেছে তাদের সমৃদ্ধি ততই বেড়েছে। জনগণ এটা মেনে নিতে চায়নি, তাই ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তেভেজা এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছে। কিন্তু যেকোনো সংগ্রামের একটা সূচনাবিন্দু থাকে, স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াইয়েরও তেমনি শুরু খুঁজতে হলে প্রথমেই আসে ৫২ সালের কথা। ৭১-এ অর্জিত এই স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি যে বেদনা এবং যে চেতনা জাগিয়ে দিয়েছিল তা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বৈষম্য বেদনা জাগিয়েছিল বলেই মুক্তি-চেতনার জন্ম হয়েছিল। এই বৈষম্য থেকে মুক্তি আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা জোগায়।
কেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যেই মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমির আন্দোলনে নিম্নবিত্ত দরিদ্র মুসলমান দলে দলে যুক্ত হয়েছিলেন এই প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আশা জাগিয়ে তোলা হয়েছিল যে মুসলমানদের আলাদা দেশ পাকিস্তান গঠিত হলে সেখানে কোনো শোষণ থাকবে না। কারণ মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। ভাই কি ভাইকে শোষণ করতে পারে? আর উচ্চবিত্ত ধনী উচ্চশিক্ষিত মুসলমান যুক্ত হয়েছিলেন এই আশায় যে রাষ্ট্রটা হাতে পেলে ক্ষমতার দুধ-মধু সবই তারা খেতে পারবেন। ফলে এই দুই শ্রেণির ছিল দুই আশা কিন্তু লক্ষ্য ছিল এক, সেটা হলো পাকিস্তান সৃষ্টি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম যে প্রশ্ন এলো এই রাষ্ট্রের সংবিধান কেমন হবে। শুধু মুসলমানদের জন্য কেন, কোনো ধর্মের ভিত্তিতেই কি কোনো দেশ হতে পারে? যদি তাই হতো তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের অধিবাসীই তো মুসলমান, তাহলে তারা সবাই মিলে একটা দেশ হতে পারে না কেন? আবার এক দেশে বহু ধর্মের মানুষ থাকলে তাদের পরিচয় কী হবে? আবার ভারতে যে মুসলমানরা থেকে গেলেন তাদের পরিচয় কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা গেলেও আশ্বস্ত করা হয়েছিল এই বলে যে, এক দিন হিন্দু আর হিন্দু হিসেবে নয়, মুসলমান আর মুসলমান হিসেবে নয় তারা সবাই বিবেচিত হবেন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয় আর নাগরিক পরিচয় এক হবে না। একেবারে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিপরীতমুখী যাত্রা! তাহলে এত সাম্প্রদায়িক কারণে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু কীসের জন্য? এই টানাপড়েনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে তাই দীর্ঘ সময় লেগে গেল। ১৯৪৭ সালে জন্ম নিল পাকিস্তান আর তার ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে প্রণীত হলো সংবিধান। এ সময়টায় সংবিধান না থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্রিটিশ প্রবর্তিত বিধান তো ছিল, তা দিয়েই চলছিল সব। রাষ্ট্রের ধর্ম নিয়ে সমাধানে আসতে না আসতেই প্রশ্ন এলো রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে? এক ধর্ম, এক দেশ, এক ভাষা এ ধরনের চিন্তা থেকেই মুসলমান, পাকিস্তান এবং উর্দু ভাষাকে সমার্থক করার আয়োজন চলছিল সর্বত্র। অন্যদিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনে ঢাকা তখন উত্তাল। এ সময় ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত গণসংবর্ধনায় তিনি বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। ভাষা আন্দোলনকে তিনি মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যের প্রতিবাদ হয় সমাবেশের মধ্যেই। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে স্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি বাতিল করে দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি অবশ্যই উর্দু। কারণ উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে। ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়। ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ভাষার দাবিকে তাচ্ছিল্য করে ২৮ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন জিন্নাহ।
জিন্নাহ চলে গেছেন কিন্তু উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে পারেননি। প্রশ্ন ছিল, উর্দু কি পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা? সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ প্রত্যেকেরই তো আলাদা ভাষা। ভাষা দিয়ে কি ধর্মের পরিচয় তুলে ধরা যায়? আরবি ভাষায় কি মুসলমান ছাড়া কেউ কথা বলে না? আরবের খ্রিস্টান, ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষরাও তো আরবি ভাষায় কথা বলে। এ কথা তো সত্য যে, মানুষ যত দ্রুত ধর্মান্তরিত হতে পারে তত সহজে ভাষান্তরিত হতে পারে না। আরবের মুসলমান আর ইন্দোনেশিয়ার মুসলমান ধর্মে এক হলেও ভাষা এবং সংস্কৃতিতে এক নয়। আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথাও যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে যে ভাষায় ৫৪ শতাংশ মানুষ কথা বলে তাদের দাবি কি অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হবে না?
ভাষা আন্দোলনের মূল সুর ছিল গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক। রাষ্ট্র তার নাগরিককে ধর্মের ভিত্তিতে বিবেচনা করবে না। এই ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া ও বসবাস করা মানুষরা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের নাগরিক। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্তি হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল শহীদ মিনার। তারা জীবন দিয়েছিলেন এই ভূখণ্ডের সব মানুষের মুখের ভাষার জন্য। তাই সব ধর্মের মানুষ যেন শ্রদ্ধা জানাতে পারে সে উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল শহীদ মিনার।
একুশ শিখিয়েছিল আত্মসমর্পণ নয়, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে। একুশ মানে মাথানত না করা। এটা আমাদের কাছে এখনো একটি প্রেরণাদায়ক কথা। প্রবল শক্তির কাছে বা যুক্তিহীনতার কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু সম্মানের সঙ্গে বাঁচা যায় না। অন্ধত্ব বা অন্ধকার যত প্রবলই হোক না কেন যুক্তি অস্ত্রে তাকে পরাভূত করা সম্ভব যদি ব্যাপক মানুষের মধ্যে সেই যুক্তির আলো পৌঁছে দেওয়া যায়। যুক্তির আলো পথ দেখিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার। স্বাধীনতার সঙ্গে মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ তা অর্জন করতে হলেও যুক্তিই হবে অন্যতম হাতিয়ার। ভাষার দাবিতে লড়াই পথ দেখিয়েছে, নাগরিক অধিকার অর্জন করতে হলে ভোটের অধিকার দরকার। বৈষম্য দূর করার প্রথম পদক্ষেপ হলো সবার ভাতের অধিকার। সে কারণেই স্লোগান উঠেছিল কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না। আর এসব দাবিকে একসঙ্গে যুক্ত করেছিল এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন করতে হবে। তাই দেখা যায়, ভাষা-ভাত-ভোট-ভূখণ্ড এই চারটি শব্দ, যা ‘ভ’ দিয়েই শুরু তা আমাদের জীবন ও রাজনীতিকে তখন কতটা প্রভাবিত করেছে এবং এখনো করছে।
আন্দোলন থামে না তার পরিণতিতে না যাওয়া পর্যন্ত। তাই ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করে স্বাধীন হলাম কিন্তু বন্দি হয়ে গেলাম পুঁজির কাছে। মুখের ভাষায় পড়তে হলে যে শিক্ষা লাগে তা তো আমরা জানি। সেই শিক্ষা ক্রমাগত ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হচ্ছে, ফলে তা চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। শিক্ষার ওপর আক্রমণের পাশাপাশি আক্রমণ আসছে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর। ছাত্রদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতীতের সংগ্রামের ইতিহাসকে। যেমন : গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং একটি গণতান্ত্রিক, বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার একই পদ্ধতির শিক্ষানীতির দাবিতে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের জীবন দিতে হয়েছিল তা প্রায় ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।
ভাষা চিন্তার বাহন। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জীবন দিলেও সে ভাষায় কথা বলতে গেলে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ লাগে, দেশে কি এখন সে অবস্থায় আছে? এই প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উত্তর নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর ভোটের অধিকারের জন্য লড়তে হচ্ছে এখনো। নানা ধরনের কালাকানুন আর সাম্প্রদায়িক বাতাবরণে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। মাথানত না করার সাহস দিয়েছে একুশ, আর মাথানত করে রাখার পরিবেশ তৈরি করেছে রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্র জনগণের ট্যাক্সে চলে সেই রাষ্ট্র জনগণকে দেখায় ভয়। ফলে দেশ, অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে বন্ধু-স্বজনরাও পরামর্শ দেয় এবং বলে, বাদ দাও তো এসব, কী দরকার রাজনীতির বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে! এই ভয় আর ভরসাহীনতার রাষ্ট্র তো আমরা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম রাষ্ট্রটা হবে জনগণের এবং জনগণকে ভরসা দেবে।
একুশ যে চেতনা জাগিয়েছিল তার মর্মে ছিল মুক্তির আকুতি। শোষণ থেকে মুক্তি, বৈষম্য থেকে মুক্তি আর মুক্তি অপমান থেকে। এই চেতনা ছড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনায়। কোনো মানুষ যেন তার মাতৃভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন সেই লড়াইকে এগিয়ে নিতে একুশ যেন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে আরও বহুদিন।
লেখক : রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট [email protected]
১৯৫২ সালে আমার বড় খালা রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্যতম ‘সিলেটি ছাত্রী’ হিসেবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সংগত কারণে নিজেকে একজন ভাষাসৈনিক পরিবারের সদস্য হিসেবে গৌরবান্বিত মনে করতাম। কিন্তু জানতাম না, আমার ছোটখালা হোসনে আরা বেগম এবং আম্মা ছালেহা বেগমও যে সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। জানতাম না, আম্মা ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালে সেখানে ভাষা আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সার দেশে শোক প্রকাশ হিসেবে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলনের জন্য জেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে চরম শাস্তি দিয়েছিল। সেই শাস্তি ছিল, তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা। আম্মাকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ফলে তিনি তার শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়েছিলেন।
বহিষ্কৃত হওয়ার পর আম্মা ময়মনসিংহ শহর ত্যাগ করেন এবং ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় অবদানের কথা কাউকে না বলে সারা জীবন অপরাধী হিসেবে কাটিয়েছেন। তাকে পারিবারিকভাবে কোরআন শপথের মাধ্যমে বড় বোন ওই শাস্তির কথা কাউকে ঘুণাক্ষরেও যাতে না বলেন, সেই ওয়াদা করিয়েছিলেন। তিনি লজ্জায় ওই শাস্তির কথা জীবদ্দশায় কাউকে বলেননি। তাকে পারিবারিকভাবে অন্য বোনদের আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ওইটুকু পড়াশোনা নিয়েই তিনি স্বামীর কর্মস্থল কুষ্টিয়ার চাঁদ সুলতানা গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ছিলেন কুলাউড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সহকারী শিক্ষিক। পরে তিনি নিজ উদ্যোগে কিশোরগঞ্জে বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০০৪ সালে ১৯ আগস্ট ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৯৫২ সালের তার সেই অনবদ্য সংগ্রামী অভিজ্ঞতা, যা আমাদের পরিবারের সবারই অজানা ছিল।
২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর আমার বড় খালা রওশন আরা বাচ্চুর জীবনাবসান হয়। এরপর ১৭ ডিসেম্বর তার জন্মদিন উপলক্ষে খালাতো বোনের মিরপুরের বাসায় স্মরণসভার আয়োজন ছিল। ওই সভায় খালাতো বোন তার বক্তব্যে আমন্ত্রিত অতিথি ও সাংবাদিক ভাইদের বলছিলেন, আমার মা-খালা তিন বোনই ভাষাসৈনিক। আমি তখন পাশে বসা ছিলাম, কিছুই বলিনি। অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার মুহূর্তে খালাতো বোন তানভীর ওয়াহেদ তুনা কয়েকটি পেজের ফটোকপি ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও, এগুলো রাখো, এগুলো ডকুমেন্ট, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’
ফেরার সময় ওই কয়েকটি পাতার লেখা পড়ার পর আম্মার অবদানের কথা স্মরণ করে ছোট বোন সৈয়দা ফরিদা আক্তার সাকীসহ দুই ভাইবোন অটোরিকশায় বসে সারা পথ শুধু কেঁদেছি। বোনের অনুরোধেই পরে আম্মার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহে ছোটাছুটি করতে থাকি এবং একের পর এক তথ্য পেতে থাকি।
খালাতো বোনের দেওয়া সেদিনের ওই কয়েকটি পাতা পড়ে জানলাম, আম্মার কথা। সেই পাতাগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদের লেখা ‘সংগ্রামী সাত নারী’ বইয়ের। বইটিতে রওশন আরা বাচ্চুকে নিয়ে লেখা অংশে তার পরিবারের ও অন্য ভাইবোনদের উদ্ধৃতি ছিল, যেখানে বারবার উল্লেখ করা আছে আমার আম্মা ছালেহা বেগমের কথা। কৃতজ্ঞতা জানাই তাজুল মোহাম্মদ ভাইকে, তার ওই লেখার সূত্র ধরেই আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু। শুরু করলাম তথ্য খোঁজা, গুগল, উইকিপিডিয়া, সিলেটপিডিয়া, পুরনো লেখক, গবেষকদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা, বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি, আত্মীয়স্বজনদের কাছে দৌড়ানো ইত্যাদি। সব জায়গাতেই আম্মার ১৯৫২ সালের ওই ঘটনার সত্যতা পাই। একপর্যায়ে ছোট বোনকে নিয়ে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গেলাম ময়মনসিংহে। সহযোগিতা পেলাম হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার এবং সাংবাদিক আবু সাইদের ছোট ভাই জনি ও বিপ্লব বর্মণের, ভাতিঝি ডালিসহ অন্য অনেক শুভাকাক্সক্ষীর। তাদের মাধ্যমে পরিচিত হলাম বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আনন্দ মোহন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রনেতা কাজী আজাদ শামীমের সঙ্গে। এগিয়ে এলেন তিনি, তাকে নিয়ে গেলাম মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে। আমরা ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের সন্তানেরা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় তার বহিষ্কারাদেশ বাতিল (মরণোত্তর) চেয়ে স্কুলের অধ্যক্ষ এবং স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে স্মারকলিপি দিলাম। সেদিন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন আমাদের দাবি গ্রহণ করলেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। জানালেন, তিনিও শুনেছেন ছালেহা বেগম ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তবে ব্যাপারটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, এ ব্যাপারে এর আগে কেন কেউ কোনো কথা বলেননি বা তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেননি। এ বিষয়টি তিনি আরও অনুসন্ধান করবেন এবং স্কুল কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকার কাছে উত্থাপন করবেন। প্রধান শিক্ষক আরও জানালেন, যেহেতু ছালেহা বেগম জেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, অতএব যদি তাদের কাছ থেকে কোনো রকম লিখিত নির্দেশ আসে তাহলে তাদের স্কুল কমিটির পক্ষে ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা সহজ হবে।
পরদিন কাজী শামীম ভাইয়ের সহযোগিতায় আমরা স্মারকলিপি নিয়ে জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন লেখকের বইপত্র, পেপার কাটিং ইত্যাদি প্রমাণসহ জমা দিই এবং সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাদের যেহেতু স্কুলে কোনো রেকর্ড নেই এবং আমরাও সেই আদেশের কোনো কপি দেখাতে পারছি না, তাই ভাষা আন্দোলনের সময়ের কোনো জীবিত লোক বা চাক্ষুস সাক্ষী খুঁজে বের করতে বললেন, যা তার জন্য সহায়ক হবে। তিনিও তার কার্যালয়ের নথি তালাশ করবেন বলে জানান এবং এ ব্যাপারে ওপরমহলের নির্দেশের কথা জানালেন। পরে আমরা আমাদের এক মামা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন, তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি আম্মাকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন এবং ভাষার জন্য আম্মার শিক্ষাজীবনের শাহাদাতবরণের বিষয়টি জানতেন। মামা ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান সাহেবকে বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ করলেন। পরদিন আমরা গেলাম ময়মনসিংহে। ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে ‘ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগম স্মৃতি পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন ও ময়মনসিংহের স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, লেখক, সাংবাদিক, গবেষকসহ এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে বহু মানুষ সোচ্চার হন। তাদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আমরা ভাইবোন মিলে করোনাকালের দুর্যোগ উপেক্ষা করে স্মারকলিপি নিয়ে গেলাম বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসানের কাছে। তিনিও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিলের বিষয়টি আমলে নিলেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেন। অল্প কিছুদিন পরেই আমরা ডাকযোগে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনারের কাছ থেকে একটি চিঠির অনুলিপি পাই। সহকারী কমিশনার রূপম দাস স্বাক্ষরিত চিঠিতে মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সদস্য সচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী ছালেহা বেগমের স্কুল থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও আইনানুগ নিষ্পত্তির জন্য। এই চিঠির অনুলিপি পেয়ে আমরা যাই স্কুলে এবং দেখা করি প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তিনিও চিঠিটি পেয়েছেন। তার স্কুল কমিটি সভা করে যে সিদ্ধান্ত নেবে, তিনি সেই সিদ্ধান্ত প্রশাসনকে জানিয়ে দেবেন এবং এও জানালেন যে তাদের পুরনো রেকর্ড ১৯৮৪ সালে উইপোকা খেয়ে ফেলেছে। নষ্ট প্রায় কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সেদিন অল্প বয়স্ক এক তরুণ ইংরেজির শিক্ষক জানালেন, তিনি ’৪৭ সাল থেকে অদ্যাবধি স্কুল কমিটির যে বৈঠক হয়েছিল সব খুঁজে দেখেছেন; ছালেহা বেগমের নামে কোথাও কোনো সিদ্ধান্তের কপি পাওয়া যায়নি। তবে আরও কিছু পুরনো কাগজপত্র একটি আলমারিতে রাখা আছে, যা খুঁজে দেখা হয়নি। তিনি খুঁজে দেখে ব্যবস্থা নেবেন এবং বিষয়টি তাদের সময়ে নিষ্পত্তি করতে পারলে তা তাদের জন্য এবং স্কুলের জন্য গৌরবের হবে।
ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক, প্রতিভা মুৎসুদ্দি ও রাজিয়া হোসেইন, অধ্যাপক ড. মন্জুরুল ইসলাম, ড. আতিয়ার রহমান, ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, ড. এম ইলিয়াস, ড. শাহ এমরান, বুলবুল খান মাহবুব, ফরিদ আহম্মেদ দুলাল, হামিদুল আলম সখা, ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম, কাইয়ুম রেজা চৌধুরী, দীনা হক, চৌধুরী নুরুল হুদা, সৌরভ জাহাংগীর, লতিফুল বারী হামীম, ডা. লিমন প্রমুখ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
সৌদি আরবের আসির প্রদেশের আভা জেলায় বাস দুর্ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাগণকে আহত বাংলাদেশী নাগরিকদের চিকিৎসার সকল প্রকার উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
সৌদি আরবের জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের মতে, সোমবার সৌদি আরবের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় আসির প্রদেশের আভা জেলায় একটি ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় প্রায় ২৪ জন নিহত এবং প্রায় ২৩ জন আহত হয়।
বিকেল ৪টার দিকে আগাবত শার নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে যাত্রীদের অনেকেই বাংলাদেশী ছিলেন বলে জানা গেছে।
বাসটি ওমরাহ পালনরত হজযাত্রীদের নিয়ে পবিত্র নগরী মক্কায় যাচ্ছিল।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রেক সিস্টেমের ত্রুটির কারণে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায় এবং আগুন ধরে যায়।
স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কনস্যুলেট প্রতিনিধিকে জানিয়েছে যে, মৃতদেহ পুড়ে যাবার এবং বিকৃত হবার কারণে তাদের জাতীয়তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়েছে।
তাই, উল্লিখিত দুর্ঘটনায় কতজন বাংলাদেশি মারা গেছে তা হাসপাতাল বা ট্রাফিক সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’