একাত্তরের দলিলপত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরী। সেই গবেষণার সারকথা তুলে ধরেছেন তার সহ-গবেষক জাকির হোসেন তমাল। ছবি তুলেছেন সাহাদাত পারভেজ
স্কুলে যখন পড়ি, তখন জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছিলাম ইতিহাসের শিক্ষক হব, নয়তো গবেষণা করব। শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছেই তখন বেশি ছিল। ইতিহাসের প্রতি ভালোবাসা ছোটকাল থেকে। খুব মন দিয়ে পড়ালেখা করতাম। ইতিহাসের বইগুলোর প্রতি আগ্রহ বেশি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় একটি বিভাগেরই ভর্তি ফরম তুলেছি, সেই ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছি। এমএ পাসের পর চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। তখন বন্ধু মোর্শেদ শফিউল হাসান বলল, ‘তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের প্রকল্পে কাজ করছে তুমিও যাও।’ মোর্শেদের কথায় প্রকল্পের প্রধান কবি ও সাংবাদিক এবং একুশের সংকলনের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমানের কাছে গেলাম। তাকে সাংবাদিক হিসেবে চিনতাম। তিনি খুব সম্মানিত মানুষ। ১৯৭৩ সালে সরকারি ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক হিসেবে যে প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি সবার আরও পরিচিত ছিলেন। তার কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন কবি মাহফুজুল্লাহ। তিনি হাসান হাফিজুর রহমান ভাইয়ের হাত ধরে বললেন, ‘উনাকে একটি চাকরি দিতে হবে।’
হাসান ভাই খুব নরম মানুষ ছিলেন, আমারও চাকরি হয়ে গেল। হয়ে গেল মানে গবেষণা ‘প্রকল্পের সহকারী’ হিসেবে যোগদান করলাম। তখন কেবল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। গবেষণার কাজ শুরু হয়নি। প্রকল্পের কাজ শুরু করে আস্তে আস্তে প্রকল্পটি সম্পর্কে বুঝতে শুরু করলাম। লোক তখনও নেওয়া হয়নি, খণ্ড-কালীন আছেন। ছয় মাসের মধ্যে দেখা গেল, মোটামুটি প্রকল্পের কর্মী হিসেবে আমি পরিচিত হয়েছি। হাসান ভাই প্রকল্পের প্রধান, প্রধান কর্মী আমি। অবস্থাটি আমার জন্য খুব ভালো ছিল। আমি কাজ শিখতে পেরেছি, নানা ধরনের গবেষণার কাজ শিখতে ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানতে পেরেছি। হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গ, তার কাছে থাকা ও কাজ শেখার গুরুত্ব অসীম। এই জীবনেও কাজে লাগছে। একই সঙ্গে সরকার সম্পর্কে বুঝতে পেরেছি। সরকার যে সাধারণত কাজ বেশি করতে চায় না এবং যেকোনো অজুহাতে দেরি করতে চায়, কর্মপ্রক্রিয়া জটিল করতে চায়; সবই মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে বোঝা হয়েছে। এরপর প্রকল্পের অনুমোদন লাভ হলো, আমরা চাকরি পেলাম। তখন ওই চাকরি করি, টিউশনিও জীবন চালাতে। জীবনের দীর্ঘকাল এভাবে কেটেছে। পরে যখন দলিলপত্র নিয়ে সত্যিকার কাজ শুরু হলো, তখন সিনিয়র সবার চিন্তা ছিল ছয় খ-ের দলিলপত্র হবে। পরিকল্পনা করা হলো দুই খণ্ডে হবে ইতিহাস, চার খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের দলিল। কাজে খুব যুক্ত, পুরো কাজে প্রধান সঙ্গী বলে স্বাভাবিকভাবেই আমি একদিন হাসান হাফিজুর ভাইকে বললাম, ‘সরকারিভাবে যদি কোনো ইতিহাস লেখা হয়, সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের ইমেজের কারণে বিশ্বাস করবে না, বরং ঝামেলাই বাড়বে। তার চেয়ে আপনি ১৫ খণ্ডে দলিলপত্র বই আকারে করলে ভালো। ছয়, আট খণ্ড দলিলপত্র হবে। দলিলগুলোর মাধ্যমে আমাদের সাধারণ মানুষ ইতিহাস চর্চা করবেন। তিনি উত্তরে বললেন, ‘ঠিক আছে, প্রকল্পটির পরিকল্পনা প্রস্তাব তৈরি কর।’ আমাকে হাসান ভাই স্নেহ করতেন। কিছু আস্থা ছিল মনে পড়ে। আমি (আফসান চৌধুরী) ১৫ খণ্ডের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করলাম। মনে হয় জীবনে যদি কনক্রিট কোনো কাজ করে থাকি, তাহলে এই মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের প্রকল্প পরিকল্পনাগুলো তৈরি করেছি।
সরকারি প্রকল্পের বেশ জটিল কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। নিয়মের বেড়াজাল পেরিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে পাস করিয়ে এনে প্রকল্প আকারে তৈরি হলো। এ আমার জীবনের অন্যতম অর্জন বলে মনে করি। কারণ, ফলে আজ যে ১৫ খণ্ডের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা করতে এই সিরিজ বই ও গবেষণাগুলোই প্রধান দালিলিক সূত্র এবং প্রমাণ, তাতে আমার কিছু চেষ্টা ও কাজ আছে। এটাই জীবনের বড় পাওয়া।
প্রকল্পের কাজ শুরুর পর বিভিন্ন জায়গা থেকে দলিলপত্র সংগ্রহের কাজ শুরু করলাম। সংগ্রহ কর্মে গিয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হলো। কয়েকজন মানুষ নিজের থেকে দলিল দিয়েছেন, তার মধ্যে একজনের নাম বলতেই হয় আমাদের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি খুব সহায়তা করেছেন। এমন আরও অনেকে আছেন। নামের সারি দীর্ঘ হবে বলে বললাম না। একই সঙ্গে অনেকে সহায়তাও করেননি। যারা করেনি তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’। কথা দিয়েছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ষিত দলিলপত্র দেবে, কিন্তু পরে একটি দলিলও এই সংঘবদ্ধ, সশস্ত্র সংস্থা দেয়নি। বাংলাদেশের ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়’ মোটেও সাহায্য করেনি। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে খুব অদ্ভূতভাবে আমি দলিলপত্রের সন্ধান পেয়েছি। একদিন তাদের লাইব্রেরিতে গিয়েছি, দেখি, নতুন যারা অফিসার হয়েছেন, তারা লাইব্রেরিতে উঁচু এক বাক্সের ওপর পা রেখে গল্প করছেন। বললাম, ‘বাক্সে কী আছে?’ কেউ খুঁজে দেখেননি। ১৯৭৮ সালের কথা বলছি। তাদের একজন দয়াপরবশ হয়ে বললেন, ‘খুলে দেখতে হবে।’ লাইব্রেরিয়ানের কী মনে হলো, বাক্সটি খুললেন। দেখলেন, ‘মুজিবনগর’ থেকে আসা নানা পত্রিকার কাটিং। ভাবা যায় সাত বছর ধরে পড়ে আছে? কেউ জানেন না? বিসিএস অফিসাররা পা রেখে বসে আছেন! এই ছিল আমাদের কাজের সময়ের অবস্থা।
বাক্সের মধ্যে কিছু ফাইলও ছিল। আমি মনে করি, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওখানে লেখা ছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাবার্তা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা। এই ধরনের বিভিন্ন বিবরণ ছিল। আমি সেগুলো দেখে খুব উৎসাহ পেলাম এবং ওটা নেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখালাম। কাজ করতে করতে আমি বিসিএস ক্যাডার আমলাদের তখন বুঝি। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কিছু নিতে হলে নানা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়ার নিয়ম আছে। অনেকে তখন আমায় অনেক সহায়তা করে বাঁচিয়েছেন আমলাতন্ত্রের হাত থেকে। তাদের অন্যতম এমদাদুল হক, সিহাবুল ইসলাম। তাদের স্বাক্ষর নিয়ে ফাইল রেজিস্টার খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় পেয়েছি, এরপর আর ফাইল রেজিস্টার নেই। ফলে বললাম, ‘ফাইলগুলো গেল কোথায়?’ কেউ বলতে পারেন না। তারা খুব ভালো চাকরি করেন। প্রয়োজন বলে তিন-চারবার গেলাম। আমাকে দেখে তারা বিরক্ত হচ্ছিলেন। আউলা-ঝাউলা দেখতে, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা আমি এক তুচ্ছ মানুষ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই লোককে দেখে খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এক অফিসার বললেন, ‘আপনি যে দলিল খুঁজছেন, সেগুলো পাবেন না। কারণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মকর্তারা বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলো যদি প্রকাশ হয়ে যায়; তাহলে তাদের পোস্টিং পেতে অসুবিধা হতে পারে।’ পোস্টিংয়ের সমস্যা থেকে বাঁচতে তারা ফাইলগুলো লুকাচ্ছিলেন। আজ পর্যন্ত (৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯) ওই দলিলগুলো দেখিনি। কোথাও প্রকাশিত হয়েছে। হয়তো আছে, হয়তো নেই। এই আমাদের দলিলপত্রের অজানা ইতিহাস। আরও আছে।
আমি ও আমরা হন্যে হয়ে কাজ করেছি। মূল দলিলগুলো ছিল এমভি স্যান্ড্রা নামের জাহাজে (ভারত থেকে)। জাহাজটি চট্টগ্রামে নোঙর ফেলেছিল। তবে জাহাজের দলিলপত্র কোথায় গিয়েছে, কেউ বলতে পারেন না। ১৫ খণ্ডে দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে (মুজিবনগর সরকার) নিজে কাজ করেছি। দলিলগুলো কপাল জোরে পেয়েছি। একদিন একজন খবর দিলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে গেলে স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র পাওয়া যেতে পারে। গিয়ে দেখলাম, কিছু দলিলপত্র আছে। বাক্সগুলো পর্যন্ত দেখতে পারলাম। তিন-চারটি বাক্স খুব নোংরা হয়ে পড়ে আছে। বললাম, ‘ভাই এই দলিলগুলো আমাদের প্রয়োজন বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বার্থে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র একসঙ্গে সঠিকভাবে তুলে রাখছি।’ তারা বললেন, ‘এই দলিলগুলো নেওয়ার জন্য চিঠি (অনুমোদনপত্র) দিতে হবে’, কিন্তু আমি তো এই কাজে খুব ব্যস্ত। সময় কীভাবে বের করে তাদের আমলাতন্ত্রের পেছনে ঘুরব? হাসান ভাইয়ের শরীর ভালো নেই। অন্যরাও ভালো চাকরি করেন। তাদের কাজ আছে, সবাই নামকরা। ফলে এক কাজ করলাম। কপালের ফেরে জানলাম, তখন সচিব আমার স্ত্রীর ফুফাতো কী চাচাতো এক ভাই। তার পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘তিনি আমার স্ত্রীর বড় ভাই।’ মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, বাংলাদেশ কোনো কাজে না দিলেও আমি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মহাগুরুত্বপূর্ণ সচিবের বোনের জামাই, সঙ্গে সঙ্গে কাজে দিল। তারা বললেন, ‘ও তাই, সাদেক সাহেব আপনার আত্মীয়?’ বললাম, ‘জ্বি।’ তারা এই কারণে দলিলগুলো আমাকে দিতে রাজি হলেন। আর ওপরের কোনো অফিসারের কাছে তাদের কাউকে যেতে হলো না। নিচের দিকের কর্মকর্তারাই দিয়ে দিলেন। নাচতে নাচতে দলিলগুলো নিয়ে চলে এলাম। আরও দুটি ভালো সংগ্রহ করেছি দুই জায়গা থেকে একটি বাংলা একাডেমি। আশ্চর্য হলেও সত্য, বাংলা একাডেমিতে রক্ষিত দলিলপত্র সংগ্রহ করতেও খুব অসুবিধা হয়েছে। তখন বাংলা একাডেমিতে দেখেছি, এক আলমিরা ভর্তি মাথার খুলি। কেন সেখানে আলমারি ভর্তি মাথার খুলি, কার আজও জানি না। প্রথমে তারা তাদের দলিলগুলো দিতে চাননি, কিন্তু হাসান ভাই বাংলা একাডেমির সদস্য তখন। তাকে গিয়ে জানিয়ে দিলাম, ‘আপনি বাংলা একাডেমিকে বলুন তারা তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রকল্পের কাজ করছেন না, আমরাই করছি। ফলে সংগ্রহ আমাদের দিয়ে সাহায্য করুক। সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কাজে সাহায্য করা হবে।’ তিনি অনুরোধ করলেন এবং তার কথায় বাংলা একাডেমি রাজি। দলিলগুলো আমাকে দেওয়া হলো। মনে আছে, বাবার গাড়িতে চড়ে দলিলগুলো নিয়ে এসেছি। যেমন অষ্টম খণ্ডে, দশম খণ্ডে আছে। এভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা দলিলগুলো পেয়েছি।
আরেক দলিল, আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সালের এই অংশের দলিলাদি। সরকারের যে গোপনীয় দলিলগুলো ছিল, সেগুলো একটি জায়গায় ছিল। কলিমদাদ খান, ভদ্রলোক ও ডেপুটি ডিরেক্টর। হাসান ভাইকে বললেন, ‘এই দলিলগুলো আছে।’ আমরা তখন তাদের কাছে গেলাম, আমি যেহেতু গবেষণা কর্মকর্তা, আমার সঙ্গে তাদের ভদ্র ব্যবহার করার কোনো কারণ নেই। আমায় তারা বললেন, ‘না, না, এগুলো দেওয়া যাবে না। আপনারা নিতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে।’ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখলাম। আমার নামেই চিঠিটি তাদের বরাবরে লিখেছিলাম। সেই ক্ষমতা দিয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান ভাই। সেখানে লিখেছিলাম, ‘দলিলগুলো এখানে আছে জেনেছি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার কাজে আমাদের দেওয়ার জন্য চিঠিতে অনুমতি দেওয়া হোক।’ মন্ত্রণালয় থেকে সাত দিন পর উত্তর এলো, ‘আপনার চিঠি আমরা পেয়েছি, কিন্তু কোনো আইন নেই এমন যে, দলিলগুলো আপনাদের দিতে হবে। নিজেদের চেষ্টায় জোগাড় করতে পারলে করুন।’ চিঠি পেয়ে খুব খুশি হয়ে গেলাম। কারণ এই চাইছিলাম। আমি তো জানি, এর চেয়ে ভালো উত্তর আসবে না। তখন যে অফিসে দলিলগুলো আছে, তাদের চিঠি লিখলাম, ‘আপানাদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বলেছিলেন, মন্ত্রণালয়ের চিঠি লাগবে। এই বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে এত তারিখে চিঠি দিয়েছি। মন্ত্রণালয় আমাকে উত্তর দিয়েছেন। ভাইড নম্বর এত এত। দয়া করে আমাকে দলিলগুলো দিন।’ সরকারি কাজে লেটার নম্বরের গুরুত্ব কল্পনা করা যাবে না। তবে আমাকে চিঠিতে দলিলগুলো দিতে মন্ত্রণালয় না বলেছে, সে বিষয়ে আমি ভুলেও কিছু উল্লেখ করলাম না। চিঠি নিয়ে সেখানে গেলাম। তারা বললেন, ‘আবার এসেছেন? কী চান?’ হাবিবুর রহমান ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন, কাগজটি দেখলেন। সবাই বললেন, ‘ওই যে ভাইড লেটার নম্বর আছে।’ দেখে তারা দলিলগুলো দিয়ে দিলেন।
দুটি রিকশায় আড়াইশ দলিল বগলদাবা করে নিয়ে এলাম। অসাধারণ দলিলপত্র সব। কত যে তথ্য পেয়েছি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এমনও তথ্য পেয়েছি যেগুলো কেউ আগে জানতেন না। সুযোগই ছিল না। ‘ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন পার্টি’, মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের মূল্যায়ন, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার কী ভাবছেÑসবকিছু দলিলগুলোতে আছে। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের (প্রথম নাম) প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে অনেকগুলো স্থান পেয়েছে। এই আমাদের দলিল সংগ্রহের কটি ঘটনা।
দলিল সংগ্রহে আমার আগ্রহ ও উৎসাহ অনেক বেশি ছিল বলে দুই ভদ্রলোক কাছে এসে দলিল দিয়ে গেছেন। একজন মোস্তাক সাহেব, চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ। অনেক দলিল দিয়েছিলেন। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রক্ষিত ছিল। আরেকজন বাংলার অধ্যাপক সাঈদুর রহমান। তিনি অনেক দলিলপত্র দিয়েছিলেন। প্রথম দুই খণ্ডে অর্থাৎ বাংলাদেশ তৈরির পটভূমির ইতিহাসে এগুলো কাজে লেগেছে। দলিলগুলো সংগ্রহের পর আমাদের কাজ শুরু হলো। কাজ আসলে সঠিকভাবে সন্নিবেশ। আমাদের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ দলিলগুলো সংগ্রহ করে প্রামাণ্যকরণ কমিটির হাতে দেওয়া। কমিটিতে ছিলেন বিখ্যাত শিক্ষক, নামকরা ইতিহাসবিদ। জাতীয় অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ, ড. আনিসুজ্জামান, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ড. এনামুল হক, ন্যাশনাল আর্কাইভসের ড. এ কে এম করিম, ড. সফর আলী আকন্দ, ড. কে এম মোহসিন, ড. শামসুল হুদা হারুন, মাহফুজুল্লাহ কবীর। তাদের কাছে দলিল সংগ্রহ করে জমা দিতাম, তারা দেখতেন, ব্যবহার করা যাবে কি না।
প্রথম খণ্ডে এক বছরের বেশি কাজ করেছি। প্রথম দুই খণ্ডের কাজ দেখার জন্য আনিসুজ্জামান স্যারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তাকে ধন্যবাদ দেই, প্রাপ্তির কোনো বিষয় ছিল না, তারপরও তিনি খুব করে কাজ করেছেন। তৃতীয় খণ্ডে একটি দলিল আছে, শেখ সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণা। আমরা পেয়েছিলাম একটা জায়গা থেকে, সেটা ছিল অফিসিয়াল দলিল। এই কারণে, সরকারি মালিকানার এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। (তখন পরিস্থিতি সরকারের এমন যে, আমাদের সবাই ভাবছেন, নেওয়া ঠিক হবে কি না? তখন মাহফুজুল্লাহ কবীর বলেছেন, আমাদের কাজ দলিলগুলো ঠিক কি না, দেখা। অতিরঞ্জিত করা নয়। আমরা বলিনি যে, শেখ সাহেব মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা করেছেন। তার নামেই ঘোষণা হয়েছিল। ভাষা যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ। শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন তার চিহ্ন হিসেবে রইল। সালাহউদ্দিন স্যার সেদিন ছিলেন, একটি দলিল নিয়ে অনেকেই আপত্তি করেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার পরে মওলানা ভাসানীর সাত দফা নাকি ১৪ দফা। অনেকে বলেছেন, প্রকাশ করলে শেখ মুজিবের গুরুত্ব কমে যেতে পারে। সালাহউদ্দিন স্যার মওলানাকে পছন্দ করতেন না। তারপরও বললেন যে, আমাদের কাজ নয় এই যে, কে পছন্দ করবেন, কোন দফা কে গুরুত্ব দেবেন। আমাদের দেখতে হবে, দলিলটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কি না? যদি তাই হয়, তাহলে স্থান দিতে হবে। আজকের লাইনবাজ, দলবাজ, রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদরা তখন ছিলেন না। কী অসাধারণ মান ও গুণের মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি আমার কাছে তার মূল্য খুব বেশি। তাদের রাজনৈতিক সত্তা ও সমর্থন থাকলেও কোনোবারই, কোনো কাজেই ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দ, রাজনীতিকে সামনে আনতে কোনোদিন দেখিনি।
এমফিলের জন্য আবেদন করলাম। এক বছর পড়তে হলো। থিসিস সুপারভাইজর অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দিন আহমদ। তার অধীনে পরীক্ষা দিয়ে ৭৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছি। মনে আছে, কারণ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এত নম্বর ওঠে না সাধারণত। তিন কি সাড়ে তিন ঘণ্টার ভাইভা চা খেতে, খেতে। ভাইভা দিতে দিতে এক পর্যায়ে দেখলাম, আমার জ্ঞানের ভাণ্ডার শেষ হয়ে গিয়েছে। বললাম, ‘স্যার বহুত হইছে, আর আমি জানি না। এবার বন্ধ করেন।’ স্যাররা খুব খুশি হয়েছিলেন, আমাকে পিএইচডিতে ট্রান্সফার করে দিলেন।
ততদিনে চিন্তা-ভাবনা পাল্টাতে শুরু করেছে। দেখতে পাচ্ছি, দলিলভিত্তিক ইতিহাসের সীমাবদ্ধতা প্রচুর। যিনি লিখেছেন, নিজের মতো করে দলিল তৈরি করেছেন। ভেবেছেন, এই গ্রহণ করা হবে। আবার ইতিহাসে সাধারণ মানুষকে পাইনি। আমায় পীড়া দিচ্ছিল। পিএইচডির এক বছর পর, আমার সঙ্গে পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছিলেন অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। সালাহউদ্দিন স্যার বুঝতে পারছিলেন, আমার আগ্রহ কমছে। একসময় বললাম, ‘স্যার, পিএইচডি করব না।’ বুঝে গিয়েছি পিএইচডি কী? পিএইচডি খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু আমার বিদ্যাচর্চা এভাবে, এতে হচ্ছে না। যে বিদ্যা চর্চার মাধ্যমে পিএইচডি করছি, তাতে আমার আস্থা কমেছে। শুনে স্যার খুব কষ্ট পেলেন। খুব ভালোবাসতেন।
সরে এলাম। ততদিনে সন্ধান শুরু করেছি মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের ইতিহাস। এই কাজে বারবার মনে হয়েছে, দলিলে প্রায় কিছুই থাকে না। দলিলে মানুষ আসল কথা বলেন না, দলিলে পাওয়াও যায় না। এই অবস্থায় সাংবাদিকতা শুরু করলাম ১৯৮৪ সালে। তবে সে কথা নয়; মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কথা বলি।
ইতিহাসে আমরা সাধারণ মানুষ, নারীর কথা চিন্তা করি না। একজন নারীর ইতিহাস লিখতে চান বলেছেন, আমি বলছি, মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ডের দলিলপত্রে নারী নেই। দলিলভিত্তিক ইতিহাসে নারীর অবস্থান থাকে না। দালিলিক ইতিহাসের প্রতি আমার আস্থা অনেক কমে গেল। ফলে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ছেড়ে সাংবাদিকতায় পুরো চলে এলাম, কিছুদিন পর জাতিসংঘে কাজ করতে চলে গেলাম। বড় ধরনের সুবিধা হলো সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াবার সুযোগ হলো। বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ায় সরাসরি সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। সুবিধাও ছিল। খেয়াল করলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভীষণ অসম্পূর্ণ। এতটাই যে, ইতিহাস হিসেবে চালানোই আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে জাতিসংঘের চাকরি ছাড়লাম ১৯৯৩ সালে। প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের কাজ করতে লাগলাম। বই হয়েছে দু-একটি। প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চা থেকে বেরিয়ে আবার সাংবাদিকতায় গেলাম। ১৯৯৩ সালে বিবিসিতে কাজ শুরু করলাম, তখনই প্রথম সাধারণ মানুষ নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেলাম। বিবিসির জন্য পাঁচ-ছয়টা রেডিও সিরিজ করতে পেরেছি। সেগুলো জীবনের জন্য খুব বড় অর্জন। যেমন ‘নারীর একাত্তর’ সিরিজ আমি প্রথম করেছি বিবিসি রেডিওতে। সোহাগপুর থেকে সব তথ্য, উপাত্ত ও প্রমাণ আমরা নিয়ে এসেছি। তাতে নারী বলতে শুধু বাংলাদেশের নারী বোঝানো হয়নি, বিহারি নারীদের ইতিহাসও উঠে এসেছে। তাদের কী অবস্থা ছিল একাত্তরে, তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তখন ‘শিশুদের একাত্তর’ সিরিজ আমি করেছি। খুব মজার ছিল, ওরা কী ভেবেছে একাত্তরের দুঃসহ দিনগুলোতে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও জীবিকা নিয়ে কাজ করতে করতে ২০০০ সালের দিকে ‘বাংলাদেশ একাত্তর’ প্রকল্পে কাজ শুরু করলাম। বিবিসির সাবির মোস্তফা বলল, ‘শুরু করেন।’ ডেইলি স্টারে চাকরি করতাম। চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে বিবিসির কাজ শুরু করলাম। এই কাজে ভারতেও গিয়েছি। বিবিসিতে খুব লাভ হয়েছে এই, বহুজন আমার সঙ্গে কথা বলেছে। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে কাজ করতে গিয়ে যেমন অফিসিয়াল দাগ ছিল, সেটায় যেমন সুবিধা হয়েছে; তেমন বিবিসিতে কাজ করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গের সুবিধা হয়েছে। তখন তথ্যগুলো পাচ্ছি, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি। ২০০২ সালে বিবিসির সিরিজটি তৈরি করে ডেইলি স্টারের চাকরি ছেড়ে দিলাম। ওই সিরিজটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এখনো মাঝে মাঝে অনেকে বাজান। জীবনের আরেক বড় অর্জন। ২০০২ সালে ব্র্যাকে চাকরি শুরু করলাম। সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার আরও বড় দরজা খুলে গেল। তারা যেহেতু গ্রাম পর্যায়ে কাজ করেন, আমিও গ্রামে যাওয়া শুরু করতে পারলাম। যে প্রকল্পের সঙ্গে ব্র্যাকে ছিলাম, কাজ ছিল গ্রামে। কেবল নিজে কাজ করিনি, অন্যদের নিয়েও কাজ করেছি। তথ্য সংগ্রহ করতে করতে ২০০২ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে কাজগুলো নিয়ে সম্পাদনা করলাম ও প্রকাশ হলো ‘বাংলাদেশ একাত্তর’ চার খণ্ডের বই। ২০২০ সালে বইটি আবার সম্পাদনা করে ফের প্রকাশ করার কাজগুলো হচ্ছে।