ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে আবারও সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত রবিবার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, দোকানপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের করিমপুরের মাঝিপাড়ার ২৫টি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। লুটপাট চালিয়েছে অন্তত ৫০ বাড়িতে। এতে হতাহতের কোনো ঘটনা না ঘটলেও হামলাকারীদের ভয়ে ধানক্ষেতে কিংবা জঙ্গলে রাত কাটায় মাঝিপাড়ার বাসিন্দারা। পুলিশের ধারণা, একটি ভুয়া আইডি থেকে পোস্ট দিয়েই এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ ঘটনায় একটি মামলা হওয়ার কথা জানিয়ে পুলিশ বলেছে, তারা ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, গত রবিবার রাতে একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে করিমপুর গ্রামে উত্তেজনা তৈরি হওয়ার খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং জনপ্রতিনিধিরা সেখানে যান। পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার মধ্যেই হামলা ও লুটপাট শুরু হয়। কয়েক ঘণ্টা পর র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে দমকল বাহিনী যতক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ততক্ষণে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায় অনেকের।
রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, প্রশাসন সতর্ক থাকায় হামলাকারীরা বড় কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তিনি বলেন, দুর্গাপূজায় বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায় আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক ছিলাম। তাই আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারেনি দুষ্কৃতকারীরা।
তবে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, তারা সব হারিয়েছেন। এখন খাবার মতোও কিছু নাই। রবিবার রাতের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা সাংবাদিকদের শুনিয়েছেন ওই গ্রামের ননী গোপাল, উজালী রানী, মিনতি রানী, দেবদাস রায়সহ অন্তত ১০ জন। করিমপুরের কৃষক ননী গোপাল বলেন, ‘আমি চার সন্তান নিয়ে বাড়িতে বসবাস করি। রবিবার রাত ৮টায় শুনতে পেলাম পাশের গ্রামে একটি হিন্দুবাড়ির খড়ের গাদায় আগুন দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পুলিশ, চেয়ারম্যান গাড়িতে করে ছুটে যান সেখানে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। পুলিশ যাওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। এরপর শত শত মানুষ আমাদের গ্রামে এসে একটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমার পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে আগুন দেয়।’
ওই গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী গোপাল বলেন, ‘আমি প্রাণভয়ে আমার ছোট ভাইয়ের বাড়িতে পালিয়ে যাই। দূর থেকে দেখেছি আমার বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ঠেকানোর মতো উপায় নেই। এখন আমার আর কিছুই নেই। খাবার নেই, কাপড় নেই। কী দোষ করেছিলাম আমরা?’
উজালী রানী বলেন, ‘আগুনে আমার সব পুড়ে গেছে। এর ক্ষতিপূরণ সরকারও দিতে পারবে না। আমি এর বিচার চাই।’
রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আদলে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ওই গ্রামে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই সবকিছু পুড়ে যায়।
জেলার সহকারী পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ভালোবাসার প্রস্তাব নামে একটি ফেইসবুক আইডির প্রোফাইল ফটোতে কাবা শরীফের ছবি ছিল। সেখানে একটি কমেন্ট করা হয়। তার জেরেই এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এটা ফেক আইডি হবে বলে আমরা ধারণা করছি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ফেইসবুকে ধিক্কারজনক একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে ৩টি গ্রামে নৃশংস ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে। অসংখ্য দুষ্কৃতকারী নাশকতা চালিয়েছে। প্রায় তিনশ মানুষ মাঝিপাড়ায় সমবেত হয়েছিল। তারা মুহূর্তের মধ্যে গ্রামে পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করেছে। পেট্রোল ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি আমরা মনে করছি সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।
একই কথা বলেন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ শফিউর রহমান মিলন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যারা হামলা চালিয়েছে তারা পরিকল্পিতভাবেই চালিয়েছে। আগে থেকেই তারা বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। এজন্য আলোচনার মধ্যেই হঠাৎ হামলা শুরু হয়েছে।’
তবে এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে উল্লেখ করে মিলন বলেন, র্যাব-পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষায় এলাকাবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করেছে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের নানা ধরনের সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঘটনাটিকে অনাকাক্সিক্ষত উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর তৈরি করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রংপুরের পীরগঞ্জে ২৫টি বাড়িতে আগুন, ৯০টির বেশি বাড়িঘর লুটপাট এবং ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের বাড়িঘর তৈরি করে দেওয়া হবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রংপুরের পীরগঞ্জে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছায় দিক বা অনিচ্ছায় বা কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হোক স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় সবাই কষ্ট পেয়েছে।
তবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের ভাষ্য, পীরগঞ্জের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। কুমিল্লায় বুধবারের ঘটনার পর থেকে দেশের ২০টি জেলায় যেসব হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে পীরগঞ্জের ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা। তিনি বলেন, ‘সারা দেশেই হামলাকারীদের টার্গেট হলো মন্দির, মণ্ডপ এবং ঘরবাড়িতে হামলা, আগুন দেওয়া, দোকানপাট লুট করা।’
গত বুধবার দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লা শহরে একটি পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর সেখানে হামলা হয়। এরপর টানা তিন দিন নোয়াখালী, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। পীরগঞ্জের আগে সর্বশেষ শনিবার ফেনীতেও সংঘর্ষ হয়েছে। এসব হামলা-সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অন্তত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।