বহুল প্রচলিত খনার বচন ‘যদি বর্ষে আগনে-রাজা যায় মাগনে।’ অর্থাৎ যদি অগ্রহায়ণ মাসে বৃষ্টিপাত হয় তাহলে দুর্ভিক্ষে রাজাকে ভিক্ষা করতে হয়। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের কারণে শীত মৌসুমে তিন দিন ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে এমনই অবস্থা দাঁড়িয়েছে দেশজুড়ে। নিচু জমিগুলোতে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। বৃষ্টিতে শীতকালীন শাকসবজি, আমন ধান ও বোরো ধানের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর :
ফরিদপুর : বিখ্যাত মুড়িকাটা পেঁয়াজের জমিগুলো এখন বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত। কৃষি বিভাগ বলছে, প্রাথমিক তথ্যমতে, জেলায় চলতি মৌসুমের ২০ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। চলতি মৌসুমে এ জেলায় মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে পাঁচ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে। চাষিরা এখন ক্ষেত থেকে সেই পেঁয়াজ ঘরে তোলার অপেক্ষায়। কিন্তু হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে গত দুদিন টানা বৃষ্টিতে এখন মাথায় হাত তাদের।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক ড. হযরত আলী বলেন, ধারাবাহিক বৃষ্টিতে জেলার ২০ হাজার হেক্টর জমি নিমজ্জিত হয়েছে।
দাউদকান্দি (কুমিল্লা) : তিন দিনের বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন দাউদকান্দির কৃষকরা। টমেটো, খিরা, আলুসহ শীতকালীন নানা সবজি নিয়ে চাষিরা বিপাকে পড়েছেন বেশি। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় আবাদি জমির গাছ নষ্ট হয়েছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে যারা আলুর বীজ রোপণ করেছিলেন তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ইরি বোরো ধানের বীজতলা, করলা, ধনিয়া, মুলা, লালশাক, মরিচ, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টামটা গ্রামের শাহনেওয়াজ, জয়নাল খাঁ ও আবুল কাসেম বলেন, আমাদের স্বপ্ন এখন পানির নিচে ডুবে আছে।
চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) : বৃষ্টিপাতে আমন, বোরো, আবাদি শাকসবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত রবিবার সকাল থেকে বৃষ্টিতে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। টানা বৃষ্টিতে সড়ক-মহাসড়ক, বাজার-ঘাটে মানুষের চলাচল কমে যায়। বন্ধ রয়েছে ইটভাটার হাজার হাজার শ্রমিকের কাজ। এতে করে বিপাকে পড়েছেন চৌদ্দগ্রামে কাজ করতে আসা উত্তরাঞ্চলের হাজারও শ্রমিক এবং স্থানীয় নিম্ন আয়ের মানুষ।
মাদারীপুর : জেলায় ১০ হাজার হেক্টর আবাদি জমির রবি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’র প্রভাবে মাদারীপুর ভারী বর্ষণ হয়েছে। বৃষ্টিতে কৃষকের পাকা আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। অধিকাংশ কৃষকের ধান বৃষ্টিতে ভিজে জমিতে নষ্ট হচ্ছে। এ অর্থবছরে রবি মৌসুমে জেলায় ৪৫ হাজার ১০৯ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফসল বপন করা হয়। এর মধ্যে ১০ হাজার ৪২৬ হেক্টর জমির রবি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শিবচর (মাদারীপুর) : শিবচরে অন্তত চার হাজার হেক্টর আবাদি জমির ফসল বৃষ্টিতে ভিজে বিনষ্ট হয়েছে। নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসলের মধ্যে রয়েছে বোরো ধান, সরিষা, মসুর, মাসকলাই, পেঁয়াজ, রসুন, খেসারি, গম, ধনিয়া, আলু, ভুট্টা, মরিচ, কালোজিরাসহ বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজি। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন স্বল্প আয়ের কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে গত ৫ ডিসেম্বর ২৭ মিলিমিটার ও ৬ ডিসেম্বর ৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীর পানির বৃদ্ধি পেয়ে ফসলের মাঠে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের রবি মৌসুমে উপজেলায় ১৫ হাজার ৯২৪ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করা হয়। কৃষি অফিসের মাঠকর্মীরা ক্ষতি নিরূপণ করতে মাঠে রয়েছেন।
চরজানাজাত এলাকার কৃষক নওয়াব আলী বলেন, তিন বিঘা জমিতে ছোলা চাষ করেছিলাম। অসময়ের বৃষ্টি দিয়েছে সব বরবাদ করে।
দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি) : শীত মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে শীতকালীন শাকসবজি এবং আমন ও বোরো ধানের বীজতলা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীঘিনালার মাইনীমুখ নদীর দুই তীরে প্রচুর পরিমাণ শীতকালীন শাকসবজি চাষ করা হয়। প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার এখনো না কাটা আমন ধান, শীতকালীন শাকসবজি ও বোরো ধানের বীজতলায় পানি জমে গেছে।
দীঘিনালা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, উপজেলায় ৩০ হেক্টর পাকা আমন হেলে পড়ে নিমজ্জিত হয়েছে। শাকসবজি ক্ষতি হয়েছে ৯৮ হেক্টর জমির এবং তিন হেক্টর জমির বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়েছে।
সিংগাইর (মানিকগঞ্জ) : বৃষ্টি আর বাতাসে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে সরিষাসহ অন্যান্য রবি শস্য ও শাকসবজির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জমিগুলো এখনো তলিয়ে আছে পানির নিচে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সদ্য বেড়ে ওঠা সরিষা গাছগুলো মাটিতে নুয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে আলুসহ অনেক শাকসবজির জমি। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন হাজারও কৃষক। স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে শতাধিক মৌয়ালের মৌ-চাষ।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, টানা বৃষ্টিতে উপজেলায় ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।