গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ওপর তদন্তের নামে পুলিশ চাপ প্রয়োগ এবং হয়রানি করছে বলে অভিযোগ করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে ‘গুমের শিকার ভিকটিম পরিবারগুলোর প্রতি শুরু হওয়া পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ অভিযোগ করেন।
সংগঠনের সমন্বয়ক ও নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান। এছাড়া, ঘটনার তদন্তে জাতিসংঘের কমিটিকে আসতে দেয়ারও দাবি জানানো হয়।
সম্প্রতি যাদের বাড়িতে পুলিশ গেছে বা যাদের থানায় যেতে হয়েছে বা পুলিশের লিখে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করার জন্য চাপের মুখে পড়তে হয়েছে, তারাই এই সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।
এদিকে সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে সেখানে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া শাখার সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হন। মায়ের ডাকের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও সেখানে পুলিশ সদস্যদের স্বাগত জানান। পরে পুলিশ ভুক্তভোগীদের বক্তব্য রেকর্ড করেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নও করেন।
নিখোঁজ স্বজনদের ছবিসহ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন ভুক্তভোগীরা। কারও কাছে সন্তানের ছবি, কারও বুকে বাবার এবং আবার কারও বুকে ভাইয়ের ছবি ছিল। অনুষ্ঠানে নিজেদের দুঃসহ কষ্টের কথা তুলে ধরেন তারা। নিখোঁজদের কারও সন্তান, মা, কারও বোন ঘটনার বর্ণনা দেন।
কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বাতেন তিন বছর ধরে বাড়ি ফেরেন না। র্যাব-৪ তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে পরিবারের অভিযোগ। বাতেনের স্ত্রী নাসিমা আক্তার বলেন, স্বামীর খোঁজে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তিন বছর পর এখন পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করছে, ইসমাইল সত্যিই গুম হয়েছেন কি না।
২০১৯ সালের ১৯ জুন ইসমাইল হোসেন বাতেন নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তার স্ত্রী নাসিমা আক্তার সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কী আচরণের মুখোমুখি হয়েছেন, তার বিবরণ দেন। নতুন করে পুলিশি তৎপরতার কী কারণ, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। নাসিমা আক্তার বলেন, ‘কিসের পুলিশ? আমি থানায় গেছি, পুলিশ আমাকে থানা থেকে বের করে দিয়েছে। পুলিশের ডিসি আমার চিঠিটা একবার পড়ল না। বলে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আপনি র্যাবের কাছে যান। পুলিশ এখন তিন বছর পর এসে জিজ্ঞেস করে আমার স্বামী আসলে গুম হয়েছে, নাকি কোথাও চলে গেছে। আমাদের কষ্ট লাগে, ঘেন্না আসে এখন।
তিনি বলেন, মন্ত্রীরা আরামে বসে থাকে, আমাদের বিরুদ্ধে যখন কথা বলে, হেলেদুলে বলে- ‘আরে না। বাংলাদেশে কখনো গুম হয় না। উনারা ঋণের দায়ে চলে গেছে, বিয়ে করেছে।’ এটা কতটা লজ্জার! আমার মনে হয় না সমাজে শ্বাস নিই। আমাদের এখন মেরে ফেলেন। তারা আমাদের চোখের পানি নিয়ে হোলি খেলে। উপহাস করে। আমার ঘরে কোনো উৎসব হয় না। আমার বাচ্চারা কখনো হাসে না।
স্বামীর সন্ধান চেয়ে এই নারী বলেন, বলেন কোথায় রেখেছেন। লাশটা দেন। আমরা কি কোনো দিন একটা মিলাদ পড়তে পারব?
মায়ের ডাকের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম বলেন, তদন্ত করলে সাধুবাদ জানাই। আপনারা জাতিসংঘকে কাগজপত্র পাঠাতে চান বলেছেন। আমরা আমাদের স্বার্থেই সহযোগিতা করব। কিন্তু আপনারা এই যে হাফ উইডোদের (প্রায় বিধবা) কখনো দিনে কখনো রাতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। দুই ঘণ্টা আটকে রেখেছেন। তারা ভীতির মধ্যে আছেন। তাদের ফিরে পেতে যা যা করতে হয়, মানবিকতার সঙ্গে করেন।
নিজের ভাই গুম হওয়ার পর তারা কি কি করেছেন তা তুলে ধরে আফরোজা ইসলাম বলেন, পুলিশ এখন বলার চেষ্টা করছে যে জিডির কপিতে তথ্য গোপন করা হয়েছে। স্বজনেরা যখন গুম হন, তখন পুলিশ মামলা বা থানায় সাধারণ ডায়েরি নিতে চায়নি। তার ভাই সাজেদুল ইসলাম গুম হওয়ার পর তারা ভাটারা থানায় গেলে পুলিশ বলেছে তেজগাঁওয়ে যেতে, তেজগাঁওয়ে গেলে বলেছে উত্তরায় যেতে হবে। ছয় সাতজনের সামনে থেকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে এই কথা বললে আর জিডি করা যায়নি। বলা হয়েছে, বাসায় ফেরেনি, খুঁজে পাওয়া যায়নি এভাবে লিখতে। এসব কথা আগেও অজস্রবার বলা হয়েছে। এখন নতুন করে ধানাইপানাই করা হচ্ছে যে তথ্য গোপন করা হয়েছে।
কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ বংশাল থানা ছাত্রদল সভাপতি পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, তিনি এখন সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। কয়েক দিন আগে পুলিশ স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে বংশালে তার শ্বশুরবাড়িতে যায়। তার শাশুড়ির ফোন থেকে তাকে ফোন দেয় এবং দেখা করতে বলে। ঢাকায় ফিরে তিনি পুলিশকে খবর দেবেন। তাদের যা যা তথ্য লাগে, সবই জানাবেন। তখন ওই পুলিশ সদস্য তাকে একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করতে বলেন। এমনকি ওই পুলিশ সদস্যরা পারভেজ হোসেনের মাকে বলেছেন, ফারজানা জানেন তার স্বামী কোথায়। তিনিই লুকিয়ে রেখেছেন। ফারজানার প্রশ্ন, তিনি লুকিয়ে রাখলে পুলিশ কেন খুঁজে বের করতে পারছে না?
লক্ষ্মীপুর থেকে হারিয়ে যাওয়া বিএনপির সদস্য আলমগীর মোল্লার বাবা শাহজাহান মোল্লা বলেন, গত ১০ জানুয়ারি থেকে তাকে কয়েকবার থানায় যেতে হয়েছে। তার ছেলের সঙ্গে কী ঘটেছিল, সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে পুলিশ। বেশ কয়েকটি অনুলিপি তিনি দেখেছেন। কিন্তু তিনি যে কাগজে স্বাক্ষর করেছেন, তার একটি অনুলিপি চাইলেও পুলিশ দেয়নি।
একই জেলার বাসিন্দা ফরিদ আহমেদের বোন শিল্পী বলেন, তাদের বাসায় পুলিশ কয়েকবার গেছে। কাগজপত্রে তার, স্বামীর ও মায়ের সই নিয়েছে। ঢাকা থেকে গুম হওয়া আবদুল কাদের মাসুমদের বাসায় পুলিশ তিনবার গেছে। প্রতিবারই একই কথা জিজ্ঞাসা করেছে তারা।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘পুলিশ কাগজে লিখিয়ে নিতে চান, উনি হারিয়ে গেছেন। পুলিশ কাগজে সই নিয়ে করবে কি? তারমানে কাগজ তাদের (পুলিশ) কোথাও দেখাতে হবে, 'আমরা কিন্তু গুম করিনি, এটা ওনারই দোষ'।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গুম হওয়াদের খুঁজে না বের করে বরং তাদেরকে নানাভাবে পুলিশি হয়রানি করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন অধিকারের পরিচালক নাসিম উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম প্রমুখ।