শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক ধসের পেছনে জৈবিক চাষের ভূমিকা দেখছেন অনেকে। দেশব্যাপী জৈবিক চাষের সিদ্ধান্তের ফলেই শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক ধস নেমে এসেছে বলে বিশ্ব গণমাধ্যমে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা কী সত্যি? পরিবেশকর্মী ও লেখক বন্দনা শিবার সঙ্গে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন ইন্দ্র। দ্য ওয়াইর’র (The Wire) কৃষি বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠান ‘কৃষি কি বাত ইন্দ্র কি সাথ’ থেকে সাক্ষাৎকারটি শ্রুতিলেখন ও অনুবাদ করেছেন নুসরাত জাহান।
ইন্দ্র: শ্রীলঙ্কার ঋণগ্রস্ততার কারণ কী জৈবিক চাষের সিদ্ধান্ত, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?
শিবা: শ্রীলঙ্কার এই দুর্যোগের সূত্রপাত হয়েছে অবকাঠামোগত উচ্চাভিলাষ থেকে। ক্রমাগত বড় বড় বন্দর, পাওয়ার প্ল্যান্ট, মহাসড়ক তথা দৃশ্যমান উন্নয়নের লোভ মেটাতে শ্রীলঙ্কায় টাকা ঢালছিল চীন। সঙ্গে নিজের লোকদের কর্মসংস্থান দিচ্ছিল সেসব প্রকল্পে। যখন শ্রীলঙ্কা এই সব দানবীয় প্রকল্পের ঋণে ডুবে গেল, মজুরি পরিশোধ করার মতো অবস্থাও ছিল না আর। তখন সেই সব মহাসড়ক, বন্দর সব চীনের হয়ে গেল। তার ওপর ২০২০ এর করোনা সংক্রমণে শত শত লোককে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরতে হয়েছে। ফলে শ্রীলঙ্কার জাতীয় আয়ের তিনটি প্রধান উৎস ভেঙে গেছে। পর্যটন, প্রবাসী রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি খাত। ৫০ শতাংশ লোকসান হয়েছে পর্যটন বাণিজ্যে। প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্স পাঠানো কমে গেছে ব্যাপক হারে। মসলা, চা, কফি, রাবার ইত্যাদি অর্থকড়ি ফসলের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করোনায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকার কারণে। রপ্তানি খাতের এই অবস্থার কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সমস্যা তখন থেকেই মাথাচাড়া দিয়েছে। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছিল রাসায়নিক সার আমদানি করতে। খরচ বাঁচাতে তাদের নেতারা বলল, এটা বন্ধ করে দাও। যদিও কথাবার্তা অনেক বছর ধরেই চলছিল এবং জোরদার আন্দোলনও চলমান ছিল রাসায়নিক সার বন্ধের জন্য। তারপর হুট করে সার ও বিষ আমদানি বন্ধ হলো। কিন্তু, জৈবিক নীতি কখনো নেওয়া হয়নি। আমি নিজে জৈবিক চাষ করি। জৈবিক চাষে আপনাকে গবেষণা করতে হবে, কম্পোস্ট তৈরি করতে হবে, জৈবিক খাত তৈরি করতে হবে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। শ্রীলঙ্কায় এসবের কিছুই হয়নি। নিষিদ্ধকরণ হয়েছে শুধু। এবং সেই জায়গায় ওই চীন থেকেই আবার জৈবিক সার আমদানি করা হয়েছে যা ছিল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত। আপনি রাসায়নিক সারের পরিবর্তে আমদানিকৃত জৈবিক সার ব্যবহার করতে পারেন না। কারণ জৈবিক সার বা চাষের বিষয়টি মাটির নিজস্ব একটি প্রক্রিয়া। এটা স্থানীয় মাটির ভেতরে ঘটবে। সুতরাং, মাঠপর্যায়ে শ্রীলঙ্কায় কখনো জৈবিক চাষের প্রয়োগই হয়নি। আপনি যদি সত্যিই জৈবিক চাষের উদাহরণ দেখতে চান, কিউবাকে দেখুন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফলে তাদের তেল আর সার আমদানি বন্ধ হয়ে গেল। কিউবার সমগ্র গবেষণা, বিজ্ঞান এবং সরকারি ব্যবস্থা একত্রিত হয়ে কীভাবে তেল, ট্রাক্টর ও রাসায়নিক সার ছাড়া খাদ্য উৎপাদন করা যায় তার উপায় খুঁজতে লাগল। সমগ্র দ্বীপটি সম্পূর্ণভাবে জৈবিক চাষে নিয়োজিত হলো ধাপে ধাপে। পরিকল্পনা ও গবেষণার মাধ্যমে। আজ তারা জৈবিক চাষের সফল উদাহরণ।
রাসায়নিক দিক দিয়ে কত উন্নতি হয় এটা দেখতে হলে আমাদের তাকাতে হবে পাঞ্জাবের দিকে। শ্রীলঙ্কার দিকে না। পাঞ্জাবের পানি নিঃশেষ হয়ে গেছে। ক্যানসার ট্রেন চলে পাঞ্জাব থেকে। কৃষকেরা ঋণগ্রস্ত। যারা সবুজ বিপ্লবের নামে রাসায়নিক সার বিক্রির জন্য উর্বর পাঞ্জাবকে ধ্বংস করেছে, যারা আজ আফ্রিকাকে ধ্বংস করতে চায় আরেকটা সবুজ বিপ্লব দিয়ে তাদের থেকে সত্য শোনার আশা করা তো বোকামি। তারা তো দুনিয়ায় কোথাও কোনো সমস্যা দেখলেই আঙুল তোলে বলবে এটা জৈবিক চাষের দোষ। আর সেই ফাঁকে নিজেদের বিষের প্রচারণা চালাবে। এই বছরই দেখুন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে রাসায়নিক সারের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ইন্দ্র: ব্রিটিশদের সময় থেকে শ্রীলঙ্কায় প্রচুর প্ল্যান্টেশনের ফলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। গ্লাইফোসেট ইত্যাদি কীটনাশকের কারণেও অসংখ্য মানুষ কিডনি রোগে ভুগে মারা গেছেন। রাসায়নিক সার, বিষ নিয়ে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা সব সময়ই ভয়াবহ। এ বিষয়ে কিছু বলবেন।
শিবা: আমাদের দক্ষিণের দেশগুলোর মতো শ্রীলঙ্কাও মসলা চাষে সমৃদ্ধ ছিল। আমরা ছিলাম রপ্তানি নির্ভর জাতি। যতদিন আমাদের হাতে আমাদের মসলা ছিল। ব্রিটিশরা কেরালা, শ্রীলঙ্কা এমন অনেক উর্বর অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ শাসন দাস ব্যবস্থা দ্বারা চা, রাবার ইত্যাদির প্ল্যান্টেশন করে। এরপর এলো বিশ্বব্যাংকের খবরদারি। তাদের জন্যও ব্যাপক স্থানান্তর ঘটেছে। জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে সিনহেলা ও তামিলের মধ্যে। উঁচুভূমির মানুষকে, পাহাড়ের মানুষকে নিচে সমতলে এনে সেটেল করা হয়েছে। তার ফলেও সংঘর্ষ হয়েছে। ভূ-রাজনীতি এমনিতেও জাতিগত বিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢালছে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে রাউন্ডাপ আর গ্লাইফোসেট ছড়ানো হয়েছে। যেমনটা সবখানেই হয়েছে। বলা হলো, সাফ করো। ক্ষেত, খাল, উঠান, বাগান সব সাফ করো। তবে শ্রীলঙ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যে সূক্ষ্ম গবেষণা করেছেন তেমনটা আর কোথাও হয়নি। কারণ সেখানে একেবারে হঠাৎ করে কিডনি রোগের প্রকোপ শুরু হয়েছিল। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে তারা প্রত্যেকটা বিষয় খতিয়ে দেখেছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে রাউন্ডাপ আর গ্লাইফোসেট-এর প্রভাবে কিডনি রোগ হচ্ছে। এসব গবেষণার জন্য তাঁদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। বড় বড় জার্নালে তাদের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তার পরেও তাদের ওপর করপোরেট বিজ্ঞানের আক্রমণ এসেছে। আমেরিকার বিজ্ঞানীদের বসানো হয়েছে তাদের জায়গায়। তারা বলেছে, কুয়া থেকে পানি খায় বলে কিডনি রোগ হয়।
ইন্দ্র: তার মানে আপনি কী বলতে চান, বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা বিজ্ঞানের নামে যেসব কথা বলা হচ্ছে সেগুলো আসলে গুজব?
শিবা: আমি সোজাসুজি সেটাই বলছি। এটা হলো বিষের ফাঁদ। যাকে আমি বলি ‘পয়জন কার্টেল’। পাঞ্জাবে সবুজ বিপ্লবের নাশকতার সময়, জিএমও আর বিটি তুলার নাশকতার সময় আর শ্রীলঙ্কার সময়ও এরা প্রোপাগান্ডা তৈরি আর বিলানো ছাড়া আর কিছুই করে না কখনো।
আরে ভাই, এত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর মাটিকে যারা ফাঁপা, মৃত, জড়পদার্থ বলতে পারে তাদের নিজেদের খুপরিটাই তো ফাঁপা আসলে। এটা বিজ্ঞান হতেই পারে না। এটা বিজ্ঞানের নামে রটানো গুজব। যাতে কোনোমতে বিষের ব্যবসার ফাঁদটাকে টিকিয়ে রাখা যায়। রাসায়নিক কীটনাশক ও সার বিক্রির জন্য, পুরোনো ও নতুন জিএমও বীজ বিক্রির জন্য, এবং আমাদের খাদ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই ফাঁদ। যা আসলে দুর্ভিক্ষের ফাঁদ। তারা আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে চায়। তাই আমরা অন্নের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করছি। আমরা বলতে চাই, আমাদের খাদ্য আমরা উৎপাদন করতে জানি। ১.৩৬ বিলিয়ন মানুষের মুখে খাদ্য আমরা তুলে দিচ্ছি প্রতিদিন। এবং এই সার্বভৌমত্ব আমরা কখনো হারাতে দিবো না।
ইন্দ্র: সবুজ বিপ্লবের জনক নরম্যান বোরলাক বলেছিলেন, জৈবিক চাষের মাধ্যমে পৃথিবীর ৪-৫ বিলিয়ন লোককে খাওয়ানো সম্ভব। কিন্তু জনসংখ্যা যখন আরও বেশি হবে তখন রাসায়নিকের দরকার পড়বে। এই বক্তব্য নিয়ে আপনার মতামত কী?
শিবা: আমি বোরলাকের বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছি। কারণ আমি সবুজ বিপ্লবের ট্র্যাজেডি, ১৯৮৪’র সহিংসতাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। বোরলাক বারবার বলতেন, আমি যদি তোমাদের এমপি হতাম তাহলে প্রতিদিন সংসদে বসে তোমাদেরকে বলতাম ‘সার বেচো। সার বেচো। সার বেচো।’ বোরলাকের কাজ ছিল ডিউপন্ট ডিফেন্স (সামরিক) ল্যাবের অধীনে। যেকোনো উপায়ে যুদ্ধের বেঁচে যাওয়া রাসায়নিক বিস্ফোরকগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করাই ছিল যার উদ্দেশ্য। তারা যে বারবার বলে, রাসায়নিক ছাড়া সারা পৃথিবীকে খাওয়ানো যাবে না; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে রাসায়নিক সার ছিল পৃথিবীতে? তার আগে কী পৃথিবীর মানুষ খেত না?
আরেকটা বিষয়, একর প্রতি উৎপাদনের যে হিসাব তারা দেখায় সেটা উৎপাদনের সম্পূর্ণ হিসাব নয়। যেভাবে জিডিপি দিয়ে সমগ্র অর্থনীতির হিসাব হয় না। জিডিপি শুধু শিল্পখাতের আয় ব্যয় হিসাব করে। সেভাবেই একর প্রতি উৎপাদন কেবলমাত্র বাণিজ্যিক পণ্যকে হিসাবে ধরে। ক্ষেত থেকে যতটুকু মুক্তবাজারে গেল ততটুকু। ক্ষেতে কী কী ফসল ফললো, মানুষ কী কী ফসল খাবার হিসেবে খেলো সেসব কিছুই হিসাবে ধরা হয় না। এ জন্যই আমরা একর প্রতি পুষ্টি বা একর প্রতি স্বাস্থ্যের পরিমাপক বের করেছি। কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের গবেষণায় আমরা দেখিয়েছি, ভারতের জনসংখ্যার সমান দু’টি দেশকে সম্পূর্ণ পুষ্টি চাহিদা সম্পন্ন খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব। পুষ্টিটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমাদের দেশে প্রতি চারজনে একজন অপুষ্টিতে ভোগেন। কারণ আমরা খাদ্য উৎপাদন করছি না, উৎপাদন করছি পণ্য। FAO নিজেই বলছে ৮০ শতাংশ খাবার ছোট কৃষকদের জমি থেকেই আসে। চৌধুরী চরণসিংহ বলেছিলেন, আমার কাছে যদি ১০০ একর জমি থাকে আমি সেটা ২০ জন ক্ষুদ্র কৃষককে দেবো। কারণ তারা পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে বেশি উৎপাদন করবেন। বড়বড় জমিতে খাদ্যের চাষ হয় না, পণ্যের হয়। এই সব গবেষণা বারবার করা হয়েছে এবং এগুলো প্রতিষ্ঠিত।
আমরা যদি আমেরিকার দিকে দেখি, তারাও প্রচুর পণ্য উৎপাদন করে। কিন্তু সেগুলো পশুখাদ্য আর জৈব-জ্বালানির জন্য চলে যায়। আমেরিকার মানুষ কিন্তু জিএম সয়াবিন বা জিএম শস্য খায় না। বরং স্থানীয় ক্ষুদ্র কৃষকদের উৎপাদন করা খাবার খায়।
বিশেষ করে এখন যখন জলবায়ু সংকটসহ চারদিকে নানারকম দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে, আমাদের আরও একটি হারিয়ে যাওয়া চেতনা জাগ্রত হচ্ছে। শুধু চাষ করা খাবার তো আমরা খেতাম না। আমরা গাছ লাগাতাম। আমরা স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে খাদ্য সংগ্রহ করতাম। আমাদের আদিবাসীরা ৯০ শতাংশ খাবার জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে আনতেন। ১০% খাবার কোনো ছোট ক্ষেতে স্থানান্তর চাষের মাধ্যমে ফলিয়ে নিতেন। আমরা আমাদের পুষ্টিসমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের কথা ভুলে গেছি। কারণ রাসায়নিক সারের প্রয়োগের স্বার্থে আমাদের গুটিকয়েক বাণিজ্যিক ফসল চাষ করতে হয়েছে। এখন আমাদের এটা বদলাতে হবে। জৈবিক জীবনে ফিরে আসতে হবে। জীববৈচিত্র্য নির্ভর জৈবিক চাষই একমাত্র পথ যা কৃষককে ঋণগ্রস্ত না করে, দেশকে ঋণগ্রস্ত না করেও সম্পূর্ণ পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পারে। এর মাধ্যমে মাটিতে, পানিতে, সকল প্রাণ ও মানুষের সুস্থতা রক্ষা পাবে। সব থেকে জরুরি বিষয়, রক্ষা পাবে এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে কৃষকেরা ভূমি থেকে উৎখাত হবেন না। জৈবিক চাষে ২ থেকে ১০ গুণ বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব।
ইন্দ্র: জৈবিক চাষের যে ধারণা এটা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে— যেখানে কৃষকেরা টাকার জন্য না, বাজারের জন্য না বরং নিজের জন্য চাষ করবেন? কোনো মডেল কী আছে যার ভিত্তিতে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
শিবা: আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে এই কাজই করছি। যখন থেকে পাঞ্জাবে সবুজ বিপ্লবের নাশকতা শুরু হয়েছে। আমি তো ফিজিকসের ছাত্রী, কৃষি তো আমার বিষয়ও ছিল না। প্রায় দশ লাখ কৃষকের সঙ্গে আমরা এই মডেল নিয়ে কাজ করেছি। নিজেদের বীজ রক্ষা করো। যে যে অঞ্চলে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে সবখানেই কৃষকেরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন বাজারের বীজের ওপর। ৪০০০ আত্মহত্যার ৮৫% ঘটেছে বিটি তুলা চাষের এলাকায়। কারণ প্রতিবার চাষে বীজ কিনতে হয়। আর প্রতিবছর বীজের দাম বাড়ে। এটাই কৃষক মৃত্যুর দুষ্টচক্র। তাহলে কীভাবে সম্ভব এমন চাষ যা কৃষককে বাঁচাবে, তাকে পুষ্টি দেবে? মানুষ যখন অপুষ্টিতে ভুগছে তখন আপনি কী এমন চাষ করবেন যাতে খাদ্যের পুষ্টি ৬০% কমে যায়? নাকি এমন চাষ করবেন যাতে ৬০% পুষ্টি বাড়ে? বাড়ে যেটা সেটাই করবেন, না? কিন্তু এই হিসাবটা হয়নি। হিসাব না করেই এই যে নাই বলে দেওয়া এটাকে আমি বলি, ‘don’t look, don’t see, and then say it doesn’t exist’।
এই অন্ধকার থেকেই যা বিজ্ঞান নয় তা নিজেকে বিজ্ঞান বলে দাবি করে। আমাদের এলাকাগুলোতে অর্থাৎ ঝাড়খণ্ড, বাংলা, ওডিশা, ছত্রিশগড়, গাড়োয়াল এমন অনেক জায়গায় কৃষক জীববৈচিত্র্য নির্ভর চাষবাস করে সব রকম চাহিদা পূরণ করছেন। নিজেরা ভালো খাবার খাচ্ছেন, প্রতিবেশীদের বিলাচ্ছেন, বিনিময় করছেন। কেউ টমেটো চাষ করছে তো কেউ আলু, কেউ গম চাষ করছে, কেউ বজরা। এবং তারা নিজেরাই নিজেদের স্থানীয় বাজারব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছেন। শুধু গ্রামের বাজারে বেচাকেনা করেই তারা ভালো উপার্জনও করছেন। বাইরে যাওয়ার দরকারই পড়ছে না। সবাই বলে এসব জৈবিক খাবার বড়লোকদের জন্য। কিন্তু গরিবরাও জানে পুষ্টিকর খাবার কোনটি। গরিবরাও জানে স্বাদ কাকে বলে। পরিশ্রমের পর ভালো খাবার খাওয়ার তৃপ্তি গরিবও জানে। তাই আমরা বলেছি বৈচিত্র্য শুধু গাছের না, ফসলের না; অর্থনীতির বৈচিত্র্য আনতে হবে। স্থানীয় অর্থনীতি, আঞ্চলিক অর্থনীতি, জাতীয় অর্থনীতি এরপর অতিরিক্ত কিছু অবশিষ্ট থাকলে সেটুকু আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হতে পারে। ১৯৯১ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট নামে উল্টোটা চেষ্টা করে আসছে। তারা আমাদের বলছে, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করে কী হবে? সবজি, ফল আর চিংড়ি চাষ করো যাতে রপ্তানি করা যায়। মাংসের উৎপাদন বাড়ানোও তাদেরই নির্দেশনা ছিল। সব জীবজন্তু ক্ষেত থেকে হারিয়ে গিয়ে রাস্তায় চলে এসেছে। এখন তারা হয়ে গেছে গৃহহীন, আশ্রয়হীন।সবই বিশ্বব্যাংকের নীতি মোতাবেক। আমরা যদি তাদের কথা পুরোপুরি শুনতাম তাহলে আজ আমাদের অবস্থা লেবাননের মতো হতো। লেবানন এখন গম আমদানি করতে পারছে না। দুর্ভিক্ষ চলছে সেখানে। আপনি যদি আপনার নিজের খাদ্য উৎপাদনের দায়িত্ব না নেন জলবায়ু সংকটে, যুদ্ধে, মূল্যস্ফীতির সময়, সার-তেল প্রভৃতির মূল্য বৃদ্ধির সময় আপনাকে না খেয়ে মরতে হবে। তাই স্বনির্ভরতা আর স্বাধীনতার মহোৎসব শুরু হয় খাদ্য থেকে।
ইন্দ্র: আজ সব গ্রামেই কৃষক পরিবারগুলো ঋণগ্রস্ত। বীজ সংরক্ষণ, দেশজ চাষের যে জ্ঞান আগের সমাজগুলোতে ছিল সবাই তা ভুলে গেছে। এখন সব বাজার নির্ভর। নতুন প্রজন্মও এসবে আগ্রহী নয়, তারা পাবজি খেলায় ব্যস্ত। এখন এসব লোকদের জন্য যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা ধাপে ধাপে কীভাবে আজকের এই বাজার নির্ভর সমাজকে জৈবিক এবং স্বনির্ভর করে তুলতে পারেন?
শিবা: আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় একটা সংকট হলো জলবায়ু পরিবর্তন। ৫০% খাদ্য এমন এক ব্যবস্থা থেকে আসে যা জীবাশ্ম জ্বালানি, রাসায়নিক, কীটনাশক আর দূরবর্তী পণ্য সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। এই জলবায়ু সংকট যত বাড়বে খাদ্য নিরাপত্তা তত ভাঙতে থাকবে। আমাদের ফসলের ক্ষেতগুলো ধ্বংস হবে। সাইক্লোন হবে, হিমবাহ গলবে আরও কত কী। অতএব আমাদেরকে প্রতিরক্ষা করতে হবে এবং জীববৈচিত্র্যই হতে পারে প্রতিরক্ষার একমাত্র হাতিয়ার। সেরকম বীজ আমাদের আছে। নোনাসহিষ্ণু, বন্যাসহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু এমন বৈচিত্র্যময় সব বীজ। আরেকটা সংকট হলো স্বাস্থ্যের। আমরা তর্ক করতে থাকি কে খাওয়াবে। কিন্তু এ সত্য আমরা এড়াতে পারি না, রোগের উৎপত্তি হয়েছে প্যাকেটজাত খাবার আর রাসায়নিক থেকেই। জৈবিক খাবার মাত্র দশ দিনে আপনার পেট থেকে ওইসব বিষ বের করে দিতে পারে। জৈবিক পন্থায় চাষ করা খাদ্যে ৪০-৫০% প্রধান পুষ্টি উপাদান— সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, জিংক, নিকেল মজুত থাকে। এই সকল ফাইটোকেমিকেল মানুষের পুষ্টি ও সুস্থতা নিশ্চিত করে। অন্যদিকে ৭৫% অসুখ-বিসুখ হয় ভেজাল খাবারের কারণে। আর মানুষের আয়ের সব থেকে বড় অংশ খরচ হয় চিকিৎসার পেছনে। সুতরাং জলবায়ু সংকট প্রতিহত করাই হোক আর সুস্থ থাকার জন্যই হোক, আপনাকে আপনার খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। অন্য সব তর্ক ছেড়েই দিন, সুস্থ থাকা আর জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে টিকে থাকার জন্য হলেও এই পথেই এগোতে হবে। এ বিষয়ে যত প্রচারণা আর গুজবই চালানো হোক না কেন শেষ পর্যন্ত এটাই প্রমাণিত হবে, যে মাটিতে জীববৈচিত্র্য বেশি সেই মাটিরই সহিষ্ণুতা বেশি। যে ক্ষেতে জীববৈচিত্র্য বেশি সে কখনো বন্যা কিংবা খরায় পুরোপুরি ধ্বংস হয় না, কিছু না কিছু ফসল দেয়। আর জৈবিক চাষের যে পদ্ধতি তাতে খরচ কম, অর্থাৎ তা কৃষকের জন্যও ভালো। সব থেকে বড় কথা, যে চাষ করার জন্য মাটিকে সুস্থ রাখতে হয় তার ফসল আপনার স্বাস্থ্য, আপনার পেটের জন্য সবচেয়ে ভালো। নিউইয়র্ক, মিলান আরও নানা জায়গার এত এত ডাক্তার, বিজ্ঞানীদের আমি চিনি যারা নিজেদের ক্যানসার ক্লিনিক বন্ধ করে জৈবিক চাষ করতে চলে গেছেন। কারণ স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলা করার পথ এই একটাই। জীববৈচিত্র্য নির্ভর জৈবিক চাষ।
ইন্দ্র: আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে সরকারের উচিত জৈবিক চাষের জন্য ভর্তুকি দেওয়া!
শিবা: অবশ্যই। আমি এ কথা বারবার বলেছি। রাসায়নিক চাষ, সবুজ বিপ্লব বা যাই বলুন না কেন, এটার ক্ষতির পরিমাণ ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্তত কৃষকদের ওপর আর পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে শুধু তার হিসাবও যদি করি। এর সঙ্গে আরও যোগ হবে চিকিৎসার খরচ। সেটা তো সরাসরি যুক্ত। ক্যানসার কোষ ওই সব বিষাক্ত উপাদানের থেকেই তৈরি হয়। এছাড়াও অপুষ্টি, বিপাকীয় রোগবালাই কত কী! এগুলো সব মিলে হিসাব করলে ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতি হয় মানুষের, প্রকৃতির, প্রাণের যা আমাদের জিডিপির চেয়েও বেশি। যে কৃষক নিজের বীজ নিয়ে জৈবিক পন্থায়, নিজের মতো করে চাষ করছে সে দশ গুণ বেশি লাভবান হচ্ছে। যে সংকট আমাদের সামনে তার পথ এটাই। সরকারের কাছে কিছুদিন তো সুপারিশ আসবেই। অবশ্যই চাপ আসবে কারণ তারা অনেক প্রভাবশালী। ৪০ বছর ধরে এগুলোই বোঝার চেষ্টা করছি। মিথ্যা বলে, পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, বাতিল করে দেয়। ভারতের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে আমি কাজ করেছি যারা জৈবিক চাষের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়নের পথে এগোতে পারেনি। আর শ্রীলঙ্কার বিষয়ে এটা আমি স্পষ্ট করে বলব যে, তারা কখনো জৈবিক পদ্ধতি অবলম্বনই করেনি। রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করাই জৈবিক হয়ে যাওয়া নয়। এটা অনেকটা ‘আমি আজ থেকে প্যাকেট খাবার খাবো না’ বলার মতো। তারপর কী না খেয়ে মরবো? বাইরের খাবার না খাওয়ার অর্থ না খেয়ে থাকা নয়৷ নিজের খাবার বানাতে হবে তখন। নিজে উৎপাদনটা করতে হবে। শ্রীলঙ্কা তো নিজের খাবার তৈরিই করেনি! সমস্যাটা এখানে। সব সমাজে, সব দেশে এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মৃত্যুফাঁদ পাতা। যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, দেশকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এর মাধ্যমেই সামনের দিনগুলোতেও আরও অর্থনৈতিক লুটতরাজ চলবে। তারা এখন প্রাকৃতিক সম্পদের কোম্পানি বানাচ্ছে। গোটা দেশ কিনে ফেলো যাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। তাদের পাহাড়, নদী, ফসল সবকিছু কিনে ফেলো।
ইন্দ্র: সামনে যে ধরিত্রী দিবস আসছে তার প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘ইনভেস্ট ইন দ্য প্ল্যানেট’। এর মাধ্যমে কি যেটুকু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য টিকে আছে তারও ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে?
শিবা: আপনি একদম ঠিক জায়গায় হাত দিয়েছেন। গ্লাসগোতে যে কপ২৬ সম্মেলন হয়েছে তার ঠিক এক মাস আগে ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের চারটা গ্রুপ মিলে একটা নতুন জিনিস বানিয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের কোম্পানি। এদের সঙ্গে আছে সবুজ বিপ্লবের উদ্যোক্তা রকফেলার, যারা আমাদের প্রাচীন স্বাস্থ্যকর চর্চা বাতিল করেছে ফার্মাসিউটিক্যালের ব্যবসা করার জন্য। এরা যখন বলে ‘ইনভেস্ট ইন দ্য প্ল্যানেট’ তার মানে হলো মানুষকে এত গরিব বানিয়ে দাও, দেশের ওপর এত ঋণ চাপিয়ে দাও যাতে তাদের টাকার দরকার হয়। এবং তখন বিনিয়োগের নামে টাকা দিয়ে তারা বলবে, তোমার জমি এখন আমার। আমি এটা আমার মতো ব্যবহার করবো, আমার মতো হিসাব করবো। এরা পুরো সৃষ্টির ওপর জমিদারি করতে চায়। এবং এই খেলা খেলছে দশজন মতো লোক। ব্ল্যাক রক, ভ্যানগার্ড, রকফেলার, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এরা। তারা আমাদেরই ভাষা নিয়ে উল্টো করে আমাদের দিকেই ছুড়ে দিচ্ছে। বলছে, আমরা অর্ধেক অংশ প্রকৃতির জন্য ছেড়ে দিই।
আরে ভাই, তুমি কে প্রকৃতির জন্য ছাড়ার? তুমি তো প্রকৃতির থেকে নিয়ে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকো। তোমাদের বৈদ্যুতিক গাড়ির লিথিয়ামও প্রকৃতি থেকেই আসে। ওয়েস্ট-এর এসব তত্ত্ব হচ্ছে, সবুজ উপনিবেশায়ন। আমাদের যে চেতনা তা হলো প্রাকৃতিক সহাবস্থান। আমরা বলি— নষ্ট করো না, ক্ষতি করো না। সকল প্রাণের সঙ্গে বাঁচো। তাদের হক মেরো না। সকল প্রাণ সুস্থ থাকলেই তুমি সুস্থ থাকবে৷ আমরা দশ হাজার বছর ধরে আয়ুর্বেদ, প্রাকৃতিক কৃষি, বসুদেব কুটুমের চিন্তায়-জ্ঞানে এসকল বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছি। সেটা ছিল অর্থশাস্ত্র। অর্থনীতি। নতুন এক রটনা রটানো হচ্ছে যে, অর্থনীতির জনক পশ্চিমা এডাম স্মিথ! এই লোক তো উপনেবিশের কাজকর্ম ছাড়া আর কিছুই ব্যাখ্যা করে যায়নি। তবে তিনি তাকে উপনিবেশ বলেননি অবশ্য, বলেছেন ওয়েলথ অব নেশন! তার যে অদৃশ্য হাত তা আসলে পশ্চিমের হাত। রকফেলারদের হাত। এখন সেই অদৃশ্য হাতই সমগ্র ভূমি, পানি, কার্বন, অক্সিজেন, খাবার, বীজ সব লুটপাট করে নিতে চাচ্ছে। এটাই সময় আমাদের বীজের সার্বভৌমত্ব, খাদ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার। স্বাধীনতার আসল মহোৎসব তো তখনই হবে যখন আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের স্বাধীনতা, আমাদের খাদ্যের স্বাধীনতা আমরা রক্ষা করতে পারব।