logo
আপডেট : ১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০
কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদন
চলতি বছর মাসে ২৮৮ জন বাল্যবিয়ের শিকার
নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি বছর মাসে ২৮৮ জন বাল্যবিয়ের শিকার

চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ২ হাজার ৩০১ জন কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে ২৮৮ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। এ সময়ে ৫৮৯টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। একই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৪ জন কন্যাশিশু। তাদের মধ্যে ৮৪ জন সংঘবদ্ধ ও ৩৬৪ জন একক ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) কন্যাশিশু রয়েছে ৪৩ জন। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘জানুয়ারি-আগস্ট ২০২২ : কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন’ উপস্থাপন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি। তিনি জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় ও অনলাইন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে শূন্য থেকে ১৯ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের নির্যাতনের তথ্য ১৩টি ক্যাটাগরির আওতায় ৫৬টি সাব-ক্যাটাগরিতে ভাগ করে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আট মাসে প্রেমের অভিনয় ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ৪৯ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ জনকে হত্যাও করা হয়েছে। ৮৭ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৬ জন। ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার কন্যাশিশুদের মধ্যে এক বছর বয়সী শিশুও রয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, এ সময়ে ১৮৬ জন কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। পাচার করা হয়েছে ১৩৬ কন্যাশিশুকে; তাদের মধ্যে ৭৪ জনকে অপহরণ করা হয়েছে।

দেশে গত আট মাসে ১৮১ জন কন্যাশিশু আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেমে প্রতারণার শিকার হয়ে ৪৬ জন এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে ৩৫ জন কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। এর আগে ২০২১ সালের প্রথম আট মাসে আত্মহত্যা করেছিল ১৫৩ জন। অর্থাৎ ২০২২ সালে বেড়েছে আত্মহত্যার পরিমাণ। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৮৬ জন কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ জন। যৌতুক দিতে না পারায় পাঁচজন কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া গৃহশ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি। এর মধ্যে দুজনকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে এবং একজন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।

কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম জানিয়েছে, কন্যাশিশু ও নারীরা পথঘাট, যানবাহন ও বাজারসহ সব ধরনের পাবলিক প্লেসে, শিক্ষা ও ধর্মীয়প্রতিষ্ঠান এমনকি নিজ বাড়িতেও হরহামেশা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৭৬ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) শিশুও রয়েছে। এ নির্যাতনগুলোর অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছে রাস্তায়, নিজের বাসায়, নিকট আত্মীয়-পরিজন ও গৃহকর্তার হাতে। এছাড়া প্রতিদিন ৩০-৩৫ জন, মাসে ৯০০-১০০০ জন কন্যাশিশু সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ১৫ জন কন্যাশিশু। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া অধিকাংশ কন্যাশিশুই জানে না কীভাবে, কোথায়, কার সহায়তায় এ বিষয়ে অভিযোগ করা যায় বা এর ফল কী হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাসিডের সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ৩ জন কন্যাশিশু। পারিবারিক বিবাদ, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, সম্পত্তিসংক্রান্ত আক্রোশ ইত্যাদি কারণে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ১৩৬ জন কন্যাশিশু। এর মধ্যে অপহরণের শিকার হয়েছে ৭৪ জন। অপহরণের শিকার শিশুদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জোরপূর্বক যৌনপেশায় নিয়োজিত করা হয়।

অনুষ্ঠানে আলোচকরা বলেন, দেশে নতুন বা পুরনো যেকোনো ধরনের অস্থিরতাতেই কন্যাশিশু ও নারীর ওপর নির্যাতন কখনো থামে না। বরং তা সব সময় বৃদ্ধিই পায়। এ নির্যাতন শুধু ঘরের বাইরেই নয়, নিজ ঘরেও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়তই ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাগুলো সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে।

তারা আরও বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষের অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও হিংস্রতা। লঙ্ঘিত হচ্ছে কন্যাশিশু ও নারীর মানবাধিকার। একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কন্যাশিশুদের অধিকার, তাদের শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ নিশ্চিত করাসহ নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

তথ্য বিশ্লেষণ করে আলোচকরা বলেন, কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা ধরনের ভুল ধারণা, শঙ্কা ও কুসংস্কার এখনো বিদ্যমান। নির্যাতিত কন্যাশিশু বা তার পরিবার নানা বাধা পেরিয়ে বিচার চাইতে গেলেও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়।

অনুষ্ঠানে বক্তারা সুপারিশ করেন, কন্যাশিশু নির্যাতন বন্ধে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সব ঘটনা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম শেষ করতে হবে; সর্বস্তরের জন্য ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে; সাইবার নিরাপত্তায় নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করাসহ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

অনুষ্ঠানে কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার, চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড প্রটেকশন এডুকো বাংলাদেশ স্পেশালিস্ট মো. শহীদুল ইসলাম, গুডনেইবারস বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাঈনুদ্দীন মাইনুল, বাংলাদেশ ওয়াইডব্লিউসিএ’র জাতীয় সাধারণ সম্পাদক হেলেন মনিষা সরকার বক্তব্য রাখেন।