বসতিতে হারিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাহাড়গুলো। বৃষ্টির পানি ধারণের জায়গাগুলো ভরাট করে গড়ে ওঠা এসব বসতির কারণে নগরীতে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এতে নগরী এখন বসবাসের অনুপযোগী। পাহাড় কেটে ও জলাধার ভরাট করে গত ২০ বছরে ১০টি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। যদিও সিডিএর দাবি, পাহাড় কাটা হয়নি, নিচু জমি ভরাট করে আবাসন করা হয়েছে। নগরবিদরা একে ‘দুষ্ট পরিকল্পনা’ ও স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্য হাসিলের পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনন্যা আবাসিক এলাকা। চান্দগাঁও ও কুয়াইশ এলাকার প্রায় ৬২ একর নিচু ভূমি ভরাট করে ১ হাজার ৭০০টি প্লটের বিশাল এক আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০৭ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও শেষ হয় ২০১৮ সালের দিকে। আর শেষ হওয়ার পরপরই অক্সিজেন, বালুচরাসহ আশপাশ এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
শুধু এ আবাসিক এলাকার মাধ্যমে সিডিএ নগর দুর্ভোগ ডেকে আনেনি, পাহাড় কেটে ও জলাধার ভরাট করে সীতাকুন্ডের সিলিমপুর আবাসিক এলাকায় ২০১৩ সালে আংশিক প্লট বরাদ্দ দিয়েছে সিডিএ। বাকলিয়া এলাকার জলাধার ভরাট করে কল্পলোক আবাসিক এলাকা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় (১ হাজার ৭০০ প্লট) গড়ে তোলা হয়েছে ২০০৫ থেকে ’০৭ সালে। এখন এই এলাকায় বাড়িঘর গড়ে উঠছে এবং পানির কারণে ভবনগুলোর নিচতলা রাস্তা থেকে উঁচু করে নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকৃতি বিনাশ করে শুধু সিডিএই আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে না, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ২০০০ সালের দিকে ৪ হাজার ১৪৪ প্লটের কৈবল্যধাম বিশ্বব্যাংক কলোনি আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে পাহাড় কেটে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০০৪ সালের দিকে দক্ষিণ খুলশী এলাকায় পাহাড় কেটে ৬৫টি প্লটের সিটি করপোরেশন ভিআইপি আবাসিক এলাকা করেছে, আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় কেটে ৫২০টি প্লটের লেকসিটি হাউজিং, বাকলিয়ায় নিচু এলাকা ভরাট করে ২৬টি প্লটের বগারবিল ও সৈয়দশাহ হাউজিং গড়ে তোলা হয়েছে।
বিশ^ বসতি দিবস আজ। এবারের বসতি দিবসের প্রতিবাদ্য ‘মাইন্ড দ্য গ্যাপ। লিভ অন ওয়ান অ্যান্ড প্লেস বিহাইন্ড’। এ উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে গৃহায়ন অধিদপ্তর।
প্রকৃতি বিনাশে পিছিয়ে নেই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানও : সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যেখানে প্রকৃতি বিনাশ করে বসতি গড়ে তুলেছে, সেখানে ব্যক্তিগত ও প্রাইভেট অনেক প্রতিষ্ঠানও বসতি গড়ে তুলেছে। এদের মধ্যে অন্যতম জাকির হোসেন রোডে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা নাসিরাবাদ হাউজিং প্রপার্টিজ। পুরো এলাকায় একসময় সুউচ্চ পাহাড় ছিল, এখন পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাশে হয়েছে এয়াকুব ফিউচার পার্ক। এ স্থানে ২০০০ সালেও পাহাড় ও ইটভাটা ছিল। ইটভাটার মাধ্যমে পাহাড় সাবাড় করার পর ইটভাটা বন্ধ করে এখন সিডিএর অনুমোদনে গড়ে তোলা হয়েছে এয়াকুব ফিউচার পার্ক নামে আবাসন প্রকল্প। এ ছাড়া পশ্চিম খুলশীর উত্তরে কৃষ্ণচূড়া আবাসিক এলাকা, গোল্ডেন ভিউসহ কয়েকটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে পাহাড় কেটে। একই সঙ্গে আকবরশাহ এলাকায় শাপলা হাউজিং, বায়েজিদে হিলভিউ আবাসিক এলাকা, চন্দ্রনগর সোসাইটি, জালালাবাদ হাউজিং, দক্ষিণ খুলশী পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা, রহমান নগর আবাসিক এলাকা ও কসমোপলিটনসহ অনেক আবাসিক এলাকা পাহাড় কেটে কিংবা নিচু ভূমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে।
আইনে যা আছে : বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-তে পাহাড় কাটা সম্পর্কে বাধা-নিষেধ (৬খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন ও/বা মোচন করা যাইবে না। তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে কোনো পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইতে পারে।
নগরবিদদের বক্তব্য : দেশের নগরগুলো নিয়ে গবেষণা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর গবেষণা কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বিশিষ্ট ভূগোলবিদ প্রফেসর নজরুল ইসলাম সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরের ভৌগোলিক সমীক্ষা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রামে বসতি নিয়ে কথা হয় এ নগরবিদের কাছে। তিনি বলেন, ‘পাহাড় কেটে ও জলাধার ভরাট করে বসতির নামে যে পরিকল্পনা হচ্ছে তা হলো দুষ্ট পরিকল্পনা। একে অপরিকল্পনা না বলে বলতে হবে ভুল পরিকল্পনা এবং স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্য হাসিলের পরিকল্পনা। আর তাদের এ দুষ্ট পরিকল্পনার কারণে নগর দুর্যোগ শুরু হয়েছে।’
কিন্তু সিডিএ বলছে চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা, তাই পাহাড় না কেটে ও নিচু ভূমি ভরাট না করে বসতি সম্ভব নয়। এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বের কোনো দেশে পাহাড় কাটে না। আমরাই পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তুলছি। পাহাড়ই সৌন্দর্য। পাহাড় রেখে যেমন পরিকল্পনা করা যায় তেমনি নিচু ভূমি এলাকা রক্ষা করেও পরিকল্পনা করে বসতি নির্মাণ করা যায়।’
প্রফেসর নজরুল ইসলামের সঙ্গে একমত পোষণ করে রাশিয়া থেকে স্থাপত্য বিদ্যায় এবং নগর পরিকল্পনা বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়া স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ‘পাহাড় কাটা ও নিচু ভূমি ভরাটের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা কার্যকর হয়নি। আর এতে নগরীর বিকাশ হয়েছে অপরিকল্পিত। এই মুহূর্তে নগরীর প্রান্তিক এলাকা ও উপজেলা পর্যায় নিয়ে পরিকল্পনা জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যথায় উপজেলা সদরগুলোর বিকাশও অপরিকল্পিত হবে।’
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় গবেষণারত ও সিডিএর সাবেক ঊর্ধ্বতন স্থপতি মাহারিনা জাফরিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর অপরিকল্পিত বসতির কারণ হলো সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। ওয়াসা যেসব নিচু এলাকা চিহ্নিত করেছে সেসব এলাকায় আবাসন না করাই উত্তম ছিল। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো তা মানেনি। আর এতেই নগরীতে আজ দুর্ভোগ।’
সিডিএর বক্তব্য : সিডিএ পাহাড় কেটে কোনো আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেনি উল্লেখ করে সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আমরা কিছু নিচু জায়গা ভরাট করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছি, তবে সেগুলোতে যাতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো থাকে সে জন্য খাল ও ড্রেন নির্মাণের প্রস্তাবনা ছিল। বর্তমানে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় তা করা হচ্ছে।’
কিন্তু নগরজুড়ে আবাসিক এলাকার অনুমোদন দিয়ে থাকে সিডিএ। পাহাড় কেটে ও নিচু এলাকা ভরাট করে গড়ে ওঠা বসতির কারণে আজ নগর জীবন দুর্বিষহ। এ প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘অন্যান্য সরকারি সংস্থা সিডিএ থেকে অনাপত্তিপত্র না নিয়ে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে এবং সিডিএ সেসব এলাকায় ভবনের অনুমোদনও দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটু ব্যত্যয় হয়েছে।’
সমাধান কোথায়? : সিডিএর সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘সিডিএর প্রায় সব আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট করে। তাই আজ জলাবদ্ধতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। সিডিএ যদি আবাসিক এলাকা গড়ে তুলতে পারে তাহলে জলাধারও তৈরি করতে হবে অথবা রক্ষা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় গুলশান ও ধানমন্ডি লেকের মাধ্যমে পানি ধারণের জায়গা করা হয়েছে। চট্টগ্রামেও এমন জলাধার তৈরি করতে হবে।’
এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় জলাধার নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া খাল ও ড্রেনও নির্মাণ করা হচ্ছে।’
প্রাকৃতিক জলাধার ছাড়া অতিরিক্ত পানি ধারণের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে বিশিষ্ট স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ‘এ কাজটি সিডিএকে করতে হবে। কোন কোন এলাকায় প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণ করবে তা আগে থেকে নির্ধারণ করে সেই এলাকায় ঘরবাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া যাবে না।’