logo
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০
শিক্ষায় বিনিয়োগে মানবপুঁজি বাড়বে

শিক্ষায় বিনিয়োগে মানবপুঁজি বাড়বে

পৃথিবীর কোনো দেশেই প্রকৃত উন্নয়ন বোঝাতে কেবল মাথাপিছু আয় ও জিডিপির হিসাবকে সূচক হিসেবে ধরা হয় না। কারণ মাথাপিছু আয় ও জিডিপির হিসাব দিয়ে সাধারণ মানুষের সত্যিকার উন্নয়ন এবং তাদের জীবনধারণের প্রকৃত অবস্থা জানা যায় না। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক প্রবর্তিত মানবপুঁজি সূচক একটা সাম্প্রতিক মানদ- বটে। যদিও বিশ্বব্যাংকের আগে থেকেই অনেকে এই বিষয় নিয়ে কথা বলে আসছিলেন। খেয়াল করা জরুরি, মানবপুঁজির দুটি দিক রয়েছেএক. শিক্ষাপুঁজি এবং দুই. স্বাস্থ্যপুঁজি। মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ও সমাজের জীবনমানের প্রকৃত উন্নয়নের প্রশ্নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটিই সমানভাবে ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর যেসব দেশে উন্নয়ন হয়েছে দেখা গেছে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটি খাতেই অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই নিজেদের উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুই খাতেই বাংলাদেশের বিনিয়োগ আশানুরূপ তো নয়ই, বরং কাক্সিক্ষত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে। 

এমন বাস্তবতার মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার সারা বিশ্বে পালিত হলো‘আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২৩’। জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘জনগণের জন্য বিনিয়োগে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিন’। তবে দিবসটি আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় না। বেসরকারি উদ্যোগে কিছু সভা-সেমিনারের মাধ্যমেই দিবসটির আয়োজন সীমাবদ্ধ থাকছে। এটাও হয়তো শিক্ষায় বিনিয়োগে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতারই দৃষ্টান্ত। খেয়াল করা দরকার, চলতি অর্থবছরে আমাদের দেশে শিক্ষায় বরাদ্দ মোট বাজেটের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে ইউনেস্কো শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। তবে একবারে এই বরাদ্দ ২০ শতাংশ দেওয়া সম্ভব না হলে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলেছিলেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এক্ষেত্রেও সমালোচনা রয়েছে যে, শিক্ষায় বাজেটের যে অংশটুকুই বরাদ্দ দেওয়া হোক না কেন তার পুরো অর্থ প্রকৃত অর্থে শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। নানা উপখাতের মাধ্যমে বিভিন্ন বরাদ্দের হিসাবও শিক্ষা খাতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অথচ প্রয়োজন ছিল শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা।

ইউনেস্কোর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’-এ বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ বাংলাদেশে মাধ্যমিকের ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যয়ের ৭১ শতাংশ পরিবার বহন করে। তবে এনজিও স্কুলে ফি সরকারির তুলনায় তিনগুণ ও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ফি সরকারির তুলনায় ৯ গুণ বেশি। বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের বেশি রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাইভেট পাঠদান শিক্ষার্থীদের ভালো ফল পেতে সাহায্য করেছে। এদিকে, রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ কমলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বাড়ে। বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। শিক্ষা সব দেশের উন্নয়নের চাবি। ভোকেশনাল, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার মানোন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে শিক্ষকদের অবদানই মুখ্য। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ্য মেধাবীদের শিক্ষা খাতের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান এত নিম্নমানের যে, অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার সুযোগ থাকলে কেউ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। অথচ উন্নত দেশে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক তার বিপরীত। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান আমাদের দেশের থেকেও অনেক উন্নত। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে যে সরকারের বিশেষ মনোযোগ নেই সেটা বোঝা যায় জাতীয় শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে গড়িমসি থেকেও। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি গত ১২ বছরেও। এমনকি সরকারের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেই। অন্যদিকে, শিক্ষা খাতে ধনী-গরিব, গ্রাম-শহরসহ নানা ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মুখে মুখে কারিগরি শিক্ষার কথা বলা হলেও সেখানে নেই বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ। আর এজন্যই শিক্ষায় বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লেই কেবল মানবপুঁজিতে উন্নত জাতি হওয়া সম্ভব।