
বঙ্গবন্ধু তার সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছি, মুক্তি কি অর্জিত হয়েছে? স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে প্রত্যেক ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছিল উন্নতির অবারিত সুযোগ। সেই সুযোগ কি আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি? রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে আমরা আমাদের আকাক্সক্ষার হিসেব মেলাতে চেয়েছি স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ এই আয়োজনে
মুক্তির ধারণা ইউরোপে এক সময় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। সেটা ছিল রেনেসাঁসের সময়। মানুষ তখন ইহজাগতিক হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের জায়গায় স্থাপন করেছে মানুষের নিজের প্রতি আনুগত্য। চিন্তা জগতে ঘটনাটা খুবই বৈপ্লবিক। মানুষ নিজেকে মুক্ত হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। তার জীবনের চরিতার্থতা ঈশ্বরের ইচ্ছা পরিপূরণের ওপর নির্ভরশীল নয়, নির্ভরশীল তার নিজেকে বিকশিত করার ওপর, এই যে নতুন মূল্যবোধ এটা তাকে দিল সাহস ও আত্মবিশ্বাস। মুক্তির ওই চিন্তার কেন্দ্রে রইল ব্যক্তি। কিন্তু মুশকিল হলো এই যে, ব্যক্তি দেখল স্বাধীন হয়েও সে স্বাধীন নয়, সে নিয়ন্ত্রিত হয় সমাজ ও অর্থনীতি দ্বারা, তাকে থাকতে হয় রাষ্ট্রের অধীনে; তাছাড়া সব মানুষ তো সমান অবস্থানে নেই, তাদের ভেতর বিভাজন রয়েছে শ্রেণির, পার্থক্য আছে ধনী ও গরিবের। ওদিকে পুঁজিবাদ এগুচ্ছে, যে-ব্যবস্থা সাম্য আনে না, বরঞ্চ বৃদ্ধি করে বৈষম্য। এই পরিস্থিতিতে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লবের রণধ্বনি ছিল স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রীর। তিনটি আলাদা আলাদা নয়, একসঙ্গে। যে-মুক্তি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তার ভিত্তি হচ্ছে ওই তিনটি উপাদান-স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রী। স্বাধীনতাই প্রথমে আসে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, চাই সাম্যও, দরকার মৈত্রীও, যে দুটি কিছুতেই আসবে না সাম্য না থাকলে। ফরাসি বিপ্লব হঠাৎ করে ঘটেনি, তার পেছনে একটি প্রাণবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি ছিল। সে দেশে তখন রাজতন্ত্রের দুঃশাসন চলছে। সঙ্গে ছিল পুরোহিততন্ত্রের অত্যাচার। মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল, তারা স্বাধীনতা চাইছিল রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের হাত থেকে। কিন্তু এই বোধ তাদের ভেতরে ছিল যে, কেবল ওই দুই শত্রুর পতনেই মুক্তি আসবে না, যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে রেখেছে সেটাকেও দূর করা চাই, তার জন্য দরকার সাম্য, সাম্য না-থাকলে মৈত্রী আসবে না এবং সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা যদি মৈত্রীর না হয়ে হয় শত্রুতার, তাহলে তো সেই সমাজ মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত হবে না। সেখানে তৈরি হবে না সামাজিক শক্তির। বিপ্লবীরা তাই একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠা চেয়েছিল স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রীর।
তারপরে কী ঘটেছে তা আমরা জানি। ক্ষমতাসীনদের পতন ঘটেছে, ফলে এক ধরনের স্বাধীনতা এসেছিল বৈকি, কিন্তু সাম্য আসেনি। না-আসার দরুন স্থায়ী মৈত্রীও গড়ে ওঠেনি। আর সত্য তো এটাও যে, সাম্য না-এলে মৈত্রী তো পরের ব্যাপার, স্বাধীনতাও আসে না। কেননা বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থায় কারও স্বাধীনতা হয়ে পড়ে আকাশমুখী, কারও স্বাধীনতা (অর্থাৎ অধিকার) চলে যায় পাতালমুখে। সাম্য যেহেতু এলো না তাই রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেল অভিজাত ও পুরোহিতদের হাত থেকে বুর্জোয়াদের হাতে। তারাই হয়ে দাঁড়াল নতুন শাসক। কিন্তু সাম্য ও মৈত্রীর আকাক্সক্ষাটা তো রইল। যে জন্য প্রয়োজন হয়েছিল রুশ বিপ্লবের।
রুশ বিপ্লব মানুষের সভ্যতার জন্য আরেকটি আশা-তৈরিকারী ঘটনা। এর আদর্শগত অভিঘাত ফরাসি বিপ্লবকেও ছাড়িয়ে গেছে। লক্ষ্যটা ছিল বৈষম্য দূর করে মানুষকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করা, মানুষে মানুষে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলা। রুশ বিপ্লব কেবল রুশ দেশে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার প্রভাবে নানা দেশে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটেছে এবং যেখানে বিপ্লব ঘটেনি সেখানেও বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। মৈত্রীর আহ্বানটা আন্তর্জাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপাকে পড়ে পুঁজিবাদী দেশগুলো সমাজের দুর্বল অংশকে ছাড় দিয়েছে, কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাকে কমবেশি ধারণ করতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু পরে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও দেখা গেছে পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনুপ্রবেশ ঘটছে, ভোগবাদিতা বিকশিত হচ্ছে। সেখানেও আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছে। ফলে ওই বিশ্বেরও পতন ঘটল এবং বিশ্বময় পুঁজিবাদী দানব একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। ফলটা যে কেমন ভয়াবহ হতে পারে তা পুঁজিবাদের চরিত্র সম্পর্কে মৃদুকণ্ঠে সচেতনতা ব্যক্ত করেন যে উদারনীতিকরা তারাও অনুমান করতে পারেননি।
পুঁজিবাদকে ধমক দেওয়ার আজ কোনো সংগঠিত শক্তি নেই, তাকে শাসন করবে এমন ক্ষমতা কেউ রাখে না। ফলে তার স্বেচ্ছাচার ও ধ্বংস-তৎপরতা অবাধে, অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে। মার্কস-এঙ্গেলস লক্ষ করেছিলেন, পুঁজিবাদের দুঃশাসন ক্লেদ ও রক্তপাতে পৃথিবীকে পূর্ণ করে দেয়; সেটা যে কতদূর সত্য হতে পারে বিশ্ববাসী এখন তা দেখছে। সবচেয়ে উন্নত দেশ বলে গর্ব করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ভয় দেখানো হতো কমিউনিজমের, এখন দেখানো হচ্ছে সন্ত্রাসের। ভয় দেখিয়ে তারা ঘরে-বাইরে সমানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের রাষ্ট্রপ্রধান কথা বলেন দাম্ভিক বয়স্ক শিশুর মতো এবং নৈতিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে ওই মাপের বলেই তিনি নির্বাচিত সরকারের স্বৈরাচারী প্রধান হন, যে-সরকার নির্বাচিত হয় কারচুপি ও জালিয়াতির মাধ্যমে। তার আগেও নির্বাচনে সত্য ছিল কারচুপি, পরে ঘটেছে ইলেকটোরাল সিস্টেমের জালিয়াতি।
বস্তুত মানুষের সভ্যতা আজ যত বড় সংকটের মুখোমুখি হয়েছে তেমনটি অতীতের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। সাম্রাজ্যবাদীরা যেখানে ইচ্ছা গিয়ে যখন-তখন হানা দিচ্ছে, দুর্বল দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করছে, দখল করছে বাজার, ঋণ দিয়ে জালে আবদ্ধ করছে এবং বিপন্ন করছে প্রকৃতি ও পরিবেশকে। শ্রেণি-বিভাজনের সত্যকে অবলুপ্ত করে দিতে চাইছে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদকাসক্তি। বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে এইডসের। পদদলিত করছে বিশ্ব জনমতকে। হত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংস ইত্যাদিকে পরিণত করেছে নিত্যনৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক ঘটনাতে। সাম্রাজ্যবাদের মুখে এখন আর কোনো মুখোশ নেই। জাতিসংঘ তার হাতের পুতুল, অধিকাংশ রাষ্ট্রই তার হুকুমের চাকর। ঋণ, পরামর্শ, ভীতিপ্রদর্শন, আগ্রাসন কোনো ব্যাপারেই রাখঢাক হায়া-শরম নেই। পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ এখন নিরাপত্তাহীনতায় জর্জরিত। কোনো কিছুই আজ আর অকলুষিত নেই। এমনকি নির্মল খেলাধুলাও পরিণত হয়েছে টাকার খেলায়।
আমরা আছি পুঁজিবাদী বিশ্বের এক প্রান্তে। কিন্তু ওই বিশ্বের যত রোগ সবই আমাদের এখানে রয়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের লোকেরাই বলে দিচ্ছে যে, দুর্নীতিতে আমরা শীর্ষস্থানে আছি, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থান যদিও অত্যন্ত নিচুতে। আমাদের দেশে একসময় রক্ষীবাহিনী নেমেছিল; তারা যাকে ইচ্ছা হত্যা করত, এখন র্যাব নেমেছে, ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, নিরীহ মানুষকে মারা হচ্ছে না, যার অর্থ দাঁড়ায় তারা স্বীকার করছে, মানুষ মারা হচ্ছে। তাহলে বিচারের খবরটা কী? কে নিরীহ কে অপরাধী, এটা ঠিক করবে কে? বিচার করছে যারা হত্যাকারী তারা নিজেরাই। কিন্তু তাদের খবর কী যারা এসব তথাকথিত অপরাধীদের পালনকর্তা? আইনের শাসনের হালটা কী?
আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতা তো দেখা যাচ্ছে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই। স্বাধীনতার হিসাব পরে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাই নেই না অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, না জীবনের ক্ষেত্রে। ওদিকে রাষ্ট্র যে স্বাধীন তাও বলার উপায় নেই। যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের সংগ্রামে অতি তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছিল, এখন রাষ্ট্র চলে তাদের অঙ্গুলি সঞ্চালনে। দেশের শাসকশ্রেণি নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সাম্রাজ্যবাদীদের তোষণ করার ব্যাপারে। আর মুক্তি? সে তো সুদূরপরাহত।
পুঁজিবাদ যে মানুষের মুক্তিদাতা নয় সে তো পরীক্ষিত সত্য। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সূচনাকালে রোমান্টিক কবিরা আতঙ্ক প্রকাশ করেছিলেন এক নব্য দানবের অভ্যুদয় ঘটেছে ভেবে। আশঙ্কটা ছিল এই যে, দানবটি মানুষকে উৎপাটিত করবে, আশ্রয় থেকে তুলে তাকে নিয়ে আসবে বস্তিতে, মানুষের শ্রম পণ্যের মতো কেনাবেচা হবে বাজারে এবং সর্বনাশ ঘটবে প্রকৃতির, ধ্বংস হয়ে যাবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাদের সেই ভয় মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি। প্রকৃত ঘটনা যা ঘটেছে তা অবশ্য কবি-কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কেননা শিল্পায়নের ওই যে দৈত্য সে চলে গেছে পুঁজিবাদের অধীনে, যার ফলে সে হয়ে উঠেছে আরও নির্মম ও মদমত্ত। সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। মানুষকে পরিণত করছে ভোগবাদী প্রাণিতে। এই প্রাণীটি বিচ্ছিন্ন, একাকী, নিঃসঙ্গ, সে অন্য মানুষের সঙ্গে মৈত্রী গড়তে চায় না, চাইলেও পারে না। পুঁজিবাদী বিশ্বে সাম্য নেই, সাম্য সেখানে সম্ভবই নয়, কেননা সেখানে ধনীর জন্য স্বাধীনতা আছে আরও ধনী হওয়ার, অর্থাৎ দুর্বলকে লুণ্ঠন করার। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে নিরন্তর উৎসাহিত করে মুনাফা করতে, যার ফলে ব্যক্তি কেবল মুনাফাই চেনে, মনুষ্যত্ব চেনে না, এবং মুনাফা অর্জনকেই ভাবে চরিতার্থতার একমাত্র উপায়। সভ্যতা অনেক এগিয়ে আজ করাল গ্রাসে পড়ে গেছে বিবেকহীন ও রক্তপিপাসু এক দানবের।
আশার কথা এই যে, দানবের নিজের ভেতরেই অসুখ আছে এবং সেই অসুখের সুচিকিৎসা নেই। কিন্তু তাই বলে সে যে আপনা থেকেই পড়ে যাবে এমনও নয়। তাকে ধাক্কা দিতে হবে। প্রবল ভাবে, বহু হাতে, একত্র হয়ে। তা না হলে বিশ্বের মুক্তি নেই, স্বাধীনতাও নেই।
ধাক্কা দেওয়ার কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। ওই আন্দোলন আজ আর আগের মতো সুসংগঠিত অবস্থায় নেই, বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মানুষ আছে, তারা রুখে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বের সর্বত্রই পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে এবং হবে।
আমরাও ওই দানবের অধীনেই রয়েছি। যে জন্য স্বাধীন হয়েও স্বাধীন হইনি, মুক্তির জন্য দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করেও মুক্ত হতে পারিনি। মুক্তির সংগ্রামটা একাত্তরে শুরু হয়নি, সেটা তখনো ছিল যখন আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছিলাম। স্বাধীনতাই ছিল নিকটবর্তী লক্ষ্য, কিন্তু স্বাধীনতার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষাটা ছিল বলেই।
মুক্তির জন্য তাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রাম একইসঙ্গে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক। মুক্তিযুদ্ধটা ছিল কার বিরুদ্ধে? একসময় ছিল ব্রিটিশ, পরে এলো পাকিস্তানিরা, কিন্তু তাদের অবস্থানগত পরিচয় ছিল এক ও অভিন্ন, তারা ছিল শাসকশ্রেণি। আজ যখন আমরা আমাদের দেশে মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি তখনো শত্রু ওই একই, ওই শাসকশ্রেণি। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির ভেতর নানা দল-উপদল-কোন্দল, লাঠালাঠি সবই আছে, কিন্তু তারা এক এবং অভিন্ন বটে, তারা হচ্ছে শতকরা সেই পাঁচজন, যারা সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ-নিপীড়ন চালায়, জনগণকে পদে পদে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে। সেটা তাদের ঐক্যের একটা ভিত্তি বটে।
শাসক শ্রেণি আরও এক জায়গাতে খুবই একতাবদ্ধ, সেটা হলো সাম্রাজ্যবাদের তোষণ। তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি পুঁজিবাদী এবং তারা সাম্রাজ্যবাদের, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একনিষ্ঠ ভক্ত। তারা মনে করে, তাদের ক্ষমতায় থাকা না-থাকা জনসমর্থনের ওপর যতটা নয়, তার চেয়ে অধিক পরিমাণে নির্ভর করে আমেরিকার সমর্থনের ওপর। এবং নব্য ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের কৃপায়। মুক্তি সংগ্রাম আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি থাকবে এবং প্রতিপক্ষ যে স্বদেশি শাসক ও তাদের বিদেশি প্রভু এ বিষয়ে সন্দেহ থাকলে যা তৈরি হবে সেটা বিভ্রম ভিন্ন অন্যকিছু নয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের পর বিজয়ী আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে। যার ফলে শুরু হয় তীব্র রাজনৈতিক সংকট। যা শেষ পর্যন্ত গড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। সামরিক সরকারের অধীনে হলেও ’৭০-এর নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক ছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সবার আশা ছিল বাংলাদেশে একটা দারুণ নির্বাচনী পরিবেশ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গড়ে ওঠবে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে দীর্ঘদিন অসাংবিধানিক সরকারের দেশ শাসনের ফলে নির্বাচনী সংস্কৃতি হোঁচট খায়।
আজকের আলোচনায় স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোকে আমরা ৩ ভাগে ভাগ করে আলোচনা করব। ১. মোটা দাগে ভালো নির্বাচন ২. মোটামুটি মানের/ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ৩. নিয়ম রক্ষার নির্বাচন।
মোটা দাগে ভালো নির্বাচন
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মাচ। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল খুব শক্ত। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব¡দানকারী দলটি সে সময় বিরাট বিজয় পাবেÑ এটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯১টি আসন লাভ করে। যদিও এই নির্বাচনে খন্দকার মোস্তাকের জয়লাভ ও ডক্টর আলীম আল রাজীর পরাজয় নিয়ে কিছু সমালোচনা ছিল।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর আর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরÑ এই তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়। এই ৪টি নির্বাচনের মধ্যে ২টিতে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি ও তার শরিকরা এবং ২টিতে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা।
অন্তর্বর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনগুলোতে যে দলগুলো বিরোধী দল হিসেবে ছিল তারা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এবং যারা সরকারি দলে ছিল তারা পরাজিত হয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে।
পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে বিএনপি।
সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১ সালের ১ অক্টোবর। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির সরকার গঠন করে।
নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
মোটামুটি মানের নির্বাচন/ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন
এই ভাগে আমরা রেখেছি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটবে, নির্বাচন ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসবে বলে যারা মনে করেছিলেন তারা হোঁচট খান সে সময়ের শাসক দল বিএনপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ড দেখে। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৩ সালের দিকে মাগুরা ও মিরপুরে দুটি উপনির্বাচন হয়। যেখানে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে।
ইসরায়েলের হ্যাভরনে হযরত ইবরাহীম আ. এর রওজা শরিফে অনুষ্ঠিত প্রার্থনারত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠানে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নিরিখে নিন্দা প্রস্তাব আনতে ব্যর্থ হয়ে এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারের তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার তির্যক মন্তব্যের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সংসদ সদস্যরা সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন এবং আর কখনোই ওই সংসদের কোনো অধিবেশনে যোগদান করেননি। এর পরপরই বিরোধী দলগুলো সংবিধানে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের দাবি তোলে এবং ইস্যুটি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে।
বিএনপি সরকার অবশ্য সে দাবি মানেনি। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। বিএনপি সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে নিজেদের অধীনে নির্বাচন করানোর, বিরোধী দলগুলো দাবি করতে থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের। এমনই একটা সময়ে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ রক্ষার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বল্প মেয়াদি। আওয়ামী লীগসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচন বয়কট করে।
৩০ মার্চ ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া পদত্যাগ করলে পরে প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের আওতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
নির্দলীয় ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিএনপি ও জামায়াতের ভোট প্রতিহত করার হুমকির মুখে সরকার নির্বাচন আয়োজন করে। এ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে শাসক দল আওয়ামী লীগ। তবে এই নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নিয়ন্ত্রিত এবং একচেটিয়াভাবে নির্বাচন করার অভিযোগ ওঠে।
নিয়মরক্ষার নির্বাচন
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৩টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেনাশাসিত সরকারের অধীনে। যেগুলোকে আমরা নিয়মরক্ষার নির্বাচন বলে মনে করি। লে. জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন নবগঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২২০টি আসনে বিজয় লাভ করে। তৃতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ সালের ৭ মে। এরশাদের নেতৃত্বাধীন নবগঠিত জাতীয় পার্টি সে নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৮৩টি আসনে জয়লাভ করে। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। তখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বড় দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল। ফলে এরশাদ সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়।
স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও নির্বাচন কমিশন গঠন ও পদ্ধতি তৈরি করা যায়নি
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো কমিশন গঠন হয়েছে সেগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে, প্রথমে আইনে নির্দিষ্ট করা ছিল না। ফলে রাম, যদু, মধু যাকে ইচ্ছা কমিশনে বসানো যেত। যখন যাকে ইচ্ছা কমিশনে নিয়ে আসার সুযোগ ছিল, এমনকি কমিশনের সদস্য সংখ্যা একেক সরকার একেকরকম করেছিল। যেটা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আমরা দেখলাম, যে কমিশন কাজ করেছিল, তাদের কি প্রক্রিয়ায় পদায়ন করা হয়েছিল, সেটাও কিন্তু স্পষ্ট নয়। যদিও পারফরম্যান্সের দিক থেকে তাদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। আবার এরপর আমরা দেখলাম সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশনে পদায়নের ব্যবস্থা করতে, তারপর আইন প্রণীত হলো।
কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা রয়েছে। আগের বার যখন সার্চ কমিটির মাধ্যমে ১০ জনের একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছিল এবং সেখান থেকে ৫ জনকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিয়েছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তখন কিন্তু এই তালিকায় থাকা ১০ জনের পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত ৫ জনের পরিচয় আমরা জানতে পারলেও সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা বাকি ৫ জনের পরিচয় জানা যায়নি।
সর্বশেষ আমরা বলব, নির্বাচনের পূর্বে, নির্বাচনের ক্ষেত্রটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল করা যায় কিনা, সেটা নিয়ে তারা কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন বা করবেন সেটা দেখার এখনো অনেক সময় বাকি। এই মুহূর্তে কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা।
দেশের রাজনীতির অঙ্গনে বড় দলগুলো পরস্পরকে অনেক ক্ষেত্রে পারস্পরের আনুষ্ঠানিক দেখা-দেখি পর্যন্ত বন্ধ। রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে এক দলের নেতা, অন্য দলের অফিসে যাবে-বড় দলগুলো এটাকে পর্যন্ত দলীয়করণ করেছে। তৃণমূল পর্যায়ে, সমাজের অনেক ক্ষেত্রে এসব দলের বিভাজনে স্পষ্ট ভাগাভাগি হয়ে গেছে। অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে তার ছাপ মেলে। ঘায়েল করার জন্য দোষারোপকে সামনে আনছে প্রতিনিয়ত। ব্যক্তিগত পর্যায়েও দোষারোপ পৌঁছাচ্ছে। অধিকাংশ প্রচার মাধ্যম এটাকেই প্রধান করে তুলেছে। রাজনীতি মানে যেন, এ ধরনের দোষারোপ-এটি মনে করছে অনেকে।
এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের, দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক ঘটনা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এ বিষয়ে অন্য সময় আলাপ করা যাবে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কী এমন ছিল? ব্রিটিশদের হাত থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে নানা মাত্রায় লড়াই সংগঠিত হয়েছিল। ঐ সময় রাজনৈতিক দল কগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ঐ সময়ে প্রকাশ্য প্রধান দল কংগ্রেস-মুসলিম লীগের মধ্যে সম্পর্ক, বাক্য বিনিময় ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য প্রকাশ্যে কম এলেও নানা মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এসব ক্ষেত্রে অশালীন ভাষার পরিবর্তে যার যার অবস্থান থেকে যুক্তিতর্কই সামনে এসেছে। দেখা সাক্ষাতে পারস্পরিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত খোঁজখবর অনেক সংকট মোকাবিলায়, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রেখেছে।
একথা বলে নেওয়া ভালো যে, একজন রাজনীতির ছাত্র হিসেবে জানি, রাজনীতি অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ। একটা রাজনৈতিক দল শ্রেণি স্বার্থের ঊর্ধ্বে নয়। কোনো না কোনো শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় এসব দল গঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে এখন আলোচনা নয়। কথা বলছি রাজনৈতিক সামাজিকতা, সংস্কৃতি নিয়ে।
পাকিস্তান আমলে বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশ ও এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ মেলে। গোপনে দেখা সাক্ষাৎ, পারস্পরিক সহায়তা, অনেক রাজনৈতিক সংকট দূর করতে সহযোগিতা করেছে।
পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার দীর্ঘ লড়াইয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অপশক্তি, মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে এরা চিহ্নিত শত্রুপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাদের ঘৃণ্য অপকর্ম রাজনৈতিক অঙ্গনে এই সহনশীল মাত্রাকে বৈরী পরিবেশে তৈরি করে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর স্বাধীন দেশেও আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতির পরিবেশে রাজনৈতিক নেতাদের প্রকাশ্য কথোপকথনের বাইরে পারস্পরিক সম্পর্কের খবর, নানাভাবে খবরাখবর নেওয়া সহায়তা করার কথা-বার্তা জানা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এমন উদারতার খবর পাওয়া যায় যা রাজনৈতিক বৈরী আদর্শের সঙ্গে মাননসই পর্যন্ত ছিল না।
রাজনীতির নানা উত্থান-পতনে, নানা সময়ে পরিবেশ একরকম না থাকলেও এসব ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান প্রাধান্য পায়। আজ এই অবস্থায় ভিন্ন মাত্রা চোখে পড়ছে।
টেলিভিশন টকশো, গুটিকয়েক সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়া রাজনীতিকদের একত্রিত হওয়ার জায়গা কম। বড় বিষয় হলো, এসব ক্ষেত্রে রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ প্রধান হলে দলীয়, গোষ্ঠী স্বার্থ বিবেচনায় পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে যায়। সৌহার্দ্য চলে যায় অন্তরালে। পক্ষ-বিপক্ষে চিহ্নিত করায়ও প্রবণতা এই দূরত্ব বাড়িয়ে তুলছে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রম করছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করলেও দেশের অধিকাংশ মানুষের মুক্তি অর্জিত হয়নি। এটি না হওয়া পর্যন্ত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম, আন্দোলন চলবে। বিশেষ করে কমিউনিস্ট, বামপন্থিরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতির ভিত্তিতে দেশকে অগ্রসর করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখছে, রাখবে।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রত্যাশা অনেকে করেছিলেন সেটি অর্জিত হয়নি। সংকট ছিল। শ্রেণিস্বার্থের পরিচালিত দলগুলো তার স্বার্থরক্ষায় এগুবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে সংঘাত, সংঘর্ষ অনিবার্য। ঘটছেও তাই।
বহুদলীয় গণতন্ত্রে দেশ পরিচালনার কথা বলে এক ধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা করে এগুনোর চেষ্টা করলেও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, শ্রেণিস্বার্থে ক্ষমতার ব্যবহার একচ্ছত্র ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ একে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই পরিবেশের অবসান হয়নি। বরং বেড়েছে।
ক্ষমতাশ্রয়ী দলগুলোর যার যার অবস্থানে যতটুকু তাদের বিবেচনায় আদর্শচর্চার মধ্যে ছিল, মানুষের স্বার্থরক্ষায় কিছুটা প্রাধান্য দিত তার থেকে পিছিয়েছে। বিপরীতে ক্ষমতার রাজনীতি বেড়েছে। এই ক্ষমতাই যেন সব। সব ক্ষমতা এক এক জায়গায় এক এক ব্যক্তি, গোষ্ঠীকে নতুন জমিদারে পরিণত করেছে। এর ফলে এসব ক্ষেত্রে সংস্কৃতিতে গোষ্ঠী বিভেদ, ব্যক্তি বিভেদ পরিচালিত হচ্ছে দলগুলোকে ঘিরে। দলগুলোকে ব্যবহার করাও হচ্ছে এখানে।
তাইতো নানা সময়ে এসব দলের মাঝারি সারির অনেককে বলতে শুনি, ‘কী করব আমরা তো... এমডি’র অধীনে আছি।’
৯০ দশকে এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সামনে সংকট নিরসনে পথযাত্রার এক পথ দেখিয়েছিল।
দীর্ঘ আন্দোলন, জীবনদানের অভিজ্ঞতায় তিন জোটের রূপরেখা ও আচরণবিধি প্রণীত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কথা হলো :
‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। দক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।’ ‘অসাংবিধানেক বা সংবিধান বহির্ভূত কোনো পন্থায়, কোনো অজুহাতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না।’
সেই সঙ্গে বলা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দমন, সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রপাগান্ডা বন্ধ এবং এদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনা। বলা হয়েছিল রাজনৈতিক সংকট হলে পারস্পরিক কথা বলে সমস্যা সমাধানের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা।
আদর্শকে প্রধান না করে ক্ষমতাশ্রয়ী বড় দলগুলোর কাছে এসব থেকে গেছে কথার কথা হিসেবে। এরপরও রাজনীতিতে নানা ঘটনা, এমনকি রাজনৈতিক দলের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। যার যার সুবিধামতো ইতিহাস রচনা চলছে। এসব ঘটনা আর রাজনীতি ব্যক্তি, গোষ্ঠীর লাভলাভে পরিণত হওয়ার জন্য ‘ক্ষমতা’ নামক সোনার হরিণকে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে নেওয়া সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে।
স্বাধীনতা দিবসের এই ক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে দেশ-দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে জনগণের শক্তিকে জাগ্রত করেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে।
খাদ্য উৎপাদন ও দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য অসাধারণ। স্বাধীনতার পর বিগত অর্ধ শতাব্দীতে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের কিছু বেশি, কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও অধিক; এখন খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪ কোটি টনের কাছাকাছি। বাংলাদেশ চাল, মাংস, মাছ সবজি উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। এত সব অর্জন সত্ত্বেও এক্ষেত্রে আত্মপ্রসাদ লাভের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, লভ্যতার বাইরেও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে জটিল অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জৈবিক প্রক্রিয়া। এসব ক্ষেত্রে এখনো অনেক কাজ বাকি। অধিকন্তু বর্তমানে অনেক নতুন নতুন সমস্যা ও সংকট আবির্ভূত হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলার জন্য আলাদা ভাবে সম্পদ সংস্থান ও উপযুক্ত কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমানে দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮০ লাখ হেক্টরের মতো। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশ জমি সেচের আওতায় এসেছে। বাকি জমির খুব কমই সেচের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। জমিতে আবাদের ঘনত্ব ১.৮। ফলে এটা বৃদ্ধিরও তেমন কোনো সুযোগ নেই। আবার প্রতি বছর ০.৭৪ শতাংশ হারে কৃষিজমি আবাসন ও নানাবিধ অকৃষি কাজে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নগরায়ণ ও শিল্পায়ন বৃদ্ধি এবং মানুষের আয় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ বেদখলের মাত্রা ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাবে।
দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের হার ইতিমধ্যে যথেষ্ট কমলেও এখনো একটি বড় জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীন ও ক্ষুধায় আক্রান্ত। দরিদ্র ও অতিদরিদ্র- এই দুই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি; এই তথ্য কভিডের আগের। কভিডের অচলাবস্থা ও সরবরাহ বিপর্যয়ে স্বল্প রোজগেরে অনেক মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার ও দরিদ্র হয়ে যায়। এসব নতুন দরিদ্র মানুষকে যুক্ত করলে কভিড-উত্তর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কম পক্ষে সাত কোটি বলে বেসরকারি অনেক থিংকট্যাংক প্রাক্কলন করে থাকেন। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতিতে এখন যে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির দাবদাহ চলছে এবং এদেশের মানুষও যে সে অনল প্রবাহে গলদঘর্ম হচ্ছে, তাতে এটা নিশ্চিত যে, দেশে আরও কিছু মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাবে। তাছাড়া, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় স্থানীয় ভাবে আরও কিছু মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে চলে আসে।
খাদ্য নিরাপত্তায় যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা এখনো লিঙ্গ বৈষম্যকে ভেদ করতে পারেনি; এখনো পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তার প্রথম আঘাত আসে নারীর ওপর। অথচ নারীর খাদ্য নিরাপত্তা তার পরিবার ও দেশ- উভয়ের জন্যই অধিকতর ফলপ্রসূ।
সাধারণ মানুষের খাদ্যের মান ও বৈচিত্র্যের অভাব এখনো প্রকট। এখনো নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যশক্তির প্রায় ৭৭ শতাংশ আসে খাদ্যশস্য ভোগ থেকে। খাদ্যে বৈচিত্র্য না আনতে পারলে পুষ্টির অভাব দূর করা যাবে না।
দেশে অপুষ্টির প্রকোপ ব্যাপক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল খর্বকায়তায় আক্রান্ত পুষ্টিহীনতা। এখনো ২৮ শতাংশ শিশু খর্বকায়তার বেড়াজালে বন্দি এবং তাদের ভাগ্যোন্নয়নের গতি অত্যন্ত মন্থর।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা খাদ্য নিরাপত্তার আরও অবনতি ঘটাতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ১৭ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যেতে পারে এবং ৩০ শতাংশ খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার প্রাক্কলন আছে। উল্টো দিকে, নদীমাতৃক এই দেশে সেচের জন্য পানির সমস্যা ক্রমে প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। কৃষির জন্য এটি একটি অশনি সংকেত।
উৎপাদন কমার পাশাপাশি এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাস্তুচ্যুত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া, লবণাক্ত পানির প্রভাবে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে; বিশেষ করে গর্ভবতী নারীরা রক্তচাপজনিত প্রি-এক্লামশিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ভূমি-বুভুক্ষু এই দেশে এখন আবার ঘাঁটি গেড়ে বসেছে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু।
বাংলাদেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্যও বেড়ে যাচ্ছে, এ পরিস্থিতি দারিদ্র্য বিমোচন ও সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে আদৌ অনুকূল নয়। দেশে এখন সম্পদের কেন্দ্রীভবন হছে; ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা আরও গরিব হয়ে পড়ছে। ১৯৭৩ সালে দেশে জিনি সহগ ছিল ০.৩৬, আর ২০১৬ সালে এর মান পৌঁছে গেছে ০.৪৮৩ এতে। বৈষম্য পরিমাপের এই স্কেলে ০ হলো সব মানুষের আয় ও সম্পদের সমতা এবং ১ হলো সব আয় ও সম্পদের এক হাতে কেন্দ্রীভবন নির্দেশ করে। বর্তমানে দেশে আয় বৈষম্যের আনুষ্ঠানিক চিত্র নেই। তবে আমেরিকান ক্রেডিট সুইচ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডাটাবেইজ থেকে দেখা যায় যে, ২০২১ সালে কভিডের দুঃসময়েও দেশে মিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ হারে (দৈনিক বণিক বার্তা, ৫ ফেব্রুয়ারি,২০২৩)।
খাদ্য ও পুষ্টি প্রকৃতপক্ষে জটিল ও বহুমাত্রিক একটা সমস্যা। এজন্য এর টেকসই সমাধানের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে একযোগে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। নিচের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হলে এক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়ার সম্ভবনা বেশি।
কৃষির উন্নয়ন হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি সহজ হয়; আর বৈষম্য ও দারিদ্র্য হ্রাস ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জমিতে একই পণ্য উৎপাদনের চর্চা কৃষিকে যেমন ভঙ্গুর করে ফেলেছে, তেমনি জনস্বাস্থ্যেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। উপর্যুপরি একই ফসল ফলানোর জন্য ভূমির স্বাস্থ্যহানি ঘটছে, উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে, রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। ভূমির প্রাণ বলে বিবেচিত জৈব পদার্থের মাত্রা গড়পড়তা ২ শতাংশের নিচে নেমে গেছে; এতে ফলন বৃদ্ধি বিঘিœত হচ্ছে এবং কৃষি টেকসই করা দুরূহ হয়ে পড়ছে।
এর বিপরীতে বহুমুখী ও পুষ্টি সংবেদনশীল কৃষিব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে পারলে কৃষি নিজে নিজেই যেমন টেকসই হতে পারে, তেমনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হতে পারে। এ ব্যবস্থায় চাষিরা নিজেরাও সে সবের ভাগীদার হতে পারেন। পুষ্টিকর এসব কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সবার জন্য সুলভ হবে। এসব পণ্য বাজারজাত করার জন্য পল্লী অঞ্চলে মৌসুমভিত্তিক কর্মসৃজনের পরিবর্তে বছরব্যাপী গতিশীল কর্মসৃজনের ক্ষেত্র তৈরি হবে।
টেকসই খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেছে যে, নারীর ক্ষমতায়ন হলে কৃষক পরিবার বহুমুখী চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাছাড়া, ক্ষমতায়িত নারী পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে অধিক হারে যুক্ত হয়। ফলে পরিবারের খাদ্যাভ্যাসেও সহজে পরিবর্তন আসে।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আগাগোড়াই বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে এক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় জিডিপির ৩ শতাংশ এবং মোট সরকারি ব্যয়ের ১৮ শতাংশের মতো। এই বরাদ্দ থেকে অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ বাদ দিলে প্রকৃত বরাদ্দ ২ শতাংশের বেশি হবে না। এটা বাড়ানো দরকার।
এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো কর্মসূচি ও সুবিধাভোগী নির্বাচনে সমন্বয়হীনতা; আট নয়টি মন্ত্রণালয় পরিচালিত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় থাকে সামান্যই। ফলে দ্বৈততা বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক অবস্থার তৈরি হয়। এতে কর্মসূচিভিত্তিক সুবিধাভোগী প্রতি সম্পদের পরিমাণ অপ্রতুল হয়। তাছাড়া, এসব কর্মসূচির বেশির ভাগই পুষ্টি-নিবদ্ধ নয়; আয়-নিবদ্ধ। এসব ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে সরকার ২০১৫ সালে ন্যাশনাল সোশাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি (এনএসএসএস) এর আওতায় ব্যাপকভিত্তিক সুসমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম গড়ে তোলার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করে। তবে এ কৌশল এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ কৌশল দ্রুত পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে এবং অপুষ্টি ও লক্ষ্যচ্যুতির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
আসলে পুষ্টির বিষয়টা বহুমাত্রিক ও জটিল। শুধু আর্থিক সক্ষমতাই পরিবারের পুষ্টির নিয়ামক নয়। অপুষ্টি শুধু দরিদ্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে সচ্ছল পরিবারের শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করাও অপুষ্টির শিকার হতে পারে।
২০১৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, জনসংখ্যার সবচেয়ে সচ্ছল এক-পঞ্চমাংশের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচ জন শিশুর মধ্যে একজন খর্বকায়তায় ভুগছে। আবার দেশের এমন কিছু এলাকা রয়েছে, যেখানে দারিদ্র্যের প্রকোপ বেশ হওয়া সত্ত্বেও খর্বকায়তার হার সর্বনি¤œ। কাজেই এই বহুমাত্রিক ও জটিল সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে জনপ্রতি ভূমির পরিমাণ খুবই কম। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এ অনুপাত আরও সংকুচিত হবে। এজন্য এই স্বল্প জমি কাজে লাগিয়ে কীভাবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানো যায়, তার জন্য ভূমি সাশ্রয়ী কৃষির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন নতুন পদ্ধতিতে খাদ্যশস্য, পশুসম্পদ, মৎস্যসম্পদ ও জলজ খাদ্যপণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। শস্যের জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে মানুষের পুষ্টি চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের বিশাল সমুদ্রের অফুরন্ত জলজ ও মৎস্যসম্পদকে পুষ্টির হাতিয়ারে পরিণত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ভাবে গবেষণার মাধ্যমে ফেলনা ও মূল্যহীন জিনিসগুলোকে সম্পদে রূপান্তর করার ব্যবস্থা নিতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সমস্যাকে বাগে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে সমস্যাটি সামনে চলে আসছে, সেটা হলো উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার যেভাবে কমে আসছিল, বর্তমানে উন্নয়নের গতিবৃদ্ধি সত্ত্বেও সে হার অনেকটা স্থবির হয়ে গেছে; দরিদ্র ও অতি-দরিদ্রদের হার যথাক্রমে ২০ ও ৮ শতাংশের মধ্যে নেমে অনেকটা থমকে দাঁড়িয়েছিল। কভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার ফলিত মুদ্রাস্ফীতি এখন আবার সেই প্রক্রিয়াকে উল্টোপথে চালিত করেছে। এটা উন্নয়নের মডেলে সংশোধন আনার বার্তা দিচ্ছে।
এজন্য দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাকে বিচ্ছিনভাবে চিন্তা না করে সামগ্রিক উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং এ নিরাপত্তা অর্জনে সমধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। একাজে অনেক সেক্টর ও সংস্থা সংশ্লিষ্ট; আবার সময়ের দিক থেকে লক্ষ্য অর্জনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণও প্রয়োজন। কাজেই এই উল্লম্ব ও আনুভূমিক কর্মকাণ্ড সমন্বয়ের জন্য এনএসএসএস-নির্দেশিত পথে প্রয়োজনীয় কাঠামো গড়তে হবে। বাংলাদেশ অনেক অনেক প্রতিবন্ধকতা ও নিন্দাবাদ অতিক্রমে করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আজ এমন এক সম্ভবনাময় স্থানে জায়গা করে নিয়েছে, যেখানে তার নিন্দুকেরা পর্যন্ত বাহবা দিচ্ছে। কাজেই সঠিক ভাবে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে তার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন করাও কোনো কঠিন কাজ নয়। তবে এদেশে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও সমন্বয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য বড়ই করুণ। স্মার্ট বাংলাদেশে এই দুইটি কাজ স্মার্টলি করে সাফল্য ঘরে তুলতে হবে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিকাশ নিয়ে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের একটা ভাষ্য আছে। ‘সংস্কৃতিকর্মীদের স্বাধীনতার আন্দোলন’ শীর্ষক রচনায় তিনি লিখেছিলেন, ১৯৪৮ সালে রিক্ত, নিঃস্ব পূর্ববাংলার ওপর যখন ভিন্ন ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হলো, তখন এই বাংলার মানুষ একটা বড় ধাক্কা খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এই যে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি। বিষয়টি লঘুচালে বলা হলেও এর গভীর দিকটি দৃষ্টি এড়ায় না।
১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও মর্মান্তিক এই ভুল পরবর্তী ২৩ বছরে সংশোধন করে নেওয়া হয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আর প্রথম থেকেই এই রাষ্ট্রের জন্মবেদনা বহন করেছে এর সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরেও এই প্রভাবের দেখা মিলেছে।
এমনিতে অর্ধশতাব্দীর পথচলায় অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতির সাক্ষী হয়েছে বিশ্ব। অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্জন কম নয়। আবার অপ্রাপ্তির তালিকাও দীর্ঘ। আর এই অর্জন-অপ্রাপ্তির খানিকটাতে হলেও মুহূর্ত হয়ে থেকেছে বাংলাদেশের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ফ্যাশন ও খেলাধুলা।
গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে। তারা শুধু প্রবাসীই হননি, সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি। তাই বিশ্বজুড়েই প্রয়োজন হয় বাংলা ভাষার, বাংলা গানের, বাংলা সিনেমার, এমনকি পোশাকেরও।
গত ৫০ বছরের বাংলাদেশে কবি-সাহিত্যিকরা কম লেখেননি। এখানে মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, রাজনীতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, রহস্যসহ অনেক রকম বিষয়কে আশ্রয় করে উপন্যাস লেখা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে, রশীদ করিমের ‘আমার যত গ্লানি’, শওকত ওসমানের ‘দুই সৈনিক’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘যাবজ্জীবন’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’, শওকত আলীর ‘প্রাদোষে প্রাকৃতজন’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াব নামা’, শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’, আনিসুল হকের ‘ফাঁদ’, মশিউল আলমের ‘তনুশ্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় রাত’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, মামুন হোসাইনের ‘নিক্রপলিস’, শাহীন আখতারের ‘তালাশ’ এগুলো বাংলাদেশে লেখা উপন্যাস। এ ছাড়াও রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, রাহাত খান লিখেছেন। সম্ভবত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ছাড়া প্রায় সবাই বাংলাদেশ হওয়ার পর লেখার সুযোগ পেয়েছেন।
আবার কবিতায় শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’, আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’, নির্মলেন্দু গুণের ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’, শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তম’, আবুল হাসানের ‘পৃথক পালঙ্ক’, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘উপদ্রুত উপকূল’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ‘তনুমধ্যা’, মাসুদ খানের ‘পাখিতীর্থদিন’ -এর মতো বই লেখা হয়েছে।
ছোটগল্প, শিশুসাহিত্য, নাটক, কাব্যনাট্য, অনুবাদ, গবেষণা ও অন্যান্য বইয়ের কথা উল্লেখ না করেও বলা যায়, ৫০ বছরে এতগুলো ভালো ও জনপ্রিয় বই আসলে যথেষ্ট প্রাপ্তি। এর মধ্যে কিছু কিছু অন্য ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। কিন্তু সংখ্যাটা অপ্রতুল, অনুবাদের মান নিয়েও আছে প্রশ্ন।
অপরদিকে সেলিম আল দীনসহ অনেক লেখকের বই বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। সেগুলো কেমন প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে আলোচনাও নেই। বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ বইমেলার একটি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। বাংলাদেশের কোনো কোনো প্রকাশক প্রতিবছর সেখানে দেশের বই নিয়ে হাজির হন। কিন্তু কোনো বারই বিস্তারিত কিছু জানান না। ফলে আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের সাহিত্যের গ্রহণযোগ্যতা এক ধরনের ধোঁয়াশা থেকে গেছে।
তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশের ইংরেজি লিখিয়ে কায়সার হক, তাহমিমা আনাম, ফারাহ গজনবী, মাহমুদ রহমান, কাজী আনিস আহমেদ, খাদেমুল ইসলামের মতো লেখকদের বই ছাপা হচ্ছে বিশ্বখ্যাত সব প্রকাশনী থেকে, যা অচিরেই দৃষ্টি ফেরাতে পারে বাংলাদেশের সাহিত্যের দিকে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সংগীতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুটোর মিশ্রণই রয়েছে। আছে বাউল, ভাটিয়ালি, জারি-সারি, মুর্শিদি গান। এ ছাড়াও সত্তর-আশির দশকে উপমহাদেশজুড়ে খ্যাতি কুড়িয়েছেন রবিন ঘোষ, আলাউদ্দীন আলী বা লাকী আখন্দের মতো সুরকাররা। বাংলাদেশের রুনা লায়লা, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, জেমস, আইয়ুব বাচ্চুর শ্রোতা আছে বিশ্বজুড়েই।
বর্তমানে অনেকে আছেন যারা প্রবাসে থেকেও সংগীতচর্চা ধরে রেখেছেন। তাদের মধ্যে আছেন আর্ক ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান টুলু, ভাইবের লিড গিটারিস্ট অনি হাসান। তালিকায় রয়েছেন ওয়ারফেজের সাবেক গিটারিস্ট-কিবোর্ডিস্ট রাসেল আলীও। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। কাজ করেছেন ডেমি লোভাটো, লিম্প বিজকিটের সঙ্গে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বসংগীতের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ গ্র্যামির আসরে ধারাবাহিকভাবে উপস্থিত থেকেছেন বাংলাদেশের এলিটা করিম, তাহসান, হাবিব ও জোহাদ। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে প্রথমদিকে এসব ভাবাই যেত না। বর্তমানে অনেক আন্তর্জাতিক স্ট্রিম প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে উপস্থিত। বা বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজ সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যেই কাজ করে চলেছেন ফুয়াদ, অর্ণব, ফারুক ভাই, দামীর। তাদের শ্রোতাও কম নয়। তবে সেগুলো খুব বেশি যোগবোধক হয়েছে তা বলা যায় না।
সিনেমার ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন। তবে বাংলাদেশের গল্প বলা থামাননি পরিচালকরা। প্রথম দিকের পরিচালক যেমন জহির রায়হান, আলমগীর কবির, আমজাদ হোসেনদের নির্মিত সিনেমাগুলো দেশের বাইরে খুব বেশি প্রচার হয়নি। পরবর্তীতে তারেক মাসুদ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, কামার আহমাদ সাইমনের মতো নির্মাতারা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মের জগতে মোটামুটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন।
আশা আছে বাংলাদেশের ফ্যাশন নিয়েও। গত ৫২ বছরে সময়ের সঙ্গে বদলেছে বাংলাদেশের ফ্যাশন। দেশের ফ্যাশন জগতের আইকন বিবি রাসেলের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত তাঁতপল্লীতে গিয়ে গামছা, খাদি কিংবা জামদানির মতো দেশীয় বস্ত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছিলেন তিনি। চেষ্টা করেছিলেন দেশীয় হস্তশিল্পকে বিশ্ববাজারে পরিচয় করিয়ে দিতে। এ ছাড়াও আছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আড়ংয়ের দৃঢ় ভূমিকা। ভূমিকা রেখেছেন এমদাদ হক, বিপ্লব সাহার মতো ফ্যাশন ডিজাইনাররা।
যদিও অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় পোশাকের কার্যকর উপস্থাপন নিয়ে সরকারি প্রচেষ্টা খুব কম। আর যেসব উদ্যোগ কর্তৃপক্ষ নেয় তাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়হীনতা থাকে।
অবশ্য বিপরীত চিত্র ক্রীড়া ক্ষেত্রে। এক সময় ফুটবল খুব জনপ্রিয় ছিল বাংলাদেশে, বর্তমানে যা দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট। বাংলাদেশের সাবেক ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন, বাদল রায়, কায়সার হামিদ, আশরাফ চুন্নু, মোনেম মুন্না, আসলাম, সৈয়দ ওয়ালি সাব্বির, আরিফ খান জয়, আলফাজ আহমেদ, আরমান মিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই ধারা অক্ষুণ্ন রেখেছেন জামাল ভূঁইয়া। কিন্তু ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা, মোহাম্মদ আশরাফুল, মোহাম্মদ রফিক, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমানের পরিচিতি ছড়িয়েছে আরও দূর। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিখ্যাত দাবাড়– নিয়াজ মোর্শেদ, টেবিল টেনিস প্লেয়ার জোবেরা রহমান লিনু বা হকির জুম্মন লুসাইকেও চেনে অনেকেই। দলগত গুরুত্বপূর্ণ অর্জন উল্লেখযোগ্য কিছু না থাকলেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা বারবার জিতে নিয়েছেন মানুষের মন, যা কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ড।
তবে খেলোয়াড়রা জনপ্রিয়তা পেলেও এমন নয় যে পুমা, নাইকি ও এডিডাসের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করছে।
ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ থাকছে না বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে একটি মহল পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য এসেছে। আর ওই তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার পুলিশের সব রেঞ্জ অফিস ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষ বার্তা পেয়ে ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোমবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিদ্যুৎ স্টেশনে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি মহল লোডশেডিংয়ের অজুহাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশেষ বৈঠক করছি। এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তা সত্য। এ জন্য আমরা বেশ সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ অফিস ও স্টেশনগুলোর বিষয়ে থানার ওসিদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি বিশেষ মহল। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তা ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ অফিসের পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে ৫০ থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাইকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যা নিয়ে কোন মহল যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। আশা করি বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে না। তারপরও পুলিশ সতর্ক আছে।
সূত্র জানায়, লোডশেডিংকে পুঁজি করে কেউ যাতে অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনার পর সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস, সাবস্টেশনসহ কেপিআই স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সমিতি বা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশকে চিঠি দিয়ে বাড়তি নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল দেশের সর্ববৃহৎ পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। গতকাল সোমবার দুপুরে কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কয়লা সংকটে গত ২৫ মে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বন্ধ হয়। ২০২০ সালে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পর এবারই প্রথম কয়লা সংকটে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ হলো।
চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগের এই বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানটিকে কয়লা ক্রয়ে ঋণ দিয়ে আসছে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি (সিএমসি)। এপ্রিল পর্যন্ত কয়লার ৩৯০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সিএমসি। পরে ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হলে কয়লা আমদানির এলসি খোলার শর্ত দেয় চীনা প্রতিষ্ঠান। গতকাল পর্যন্ত ৯৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এ মাসের শেষদিকে কয়লা দেশে আসার কথা রয়েছে।
কয়লার অভাবে দেশের সবচেয়ে বড় এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এক মাসে লোকসান হবে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে জনদুর্ভোগ ও কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে পুরো ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
এদিকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের বাইরে শুধু কয়লাবাবদ পিডিবির কাছে কেন্দ্রটির বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে থাকা এ বকেয়ার টাকা পরিশোধের জন্য দফায় দফায় চিঠি দিয়েও তা পরিশোধ করা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলার কারণেই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নিজেদের দায় অস্বীকার করে বলছে, বৈশি^ক মন্দার পরিস্থিতিতে ডলার সংকটের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি কেন্দ্রভাড়া বাবদ প্রতি মাসে পিডিবিকে ২৪৭ কোটি টাকা দিতে হবে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও নির্ধারিত কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্নভাবে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট করে প্রায় তিন কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল কেন্দ্রটি। প্রতি মাসে এর পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি ইউনিট। গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ছিল ৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৬ টাকার মতো।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফার প্রকৃত জানা না গেলেও নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানান, সব ধরনের ব্যয় বাদ দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে তাদের নিট মুনাফা হতো ৫ থেকে ৬ শতাংশ। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড়মূল্য সাড়ে ৫ টাকা এবং মুনাফা সাড়ে ৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির এক মাসে মুনাফার পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় এ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবে বিসিপিসিএল। এদিকে কয়লা কেনার জন্য সাড়ে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। গত ছয় মাসের বেশি সময় কয়লার বিল বকেয়া থাকায় সুদের পরিমাণও বেড়ে যাবে। বাড়তি এ সুদের অর্থ বিসিপিসিএলকেই পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের প্রতি ইউনিটের গড়মূল্য প্রায় ১১ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও পিডিবি এ বিদ্যুৎ লোকসান দিয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে ৮ টাকা ১০ পয়সায়। পায়রা থেকে এক মাস বিদ্যুৎ কিনতে না পারলে পিডিবির লোকসান আরও বাড়বে।
সূত্রমতে, কয়লা দেশে পৌঁছানো এবং কেন্দ্র চালু করতে সব মিলে অন্তত এক মাসের মতো সময় লাগবে। কোনো কারণে যদি কয়লা আসতে আরও দেরি হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিশে^র সেরা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক সুইচে চালু করার পর নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও বৈশি^ক কারণে ডলার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। তবে এ সময়ে আমরা বসে না থেকে কেন্দ্রের মেইনটেনেন্সের কাজটি করে ফেলব, যাতে দীর্ঘদিন আর মেইনটেনেন্স করা না লাগে।’
কেন্দ্রটি বন্ধের ফলে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে তা জানতে চাইলে প্ল্যান্ট ম্যানেজার শাহ আবদুল মওলা দেশ রূপান্তরকে বলেন ‘আমরা এমনিতেই বকেয়া বিল পাচ্ছি না। এটাই বড় ক্ষতি। অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি কেন্দ্রটি বন্ধের কারণে সাশ্রয়ী দামে দেশের মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দিতে না পেরে কমফোর্ড ফিল করছি না।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেন্দ্র ভাড়ার পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তি এবং কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেও এ ক্ষতির পরিমাণ অপূরণীয়। আর লোডশেডিং না দিয়ে সরকার যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়, তাহলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই এই মুহূর্তে। সে ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে ৪ টাকার ওপর লোকসান হবে।’ তিনি বলেন, ‘ডলার ছাড় ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার আগেই ডলার ছাড় করা উচিত ছিল। এতে বিরাট ক্ষতি হলো। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারে। একটি হলো যারা ডলার ছাড় করছেন তারা বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না অথবা দেশের পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ। তবে দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে অবশ্যই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডলার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে। এ ক্ষেত্রে খাতের গুরুত্ব বুঝে ডলার ছাড় করা হয়। তবে দেশের প্রয়োজনে ডলার ছাড় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল বিশ্বের প্রায় সব দেশই। অধিকাংশ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কার নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির কথা প্রায় সবারই জানা, তারাও ইতিমধ্যে তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। কোনোভাবেই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। ফলাফল ভোক্তা মূল্যসূচকে (সিপিআই) বা মূল্যস্ফীতিতে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড। মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সিপিআই ইনডেক্সে এ হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে।
গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করে সরকার। এ বাজেটের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আগামী অর্থবছরে সরকার কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজেট প্রস্তাবে কোনো পদক্ষেপ না থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি পরাবাস্তব বাজেট। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা আসলে সম্ভব নয়। গত ১১ মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। সে হিসাবে মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, আগের বছরের মে মাসে যে পণ্য গড়ে ১০০ টাকা কিনতে হয়েছে, এ বছরের মে মাসে তা কিনতে হচ্ছে গড়ে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সায়। আরও পরিষ্কারভাবে বললে, ধরুন আগের বছরের একই সময়ে ৫০০ টাকার একটি নোটে কোনো ব্যক্তি পাঁচটি পণ্য কিনতে পেরেছিলেন। এ বছরের একই সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় এখন একই টাকায় তিনটি পণ্য কিনতে পারছেন। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১ বছরে বেড়েছে ১১.৩২ শতাংশ : ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, অথচ এ বছরের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ বছরের এপ্রিল মাসেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ।
খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে এক বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ : বিবিএসের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ হয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৬৪ শতাংশ।
গ্রামের চেয়ে শহরের মূল্যস্ফীতি বেশি : এক বছর আগেও শহরের মূল্যস্ফীতি গ্রামের চেয়ে কম ছিল। কারণ গ্রামের চেয়ে শহরে পণ্য মজুদের আধুনিক ব্যবস্থা আছে। তবে সরকারি উদ্যোগে শহরের মতো গ্রামেও কিছু স্থানে খাদ্যগুদামের ব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় এখন শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি কমেছে। মে মাসে শহর এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ, একই সময়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বিশ্বে কমেছে মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশে বাড়ছে : গত শনিবার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ মূল্যস্ফীতি ইস্যুতে বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। শুধু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, থাইল্যান্ডে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, গত এপ্রিলে তা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। অর্থাৎ আগের তুলনায় দেশটিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে ৬৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সেখান থেকে ৪৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গত অক্টোবর মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখান থেকে ৩৪ শতাংশ কমিয়ে ৭ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে ইইউ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশ এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় শুরুর দিকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো গত বছর আগস্টে এক ঘোষণাতেই জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই মাসেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ দেরিতে হলেও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। বর্তমানে এ সুদহার ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে আভাস দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দাবি করেছে, বিশে^র দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির যে হার, তা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য হুমকি। মূল্যস্ফীতির এই হার ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনো মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপর ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এরকম এক সময়ে গত বছর ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এ দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে।
যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে। তবে রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল।
মজুরি সূচক বেড়েছে : বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। যা মে মাসে এসে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩২ শতাংশে।
দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে হাইড্রোলিক পাওয়ার স্টেশনে তীব্র পানির সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনাবৃষ্টি এবং তীব্র তাপদাহে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই সংকট দেখা দিয়েছে। ৫টি ইউনিটের মধ্যে কোনরকমে মাত্র ১টি ইউনিট সচল রেখে সর্বনিম্ন ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (৬ জুন) সকালে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের জানান, হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি জানান, পানির অভাবে কেন্দ্রের সব ক’টি ইউনিট সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে ঠেকেছে। তিনি আরও জানান, কেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে ১ নম্বর ইউনিটটি চালু রাখা হয়েছে। এই ইউনিট হতে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এই কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট সচল থাকলে প্রায় ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে পাঠানো হয়। সেখানে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট।
এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, বছরের এই সময়ে কখনই পানি এতো নিচে থাকে না। এ বছর এখনো বৃষ্টিপাত শুরু না হওয়ায় খুবই বিপাকে পড়তে হয়েছে আমাদের। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মাত্র একটি ইউনিট চালু আছে। আমরাও বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছি।
কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বরত প্রকৌশলী জানান, গত মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদের পানির পরিমাণ ৭৩ দশমিক ৬২ ফুট (মিন সি লেভেল) ছিল। রুলকার্ভ অনুযায়ী এসময় হ্রদে পানি থাকার কথা ৭৮ দশমিক ২০ ফুট এমএসএল (মিন সি লেভেল)। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাত না হলে এই সংকট হতে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে জানান প্রকৌশলীরা।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, অনাবৃষ্টি, বন উজার হওয়া, কাপ্তাই হ্রদে নাব্যতা সংকটের কারণে পানি তলানিতে চলে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এমন বিপর্যয় ঘটেছে। সঙ্গতকারণে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে পানি কমে যাওয়ার ফলে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। হ্রদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি উপজেলার সাথে নৌপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাপ্তাই হ্রদের পাশে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম জানান, ভারী বৃষ্টিপাত না হলে হ্রদে পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তাই দ্রুত সময়ে কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করা প্রয়োজন। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদের গভীরতা যেমন বাড়বে তেমনি এই সমস্যা থেকে কিছুটা সমাধান পাওয়া যাবে।
বিলাইছড়ি বাজারের ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন জানান, বিলাইছড়িতে নৌপথ বন্ধ মানেই জীবন ও জীবিকার দুর্বিষহ অবস্থা। আমরা বিলাইছড়িবাসীই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি হ্রদের পানি কমে যাওয়ায়। বৃষ্টি হতে যত দেরি হবে আমাদের কষ্ট তত বেশি দীর্ঘায়িত হবে।
তিনি বলেন, হ্রদের পানি অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বাজারের পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বড় বোটতো আসতেই পারছে না, ছোট ছোট বোটে পণ্য পরিবহনে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, পর্যাপ্ত পণ্যও আনা যাচ্ছে না। আবার অনেক দূর থেকে পণ্য বাজারে তুলতে শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিতে হচ্ছে। একই সঙ্গে সাপ্তাহিক বাজারও এখন ঠিকমতো জমছে না। কারণ দূর থেকে মানুষজন আসতে পারছে না। এখন বৃষ্টি হওয়া ছাড়া পানি বাড়ার তো আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রেম এরপর বিয়ে। দেড় বছরের দাম্পত্য জীবনে আট মাস ধরে চিত্রনায়িকা পরীমণি ও শরিফুল রাজের বনিবনা হচ্ছে না বলেই শোনা যাচ্ছে। চলছে টানাপোড়েন এবং সেই সংসার এখন ভাঙনের পথে। রাজের ফেসবুক থেকে অভিনেত্রী তানজিন তিশা, নাজিফা তুষি ও সুনেরাহ বিনতে কামালের কিছু ছবি ও ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর রাজের সঙ্গে পরীমণির মতপার্থক্য প্রকাশ্যে আসে। সব ছাপিয়ে যা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
রবিবার একটি গণমাধ্যমের ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানে এসে শরিফুল রাজ জানান, আপাতত তারা সেপারেশনে আছেন এবং তাদের আর একসাথে হওয়ার কোন সুযোগ নেই। পরীকে তিনি শ্রদ্ধা করেন জানিয়ে সবশেষে পরীমণির উদ্দেশ্যে রাজ বলেন, ‘বেবি, আই লাভ ইউ। যা-ই হোক না কেন, আনন্দে থেকো। আমরা আমাদের সন্তানকে ভালো রাখব।’
রাজের এমন মন্তব্যের উত্তর দিতে সোমবার রাতে গণমাধ্যমটির লাইভে এসে রাজের উদ্দেশ্যে পরীমণি বলেন, ‘গরু মেরে জুতা দান করার কোনো দরকার নেই। কেউ রেসপেক্ট করলে সেটা তার কার্যকলাপ দেখেই বোঝা যায়, মুখ ফুটে বলতে হয় না। আমাকে পাবলিকলি অপমান করে এরপর রেসপেক্ট দেখানোর কোনো দরকার নেই। আর আমার বাচ্চাকে নিয়ে এসব ইমোশনালি কোনো কথা শুনতে চাই না। এসব ইমোশনালি কথা মানুষকে গিলিয়ে লাভ নেই। মানুষ বুঝে।’
ফাঁস হওয়া ভিডিওগুলো পরী বলেন, ‘এত বছর ধরে তারা বন্ধু অথচ আমি জানতাম না। এসব সামনে আসার পর জানতে পারলাম। আর রাজ যতটা তার বন্ধুদের ইমেজ নিয়ে কনসার্ন তার পরিবার নিয়ে এতটাও কনসার্ন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এমনিতে অনেক শান্তশিষ্ট। অনেকটা সাপের মতো, লেজে পাড়া না দিলে চুপচাপ থাকি কিন্তু আমার লেজে পাড়া দিলেই আমি ফুঁস করে উঠি আর তখন কামড় দিবই।’
সবশেষে পরী বলেন, ‘আমি চাই এসবের শেষ হোক। আমি আজকে এখানে এসে এসব বলতাম না। তুমিই (রাজ) আমাকে বাধ্য করেছ। এরকম অসুস্থ মানুষের সঙ্গে আমি আর থাকতে চাই না। আমি চাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজ আমাকে ডিভোর্স দিক।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।