চীনে ‘শূন্য করোনা’ আতঙ্ক
রূপান্তর ডেস্ক | ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে চীন ‘শূন্য করোনা’ নীতিতে হাঁটছে। করোনা মহামারীর চেয়েও কর্র্তৃত্ববাদী এই নীতি ‘অমানবিক’ হয়ে উঠেছে। করোনা সংক্রমণ শূন্যে নামিয়ে আনতে দেশটির কর্মকর্তারা ক্ষমতার মধ্য থেকে সবকিছুই করছেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংও এমনটাই চান। প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা পূরণ করতে তাই পেইচিংকে অনেক কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে, যা রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটির জনগণের জন্য।
শূন্য করোনানীতি বাস্তবায়ন করতে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শানজি প্রদেশের শহর জিয়ানে লকডাউন চলছে। এ পরিস্থিতিতে বুকে ব্যথা নিয়ে এক ব্যক্তি হাসপাতালে এলে তাকে ভর্তি করেননি হাসপাতালের কর্মীরা। পরে চিকিৎসা না পেয়ে হৃদরোগে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী চিকিৎসা নিতে ওই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সে সময় তার রক্তপাত শুরু হয়। অথচ হাসপাতালের কর্মীরা তাকে সেবা না দিয়ে জানিয়েছিলেন, তার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ঠিক নয়। পরে ওই নারীর গর্ভপাত হয়।
ক্ষুধার যন্ত্রণায় লকডাউন অমান্য করতে বাধ্য হন এক তরুণ। খাবারের সন্ধানে বাইরে বের হলে দুজন কমিউনিটি নিরাপত্তারক্ষী তাকে আটক করেন। ওই তরুণ ‘খাবার নেই’ কথাটা জানালে এটা তাদের দেখার বিষয় নয় জানিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে ব্যাপক মারধর করেন। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে জিয়ানে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। সংক্রমণ রোধে জিয়ানের স্থানীয় সরকার কঠোর লকডাউন জারি করে। কিন্তু শহরটির প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দার খাদ্য, চিকিৎসাসেবা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করার জন্য তাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এ কারণে চরম বিশৃঙ্খলা ও সংকটের সৃষ্টি হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে উহানে জারি করা প্রথম লকডাউনের পর এতটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও সংকট দেশে আর দেখা যায়নি। শুরুর দিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পদক্ষেপের সাফল্যই সরকারকে এ কর্র্তৃত্ববাদী নীতি আরোপ করতে উৎসাহিত করেছে। বাস্তবিক অর্থেই তাদের কাছে এখন সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই বছর আগে উহানে প্রথম করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এতে চীনের ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। আর এখন চীনে ‘নন-কভিড’ রোগে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মানুষ। এসব পরিস্থিতি দেখেও জিয়ানে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে কোনো ছাড় দিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। জিয়ানের লকডাউন দেখিয়ে দিয়েছে, একক ইচ্ছায় শূন্য করোনানীতি বাস্তবায়নে দেশের রাজনৈতিক কৌশল কতটা স্থবির হয়ে আছে। সরকার কমিউনিটির একটি বিশাল বাহিনীর সহায়তায় এ নীতি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এ নীতি অমান্যকারী বা উদ্বেগ উত্থাপনকারীদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন ওই বাহিনীর সদস্যরা।
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তি মৃতপ্রায় অবস্থায় জিয়ানের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় তাকে। অবস্থার অবনতি হলে তার মেয়ে বাবাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য হাসপাতালের কর্মচারীদের কাছে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চেয়ে আকুতি জানান। পরে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ‘দ্য ব্যানালিটি অব ইভিল’ এমন একটি ধারণা, যা চীনের বুদ্ধিজীবীরা জিয়ানের মতো পরিস্থিতিকে বলে থাকেন। এটি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ হাননা আরেন্ডের একটি ধারণা। ‘আইখম্যান ইন জেরুজালেম : দ্য ব্যানালিটি অব ইভিল’ নামে তার একটি প্রতিবেদক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে সাড়া জাগিয়েছিল বিশ্বময়। হাননা কেবল বিচারে সীমাবদ্ধ থাকেননি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভয়ংকর হয়ে ওঠার পেছনের কার্যকারণ এ ধারণার মাধ্যমে তলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন।
শেয়ার করুন
রূপান্তর ডেস্ক | ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে চীন ‘শূন্য করোনা’ নীতিতে হাঁটছে। করোনা মহামারীর চেয়েও কর্র্তৃত্ববাদী এই নীতি ‘অমানবিক’ হয়ে উঠেছে। করোনা সংক্রমণ শূন্যে নামিয়ে আনতে দেশটির কর্মকর্তারা ক্ষমতার মধ্য থেকে সবকিছুই করছেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংও এমনটাই চান। প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা পূরণ করতে তাই পেইচিংকে অনেক কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে, যা রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটির জনগণের জন্য।
শূন্য করোনানীতি বাস্তবায়ন করতে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শানজি প্রদেশের শহর জিয়ানে লকডাউন চলছে। এ পরিস্থিতিতে বুকে ব্যথা নিয়ে এক ব্যক্তি হাসপাতালে এলে তাকে ভর্তি করেননি হাসপাতালের কর্মীরা। পরে চিকিৎসা না পেয়ে হৃদরোগে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী চিকিৎসা নিতে ওই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সে সময় তার রক্তপাত শুরু হয়। অথচ হাসপাতালের কর্মীরা তাকে সেবা না দিয়ে জানিয়েছিলেন, তার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ঠিক নয়। পরে ওই নারীর গর্ভপাত হয়।
ক্ষুধার যন্ত্রণায় লকডাউন অমান্য করতে বাধ্য হন এক তরুণ। খাবারের সন্ধানে বাইরে বের হলে দুজন কমিউনিটি নিরাপত্তারক্ষী তাকে আটক করেন। ওই তরুণ ‘খাবার নেই’ কথাটা জানালে এটা তাদের দেখার বিষয় নয় জানিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে ব্যাপক মারধর করেন। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে জিয়ানে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। সংক্রমণ রোধে জিয়ানের স্থানীয় সরকার কঠোর লকডাউন জারি করে। কিন্তু শহরটির প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দার খাদ্য, চিকিৎসাসেবা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করার জন্য তাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এ কারণে চরম বিশৃঙ্খলা ও সংকটের সৃষ্টি হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে উহানে জারি করা প্রথম লকডাউনের পর এতটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও সংকট দেশে আর দেখা যায়নি। শুরুর দিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পদক্ষেপের সাফল্যই সরকারকে এ কর্র্তৃত্ববাদী নীতি আরোপ করতে উৎসাহিত করেছে। বাস্তবিক অর্থেই তাদের কাছে এখন সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই বছর আগে উহানে প্রথম করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এতে চীনের ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। আর এখন চীনে ‘নন-কভিড’ রোগে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মানুষ। এসব পরিস্থিতি দেখেও জিয়ানে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে কোনো ছাড় দিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। জিয়ানের লকডাউন দেখিয়ে দিয়েছে, একক ইচ্ছায় শূন্য করোনানীতি বাস্তবায়নে দেশের রাজনৈতিক কৌশল কতটা স্থবির হয়ে আছে। সরকার কমিউনিটির একটি বিশাল বাহিনীর সহায়তায় এ নীতি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এ নীতি অমান্যকারী বা উদ্বেগ উত্থাপনকারীদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন ওই বাহিনীর সদস্যরা।
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তি মৃতপ্রায় অবস্থায় জিয়ানের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় তাকে। অবস্থার অবনতি হলে তার মেয়ে বাবাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য হাসপাতালের কর্মচারীদের কাছে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চেয়ে আকুতি জানান। পরে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ‘দ্য ব্যানালিটি অব ইভিল’ এমন একটি ধারণা, যা চীনের বুদ্ধিজীবীরা জিয়ানের মতো পরিস্থিতিকে বলে থাকেন। এটি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ হাননা আরেন্ডের একটি ধারণা। ‘আইখম্যান ইন জেরুজালেম : দ্য ব্যানালিটি অব ইভিল’ নামে তার একটি প্রতিবেদক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে সাড়া জাগিয়েছিল বিশ্বময়। হাননা কেবল বিচারে সীমাবদ্ধ থাকেননি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভয়ংকর হয়ে ওঠার পেছনের কার্যকারণ এ ধারণার মাধ্যমে তলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন।