
ঘটা করে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার পরেও আপাতত কোণঠাসা রুশ বাহিনী যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাশিয়া ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলে প্রবল গোলাবর্ষণ করেছে। ইউক্রেনের প্রশাসনের ধারণা, অবশিষ্ট অধিকৃত এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরালো করতেই রুশ বাহিনী এমন হামলা চালাচ্ছে।
ইউক্রেন প্রশাসনের বরাতে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের খবরে বলা হয়েছে, গতকাল বাখমুট ও আভদিভিকা শহর লক্ষ্য করে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ চলেছে। অঞ্চলের গভর্নর পাভলো কিরিলেংকো বলেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী নভেম্বর মাসে লাইমান এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার পর রাশিয়া আবার সেখানে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। ইউক্রেনের বাহিনী যাতে আরও অগ্রসর না হতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতেই রাশিয়া জোরালো হামলা চালাচ্ছে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র সেই পরিকল্পনার উল্লেখও করেছেন। বৃহস্পতিবার ক্রেমলিন জানিয়েছে, ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণের যে অংশ রাশিয়ার অন্তর্গত করা হয়েছিল, সেই অঞ্চলের সিংহভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করাই আপাতত মূল লক্ষ্য। নতুন করে কোনো এলাকা দখল করার পরিকল্পনা আপাতত নেই। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ আরও বলেন, ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাত থেকে রাশিয়ার সংযুক্ত ভূখণ্ড ‘মুক্ত’ করতে অনেক কাজ বাকি রয়েছে। ২০১৪ সালে দখল করা ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। বৃহস্পতিবার সেখানকার সেভাস্তোপোল শহরের কাছে ইউক্রেনের ড্রোন রুশ নৌবাহিনীর ওপর আঘাত করায় পেসকভ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারি মাসে হামলা শুরু করার পর থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে রাশিয়া বয়ান বদলে চলেছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে রুশ হানাদার বাহিনীকে পুরোপুরি বহিষ্কার করার অঙ্গীকার করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতের ভিডিও বার্তায় তিনি অধিকৃত এলাকায় রাশিয়ার ল্যান্ডমাইন ব্যবহারের তীব্র সমালোচনা করেন। খেরসন প্রদেশে মাইন বিস্ফোরণে নিহত চারজন পুলিশকর্মীর প্রতি সম্মান জানান তিনি। যুদ্ধের পর নিরীহ মানুষের হত্যালীলার দায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘মাইন সন্ত্রাসবাদ’ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের করার হুমকি দেন তিনি।
রুশ ভূখণ্ডে ইউক্রেনের সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কেও রাশিয়ার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। দুটি সামরিক ঘাঁটির ওপর ড্রোন হামলা সম্পর্কে ইউক্রেন সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও জার্মান সরকার এক বিবৃতিতে আত্মরক্ষার স্বার্থে ইউক্রেনের সেই অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র পেসকভ সতর্ক করে বলেন, এর ফলে সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা বিশে^র আরও সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। ইউক্রেনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ইউরোপ রাশিয়ার ওপর আগামী পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা চাপানোর পরিকল্পনা করছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেন, সেøাভাকিয়ার কয়েকজন মন্ত্রী সেই লক্ষ্যে কিয়েভে আলোচনা করেছেন।
চলতি সপ্তাহে ইউরোপের প্রাতিষ্ঠানিক সীমানার প্রশ্নে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। বলকান অঞ্চলের পশ্চিমের দেশগুলোর ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের প্রশ্নে সামান্য হলেও কিছু সাফল্য দেখা গেছে। সেই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে সদিচ্ছা প্রকাশ করেছেন শীর্ষ নেতারা। স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার ইইউ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা আরও তিনটি দেশকে শেনজেন চুক্তির আওতায় আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বসেন। তবে শুধু ক্রোয়েশিয়াকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে চুক্তির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। ঐকমত্যের অভাবে বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া আপাতত এই কাঠামোর বাইরে থাকছে। সম্ভবত ছয় মাস পর সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। আয়ারল্যান্ড ও সাইপ্রাস ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব ‘আদি’ সদস্যই ২৬ সদস্যের শেনজেন চুক্তির আওতায় পড়ে। এ ছাড়া নরওয়ে, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও লিশটেনস্টাইন ইইউ সদস্য না হয়েও এই কাঠামোয় যোগদান করেছে। শেনজেন এলাকার বহিঃসীমানায় কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকলেও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সীমানায় সাধারণত কোনো নিয়ন্ত্রণই থাকে না। এক কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে বহিরাগতদের ভিসাসংক্রান্ত তথ্য জমা হয়, যা সব সদস্য দেশের নাগালে থাকে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী সব দেশের সম্মতি ছাড়া নতুন কোনো দেশকে এই কাঠামোর অন্তর্গত করা সম্ভব নয়।
ইউরোপীয় কমিশন গত মাসেই শেনজেন এলাকায় বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার যোগদানের পক্ষে সওয়াল করলেও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি দেশের ক্ষমতা নিয়ে সংশয় থেকে গেছে। অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার গত মঙ্গলবার ক্রোয়েশিয়ার যোগদানের প্রতি সমর্থন জানালেও বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ার অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ করেন। গত অক্টোবর মাসে নেদারল্যান্ডসের সংসদ এক প্রস্তাব অনুমোদন করে সেই দুই দেশে আইনের শাসন, দুর্নীতি ও সংঘটিত অপরাধচক্রের মাত্রা আরও খতিয়ে দেখার ডাক দিয়েছে। উল্লেখ্য, গত প্রায় এক দশক ধরে এই দুই দেশের যোগদান নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে। ইউরোপীয় কমিশন ২০১১ সালেই বুলগেরিয়া ও রোমানিয়াকে ‘শেনজেনের জন্য প্রস্তুত’ হিসেবে ছাড়পত্র দিয়েছিল। ২০২২ সালে তিনটি দেশই প্রযুক্তিগত শর্ত পূরণ করেছে বলে কমিশন জানিয়েছে। অর্থাৎ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, তথ্য সংরক্ষণ ও ভিসা নীতির ক্ষেত্রে শেনজেনের মানদণ্ড মেনে চলছে এই তিন দেশ।
গত প্রায় এক দশক ধরে বেআইনি অনুপ্রবেশ ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণে শেনজেন এলাকার গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। সদস্য দেশগুলো এমন হুমকির মোকাবিলা করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে মুক্ত ও অবাধ এই এলাকা বিপন্ন হতে পারে। তাই নতুন সদস্য গ্রহণ করার আগে সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চায় অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশ।
কারণ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা কৌশলে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। গেল দশকের সিরিয়া ও লিবিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিকে নিয়ে গেছে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায়। আর চলতি বছর শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাতে দিয়েছে নতুন মাত্রা। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের স্রোতে হুমকিতে পড়েছে অঞ্চলটির বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। ফলে অঞ্চলটির দেশগুলোর মধ্যে অবাধ যাতায়াতের বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক দেশই শেনজেন চুক্তি লঙ্ঘন করে সীমান্তে তল্লাশি বাড়িয়েছে। অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন আদালত বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করেছে ইতিমধ্যে। আইনের মধ্যে থেকেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন। তবে সেটা যদি প্রযুক্তিগত বিষয় হয়, তাহলে অঞ্চলটির বাসিন্দারা পড়ছেন সার্বক্ষণিক নজরদারির ঝুঁকিতে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাতে পারে এমন যুদ্ধবিমান বানাতে যুক্তরাজ্য, ইতালি ও জাপানের যৌথ উদ্যোগের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। যুক্তরাজ্যে কয়েক হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে এই যৌথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বিবিসি বলছে, এই তিন দেশ মিলে যে পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বানাবে তা ধীরে ধীরে ‘টাইফুন’ জেটের জায়গা দখল করে নেবে। নতুন এ যুদ্ধবিমানগুলো আগামী দশকের মাঝামাঝি বাহিনীতে যুক্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন এ ‘টেম্পেস্ট’ জেট অত্যাধুনিক অস্ত্র বহনে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিবিসি বলছে, যুদ্ধবিমানটি বানানোর কাজ এরই মধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। প্রকৌশলীদের লক্ষ্য এমন একটি যুদ্ধযান বানানো যেটি শত্রুপক্ষের রাডার ফাঁকি দিয়ে দ্রুতগতিতে চলতে পারবে, অত্যাধুনিক সেন্সর এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও ব্যবহার করতে পারবে; যা বিহ্বল হয়ে পড়া বা তীব্র চাপে থাকা পাইলটকে সহায়তা দেবে। প্রয়োজনে পাইলটের নির্দেশনা ছাড়াই বিমানটি উড়তে পারবে, পারবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তেও।
এ ধরনের জটিল যুদ্ধবিমান বানাতে বিপুল ব্যয় হয়। ব্যয়ের কথা মাথায় রেখে যুক্তরাজ্য অনেক দিন ধরেই প্রকল্পটির জন্য অংশীদার খুঁজছিল; ইতালি আগেই রাজি ছিল, সর্বশেষ জাপানও যুক্ত হলো। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের আরও আগ্রাসী আচরণ নিয়ে উদ্বেগ থেকে ব্রিটেন যখন তার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করছে, তখন জাপানের এমন প্রকল্পে যুক্ত হওয়াকে কৌশলগতভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলছেন বিশ্লেষকরা। অন্য দেশগুলোও এই প্রকল্পে যুক্ত হতে পারে। ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেন ইতিমধ্যে একসঙ্গে তাদের নিজস্ব নকশার বিমান নিয়ে কাজ করছে, কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রও।
যুক্তরাজ্যের জন্য নতুন বিমান বানাতে তিন দেশের মধ্যে হতে যাওয়া চুক্তিটি কেবল নিরাপত্তা নিয়ে নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন এ যুদ্ধবিমান বানানোর কাজে যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, আরও অস্ত্র রপ্তানির দুয়ার খুলবে, এমনটাই আশা লন্ডনের।
শুক্রবার লিঙ্কনশায়ারে রয়্যাল এয়ার ফোর্সের (আরএএফ) কনিংসবি ঘাঁটি সফরকালে সুনাক ত্রিদেশীয় এ প্রকল্পের প্রথম বড় পর্বের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। বিমানঘাঁটিতে যাওয়ার আগে তিনি বলেছেন, তার সরকারের কাছে যুক্তরাজ্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে।
রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধ মোকাবিলায় ইউক্রেনকে ২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের অতিরিক্ত সামরিক সাহায্য পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে আছে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ এবং ড্রোন খুঁজে বের করা ও তা ধ্বংসের জন্য উচ্চপ্রযুক্তি ব্যবস্থা। দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ কথা জানিয়েছেন। হাতে পাওয়া নথি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাতে রয়টার্স বলছে, হাই-মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম (হিমার্স) লঞ্চারের জন্য লকহিড মার্টিনের তৈরি রকেট, ১৫৫ এমএম গোলা, হামভি সামরিক যান এবং জেনারেটর পাঠানো হতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সই না করা পর্যন্ত এ প্যাকেজের আকার ও উপকরণ পরিবর্তন হতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র এ সাহায্য নিয়ে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রয়টার্স জানাচ্ছে, প্রেসিডেন্সিয়াল ড্রডাউন অথোরিটির (পিডিএ) আওতায় এ সাহায্য পাঠানো হবে। পিডিএর অধীনে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই দ্রুত সামরিক সহায়তা পাঠানো যায়।
প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রস্তাবিত বিধি প্রকৃতপক্ষে আর্থিক স্থিতিশীলতাকে বিপদে ফেলতে পারে বলে আনুষ্ঠানিক মতামতে জানিয়েছে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি)। ইসিবি বলেছে, প্রস্তাবিত বিধিটি নতুন করে নকশা করা দরকার।
জ্বালানি ডেরিভেটিভস ট্রেডিংয়ে আর্থিক বাজারে চাপ সৃষ্টি ও জ্বালানির খরচ বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় ওঠার পর গত মাসে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ও বাজারের অস্থিরতা সীমিত রাখার লক্ষ্যে ‘বাজার সংশোধন প্রক্রিয়া’ প্রস্তাব করে ইইউ।ইইউর আর্থিক স্থিতিশীলতার অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক ইসিবি স্বীকার করেছে, চরম মূল্যস্তর ও অস্থিরতাকে সহনশীল অবস্থায় আনতে এটি করা হয়েছিল, কিন্তু এই নীতিগুলো বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছে তারা।
প্রেসিডেন্ট ক্রিস্তিন লাগার্দের স্বাক্ষর করা মতামতে ইসিবি বলেছে, ‘ইসিবির বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজার সংশোধন প্রক্রিয়ার বর্তমান পরিকল্পনা সম্ভবত কিছু পরিস্থিতিতে ইউরো এলাকার আর্থিক স্থিতিশীলতাকে বিপদে ফেলবে।’ ইসিবি ইউরোপীয় কমিশনকে মূল্য প্রক্রিয়া সক্রিয় ও শেষ করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা হ্রাস করতে বলেছে এবং ইইউকে প্রয়োজনে ইসিবির পরামর্শ নিতে বলেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
‘বস্তি এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পানি সরবরাহ ও নর্দমা লাইন প্রায়ই এক হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দূষিত ও নোংরা পানি পান করছেন তারা।’ এভাবে বলছিলেন ঢাকার বস্তির জীবন মান নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মী বাছেরা আক্তার।
শুধু বস্তি এলাকা নয়, দেশের সব এলাকার সুপেয় পানি সরবরাহের চিত্র এমনই। রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানিই না ফুটিয়ে পান করা যায় না। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। খুলনায় সরবরাহ করা পানিও না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার কারণে ব্যবহার করাও দুষ্কর। পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎস সীমিত। পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদন্ডনদীর পানিও কমছে। সুপেয় পানি ও সেচের জন্য অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’
সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না। এ ব্যর্থতা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় পানি বলা যায়। তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেই পানিকে আর সুপেয় থাকে না। সুপেয় পানি না ফুটিয়েই পান করা যাবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরে ময়লা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সেই পানিকে নিরাপদ বলা যাবে না। শুধু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানির মান ভালো হলে চলবে না, বাসা পর্যন্ত ভালো পানি পৌঁছে দিতে হবে। কেননা সরবরাহ লাইনের পানি নিরাপদ রাখাও সংস্থার দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আশা করি সবাই মিলে কাজ করে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে আমরা নির্ধারণ সময়ে লক্ষ্যপূরণ করতে পারব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ৫৯ ভাগ অর্থাৎ ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২২০ জন মানুষ সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় এসেছে। আর সুপেয় পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে ৪১ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৮০ জন মানুষ। এখনো দেশের ১০ ভাগ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ছয় শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়। দেশের ১৫৯ সিটি ও পৌরসভায় সরবরাহ করা পানির মানও একই। ওইসব এলাকায় ১৬৮টি পানি শোধনাগার, ১ হাজার ৫০০টি গভীর নলকূপে ১৫ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সরকার চালু রেখেছে। গ্রাম পর্যায়ের ২০ লাখ টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। তবে আর্সেনিক ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রন সে পানিও জনজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে বড় ‘গণবিষ’-এর উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতিকে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বছরে আর্সেনিকে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ২০০৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তে ২০১২ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী সেবা গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই হিসাবে জনসংখ্যার বিবেচনায় সরকার ৮৩ জনে একটি পানির উৎস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র জনসংখ্যার বিবেচনায় বর্তমান পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১১ ভাগ। আর শহর এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৮ ভাগ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে সুপেয় পানি সরবরাহে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রতি বছর ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমান অগ্রগতি প্রায় এক ভাগ। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে সামনের দিনগুলোতে পানি সরবরাহ খাতের অর্জন আরও কম হতে পারে। এ জন্য লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে চারগুণ তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বেসরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। আর সরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এ দুটো ধরে হিসাব করতে দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনে একটি পানির উৎস রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশিরভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। সরকার পানি সরবরাহ সেবার আওতায় আনতে পেরেছে ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষকে। এখনো ১ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ পানি সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে।
নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচেই ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫-৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এ অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫-১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এ উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না।
ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যরকম সংকট। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারকে বর্ষায় কৃত্রিমভাবে মাটির নিচে পানি প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ততা সমস্যা : ভূতত্ত্ববিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকার পানিতে একবার লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে ওখানকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাবে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকে লবণ পানি প্রবেশের হার বাড়বে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরের উপকূলীয় এলকাগুলোতে আমরা গভীর নলকূপ বসাতে পারি না। এই এলাকায় নলকূপে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।’
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা বলছে ভূতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি যৌথ নদী থেকে ইতিমধ্যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়েও যাচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারা নওরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নিচে। এখন এই হার আরও বেড়েছে।’
বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে আলোচিত পুলিশ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভের রেসিডেন্ট পারমিট বাতিল করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই সরকার। এর ফলে তার ভিসাও বাতিল হয়ে গেছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। একই সঙ্গে ভারতও তার পাসপোর্ট বাতিল করেছে বলে পুলিশ একটি সূত্র জানিয়েছে।
অন্যদিকে, গতকাল মঙ্গলবার দিনভর গুঞ্জন ছিল দুবাই পুলিশ আরাভকে আটক করেছে। তবে তাকে আটকের বিষয়টি কেউ স্বীকার করছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আরাভের বিষয়ে ইন্টারপোলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, দুবাইতে থাকা আরাভের রেসিডেন্ট পারমিট সোমবার বাতিল করা হয়েছে। আটকের বিষয়ে তিনি বলেন,তাদের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। যতক্ষণ ইন্টারপোল বা দুবাই পুলিশ তাদের নিশ্চিত না করবে ততক্ষণ তারা গুঞ্জনকে পাত্তা দেবেন না। তবে তাকে আটকের জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে তারা চেষ্টা করছেন। আরাভ আটক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের টিম দুবাই পাঠানো হবে। সে জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আরাভকে নজরদারির মধ্যে রাখা আছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
এদিকে পুলিশে একটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তা খুনের পর আরাভ খান নামধারী রবিউল ভারতে পালিয়ে যান। আরাভ খান নামে ওই দেশের পাসপোর্ট নিয়ে পরে তিনি দুবাই চলে যান। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার সে পাসপোর্ট বাতিল করেছে।
আটক হওয়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য আমার কাছে নেই। তবে দ্রুত তাকে আটক করা যাবে বলে আশা করছি।’
গতকাল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও বলেছেন, পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলার পলাতক আসামি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম দুবাইয়ে গ্রেপ্তার হননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এটুকুই বলতে পারি যে, বাংলাদেশের কোনো আসামি বন্ধু রাষ্ট্রে গিয়ে পালিয়ে থাকতে পারবে না। আরাভের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে অফিশিয়ালি দুবাইয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে।’
গত সোমবার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। ইন্টারপোল সেই আবেদন গ্রহণ করেছে।
জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত সপ্তাহে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন করার পর আলোচনায় আসেন জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খান। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়া ও বিনোদন জগতের অনেক তারকাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। সেই তাকে পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার আসামি বলে শনাক্ত করে ফেলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। আরাভ জুয়েলার্স নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক আরাভ খানের আসল নাম রবিউল ইসলাম। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তার বাড়ি। তিনি সোহাগ মোল্লা, হৃদয় শেখ, আপন এরকম কয়েকটি নামেও পরিচিত। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই ঢাকায় পুলিশের পরিদর্শক মামুন ইমরান খান খুন হন। সেই খুনের আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন রবিউল। দেশ ত্যাগের আগে ওই খুনের ঘটনার অন্য আসামিদের সঙ্গে আরাভকে আটক করেছিল ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে দুদিন রাখার পর তাকে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তা ও রাজনৈতিক নেতার অনুরোধে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মামলা ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে বনানীর একটি ফ্ল্যাটে জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান। গুম করতে লাশ গাড়িতে করে নেওয়া হয় গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি জঙ্গলে। সেখানে লাশে পেট্রল ঢেলে আগুনে ঝলসে দেওয়া হয় চেহারা। সেই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন। ওই বছরের ১০ জুলাই মামুনের ভাই ঢাকার বনানী থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
মামলা ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া একটি চক্রের কবলে পড়েন মামুন ইমরান খান। এরপর তাকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পেট্রল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। এ মামলার ৬ নম্বর আসামি হলেন আরাভ খান।
মামুন ইমরান হত্যা মামলায় বাদীর সাক্ষ্য : মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন নিহতের ভাই ও মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলম খান। গতকাল তার সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফয়সাল আতিক বিন কাদের পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য আগামী ৪ জুন ধার্য করেন।
মামুন ইমরান হত্যা মামলার তদন্ত শেষে ডিবির পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আরাভের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া, ইমরানের বন্ধু রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারোয়ার হোসেন এবং দুই কিশোরী রয়েছেন। তাদের মধ্যে আরাভ ও সুরাইয়া পলাতক, দুই কিশোরী অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের বিচার হচ্ছে শিশু আদালতে এবং তারা জামিনে আছেন।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, হত্যা মামলা হওয়ায় পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীরা শুনানি করছেন। এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৩৮ জনকে।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতাসহ অনেক ভাস্কর্যের শিল্পী শামীম সিকদার আর নেই। নিভৃতে জীবন কাটানো এই শিল্পী চলেও গেলেন খুব নিভৃতে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় একুশে পদকজয়ী ভাস্কর শামীম সিকদারের। আলোচিত কমিউনিস্ট নেতা সিরাজ সিকদারের বোন শামীম সিকদারের বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামীম সিকদারের ভাস্কর্যগুলোর কিউরেটর মো. ইমরান হোসেন জানান, ঢাবির চারুকলার সাবেক অধ্যাপক নিজের শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করতে কয়েক মাস আগে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছিলেন। তবে দেশে ফিরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে তিনি প্রায় এক সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে মৃত্যু হয় তার।
তিনি জানান, শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বেলা ১১টায় শামীম সিকদারের মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে নেওয়া হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার মরদেহ শহীদ মিনার কিংবা তার যেকোনো একটি ভাস্কর্য প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। তার পরিবারের সদস্য ও শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে দাফনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে
মোহাম্মদপুরে তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফনের একটি পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
শামীম সিকদার ১৯৫২ সালের ২২ অক্টোবর বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়ের চিংগাশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হন। পরে ১৯৭৬ সালে তিনি লন্ডনের স্যার জন কাস স্কুলে চলে যান। গত শতকের আশির দশকে চারুকলায় শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি।
১৯৭৪ সালে এই ভাস্কর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ শিরোনামের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটির মূল বেদিতে আছে একাত্তরের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটি স্থাপন করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন ১৯৯৪ সালে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে স্থাপন করা হয়। ১৯৮০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ললিতকলা অনুষদের একজন ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিলেন। তিনি ২০০০ সালে একুশে পদক পান।
শামীম সিকদারের ছাত্র ও বর্তমানে ঢাবি ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুকুল কুমার বাড়ৈ প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুর পর দেশ রূপান্তকে জানিয়েছেন তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। তিনি বলেন, ‘শামীম আরা সিকদার ভাস্কর্য বিভাগে আমার শিক্ষক ছিলেন। তার মতো শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক আজকের সময়ে খুবই কম পাওয়া যায়। তিনি অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন, শিক্ষার্থীদের মুখ দেখলেই তিনি বুঝতে পারতেন শিক্ষার্থী হয়তো সকালের খাবার খেয়ে আসেনি, তিনি তৎক্ষণাৎ তার খাবারের ব্যবস্থা করতেন। অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য তিনি ক্লাস ওয়ার্কের বাইরে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কমিশন ওয়ার্ক দিয়ে দিতেন। অত্যন্ত আধুনিকমনস্ক শিল্পী করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করতেন শিক্ষার্থীদের। প্রচ- মাত্রায় পরিশ্রমী কাজপাগল একজন ভাস্কর ছিলেন তিনি।’
মুকুল কুমার বলেন, ‘বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্য চর্চার ইতিহাসে সামাজিকভাবে ভাস্কর্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তার অবদান বিশালতম। তিনি আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। স্বাধীনতাসংগ্রামে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করার কথা মাঝেমধ্যে আমাদের শোনাতেন। বাংলাদেশের ভাস্কর্য চর্চার ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রাজধানীর একটি নামি স্কুলে আগের বছরগুলোর মতো এবারও শিক্ষার্থীদের বর্ষপঞ্জি দেওয়া হয়। তাতে মার্চের মাঝামাঝি তাদের প্রথম শ্রেণি-অভীক্ষা শুরুর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ পেয়ে শিক্ষকরা জানান, এ বছর শ্রেণি-অভীক্ষা হবে না। ফলে শিথিল অবস্থায় ছিল শিক্ষার্থীরা। প্রথম অভীক্ষার জন্য দেওয়া সিলেবাসও শেষ হয়নি তাদের। এখন হঠাৎ করে প্রচলিত নিয়মে শ্রেণি-অভীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে স্কুলটি। দশ বিষয়েরই। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
শুধু রাজধানীর একটি স্কুলই নয়, দেশের বেশির ভাগ স্কুলেই এ বছর একই অবস্থা। নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে সবাই তালগোলে পড়ে গেছে। এ বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে প্রচলিত কোনো পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট নেওয়া যাবে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই সারা বছর শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন চলবে। বছর শেষে মাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু তা না মেনে অনেক স্কুল শ্রেণি-অভীক্ষা বা সিটি পরীক্ষার সূচি প্রকাশ করেছে। কোনো স্কুল পরীক্ষা নিতেও শুরু করেছে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় রয়েছে। এসবের মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ। আর জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি এই পাঁচ বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে যে বিষয়গুলো আনার পরিকল্পনা ছিল তা সঠিকভাবে আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বইপত্র নিয়ে যা হয়েছে, মূল্যায়ন নিয়ে এর চেয়েও বেশি তালগোল অবস্থা তৈরি হবে। যে শিক্ষাক্রম হয়েছে, তা আমাদের শিক্ষকদের সক্ষমতার বাইরে। এই শিক্ষাক্রম অনুসরণ করার মতো শিক্ষক আমাদের নেই। বই যারা লিখেছেন তারাও নিরপেক্ষ থাকেননি।’ আগামী দিনের জন্য পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম আরও সময় নিয়ে ধাপে ধাপে করা উচিত ছিল। আগে যথাযথভাবে বইপত্র তৈরি করতে হবে, শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে; তারপর শিক্ষকদের তৈরি করতে হবে। চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষক তৈরি করা সম্ভব নয়। আগামী বছরের জন্য এখন থেকেই এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রম চালু করে স্বস্তিতে নেই শিক্ষা প্রশাসন। গত মাসে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধানী পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী পাঠ ও ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান এই তিনটি বই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনো সংশোধনের কাজ শেষ হয়নি। তিন মাস হতে চলছে বই তিনটি ঠিকমতো পড়াতে পারছেন না শিক্ষকরা। নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যান্য বইতেও অসংখ্য ভুল আর অসংগতি ধরা পড়ছে। অথচ দুটি বই প্রত্যাহার করেই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনটি বইয়ের সংশোধন বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত তা করা যায়। যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে ওই দুটির আরেকটি করে অংশ রয়েছে, যা পড়লে শিক্ষার্থীরা পুরো পাঠই পাবে। আগামী বছরের বইগুলোর ব্যাপারে আমরা আরও সচেতন থাকব। এ বছরের বইগুলোর যথাযথ পরিমার্জন করা হবে আগামী বছর।’
আগে পাঠ্যবইয়ের কোনো কিছু না বুঝলে সহায়ক বইয়ের সাহায্য নিতেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সহায়ক বই প্রকাশ করেনি। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তারা প্রতিদিন লাইব্রেরিতে সহায়ক বইয়ের জন্য ধরনা দিচ্ছেন।
এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয় প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল। দুপুরে ফল প্রকাশ হলেও বিকেলেই তা স্থগিত করা হয়। পরদিন ১ মার্চ রাতে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়। দেখা যায়, প্রথমবার প্রকাশিত ফলে যারা বৃত্তি পেয়েছিল, সংশোধিত ফলে তাদের অনেকের নাম নেই। অথচ বৃত্তি পেয়ে আনন্দ-উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ করে ফেলেছিল তারা। তাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা জেনে গিয়েছিল বৃত্তি পাওয়ার খবর। কিন্তু সংশোধিত ফলে যখন ওই শিক্ষার্থীর নাম এলো না তখন তাদের মন ভেঙে যায়।
১৪ বছর ধরে চালু থাকা সৃজনশীল পদ্ধতি শুরুতে বুঝতে হিমশিম খেয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এখন আবার নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ায় আবারও হিমশিম খাওয়ার দশায় পড়েছে তারা। অনেকেই তাল মেলাতে পারছে না। পরীক্ষা ও নম্বর বণ্টনের বিষয়টি তারা বুঝে উঠতে পারছে না। পরীক্ষার ওপর চাপ কমানোর ফলে স্কুলেও পড়ালেখার চাপ কমেছে। কোনো রকমে ক্লাস পার করেই দায় সারছেন অনেক শিক্ষক। আর অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমবিষয়ক মাত্র পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকরা কতটা আত্মস্থ হতে পেরেছেন তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। বাস্তবভিত্তিক ও শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নিয়েও জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোঝানো একজন শিক্ষকের পক্ষে কষ্টকর। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, বিজ্ঞানাগার ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ নেই বেশির ভাগ স্কুলে। এটা বড় সমস্যা। এই শিক্ষকরাই যেহেতু সরাসরি শিখনকালীন মূল্যায়ন করবেন, তারা কতটুকু নির্মোহভাবে তা করতে পারবেন সে ব্যাপারে অভিভাবকরা সন্দিহান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হবে। কারণ ধনী পরিবারের সন্তানরা এরই মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশিক্ষণ পাওয়া একাধিক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করেছেন। এগিয়ে যাচ্ছে তারা। আর প্রাইভেট পড়তে না পেরে পিছিয়ে পড়ছে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা। আবার শহরের স্কুলের চেয়ে গ্রামের স্কুলগুলো আগে থেকেই পিছিয়ে আছে। কারণ শহরের স্কুলগুলোতে বেশি বেতন ও প্রাইভেটে বেশি শিক্ষার্থী পাওয়ায় অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা সেখানে শিক্ষকতা করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়বে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব শিক্ষক সমান যোগ্যতাসম্পন্ন নন। ফলে তারা এখনো সেভাবে নতুন শিক্ষাক্রমে অভ্যস্ত হতে পারেননি। একদল শিক্ষার্থী মনে করছে, তাদের পরীক্ষা নেই। তারা রিলাক্স মুডে রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সহায়ক সামগ্রী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর এখনো প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি। তারা কীভাবে বিষয়টির তদারকি করবেন, সেটা বড় সমস্যা।’